প্রত্যয়েতর

প্রত্যয় (অক্টোবর ২০১৪)

জি সি ভট্টাচার্য
  • 0
‘আপনি নাকি একজন গোয়েন্দা?’

‘না, মানে ঠিক আক্ষরিক অর্থে আমি তা নই। শখের অনুসন্ধিৎসা একটু আছে মানে….’

‘ওই একই কথা । যার নাম পটেটো চিপস্ তাকেই বলে আলুভাজা। তা মশাইয়ের ফিস কতো?’

ওরে সর্বনাশ…এ বলে কী? ফী নয় ফিস? যেমন ছেলে মেয়েদের স্কুলে পরীক্ষার ফিস, ভর্তি ফিস এই সব লাগে না? এও দেখি তাই? …তার কথাটি শুনে বেশ দমে গিয়ে বললুম-- ‘সেটা নির্ভর করে….কেসের ওপরে। আপনার কেসটা কী? খুন না ডাকাতী না …?’

‘না না ওসব কিছু নয়। এ হচ্ছে স্রেফ চুরী…’

‘ও, তা কি চুরী গিয়েছে আপনার?’

‘আমার একমাত্র সুরজকে কেউ কাল রাতে চুরী করে নিয়ে গেছে। ও হো হো …এখন আমি কি করি?’

‘পুলিশে খবর দিয়েছেন? চুরির কেসে সেটাই তো প্রাথমিক কর্তব্য আপনার…’

‘নাঃ….পুলিশের গুঁতো বড় বিচ্ছিরী জিনিষ। ও আমি একটু ও খেতে বা হজম করতে পারবো না। আমি তাই সে ধারেই যাই নি। আপনার নাম শুনে ছুটে আপনার কাছে চলে এসেছি। প্রায়ই তো আপনার ফোটো দেখি পেপার মে। তা এখন আপনি আমার সুরজকে খুঁজে এনে দিন দেখি ঝট সে । আমি দশ বিশ পঞ্চাশ টাকা যা বলবেন তাই দিয়ে দেব আপনার ফিস….’।

অ্যাঁ…..সর্বনাশ….দশ …বিশ …পঞ্চাশ… ও রে খেয়েছে রে…।

তবু ও বলি—‘আগে আপনি থানায় গিয়ে একটা রিপোর্ট করে এফ আই আর করিয়ে আসুন। এটা ছেলে চুরির কেস যখন……..’

‘কে বললে আপনাকে যে এটা ছেলে চুরির কেস? রাজু ধোপা কি এখুনি বিয়ে করেছে না কি যে ছেলে হবে তার? যত্ত সব……’

তারপরেই মুখ নামিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে বললো—‘অবশ্য কথাবার্তা সব পাকা হয়েই গেছে….. এমনকি তিলক ও চড়ে গেছে। কিন্তু তাইতে কি ছেলে হয়, মশাই?’

ওরে বাবা। এ বলে কি?

বললুম—‘নাঃ ছেলে অতো সহজে হয় না। তা মানছি বই কি। তা’হলে এই সুরজটি আপনার কে হয় বলুন দেখি?’

‘কেন? তাকে আপনি চেনেন না? এক পাড়ায় থাকি আমরা যখন আর তায় আপনি হচ্ছেন একজন জবর্দস্ত নামজাদা গোয়েন্দা…..’

‘ঠিক চিনতে .মানে মনে করতে পারছি না.’।

‘তবেই করেছেন আপনি গোয়েন্দাগিরী। ছাড়ুন মশাই। .আরে ছোঃ….আমি তবে উঠি……..’

বোঝ ঠ্যালা। বেজায় রাগ হ’লে ও চুপ করেই থাকতে হ’লো আমাকে। কি আর বলি? অতিথি যখন…..

তা তিনি ওঠবার আগেই দেখি যে পাশের ঘরের দরজাটা একটুখানি ফাঁক হ’লো আর সে’খান দিয়ে অব্যর্থ লক্ষ্যে ছোট্ট সবুজ মতন কি একটা জিনিষ যেন বেগে ছুটে এসে ঠিক তাঁর পায়ের কাছে পড়লো… নিঃশব্দে……. রাগের মাথায় .তিনি তা খেয়াল ও করলেন না।

আমি বেশ বুঝলুম যে আমার ছোট্ট ছেলেটা আছে আশে পাশেই। আর সে সবই শুনেছে এবং রেগেছে ও বেশ।
আমি ধৈর্য ধরে বললুম—‘তা সুরজের ডেসক্রিপসানটা অন্তত একটু না দিলে আমি তাকে খুঁজবো কেমন করে, বলুন তো?’

‘ওঃ হোঃ….কেন? ক্যাঁক করে গিয়ে চোরটাকে চেপে ধরলেই তো কাজ হয়ে যায়। খুঁজতে আর কি অসুবিধে তখন আপনার? তবে বলছি শুনুন---ছাই ছাই রং…লম্বা লম্বা কান…ভারী বুদ্ধিমান …কপালে গোল টিপের মতন দাগ …হাজারে একটা ও হয় এমন? যেমন পরিশ্রমী আর তেমনি পাজী …..উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন ফিট আর লম্বা লেজ…..’

‘ও ও রে বাবা …কি সর্বনাশ। সাড়ে তিনের ওপরে.আবার লেজ ও আছে? তা সুরজ কে হয় আপনার?’

‘কেন? পুষ্যি.’

‘তা তো হবেই। নিজের ছেলে না থাকলে তো লোকে পুষ্যিই নেয়….আর অতি বাঁদর ছেলে হ’লে শুনেছি যে তার লেজ ও গজাতে দেরী হয় না বড় একটা ….’

‘এ্যাই….খবরদার বলছি……আমার গাধাকে বাঁদর বললে কিন্তু ভালো হবে না। এক ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে ছাড়বো। হতচ্ছাড়া বঙ্গলিয়া……….’।

হুঁ…এইবারে আসল কথা ও নিজমূর্তি বেরিয়েছে দেখছি। মনে মনে বললুম আমি।

কিন্তু আগন্তুক ওই বলেই রেগে মেগে লাফিয়ে উঠে প্রস্থানোদ্যত হ’লেন আর এক পা এগুতেই ধপাস ধাঁই……….

‘আইরে বপ্পা রে….মর গইলি রে…’.

‘কি হ’লো ? কি হ’লো? …’

আর হবে কি? সকাল বেলার সেই অদ্ভূত অবাঙালী আগন্তুক দেখি তখন নিজের বড়ো সড়ো ভূঁড়িটি সমেত পপাত ধরণীতলে হয়েছে….

খানিক পরে কোঁকাতে কোঁকাতে উঠে বসে বললো—‘হ্যাঃ, ক্যা আজব চিজ হ্যায় এই বঙ্গলিয়া জাসুসঠো রে বাপ? সঙ্গমরমর দিয়ে কেউ ফর্শ বানায় কখনো? ছ্যাঃ …হায় রে …পুরী দুনিয়া ঘুম রহী হ্যায় অভি তক মেরে আঁখো কে সামনে….’

পাশের দরজাটা খুলে ছোট্ট ছেলে গৌরব একটা গ্লাশ হাতে নিয়ে এইবার বেরিয়ে এসে নিজের সুরেলা কন্ঠস্বরে বললো-‘আংকল, থোড়া পানী পি লিজিয়ে। অভি সব ঠিক হো জায়েগা অউর আপকো সুরজ ভি মিল জায়েগা.’

জলের গ্লাশ হাতে নিয়ে তিনি বললেন-‘ও কৈসে, বেটা?’

‘কেঁও আংকল? পুরী দুনিয়া তো ঘুম হি রহী হ্যায় আপকে সামনে। আপ ব্যস সবকা ঘর ধ্যান সে দেখতে চলে যাইয়ে বৈঠ কর, কঁহি পর তো হোগা হি সুরজ..’

কি যে দুষ্টু হয়েছে ছেলেটা তার আর ঠিক নেই। আমি হাসি চাপতে মুখটা ঘুরিয়ে নিলুম নইলে রাগ বাড়তে পারে তার।

কিন্তু সে বললো-- ‘বেটা, ই ভি বাত তুম্হারী ঠিক হি হ্যায়…………ফির ইস বঙ্গলিয়া জাসুস কো ফালতু মে পয়সা কেঁও দুঁ ….হাঃ…তুম বড়ে অকলমন্দ হো বেটা। ম্যয় হি খোজতা হুঁ সুরজ কো অভি …..’

তিনি তখনি উঠে বিদায় হয়ে গেলেন।

আমি হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলুম। আর গৌরব ছেলেটা হি….হি.. করে হাসতে লাগলো সমানে।

খানিক পরে আমার চকচকে ঝকঝকে রূপবান ছেলে গৌরবকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে আমি বললুম—‘তা ওটা কি ছিল, বাপু?’

যারা আমার আগের লেখা পড়েছেন তাদের কাছে আর গৌরবের পরিচয় নতুন করে দিতে হবে না নিশ্চয়ই আর যারা পড়েননি, তারা নিজেই জানতে পারবেন এই লেখাটা পড়া হলেই।

‘সাত বছরের সুন্দর ছেলে গৌরব চোখ দু’টো আর ও বড় বড় করে বলল-‘কই? কি বাপী? ওঃ …ওইটা ….ওটা তো.. ও হচ্ছে জলপাইয়ের আচার। আমার এক হিন্দুস্তানী ক্লাশ মেট আজ দিয়েছিলো। তা আমার মতন বঙ্গলিয়ার ছেলের কি ওই সব খাদ্য খাওয়া পোষায়, বাপী? তাই.ওদেরই এক জাতভাইকে ফেরৎ দিয়ে দিলুম আর কি…. হিঃ…….হিঃ………..হিঃ….’

বুঝলুম বার বার বঙ্গলিয়া শুনে ঝাঁ চকচকে ছোট্ট স্মার্ট ছেলেটা বেশ রেগেছে।

তাকে ঠান্ডা করতে আমি বললুম-‘তা গৌরব, এই গাধা চুরির কেস তো কোনমতে নামলো ঘাড় থেকে। অতঃ কিম্?’

‘চলো না বাপী আমরা গিয়ে আজ একটুখানি রেলগাড়ী দেখে আসি..’

এই আবার এক নতুন রোগ হয়েছে আজকাল আমার ছেলের। রেলগাড়ী দেখার শখ।। কোন মানে হয়?

জানতে চাইলুম--‘কোথায় যাবো?’

‘কেন? রেল স্টেশনে।’

‘ও রে বাবা। সে তো বেনারস ক্যান্টে…..অনেক দূর যে ।’

ছেলে চুপ।

কি আর করি তখন? আগে নিজে তাড়াতাড়ি গিয়ে তৈরী হয়ে নিলুম।

তারপরে আমার অত্যন্ত সুন্দর আর ফর্সা ছেলে গৌরবকে হাত ধরে নিয়ে প্রসাধন ঘরে গিয়ে তার ঘরের পোষাকগুলো খুলে ফেলে বেশ করে খানিক ক্রীম টিম আর পাউডার মাখিয়ে, হাল্কা করে কাজল পরিয়ে, চুল আঁচড়ে দিলুম। সব শেষে গৌরবকে একটা দামী ফুল শার্ট ও প্যান্ট, মোজা, জুতো সব পরিয়ে তৈরী করে দিলুম। বাইরে তখনই কটকটে রোদ্দূর আর বেশ গরম কিন্তু কি করবো? আমার অভ্যাস। সেই আরো ছোটবেলা থেকেই আমি ছেলেটাকে বেশ করে না সাজিয়ে কোথাও নিয়ে বেরোই না। অবশ্য গৌরব যা দারুণ সুন্দর ছেলে না একটা…ওকে এতো করে না সাজালে ও দিব্যি চলে যায়। কিন্তু আমার অভ্যাসটি যায় কোথায়?

এইবার বলো জয় মা দুর্গা।

কাল থেকে তো শারদীয় নবরাত্রি শুরু হবে। আজ মহালয়া। হিন্দুস্তানিদের পিতৃ বিসর্জন। তাই আমার অফিসে ও ছুটি ছিলো। ভাবলুম- আর চুপ করে ঘরেই বসে থাকা ও তো দেখি কোন মতেই নিরাপদ কাজ নয়। বিশেষ করে কখন কে যে এসে পড়ে আমাকে গাধা গরু সব খুঁজতে লাগিয়ে দেবে আচমকা, তার ঠিক কি? ডিটেক্টিভগিরির কাঁথায় আগুন। অতএব যঃ পলায়তি……নীতিই ভালো আমার পক্ষে……….।

একটা অটো ধরে চলে গেলুম সোজা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে।

তারপরে নিলুম দু’টো প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে।

কিন্তু স্টেশনে ঢুকে দেখি ও মা…কোথার রেলগাড়ী? এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম ভোঁ ভাঁ। একটা মালগাড়ী ও নেই। এখন আমাদের ওভার ব্রিজে উঠতেই হবে।

গৌরব ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান আর চকচকে, চটপটে আর চালাক চতুর ও বটে। যদি ও অতিথির সাথে অমন ব্যবহার করা উচিৎ নয় কখনোই কিন্তু ওরা যেন বাঙালিদের অশ্রদ্ধা ও অপমান করতেই জন্মেছে। দেখলে শুনলে কার না রাগ হয়? শুনি।

তবে ছেলেটা মাঝে মাঝে অনেক অদ্ভূত শখের কথা বলতো এই যেমন রেলগাড়ী দেখবার শখ। কোথা ও যাবার নেই তো কি হয়েছে রেলগাড়ী দেখতে বাধা কোথায়?

শৈশবেই ছেলেটা মাতৃহীন হয়ে আমাকে বেশ ঝামেলায় ফেলেছিল, সে সব কথা তো আমি আগেই বলেছি। কিন্তু ছেলেটাকে মানুষ করার দায়িত্ব ও শেষে নিজেই নিয়েছিলাম যদি ও অফিস আর ছেলে, তাও এতো ছোট একটা বাচ্ছাকে সামলানো মোটেই সহজ কাজ নয় একলা আমার মতন একজনের যুবকের পক্ষে।

গৌরব যখন জন্মায় তখন আমি সবে চাকরিতে ঢুকেছি এম০বি০এ০ করে। বছর তেইশ চব্বিশ বয়স হবে তখন আমার।

ছেলের দরকারে কাজের লোক ও একজন রেখেছিলাম দিনভোরের জন্য।

তা দেখি যে সে মাসে দশদিন কাজে আসেই না। মহা ঝামেলা হয় তখন । আর যখন সে আসে তখন ও ছেলেটাকে ঠিক মতন নাওয়ানো খাওয়ানোতে ও বেশ ফাঁকি দেয়। এমন কি ভালো দুধ, ছানা বা মিষ্টি যা ফ্রিজে এনে রাখা থাকে সে সব ও ছেলেটাকে খাওয়াবার বদলে নিজেই খেয়ে বসে থাকে। তখন সেই এক বছরের ছেলে তো আর কিছু বলে দিতে পারবে না তার বাপীকে। তাই বেশ নিশ্চিন্ত ছিল সে।

তবে গৌরব সব্বার সব ব্যাপারে মানে অনুচিত কাজেই যে বাদ সাধে সে আমি ঠিক দেখেছি।

সময়ের আগে খুব অল্প দিনেই প্রথমে ছেলেটা ইসারায় কথা বলতে শুরু করে দেয়। গৌরবের সে ভাষা এক আমিই বুঝতাম।

আর তারপরেই তো সে কথা বলতে ও শিখে নিয়ে সব মাটি করে দিলো। আমাকে সব বলে দিতে লাগলো ছেলে আর আমি ও তাকে কাজ থেকে জবাব দিয়ে নিজের ছেলে নিজেই দেখব ঠিক করে একটা প্রি স্কুল ডে চাইল্ড কেয়ার হোমের সাথে কথা বলে নিলুম।

গৌরবের মামা অবশ্য এসে ভার নিতে চেয়েছিলেন, আমি আর রাজি হই নি। কে জানে বাবা? সে’খানে ও হয়তো একই অবস্থা হবে আর গৌরবকে না খেয়েই থাকতে হবে, এই ভয়ে। কিছু বলতে ও তো পারবো না। তবে মামার অধিকারের প্রতিবাদ করেছিলো সদ্য কথা শেখা ছেলেটা, সেটা বেশ মনে আছে আমার।

গৌরবের মামা বলেছিলেন—‘ছেলেটা আমাকে দাও তুমি। একলা ঘরে কি ছেলে মানুষ হয় না কি আবার?’

শোনামাত্র গৌরব বলেছিলো-‘কেন মামা? ছেলেরা বুঝি মানুষ হয়ে জন্মায়ই না যে তাদের পরে মানুষ করে দিতে হয়?’

মামা তো রেগে গিয়ে ধামা বাজিয়ে দে পিঠটান সেই কথা শুনেই।

ফলে ছেলের সব দায় দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়েছিলো। তাকে নাওয়ানো, খাওয়ানো, সাজানো, বেড়ানো, তার জামা কাপড় কাচা, ঘুম পাড়ানো, তার সাথে বসে খেলা করা, তাকে পড়ানো….এমন কি দরকারে ওষুধ পথ্য দেওয়া, সব।….সব। কাজ কি একটা? এখন তো সেই এক ফোঁটা কচি ছেলে গৌরব বেশ একটু দেখি বড় ও হয়েছে

পুরো ওভার ব্রিজের শেষে নয় নম্বরে গিয়ে দেখি যে একটা মাত্র নীল রঙের গাড়ী আছে দাঁড়িয়ে। অনেকে উঠছে নামছে ও। সামনে সব স্লিপার ক্লাশ। তেরো খানা। এস ১, এস ২ করে এস ১৩ অবধি। শুরুতেই খান দুই জেনারেল কোচ আর মধ্যে খান তিনেক এ সী কোচ ছিলো। প্যান্ট্রি কার নিয়ে ১৯ খানা কোচ।

একদৌড়ে গৌরব সব গুনে দেখে টেখে এসে আবদার ধরলো—‘ও বাপী, চলো না। আমরা একটা গাড়িতে একটু উঠি গিয়ে। কতো লোক তো উঠছে …নামছে….গাড়ী সিটি দেবে ঘোষণার পরে, গার্ডের সবুজ ঝান্ডা নাড়া হবে তবে না ট্রেন ছাড়বে? তার আগে আমরা নেমেই পড়বো টুপ করে’।

এখন আমি তো নিয়েছি প্ল্যাটফর্ম টিকিট। বিনা জার্নি টিকিটে ট্রেনে ওঠা তো বেআইনি কাজ। তবু ও গৌরবের মতন ছেলেকে বোঝায় কে? আর বেনারস তো হচ্ছে বেআইনী কাজের জন্যই বিখ্যাত। নইলে ডিটেক্টিভকে দিয়ে গাধা চুরির কেস সামলাতে বলে। অবশ্যই বাঙালী ডিটেক্টিভ হ’লে তবেই। বাঙালিকে ওরা কাঙালী ছাড়া আর কিছু
মনেই করে না।

আমার মনে রাগ তো ছিলই একটু। ছেলের কথায় এস- ৩ য়ে উঠে পড়লুম। গৌরব লাফিয়ে গিয়ে টি টির সীটে বসে পড়লো। আর তখনি বলা নেই কওয়া নেই সিটি নেই ঘোষণা নেই, ট্রেন দিলো ছেড়ে।

‘ও গৌরব, শিগ্গীর নেমে এসো। ট্রেন তো হঠাৎ ছেড়েই দিয়েছে দেখছি। সর্বনাশ….’

‘কি মজা….কি মজা…কুউউউ….ঝিকঝিক….ট্রেন চলছে ট্রেন চলছে….’
হাত তালি দিয়ে গৌরব তো আল্হাদে আটখানা হচ্ছে তখন। আমার তো মাথায় হাত এক্কেবারে। কি করি?

এই ছাতুখোরের দেশের না নিকুচি করেছে ছাতা। কোন নিয়মেরই তো দেখি ধারই ধারে না এই লিট্টিখেকোগুলো। ট্রেন ছাড়তেই এই দারুণ স্পীড। এ তো সাংঘাতিক বেআইনী কাজ। কতো লোক যারা সী অফ করতে এসেছে, ট্রেন থেকে তো নামতেই আর পারবে না আর নয়তো লাফিয়ে নামতে গিয়ে রেল লাইনের ওপরে পড়ে হাত পা ভাঙবে বা ট্রেনের চাকার নীচে চলে যাবে।

আমি গৌরবকে নিয়ে নামবার কোন চেষ্টাই না করে একজন যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলুম—‘ভাইসা’ব, এই ট্রেন রুকেগী কাঁহা অব?’
ঘাসের গোছার মতন কচর কচর করে একমুখ পান আর সুপুরী জর্দা চিবোতে চিবোতে তিনি মুখটিকে ঠিক ঘোড়ার মতন উঁচু করে তুলে ঠোঁট বেঁকিয়ে অদ্ভূত অস্পষ্টস্বরে বললেন—‘ই মহানগরী হও…সীধে চুণার ঠহরেগী ….দো মিনট.’

বুঝলুম…এ হচ্ছে সেই …. ‘খাইকে পান বনারস বালা….’ গানের জীবন্ত ছবি। মরুক গিয়ে পড়ে।

তবে এখন আমি পড়েছি গভীর গাঢ্ঢাতে….সোজা পঞ্চাশ কিলোমিটারের ধাক্কা। ইসসসসস্ ….এর চেয়ে তো গাধা খোঁজা ও ভালো ছিলো দেখছি। নাঃ …আজ দেখছি কপালটাই মন্দ আমার। একে অমাবস্যা তায় শনিবার …..একটা বাচ্ছা ছেলের কথায় বেরিয়েই মাটি করেছি আজ।

‘বাপী, এসো না…। বসো এইখানে এসে তুমি। অতো ভাবছো কেন? আমরা নিরুদ্দেশের যাত্রী এখন….হিঃ….হিঃ….হিঃ….’

‘নিরুদ্দেশের যাত্রিদের নিয়ে যাওয়া হয় জেলখানায়, তা জানো গৌরব?’
রাগ করে আমি বললুম।

তা সে ওইটুকু ছেলের দেখি ভয় পেতে বড় বয়েই গেছে।

গৌরব বললো-‘আচ্ছা বাপী, আমি বলে দিচ্ছি……কেউ তোমাকে জেলে পাঠাতে আসবেই না আর এখন । হবে তো? এইবার এসে বসো আমার পাশে তুমি একটু নিশ্চিন্ত হয়ে। তুমি না বাপী বড্ড ভীতু ছেলে একটা ….’।

‘কাকে বলবে, গৌরব? কেউ তো নেই ….টি টি ও নেই যে কথা বলবো। হয়তো খানিক পরেই দর্শন দেবে।’

‘মাআআআআআ’……….বলেই ছেলে মুখে হাত চাপা দিলো।

‘যাচ্চলে….’.বলে আমি হতাশ হয়ে গৌরবের পাশে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লুম।

কি আর করা? এগারোটা চল্লিশে ছেড়েছে ট্রেন…দশ মিনিট লেট করে। সময়ের পরেও দাঁড়িয়ে ছিলো আর ছেড়েই ছুটেছে সত্তর কিমি স্পীড নিয়ে। চল্লিশ মিনিটের পথ চুণার তবে স্পীড তো কমবেই একটু গিয়েই নানা কারণে আর তাই বারোটা পেরিয়ে গিয়ে ট্রেন থামবে চুণারে । তখনি নামতে হবে আমাদের ও।

রিজার্ভ কোচ তাই তার আগে টি টি আসবেই টিকিট চেক করতে আর সে এলে চুণার অবধি ভাড়া তো দিতেই হবে আমাকে ফাইন সমেত। তাই সই। অন্য উপায় নাস্তি যে।

আমি বসেই আছি ব্যাজার মুখে।

ট্রেন ছুটছে।

পার হ’লো ছোট ছোট অনেক স্টেশন। তবে স্পীড একটু ও কমলো না ট্রেনের। ভীষণ দুলছে আর লাফাচ্ছে আমাদের কোচ। শব্দ ঝন্ঝনায় কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে আমার। দশ মিনিট কাটলো…………বিশ মিনিট…..ত্রিশ মিনিট…..তখন দেখলেম যে কেলহট বাজার না কি নাম লেখা একটা ছোট স্টেশন উল্কা বেগে পার হয়ে গেল।

গৌরব একমনে বাইরের দৃশ্য দেখছে চুপচাপ।

ঝম ঝম ঝমা ঝম….শব্দে একটা ছোট নদীর পোল পার হয়ে এলো ট্রেন নিমেষের মধ্যে। জারগো না কি নাম নদীর। তবে বোর্ডের লেখা পড়া ও কঠিন ট্রেন এই দারুণ স্পীডে চলবার ফলে।

সওয়া বারোটা….

ক্যাঁচচচচচ……

ব্রেক কষছে ড্রাইভার সশব্দে….চুণার…….. তাকিয়ে দেখি যে স্টেশন এসে গেছে।

‘ও গৌরব….এসো…..এইবার আমাদের তো নামতে হবে…।’

‘আসছি বাপী,…তবে……’

‘কি তবে আবার?’

‘দেখো না…যা ভীড়…..উঃ ..নামা হয়তো যাবেই না, বাপী’…
‘কি সর্বনাশ……তাইতো দেখছি গৌরব, আর এই দেহাতিগুলো এই কোচে এসে সব হুড়মুড়িয়ে উঠছেই বা কেন? ওদের কি রিজার্ভ টিকিট আছে?’

‘দরকার কি বাপী? ওরা ওই সব নিয়ম কানুন কিছু মানলে তো? ওরা যাচ্ছে আজ পিতৃ বিসর্জনে। তাই রেলের নিয়মকে ও বিসর্জন দিয়েছে। হিঃ…..হিঃ….হিঃ…..’

তবে আমরা কি করবো এখন, ও গৌরব?’

‘কি আর করবো, বাপী। চুপটি করে বসে থাকবো। ওই সিটি দিয়েছে ট্রেন। ইসসসস সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে ও দিয়েছে…ওই দেখো আরো যারা উঠছিলো, সব .হুড়মুড় করে পড়েই গেলো ….তিনজন মনে হয়। তুমি বসো…..আর কয়েক মিনিট, বাপী। বারোটা পঁয়তাল্লিশে আসবে মীর্জাপুর। আমি ওই আংকলের কাছে জেনে নিয়েছি। রাইট টাইম তো তাই। অবশ্য ট্রেন তো দশ মিনিট লেট চলছে। হয়তো তাই পঞ্চান্ন হবে’।

‘তা হবে না হয়তো। মনে হয় লেট মেক আপ হয়ে গেছে, গৌরব…’

‘তা হতেই পারে, বাপী। সবাই তো বলছে ও ….যে মহানগরী না কি লেট হয় না। আমরা বারোটা চুয়াল্লিশে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াবো। ট্রেন থামলেই নেমে পড়বো তবে এখানে হয়তো অতো ভীড় হবে না আর ট্রেন দাঁড়াবে ও চার পাঁচ মিনিট’।

‘কিন্তু টি টি?’

‘সে আর আসছে না, বাপী। আগে ওই দেহাতিদের কাছ থেকে আদায় করুক তো টিকিট আর ফাইনের টাকা এখন ঝগড়া করে…হিঃ….হিঃ…..হিঃ……….’

আধঘন্টা ও হয় নি, আবার জাগলো ব্রেকের কর্কশ ধ্বনি….দুরন্ত গতির মহানগরী এক্সপ্রেস ট্রেন থামছে…..মীর্জাপুর জংশন লেখাটা সাঁ করে পেছনে চলে গেল।
আমরা ও নেমে পড়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম ট্রেন থামতেই।

খানিক পরেই ট্রেন ও ছেড়ে চলে গেল প্ল্যাটফর্ম থেকে। লোকজন ও কমে এলো।

‘অতঃ কিম্, বলো তো আমার সুকুমার প্রিয় পুত্রবর?’

‘তুমিই বলো না, বাপী.’
‘আমার মুন্ডু ঘুরে গেছে। কিচ্ছু ঠিক করতেই পারছি না, গৌরব। প্রথমে ধোপার পাট খেয়ে আর পরে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের চোটে….ও রে বাপ রে….গেছি রে’

‘হিঃ….হিঃ…..হিঃ….তুমি না বাপী একটু মজা ও বোঝ না। একটুতেই না একদম…..যাঃ …আমাকেই দেখছি তোমাকে দেখে শুনে রাখতে হবে। হুঁ…..মা তো তাই বলেই দিয়েছে আমাকে। কি আর করবো? যার যেমন ভাগ্য…’.ছেলে হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখে দু’হাত উল্টে বললো।

‘তা এখন চলো বাপী আমরা ঠাকুর দেখতে যাই আগে….তারপরে কিছু খেয়ে নিয়ে ফেরবার ট্রেন ধরলেই হবে…।’

গৌরবের কথায় আশ্চর্য হতে গিয়ে ও হলুম না কেননা তখন আমার মনে পড়লো, ওঃ হো… কাল থেকে তো শারদীয় নবরাত্রি শুরু হচ্ছে আর আমরা দৈবযোগে এসে পড়েছি মা বিন্ধ্যবাসিনীর কাছে। অবশ্য সেটা ঠিক জানবার কথা নয় গৌরবের তখন। বললো কি করে? তবে দর্শন করে পূজো টুজো দিয়ে গেলেই তো বেশ হয়। অবশ্য পান্ডা ঠাকুরকে না ধরলে চলবে না। যেমন কোর্ট কাছারিতে গেলেই উকিল ঠাকুরকে ধরতে হয়। তাই সই।

তা সেদিন মন্দিরে একটুও ভীড় ছিলো না। দিব্যি ভালোভাবে দর্শন করে পূজো দিয়ে বাইরে এসে একটা হোটেলে গিয়ে দু’জনে পেট ভরে খেয়ে দেয়ে নিয়ে যখন আবার রিক্সায় উঠে বসলুম তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। স্টেশনেই জেনে এসেছিলাম যে ছ’টায় একটা ট্রেন আছে। বেনারস হয়ে দিল্লী না কোথায় যায়। তা সে যেখানে খুশী যাক, আমাদের বেনারসে পৌঁছে তো দিক আগে। ব্যস…..

এইবার আমি স্টেশনে পৌঁছেই আর বিলম্ব না করে আগে দু’টো টিকিট কেটে নিয়ে গৌরবের নরম চকচকে ফর্সা ডান হাতটা ধরে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লুম ঝপ করে।

আঃ….বাঁচলুম…..

পাঁচটাতেই বেশ অন্ধকার মতন হয়ে আসছিলো। সাড়ে পাঁচটার সময় তো চারদিক ঘোর অন্ধকার হয়ে গেল। স্টেশনে আলো জ্বলে উঠলো।

আমি বসেই আছি। হঠাৎ দূরে জাগলো একটা হেড লাইটের আলো। ট্রেন আসছে।
তবে মনে হয় বিফোর টাইম কেননা তখন ও ছ’টা তো বাজেই নি দেখি। মরুক গিয়ে। গাড়ী থেমেছে কি আমি উঠেছি…..।

ভীমবেগে ট্রেন ইন করলো প্ল্যাটফর্মে আর ঝপ করে তখনি স্টেশনের সব আলোগুলো ও ছাই গেলো নিভে।

‘ও গৌরব? এটা কি হ’লো আবার?’

‘হিঃ…হিঃ….হিঃ…মনে হয় লোডশেডিং হয়ে গেছে…..তা চলো, আমরা সামনের ফাঁকা কামরাটাতেই গিয়ে উঠে পড়ি, বাপী। অন্ধকারে আর এগিয়ে দেখে কাজ নেই। সঙ্গে যখন টর্চ অবধি নেই একটা’।

যুক্তিপূর্ণ কথা। আমরা ট্রেনে উঠে পড়লুম।

হাঁফ ছেড়ে একটা সীটে বসে দেখি যে কামরাতে বেশ ঠান্ডা ভাব রয়েছে এ সী কোচের মতন আর কম পাওয়ারের হ’লে ও গোটা দশেক আলো জ্বলছে, তাই স্টেশনের মতন ঘোর অন্ধকারটা আর নেই। এই যা রক্ষা। নইলে স্টেশনে বসে তো গৌরবের অতো ফর্সা দুধবরণ হাতটাকে ও দেখতেই পাচ্ছিলুম না। ভাগ্যিস আমি ছেলের হাতটা আগে থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম স্টেশন চত্বরে এসেই। নইলে খুঁজেই পেতাম না আর গৌরবকে।

ট্রেন ছেড়ে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে ঝম ঝম ঝমা ঝম শব্দটা দেখতে দেখতে বড়ই বেড়ে গেলো যেন। তারপরে সেই ট্রেনের বেগ সকালের মহানগরীকে ছাড়িয়ে শতাব্দী ও রাজধানী এক্সপ্রেসের স্তরে পৌঁছে গেল যেন।

‘বাপী, এটা কি প্যাসেঞ্জার ট্রেন?

‘মনে হয় না তবে সমস্তীপুর হতে পারে। কি করে বলি? ঘোর অন্ধকারে ট্রেনের নাম তো আমি পড়তেই পারিনি, গৌরব’।

তখনি আমার মনে হ’লো যে ট্রেনের স্পীড বাড়লে তো দেখি সব কোচেই আলোর বেশ জোর হয় ডায়নামোর কল্যাণে কিন্তু এই গাড়ীর দেখি সবই উল্টো ব্যাপার। আলোর জোর আরোই যেন কমে এসেছে। দূরে দূরে দশ বারোজন যাত্রী মাত্র বসে আছে বটে তবে তাদের দেখাচ্ছে আবছামতন। ঠিক যেন ছায়ামূর্তি। চোখ মুখ স্পষ্ট করে বোঝা যায় না।

‘বাপী গাড়িটা যেন বড্ড বেশী দুলছে, তাই না?’

বললুম—‘হুঁ, ভয়ংকর স্পীড নিয়েছে ট্রেন তো, তাই…মনে হয় সোওয়া শো কিলোমিটারের কম নয় এখন গতিবেগ…’

তবে গৌরবের কথা শুনে বড়ই চমকে উঠলুম আমি।

চমকে ওঠবার কথা নয়। কিন্তু একটা অদ্ভূত তথ্য আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে এসে দাঁড়ালো গৌরবের কথায়। বললে কারো হবে না প্রত্যয়। তা ঠিক ।

ট্রেন ভীষণ বেগে ছুটছে…আর ক্রমেই যেন আরো বাড়ছে তার বিষম গতিবেগ। কোচ প্রচন্ড দুলছে …আমরা ও দুলছি তার সাথে …মনে হচ্ছে এই বুঝি ছিটকে পড়লুম নীচে….কিন্তু …ও ও কী? অন্য সব যাত্রিদের তো কারো দেহই দোলায়মান নয়…একদম স্থির…ছবির মতন অচঞ্চল হয়ে বসে আছে সবাই। এ এ হয় কি করে? অ্যাঁ………

এ কী করে সম্ভব?

আমার এক বিচ্ছিরী স্বভাব হ’লো যে আমি সব কথাই যা যখন আমার মনে আসে গৌরবকে বলে ফেলি আর সে ছেলেও দেখি যে বাপ কা বেটা।

তবে এখন আমার এই বাজে সন্দেহের কথাটা আর বললুম না। বাচ্ছা ছেলে ভয় পাবে ভেবেই।

খানিক পরে আমি বললুম—‘পাশের দু’টো সীটের পরেই যে লোকটা বসে আছে সে হচ্ছে আমাদের নিকটতম সহযাত্রী। গৌরব, তুমি একটু বসে থাকো আমি গিয়ে ওনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করে আসছি…’

‘চলো বাপী…আমি ও যাই তোমার সঙ্গে। আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে খুব এই গাড়িটাতে উঠেই, বাপী। কোচটা ভালো নয় মনে হয়। কই? সকালে তো এমন কিছুই মনে হয় নি আমার।’।

‘ভাই সা’ব, আপ কঁহা তক যা রহে হ্যায়?’ গৌরবের হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে সহযাত্রিকে জিজ্ঞাসা করলুম আমি।

লোকটা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে খানিকক্ষণ যেন আপাদমস্তক জরীপ করলো তারপর কেমন সর্দিবসা গলায় বললো-‘যঁহা তক ইহ ট্রেন যায়েগী’।

‘আউর ইহ ট্রেন যায়েগী কঁহা তক?’

‘জঁহা সে আই থী…..’।

‘ভাইসা’ব, বহী তো জাননা হ্যায় কি ইহ গাড়ী আই থী কঁহা সে?’

‘উসসে আপকা ক্যা মতলব? আপকো যানা কঁহা তক হ্যায়?’

‘বেনারস’।

‘ফির আপ ইস স্পেশাল ট্রেন মে কেঁও চঢ়ে হ্যায়? ইহ ট্রেন তো হর জগহ পর রুকতি ভি নহী হ্যায়’।

‘তো ক্যা ইহ সমস্তীপুর নহী হ্যায়?’

‘নহী তো। ইহ স্পেশাল ট্রেন হমারী বাপসী কি গাড়ী হ্যায়’।

‘বাপস জা কঁহা রহী হ্যায় ইহ গাড়ী সওয়াশো কিমী স্পীড সে?’

‘নহী…নহী…..গলত…একশো পঁচহত্তর কহিয়ে…। অউর যা রহী হ্যায় বঁহী পর জঁহা সে হম আয়ে থে ইস পিতর পচ্ছ মে। আজ কে দিন শাম কো ইহ ট্রেন সির্ফ হমারে লিয়ে হী চলতি হ্যায় তাকি লোগ ছুট কর কোই রহ না যায় য়ঁহা পর। বহুত কড়াই চল রহী হ্যায় আজকল হমারে য়ঁহা….ক্যা করেঁ লোগ ভি? আউর কোই উপায় ভি নহী হ্যায় কারণ যহ হ্যায় কি বাপস জানা হি নহী চাহতে থে বহুত সারে লোগ য়ঁহা আনে কে বাদ। ইসলিয়ে …’

‘লেকিন আপ তো হমারে লিয়ে অজনবী হ্যায়। আপ তো হমারে সাথ নহী আয়ে থে? আপ বেটে কে সাথ মরনে কে লিয়ে ইস ট্রেন মে কেঁও আয়ে? দক্ষিণ দরওয়াজা স্টেশন কো পার করতে হী আপলোগ ভি জিন্দা নহী রহেঙ্গে’।

সর্বনাশ…এ বলে কী? দক্ষিণ দরওয়াজা? তার মানে? যমের দক্ষিণ দোর? তবে এটা কী যমালয়ের যাবার জন্য স্পেশাল ট্রেন না কী রে বাবা? না ভয় দেখাচ্ছে পাজী লোকটা আমাকে, আমি বাঙালী দেখে? নির্ঘাৎ তাই হবে।

তাই আবার সাহস করে জানতে চাইলুম—‘ইহ গাড়ী অব আগে কঁহা পর ঠহরেগী, ভাইসা’ব?’

‘বহুত সারে স্টেশন পর ঠহরেগী জরুর, লেকিন কোই ভি লোগ উতরেঙ্গে নহী। বস চঢ়তে হি চলে যায়েঙ্গে তেজী সে ধক্কে দেকর…..একসাথ হি….কুছ সমঝে? । আপকে লিয়ে উতর পানা নামুমকিন হি হ্যায় উস ভীড় মে…’

এ হিঁ…হিঁ…হিঁ…হিঁ…হিঁ….’।

অদ্ভূত বিকট এক হাসির শব্দে আমরা দু’জনেই চমকে উঠে ছুটলুম দরজার দিকে। স্পীভ কমছে ট্রেনের তখন…। মনে হয় কোন স্টেশন আসছে। থামলেই নেমে পড়তে হবে আমাদের এই হতভাগা ট্রেন থেকে এখনি। তা সে যেখানেই হোক না কেন। নইলে বিপদ বাড়তে পারে আমাদের।

নাঃ আজকের দিনটাই দেখছি অতি অপয়া ছিল। সব দেখে শুনে গৌরবের মতন স্মার্ট ছেলের মুখে ও তখন আর কথাটি নেই।

ট্রেন থামলো।

এখানে ও বাইরে দেখি ঘোর অন্ধকার। কোন স্টেশন যে এসেছে সেটি বোঝবার কোন ও উপায়ই নেই। আর তখনি কোথা হ’তে প্রায় সাত আটজন ছায়া মূর্তির মতন আগা গোড়া কালো কাপড় জড়ানো লোক হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লো ট্রেনে আর সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিলো গাড়ী ভীষণ বেগে।
তখনি আমার মনে হ’লো যেন কোচের মধ্যে ঠান্ডা ভাবটা দ্বিগুন হয়ে গেছে হঠাৎ।

কান্ড কারখানা সব দেখে আমি প্রমাদ গুনলুম মনে মনে ।
লোকটা তো তবে মিথ্যা বলে নি দেখছি। এই ট্রেন থেকে নামা ও তো দেখি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

ঝপা ঝপ করে গাড়ীর মধ্যে গোটা তিন চার লাইট নিভে গেল এইসময় হঠাৎ করে। হয় বাল্ব ফিউজ হয়েছে আর নয় তো সার্কেট ব্রেক।

কি জ্বালা। এরা দেখি আলো ও দেখতে পারে না দু’চোখে। তাই গাড়ী ঢুকলেই স্টেশন হয় অন্ধকার। আর নতুন লোক উঠলেই নেভে গাড়ীর কতকগুলো আলো। যত স্পীড বাড়ে ততোই গাড়ি আলো ও আসে নিভে। এ যে কি ব্যাপার তা একমাত্র ভগবানই জানেন।

বললুম--হুম্, এসব কি অদ্ভূতুড়ে আর মানুষকে ভয় দেখানো কান্ড রে বাবা?

গাড়ির গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলুম আমি গৌরবের হাত ধরে। মনে হ’লো হাতটা যেন বেশ কাঁপছে। কি করি? ফিরে গিয়ে ওই সাংঘাতিক লোকগুলোর পাশে বসবার আর ইচ্ছে নেই আমার ।

তাই জিজ্ঞেস করলুম—‘গৌরব, তোমার কি ভয় করছে?’

‘না বাপী। খুব শীত করছে। আমাদের কোচে পোষমাসের মতন এতো বেশী ঠান্ডা কেন, বাপী?’

‘কে জানে? বাঁ দিকের দরজা আছে বন্ধ। ডানদিকেরটাই খোলা আর এইদিকেই সব প্ল্যাটফর্ম ও পড়ছে দেখছি একে একে। তবে জোর হাওয়া যা আসছে তাও কনকনে ঠান্ডা। ঠিক যেন বরফের ছুরী হয়ে যাচ্ছে এই কোচে হাওয়া ঢুকলেই। এমনটি হবে কে জানতো? নইলে তোমাকে উলেন ড্রেসই পরিয়ে আনতুম আমি…’

আবার থামলো ট্রেন এক অন্ধকারময় স্টেশনে।

হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লো জনা চারেক লোক। সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিলো ট্রেন আর ও’দিকে নিভলো গাড়ির মধ্যে আরও কটা আলো আবার। ঠান্ডা ও এমন বাড়লো যে আমি নিজেই তখন ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করলুম।

এই করে যখন শেষ বাতিটা ও গাড়ির নিভে গেল তখন দারুণ ঠান্ডায় আমার কথা বলবার শক্তি আর নেই। ঘোর অন্ধকার বাইরে আর ভিতরে। কিছুই আর দেখা যায় না। নিজেদের হাত পা ও নয়। আমি শীত কাটাতে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলুম গৌরবকে।

হঠাৎ কোচের ভিতরে জাগলো এক বিষম হট্টগোল। হৈ চৈ…. বিশ্রী অমানুষিক কন্ঠে বিকট সব চীৎকার। কারা যেন দুপদাপিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

এঁ …হেঁ …হেঁ …হেঁ…. হেঁ …হেঁ….আবার জাগলো সেই বিকট হাসি…

‘বাপী….দেখ…দেখ…বাইরে একটা রেলিং পড়ছে মনে হয় কোন পোল আসছে ’
.
‘তা…কি হবে আর এখন পোল দিয়ে?’

‘বুঝলে না বাপী? পোলের ওপরে ট্রেন চলে মাত্র বিশ কিমী স্পীডে…’

‘তা হবে হয়তো….কিন্তু এই হতচ্ছাড়া ট্রেন হয়তো সেই নিয়ম ও মানবে না…ছাই…’

‘তা হ’তে পারে বাপী….তবে কোন পোলের শেষে পড়ে অনেক ঝোপঝাপ…ঘাস জমি….’

‘ওরা আসছে…সাবধান…আর সময় নেই, বাপী। আমি বুঝতে পারছি যে এখন ওরা দল বেঁধে আমাদের আক্রমণ করতে আসছে…মনে হয় এরা হচ্ছে সবাই ট্রেন ডাকাত, বাপী। ভয় দেখিয়ে আমাদের আগে জব্দ করতে চাইছিলো, বাপী। সেই মতন কাজ হ’লো না দেখে এখন নিজমূর্তি ধরেছে সবাই। এরাই সেই বিখ্যাত মির্জাপুরী ডাকাতের দল …’

‘কুইক বাপী…আমাকে তুমি শক্ত করে আর ও জড়িয়ে ধরে নাও আর আমি এক…দুই…তিন বললেই দাও বাইরে এক লাফ ঠিক জাম্বুমানের মতন…আর কোন পথ নেই…আমি মা কে বলে দিয়েছি…ওরা যেই হোক …আমাদের টিকি ও ছুঁতে পারবে না, বাপী। তা ঠিক…রেডী……………….. ওয়ান…টু…থ্রি…’
সঙ্গে সঙ্গে দু’তিনটে অদ্ভূত ঘটনা প্রায় একসাথেই ঘটে গেলো আধ সেকেন্ডের মধ্যে।

একটা ঠান্ডা…আর ও ভীষণ …ভয়ংকর বরফের চেয়ে ও ঠান্ডা আর লোহার মতন শক্ত হাত এসে খামচে ধরতে গেল আমার কাঁধ…আর আমার পিছনের দরজাটা গেলো দড়াম শব্দ করে খুলে হাট হয়ে সেই সাথেই…………

মনে হ’লো কেউ যেন সজোরে টেনে খুলে ফেললো সেই বন্ধ দরজাটা আর হু হু করে ছুটে এলো দুরন্ত ঠান্ডা হাওয়ার বিষম এক ঝড় দরজাটা খুলে যেতেই। হয়তো দু’শো মাইল বেগে….সেই ঝটকায় হাতটা যেন পিছলে সরে গেলো আমার কাঁধটা চেপে ধরবার আগেই।

আর তখনি আমি ও দিলুম এক লাফ ট্রেনের বাইরে গৌরব… থ্রি …উচ্চারণ করা মাত্র ….জয় মা দুর্গা বলে…।

তারপরে?

তারপরে শূণ্যে সন্তরণ……………….

আমার শুধুমাত্র মনে হলো যে সেই প্রচন্ড হাওয়ার টানে আমি ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন উড়ে চলেছি গৌরবকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে।

আর ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে পিছনে জাগছে এক ক্রু্দ্ধ ভয়ংকর বিকট জান্তব গর্জন সেই ফেলে আসা ঘোর অন্ধকার কামরাতে।

তারপরে….. আর কিছুই বোধ রইলো না আমার । তবে গৌরবকে যে ছাড়িনি আমি তা বেশ বুঝলুম ক্ষনেকের জন্য।

যখন আমার জ্ঞান হ’লো দেখি যে অন্ধকার খোলা আকাশের নীচে একটা বড় বড় প্রায় হাতখানেক উঁচু নরম ঘাস ঝোপের ওপরে পড়ে আছি আমরা। চোট আঘাত তেমন বিশেষ কিছু লাগে নি আমাদের। প্রবল গতির সেই ঝোড়ো হাওয়ায় দু’জনে ভেসে চলে এসেছি, আর হয়তো বেঁচে গেছি ঝোপের ওপরে এসে পড়বার ফলে।।

‘ও বাপী, চলো আর এখন মনে হয় আমাদের কোনো ভয় নেই। আর কেউ ধরতে ও আসছে না আমাদের। তেমন সাংঘাতিক ঠান্ডা ও তো নেই আর এখন। এইবার আমরা রেল লাইন ধরে দু’জনে গুড় গুড় করে খানিকটা হাঁটি। একটা কোন স্টেশন এলেই আমাদের কাজ হবে সহজ ‘।

‘বললুম—‘গৌরব রে, মনে হয় বেনারস আর বেশীদূর নয় কেননা প্রায় দেড়শো মাইল স্পীডে ঠিক উড়ে এসেছে ট্রেন আর আধঘন্টার মতন চলেছে ও তো । তাই হিসেব মতন এখন আমরা আছি বেনারসের কাছাকাছিই কোথাও। হয়তো বড় জোর মাইল তিন চারেকের ভেতরেই’।

গৌরব আমার হাত ধরে টানলো—‘বাপী, এসো’।

বললুম---‘তাই চলো’।

‘ভাগ্যিস মা হাওয়ার জোরে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে এলো নইলে এই ট্রেনের নীচেই যেতে হ’তো হয়তো। চলো যাই বাপী….’

‘হুম্……’

‘তবে কিন্তু ওদের দক্ষিণ দরওয়াজা স্টেশনটা আমাদের আজ আর দেখা হয়েই উঠলো না। ভাগ্যে নেই….তা আজ না হোক কিছুদিন পরে গিয়ে দেখলে ও কোন তেমন ক্ষতি নেই। কি বলো, বাপী? স্পেশাল ট্রেনে উঠে পড়লেই হবে দিনক্ষণ দেখে নিয়ে….. হিঃ….হিঃ…..হিঃ…’।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

২৩ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪