শেষদেখা !

ইচ্ছা (জুলাই ২০১৩)

মোঃ ইয়াসির ইরফান
  • 0
  • ২৯
ভাইজান, অ ভাইজান উঠেন না । আর কত ঘুমাবেন !
রহিমার মা'র ডাক উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য । অগত্য, তাই ইরফান কে ঘুম থেকে উঠতেই হল । চোখ দুটো খূলতেই চাইছে না, তবু বহু কষ্টে খুলতে হল । দেয়াল ঘড়িতে প্রায় এগারো টা বাজি বাজি করছে । হাই তুলতে তুলতে বলল, কি রহিমা'র মা সব ভাল । আজকে তো বোধহয় দেরীতে এলে !
জ্বী ভাইজান, আজ তো হরতাল । ছুটির দিন । তাই একটু দেরীতে আসলাম ।
অ ।
ভাইজান, তাড়াতাড়ি উঠেন । ঘরটা ঝাড়ু দিতে হবে । কি অবস্থা করে রাখছেন, মনে হচ্ছে এই ঘরে পিকেটার আর পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-ধাওয়ি হয়ে গেছে ।
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল ইরফান । বলল, তা যা বলেছ রহিমা'র মা । হোঃ হোঃ করে হাসতে হাসতে উঠে বাথরুমের দিকে পা বাড়াল ইরফান । বাথরুমে গিয়েও উচ্চস্বরে হাসতে থাকে ইরফান ।

এই রহিমা'র মার রসবোধ প্রবল । দীর্ঘদিন ধরে ব্যাচেলরদের এই বাসায় কাজ করছে সে । এখানখার ছেলেদের সে সন্তানতুল্য স্নেহ দিয়ে থাকে । আর ছেলেরাও তাকে মাতৃস্থানীয়ার মত শ্রদ্ধা করে । কিন্তু সম্বোধনটা ভাইজান আর রহিমা'র মা কেন তা কেউ বলতে পারবে না । কিভাবে যেন এটাই হয়ে গেছে ।
রহিমা'র মা প্রায় সময় সকলের সাথেই হাস্য-পরিহাস করে । এজন্য ছেলেরাও তাকে আরো বেশী পছন্দ করে, ভালবাসে । একবার এক ফার্মেসীতে গেল ওষুধের জন্য । তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল কি চাই, সে লোকটির হাবভাব দেখে বলল- কচু । লোকটি হতভম্ব হয়ে বলল, মানে কী !
রহিমা'র মার শান্ত উত্তর, ওষূধের দোকানে মানুষ কি জন্য আসে ! যারা তাকে জানে তাদেরই ভিরমি খেতে হয়, আর ঐ বেচারা তো কিছু জানেও না ।
আরেকবার মাসুদের পরীক্ষা চলছিল, তাড়াহুড়া করায় জুতা খুজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, রহিমা'র মা আমার জুতাগুলা কোথায় দ্যাখছ ?
ব্যস, সেটাই কাল হলো মাসুদের জন্য ।
রহিমা'র মা বলল, জ্বী ভাইজান দেখছিলাম । আমি সিড়ি দিয়ে উঠার সময় নেমে যেতে দেখছিলাম ।
দেখ, রহিমা'র মা পরীক্ষায় যাওয়ার সময় এসব ভাল লাগে না ।
আমার তো খুব ভাল লাগে, আর কি ! জুতার তো আর ঠ্যাং গজায় নাই, জুতা যেখানে থাকার কথা সেখানেই তো থাকবে । পরে নিজেই বের করে দিল । দেখা গেল জুতা মাসুদের সামনেই ছিল । তাড়াতাড়ি করায় পাচ্ছিল না ।
খুজে দিয়ে রহিমা'র মা বলল, এই দ্যাখেন ভাইজান । জুতা আপনার দিকে তাকায় আছে, আর আপনি জুতারে দেখতাছেন না ।
অন্যরা তো আগে থেকেই রহিমা'র মার কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছিল । শেষ কথায় চিন্তাগ্রস্থ মাসুদও হেসে দিয়েছিল । এমনই রসিক মহিলা এই রহিমা'র মা ।
প্রতিদিনই এমন নানা হাসির ঘটনায়, কথায় মুখরিত থাকে বাসাটা । আর তার সিংহভাগ কৃতিত্বই রহিমা'র মার । মানুষের সুখ-দুখ, ভাল-মন্দ, হাসি-কান্না সব কিছু নিয়েই রসিকতা করে যেতে পারে, একটুও আটকায় না ।

ইরফানকে গোসল করে বের হতে দেখে রহিমা'র মা বলল, ভাইজান টেবিলে নাস্তা ঢেকে রাখা আছে ।
মাসুদ, শফিক কোথায় ? কাদের ভাই কি এখনো ঘুমাচ্ছে নাকি !
মাসুদ ভাইজান নীচে খেলতেছেন, আর শফিক ভাইজান গেছেন বাজারে । আজকে নাকি এসপেশাল(স্পেশাল) রান্না হবে । কাদের ভাইজান তো খাইদাই আবারো ঘুম মারতাছেন ।
অ, কাদের ভাই তো ছুটির দিনে ঘুম মারা ছাড়া কোন কাজ পারে না । তা তোমার এসপেশাল (!) রান্নাটা কী ?
আগে ভাইজান বাজার আনুক, তারপর বলতে পারব ।
নাস্তা খেতে বসে ইরফান মোবাইল অন করল । গত রাত থেকে ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিল ।
অন করার সাথে সাথেই দেখল একের পর এক মিসড কল এলার্ট আসছে । প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ টার মত হবে । কোনটা আম্মার, কোনটা আপার, আবার ছোট মামারও আছে ।
এই অবস্থা দেখে ভীষন অস্থির হয়ে পড়ল ও, ফোনে টাকাও নাই । কি করা যায় !
ভীষন অস্থির হয়ে পড়ল ইরফান । সাত-পাঁচ ভাবার আগেই ও দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে মাসুদ কে ডাকতে শুরু করল । মাসুদ তখন ব্যাটিং করছে । ওর ডাক শুনে চিৎকার করে বলল, ইরফান ভাই 'রাইটহ্যান্ডার তামিম' ব্যাট করছে । ডিষ্টার্ব করিয়েন না ।
'রাইটহ্যান্ডার তামিম' হল একটা কোড । অর্থাৎ উত্তর দিকের চারতলা বিল্ডিংটার দ্বিতীয় তলায় লাইলী দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান একটু ঘুরেই দেখল এলোচুল আর ওড়নার মাথা দেখা যাচ্ছে । অতএব হাজার ডাকেও মাসুদকে নড়ানো যাবে না ।
এই লাইলী-মজনুর প্রেম দীর্ঘ তিন বছর ধরে চলমান । আজ পর্যন্ত কেউ কারো সাথে ভাল করে কথাও বলে নাই , অথচ মাসুদ বলে ওরা নাকি চোখের ভাষা বোঝে । কি সব আজাইরা কথাবার্তা ! ওরা যেন এ যুগে নয়, এখনো সেই যুগে বসবাস করছে ! আর 'রাইটহ্যান্ডার তামিম' নামটা ওর নিজেরই দেয়া । তামিম ওর ফেভারিট ব্যাটসম্যান । কিন্তু মাসুদ বেচারা ব্যাট করে ডান হাতে । তাই নাম নিল রাইটহ্যান্ডার তামিম !
মাসুদ কে দেখে কে বলবে, ও ইন্টার্নি করছে । পরীক্ষা ছাড়া পড়ার টেবিলে ওকে দেখায় যায় না । প্রায় সময় আড্ডাতেই কাটিয়ে দেয়, ছুটির দিনে আশেপাশের বিল্ডিংয়ের ছেলেদের নিয়ে ক্রিকেট শুরু করে দেয় । ক্রিকেট যে খুব একটা ভাল খেলে ব্যাপারটা তেমন না । খেলোয়াড় বেশীর ভাগই বাচ্চা । তাই বড়ভাই সুলভ প্রভাব কাটিয়ে ইচ্ছেমত ব্যাটিং করে ও । এমনিতে খেলা পরিচালনাতেই বেশী মনযোগী দেখা যায় মাসুদকে । কিন্তু উর্বশী লাইলী (!) কে দেখলেই ওর বীরত্ব দেখাতে ব্যাটিং করতে শুরু করে । আর খেলার সময় হৈ-হল্লা চিল্লা-ফাল্লা করে এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যে, আশেপাশের বিল্ডিংয়ের ব্যালকনি, জানালার পাশ ইত্যাদি জায়গা গুলো গ্যালারী মতন হয়ে যায় ।
ইরফান ভেবে পায় না, বীরত্ব দেখাতে ব্যাটিং কেন, বোলিং নয় কেন ! তবে কি আমরা শাসন করতেই বেশী ভালবাসি !
ভাগ্যিস, ফারিয়ার বাসা এই এলাকায় পড়ে নাই, নয়তো ইরফানের সাথে মাসুদের ভালই ফ্যাসাদ হতে পারত । দুই মজনুই তো চাইত স্ব স্ব লাইলীকে ইমপ্রেস করতে !

অন্য সময় হলে উর্বশীকে দেখে ইরফান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখত । মাসুদের ছেলেমানুষী ছোটাছুটিতে বিস্তর মজা নিত । কিন্তু এখন সময়টা ভিন্ন । চাইছিল, মাসুদকে ডাক মেরে বলে মোবাইলে কিছু টাকা ইজিলোড করে দিতে । ছেলেটাকে তো এখন নড়ানো মুশকিল ! কি করবে কিচ্ছু ভেবে পায় না, ও । দরদর করে ঘামছে ইরফান । এতগুলা কল কি জন্য ! কোন অঘটন ঘটে নাই তো ... । তুফান বয়ে যাচ্ছে দেহের উপর দিয়ে । কি যে করবে...। আর ব্যালান্স নীল হওয়ারও আর সময় পেল না ।
একছুটে কাদের ভাইয়ের রুমে গিয়ে মোবাইলটা তুলে নিল ইরফান । সহজে কেউ কাদেরের রুমে আসে না, ওর জিনিসপত্র খুব একটা ছোয় না । সিনিয়র ভাই হওয়ায় প্রায়ই একটা ভাব নিয়ে থাকে কাদের । তাই ওর ধারে কাছে কেউ ঘেঁষতে চায় না, ওকে ঘাটাতেও চায় না । তবে এখনখার পরিস্থিতি ভিন্ন । কাদেরের মোবাইল হাতে নিয়েই আরেক ধাক্কা খেল ইরফান । ব্যালান্স আছে এক টাকা তিয়াত্তর পয়সা । ভাগ্যি আর কাকে বলে ! উপায় না পেয়ে তাতেই শফিককে ফোন করে বসল ইরফান ।
-হ্যালো শফিক, ভাই আমার নাম্বারে কিছু টাকা ইজিলোড করে দাও তো ।
-আরে ইরফান ভাই, আপনি ! কাদের ভাইয়ের ফোন থেকে কেন ! আপনারটা......
-এত কথা বলার সময় নাই, তুমি যত তাড়াতাড়ি পার আমারটাতে রিচার্জ করে দাও ।
-ভাইয়া, আমার হাতে আছে চল্লিশ টাকা । মাংসের মশলা আর ধনেপাতা নিতে হবে । আজকে স্পিশাল রান্না হবে । আপনার ফেভারিট গরুর গোস্ত আর চিংড়িও থাকবে, সাথে ডিম-সালাদ তো আছেই ......।
-যা লাগে ঐ সব পরে আনবা । এখন বার, পনের যা হোক একটা রিচার্জ করে দাও । ভেরী আর্জেন্ট ।
-শফিক হাসি হাসি করে বলল, কেন ভাইয়া ফারিয়া আপা ফোন দিয়েছিল নাকি ! মেয়েদের এক-আধটু অভিমান.........
-শফিক্যা তোরে আমি.........
তখনি রিং বেজে উঠে ইরফানের মোবাইলে । ও ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই, আপার নাকি(কান্নামাখা) আওয়াজ পায় ।
-কিরে ভাই, তুই কোথায় ছিলি ? আমরা কখন থেকে তোকে ট্রাই করছি ।
-আহ আপা ! ফ্যাচফ্যাচ কান্নাটা বন্ধ করে কি হয়েছে বল তো ।
-কি আর বলব, ভাই । বলার কি আর কিছু বাকী আছে ।
-আরে কি জ্বালা । আপা, তুমি থামবে । পরিস্কার করে বল না কি হয়েছে !
-আমাদের সব শেষ .........। ফোনটা ছোটমামা এক ধমক দিয়ে কেড়ে নিল ।
হ্যা, ইরফান শোন ।
-মামা বলেন । কি হয়েছে, আপা এভাবে কাঁদছে কেন ?
-আরে এই মেয়েদের কথা আর বলিস না তো । প্রয়োজনের সময় ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না ছাড়া এদের আর কোন কাজ নাই । তুই কি এখন বাসায় ?
-জ্বি মামা । হরতাল তো তাই বন্ধ ।
-শোন, তোর আব্বাকে আমরা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসেছি ।
-সে কী !
-গত রাতে হঠাৎ খারাপ লাগায় মেডিকেলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলে তোর আব্বা ভর্তি হতে চান নি । উনার একটাই কথা, -আমাকে গ্রামে নিয়ে চল । তো আজ ভোরে পৌছলাম । তোকে সেই রাত থেকে ফোন করে যাচ্ছি, লাইন পাচ্ছি না ।
-এখন কি অবস্থা !
-অবস্থা বিশেষ সুবিধার না । তোর বড় মামার বন্ধু ডাঃ হাছান দেখছেন । একটু পরপর সেন্সলেস হয়ে পড়ছে । আর তোকে খুব করে দেখতে চাচ্ছে ।
ইরফানের দু'চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছে । সে কথা বলতে পারছে না । কথা বলতে গেলেই গলা ধরে আসছে ।
-মামা, আমি এখন কী করব ! কিভাবে আসব ।
-এই তোর আপার মত ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবি না তো । পুরুষ মানুষের চোখে জল মানায় না । আল্লাহর উপর ভরসা রাখ । ইনশাআল্লাহ একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই ।
-হরতালে গাড়ী পাব কোথায় ! এখান থেকে চট্টগ্রাম তারপর আবার গ্রামের বাড়ি । প্রায় ৮-১০ ঘন্টার জার্নি । অন্তত ততক্ষন আব্বাকে আপনারা রাখতে পারবেন না, মামা ।
-কি যা তা বলছিস ।
আওয়াজ নেই । একদম চুপচাপ ।
-ইরফান, এই ইরফান …….. । কয়েক মূহুর্ত পর ছোট মামা বললেন, ইরফান চিন্তার কিছু নাই । চিন্তা করিস না বাবা । দেখ চেষ্টা করে, আল্লাহর রহমতে কোন না কোন ব্যবস্থা অবশ্যই হবে ।
-ইরফান, তুই শুনছিস তো …... ! আমার কথা বুঝতে পারছিস তো …... ।
-মামা, রাখি তাহলে ।
-হুম রাখ ।
-আল্লাহ হাফেজ ।
-আচ্ছা ।
কথা শেষ করে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকল ইরফান । ঘাড় ফেরাতেই দেখল পিছনে কাদের এসে দাড়িয়েছে ।
কাদেরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ইরফান সবকিছু খুলে বলল । সব শুনে কাদের কিছু সময় থম ধরে বসে থাকল । একটু ভেবে বলল, ইরফান তোমার কি ফোন-টোন করা লাগবে ? আমার অন্য ফোনে টাকা আছে ।
-না, কাদের ভাই । আপনি বরং শফিককে ফোন করে বলে দেন যে, গলির মোড়ের সুমনের দোকান থেকে আমার নাম্বারে যেন তিন'শ টাকার মত রিচার্জ করে দেয় । আমার নাম বললেই হবে ।
-গলির মোড়ের দোকান বলতে ঐ বেটে ফরসা মত ছেলেটা............ ওর নাম সুমন নাকি ! আমি তো বিশ্বাস বাবু বলে জানি ।
-হ্য, ওর নাম সুমন বিশ্বাস ।
-আচ্ছা । তো ওর নাম্বার তো আমার কাছে আছে । তুমিই ওকে বলে দাও ।

হরতালে গাড়ী পাওয়া নিয়ে সমস্যা । ইরফান বুঝে উঠতে পারছে না, কিভাবে এই সুদূর ঢাকা থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দেবে ।
অনেক ভেবে ও নজিবুলকে ফোন করল । নজিবুল ওর ক্লাসমেট ছিল । তবে এখন এক ইয়ার পিছনে পড়ে গেছে । রিলেশন টা ভালই আছে । ওর আবার পলিটিক্যাল যোগাযোগ টাও ভাল । তাই ওকে বললে কিছু হতে পারে এই আশায় ওকেই ফোন দিল ইরফান ।
-আরে, দোস্ত তুই কোত্থেকে এতদিন পর ! মনে হচ্ছে ফারিয়াকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেছস । যাই করিস মনে রাখবি এই নজিবুলই কিন্তু ফারিয়ার সাথে তোরে বেঁধে দিয়েছিল । খবর-টবর বল । তোদের প্রেমগাথা কদ্দুর হল শুনি ।
-দোস্ত, আমার আজই এখনি একটু বাড়ি যাওয়া লাগবে । ব্যবস্থা করতে পারবি ! গলায় ধলা পাকিয়ে কথা আটকে যায় ইরফানের ।
-কেন, দোস্ত বাড়িতে বউ-টউ ঠিক হল নাকি ? বিয়ে করবি ? তাহলে ফারিয়ার কি হবে ? শেষ পর্যন্ত ওরে তুই ছ্যাকা দিবি ! দোস্ত তোরে আমি.........
-আরে ওসব কিছু না । একটু আহত শোনায় ইরফানকে ।
নজিবুল সেটা বুঝতে পারে না । তাহলে কি সব কারবার । ডুবে ডুবে.........
-নজিবুল শোন, আমার আব্বার অবস্থা ভাল না । তাই......... গলা ধরে আসে । আর কিছু বলতে পারে না ইরফান ।
এইবার চৈতন্য হয় নজিবুলের । সে চুপ করে যায় । কয়েক সেকেন্ড... তারপর নজিবুলই বলে উঠে, তুই কিছু চিন্তা করিস না দোস্ত । আমি খবরাখবর নিয়েই তোকে জানাচ্ছি । লাইনটা নিজ থেকেই কেটে দেয় নজিবুল ।
আধঘন্টা পরেই নজিবুল জানায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে প্রথম বাসটা সাড়ে তিনটার দিকে ছাড়তে পারে । ও টিকেট কেটে ষ্টেষনে অপেক্ষা করবে বলে জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় ।
বাসার সবার সহযোগিতায় অতিদ্রুত যথা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে দুটার আগেই ষ্টেষনের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে ইরফান । যদিও তা মাত্র আধঘন্টার পথ ।

সাড়ে তিনটায় গাড়ী ছাড়ার কথা থাকলেও অতি সতর্কতা অবলম্বন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গাড়ী ছাড়ল চারটা কুড়ি মিনিটে । তিনটা থেকে নজিবুল টিকেট সাথে নিয়ে ইরফানের সাথে ছিল । দুপুরে খায়নি, তাই অনেক জোর করে রহিমা'র মা দুটি কলা সাথে দিয়েছে । বাসে ক্ষিধা লাগলে খাওয়ার জন্য ।
দুরন্ত গতিতে গাড়ী এগিয়ে চলেছে গন্তব্য অভিমুখে । তবু ইরফানের মনে হচ্ছে গাড়ীটা বড্ড আস্তে চলছে । সেই গাড়ীতে উঠে বসার পর থেকে চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরেই যাচ্ছে । আষাঢ়-শ্রাবণের সমস্ত জল বুঝি ওর চোখে জমা হয়েছে । ইরফান ভেবে পায় না, এত জল এল কোত্থেকে । চোখের এই অতি ক্ষুদ্র কোনটাতে এত জল কিভাবে জমে ছিল !
ইরফান ভাবে, ওর আব্বা কি মৃত্যু পথযাত্রী ? না ! এটা হতে পারে না । আব্বাকে ছাড়া ও-তো গোড়া কাটা গাছের মত । কিভাবে বাঁচবে ও, আদৌ বেঁচে থাকা যাবে ! বাঁচা যায় !
একদিকে চোখের জল অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে । অন্যদিকে কত কথা, কত স্মৃতি মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে । মনে পড়ছে অনেকদিন আগে শোনা মৃত্যু পথযাত্রী নিয়ে জোকস । একজন বলল, একটু দোয়া করো অমুক তো মৃত্যু পথযাত্রী । অন্যজনের জবাব, যাত্রা শুভ হোক । কি নির্মম রসিকতা ।
রহিমা'র মা-ও এমন রসিকতা করতে পারে । ওর কলোনীর এক মেয়ে একবার হঠাৎ এসে বলল, ছলিমের মেয়েটা মরতে বসেছে । রহিমা'র মা তৎক্ষনাত উত্তর করল, মরার জন্য আবার বসতে হয় নাকি ! বসে বসে তো কাউকে মরতে দেখি নি, চল একবার দেখে আসি ।
বিচ্ছেদ-যন্ত্রনার রসিকতা বড় নির্মম, বড় কঠিন । তবে এটা নিয়ে হাস্য-রস করা তারও চেয়ে কঠিন । সবাই এটা পারে না, সকলের সে ক্ষমতা থাকে না ।
মহান স্রষ্টা পরিস্কার বলে দিয়েছেন, "নিশ্চয় আমার দিকেই প্রত্যবর্তন করবে" । তবু বিচ্ছেদ-যাতনা সওয়া যায় না ।

বাস চট্টগ্রাম রোডে প্রবেশ করেছে । মাঠ-ঘাট পেরিয়ে ছুটে চলেছে । আর কিছুক্ষন পরেই ইরফান বাস থেকে নামবে । তারপর আবার ঘন্টা দুয়েকের জার্নি । এখন রাত এগারোটা । দুটার আগে পৌছতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না । একটু পরপর যোগাযোগ করছে । অবস্থার পরিবর্তন হয়নি । এখনো শুনতে পাচ্ছে ইরফানকে দেখার আকুতি । তারও কি কম দেখতে ইচ্ছে করছে আব্বাকে ।
ইরফান আপনমনে আউড়ে যাচ্ছে, আমি আসছি আব্বা । আর একটু অপেক্ষা করেন ।
সেই রওনা হওয়ার পর থেকে এক মূহুর্তের জন্যেও চোখের জল পড়া থামে নি ।

*****
ইকরাম সাহেবের সেন্স আবার ফিরেছে । তিনি ইরফানের বাবা । তিনি দেখছেন চারপাশে স্বজনদের ভিড় । ভিড়ের মাঝে তিনি একটা মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু সে মুখ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না । ওরা সেই কখন থেকে বলছে, সে নাকি অন দ্যা ওয়ে । কই, এখনও তো এল না । তবে কি দেখা হবে না ! একটু ছোঁয়া যাবে না । একবার চোখের দেখা ......।
ইকরাম সাহেবের মনে পড়ে যায় চল্লিশ বছর আগের এক স্মৃতি । তখন তিনি তেইশ বছর বয়সী টগবগে উচ্ছল এক যুবক । সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছেন । মহা উদ্যমের সাথে কাজ করেন । চট্টগ্রাম শহরে বাসা নেওয়া হয়নি তখন, বিয়ে আরো দূরের ব্যাপার । একমনে কাজ করেন, ফাঁকি-ঝুকি কিছুই করেন না । গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে এক মফস্বলে পোষ্টিং । এক সকালে অফিস যাওয়ার মূহুর্তে পেলেন বড় চাচার সংক্ষিপ্ত তবে জরুরী টেলিগ্রাম । তাতে যা লেখা ছিল তা তিনি কোনদিন ভুলেন নাই ।
"তোমার পিতার শারীরিক অবস্থা বিশেষ ভাল না । পত্র পাঠ মাত্র তুমি বাড়ীর অভিমুখে যাত্রা করিবে । -বড় চাচা
ইকরাম সাহেব পত্র পাঠ মাত্র বাড়ীর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন নাই । তিনি নতুন চাকরিতে যোগদান করায়, কাজটাকে প্রাদান্য দিয়েছিলেন । তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন দুপুর আড়াইটার শেষ বাসে । সবাইকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বাড়ীর পথ যখন ধরেন, ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে ।
বাড়ী পৌছেন সন্ধ্যা প্রায় সাতটা । পাঁচটার দিকেই উনার বাবা মারা যান । আর ছেলে ইকরাম পত্র পাই নাই মনে করে অপেক্ষা না করেই মাগরিবের নামাযের পর জানাযা পড়ে কবর দেয়া হয়ে যায় । তিনি যখন পৌছেন তখন সব শেষ ।
সবাই যখন সামান্য সময়ের জন্য আক্ষেপ করছিলেন, তখন তিনি ভেতরে ভেতরে ডুকরে কেঁদে অস্থির হয়ে মরছিলেন । উনার বাবাও পুত্রকে একবার দেখার জন্য ভীষন ছটফট করেছিলেন । কিন্তু দেখতে পারেন নাই ।
আজ ইকরাম সাহেবেরও ছেলেটাকে ভীষন দেখতে ইচ্ছা করছে । একটিবার কলিজায় লাগাতে মন বড় আনচান করছে । মন বলছে, আর একটুক্ষন পরেই ছেলেটা আসবে । ততক্ষন সময় পাওয়া যাবে কি না তিনি বুঝতে পারছেন না ।

চোখ লেগে আসছে, বন্ধ হয়ে পড়ছে চোখের পাতা । তিনি জেগে থাকতে চান । ছেলেটাকে একটিবার দেখার পর যা হবার হবে । এত সব ভাবতে ভাবতে তিনি আবারো কলমা পড়া শুরু করেন এবং পুনরায় সেন্সলেস হয়ে পড়েন ।


_______#####____________
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাফিসা রাফা শেষটা বেশি ভালো লাগলো না...তবে গল্পটাতে পাঠককে আটকে রাখার ক্ষমতা আছে...লেখা চালিয়ে যান...
জায়েদ রশীদ গোছান গল্প। পরিশেষে একটু ভিন্নতা আশা করছিলাম। ...রসটাও দীর্ঘায়িত হতে পারত।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন কমি-ট্রাজিক একটা গল্প। বস্তবতার ছোঁয়া আছে। খুব ভাল লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল।
মিলন বনিক গভীর বেদনার সাথে রম্য কথন আর চরিত্র চিত্রায়ন খুব সুন্দর হয়েছে..একেবারে জীবন্ত ছবি এঁকেছেন...খুব ভালো লাগলো...শুভকামনা....
তাপসকিরণ রায় শুরুর হাস্য রস ভাল লাগছিল--শেষে বড় বেদনার রেশ ছড়িয়ে গেল,ভাই ! ধন্যবাদ।
মামুন ম. আজিজ নিয়মিত লেখার আহ্বান রইল।
ইনশাআল্লাহ, চেষ্টা করব । ধন্যবাদ ।
এফ, আই , জুয়েল # চমক জাগানিয়া অনেক সুন্দর গল্প ।।
শাহ্‌নাজ আক্তার রহিমার মা কে নিয়ে লেখা টুকু বেশ লেগেছে , তবে গল্পের শেসে এসে কন্ঠটা ভারী হয়ে গেল, ..... ভালো লিখেছেন অনেক.
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।

১৫ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ১৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী