ভাইজান, অ ভাইজান উঠেন না । আর কত ঘুমাবেন !
রহিমার মা'র ডাক উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য । অগত্য, তাই ইরফান কে ঘুম থেকে উঠতেই হল । চোখ দুটো খূলতেই চাইছে না, তবু বহু কষ্টে খুলতে হল । দেয়াল ঘড়িতে প্রায় এগারো টা বাজি বাজি করছে । হাই তুলতে তুলতে বলল, কি রহিমা'র মা সব ভাল । আজকে তো বোধহয় দেরীতে এলে !
জ্বী ভাইজান, আজ তো হরতাল । ছুটির দিন । তাই একটু দেরীতে আসলাম ।
অ ।
ভাইজান, তাড়াতাড়ি উঠেন । ঘরটা ঝাড়ু দিতে হবে । কি অবস্থা করে রাখছেন, মনে হচ্ছে এই ঘরে পিকেটার আর পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-ধাওয়ি হয়ে গেছে ।
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল ইরফান । বলল, তা যা বলেছ রহিমা'র মা । হোঃ হোঃ করে হাসতে হাসতে উঠে বাথরুমের দিকে পা বাড়াল ইরফান । বাথরুমে গিয়েও উচ্চস্বরে হাসতে থাকে ইরফান ।
এই রহিমা'র মার রসবোধ প্রবল । দীর্ঘদিন ধরে ব্যাচেলরদের এই বাসায় কাজ করছে সে । এখানখার ছেলেদের সে সন্তানতুল্য স্নেহ দিয়ে থাকে । আর ছেলেরাও তাকে মাতৃস্থানীয়ার মত শ্রদ্ধা করে । কিন্তু সম্বোধনটা ভাইজান আর রহিমা'র মা কেন তা কেউ বলতে পারবে না । কিভাবে যেন এটাই হয়ে গেছে ।
রহিমা'র মা প্রায় সময় সকলের সাথেই হাস্য-পরিহাস করে । এজন্য ছেলেরাও তাকে আরো বেশী পছন্দ করে, ভালবাসে । একবার এক ফার্মেসীতে গেল ওষুধের জন্য । তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল কি চাই, সে লোকটির হাবভাব দেখে বলল- কচু । লোকটি হতভম্ব হয়ে বলল, মানে কী !
রহিমা'র মার শান্ত উত্তর, ওষূধের দোকানে মানুষ কি জন্য আসে ! যারা তাকে জানে তাদেরই ভিরমি খেতে হয়, আর ঐ বেচারা তো কিছু জানেও না ।
আরেকবার মাসুদের পরীক্ষা চলছিল, তাড়াহুড়া করায় জুতা খুজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, রহিমা'র মা আমার জুতাগুলা কোথায় দ্যাখছ ?
ব্যস, সেটাই কাল হলো মাসুদের জন্য ।
রহিমা'র মা বলল, জ্বী ভাইজান দেখছিলাম । আমি সিড়ি দিয়ে উঠার সময় নেমে যেতে দেখছিলাম ।
দেখ, রহিমা'র মা পরীক্ষায় যাওয়ার সময় এসব ভাল লাগে না ।
আমার তো খুব ভাল লাগে, আর কি ! জুতার তো আর ঠ্যাং গজায় নাই, জুতা যেখানে থাকার কথা সেখানেই তো থাকবে । পরে নিজেই বের করে দিল । দেখা গেল জুতা মাসুদের সামনেই ছিল । তাড়াতাড়ি করায় পাচ্ছিল না ।
খুজে দিয়ে রহিমা'র মা বলল, এই দ্যাখেন ভাইজান । জুতা আপনার দিকে তাকায় আছে, আর আপনি জুতারে দেখতাছেন না ।
অন্যরা তো আগে থেকেই রহিমা'র মার কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছিল । শেষ কথায় চিন্তাগ্রস্থ মাসুদও হেসে দিয়েছিল । এমনই রসিক মহিলা এই রহিমা'র মা ।
প্রতিদিনই এমন নানা হাসির ঘটনায়, কথায় মুখরিত থাকে বাসাটা । আর তার সিংহভাগ কৃতিত্বই রহিমা'র মার । মানুষের সুখ-দুখ, ভাল-মন্দ, হাসি-কান্না সব কিছু নিয়েই রসিকতা করে যেতে পারে, একটুও আটকায় না ।
ইরফানকে গোসল করে বের হতে দেখে রহিমা'র মা বলল, ভাইজান টেবিলে নাস্তা ঢেকে রাখা আছে ।
মাসুদ, শফিক কোথায় ? কাদের ভাই কি এখনো ঘুমাচ্ছে নাকি !
মাসুদ ভাইজান নীচে খেলতেছেন, আর শফিক ভাইজান গেছেন বাজারে । আজকে নাকি এসপেশাল(স্পেশাল) রান্না হবে । কাদের ভাইজান তো খাইদাই আবারো ঘুম মারতাছেন ।
অ, কাদের ভাই তো ছুটির দিনে ঘুম মারা ছাড়া কোন কাজ পারে না । তা তোমার এসপেশাল (!) রান্নাটা কী ?
আগে ভাইজান বাজার আনুক, তারপর বলতে পারব ।
নাস্তা খেতে বসে ইরফান মোবাইল অন করল । গত রাত থেকে ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিল ।
অন করার সাথে সাথেই দেখল একের পর এক মিসড কল এলার্ট আসছে । প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ টার মত হবে । কোনটা আম্মার, কোনটা আপার, আবার ছোট মামারও আছে ।
এই অবস্থা দেখে ভীষন অস্থির হয়ে পড়ল ও, ফোনে টাকাও নাই । কি করা যায় !
ভীষন অস্থির হয়ে পড়ল ইরফান । সাত-পাঁচ ভাবার আগেই ও দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে মাসুদ কে ডাকতে শুরু করল । মাসুদ তখন ব্যাটিং করছে । ওর ডাক শুনে চিৎকার করে বলল, ইরফান ভাই 'রাইটহ্যান্ডার তামিম' ব্যাট করছে । ডিষ্টার্ব করিয়েন না ।
'রাইটহ্যান্ডার তামিম' হল একটা কোড । অর্থাৎ উত্তর দিকের চারতলা বিল্ডিংটার দ্বিতীয় তলায় লাইলী দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান একটু ঘুরেই দেখল এলোচুল আর ওড়নার মাথা দেখা যাচ্ছে । অতএব হাজার ডাকেও মাসুদকে নড়ানো যাবে না ।
এই লাইলী-মজনুর প্রেম দীর্ঘ তিন বছর ধরে চলমান । আজ পর্যন্ত কেউ কারো সাথে ভাল করে কথাও বলে নাই , অথচ মাসুদ বলে ওরা নাকি চোখের ভাষা বোঝে । কি সব আজাইরা কথাবার্তা ! ওরা যেন এ যুগে নয়, এখনো সেই যুগে বসবাস করছে ! আর 'রাইটহ্যান্ডার তামিম' নামটা ওর নিজেরই দেয়া । তামিম ওর ফেভারিট ব্যাটসম্যান । কিন্তু মাসুদ বেচারা ব্যাট করে ডান হাতে । তাই নাম নিল রাইটহ্যান্ডার তামিম !
মাসুদ কে দেখে কে বলবে, ও ইন্টার্নি করছে । পরীক্ষা ছাড়া পড়ার টেবিলে ওকে দেখায় যায় না । প্রায় সময় আড্ডাতেই কাটিয়ে দেয়, ছুটির দিনে আশেপাশের বিল্ডিংয়ের ছেলেদের নিয়ে ক্রিকেট শুরু করে দেয় । ক্রিকেট যে খুব একটা ভাল খেলে ব্যাপারটা তেমন না । খেলোয়াড় বেশীর ভাগই বাচ্চা । তাই বড়ভাই সুলভ প্রভাব কাটিয়ে ইচ্ছেমত ব্যাটিং করে ও । এমনিতে খেলা পরিচালনাতেই বেশী মনযোগী দেখা যায় মাসুদকে । কিন্তু উর্বশী লাইলী (!) কে দেখলেই ওর বীরত্ব দেখাতে ব্যাটিং করতে শুরু করে । আর খেলার সময় হৈ-হল্লা চিল্লা-ফাল্লা করে এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যে, আশেপাশের বিল্ডিংয়ের ব্যালকনি, জানালার পাশ ইত্যাদি জায়গা গুলো গ্যালারী মতন হয়ে যায় ।
ইরফান ভেবে পায় না, বীরত্ব দেখাতে ব্যাটিং কেন, বোলিং নয় কেন ! তবে কি আমরা শাসন করতেই বেশী ভালবাসি !
ভাগ্যিস, ফারিয়ার বাসা এই এলাকায় পড়ে নাই, নয়তো ইরফানের সাথে মাসুদের ভালই ফ্যাসাদ হতে পারত । দুই মজনুই তো চাইত স্ব স্ব লাইলীকে ইমপ্রেস করতে !
অন্য সময় হলে উর্বশীকে দেখে ইরফান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখত । মাসুদের ছেলেমানুষী ছোটাছুটিতে বিস্তর মজা নিত । কিন্তু এখন সময়টা ভিন্ন । চাইছিল, মাসুদকে ডাক মেরে বলে মোবাইলে কিছু টাকা ইজিলোড করে দিতে । ছেলেটাকে তো এখন নড়ানো মুশকিল ! কি করবে কিচ্ছু ভেবে পায় না, ও । দরদর করে ঘামছে ইরফান । এতগুলা কল কি জন্য ! কোন অঘটন ঘটে নাই তো ... । তুফান বয়ে যাচ্ছে দেহের উপর দিয়ে । কি যে করবে...। আর ব্যালান্স নীল হওয়ারও আর সময় পেল না ।
একছুটে কাদের ভাইয়ের রুমে গিয়ে মোবাইলটা তুলে নিল ইরফান । সহজে কেউ কাদেরের রুমে আসে না, ওর জিনিসপত্র খুব একটা ছোয় না । সিনিয়র ভাই হওয়ায় প্রায়ই একটা ভাব নিয়ে থাকে কাদের । তাই ওর ধারে কাছে কেউ ঘেঁষতে চায় না, ওকে ঘাটাতেও চায় না । তবে এখনখার পরিস্থিতি ভিন্ন । কাদেরের মোবাইল হাতে নিয়েই আরেক ধাক্কা খেল ইরফান । ব্যালান্স আছে এক টাকা তিয়াত্তর পয়সা । ভাগ্যি আর কাকে বলে ! উপায় না পেয়ে তাতেই শফিককে ফোন করে বসল ইরফান ।
-হ্যালো শফিক, ভাই আমার নাম্বারে কিছু টাকা ইজিলোড করে দাও তো ।
-আরে ইরফান ভাই, আপনি ! কাদের ভাইয়ের ফোন থেকে কেন ! আপনারটা......
-এত কথা বলার সময় নাই, তুমি যত তাড়াতাড়ি পার আমারটাতে রিচার্জ করে দাও ।
-ভাইয়া, আমার হাতে আছে চল্লিশ টাকা । মাংসের মশলা আর ধনেপাতা নিতে হবে । আজকে স্পিশাল রান্না হবে । আপনার ফেভারিট গরুর গোস্ত আর চিংড়িও থাকবে, সাথে ডিম-সালাদ তো আছেই ......।
-যা লাগে ঐ সব পরে আনবা । এখন বার, পনের যা হোক একটা রিচার্জ করে দাও । ভেরী আর্জেন্ট ।
-শফিক হাসি হাসি করে বলল, কেন ভাইয়া ফারিয়া আপা ফোন দিয়েছিল নাকি ! মেয়েদের এক-আধটু অভিমান.........
-শফিক্যা তোরে আমি.........
তখনি রিং বেজে উঠে ইরফানের মোবাইলে । ও ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই, আপার নাকি(কান্নামাখা) আওয়াজ পায় ।
-কিরে ভাই, তুই কোথায় ছিলি ? আমরা কখন থেকে তোকে ট্রাই করছি ।
-আহ আপা ! ফ্যাচফ্যাচ কান্নাটা বন্ধ করে কি হয়েছে বল তো ।
-কি আর বলব, ভাই । বলার কি আর কিছু বাকী আছে ।
-আরে কি জ্বালা । আপা, তুমি থামবে । পরিস্কার করে বল না কি হয়েছে !
-আমাদের সব শেষ .........। ফোনটা ছোটমামা এক ধমক দিয়ে কেড়ে নিল ।
হ্যা, ইরফান শোন ।
-মামা বলেন । কি হয়েছে, আপা এভাবে কাঁদছে কেন ?
-আরে এই মেয়েদের কথা আর বলিস না তো । প্রয়োজনের সময় ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না ছাড়া এদের আর কোন কাজ নাই । তুই কি এখন বাসায় ?
-জ্বি মামা । হরতাল তো তাই বন্ধ ।
-শোন, তোর আব্বাকে আমরা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসেছি ।
-সে কী !
-গত রাতে হঠাৎ খারাপ লাগায় মেডিকেলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলে তোর আব্বা ভর্তি হতে চান নি । উনার একটাই কথা, -আমাকে গ্রামে নিয়ে চল । তো আজ ভোরে পৌছলাম । তোকে সেই রাত থেকে ফোন করে যাচ্ছি, লাইন পাচ্ছি না ।
-এখন কি অবস্থা !
-অবস্থা বিশেষ সুবিধার না । তোর বড় মামার বন্ধু ডাঃ হাছান দেখছেন । একটু পরপর সেন্সলেস হয়ে পড়ছে । আর তোকে খুব করে দেখতে চাচ্ছে ।
ইরফানের দু'চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছে । সে কথা বলতে পারছে না । কথা বলতে গেলেই গলা ধরে আসছে ।
-মামা, আমি এখন কী করব ! কিভাবে আসব ।
-এই তোর আপার মত ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবি না তো । পুরুষ মানুষের চোখে জল মানায় না । আল্লাহর উপর ভরসা রাখ । ইনশাআল্লাহ একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই ।
-হরতালে গাড়ী পাব কোথায় ! এখান থেকে চট্টগ্রাম তারপর আবার গ্রামের বাড়ি । প্রায় ৮-১০ ঘন্টার জার্নি । অন্তত ততক্ষন আব্বাকে আপনারা রাখতে পারবেন না, মামা ।
-কি যা তা বলছিস ।
আওয়াজ নেই । একদম চুপচাপ ।
-ইরফান, এই ইরফান …….. । কয়েক মূহুর্ত পর ছোট মামা বললেন, ইরফান চিন্তার কিছু নাই । চিন্তা করিস না বাবা । দেখ চেষ্টা করে, আল্লাহর রহমতে কোন না কোন ব্যবস্থা অবশ্যই হবে ।
-ইরফান, তুই শুনছিস তো …... ! আমার কথা বুঝতে পারছিস তো …... ।
-মামা, রাখি তাহলে ।
-হুম রাখ ।
-আল্লাহ হাফেজ ।
-আচ্ছা ।
কথা শেষ করে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকল ইরফান । ঘাড় ফেরাতেই দেখল পিছনে কাদের এসে দাড়িয়েছে ।
কাদেরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ইরফান সবকিছু খুলে বলল । সব শুনে কাদের কিছু সময় থম ধরে বসে থাকল । একটু ভেবে বলল, ইরফান তোমার কি ফোন-টোন করা লাগবে ? আমার অন্য ফোনে টাকা আছে ।
-না, কাদের ভাই । আপনি বরং শফিককে ফোন করে বলে দেন যে, গলির মোড়ের সুমনের দোকান থেকে আমার নাম্বারে যেন তিন'শ টাকার মত রিচার্জ করে দেয় । আমার নাম বললেই হবে ।
-গলির মোড়ের দোকান বলতে ঐ বেটে ফরসা মত ছেলেটা............ ওর নাম সুমন নাকি ! আমি তো বিশ্বাস বাবু বলে জানি ।
-হ্য, ওর নাম সুমন বিশ্বাস ।
-আচ্ছা । তো ওর নাম্বার তো আমার কাছে আছে । তুমিই ওকে বলে দাও ।
হরতালে গাড়ী পাওয়া নিয়ে সমস্যা । ইরফান বুঝে উঠতে পারছে না, কিভাবে এই সুদূর ঢাকা থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দেবে ।
অনেক ভেবে ও নজিবুলকে ফোন করল । নজিবুল ওর ক্লাসমেট ছিল । তবে এখন এক ইয়ার পিছনে পড়ে গেছে । রিলেশন টা ভালই আছে । ওর আবার পলিটিক্যাল যোগাযোগ টাও ভাল । তাই ওকে বললে কিছু হতে পারে এই আশায় ওকেই ফোন দিল ইরফান ।
-আরে, দোস্ত তুই কোত্থেকে এতদিন পর ! মনে হচ্ছে ফারিয়াকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেছস । যাই করিস মনে রাখবি এই নজিবুলই কিন্তু ফারিয়ার সাথে তোরে বেঁধে দিয়েছিল । খবর-টবর বল । তোদের প্রেমগাথা কদ্দুর হল শুনি ।
-দোস্ত, আমার আজই এখনি একটু বাড়ি যাওয়া লাগবে । ব্যবস্থা করতে পারবি ! গলায় ধলা পাকিয়ে কথা আটকে যায় ইরফানের ।
-কেন, দোস্ত বাড়িতে বউ-টউ ঠিক হল নাকি ? বিয়ে করবি ? তাহলে ফারিয়ার কি হবে ? শেষ পর্যন্ত ওরে তুই ছ্যাকা দিবি ! দোস্ত তোরে আমি.........
-আরে ওসব কিছু না । একটু আহত শোনায় ইরফানকে ।
নজিবুল সেটা বুঝতে পারে না । তাহলে কি সব কারবার । ডুবে ডুবে.........
-নজিবুল শোন, আমার আব্বার অবস্থা ভাল না । তাই......... গলা ধরে আসে । আর কিছু বলতে পারে না ইরফান ।
এইবার চৈতন্য হয় নজিবুলের । সে চুপ করে যায় । কয়েক সেকেন্ড... তারপর নজিবুলই বলে উঠে, তুই কিছু চিন্তা করিস না দোস্ত । আমি খবরাখবর নিয়েই তোকে জানাচ্ছি । লাইনটা নিজ থেকেই কেটে দেয় নজিবুল ।
আধঘন্টা পরেই নজিবুল জানায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে প্রথম বাসটা সাড়ে তিনটার দিকে ছাড়তে পারে । ও টিকেট কেটে ষ্টেষনে অপেক্ষা করবে বলে জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় ।
বাসার সবার সহযোগিতায় অতিদ্রুত যথা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে দুটার আগেই ষ্টেষনের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে ইরফান । যদিও তা মাত্র আধঘন্টার পথ ।
সাড়ে তিনটায় গাড়ী ছাড়ার কথা থাকলেও অতি সতর্কতা অবলম্বন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গাড়ী ছাড়ল চারটা কুড়ি মিনিটে । তিনটা থেকে নজিবুল টিকেট সাথে নিয়ে ইরফানের সাথে ছিল । দুপুরে খায়নি, তাই অনেক জোর করে রহিমা'র মা দুটি কলা সাথে দিয়েছে । বাসে ক্ষিধা লাগলে খাওয়ার জন্য ।
দুরন্ত গতিতে গাড়ী এগিয়ে চলেছে গন্তব্য অভিমুখে । তবু ইরফানের মনে হচ্ছে গাড়ীটা বড্ড আস্তে চলছে । সেই গাড়ীতে উঠে বসার পর থেকে চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরেই যাচ্ছে । আষাঢ়-শ্রাবণের সমস্ত জল বুঝি ওর চোখে জমা হয়েছে । ইরফান ভেবে পায় না, এত জল এল কোত্থেকে । চোখের এই অতি ক্ষুদ্র কোনটাতে এত জল কিভাবে জমে ছিল !
ইরফান ভাবে, ওর আব্বা কি মৃত্যু পথযাত্রী ? না ! এটা হতে পারে না । আব্বাকে ছাড়া ও-তো গোড়া কাটা গাছের মত । কিভাবে বাঁচবে ও, আদৌ বেঁচে থাকা যাবে ! বাঁচা যায় !
একদিকে চোখের জল অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে । অন্যদিকে কত কথা, কত স্মৃতি মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে । মনে পড়ছে অনেকদিন আগে শোনা মৃত্যু পথযাত্রী নিয়ে জোকস । একজন বলল, একটু দোয়া করো অমুক তো মৃত্যু পথযাত্রী । অন্যজনের জবাব, যাত্রা শুভ হোক । কি নির্মম রসিকতা ।
রহিমা'র মা-ও এমন রসিকতা করতে পারে । ওর কলোনীর এক মেয়ে একবার হঠাৎ এসে বলল, ছলিমের মেয়েটা মরতে বসেছে । রহিমা'র মা তৎক্ষনাত উত্তর করল, মরার জন্য আবার বসতে হয় নাকি ! বসে বসে তো কাউকে মরতে দেখি নি, চল একবার দেখে আসি ।
বিচ্ছেদ-যন্ত্রনার রসিকতা বড় নির্মম, বড় কঠিন । তবে এটা নিয়ে হাস্য-রস করা তারও চেয়ে কঠিন । সবাই এটা পারে না, সকলের সে ক্ষমতা থাকে না ।
মহান স্রষ্টা পরিস্কার বলে দিয়েছেন, "নিশ্চয় আমার দিকেই প্রত্যবর্তন করবে" । তবু বিচ্ছেদ-যাতনা সওয়া যায় না ।
বাস চট্টগ্রাম রোডে প্রবেশ করেছে । মাঠ-ঘাট পেরিয়ে ছুটে চলেছে । আর কিছুক্ষন পরেই ইরফান বাস থেকে নামবে । তারপর আবার ঘন্টা দুয়েকের জার্নি । এখন রাত এগারোটা । দুটার আগে পৌছতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না । একটু পরপর যোগাযোগ করছে । অবস্থার পরিবর্তন হয়নি । এখনো শুনতে পাচ্ছে ইরফানকে দেখার আকুতি । তারও কি কম দেখতে ইচ্ছে করছে আব্বাকে ।
ইরফান আপনমনে আউড়ে যাচ্ছে, আমি আসছি আব্বা । আর একটু অপেক্ষা করেন ।
সেই রওনা হওয়ার পর থেকে এক মূহুর্তের জন্যেও চোখের জল পড়া থামে নি ।
*****
ইকরাম সাহেবের সেন্স আবার ফিরেছে । তিনি ইরফানের বাবা । তিনি দেখছেন চারপাশে স্বজনদের ভিড় । ভিড়ের মাঝে তিনি একটা মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু সে মুখ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না । ওরা সেই কখন থেকে বলছে, সে নাকি অন দ্যা ওয়ে । কই, এখনও তো এল না । তবে কি দেখা হবে না ! একটু ছোঁয়া যাবে না । একবার চোখের দেখা ......।
ইকরাম সাহেবের মনে পড়ে যায় চল্লিশ বছর আগের এক স্মৃতি । তখন তিনি তেইশ বছর বয়সী টগবগে উচ্ছল এক যুবক । সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছেন । মহা উদ্যমের সাথে কাজ করেন । চট্টগ্রাম শহরে বাসা নেওয়া হয়নি তখন, বিয়ে আরো দূরের ব্যাপার । একমনে কাজ করেন, ফাঁকি-ঝুকি কিছুই করেন না । গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে এক মফস্বলে পোষ্টিং । এক সকালে অফিস যাওয়ার মূহুর্তে পেলেন বড় চাচার সংক্ষিপ্ত তবে জরুরী টেলিগ্রাম । তাতে যা লেখা ছিল তা তিনি কোনদিন ভুলেন নাই ।
"তোমার পিতার শারীরিক অবস্থা বিশেষ ভাল না । পত্র পাঠ মাত্র তুমি বাড়ীর অভিমুখে যাত্রা করিবে । -বড় চাচা
ইকরাম সাহেব পত্র পাঠ মাত্র বাড়ীর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন নাই । তিনি নতুন চাকরিতে যোগদান করায়, কাজটাকে প্রাদান্য দিয়েছিলেন । তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন দুপুর আড়াইটার শেষ বাসে । সবাইকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বাড়ীর পথ যখন ধরেন, ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে ।
বাড়ী পৌছেন সন্ধ্যা প্রায় সাতটা । পাঁচটার দিকেই উনার বাবা মারা যান । আর ছেলে ইকরাম পত্র পাই নাই মনে করে অপেক্ষা না করেই মাগরিবের নামাযের পর জানাযা পড়ে কবর দেয়া হয়ে যায় । তিনি যখন পৌছেন তখন সব শেষ ।
সবাই যখন সামান্য সময়ের জন্য আক্ষেপ করছিলেন, তখন তিনি ভেতরে ভেতরে ডুকরে কেঁদে অস্থির হয়ে মরছিলেন । উনার বাবাও পুত্রকে একবার দেখার জন্য ভীষন ছটফট করেছিলেন । কিন্তু দেখতে পারেন নাই ।
আজ ইকরাম সাহেবেরও ছেলেটাকে ভীষন দেখতে ইচ্ছা করছে । একটিবার কলিজায় লাগাতে মন বড় আনচান করছে । মন বলছে, আর একটুক্ষন পরেই ছেলেটা আসবে । ততক্ষন সময় পাওয়া যাবে কি না তিনি বুঝতে পারছেন না ।
চোখ লেগে আসছে, বন্ধ হয়ে পড়ছে চোখের পাতা । তিনি জেগে থাকতে চান । ছেলেটাকে একটিবার দেখার পর যা হবার হবে । এত সব ভাবতে ভাবতে তিনি আবারো কলমা পড়া শুরু করেন এবং পুনরায় সেন্সলেস হয়ে পড়েন ।
_______#####____________