এক
আমার ছেলের সাথে কথা বলাটাও যেন একটা বিনোদন । তার সাথে যত গম্ভীর বিষয় নিয়েই কথা বলি না কেন, সে ঠিক একটা হাস্যরস সৃষ্টি করবেই । মাঝে মধ্যে বেশ বিরক্ত লাগে, এসব । সারাক্ষণ এমন হালকা মুড ভাল লাগে ?
‘আচ্ছা, তোর কি কোনদিন আক্কেল হবে না ? তোর সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করছি, সেখানেও তুই হাসাহাসি করবি ?’
‘আব্বা, আমার বোধহয় আক্কেল দাঁত উঠে নাই এখনো ! দেখেন তো উঠছে কি না ?’ এই বলে সে হাঁ করে দাঁত দেখাতে চলে আসে ।
ভালই লাগে । আর্থিক-দৈন্যতার মাঝেও যে হাসি-খুশীর কোন দৈন্যতা থাকে না, বরং ভালবাসার একটা স্বতস্ফূর্ত ঐশ্বর্য্য উপচে পড়ে, সে তো আমার ঐ পাগল ছেলেটার জন্যই । তার সাথে আমার সম্পর্কটা অবিশ্বাস্য রকম সহজ । হয়তো অনেক বছর ধরে বাপ-বেটা একসাথে থাকতে থাকতে এমন হয়ে গেছে ।
দুই
ছেলেটা চাকরি খুঁজছে বহুদিন যাবৎ । পাচ্ছে না । দুপুরে খেতে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে তোর চাকরির কি অবস্থা ?’
‘অবস্থা আর কি । এখনো বায়বীয় ।’
‘মানে কি ?’
‘সোজা মানে হলো চাকরির খবর নাই । এই যুগে দুই ‘এম’ ছাড়া চাকরি হয় না, আব্বা !’
এবার রসিকতার ভূত আমার মাথায় ভর করল । বললাম, ‘তো দুই এম নিয়ে যা না । বসে আছিস কেন ? একটা বড় হাতের এম, একটা ছোট হাতের এম ।’
সে বিশাল হাসি দিয়ে বলে উঠে, ‘আব্বা, আপনিও না পারেন ভালোই । মানি’র ‘এম’ এন্ড মামা’র ‘এম’ দরকার আমার । কোথায় পাই বলেন তো ?’
‘কোন একটা স্কুলে চাকরির কথা বলছিলি, ঐটার কি অবস্থা ?’
‘ভয়ংকর অবস্থা ! তেনারা তেনাদের কোন এক আত্নীয় কে নিয়ে ফেলেছেন !’
‘ওহ ! আর কোন খবর নেই, না?’
‘খবর থাকবে না কেন ? আছে তো । পেপার-টেলিভিশনে অনেক খবর । তবে আমার চাকরির কোন খবর নেই ।’
‘ও...’
‘আব্বা, আপনি যদি আমার মতো একটু চালাক-চতুর হতেন, তাহলে আজ আমার এত কষ্ট করা লাগত না ।’ বেশ ভাব নিয়ে সে বলে ।
‘আর তুই যদি আমার চালাকির দশভাগের একভাগও পাইতি, তাহলে তোর এমন পথে পথে ঘুরা লাগত না ।’ যুতসই একটা জবাব দিতে পেরে, আমার নিজেরই খুব ভাল লাগে । হা হা হা ।
‘না, আব্বা । সত্যি বলছি । আপনি যদি তখন একটা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে রাখতেন, তাইলে কাজের কাজ হয়ে যেত না !’
‘কতবার বলছি তোরে, আমি যুদ্ধ ফুদ্ধ করি নাই...’ আমার কথা কেঁড়ে নিয়ে সে বলে উঠে, ‘যুদ্ধ করা লাগবে কেন ! আপনি গেলেই তখন সার্টিফিকেট পেয়ে যেতেন । তখন তো সবাই মুক্তিযোদ্ধা । তাছাড়া...’ এবার আমিই আটকে দিই তাকে । ‘এই বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাচ্ছি না রে ! আমাকে ক্ষ্যামা দেয় ।’
ছেলেটা কেমন বিষন্ন মুখ করে শার্টটা গায়ে চাপিয়ে দিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল । ছেলেটার বিষন্নতা আমার একদম সহ্য হয় না । কোথায় যেন শিরশিরে একটা অনুভূতি টের পাই ।
তিন
বেশ রাত করেই ঘরে ফিরে, আসাদ । ‘কিরে,এতক্ষণ কোথায় ছিলি ? খাইছিস টাইছিস কিছু ?’
আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার পা ধরে বসে সে । হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমাকে মাফ করে দেন আব্বা ! আমার একদম উচিৎ হয়নি, কথাটা বলা । আমি ভুল করছি । আর জিন্দেগীতে যদি...’
‘আহ, এই রাত-দুপুরে কি শুরু করলি ! উঠ, উঠে আয় ।’
‘আয়, আমার বুকের কাছে আয় । শোন তোকে একটা কথা বলি । বাবারে, আমি বড় দূর্বল চিত্তের মানুষ ! যুদ্ধ তো দূরের ব্যাপার, গুলি হাতে নেয়ার মতো সাহসও আমার কোন কালে ছিল না...’ ।
‘থাক না, আব্বা ! আমার জানা লাগবে না ।’
‘নাহ, তবু বলি । বহুদিন তো হয়ে গেল, সেসব কথা আর হয় না । তুই-ও বড় হয়ে গেলি । যুদ্ধদিনের কথা শোনানোর আবদার রাখার ঝক্কিও ফুরিয়ে গেল আমার ।’
‘...উমম... আসলে কি জানিস তোকে একটা ঘটনা বলতে চাই । কখনো কাউকে বলিনি । শুনবি ?’
‘আপনি শোনালে, আমি শুনব না, তা কি হয় আব্বা !’
চার
‘বহুদিন আগের কথা তো সব ঠিকঠাক মনে পড়ে না । তখন তো জানিসই আমার তরুণ বয়স । টুকটাক কবিতা লিখি ।’
‘আব্বা, আপনি কবিতা লিখতেন ?’
আমাকে কেমন জানি লজ্জা পেয়ে বসল । ‘ঐ টুকটাক চেষ্টা করতাম আর কি !’
‘ওরেব্বাস ! আমি কবি-বাবার ছেলে !’ আসাদের মুখ-চোখে কে যেন কয়েক শ ওয়াটের বাল্ব লাগিয়ে দিয়েছে । কি উজ্জ্বল হয়ে গেছে ওগুলো । পুত্র-গর্বে পিতা উজ্জ্বল হয় শুনতাম । পিতৃ-গর্বে পুত্রও কি এমন উজ্জ্বল হয়ে যায় !
‘একাত্তরের শুরুর দিকের কথা । রাজনীতির মাঠ ভীষণ উত্তপ্ত । আমার আব্বাও আমার মতোই ভীতুর ডিম ছিলেন । তিনি আমাকে একটা চিঠি পাঠালেন । যাতে স্পষ্ট হুকুম ছিল, যেন ইউনিভার্সিটির পাঠ যেমন আছে তেমন রেখেই, বাড়ীর পথ ধরি । আমারও শহরে থাকার সাহস ছিল না । আব্বার চিঠি পেয়ে তাই বিকালেই গ্রামের পথ ধরি ।’
‘তখন কি শেখ মুজিব ভাষণ দিয়ে দিয়েছেন ?’
‘নাহ, তখনও দেন নাই । রেসকোর্সের ভাষণ শুনেছিলাম, ইসমাইল চাচার দোকানে । গ্রামের সব লোকের সে কী উচ্ছাস । বললে বিশ্বাস করবি না, দোকান থেকেই একটা মিছিল বেরিয়ে গেল ।’
‘আর আপনি নিশ্চয় সেই মিছিলে ছিলেন না ।’
‘নারে, ছিলাম । কেন যেন ওদের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল । বুক ধুকপুক ধুকপুক করলেও স্লোগানগুলি শিহরণ জাগাচ্ছিল । মেজর জিয়ার ঘোষণাও শুনেছিলাম, ঐ ইসমাইল চাচার দোকানে । এখনো যেন কানে লেগে আছে রেডিওর সেই কন্ঠস্বর... ’
‘আই মেজর জিয়া অন বিহাফ অফ আওয়ার গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান... ।’
‘আব্বা, থামলেন কেন ? বলেন না, শুনতে তো ভালই লাগছিল... । এ কী কাঁদছেন কেন, আব্বা ?’
‘বাকীটা কালকে বলি । আজকে আর বলতে ইচ্ছে করছে না ।’
‘ঠিক আছে । যখন খুশী তখন বলবেন । কোন সমস্যা নেই । এখন ঘুমাতে যান ।’
পাঁচ
হঠাৎ এমন কান্না চলে আসল কেন, ছেলেটা কি বুঝতে পারল ? মনে হয় পারেনি । নিজের অক্ষমতার উপর মাঝে মাঝে এমন বিতৃষ্ণা চলে আসে, বিরক্তি চলে আসে । ইচ্ছে হয়, চিৎকার করে শুধু কাঁদতে থাকি ।
কাছ থেকে ভয়ংকর সেই সব দিন দেখেছিলাম । উত্তর পাড়ায় গিয়ে একদিন নিজ চক্ষে দেখে এসেছিলাম, আর্মিদের নৃশংসতা । ওরে বাবা ! সে কী ভয়ংকর দৃশ্য ! মনে পড়লে এখনো যেন গা-গুলিয়ে উঠে । ঘরে ফিরে স্বাভাবিক হতে লেগে গিয়েছিল কয়েক মাস ।
আম্মার সে কী কান্না ! বিলাপ ধরে ধরে কাঁদতেন । কেউ কেউ বলতেন আমাকে নাকি জ্বীনে ধরেছে ! আব্বা আমার উপর জারি করে দিয়েছিলেন কঠিন হুকুম । ঘর থেকে একদম বের হওয়া যাবে না । বড়জোর উঠোন পর্যন্ত । আমিও সানন্দে মেনে নিয়েছিলাম, আব্বার নির্দেশ ।
আর্মিরা যে কেন উত্তর পাড়া পর্যন্ত এসে ফিরে গিয়েছিল, কে জানে ! তবে আমাদের গ্রামে আর আসেনি । ঘর-উঠোন উঠোন-ঘর, এই ছিল আমার সময় কাটানোর জায়গা । সময় কাটানোর জন্য আরো একটা কাজ অবশ্য করতাম, কবিতা লেখা । ভীষণ ভাল লাগত, কবিতা লিখতে । নিজের যত অনুভূতি লিখে রাখতাম সব কবিতায় । আব্বা আগের মতোই স্কুল করতেন, নিয়ে আসতেন ভয়ংকর ভয়ংকর সব খবর । আব্বা-আম্মা চুপিসারে কথা বলতেন, পাছে আমি শুনে ফেলি ।
আমার সব বন্ধুরাই চলে গিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে । শুধু আমি যেতে পারিনি । সাহস হয়নি । বসে বসে শুধু নিজের ভীতু চরিত্র কে অভিশাপ দিতাম । আর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব্ব নিয়ে কবিতা লিখতাম ।
আর্মিরা ভয়ে পালাচ্ছে, ভয়ের চোটে তাদের প্যান্ট খুলে গেছে । তাতে পশ্চৎদেশ হয়ে পড়েছে উন্মুক্ত । ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে তাদের পায়খানা হয়ে যাচ্ছে । মুক্তিযোদ্ধারা তা দেখে হাসতে হাসতে লূটিয়ে পড়ছেন... কত রকম ভাবনা মাথায় আসত !
কত পুরনো কথা । আজ হঠাৎ সব এভাবে মনে পড়ছে কেন, কে জানে !
ছয়
‘আসাদ, আসাদ । বাবা, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি ?’
ছেলেটা ধড়মড় করে উঠে বসল । ‘না বাবা, ঘুমাইনি । বলেন ।’
আহারে, দরকার ছিল না । মাঝরাত্তিরে ছেলেটাকে এভাবে না ডাকলেও চলত । কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে উঠল ছেলেটা । ‘থাক, তুই ঘুমা । আমি ভেবেছিলাম এখনো জেগে আছিস ।’
‘আব্বা, আমার আর ঘুম আসবে না । বরং কি বমি করতে আসছিলেন, বমি করে দেন ।’
‘না রে, তেমন কিছু না । কাল সকালে বললেও চলবে ।’
‘এখন বলার জন্যই তো এই মাঝরাতে ছুটে এসেছেন । তো আর সকাল-বিকাল করার কি দরকার । একালেই বলে ফেলেন ।’
‘আসলে তেমন কিছু না । ঐ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথাটা শেষ করতে চাচ্ছিলাম । কেন জানি মনে হচ্ছে, দিনের আলো এলেই আমি আর কথাটা তোকে বলতে পারব না । তুই সারাজীবন একটা আফসোসের মধ্যেই থেকে যাবি ।’
‘ঐ সব আফসোস টাফসোস আমার আসে না ।’
আমি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে নিলাম । ‘বুঝলি, যুদ্ধে না-গেলেও সারাক্ষণ আমি যুদ্ধের কথা-ই ভাবতাম । এক এক রাত্রে ঘুম থেকে জেগে উঠতাম, দুঃস্বপ্ন দেখে । উত্তরপাড়ার বীভৎস দৃশ্যগুলি চোখের সামনে ভেসে আসত । রাবেয়া খালার বিশ্রীভাবে পড়ে থাকা, মজিদ চাচার উলংগ লাশ... সব কেমন যেন জীবন্ত হয়ে উঠত । আমি কখনো চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠতাম । আম্মা এসে মাথায় পানি টানি দিতেন । মাঝে মধ্যে আরো ভয়ংকর একটা দৃশ্য, দুঃস্বপ্ন দেখতাম । যেটা দেখলে আমি এক-দুই দিন একদম ঝিম মেরে যেতাম । দেখতাম, আমি কুকুরের মতো পাকিস্তানি আর্মিদের পা-চাটছি আর ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইছি । তারা এটা দেখে ঘর কাঁপিয়ে হাসছে ।’ আমি এক নিঃশ্বাসে এতটুক বলে থেমে গেলাম ।
‘আব্বা, আপনার এত কঠিন সময় গেছে আর আপনি আমাকে এসব এতদিন বলেননি !’
তার কথা শুনে আমার হাসি পেল । এটা হাসির কথা না, তবু কেন হাসি আসল জানি না ।
সাত
আমরা অনেকক্ষণ কেউ কথা বললাম না । দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত তিনটা পঁয়ত্রিশ । ভোর হয়ে আসছে, আমার অতিদ্রুত কথা শেষ করা দরকার । ভোর হয়ে গেলে আমি আর হয়তো আসল ঘটনা বলতে পারব না । ছেলেটা সারাজীবন ঐ আফসোস নিয়েই বেঁচে থাকবে ।
‘বুঝলি, ভীতু হওয়ার বড় জ্বালা । আমি তাই সবসময় চেয়েছি, তুই যেন ভীতু না-হোস । সেই সব দিনে যদি বই পড়া আর কবিতা লেখা না-থাকত, তাহলে হয়তো আমি পাগল-ই হয়ে যেতাম ।’
আমি আশা করেছিলাম, আসাদ কিছু বলবে । কিন্তু সে তন্ময় হয়ে আমার কথা শুনছে । আমি থামার পরও সে কিছু না-বলায়, আমি আবার শুরু করলাম ।
‘কবিতা অসাধারণ একটা জিনিস । বুঝলি, কবিতা হচ্ছে আত্নার খোরাক । স্রষ্টার ঐশ্বরিক একটা দান । আমার স্বেচ্ছা-গৃহবন্দী দিনগুলোতে কবিতার মতো ভালো আমার আর কিছুতে লাগত না । একদিন তোর দাদা আমার একটা কবিতা দেখে ফেলেছিলেন । শিক্ষক মানুষ ছিলেন তো, কবিতা বুঝত । সাহিত্যের কদর জানত । পড়েই উনার কী যে উচ্ছাস, বলার মতো না । হাঁক-ডাক করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছিলেন । আম্মাকে বলছিলেন, “শাহেদা, তোমার ছেলে বিশাল কবি হবে । নজরুলের চেয়েও বড় কবি হবে । তুমি দেখে নিও । স্বাধীন দেশে ওর কবিতা পড়েই মানুষ বাঁচতে শিখবে” । আব্বার কথা শুনে আমার চোখ বেয়ে গলগল করে পানি পড়েছিল ।’
‘সেই কবিতাটা আপনার এখনো মনে আছে, আব্বা ?’
‘কি বলিস, বাবা ! আমার আব্বা আমার একটা কবিতা পড়ে উচ্ছসিত হয়েছিলেন, আর আমি সেটা মনে রাখব না !’
‘একটু শোনাবেন আব্বা ? কবিতাটা ?’
আমি একটু মুচকি হাসলাম । ‘না বাবা, আমি শোনাব না ।’
আবার কিছুক্ষণের জন্য, আমরা পিতা-পুত্র নীরব হয়ে গেলাম ।
আট
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে, আমার সময় ফুরিয়ে আসছে । আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আযান দিবে । আমি বিশাল একটা দম নিয়ে বলতে শুরু করলাম ।
‘কোথায় যেন পড়েছিলাম, কিছু ত্যাগের বিনিময়ে কিছু পাওয়া যায় । এটা আমায় পেয়ে বসেছিল । বিষয়টা আমার মাথায় একদম গেঁথে গিয়েছিল । পাকিস্তানি আর্মিদের নৃশংসতা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছিল । গণহত্যা, নির্যাতন, লুটতরাজ যেন বেড়েই চলছিল । তাদের ভয়াবহতা যে কোনমাত্রায় পৌছেছিল, তা চোখে না-দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন ।’
‘... মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আল্লাহর কাছে সিজদায় পড়ে শুধু কাঁদতাম আর কাঁদতাম । শেষে একদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম । আল্লাহর কাছে কেঁদে-কেটে বলতে লাগলাম...
ইয়া আল্লাহ ! তুমি দেশটাকে ঐ অত্যাচারীর কাছ থেকে মুক্ত করে দাও । দেশ স্বাধীন হলে, আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দেব । তারপর থেকে ঐ একটা কথা-ই আওড়ে গিয়েছিলাম, মাঝরাতের সিজদায় ।’
‘মহাল আল্লাহ আমার দোয়া রাখলেন । একদিন দেশ স্বাধীন হলো । আমিও কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম । ভয় হতো, শপথ পালন না-করলে যদি, আমার দেশটা আবার অধীনতার শৃংখলে আটকা পরে যায় । কবিতার খাতা-টাতা সব পুড়ে ছাই করে দিয়েছিলাম তখনই । আর কোনদিন একটা কবিতাও লিখিনি । লেখার চিন্তাও করিনি ।’
আমার ছেলেটা একটা দ্বীর্ঘশ্বাস গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করল ।
দূর থেকে আযানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে । অনেকদিন পর আবারও আমার সিজদায় পড়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে । আজ নামায শেষে আমি খুব কাঁদব, খুব ।
____
উৎসর্গ : সেই সব মানুষদের । যাদের ছোটখাটো অতি গোপনীয় ত্যাগও ভূমিকা রেখেছিল আমাদের লাল-সবুজের পতাকা পেতে, নিজস্ব মানচিত্র পেতে ।