একটি মরজগত যা মানুষ ও অন্য সব মরণশীল প্রাণির জন্য আর অন্যটি আত্মা ও পরমাত্মার অবিনশ্বর জগত। এই দুইয়ের মাঝে আছে আর এক অস্থির বা ট্রানজিট জোন বা জগত আছে। যার নাম প্রেতলোক। এইজগত মৃত্যুর পরের। সব প্রাণিকেই এই জগতে আসতে হয় এবং থাকতে ও হয় একটি নির্দিষ্টকাল। যার যত অতৃপ্তি থেকে যায় জীবনে, তাকে থাকতে হয় তত বেশীদিন….অতৃপ্ত ইচ্ছার আকর্ষণে……এ’সব আমার কথা নয়। একজন সাধুর উক্তি। আমি বিশ্বাস ও করিনি তবে মাঝে মাঝেই কিছু অনুভব করেছি বইকি।
যেমন গত বার কিন্তু আমি বেশ ঝামেলায় পড়েছিলাম একজনের সাহায্য নিতে গিয়ে আর খাবার লোভে পড়ে। কেননা মোগলাই পরোটা খুব ভালো জিনিষ আর খেতে ও মন্দ নয় তাই আমার অপছন্দের কিছু ছিলো না তবে নিঊ কেবিনের ওই পরোটা যে বেশ গন্ডগোলের জিনিষ হয়ে উঠতে পারে,কারো পরোয়া না করে, কখনো তা আমাদের ধারণাতেও ছিলো না।
এখনো কিছু হয়তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা, তাই না?
তাহলে আসুন মোঘলদের খাবারের মজার খোলতাই করা যাক। বিশ্বাসযোগ্য হোক বা না মনে হোক।
সেবারে আমাকে যেতে হয়েছিল ঝাড়খন্ড রাজ্যের এক কোলিয়ারি অঞ্চলে এসেসর হয়ে, এক ইন্সুর কোম্পানির তরফ থেকে।
জায়গাটা বোকারো থেকে বেশ কিছুটা দূরে আর ট্রেন যায় না বলে কিছুটা ট্রেনে গিয়ে শেষে বাস আর পা গাড়ী ভরসা ...কি আর করা?
তবে গিয়ে দেখা গেলো যে যতটা খনির মালিক দাবি করেছিলেন ততটা ক্ষতি হয়েছে বলা চলে না, ইন্সুরান্সের টাকা পাবার জন্যে বেশ বাড়িয়ে দাবি করা হয়েছে, এক জন শ্রমিক নিহত হয়েছে, তা ঠিক কিন্তু ব্যাপারটা বেশ জটিল, কেননা এই সব অঞ্চলে বেশ কিছু অবৈধ খনন ও চলে রাতের অন্ধকারে, নিরাপত্তার নিয়মের তোয়াক্কা না রেখে আর তখনি হয় দুর্ঘটনা।
হয় কয়লার ছাদ বা স্তর ভেঙ্গে পড়ে আর নয়তো গ্যাস বা জল উঠে এসে খাদান ভরে যায় আর শ্রমিকের প্রাণ যায় । বীমার নিয়ম অনুযায়ী কিন্তু এই সব পরিস্থিতিতে কোনো দাবি পূরণ করা হয় না।
আমাকে পর্যবেক্ষন শেষ করেই গোপন রিপোর্ট ই -মেল করে দিতে বলা হয়েছিল আর সে জন্যে আমাকে একটা ল্যাপটপ ও মোডেম নেট কনেকনেক্টরের সাথে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বীমা কোম্পানির দ্বারা।
তা দেখা শোনা শেষ তো হলো কিন্তু রিপোর্ট পাঠাতে গিয়ে দেখি বেজায় গন্ডগোলের ব্যাপার কেননা না আছে ফোনের টাওয়ার আর না আছে মোডেমের টেলিফোন ডায়াল লিঙ্ক সেখানে ।
বাধ্য হয়ে রিপোর্টটা পি. ডি.এফ. ফরমাটে সেভ করে দিলো চঞ্চল মানে আমার বারো বছর বয়সের পরম সুন্দর পরীর দেশের রাজকুমার ভাইপো আর পাসওয়ার্ড প্রটেক্ট ও করে দিলো সে।
আমি আবার কম্পুটার ওয়ার্কে বিশেষ দক্ষ নই তাই এই রিপোর্ট তৈরির কাজের জন্যেই অতি রূপবান দুধবরণ ছেলেটাকে সঙ্গে নিতে হয়েছিল আমাকে।
অবশ্য ভালোই রিপোর্ট দেব বলে দিলুম কিন্তু তা’তে মানেজার বা শ্রমিকেরা কেউ বিশেষ খুশী হলো বলে আমার মনে হলো না একটুও কিন্তু । তারা ভীষণ অস্থির আর অধৈর্য হয়ে উঠছিল ক্রমেই। তার মানে অর্থাৎ টার্গেট যে হবে চঞ্চল তা ও বুঝতে পারিনি আমি তখন।
তবে সবার মনোভাবই বেশ বিরূদ্ধ ও বিদ্বেষপূর্ণ মনে হলো সেখানে আমার।
যেন আমি ইচ্ছে করলেই দাবি করা সম্পূর্ণ বীমার টাকাটা পাইয়ে দিতে পারি তাদের কিন্তু তা’দিচ্ছি না ইচ্ছে করে, যেন আমার পকেট থেকে যাবে।
অফিসের বাইরে বেশ দু’চারবার জোরে চেঁচামেচি ও শোনা গেলো। মৃত শ্রমিকের পরিবারের লোকজনের সাথে তাদের শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ও ছিলো বৈকি, কনট্র্যাকটরাও ছিলো না এমন হতেই পারে না। সবাই আমার বিরূদ্ধে স্লোগান তুলেছিলো
তা সে আর আমি কি করবো?
বে আইনি কাজ করে ক্ষতি পূরণের দাবি করলে আমি কি করতে পারি? তবে শ্রমিকরা বললো যে পয়সার লোভে আর হুকুম না মানলে নিয়মিত কাজ থেকে ও বঞ্চিত হ’বার ভয়ে তাদের এই বেআইনি খননে সাহায্য করতেই হয় তাই তাদের দাবি মানতে হবে। কথাটা সত্যি হলেও নিয়মের বাইরে বলে আমার কিছুই করার ছিলো না।
তাই আমি যাহোক কিছু বলে স্তোক দিলাম ।
ম্যানেজার ও প্রথমে বললো যে-‘আরে, কোম্পানি দেবে টাকা আপনার আর কি? পাইয়ে দিলে গরিব শ্রমিকদের কিছু সাহায্য করা হ’তো আপনার, প্রায় দিন কতই তো চাপা পড়ে সব মারা যায়, মনে করুন তাদের ও অতৃপ্ত আত্মার একটু শান্তি হ’ত, এই সব কোলিয়ারি অঞ্চল তো খুব সুবিধের জায়গা নয়’। আর ছেলে সঙ্গে নিয়ে এসেছেনই যখন, একটু তো সাবধান হতেই হবে আপনাকে….তাই অনুরোধ করছি…’ ...
কিন্তু আমি রাজি নই বুঝে শেষে তিনি সেখান থেকে আমাদের চুপচাপ বেরিয়ে যেতে পরামর্শ দিতে আমরা তারপরেই এ্যাটাচী হাতে আর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে রওনা হলাম বিকেলের আগেই আর বোকারো থার্মাল স্টেশন থেকে গোমো বা নেতাজি সুভাষ বোস জংশনের প্যাসেনজার গাড়ী ধরতে সচেষ্ট হলাম ।
জায়গাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ত্যাগ করাই ভালো বলে মনে হলো আমার আর ম্যানেজার ও তাই বলে দিয়ে ছিলেন কেননা মৃত শ্রমিকের সঙ্গী সাথীরা আমার ওপরে যে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি তা জানা কথাই আর প্রয়োজনে তারা যে অনিষ্ট ও করতে পারে, তা ঠিক।
আসলে আজকাল আর এই সব ইন্সপেকসন আর ফিজিকাল ভেরিফিকেসনের কাজ বিশেষ নিরাপদ নয় কেননা সর্বত্র অনৈতিক কাজ হয় আর সেখানে সঠিক ভাবে কোনো অ্যাসেসমেন্ট বা মূল্যাঙ্কন করাই কঠিন আর বিপদজনক কাজ হয়ে ওঠে।
ভুল রিপোর্ট দিলে কোম্পানি চাকরী নট করে দেবে আর ঠিক দিলে দাবি করনেওলারা দেখে নেবে।.বিশেষ করে চঞ্চলের মতো একটা ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এই কাজে আসা আমার পক্ষে মোটেই যে ঠিক কাজ হয়নি তাই ভাবছিলাম ট্রেনে বসে, তা বিধি বাম ..
সে গাড়ী ও চললো মাত্র কিছু ক্ষণ।
বেরমো না কি একটা স্টেশন পার হয়ে আর একটা হল্ট স্টেশন ছাড়িয়েই অচল হলো। কি? না প্যাসেন্জার গাড়ির ইঞ্জিন ফেল, বোঝো ঠ্যালা, নির্ঘাৎ অযাত্রায় বেরিয়েছি আমরা আজ।
রাত সাতটার আগে আর কোনো গাড়ী ও যে নেই তা আমার জানা ছিলো...কি আর করি?
ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে লাফিয়ে রেল লাইনের ধারের খোয়ার ওপরে নেমে পড়ে, চঞ্চলকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে নামিয়ে নিলাম আর তারপরে সোজা হন্টন দিতে হ’লো চঞ্চলের চকচকে নরম দুধ সাদা ডান হাতটা ধরে। ...
ওরে বাবা, তা সে হাঁটছি তো হাঁটছিই ...কোনো স্টেশন আর আসে না। শেষে এলো ফুসরো নামের এক এমন ছোট্ট স্টেশন যেখানে এক কাপ চা ও মেলে না দেখে মনটা খুব দমে গেলো।
ভাবলুম রাতে আর না কোথাও গিয়ে এইখানেই একটা হোটেলের খোঁজ করা যাক বরং।
স্টেশনের বাইরে একটি মাত্র টেম্পো ছিলো তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম –‘এখানে ভালো হোটেল পাবো কি রাতের জন্যে?’
সে বললো –‘ হোটেল? না:, এখানে সব লজ ...তাও বেশি নেই সেই ব্যান্ক রোডে দু’চারটে যা আছে, যাবেন তো চলুন, তিরিশ টাকা ভাড়া লাগবে কিন্তু’।
তাই সই, সন্ধে হয়ে আসছে, লাইটের বালাই নেই পথে কোথাও আর ট্রেনের ও কোনো স্থিরতা নেই, ক্ষিদে ও বেশ পেয়েছে এ’দিকে, দেখি যদি কিছু উপায় হয়। সঙ্গে চঞ্চল থাকায় চিন্তা হচ্ছিল বেশী। আমার মনে অস্থিরতা বাড়ছিল।
তা বাড়তেই পারে। ওরে বাবা ...সে কি রাস্তা? খানা খন্দে ভরা আর কয়লার কালো পুরু ধুলোতে ঢাকা, তার ওপর দিয়ে চলেছে কয়লা বোঝাই বড় বড় ট্রাকের সারি আর উঠছে ধুলোর ঝড় ঘোর কালো রঙের ....উ:, নিদারুন পরিস্থিতি যাকে বলা যায় আর কি। ...
দেখতে দেখতে আমাদের জামা কাপড় সব কালো হয়ে গেলো এমনকি চঞ্চলের দুধের বরণ হাত পা মুখ সব আদিবাসীদের ছেলেদের মতন দেখতে হয়ে উঠলো লজে গিয়ে হাজির হবার আগেই। কি বিপদ রে বাবা?
‘নিন এসে গিয়েছি, সামনেই মেঘনা লজ, সবচেয়ে ভালো লজ এখানকার ...দিন টাকা আমার, সন্ধ্যে হয়ে আসছে, আর দেরি করা চলবে না আমার কিন্তু, কেননা এই সব কোলিয়ারি অঞ্চল রাতের বেলায় বিপদজনক হয়ে ওঠে খুব, অনেক ভয় আছে রাতে এই সব পথে, আমি তো চলেই যাচ্ছিলাম তখন, নেহাত আপনি এসে বললেন তাই পৌঁছে দিয়ে গেলাম ’।
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সরু গলি পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে দু’তলাতে উঠে দেখি কেউ নেই কাউন্টারে ...ভালো মুস্কিল আর এদিকে বিকেল ও পড়ে আসছে।
অনেক হাঁক ডাক করে একটা ছেলের দেখা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম –‘ভাই, এখানে ঘর পাবো তো ?’
‘তা পাবেন স্যার, ওই যে ম্যানেজার শুয়ে আছেন বারান্দাতে, গিয়ে ডাকুন, ঘর খুলে দেবেন উঠে’।
এই অবেলাতে শুয়ে আছেন হোটেলের ম্যানেজার? ...কি কান্ড? ..তা অনেক ডাকাডাকি করতে তিনি উঠে একটা ঘর খুলে দিয়েই গিয়ে আবার লম্বা হলেন বিছানাতে।
কোনো মতে জানা গেলো যে ঘরের ভাড়া পড়বে দেড়শো টাকা খাওয়া ছাড়া।
তা তাই সই, ঘরে তো গিয়ে ঢুকে আলো জ্বেলে দিয়ে আগে হাত পা ধুতে হবে আর কিছু জলযোগ সেরে চানটাও না করলে কালো ভূত হয়ে থাকা যাবে না।
খাবার বলতে আমাদের সঙ্গে ছিলো মুড়ি চিঁড়ে আর বিস্কুট , তা সে আর শুকনো কত চিবোবো আমরা, মোডেমের কানেক্টিভিটি সেখানে ও নেই দেখে হতাশ হয়ে স্নান পর্বই সমাধা করলাম দু’জনে।
আমি আগে অপরূপ সুন্দর ছেলে চঞ্চলকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ভালো করে সাবান মাখিয়ে চান করাতে বসলাম ও তারপরে ছেলেটার দুধ সাদা নরম হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলাম ও দামি বডি লোশনও ক্রিম পাওডার দিয়ে প্রসাধন করে আগের নোংরা পোশাকের বদলে নতুন পোশাক বার করে পরিয়ে দিলাম তারপরে নিজে ও চান করে তৈরী হচ্ছি, আলো গেলো ফট হয়ে ...ওরে বাবা, এদিকে তো অন্ধকার দেখি হয়ে আসছে , কি করা যায়?
তৈরী হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি ম্যানেজার উঠেছেন, তাড়াতাড়ি রুম চার্জের টাকা জমা দিয়ে খাবার পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলাম। তা তিনি বললেন –‘টাকা দিন না, আনিয়ে দিচ্ছি , দু’জনের জন্যে পঞ্চাশ টাকার মতন পড়বে ভেজ থালির দাম’।
তা ও দিলুম
তিনি বললেন –‘আনতে দিচ্ছি, ঘরে বসুন গিয়ে, সময় লাগবে, তা সঙ্গে কে? ছেলে?’
বললাম –‘হ্যাঁ’ ;
‘নিজেরই ছেলে, আপনার?’
আজব প্রশ্ন শুনে আমি রেগে তিনটে হয়ে বললাম –‘ না, ছেলে কি আর কারো নিজের হয় নাকি কখনো? ও আমি অর্ডার দিয়ে তৈরী করিয়ে নিয়েছি এক জন ভালো কারিগরকে দিয়ে, বুঝলেন কিনা?’
‘ও:, তাই বলুন, তাই আমি ভাবছি বসে তখন থেকে,...তা নইলে এই দেশে এত সুন্দর ছেলে তো হয়ই না, কোথাও কারো ঘরেই নেই, পেলেন কোথায় আপনি? তা ছেলেই তো না কি মেয়ে? সে যাই হোক, তবে কিন্তু সঙ্গে এনে ঠিক কাজ করেন নি আপনি ওই পরীর মতন সুন্দর মেয়ে বা ছেলেটাকে ..কি.. কি দিয়ে বানিয়ে ছিলেন, বলুন তো ? আর অতো ফরসাই বা কি দিয়ে করিয়েছেন ছেলেটাকে? .দরকার হলে আবার তৈরী করিয়ে নিতে পারবেন মনে হয় কি আপনার?’
এ দেখি বেশ মজার লোক তো, তা আমিই বা হারি কেন?
বললাম –‘না:, সেটি আর হবার জো নেই, সেই কারিগরকে আর এখন পাচ্ছি
কোথায়? অনেক দিন তো হয়ে গেলো. দেখছেন না, ছেলেটাই কত বড় হয়ে গিয়েছে এখন, তা ওকে আপনি মেয়ে বলে ভাবলেন কেন? ’
‘তা ও তো বটে, তবে এত সুন্দর যে ছেলে ও হয় তা তো জানতামই না তাই মনে হলো হয়তো মেয়ে হতে পারে ...তবে ছেলে হলে ও আপনি কিন্তু সাবধানে থাকবেন খুব, নতুন এসেছেন দেখে আগেই একটু সাবধান করে দিলুম এই আর কি, এই সব জায়গা তো খুব একটা সুবিধের নয়’।
সেই সাবধান বাণী আবার শুনে আমি বেশ চিন্তায় পড়লুম, এরা সব বলে কি রে বাবা?
সে যাই হোক কিন্তু খাবার আর আসে না দেখে আবার জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছি, তখন দেখি অন্য একজন কে মোটা মতন লোক এসে জানতে চাইছেন যে কে খাবার আনবার জন্যে টাকা দিয়েছেন ?
আমি গিয়ে, নিজের নাম বলতে তিনি সেই ম্যানেজারকে গালাগাল দিয়ে বললেন –‘কে তোকে বলেছে যে খাবার পাওয়া যাবে আর তুই আনিয়ে দিবি এই সময়ে শুনি? রাতের আগে এই সময়ে খাবার মেলে কোথাও? খালি ধান্দাবাজি, তা কত নিয়েছে আপনার কাছে?’
আমি পঞ্চাশ টাকা বলতে তিনি বললেন ‘-দে, ফেরত টাকা ওনাকে এখনই’।
আমি লাইটের কথা জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন –‘লাইটের এখানে খুব গন্ডগোল হয় আর আমাদের তো জেনারেটর নেই, সে এখানে কোনো লজেই নেই তার আর কি করা যাবে? বসে থাকুন, দশ মিনিটেও আসতে পারে আর নয়তো চার ঘন্টা ও লাগতে পারে’।
তিনি চলে গেলেন ।
আমি ঘরে যেতে চঞ্চল জিজ্ঞাসা করলো –‘ও কাকু, অন্ধকারে রাত ভোর কি করে থাকা যাবে? আমার কিন্তু বেশ ভয় করছে, তুমি বাইরে গেলে আমি একবার বাথরুমে গিয়েছিলাম। চারদিক বন্ধ বলে আরো অন্ধকার কিন্তু হঠাৎ ঘরের চালে একটা গোল মতন আলো এসে পড়লো ঠিক যেন টর্চ জ্বলছে।...আমি ভাবলাম বুঝি ঘরে লাইট জ্বলেছে। কিন্তু বেরিয়ে এসে দেখি কই আলো তো আসে নি, আবার ফিরে বাথরুমে গিয়ে দেখি সব অন্ধকার, কোনো আলো নেই কোথায় ও। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত
কাকু , তুমি চলো আমরা না হয় চলেই যাই স্টেশনের দিকে। এই অদ্ভূতুড়ে হোটেলে থাকা যাবে না। এনারা তো খাবার জল টুকু ও দিলেন না এখন অব্দি, আবার খাবারের নাম করে টাকা ও নিয়ে ছিলেন তোমার কাছ থেকে’।
ঘরে কলিং বেলের বালাই নেই দেখে আমি বেরিয়ে জল চাইতে গিয়ে দেখি সব ফাঁকা, কেউ নেই কোথাও রিসেপসনে। কলা’র কেউ নেই তো কলিং কে করবে আর কাকেই বা করবে?
রাগ করে জিনিষ পত্র নিয়ে বেরিয়ে এলুম হোটেল থেকে চঞ্চলের হাত ধরে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি, হঠাৎ ছড় ছড় করে ঘোলা মতন জল পড়তে শুরু হলো জোরে ওপর থেকে। চঞ্চল লাফিয়ে সরে এলো, নইলে সেই নোংরা জলে চান হয়ে যেত আবার সে নির্ঘাৎ ।
জল পড়ছে তো পড়ছেই, সে আর থামেই না। হয়তো জলের টাঙ্কির বাল্ব ফেটে গিয়েছে। আমরা সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ বাধ্য হয়ে।
তারপরে বেরিয়ে দেখি --ওমা , কি কান্ড? কোথাও একটা টেম্পো নেই।
এখন দু ‘মাইল পথ স্টেশন, জিনিষ নিয়ে যাই কি করে?
চঞ্চল বললো –‘দাও কাকু, তোমার ব্যাগ আমি নিচ্ছি, চলো হেঁটেই যেতে হবে আমাদের, তোমার ভারী এটাচি নিয়ে’।
আবার সেই পথ আর ধুলোর কালো ঝড়ে আমাদের নতুন পোশাকের দফা সারা হয়ে গেলো, চান করাই মিছে হ’লো আমাদের অবেলাতে।
প্রায় এক ঘন্টা লাগলো লাইন দিয়ে আসা কয়লা বোঝাই ট্রাকের জন্যে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে আর জিনিষ নিয়ে ধীরে ধীরে যেতে । খানাখন্দ বাঁচিয়ে এঁকে বেঁকে চলছে ভারী ট্রাক। ঘাড়ে এসে পড়ার অবস্থা আর ভাঙাচোরা সরু পথে সরে যাবার ও জায়গা নেই। আপদ কি গাছে ফলে নাকী?
তা স্টেশানে গিয়ে শুনি যে ট্রেন আসতে অনেকটা দেরি আছে তখন ও, প্রায় দেড়ঘন্টা সময় আছে।
সারাটা পথ জনহীন প্রায়, মাত্র দু’ একজন আদিবাসীকে দেখা গেলো ।
প্লাটফর্মে গিয়েই বসতে হ’লো ।
একটা ঘেরা মতন জায়গায় সিমেন্টের বেদী করা আছে তাকেই নাকি ওয়েটিং রুম বলে এখানে, লেখা ও ছিলো তবে আমরা সে ধারে ও গেলুম না।
এদিকে বেশ ক্ষিধে পাচ্ছে দেখি। কলে জল ও নেই যে খাবো, সে পাম্প চালালে তবে নাকি মিলবে। এমন কি টিকিট ও দেবে ট্রেন আসবার আধ ঘন্টা আগে।
বিচিত্র জায়গার অদ্ভুত স্টেশন।
জনমানব হীন প্লাটফর্মে দু’জনে বসে আছি আর এদিকে ক্রমেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। হু হু করে হাওয়া চলছে খোলা প্লাটফর্মে। জিনিষ পত্র নিয়ে দু’জনে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে আছি তো আছিই। ...সময় আর কাটে না আর খাবার দাবারের ও কোনো আশা নেই। চান করে, পথ হেঁটে এসে বেশ ক্ষিদে তো পাচ্ছেই আমাদের।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে ক্রমে।
হঠাৎ দেখি কে একজন লোক প্লাটফর্মের শেষের দিক থেকে হন হনিয়ে হেঁটে আসছে।
তার পরনে নীল রঙের পোশাক আর মাথায় একটা ল্যাম্প ফিট করা আছে টুপির সাথে। দেখতে ঠিক কয়লা শ্রমিকদের মতন, যারা কয়লা কাটতে খাদের নিচে নামে ট্রলি করে।
ল্যাম্পটা অবশ্য জ্বলছিলো না।।
সে কাছে এসেই চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপরে বললো –‘ তুরা এলি কোথা হতে বল তো দেখি? ই দেশের তো লোক নয় বটিস হে’।
বলুম – ‘না, আমরা কাজে এসেছি এখানে লখনৌ থেকে’।
‘তা ভালো বটে তবে কি খেলি তুরা এখানে?’
‘কই আর পেলুম কিছু খেতে?’
‘তা চল নো কেনে, আমাদের নিউ কেবিনের খানা খেয়ে লিবি। গরম মোগলাই পরোটা পাবি, বিরিয়ানি পাবি সব সব পেয়ে যাবি হে’।
‘কত দূর এখান থেকে? আমাদের যে গোমোর ট্রেন এসে যাবে আর সঙ্গে জিনিষপত্র সব নিয়ে যাবই বা কি করে?’
‘আজ ট্রেন তো অনেক লেট আছে বটে হে, জিনিষগুলাকে মাস্টারের ঘরে রেখে দিয়ে চল নো কেনে। যা, ...তবে আমি যিব নি মাস্টারের সামনে, তা বটে’।
আমি চঞ্চলের মুখের দিকে তাকালুম, সে ঘাড় নাড়তে উঠে পড়লুম আমি।
স্টেশন মাস্টার বললেন –‘এখানে তো ক্লোকরুম নেই যে রসীদ দেবো তবে যদি বিশ্বাস করে রেখে যেতে চান তো রাখুন, তবে সন্ধ্যে তো হয়ে আসছে বেশি দেরি যেন করবেন না। সাতটার ট্রেন লেট হতে পারে তবে আধ ঘন্টার বেশি নয়। সাড়ে ছটার সময় টিকিট কাউন্টার খুলে যাবে, তার মধ্যে ঘুরে আসুন’।
তা জিনিষ পত্র রেখে চঞ্চলের হাত ধরে আবার পথে নামলাম সেই লোকটার পিছু নিয়ে তবে এবারে সে উল্টো দিকের রাস্তা ধরলো।
পথ একই ধরনের তবে সন্ধ্যে হয়ে আসছে বলে না কি কে জানে ট্রাকের ভিড় কম দেখে একটু ভালো লাগলো।
লোকটা সেই বিষম পথে কিন্তু যেন ছুটছিল আর আমরা শত চেষ্টা করে ও বেশ পিছিয়ে পড়ছি দেখে সে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে একটু থামছিল।
চঞ্চল বললো –‘ও কাকু, ক্ষিদে পেয়েছে বলে খাবারের লোভে পড়ে আমরা ভূল করলাম না তো? কে এই লোকটা বলো তো? আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানোর জন্যে ওর এত কিসের গরজ, তুমিই বলো না কাকু? সবাই তো বলছিলো যে জায়গাটা ভালো নয় আর সন্ধ্যে বেলাতে আমাদের কি এইভাবে একজন অপরিচিতের সাথে কোথাও যাওয়া ঠিক কাজ হচ্ছে? কোথাও তো জন বসতির চিহ্ন মাত্র নেই এই দিকে, তবে নিউ কেবিনটা কি পাহাড়ের ভিতরে কাকু না খাদানের মধ্যে?’
শুনে আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়ে থেমে গেলুম।
এগিয়ে যেতে যেতে লোকটা পিছন ফিরে দেখলো আর একটু পিছিয়ে এসে বললো-‘কি রে? তুদের কি ডর লেগে গেলো নাকি হে? আয় চলে, হুই তো এসে গেলছি।’
আমি আবার এগিয়ে গেলুম তার কথায়।
তবে চঞ্চল আবার দাঁড়িয়ে পড়লো আর নিজের হাত দুটো উঁচু করে তুললো।
আমি চমকে গেলাম দেখে।
এর মানে স্পষ্ট যে সে আর হাঁটতে পারছে না কিন্তু যে ছেলে একটুতেই লজ্জা পায় আজকাল আর বলে আমি বড় হয়ে গেছি না, সে কিনা রাস্তার মাঝে...না:, নির্ঘাৎ কিছু সন্দেহ করছে চঞ্চল।
আমি দেরি না করে নিচু হয়ে আমার পরীর দেশের রাজকুমার কার্তিক ঠাকুর ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিলাম একটানে। রোজ রাতে চঞ্চলকে কোলে নিয়ে পায়চারি করবার অভ্যাস ছিলো বলে কষ্ট হলো না আমার কিন্তু লোকটা ঘুরে দাঁড়ালো আবার আর হেসে বললো –‘ কি রে হাসা পারা ছেলা? এইটুকুন ও হাঁটতে লারলি নাকি তুই? তবে আমার মেয়া ঝিমলিকেই ডাকি না হয় আর সে এসে তুরে কোলে করে লিয়ে আসুক কি বলিস তুই?... হ্যা : হ্যা : হ্যা ’
চঞ্চলের মুখ ছিলো আমার পিছন দিকে।
সে আমার কানে ফিস ফিস করে বললো –‘কাকু, সাবধান, সত্যি কিন্তু আরেকজন ও আসছে এবার আমাদের পিছন থেকে আর সে মনে হয় একটা মেয়ে হবে। ...তবে ঠিক যেন হাওয়াতে ভর করে চলে আসছে সে। এরা কারা সব কাকু? মানুষ তো? এই লোকটাই বা তখন স্টেশান মাষ্টারের সামনে যেতে রাজী হ’ল না কেন, কাকু? চিনে ফেলতে পারে এস০এম০, এই ভয়ে কী? আমার না বেশ ভয় করছে এবারে’।
আমি কিছু বলবার আগেই পিছন থেকে তীক্ষ্ন নারী কন্ঠে প্রশ্ন হলো –‘কে রে তুরা? তুর সাথের এই ছেলাটাতো তো ভারী হাসাপারা বটেক হে। দে কেনে আমারে। আমি উরে কোলে করে লিয়ে যিব। আমার বড় পছন্দ হয়ে গেলেক, আমি ইটিরে বিহা করি লিবো হে’।
বেগে ঘুরে দাঁড়ালুম।
তাকে দেখে একটা আদিবাসীদের মেয়ে বলে মনে হলো আমার। রেগে গিয়ে বললাম –‘কে রে তুই? তুই তো একটা বিশ কি পঁচিশ বছরের ধাড়ী মেয়ে আর এই বারো বছরের বাচ্ছা ছেলেটাকে তুই এসেছিস বিয়ে করতে? খুব যে শখ হয়েছে তোর?’
সে হিঃ হিঃ … করে হেসে বললো ‘হবেক লাই কেনে রে? তুর ছেলাটো এত ভালো বটে, যে চোখ ফিরাতে লারছি হে। এমন ছেলা তো ই দেশে লাই যে.রে।.. আর এত বড় ছেলার বিহা হবে নাই কেনে রে?’
‘আমাদের ঘরে তো দশ বছরের ছেলাদের ও বিহা হয়ে যায় অনেক বড় বড় মেয়াদের সাথে। কুনো.দুষ নাই । আমাদের ঘরে যে বিটা ছেলা কম রে। সব খাদানে কাম করতে যেয়ে মরিয়ে যায় চাপা পড়ে। আর তুর ছেলাটো বাচ্ছা কোথায় বটে হে?’
ই তো দেখি বেশ বড় হঁয়ে গেলছে। আমি আজই উরে বিহা করে লিবো …দে তো দেখি উরে’।
‘আমার বড় বুনের তো বিহা হইছে, একটা নয় বছরের ছেলার সাথে। তা জানিস তুই? দে তুর ছেলাটোকে উরে আমি কোলে করে লিয়ে যিব’।
ব্যাস, শুরু হলো সেখানে চঞ্চলের দুধ সাদা হাত ধরে তার দারুণ টানাটানি। সে কি কান্ড রে বাবা? আমার কোলে না থাকলে চঞ্চল যে বেহাত হয়ে যেত, এতক্ষণে তা নির্ঘাৎ সত্যি কথা। হয়তো এমনিধারা কিছু একটা আন্দাজ করেই চঞ্চল আমার কোলে উঠেছিলো।
তবে সেই টানাটানি থামলো মেয়েটার গায়ে জড়িয়ে রাখা লাল শাড়িখানা টানাটানিতে খুলে যেতেই ।
তখনি সেই লোকটা ঝিমলি বলে ডাকলো আর সে গায়ে কাপড়টা জড়াতে জড়াতে ‘যিছি …যিছি’…বলে ছুট দিলো।
আমার দিকে একটা অগ্নি দৃষ্টি হেনে সে চলে গেল তারপরে।
চঞ্চল ভয়ে ভয়ে বললো –‘কাকু, ওই মেয়েটা কে? ও আমাকে বিয়ে করতে চাইছিলো কেন? কাকু, চলো , আমরা ফিরে যাই না হয়, এই জায়গা বা এখানকার লোকজন কেউ তেমন সুবিধের নয় মনে হয়’। আমি ওকে কেন বিয়ে করব, কাকু? বয়ে গিয়েছে আমার।’
‘তবে তাই যাই চলো’ বলে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।-
তখনি সেই লোকটা এগিয়ে এসে অষ্পষ্টস্বরে বললো –‘আরে তুরা আয়, নিউ কেবিন তো সামনেই। আয় ঢুকে পড় এই খান দিয়ে। খেয়েঁ লে, আমার নতুন কেবিনের নতুন খাবারটো’।
লোকটার ডাকে আমি এগিয়ে গিয়ে একটা ভাঙ্গা মতন দরজা দিয়ে ঢুকে একটা প্যাসেজ ধরে এগিয়ে গেলুম আর খানিক যেতেই সেই সুড়ঙ্গের মতন জায়গা পার হয়ে দেখি সত্যিই এক ঝকঝকে কেবিন। সেখানে .হ্যাজ্যাক বাতি জ্বলছে। সামনে চেয়ার টেবিল সাজানো আর টেবিলে দু’টো বড় থালা রয়েছে ঢাকা দেওয়া ।.জলের গেলাস ও রয়েছে। ভাল খাবার জায়গা করা হয়েছে। তবে আমাদের সন্দেহ নিছক।
লোকটা এসে বললো –‘লে তুরা বসে পড় আর পঞ্চাশটো টাকা আগে দিয়ে দে আমারে, আমার কাজ আছে, ইখানে বসে থাকতে লারবো হে’।
চঞ্চলকে এইবার নামিয়ে ছেলেটার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখে অন্য হাতে পকেট থেকে টাকা বার করে তাকে দিলুম আমি।
লোকটা হনহনিয়ে ভিতর দিকে চলে গেলো বাইরে না গিয়ে আর ঢাকা খুলে চঞ্চল বলল-‘কাকু, এই দেখো কি সুন্দর গরম মোগলাই পরোটা। বিরিয়ানি ও আছে। গরম গরম সব খাবার, কিন্তু…’….আর তারপরেই সে চুপ হয়ে গেলো হঠাৎ।...
‘কিন্তু কি চঞ্চল? খাবার তো ভালোই, বসে পড়ছি আমি। সত্যি খুবই ক্ষিধে পেয়েছে’।
‘দাঁড়াও, কাকু। একদম না। এইখানে বসে খাওয়া যাবে না কিছুই কাকু। ওপর থেকে আমার গায়ে এসে কি যেন পড়লো, ঝুপ করে। আর ওই লোকটাই বা কে? ও বাইরে না গিয়ে আরো ভিতরে চলে গেলো? এখানে কি কোনো মানুষ থাকে, কাকু? আমাদের এখান থেকে এখনি চলে যেতে হবে মনে হয় কাকু। তুমি আমার হাত ছাড় একটু, আমি দেখছি’।
চঞ্চল পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের ভাঁজ করা ক্যারিবাগ বার করে বললো –‘কাকু, সব তো শুকনো মতন খাবার, নষ্ট হবে না। আমি এই ব্যাগে সব ভরে নিচ্ছি। এই হয়েছে। ...এবারে ফিরে চলো তো তাড়াতাড়ি, কাকু’।
আমি তখন ও কিছু না বুঝলে ও চঞ্চলের প্রবল সিক্সথ সেন্স নিশ্চয় কোন আসন্ন বিপদের সংকেত আবার ওকে দিয়েছে তাই তর্ক না করে চঞ্চলের হাত ধরে আমি যে পথে এসেছিলাম সেই পথে ফিরে চললুম । বেশী সুন্দর ছেলে মেয়েদের মধ্যে কিন্তু অনেকের এই জিনিষ থাকে, তা জানি আমি।
কিন্তু এবারে আমার মাথায় এসে পড়লো ঝুপ করে ভিজে ঠাণ্ডা মাটির ছোট চাপড়া একটা।
ওরে বাবা, এত মাটি পড়ছে কেন? আর ওই লোকটাই বা কে? কোনো কয়লা শ্রমিক হ’তেই পারে তবে সে ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে গেলো কোথায় তা বলা কঠিন আর এদিকে আমরা যতই তাড়াতাড়ি করেএগিয়ে যাচ্ছি, দরজার কাছে ও গিয়ে উঠতে পারছি না তখন অব্দি কেন যে তা ও বুঝতে পারছিলাম না। মাটি ও পড়ছে সমানে।
হঠাৎ পিছনে কারো পায়ের শব্দ পেলাম অন্ধকারের মধ্যেই।
কেউ আসছে ।
আমি চঞ্চলকে নিয়ে একপাশে সরে গিয়ে থেমে গেলুম কিন্তু কই….কেউ এলো না দেখে তখন আবার চলা শুরু করলাম।
আবার একটু পরেই সেই কান্ড হ’ল। বেশ মজা তো।
অনেক সময় পরে সামনে দরজার দেখা পেলুম আমি।
তখন বাইরে বেশ অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে বলে দূর থেকে বাইরের আলো চোখে পড়ে নি আগে।
আবার পিছনে কেউ ছুটে আসছে বলে মনে হলো আমার। আমি আবার থেমে গেলাম আর চঞ্চলকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
সাবধান না হলে বিপদে পড়তে হতে পারে, মনে হচ্ছে তখন বেশ।এই জায়গাটা বড় ভাইবব্রেটিং বা আনস্টেবল মনে হচ্ছে।
ঝপ্পাস করে তখনি আমার গায়ে বেশ বড় এক চাপড়া মাটি এসে পড়লো।
সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে কেউ ছুটে এসে আমার পাশ কাটিয়ে গিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়লো।
তখনি কেউ তীক্ষ্ণ নারী কন্ঠে বললো বাইরে থেকে –‘ কি রে? তুরা না খেয়ে পালিয়ে এসে ভাবছিস বুঝি বেঁচে যিবি ইবারে? আমার বাপটো তো মরলেক খাদানে রাতে কাম করতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে আর তু তো লারলি এসে সব জেনে লিয়ে ও দু’টি সরকারী পয়সা পাইয়ে দিতে। ইবারে যদি প্রাণটো লিয়ে ফিরে যেতে চাস তবে আমারে দিয়ে দে তুর ছেলাটোকে ।.কি রে দিবি?’
‘না’
‘তবে মর কেনে ইখানে তুরা দু’জনেই চাপা পড়ে’।
‘সঙ্গে সঙ্গে কেউ বাইরে থেকে টেনে দরজাটা বন্ধ করে ঝনাৎ করে শিকল তুলে দিলো। সামান্য যে আলোটুকু ছিল তাও মিলিয়ে গিয়ে ঘোর অন্ধকারে ভরে গেলো জায়গাটা।
চঞ্চল ভয়ে ভয়ে বললো ... ‘ও কাকু, আবার ঝপ করে মাটি পড়লো আমার মাথায় আর দরজা ও তো বন্ধ করে দিলো ও বাইরে থেকে। কি হ’বে ? তুমি আমাকে দিয়ে দিলে না কেন কাকু? হয়তো তোমার প্রাণটা বেঁচে যেত কাকু, তা’হলে। ও কি বললো শুনলে তো? ওর বাপ নাকি মারা গিয়েছে মাটি চাপা পড়ে খাদানে। তবে আমাদের কে নিয়ে এলো সঙ্গে করে খাবারের লোভ দেখিয়ে, কাকু? এখন আমাদের ও কি মাটি চাপা পড়ে মরতে হ’বে এখানে নাকি?’
বাইরে তখন কেউ হি:হি:হি: করে হেসে উঠে দ্রুত পায়ে চলে গেলো বলে মনে হলো আমার।
ব্যাপার যে মোটেই সুবিধের নয় সেটা বলাই বাহুল্য তখন।
ক্ষিধের মুখে খাবারের লোভ দেখিয়ে আমাদের যে অনিষ্ট করবার জন্যে নিয়ে আসা হয়েছে তা’তো বেশ বোঝাই যাচ্ছে।
বললাম-‘ছি: চঞ্চল, আমি কি কাপুরুষ যে নিজের প্রাণের দায়ে ছেলেকে দিয়ে দেবো অন্যকে? তুমি দাঁড়াও, আমি দেখছি দরজার অবস্থাটা কি? তবে আমার হাত ধরে থেকো তুমি সবসময় কিন্তু কেননা এই ঘোর অন্ধকারে একবার হারিয়ে গেলে কেউ কাউকে খুঁজে যে আর পাবো না তা কিন্তু ঠিক কথা ’।
হাত বাড়িয়ে আন্দাজে দরজা স্পর্শ করে বুঝলাম যে পুরনো হলেও দরজাটা বেশ মজবুত আর গায়ের জোরে ভেঙ্গে বাইরে যাওয়া যাবে না । উল্টে বেশি ধাক্কা ধাক্কি করলে হয়তো এখনি গোটা ছাদটাই আমাদের মাথায় ভেঙ্গে পড়বে।
চঞ্চল এক হাতে আমার হাত ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে মোবাইল বার করতে চেষ্টা করছিলো তখন। তা বোঝা গেলো সে টর্চ অন করতেই।
‘কাকু, টাওয়ার নেই বলে কথা না বলা গেলেও আলো পাওয়া যাবে আমার মোবাইল থেকে বেশ কিন্তু চারদিকেই যে সমানে ঝুর ঝুর করে মাটি পড়ছে এখন’।
আমি কোন উত্তর না দিয়ে নিজের ডান পায়ের বুট জুতোটা একটু উঁচু করে তুলে তার হিলটা ধরে এক মোচড় দিলাম। ঘুরে গেলো হিল, আর তার থেকে টেনে বার করে আনলাম আমি একটা সরু তারের মতন বস্তুকে। বিদেশী আয়রন কাটার। দাদার আমদানি কিন্তু তার শক্তি জানা নেই আমার তখন পর্যন্ত।
সাহস করে আমি সেটা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে টেনে দরজাটাকে একটু ফাঁক করে ধরে শিকলের ওপর দিয়ে গলিয়ে দিয়ে দুই ধার ধরে ঘষতে শুরু করলাম ।
দশ ...বিশ ...তিরিশ সেকেন্ড ...সময় কাটছে আর মাটি পড়া ও বাড়ছে। কেমন একটা ঘর ঘর করে জোর শব্দ ও শুরু হয়েছে মাথার ওপরে সেই সাথে।
মনে হয় আমাদের চির সমাধি লাভের মহেন্দ্র ক্ষণ উপস্থিত।
ঝনাৎ করে দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল শিকল।
দরজা খুলে ফেলে আবার জুতোর মধ্যে যন্ত্রটাকে রাখতে রাখতে বললাম –‘চঞ্চল, বি কুইক, লাফ দাও বাইরে এবারে কেননা হয়তো আর সময় নেই। ...ওয়ান টু থ্রী…’
দু’জনেই একসাথে লাফ দিলুম।.তবে চঞ্চল মোবাইল আর খাবারের প্যাকেট ছাড়ে নি আর দরজা থেকে মাটি অনেকটা নিচুতে । চঞ্চল পড়লো আর আ: বলে আর্তনাদ করে উঠলো। আবছা অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলাম না আমি প্রথমে।
আমি উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে সেই ঘরের মধ্যে হুড়মুড় দুড় মুড় ধড়াম ধাই করে বিষম জোর শব্দ হ’লো একটা।
সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যে আমি চঞ্চলকে আগে খুঁজে নিয়ে ধরে তুললাম।
তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আলো ফেলতে সেই ঘরের মধ্যে যে দৃশ্য দেখা গেলো তা‘তে আমার দু’চোখ চড়ক গাছে উঠে গেল সাঁৎ করে।
কোথায় ঘর?
একটা ওপেন পিট বা খোলা খাদানের মুখ বলে মনে হলো সেটা, যার মুখ শক্ত কাঠের দরজা লাগিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল অনেক দিন আগেই হয়তো।
ভিতরে যে সুড়ঙ্গ মতন পথ ছিলো তা তখন মাটি আর পাথরে একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে কেননা গোটা ছাদটাই ভেঙ্গে পড়েছে নীচে।
একটু এগিয়ে দেখলাম যে শিকলের ওপরের অংশে একটা তালা ও ঝুলছে যদি ও আমি সেই মেয়েটার হাতে তালা দেখিনি কোনো আর তালা বন্ধ করবার শব্দ ও শুনিনি।
এ কি রহস্য রে বাবা?
চারদিকে কি আছে দেখবার জন্যে আলো ঘুরিয়ে ফেলতেই দেখি একটা বহু পুরনো মরচে ধরা বোর্ডে লেখা আছে – ‘পরিত্যক্ত বিপদ জনক খনি অঞ্চল’ ...’সাবধান’
আর তার নিচে বিপদ সংকেত আঁকা ...একটা মড়ার মাথার খুলি আর তার নিচে ক্রস করা দুটো হাড়।
চঞ্চল কম্পিত স্বরে বললো-‘ও কাকু, এ’তো অনেক পুরনো পরিত্যক্ত খনি আর দরজাও বন্ধ ছিলো তালা দিয়ে। তবে আমরা ওর মধ্যে গিয়ে ঢুকেছিলাম কি করে বলো তো?’
আমি বললাম –‘ হয়তো অন্য কোনো পথ আছে এর, সেই পথেই গিয়েছিলাম সেই লোকটার পিছনে তবে এখন এই অন্ধকারে তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু এক মুহূর্ত সময় আর এখানে থাকা ও ঠিক নয় আমাদের পক্ষে...শিগগির চলো’।
বলেই আমি চঞ্চলের হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে গেলাম আন্দাজে যে দিক দিয়ে এসেছিলাম বলে মনে হ’লো।
প্রায় দৌড়ে আমরা অনেকটা পথ চলে এলাম মোবাইল টর্চের আলোতে তবে স্টেশন যে কত দূরে তা তো জানা নেই আর চঞ্চলের গতি ও বেশ মন্থর হয়ে গেলো তখন।
জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে পায়ে তখন বেশ চোট লেগেছিলো ছেলেটার নীচে লাফিয়ে পড়ে আর সেই জন্যেই ব্যথায় সে হাঁটতেও পারছে না আর তখন।
আমি কাল বিলম্ব না করে নীচু হয়ে ছেলেটাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে একটানে কোলে তুলে নিয়ে ছুট লাগলাম বিনা বাক্য ব্যয়ে। চঞ্চল আলো ফেলতে লাগলো পথে।
অনেকক্ষণ পরে দূরে জাগলো আলোর চিহ্ন।
তবে হয়তো স্টেশনে লাইট এসে গিয়েছে।
যখন সেখানে গিয়ে হাজির হলাম আমরা তখন ঘড়িতে সাতটা বেজে গিয়েছে।
চঞ্চল বললো-‘যা: কাকু, তবে তো গাড়ী চলেই গিয়েছে, ...কি হবে?’
আমি হাঁফিয়ে গিয়েছিলাম বেশ। উত্তর না দিয়ে গিয়ে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। .
..
জানা গেলো ট্রেন তখন ও এসেই ওঠে নি তবে সিগন্যাল হয়ে গিয়েছে ।
দু’টো টিকিট কেটে নিলাম আমি বারো টাকা দিয়ে আর স্টেশন মাস্টারের ঘর থেকে
জিনিষ পত্র নিয়ে এসে আবার প্লাটফর্মের সেই বেঞ্চে গিয়ে বসলাম আমরা।
চঞ্চল এত কান্ডের মধ্যে ও খাবারের ব্যাগটা ফেলেনি।
এইবারে সে সেটা খুলে খাবার বার করতে বসলো কিন্তু পরক্ষনেই বলে উঠলো –‘ ও কাকু, এ সব কি খাবার দিয়েছে তোমার নিউ কেবিনে? এই কি মোগলাই পরোটা নাকি? আর বিরিয়ানিই বা গেলো কোথায়? এ সব তো দেখি মাটি না কাদা দিয়ে তৈরী খাবার আর তেমনি বাজে গন্ধ পচা পাঁকের মতন কাকু।...এ কি করে খাওয়া যাবে, ও কাকু?’
আমি একটু গন্ধ শুঁকতেই কেমন যেন গা ঘুলিয়ে উঠলো আমার।
টান মেরে সব রেলের লাইনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে এলুম আমি তখুনি।
দূরে ইঞ্জিনের আলো দেখা দিয়েছে তখন আমাদের গাড়ির।
ঝম ঝমা ঝম শব্দে এসে দাঁড়ালো চোপন প্যাসেন্জার ট্রেন।
যে কোচ সামনে পেলাম, তাইতে উঠে বসলাম আমরা।
ট্রেন ছেড়ে দিলো।
চন্দ্রপুরা জংশন পার হয়ে তবে গোমো আসবে, মধ্যে দু’তিনটে স্টেশন পড়ল। কি তেলো, ভান্ডারীদহ না কি সব নাম ঠিক পড়তে পারলাম না আমি।
রাত সাড়ে ন’টার পরে গিয়ে গোমোতে দাঁড়ালো ট্রেন।
জানা গেলো যে রাত দশটাতে আসবে ধানবাদ থেকে বেনারস গামী ট্রেন।
আমরা তাড়াতাড়ি চার নম্বর থেকে ছয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে হাজির হ’লাম কিন্তু ক্ষিধেতে পেট জ্ব্লছে। তাই একটা ভেন্ডারের কাছ থেকে মিনারেল ওয়াটার, অরেঞ্জ জুস, মাখন, পাঁওরুটি, চকলেট স্যান্ড উইচ, কেক যা পেলুম গিয়ে কিনে এনে চঞ্চলের হাতে দিলুম। প্রথমে জল।