গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে আসার দুই বছর না ঘুরতেই পঞ্চমবারের মতো বাসা বদলে ফেলেছিলেন আব্বা । বাসাগুলোও কি, একটা শহরের এ মাথা হলে তো আরেকটা ও-মাথা । আমরা ভাই-বোন দুজনই ছোট ছিলাম, তাই আমাদের কিছু বলবার উপায় ছিল না । ঘরের আসবাবও তেমন কিছু না থাকায়, আব্বার বাসা বদলাতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি । একটা ভ্যানগাড়িতে তুলে দিলেই হলো ! আব্বার কিছু একটা ভাল না লাগলেই হয়ে গেল । ব্যস, বাক্স-পেটরা গোছাও, এখানখার পাট চুকাও !
আগ্রাবাদের বাসাটাতে কত বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছিলাম, বিকেলবেলা কি মজাটাই না হতো । মাঝে মধ্যে বড় ভাইয়েরা খিচুড়ি পাকিয়ে পিকনিক করতেন, কি ভাল লাগত । তাদের ছেড়ে আসতে কি যে কষ্ট হয়েছিল আমার ! পাথরঘাটার বাসাটাতেও ভালোই ছিলাম । জমিদারের মেয়েগুলো বড় মিশুক ছিল । আমাদের দুই ভাই বোনকেই বেশ আদর করতো তারা ।
পাথরঘাটার বাসা ছেড়ে আমরা কালামিয়া বাজারের বাসায় উঠলাম । ত্বি-তল হলুদ রঙা বিল্ডিং । প্রতি তলায় দশটা করে বাসা । বাসার সামনে লম্বা লাল বারান্দা । নীচে বড় একটা মাঠ । বারান্দা থেকে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ছোঁয়া যায় মাদার গাছের ঢাল । মাদার গাছে কাকের বাসা । আশে পাশে নয় প্রতিবেশী । সবকিছু দেখে আমাদের বড় ভালো লেগে গেল । আগের বাসা ছেড়ে আসার কষ্টটা নিমেষেই কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছিল ।
আমাদের পাশের বাসাটা ছিল শিবু আংকেলদের । নীচে উনার একটা মুদি দোকান ছিল । শিবু আংকেলের মা, আম্মাকে বলে দিয়েছিলেন, মুদি বাজার যেন তাদের দোকান থেকে করা হয় । আমরাও তা-ই করতাম । কখনো কখনো তাদের দোকান থেকে বাজার না করলেই, উনি আম্মার কাছে চলে আসতেন । জিজ্ঞেস করতেন, দোকানের ছেলেপিলে কেউ কিছু বলেছে কি না ! উল্টাপাল্টা কিছু করেছে কি না !
শিবু আংকেলের এক ভাগ্নে ছিল, আংকেলের বাসাতেই থাকত । আমারই সমবয়সী । নাম ছিল মুন্না । তার সাথে ভীষণ ভাব ছিল আমার । আব্বাস ভাই আর তারেকরাও যখন আমাদের বিল্ডিংয়ে এলো, জমে গিয়েছিল খুব । সবাই মিলে সামনের লাল বারান্দাটায় দারুণ মজা করতাম আমরা । খুব খেলতাম । ক্রিকেট খেলার সময় আমি আর তারেক এক দলে খেলতাম, অন্য দলে মুন্নাকে দিতাম দুইবার ব্যাটিং । সে দুইবার ব্যাটিংয়ের লোভে আমাদের দুইজনের বিপক্ষে ‘একা’-ই খেলতো ।
আব্বাস ভাই সহ সবাই মিলে মুন্নাকে কতবার ক্বলমা পড়িয়েছিলাম । সেও বেশ মজা করে ক্বলমা পড়ত আমাদের সাথে । সকাল-দুপুর, বিকাল-সন্ধ্যা দারুণ আনন্দে দিন কাটাতাম আমরা । রাতে কারেন্ট চলে গেলে আমাদের আরো মজা, গরম লাগছে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়তাম বারান্দায় । বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটতাম, গল্প করতাম, দু’তলার নতুন ভাড়াটিয়ার মেয়েটাকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়, ফন্দী আঁটতাম । মিছামিছি কিছু খেলতাম কখনো-সখনো ।
আমাদের এমন অবাধ মেলামেশায় বড়দের কিছু বলতে শুনিনি কখনো । ‘ওতো হিঁন্দু, ওর সাথে মিশিস কেন ?’ ‘সারাদিন ঐ হিঁন্দু ছেলের সাথে এত কি তোর ?’ ‘হিঁন্দুদের সাথে এত গলায় গলায় ভাব কিসের ?’ এই ধরণের কোন প্রশ্ন আমাদের শুনতে হয়নি, বরং রোযায় ইফতার গেছে ওদের বাসায়ও । আর ওরাও ওদের পার্বণগুলোতে বিভিন্ন মিষ্টি-টিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছে বরাবর । মেজ মামা তখন আমাদের বাসাতেই থাকতেন । উনাকে দেখতাম, শিবু আংকেলের পিচ্চি ছেলেটাকে কি আদরটাই না করতেন । শিবু আংকেলের ছেলেটা জ্যান্ত তেলাপোকা খেতে পারতো । আমরা সিঁড়ির গোড়ায়, কোন কোণায় তেলাপোকা দেখলে তাকে ডেকে আনতাম । সে খুব বড় বাহাদুরের মতো করে সেসব খেয়ে ফেলতো ।
আমাদের উচ্ছল আনন্দের সময়গুলোতে হঠাৎ বিস্বাদের মতো হয়ে এলো একটা খবর । একদিন শুনতে পেলাম, মুন্না ভারতে চলে যাবে । শুনেই আমাদের বুকটা কেমন যেন খা খা করে উঠল । আমরা তাকে ধরে বারবার কথা আদায় করি, সে আবার আসবে । আমাদের ভুলে যাবে না । সে বলেছিল আমাদের, কথা দিয়েছিল, আবার আসবে । সে আসেনি, নিজের দেয়া কথা সে রাখেনি ।
বছর দুয়েক পরই আমরা আবার বাসা পাল্টেছিলাম । এবার অবশ্য একই বিল্ডিংয়েই । তৃতীয় তলা থেকে নেমে এসেছিলাম দ্বিতীয় তলায় । দ্বিতীয় তলায় আসলেও দৌড়ে দৌড়ে আমি তিন তলায় চলে যেতাম । বন্ধুরা সব ছিল সেখানে । মুন্না না থাকলেও তারেক, আব্বাস ভাইরা ছিল । এক সময় তারাও চলে গেল অন্যত্র । আমিও দ্বিতীয় তলায় মানিয়ে নিয়েছিলাম । একদৌড়ে তিন তলায় যেতাম না আর, যা খেলার আমাদের ফ্লোরেই খেলতাম । একটু বড় হওয়ার পর তো মাঠে যাওয়াও শুরু করেছিলাম ।
মাঠে যাওয়ার অবারিত স্বাধীনতা ছিল না । বাসা থেকে বাঁধা আসত । ফ্লোরেই তাই খেলার চেষ্টা করতাম । হঠাৎ একদিন আবিস্কার করলাম, আমার আবার তিন তলায় যাওয়া বেড়ে গেছে । কৌশিকরা তখন তিন তলায় থাকে । আমি দুই তলার সিঁড়ি থেকে সাংকেতিক ভাষায় চিৎকার করতাম, ‘শিক শিক’ অমনি সে বেরিয়ে আসত । সে প্লাস্টিক বল নিয়ে ঠাস-ঠুস আওয়াজ করলেই আমি বেরিয়ে পড়তাম । সিঁড়িঘরের ছোট জায়গাটায় আমরা খেলতাম, দুই তলা কিংবা তিন তলার লাল বারান্দায়ও খেলতাম আমরা । সে আমাকে হারাত, আমি তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতাম, নব উদ্যামে, নতুন আঙিকে আমাদের খেলা চলতেই থাকত ।
কৌশিকের সাথে খেলার সময় আমি কিছুটা বড় হয়েছি । পড়ালেখা করি তখন । কৌশিক স্কুলে পড়ে, আমি মাদ্রাসায় । কৌশিকের বাবা-মা কখনো তাকে বলেনি, ‘ওর সাথে খেলিস না, ও মাদ্রাসায় পড়ে ।’ ‘তোকে মাদ্রাসায় নিয়ে গিয়ে হুজুর দিয়ে মেরে ফেলবে, কেটে ফেলবে ।’ আমাকেও কেউ বলেনি, ‘তোর লজ্জা করে না, মাদ্রাসায় পড়ে একজন হিঁন্দুর সাথে থাকিস, খেলিস ?’ এমন কথা তখনো পর্যন্ত আমরা কখনো শুনিনি ।
একদিন কৌশিকটাও চলে গেল । পারিবারিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের গ্যাঁড়াকলে, ওর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটা অংকুরেই মরে গিয়েছিল ।
দ্বিতীয় তলাতেই ‘রানা নাথ’ নামে একজন ছিল । খুব পড়ুয়া, মেধাবী ছাত্র । ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টফুলে বৃত্তি পেয়েছিল । আমাকে গল্পের বই সরবরাহ করত সে । কতশত বই দিয়েছে । ঐ বাসায় থাকাকালে আমি কখনো বই কিনিনি, তার থেকে নিয়ে নিয়েই পড়তাম ।
‘পূজা’ নামে একটা আদুরে বাচ্চা এসেছিল আমাদের ফ্লোরে । আমরা তাকে আদর করতাম খুব । আমাদের বাসায় ডিশ ছিল না বলে, ক্রিকেট খেলা দেখতাম তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । পূজার রুপম কাকু আমাদের বলতেন, বাসার ভেতরে বসে খেলা দেখার জন্য ।
আমাদের ফ্লোরে-বিল্ডিংয়ে কত হিঁন্দু এসেছিল, চলে গেছে । অনেকেই এখনো আছে হয়তো । আমাদের সাথে তাদের কখনো রেষারেষি ঘটেনি, মনোমালিন্য ঘটেনি । আমরা মুসলমান ওরা হিঁন্দু, আমরা সংখ্যাগুরু ওরা সংখ্যালঘু, এমন কোন কিছু আমরা তখনো বুঝিনি, দেখিনি । বড়দের মধ্যেও কখনো সেসব শুনিনি ।
একটা বিল্ডিংয়ে অনেকগুলো পরিবার । যেন একটা পাড়া, একটা সমাজ । একটা মেয়ের জন্ম হয়েছিল আমাদের ফ্লোরে । সবার মধ্যে খুব ভাব দেখেই হয়তো, মেয়েটার বাবা-মা, তাদের প্রথম কন্যার নামই রেখে দিয়েছিলেন ‘সম্প্রীতি’ ! আমরা যাকে ‘মনা’ বলে ডাকতাম ।
অদ্ভুত এক বোঝাপড়ার সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে । স্নেহ, সৌহার্দ্যের অনন্য এক মৈত্রী দেখেছিলাম সেখানে । রোযার দিনে ওরা কখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু খেত না, বাচ্চাদেরও সামলে রাখত যত্রযত্র যেন খাওয়া নিয়ে বেরিয়ে না পড়ে । ঠিক আযানের সময় শঙ্কধ্বনি বাজাত না, হয় আগে বাজাত না হয় পরে । ওদের পূজা-উৎসবে, বারান্দায় ওদের সামনেটায়, ওরা নানা নকশা করে সাজাত । তখন আমাদের বাবা-মা’রা আমাদের আটকে রাখত, যেন ওদের উৎসবে, ওদের নকশায় বাগড়া না দিই । আমরা নকশা দেখতাম দূর থেকে ।
ঐ বিল্ডিংটাতে আইচ বাবু আংকেল ছিলেন, দোলন বাবু আংকেল ছিলেন, হ্যাপি দি ছিলেন, মিশন ছিল, শুভ ছিল, জয়-অপূর্ব ছিল, প্রত্যয় ছিল, বিজয় দা ছিল, সুভদ্র দাদা ছিল... ছিল আরো অনেকেই । সবাই এখনো সেখানে আছে কি না জানি না । কেউ হয়তো বাসা বদলে ফেলেছে, কেউ হয়তো মুন্নার মতো চলে গেছে অন্য একটা দেশে !
বাসা বদলেছি অনেকদিন হয়ে গেছে, জানি না কে কোথায় আছে এখন ।
অনেক বছর ছিলাম সেখানে । বাড়ন্ত শৈশব থেকে তারুণ্যে পা দেয়া পর্যন্ত । পাশের মাদ্রাসাতে পড়েছি । অনেক কিছু দেখেছি, অনেককেই দেখেছি । কত উত্থান-পতন, ঘটন-অঘটন, কত উত্তেজণা, উদ্দীপণা... এত কিছুর মাঝে কখনোই অভাব ঘটেনি সাম্প্রদায়িক প্রীতি-ভালবাসার । মিলেমিশে সবাই ছিলাম যার যার মতো ।
পরস্পরের মধ্যে অনড় আস্থা-বিশ্বাসেই চিড় ধরার সুযোগ পায়নি যেখানে, সেখানে ঘৃণা ছড়ানো তো অনেক দূরের ব্যাপার ।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পেয়েছিলাম ‘জয় দাশ’ নামের এক নাদুস নুদুস ছেলেকে । অল্পদিনেই ভাব হয়ে গিয়েছিল । ছেলেটার সাথে কত জায়গায় যাই, নামাযের সময় হয়ে যায় । তখন সে অকপটে বলে, ‘তুমি নামায পড়ে এসো, আমি অপেক্ষা করি ।’ তাকে অপেক্ষা করিয়ে আমরা মসজিদে ঢুকি, নামায শেষ করি । তার নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করি, সে হাসে । কিছু বলে না । তাকে নিয়ে ছড়া কাটি, “জয় দাশ/তুই কি খাস/ গপাস গপাস খা ঘাস/হলো ক’মাস” চোখ নাঁচিয়ে ইংগিত করি, তার পেটের দিকে । সে হেসে হেসে বলে, দাড়ি ছিড়ে ফেলব কিন্তু !
সাগর দাশ, শিমুল দে সবার সাথেই আমাদের হাস্যরসের সম্পর্ক । তাদেরকে নিয়ে কত মজা করি । তারাও আমাদের নিয়ে মজা করে । কোথাও কোন সমস্যা নেই । আমাদের ‘ইফতার মাহফিলে’ সানন্দে হাজির হতে কোন সংকোচ নেই, ওদের সাথে অবাধ মেলামেশায় আমাদেরও নেই কোন বাঁধা নিষেধ ।
কত সুন্দর, জড়তাহীন, স্বচ্ছ সম্পর্ক আমাদের । কোন দ্বন্ধ-সংঘাতের লেশমাত্র নেই ।
কখনো টেলিভিশন-পত্রিকায় দেখি, মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে । কোথাও হয়তো ভেঙ্গে দিয়েছে আশ্রম । পুরোহিত কিংবা পন্ডিতকে অপদস্থ করেছে বা চুল-দাড়ি কেটে দিয়েছে, কিংবা হেনস্থের চূড়ান্ত করে ছেড়েছে । ওরা নাকি বড় নির্যাতিত । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত নাকি নড়ে গেছে ।
তাহলে আমাদের চারপাশে, আমাদের সমাজে যে প্রীতি-মৈত্রী দেখা যায়, তা কিসের ? মসজিদও কি ভাঙা হয় না ? মাদ্রাসায়ও কি তালা পড়ে না ? আলেম-ওলামা, ইমাম-মুয়াজ্জিনও কি নিপীড়িত-নিগৃহীত হন না ? এখন সংখ্যাগরিষ্ঠরাও যদি একই যন্ত্রণা পোহান, তাহলে সংখ্যায় লগিষ্ঠদের ক্ষেত্রেই কেন আলাদাভাবে উচ্চবাচ্য করা হবে ? মানবিক অবক্ষয়, মানবতার বিপর্যয়-ই কেন সমস্বরে উচ্চারিত হবে না ?
একদিন এসবই বলেছিলাম সৈকত দা’কে । সৈকত দা আবার বাম রাজনীতির আদর্শে কঠিনভাবে বিশ্বাসী । সুযোগ পেলেই তাই শাসিত-শোষিত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আসেন । আমার মুখে এসব শুনেই ‘এগজেক্টলি’ বলে শুরু করেছিলেন উনার কথা । ‘সেটাই তো তোকে সবসময় বলার চেষ্টা করি । এসব হচ্ছে সুবিধাভোগীদের কাজ কারবার । তোর বিরুদ্ধে আমাকে ক্ষেপিয়ে দেবে, আমার বিরুদ্ধে তোকে বিষিয়ে তুলবে, তাহলেই না ওদের রাস্তা পরিস্কার হবে । ‘ভাগ করো শাসন করো’ সিম্পল ক্যালকুলেশন । এটা বুঝতে হবে, তোর-আমার, আমাদের । ওদের সাজানো ফাঁদে পা দিয়ে আমরা নিজেরাই তো ডেকে আনি যত অনর্থ ।’
আমি তন্ময় হয়ে শুনি সৈকত দা’র কথা । ‘এতদিনকার পরিচিত, এত কাছের মানুষদের ধুম করে অবিশ্বাস করে, কোন আক্কেলে আমরা ছুটে যাই লাঠি-সোঠা নিয়ে পরস্পরের হাড্ডিগুড্ডি ভেঙ্গে দিতে ? বুঝতে হবে, এখানে আছে তৃতীয় কোন সুযোগ সন্ধানী পক্ষের উস্কানি । এসব আমাদেরই বুঝতে হবে । অন্যরা গেল গেল প্রীতি গেল, এই বুঝি দাঙ্গা লাগলো, এসবই আওড়ে যাবে । ঘৃণা ছড়াবে, রেষারেষি বাড়াবে, উপশম করবে না । তাহলে তো তোকে আমাকে শুষতে পারবে না, পিষতে পারবে না ।’
বছর খানেক আগে নানুর বাড়ি গিয়ে সাগরকে ফোন দিয়েছিলাম । তার বাড়িও সেখানে । নানুদের মুখে শুনেছি, এক হিন্দু জমিদারের কথা । যে কিনা ভীষণ অত্যাচারী ছিল । সাগর আমাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই জমিদারের বাড়ি দেখায় । কত পুরনো বাড়ি, কি সব প্রাচীন শিল্প-কলা সে বাড়ির দেয়ালে ! শ্যাওলা জমে দেয়ালকে কিছুটা বিবর্ণ করলেও, সুনিপুণ কারুকাজগুলো অবাক করার জন্য যথেষ্ট । মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম সব । দৈত্যাকৃতির বাড়িটার ভয়ংকর হতশ্রী চেহারাই বলে দিচ্ছিল, এদের জমিদারগিরি তো গেছেই, এই বাড়ির জনসাধারণেরাও পৌছে গেছে অধঃপতনের অতল গহ্বরে । সাগর মন খারাপ করবে ভেবে জমিদারের অত্যাচারের কথা আমি না তুললেও, সে নিজেই বলে উঠে, ‘এককালে বড় বেশী নির্যাতন করেছে তো, এখন সেসবের ফল ভোগ করছে । ছেলেপিলে সব মদ-জুয়াতে আসক্ত । কিচ্ছু নেই, সব চলে গেছে । ধন-সম্পদ, মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি... সব গেছে ।’
সব শুনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে আপনাতেই ।
অত্যাচারী সে অত্যাচারীই, স্বধর্ম হোক, স্বজন হোক, তার জন্য ঘৃণাই বরাদ্দ । সেই প্রজা-নিপীড়ক জমিদারকে আমরা যেমন প্রবল ঘৃণার চোখে দেখি, সাগররাও কম ঘৃণা করে বলে মনে হলো না ।
সৈকত দা উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানী চলে গেছেন বছর দুয়েক হলো । এখনও উনার একটা কথা খুব মনে পড়ে । একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘বুঝলি ইরফান, যারা সারাদিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রসাতলে গেল বলে চিল্লাফাল্লা করে, সুযোগ পেলে দেখিস একদিন তাদের বুঝিয়ে দেব, ‘কত ধানে কত চাল, এক মুখে কত গাল’ ।’ আমাকে হাসতে দেখে বলে উঠেছিলেন, ‘হাসিস না, তোর সামনে গালি-টালি দিই না, নেহাত তুই বড় বেশী সুবোধ, ভদ্র বলে । নইলে গালিগালাজে পাঁচ-ছ’টা পিএইচডি আছে আমার । এই নিয়ে কয়েকশ পৃষ্ঠার থিসিস জমা দেয়াও আমার জন্য কোন ব্যাপার না ।’
‘চোখ বন্ধ করে বলতে পারি, সে আপনি পারবেন দাদা ।’ হাসতে হাসতে বলেছিলাম ।
‘একটা ব্যাপার দেখ, উঁচু তলায় বসে বসে নানান লেকচার দেয় তারা, অথচ নীচু তলার মানুষগুলো যে মাথার উপর ‘আকাশ’ আমক একটাই ছাদের নীচে আছে, সেসব কি কখনো খেয়াল করে ? কেবলি তীব্র ঘৃণার বিষে ভরা একটা ইনজেকশন পুশ করার তালে আছে ।’
সৈকত দা’র কথাগুলো বড় বেশী মনে পড়ে, বড় সত্য বলে মনে হয় ।
একবার আড্ডায় জয় দাশ আমাদের এক বন্ধুকে হাস্যচ্ছলে বলে উঠেছিল, ‘তুই তো ব্যাটা মানুষই, তবে মানুষের আগে কেবল একটা ‘স্বরে অ’ হবে ।’
যারা হাজার বছর ধরে বয়ে চলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বচ্ছন্দ গীতিটাকে অস্বীকার করতে চান, মায়া-মমতা, সৌহার্দ্য-ভালবাসা, প্রীতি-বিশ্বাসকে ভঙ্গুর বলতে চান, আমাদের পরিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেন, যারা সর্বক্ষণ ঘৃণার বিষে ভরা একটা ইনজেকশন পুশ করার উপায় খুঁজেন, তাদেরকেও আমার মানুষ মনে হয় ঠিকই, তবে তারা ‘স্বরে অ’ মানুষ ।
______