ঘটনাটা কিছুদিন আগের।
জায়গাটার নাম সাগর। নাঃ, গঙ্গা সাগর নয়, আর কোন সমুদ্রের নাম গন্ধ ও নেই সে’খানে ধারে কাছে।
‘জায়গাটো তো বড় সুবিধের নয়, স্যার’…বলেছিল কাপানি।
‘প্রাণ থাকতে আর আমি আসছি না এ’খানে। মাথায় থাক আমার রোজ দু’হাজার টাকার অনারারিয়াম। দু’লাখ দিলে ও আসব না আমি’।
তা সেই সাগর হচ্ছে নেহাৎই একটা ছোট শহর মধ্য প্রদেশের। সাগর দমোহ প্লেটো অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। রাজধানী ভোপাল থেকে আসতে হ’লে বিনা হয়ে আসতে হয়। । আর নইলে সেই খাজুরাহোর এয়ারপোর্ট ভরসা। আমি এসেছি ভোপাল হয়ে।
তবে সে’খানের চিরঞ্জির বরফী বেশ বিখ্যাত জিনিষ। আমি একটা কলেজের ইন্সপেক্শনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে তা জানতে পারি। চিরাচরিত মিষ্টান্নের আপ্যায়ন এড়াতে গিয়ে আমি ধাঁ করে বলে ফেলেছিলাম-‘আরেঃ, এ’সব তো আমি রোজই খাই। আপনাদের এ’খানের নতুন কিছু নেই? তেমন কিছু থাকলে দিন…’
‘তা আছে স্যার। বিকানীরের ভুজিয়া…’
‘মারো গোলি…ও আমি ঢের খেয়েছি…...’
‘তবে চিরঞ্জির বরফী আনাতে পারি…তা সে তো সব দোকানে ভালো তৈরী করতে পারে না, স্যার। শুধু রামপ্যারে হালুইকর খাঁটি দেশী ঘি দিয়ে বানায়….তবে…….
‘আবার তবেটা কি?’
‘কি…কিছু নয়, স্যার। এই….কথা হচ্ছে কি ওর দোকানে হেভী বিক্রী যদি ও দাম বেশী। কি বলবো স্যার? আগে থেকে অর্ডার না দিলে আর……….থাক গিয়ে……স্যার, আমি আনাচ্ছি। এক কিলো সঙ্গে দিয়ে ও দেব আপনার জন্য। রাস্তায় যেতে কাজে লাগবে…’
‘আরেঃ…না না…অতো লাগবে না। নতুন জিনিষ বলে একটু চেখে দেখা আর কি…’।
তা তাঁরা শুনলে তো। এসে গেল নতুন মিষ্টি। খেয়ে বেশ ভালো ও লাগলো আমার তবে এক কিলোর এক প্যাকেট ঘাড়ে গছিয়ে ছাড়লেন তাঁরা। তবে আমার মনে হ’লো যেন তাঁরা কিছু একটা কথা আমার কাছে গোপন করছেন।
কি কথা তা বুঝতে পারলুম না আমি তবে ভাবলুম যে ট্রেনে বা মোটরে ভোপাল বা খাজুরাহো কোথাও তো আগে যেতেই হবে আমাকে ফেরবার পথে, তারপরে না হয় সে’খান থেকে দিল্লী হয়ে বেনারসের ফ্লাইটে উঠলে সময় বেশী লাগবে না। আর এই শীতকালে মিষ্টি তো খারাপ হয়ে যাবার ও তেমন ভয় নেই। তাই আমার অপরূপ সুন্দর ভাইপো চঞ্চলের জন্য নিয়েই নিলাম প্যাকেটটা আর দাম যে তাঁরা নেবেন না আমার কাছে, তা তো বলাই বাহুল্য। ইন্সপেক্টার বলে কথা.।
আমার সঙ্গে এন০সি০টি০ইর সৌজন্যে একটা ভালো গাড়ী ছিলো। কাজ সেরে সন্ধ্যাবেলায় সোজা হোটেল দীপালী রেসিডেন্সিতে ফিরতে বললুম চালককে। সরকারী কাজে আসতে হয়েছে আমাকে, তাই চঞ্চলকে সঙ্গে আনতে পারিনি আমি। একলাই বেনারসের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ইন্টারন্যাশন্যাল এয়ারপোর্টে গিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে উঠতে হয়েছিলো চঞ্চলকে বৌদির কাছে রেখে। সে’খান থেকে পরের ফ্লাইটে ভোপালের রাজা ভোজ এয়ারপোর্টে নেমে রাজ্যরাণী এক্সপ্রেসে সাগর পৌঁছেছিলাম। গাড়িটা নাকি দমোহ অবধি যায়। তা সে যাক যেখানে খুশী গড়গড় করে। আমার আপত্তি নেই…।
সঙ্গে একজন জুনিয়র অ্যাসেসর মানে ভিজিটিং টীম মেম্বার ও ছিলেন। তা তিনিও পেলেন এক প্যাকেট সেই নতুন ধরনের মিষ্টি। তবে তিনি আমার মতন সাবধানী মানুষ নন মোটেই। প্যাকেটটাকে দেখে নিয়ে আমার মতন নিজের হ্যান্ড ব্যাগে না ঢুকিয়ে পেছনের সীটেই অবহেলাভরে ফেলে রেখেছিলেন তিনি।
গাড়ী চলছে। সূর্য ডুবছে বিশাল প্রান্তরে। হঠাৎ গাড়িটা কেমন গোঁ গোঁ করে উঠেই থেমে গেল।
‘কি হয়েছে, ও চালক, ভাই?’
‘স্যার। ঠিক বুঝছি না। আমি নেমে একটু দেখে নিই। এমনটি তো ঠিক হ’বার কথা নয়, দিব্যি ভালো গাড়ী, স্যার..’
ভালো যে কতো, সে আর না বললে ও চলতো। তা দেখি যে চালক নেমে গিয়ে গাড়ির বনেট খুলে মাথা ঢুকিয়ে দিলো।
আমার সঙ্গী ভদ্রলোক এক ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক। ইন্সপেক্শন নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাবার লোক নন বলে সব কাজই আমাকে করতে হয়েছে। অধিকন্তু দিবানিদ্রার অভ্যাস যে কোন অধ্যাপকের এমনধারা থাকতে পারে তা ও আমার জানা ছিল না….বসে বসেই কাজ সেরে নিতে পারেন। .তবে তিনি একটু ছটফটে স্বভাবের লোক মানে এক্সট্রোভার্ট ধরণের আর কি।
খানিক পরে তাই তিনি ও নেমে পড়লেন। আমি বসেই আছি। অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে আসছে ক্রমেই। হিটিং সিস্টেমটা ও বন্ধ বলে ঠান্ডা বাড়ছে গাড়ির ভেতরে। বাইরে বরফের মতন ঠান্ডা হাওয়া চলছে । তা আমার সঙ্গী অধ্যাপক দেখি ডোন্ট কেয়ার। মনে হয় বোতল দেবীর মহিমা….সে যাক….দূরে কোথা ও মনে হ’লো যেন কা কা করে কাক ডাকছে। এই সন্ধ্যার অন্ধকারে? কি কান্ড…….
খানিক পরে অতিষ্ট হয়ে আমি ও নামলুম তবে নিজের হ্যান্ডব্যাগ হাতে নিয়েই। কেননা ও’তেই সব ডকুমেন্ট রেখেছি যে। কাছ ছাড়া করা ঠিক নয়….
‘কি ব্যাপার? ও ভাই……’
‘এই তো….হয়ে গেছে, স্যার। তেলের পাম্পটা একটু যেন….ও কিছু না, স্যার। আপনি আবার নামলেন কেন স্যার, এই ঠান্ডায়? তা….স্যার হিটিং সিস্টেম তো বন্ধ হয়েই আছে……সে আর কি করা যাবে, স্যার? আপনি কিন্তু যেন কমপ্লেন করবেন না, স্যার। গাড়ী আগে কেন চেক করিনি আমি এই বলে মালিক ছুটি করে দেবে আমার, স্যার। গরীব মানুষ। বোঝেনই তো সব, স্যার। এ’দিকে মালিক গাড়ী না সারিয়ে দিলে আমি কি করি, স্যার? আসুন…স্যার…..উঠুন….’
গাড়ির দরজা খুলে ধরলো সে।
আমি কারে উঠতে যাচ্ছি….হঠাৎ মনে হ’লো কে যেন আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো।
কই? কেউ নেই তো কোথাও…………তবে কি আমার মনের ভূল?
বাতাসের ঝটকা হবে ভেবে আমি উঠে বসলুম। গাড়ির ভেতরটা খুব মিষ্টি গন্ধে যেন
ম ম করছে তখন মনে হ’লো আমার।
আমার সঙ্গী দূরে রাস্তার ধারে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেন মনে হ’লো।
আর কেউ তো কোথা ও নেই। কি ব্যাপার রে বাবা?
দূরে আবার সেই কা কা রব শোনা গেল।
সঙ্গী আসতেই গাড়ী ও ছেড়ে দিলো।
হোটেলে পৌঁছেই আমার সঙ্গী ফার্স্ট ফ্লোরে নিজের ২০৭ নম্বর রুমে চলে গেলেন। আর আমি ১০৩ নম্বরে নিজের ঘরে ঢুকে চাবী সকেটে রাখতেই ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। রুম হীটার চালু হয়ে গেল। ঘরে রুম ফ্রেসনারের মিষ্টি গন্ধ ভাসছে। নিশ্চয়ই খানিক আগে রুম ক্লিনিং করেছে….
আমি হ্যান্ড ব্যাগটার জীপ খুলে ডকুমেন্ট ফাইলটাকে আগে বার করে পরীক্ষা করে নিয়ে কাবার্ডে রাখলুম। তারপরে সেই মিষ্টির প্যাকেটটা ও বার করে খুলে ভেতরে সেলফোন বা বাটার পেপারে মোড়া মিষ্টির ভান্ডার পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে সব ঠিক আছে দেখে কাবার্ডে রেখে লাগেজ চেন দিয়ে সেটা লক করে রাখলুম।
সাড়ে সাতটা।
সাড়ে আটটায় বুফে ডিনার দিয়ে ইন্টার কমে ডাকবে। ততক্ষণ টি০ভি০ দেখা যাক বসে। কি আর করা? অন্ততপক্ষে খবরটাই শুনি।
তা খানিক পরেই কল বেল বাজলো।
‘কম ইন প্লীজ….’
‘স্যার…আ …আমি কাপানি…মানে….’
‘আসুন স্যার..’
‘আ…আসছি না হয় তবে আমার কেমন যেন ভয়…’
‘কি হয়েছে?’
‘আ…আমার মিষ্টির প্যাকেটটা……’
‘আপনি নিয়ে গেলেন তো সাথে। আমার কাছে নেই। শুধু আমারটাই আছে.’
‘না…মানে আপনি সেটা একটু খুলে দেখেছেন কি?’
‘হ্যাঁ….দেখেছি বই কি। সব ঠিক আছে….ডকুমেন্টস এবং মিষ্টি দুইই……….হাঃ হাঃ হাঃ………...’
‘প্লীজ হাসবেন না, স্যার। আমার মিষ্টিটার খানিকটা কে বা কিসে যেন কেটে বা ভেঙে খেয়ে নিয়েছে.’
‘তার মানে? প্যাকেট কি খোলা ছিল?’
‘নাঃ …আমি গাড়িতে উঠে দেখে নিয়ে যেমনটি রেখেছিলাম ঠিক তেমনটি আছে কিন্তু….’
‘তা হয় কি করে? আর তো কেউ ছিলো না যে………’
‘আপনি এসে দেখে যান একটু, প্লীজ….’
তাই দেখলুম গিয়ে। দেখে মনে হ’লো যে সত্যিই কেউ খানিকটা নিপুনভাবে কেটে বা ভেঙে নিয়েছে মিষ্টি………অবাক কান্ড। তিনি হয়তো আমাকেই সন্দেহ করছেন….. আমি তো কিছুই বুঝছি না তখন ও ব্যাপারটা…..বরফী রহস্য ভেদ করি কি করে তাই ভাবছি, তখনই পিঁ পিঁ করে ফোন বাজতে আমরা ডিনার উপলক্ষ্যে নীচে চলে এলুম। সে’খানে অন্য গ্রুপের ও অনেকেই ছিলেন। একজন মহিলা মেম্বার খুবই বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন দেখে আমি জিজ্ঞেস করে জানলুম যে তিনি ইন্সপেক্শান সেরে অনেক কিছু মার্কেটিং ও করে এসেছেন।
তা মহিলা যখন তখন সে তো তাঁরা করেই থাকেন…সেটা কোন কথাই নয়….তবে জিনিষ সব গাড়িতে তুলে ও দিয়েছে সেই কলেজের লোকেরা মিলে…কিন্তু হোটেলে এসে তিনি দেখেন যে খাঁটি দেশী ঘি দিয়ে তৈরী তিন কেজির কি একটা বিখ্যাত লোকাল মিষ্টির প্যাকেট এক্কেবারে নিপাত্তা…..তিনশো টাকা কেজি…হায় হায়….
‘ফোন করুন না আপনি সেই কলেজে, ম্যাডাম.’
তিনি তাঁর কালো চাকাপানা মুখখানা কাঁদো কাঁদো করে বললেন- ‘করেছি, তারা লিষ্ট মিলিয়ে সব জিনিষই তুলে দিয়েছে বলছে…’
‘কোথাও কি আপনারা থেমে ছিলেন পথে?’
‘নাঃ…শুধু একটা পেট্রোল পাম্পে একবার….তা ও শহরে ঢুকে…’
‘কেন ম্যাডাম? তেল নিতে? নামেন নি নিশ্চয়ই তখন তা হ’লে গাড়ী থেকে….’
‘নাঃ…নামতে তো হয়েছেই আমাদের…বাথরুমে যেতে…মহিলাদের যে লং কার জার্নি করে পথে যেতে কত কষ্ট হয় সে সব আপনারা ছাই কি বুঝবেন?’
‘শহরের মধ্যে যেতেই লং জার্নি….ওরে বাবা….তা সর্বক্ষণ মুখ চললে তা হতেই পারে। হয় পান ভোজন আর নয় তো বাক্যবর্ষণ….’
‘বুঝে আর আমার কাজ ও নেই…’
রাগ করে এই বলে চলে এসেই মনে হ’লো যে …হুঁ …কষ্ট তো হবেই। কাল তো আবার অন্যত্র গমন….তাও সাগরের মধ্যেই নয়। সেই…কাটনী….সুতরাং মিষ্টি ট্রেসিং অসম্ভব…..আর সে’খানে তো ওই সব মিষ্টি মেলেও না ছাই…..
তা আমি কি আর বলি? মনে মনে বললুম-‘আমি না হয় কাল আবার একটা যে লোকাল কলেজে যেতে হবে, সে’খানে আর এক কিলো ওই মিষ্টি না হয় ট্রেস আউট করবার চেষ্টা করবো ওনার বদলে আর সত্যি কথা বলা তো মহা পাপ নইলে বলেই ফেলতুম ঠিক যে ম্যাডামের এখনই যা একখানা বিষম গতর। আর তিন কিলো না হ’লে কিছুই কম হবে না মনে হয়….’
আমি ডিনার সেরে ঘরে এসে হীটার চালিয়ে তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে এসে শুয়ে পড়লুম রাত পোষাক পরে। সকালে উঠে আবার তৈরী হয়ে দৌড়তে হবে তো। তা একটু কি শান্তিতে ছাই ঘুমোবারই জো আছে।
হঠাৎ পিঁ………..পিঁ….. পিঁ….
কি হ’লো রে বাবা?
না ফোন কাঁদছে। তাও রাত দুটোয়…জ্বালাতন আর বলে কাকে?
‘হ্যালো…কে বলছেন? রিসেপশান?’
‘নাঃ…আ….আমি কা…কাপানি…’
‘কি হয়েছে?’
‘স্যার…আমার ঘরের দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে….’
‘কলিং বেল ছেড়ে টোকা? খুবই প্রাচীনপন্থী কেউ হবে মনে হয়। তা খুলেই দেখুন না আপনি দরজাটা যে তিনি কে?’
‘এতো রাতে দরজা খুলবো?’
‘তবে থাক…কাজ নেই…আপনি আবার ঝপ করে ঘুমিয়ে পড়ুন…’
‘নাঃ…সে কি করে হয়? আর আমি কি অতো ভয় পাই? দেখছি… তবে আপনি লাইনটা ধরে থাকুন একটু…’
তা ধরেই আছি…হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার জাগলো ক্ষীণকন্ঠে সেই ফোনে…দূরাগত শব্দ…নিশ্চয়ই কেউ ঘরে ঢুকে কাপানিকে ভয় টয় দেখিয়েছে…অগত্যা শাল জড়িয়ে ছোট ওপরে…অবশ্যই দরজা লক করে….আমি সাবধানী লোক…’
‘গিয়ে দেখি কাপানির ঘরের দরজা খোলা আর তিনি বাথরুমের সামনে প্যাসেজে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন……..
চোখে মুখে জল ছিটোতে খানিক পরে তিনি মোহাচ্ছন্নতা ছেড়ে উঠে বসে বললেন-‘স্যার, উড়ন্ত প্যাকেট…ওরে বাবা…ধরতে যেতেই কিসে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলুম সটান…এই হোটেলে নির্ঘাৎ ভূত টুত কিছু আছে…’
‘কিসের প্যাকেট? মিষ্টির? তা তুলে রাখেন নি কেন অ্যাটাচিতে? কই? দেখি তো সে প্যাকেট?’
‘টেবিলেই তো রেখেছিলাম আমি সন্ধ্যাবেলায় এসে..’
‘কই? নেই তো…তা আপনার কি মনে হয়? এটা কি বরফির বৈরিতা নয়?’
‘তার মানে?’
‘মানে বরফী শত্রুতা করছে আপনার সাথে। ঘর থেকে সরে পড়েছে আপনাকে কলা দেখিয়ে…’
‘যাঃ…সে আবার হয় নাকি?’
‘খুব হয়। হয় না কি করে? আর না হ’লে চোর এসেছিল আপনার ঘরে নির্ঘাৎ । আপনি রিপোর্ট করুন…যাঃ বাব্বা…এতো রাতে আবার কোথায় যেন কাক ডাকছে মনে হয়। ’
‘কি রিপোর্ট করবো? মিষ্টি চোর এসেছিল বলে? লোকে তো হাসবে, স্যার…কিন্তু আমার এক কিলো মিষ্টি…হায়…হায়….’
‘তবে কাজ নেই আর রিপোর্ট করে। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি যাই…’ বলে ফিরে আসছি, হঠাৎ আমার খেয়াল হ’লো যে ঘরটা মিষ্টি গন্ধে ম ম করছে যেন। কোথায় যেন এই গন্ধ আমি পেয়েছি আজই? হুঁ …মনে পড়েছে….সেই মোটরকারেতে ঢুকে…..সন্ধ্যাবেলায়….
মনে মনে ঠিক করলুম –‘এই বজ্জাতি যে কার তা তো জানি না তবে আমার কাছে এর উপযুক্ত ওষুধ আছে…দেখি …আবার যদি আসে তবে আমি ও ছাড়ছি না তাকে সে যেই হোক। আমি কেমিষ্ট্রি নিয়ে পড়েছি কি এমনি এমনিই? হুঁ………….
তা সে’দিন যে কলেজে গেলুম সে’খানে বলতে ও হ’লো না। সেই মিষ্টি তারা আগেই স্পেশাল অর্ডার দিয়ে আনিয়েই রেখেছিলো। নইলে সময় মতন নাকি পাওয়াই যায় না। তাই এক প্লেট সাজিয়ে এনে আমাদের খেতে তো দিলোই উল্টে দু’কিলো করে গছিয়ে ও দিলো নিয়ে যাবার জন্য।
কাজ সেরে ফিরে আসবার সময় গাড়িতে উঠে একটু পরেই কাপানি বললো-‘স্যার, আপনি ….আপনি একটু আমার পাশে এসে বসুন তো পিছনের সীটেতে….’
‘কেন?’
‘আমি এখনই একটু ওই মিষ্টি খেয়ে নিতে চাই, স্যার। হয়তো হোটেল অবধি পৌঁছবেই না আর নয়তো কালকের মতন কেউ এসে নিয়ে যাবেই….যাবে’
গাড়ী থামিয়ে আমি সীট বদলে পিছনে গিয়ে বসলুম।
তখনই সন্ধ্যে বেশ ঘনিয়ে আসছে। তবে তখন ও গাড়ির হেডলাইট জ্বালে নি চালক। বাইরে কুয়াশা ঢাকা নীলচে অন্ধকার…। হঠাৎ দূরে কোথাও কাক ডাকতে শুরু করলো …কা…কা…কা….
কাপানি প্যাকেটটা টেনে নিয়ে রবার ব্যান্ড খুলছে সবে। ওপরের কভারটা তুলতে দেখলুম যে ভিতরে দু’টো সেলফোনে মোড়া গাঢ় বাদামী রঙের বড় প্যাক রয়েছে। এ’খানে বলে রাখি যে আমার প্যাকেট আমি অন্য ডকুমেন্টগুলোর সাথে আমার হ্যান্ডব্যাগে পুরে লক করে দিয়েছি আগেই।
সেলফোন পেপার খুলে খানিকটা মিষ্টি ভেঙে নিয়ে কাপানি বললো-‘নিন স্যার’।
‘ওরে বাবা….আমি? না…নাঃ….আমি অনেকটা খেয়েছি আগেই। খুব ভারী মিষ্টি। ঘি চপচপে। আমার পেটে স্থানাভাব…আপনি খান…’
‘সে অবস্থা তো আমার ও, স্যার, তবে বিশ্বাস তো নেই তাই খাই একটু তবে ….’
এই বলে মিষ্টি মুখে ফেললো সে আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা প্রচন্ড লাফিয়ে উঠলো হঠাৎ…দমাস করে মাথা ঠুকে গেল আমাদের গাড়ির ছাদে। মিষ্টির প্যাকেট ছিটকে পড়লো কাপানির হাত থেকে….
‘ওরে বাপরে…এই কানা ড্রাইভার…তোমার এটা হচ্ছেটা কি? জান মারবে তুমি আজ আমাদের? স্পীড ব্রেকারের ওপর দিয়ে গাড়ী চালাচ্ছো আশী মাইল স্পীডে? অ্যাঁ…আজ তোমার ছুটি না করিয়েছি তো আমার নাম কাপানি নয়..’
ততক্ষনে গাড়ী থেমে গেছে আর চালক টর্চ নিয়ে নেমে গেছে।
আমি তাড়াতাড়ি নীচে ছিটকে পড়া প্যাকেটটা তুলছি। কাপানির ভ্রুক্ষেপ ও নেই। সে নিজের মাথায় হাত বোলাচ্ছে। মনে হয় জব্বর লেগেছে। আমার ও কম লাগেনি। তবে খালি যেন আমার মনে হচ্ছে যে স্পীড ব্রেকারটা অন্য রকমের ছিল। কেমন যেন নরম মতন….বেশ অদ্ভূত তো…
আমি অন্ধকারেই চট করে একটা সেলফোনে মোড়া প্যাক সরিয়ে ফেললুম নিজের হ্যান্ডব্যাগে চালান করে আর অন্যটা খুলে তার ওপরে কিছু রাসায়নিক পাউডার বেশ করে ছড়িয়ে দিলুম, পকেট থেকে একটা ছোট কাগজের পুরিয়া বার করে। এই বরফিকে মোটেই বিশ্বাস নেই।
চালক ফিরে এসে কাঁপা গলায় বললো-‘স্যার…..?’
‘কি হয়েছে?’
‘স্যার…আমি তো সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ী থামিয়ে ফেলেছি কিন্তু স্যার, পিছনে একশো মিটারের মধ্যে কোন স্পীড ব্রেকারই নেই, স্যার.’
‘কি বাজে বকছো? গাঁজা টেনে এসেছো না কি? এখন ও আমার মাথা টনটন করছে আর ….চলো আমি নিজে গিয়ে দেখবো তারপর আমি তোমার কমপ্লেন……..’
‘গাড়ির দরজা টেনে বন্ধ করলুম আমি ও নেমে এসে ।
আমি হাতে হ্যান্ডব্যাগ নিয়েই এগিয়ে গেলুম। পাশাপাশি দু’জনে। টর্চ নিয়ে চালক আগে এগিয়ে গেলো।
সত্যিই আশ্চর্য কান্ড। দু’শো মিটার গিয়ে ও স্পীড ব্রেকারের পাত্তা না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমাদের ফিরতে হ’লো। অন্ধকারে ঠান্ডায় কাঁহাতক আর অদৃশ্য স্পীড ব্রেকার খুঁজে বেড়ানো যায়?
গাড়ির কাছে এসে চালককে বললুম-‘অনেক হয়েছে। এখন চলো, ফেরা যাক…..’
‘স্যার?’
‘বলো…..’
‘আমরা হয়তো………….’
‘কি হয়তো?’
‘হয়তো সাগর ডিহ বাবার পাল্লায় পড়েছি…’
‘তিনি আবার কে?’
‘এ’খানকার ডিহ বাবা। খুবই জাগ্রত। ডিহ নাম দিয়ে আপনাদের পশ্চিম বাংলায় ও তো অনেক জায়গা আছে, স্যার। যেমন-সাঁওতালডিহ, ভোজুডিহ, শিববাবুডিহ…..’
‘তা আপনাদের সাথে কি চিরঞ্জীর বরফী ছিলো, স্যার?’
‘হ্যাঁ, তা ছিলো। বরই বৈরিভাব দেখি তার। আমাদের পাত্তাই দিতে চায় না। আর তাকে ঘরে রাখা ও মহাদায়। মানুষ শত্রুকেই সামলানো যায় না আর এ’খানে তো দেখি যে বরফিরা ও কিছু কম যায় না। তা কেন বলো তো?’
‘ওই মিষ্টি…. স্যার, … ডিহ বাবার খুব প্রিয়। ওনার ভোগ না চড়িয়ে কেউ কখনো ওই মিষ্টি খায় না এ’খানে ভূলে ও। উনি খুব রেগে যান তো, তাই…..’
‘নিকুচি করেছে তোমার ওই ডিহ বাবার….পচা একটা গাড়ী এনে জান মারবার ফন্দি করে এখন আবার সাফাই গাওয়া হচ্ছে। আগে পৌঁছাই হোটেলে, তারপরে তোমার মালিক আর তার গাড়ির গুষ্টির পিন্ডি যদি না আজ আমি চটকে দিয়েছি তো আমার নাম কাপানি নয়……..আঁ…..আঁ…..আঁ…..আঁ…..আঁ………..
হঠাৎ তার চিৎকার শুনে আমি তাকিয়ে দেখি সামনে এক অদ্ভূত দৃশ্য।
আমাদের গাড়ির পেছনের বন্ধ দরজা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে আর সেই দরজা দিয়ে নীলচে আলোয় গড়া দীর্ঘকায় এক বিশাল মূর্তি বেরিয়ে আসছে।
সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেহ। অন্তত আট নয় ফিট উঁচু তেমনি বিশাল শরীর। শালগাছের গুঁড়ির মতন হাত পা, ঘোর কালোমতন দেখতে। তবে তখন তা রেডিয়ামের মতন আলোকিত।
বিশাল কুৎসিৎ মুখ। উঁচু চোয়াল । ছোট ঢালু কপাল আর জ্বলন্ত দুই চোখে ক্রুর হিংস্র দৃষ্টি যেন আমাদের ভস্ম করে দিতে চাইছে….সে কী ভয়ংকর দৃশ্য……..
গাড়ির চালক তো তাই দেখেই …বাবাগো….. বলে এক বিকট চিৎকার দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো আর তার হাতের টর্চ ও গেলো ঝপ করে নিভে।
তখন কাপানি ও ঠক ঠক করে কাঁপছে।
মূর্তিটা বিকট মুখভঙ্গি করে আমার দিকে তেড়ে এলো।
হয়তো সে বুঝে ফেলেছে যে আমার কারসাজিতেই তার অদৃশ্য শরীর হয়েছে আলোকোজ্জ্বল আর দৃশ্যমান।
সঙ্গে ক্যামেরা নেই। নইলে সেই বিকট মূর্তির একটা ফটো ঠিক তুলে নিতুম আমি। অতি দুর্লভ জিনিষ। আর বন্দুক ও নেই। কিন্তু চোরকে এমনি এমনি ছেড়ে দিতে তো আর পারিনা।
তাই পকেট থেকে আর একটা পুরিয়া বার করলুম আমি। দেখি, এ যেই হোক না কেন, অশরীরী যখন নয়, তখন আমার ওষুধ হয়তো কাজ করতে ও পারে।
খুব কাছে এগিয়ে আসা সেই দানবের চোখে আমি লাফিয়ে উঠে ছুঁড়ে দিলুম সেই দ্বিতীয় পুরিয়ার সমস্ত পাউডারটুকু…….
বিকট এক রক্ত জল করা বিকট চিৎকার শুনে কাপানি ও মাটিতে গড়িয়ে পড়লো আর সেই রেডিয়োঅ্যাক্টিভ শরীরটা অন্য দিকে দৌড়ে অদূশ্য হয়ে গেলো…খানিক পরেই বিকৃত কাঁ…কাঁ….করে কাকের ডাক দূরে মিলিয়ে গেল ক্রমে।
সেই পলাতকের পিছনে ধাওয়া করে কে? আমার যে তখন অনেক কাজ।
প্রথমে টর্চটাকে খোঁজা।
তারপরে তাকে জ্বালাও।
তারপর দু দু’টো পড়ে থাকা মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়ে গাড়ির পিছনের সীটের নীচে ফেলে রেখে নিজেই চালকের আসনে বসে পড় দুর্গা বলে।
সোজা রাস্তা। দেখতে দেখতে আমার গাড়ী স্পীড নিয়ে নিলো। ভাগ্যে ড্রাইভিংটা শেখা ছিলো। আর আমার দ্বিতীয় পুরিয়ার পাউডারটা ও কাজ করলো। নইলে এতক্ষনে আমি নির্ঘাৎ পরপারে।
অবশ্য ওটা কোন জটিল কেমিক্যাল ছিলো না। ….নাঃ…. ধূলো ও নয়। ছিলো বেশ খানিকটা খাঁটি লাল লংকার গুঁড়ো।
সে কথা যাক। তবে কাক চরিত্র ঠিক বোঝা গেল না। কাক কি দু’রকমের হয়? দিনচরা আর রাতচরা? কে জানে বাবা?
তবে বুদ্ধি করে আজ চোরের হাত থেকে অন্তত এক কিলো মিষ্টি ও তো বাঁচিয়েছি আমি । ওইটুকু দিয়েই না হয় সান্ত্বনা দেব কাপানিকে। কি আর করা?
সে ঠিকই বলেছিল মনে হয়। জয়গাটাই যে সুবিধের নয়।
তা আমরা কি আর থাকি সে’খানে? কালই চলে যাব সাতনা।
সাগরে আর নয়, বাবা। হ্যাঁ না তো…..