কালচে ব্যথা

অস্থিরতা (জানুয়ারী ২০১৬)

রিয়াদুল রিয়াদ
  • ১০

টেবিলের উপরের এশ-ট্রে টা টেনে নিয়ে নিজের কাছে রাখল তিন্নি। ছাই এ ভরা এশ-ট্রে টার দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকাল। এই তো কয়েক দিন আগেও এখানে কোন এশ- ট্রে ছিল না। ছিল একটা সুন্দর শো পিস। সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সরিয়ে ফেলা হয় নি ঠিক, ভেঙে ফেলা হয়েছে। ছোট একটা কারণে সেদিন হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল শো পিস টা আফনান। ভেঙে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেল শো পিসটা। অথচ এই শো পিসটাই আফনান আর তিন্নি মিলে পছন্দ করে কিনে এনেছিল। টেবিলে রাখার কারণ সবসময় চোখে পড়বে, ভাল লাগবে। আর সেটাই আফনান ভেঙে ফেলল। টেবিলের উপর নাকি সিগারেটের ছাই দেখেছে আফনান। সেটা নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি। পরিবারে সদস্য তিনজন। আফনান, তিন্নি আর আফনানের ছোট ভাই আদনান। এই তিনজনের কেউ ই সিগারেট খায় না।
- তুমি বলতে চাচ্ছ সিগারেট আমি খেয়ে, এখানে ছাই ফেলে, তারপর তোমাকে জিজ্ঞেস করছি?
- আমি সেটা কখন বললাম? কি করে এখানে সিগারেটের ছাই আসল আমি কিভাবে বলব?
- আমি সিগারেট খাই?
- না।
- আদনান?
- কি বল? কখনই না।
- তাহলে আসল কোথা থেকে? আমার প্রশ্ন হচ্ছে এখানে সিগারেটের ছাই আসবে কোথা থেকে?
- আমি জানি না।
- কে আসছিল বাসায়? বল কে আসছিল?
- কে আসবে বাসায়? মাথা ঠাণ্ডা কর আফনান। এভাবে চিৎকার করছ কেন?
- মাথা ঠাণ্ডা করার মত কিছু হয় নি এখানে। তুমি সত্যি কথা বল, আমি কিছু বলব না। বল। তিন্নি, তুমি আমার সাথে মিথ্যা বল না আমি জানি। সত্যিটা বল প্লিজ।

তিন্নি আফনানের হাত ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, তুমি বিশ্বাস কর আফনান কেউ আসে নি। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।

আফনান এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দেয় তিন্নিকে।
- ভাল কথা কানে যায় না তাই তো? এখন আমাকে ছুঁয়ে মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে? আমার কিছু একটা হলেই তো তার কাছে চলে যেতে পার।
- এসব কি বলছ আফনান? কার কাছে যাব আমি?
- যে আজকে এসেছিল। তোমার সাথে সময় কাটিয়েছে। সিগারেট খেয়ে ছাই ফেলেছে টেবিলের উপর।
- আফনান, আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার বিশ্বাস ভাঙার মত কিছুই কখনও করি না।
- থাক আর ভাল সাজতে হবে না। তুমি কি করছ না করছ জানি আমি। থাকো, আসছি আমি।
- কোথায় যাচ্ছ?
- আসি, আসলেই দেখতে পাবে।

আফনান হন হন করে চলে গেল ঘর থেকে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ফেরত আসল, হাতে একটা এশ-ট্রে নিয়ে। তিন্নি বুঝতে পারে না কি ঘটছে। টেবিলের উপর রাখা শো পিসটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে, সেখানে এশ ট্রে টা রাখে। কোনদিন সিগারেট না খাওয়া আফনান সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে টান দিয়ে ছাই ফেলে এশ ট্রে তে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আফনান বলে, এখন থেকে আর সন্দেহের কিছু নেই। এখানে এশ ট্রে থাকবে। ছাই থাকবে। আমি খাব সিগারেট। তোমার সে আসলে তাকেও এখানে, ফেলতে বলবে। আমি কিছু বুঝতে পারব না।

তিন্নি নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভিতর খুব কষ্ট হয়। টপ টপ করে পানি পড়ে চোখ দিয়ে। আফনান তা দেখে না। আফনান বদলে গেছে, অনেক বদলে গেছে।
এখনও কাঁদছে তিন্নি, আফনান জানছে না, বুঝছে না। অফিস থেকে এসে আবার ঝগড়া শুরু করবে, নিজে নিজে কিছু একটা খুঁজে বের করে। বিয়ের মাত্র আট মাস হল। প্রথম ছয় মাস ভালই ছিল। এরপর থেকে আফনান সব কিছুতে তিন্নিকে সন্দেহ করে। বিয়ের আগে কারও সাথে প্রেম ছিল কিনা জানতে চায়। তিন্নি যখন বলে , ছিল না। আফনান মানতে চায় না। বিশ্বাস করতে চায় না। বলে, এই যুগে এমন কোন মেয়ে আছে, যাদের বিয়ের আগে কারও সাথে সম্পর্ক ছিল না?
তিন্নি সব শুনে। কখনও প্রতিবাদ করে। কখনও চুপ করে থাকে। আফনানকে অসুস্থ লাগে ইদানীং তিন্নির। এশ ট্রে টা রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় তিন্নি। ফ্লাটের সামনে রাস্তার ওপাশে পার্ক। পার্কের পাশে লেক। সেই লেকের পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জীবন খুব অসহ্য লাগছে তিন্নির। মাঝে মাঝে খুব মরে যেতে ইচ্ছা করে।
- ভাবী, ক্ষুধা লাগছে, ভাত দিয়ে যান একটু।

আদনানের কথায় পিছন ফিরে তাকায় তিন্নি। অতি ভদ্র ছেলে বলতে যা বুঝায় আদনান তাই। বেশী ভদ্র বলেই তিন্নির সাথে ভাবী, দেবরের যে দুষ্টামি, খুনসুটির সম্পর্ক গড়ে উঠার কথা তেমন কিছুই হয় নি। সারাক্ষণ একা একা থাকে আদনান। দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। বাসায় দুইটা মানুষ থাকলে তাদের ভিতর কথা হয়। তিন্নির সাথে তেমন কিছুই হয় না আদনানের। প্রায় কাছাকাছি বয়সের বলেই হয়ত আদনান এড়িয়ে চলে তিন্নিকে। তিন্নি কত বড় হবে আদনানের চেয়ে? এই ২ কি ৩ বছর। ভার্সিটিতে যাওয়া, এরপর খাওয়া আর দরজা আটকিয়ে বসে থাকা, এই হল আদনানের রুটিন। কোন বন্ধু বান্ধব আছে বলেও মনে হয় না, এই ছেলের।
খাবার টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার সময় একটা কথাও বলে না আদনান। তিন্নিই নিজে বলে, আদনান আমাকে কি তোমার খুব বেশী অপছন্দ?
আদনান মাথা নিচু করেই বলে, কি বলেন ভাবী? আপনি অনেক ভাল একজন মানুষ।
- আমার সাথে তুমি তো কখনও ভাল করে কথাই বল না। বুঝলে কি করে ভাল মানুষ? তোমার ভাইয়া আমাকে কত রকম কথা বলে। তুমি সবই শুনো। এরপরও মনে হয় আমি ভাল মানুষ?
- জ্বি। আপনি ভাল মানুষ এটা আমি জানি। অনেক ভাল করেই জানি। ভাইয়া যা বলছে, সব সন্দেহ থেকে। সন্দেহ আর সত্যি এক না।
- আমাকে ভাল ভাবলে, আমার সাথে কথা বল না কেন? নাকি আমাকে খুশি করার জন্য বললে আমি ভাল?
- না ভাবী। আমি আসলে কারও সাথে ভাল করে কথা বলতে পারি না। কারও সাথে মিশতে পারি না। ভয় করে।
- কিসের ভয়?
- জানিনা। আমার একা থাকতে ভাল লাগে। আপনার কথা না শুধু, আমার আসলে সব মানুষকেই বিরক্ত লাগে।
- কি বল? খুব খারাপ। তোমার ভাই তো পাগল হয়ে গেছে। তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। এখন দেখি তোমাকেও দেখাতে হবে। দুই পাগল, হিহিহি।

শব্দ করে হাসে তিন্নি। আদনান শুধু একটু মুচকি হাসি দেয়। খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। তিন্নি হাসতে হাসতেই বলে,দুই পাগলের সাথে থাকতে থাকতে আমি নিজেও পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার জানো, প্রতিদিন সকালে একবার করে মনে হয় মরে যাই। পরে আবার ভাবি, মরে গেলে এই পাগল দুইটাকে রান্না করে খাওয়াবে কে?

তিন্নি আবার হাসে। আদনান কিছু না বলে রুমে চলে যায়। তিন্নি হাসতেই থাকে। হেসে হেসে একটু হালকা হবার চেষ্টা। হাসতে হাসতে মোবাইলের দিকে চোখ দিয়ে দেখে, কেউ কল করেছে। অপরিচিত নাম্বার। তিন্নি কল ধরে হ্যালো বলে।


- স্যার, দেলোয়ার সাহেবের ব্যাপারটা শুনেছেন?

কম্পিউটার থেকে চোখ না তুলেই আফনান বলে, জ্বি না শুনি নি।
পাশের টেবিলে বসা কলিগটা এবার আফনানের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, তার বউ একজনের সাথে ভেগে গেছে। শুনেছিলাম স্বভাব চরিত্র অত ভাল ছিল না। বিয়ের আগে এক ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। নতুন করে সে প্রেম চাড়া দিয়ে উঠেছে। মোবাইলে কথা হত। এরপর সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেল।

আফনান এবার কম্পিউটার থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।
- আপনার কোন কাজ নেই? আপনাকে এসব কথা কেউ বলেছে আমাকে বলতে? নাকি আমি আপনার কাছে শুনতে চেয়েছি?
-সরি স্যার।
- কাজ করেন যান।

আফনান তাড়িয়ে দিল লোকটাকে। তবে মাথার ভিতর থেকে ব্যাপারটা তাড়াতে পারছে না। বারবার তিন্নির কথা মনে পড়ছে। তিন্নির কথা সবসময় মনে পড়ে। তবে এখন মনে পড়ার ব্যাপারটা একটু আলাদা। আগে ভালবেসে মনে পড়ত। এখন মনে হয় বার বার কি করছে? কারও সাথে আছে কিনা। এসব ভাবতে চায় না আফনান। তবুও মাথার ভিতর এসব আসে। মাঝে মাঝে নিজের সাথে খুব যুদ্ধ করে। আফনান জানে তিন্নি অনেক ভাল একটা মেয়ে। তবুও এসব সন্দেহ কেন আসে, জানে না। বাকিটা সময় কাজে মন দিতে পারে না আফনান। অসুস্থতার অজুহাতে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসে। তিন্নি দরজা খুলতেই দ্রুত বেডরুমে চলে যায় আফনান। রুমে গিয়ে হাতিয়ে হাতিয়ে কি যেন খুঁজতে থাকে। তিন্নি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আফনানের অবস্থা।
- কিছু খুঁজছ তুমি?
- হ্যাঁ।
- কী?
- তোমার মোবাইল কোথায়?

কথাটা শুনে একটু চমকে উঠে তিন্নি।
- মোবাইল কেন হঠাৎ?
- দিতে বলছি দাও।

তিন্নি হাত থেকে কাঁপা হাতে মোবাইলটা আফনানের দিকে বাড়িয়ে দিল। আফনান মোবাইল হাতে নিয়েই কল লিস্ট, মেসেজ ইনবক্স, সেন্ট বক্স চেক করতে লাগল। কিছুই পেল না।
- রিতু কে?
- আমার এক ফ্রেন্ড। আজ অনেক দিন পর কল করেছিল।
- কি করে?
- ডাক্তার। ইন্টার্নি করছে।
- হুম, নাও।

আফনানকে একটু শান্ত লাগছে। আর কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তিন্নি তখনও দাঁড়িয়ে।
- সরি আমি।

আফনানের কথা শুনে, একটু হেসে উঠল তিন্নি।
- তুমি এমন পাগল কেন?

কোন উত্তর দেয় না আফনান। আফনান খুব ক্লান্ত। হঠাৎ তিন্নির মোবাইল বেজে উঠতেই আফনান দরফর করে উঠে বসে।
- দেখি, কে কল দিছে?

তিন্নি আফনানের হাতে মোবাইল দেয়। রিতু নামটা ভাসছে।
- আচ্ছা কথা বল।

তিন্নি মোবাইল ধরে কথা বলতে শুরু করে। তবে আফনানের সামনে বলবে না। অনেকের অনেক রকম অসধারণ গুণ থাকে। আফনানের অসাধারণ গুণটা হল, ওর সামনে বসে কেউ কথা বললে মোবাইলে, মোবাইলের ওপাশে কি বলছে বুঝে ফেলে। কিভাবে যেন শুনতে পায়। যত ভলিউম কমিয়েই রাখা হোক না কেন। একদিন এক বান্ধবী মিলার সাথে আফনানের সামনে বসে কথা বলছিল। তিন্নি ভাবল ওপাশে কি বলছে শুনতে পাবে না আফনান। তবে মোবাইল রাখার পরেই আফনান অবাক করে দিয়ে, তোমরা মেয়েরাও এতো পচা কথা বলতে পার?

তাই এবার আর কোন সুযোগ নয়। মোবাইলে কথা বলে এসে দেখে আফনান ঘুমিয়ে গেছে। কিছু না খেয়েই। তবে জাগাতে ভয় লাগছে। জাগালেই রেগে যাবে আফনান। ঘুমানোর পর কত নিস্পাপ লাগছে আফনানকে। পাশে বসে মাথার চুলে আলতো করে হাত রাখল তিন্নি। তিন্নি চায়, খুব করে চায় আফনান আগের মত হয়ে যাক। রিতুকে সব বলল। রিতু সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল তিন্নির। বিয়ের আগে একটা বিষয় নিয়ে একটু মনোমালিন্য। এরপর অনেকটা সময় বিচ্ছিন্ন। আজ অনেক দিন পর আবার কথা। সব শুনে রিতু মনে হল, কষ্ট পেয়েছে অনেক। বলল, তোর আফনান মানসিকভাবে অসুস্থ। যত দ্রুত পারিস ডাক্তার দেখা। নয়ত অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে।
তিন্নি জানে আফনান এমন না। হঠাৎ করে কোন মানসিক অশান্তির জন্য এমন হয়ে যাচ্ছে। তবে অশান্তির কারণটা জানতে চায় তিন্নি। আফনান সুস্থ হোক চায় তিন্নি। আবার আগের মত ভালবাসুক চায় তিন্নি।


- ভাইয়া তোর কিছু লাগবে? তোর কি নিজে থেকে কিছুই চাইতে ইচ্ছা করে না আমার কাছে? সারাক্ষণ মন মরা হয়ে বসে থাকিস। এই বয়সের ছেলেরা থাকবে হাসি খুশি চঞ্চল। বাবা মা নাই কি হইছে? আমি আছি, তোর ভাবী আছে।

আদনান কিছু না বলে চুপ করে শুনে। বাবা মা মারা গেলেন প্রায় এক বছর। আফনানের বিয়ের দুই মাস আগে। তিন্নির সাথে বিয়ের ব্যাপারে সব ঠিক ঠাক তখন। এর মাঝে হঠাৎ করে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, বাবা মা। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় আফনান। আদনান ছিল না গাড়িতে। থাকলে হয়ত আদনানও মরে যেত। কিংবা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যেত আফনানের মত।
আদনানের কথার উত্তর না পেয়ে আফনান বলে, তোর ভাবীর কাছে টাকা দেয়া আছে। এই মাসের তোর খরচ। টাকা লাগবে চাইবি। এমন একটা ভাব নিয়ে থাকিস সবসময় যেন আমরা তোর পর। দূরের মানুষ।

আদনান মুখ তুলে তাকায়। তবে বলে না কিছু। আফনান কিছুটা হতাশ হয়ে, বের হয়ে গেল বাসা থেকে। যাবার আগে বলে গেল, আজ আসতে দেরী হতে পারে অফিস থেকে।

রিতু বলেছে, ওর পরিচিত একজন সাইকিয়াটিস্ট আছেন। অনেক নাম করা। রিতু বলে দিলে, যে কোন সময় তার সাথে দেখা করা যাবে। তিন্নি যেন যত দ্রুত সম্ভব তার সাথে দেখা করে, আফনানকে নিয়ে। কিন্তু সমস্যা হল আফনান কিভাবে নিবে ব্যাপারটা। রাজি হবে তো ডাক্তারের কাছে যেতে?

আফনানের দেরীতে আসার কথা থাকলেও, সন্ধ্যার আগেই চলে আসল। তিন্নি বাসায় একা। আদনান কখন যেন বের হয়ে গিয়েছে। আর তিন্নি একা বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুম পেয়ে গেছে বলতেই পারে না। আফনান আদনানকে কল করে বলেছিল, রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু কাবাব নিয়ে আসতে। কাবাব পার্টি হবে তিন জনের, সন্ধ্যার পর। আদনান গেছে কাবাব আনতেই।
কয়েক বার কলিং বেল টিপল আফনান। তিন্নির কোন সাড়া শব্দ নেই। আফনান দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভিতর থেকে লাগানো না। আজ তিন্নিকে একটু চমকে দিবে। কাবাব পার্টি করে, তিন্নির মন ভাল করে দিবে। ইদানীং একটু বেশীই ঝগড়া ঝাটি হয়। দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই একটা গন্ধ পেল আফনান। কড়া একটা গন্ধ। গন্ধটা সিগারেটের। সিগারেট আফনান খায়। তবে গত দুই দিন ধরে খাচ্ছে না। দুই দিন আগের গন্ধ এখনও থাকবে না ঘরে। আর এমন উৎকট গন্ধের সিগারেট আফনান খায় না। সস্তা সিগারেটের গন্ধ এটা। এশ- ট্রে টার কাছে গিয়ে নিখুঁত চোখে তাকাল আফনান। কিছু একটা খুঁজছে। হ্যাঁ এইতো, এশ ট্রে র পাশে সিগারেটের ছাই। এশ ট্রে থেকে সবগুলো সিগারেটের পিছনের অংশ ফেলে, গুণতে শুরু করল। তিন বার করে গুণল। আফনানের ঠিক মনে আছে এখানে ১৪ টা ছিল, সিগারেটের পিছনের অংশ। এখন ১৬ টা। ২ টা বেশী। আফনান এমন কিছুই সন্দেহ করেছিল। তাই আগে থেকেই গুণে রেখেছিল। সন্দেহ সত্যি হয়েছে। তার মানে লোকটা এসেছিল আবার তিন্নির কাছে। রাগে শরীর কাঁপছে। তিন্নির ঘরে যেতেই দেখল, তিন্নি চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে শরীরটা মৃদু ভাবে নড়ছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তিন্নির দিকে। একটা মানুষ কত ভাল অভিনয় করতে পারে তাই ভাবছে আফনান। এই সুন্দর মুখ, এই সুন্দর শরীরের জন্যই লোকটা আসছে। ইচ্ছা করছে এখনই গলটা টিপে ধরে তিন্নির, পৃথিবী থেকে তাড়িয়ে দিক। প্রাণ না থাকলে, এই সুন্দর মুখ, এই সুন্দর শরীরের কোন দাম নেই। বিছানার চাদর এলোমেলো। ঘরের ভিতর কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবে হাঁটল আফনান। মোবাইলটা হাতে নিল তিন্নির। রিতু নামটা কল লিস্টে। নাহ মেয়েটা অনেক চালাক। কথা বলে নাম্বার ডিলেট করে দিয়েছে। রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমের দরজা খুলল আফনান। এখনও টিপটিপ করে পানি পড়ছে। বাথরুমের ভিতর বালতিতে চোখ যেতেই চমকে উঠল। আফনানের একটা লুঙ্গী সেখানে ভিজিয়ে রাখা। মাথাটা ভন ভন করে ঘুরছে। আর কিছুই বুঝতে বাকি নেই। এই লুঙ্গীও ব্যবহার করেছে লোকটা। খুব কষ্ট হচ্ছে আফনানের। রাগ হচ্ছে। শরীর কাঁপছে সেই রাগে। বাথরুম থেকে বের হয়ে গিয়ে তিন্নিকে টেনে তুলল। তিন্নি ঘুম থেকে উঠেই আফনানকে এভাবে দেখে চমকে উঠল।
- তুমি?
- কেন খুব অসুবিধা করে ফেললাম? সব গুছিয়ে উঠতে পার নি, তাই না?
- মানে?
- একদম ঢঙ করবে না। আজ সবকিছু ধরা পড়ে গেছে। কে এসেছিল তোমার কাছে সত্যি কথা বল?
- কে আসবে? আফনান, তুমি আবার এসব বলছ আমাকে?
- মিথ্যা বলছি তাই না?
- সত্যিও বলছ না।
- আচ্ছা তাই?

আফনান রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিন্নির মাথার চুলের পিছন দিয়ে চুলগুলো খামচে ধরল। একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠল তিন্নি।
- যদি মিথ্যেই বলে থাকি, বল বিছানা এমন এলোমেলো কেন?
- বিছানা এলোমেলো থাকতে পারে না?
- আবার মিথ্যা। আবার?

শক্ত হাতে তিন্নির গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। গালে হাত দিয়ে নির্বাক চোখে আফনানের দিকে তাকিয়ে রইল তিন্নি। বিশ্বাস হচ্ছে না, আফনান গায়ে হাত তুলেছে তিন্নির। এলোমেলো চুল নিয়ে চুপ করে বিছানার মাঝে বসে, নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল তিন্নি। এই চোখের জলের কোন মূল্য নেই আফনানের কাছে। আফনান যেন গায়ে হাত তুলে একটা পৈচাশিক আনন্দ পেয়েছে। পাগলের মত ঘরের এদিক ওদিক ঘুরছে। মাথার চুল গুলো টানছে। এতো কিছুর পরও তিন্নি বলে, আফনান, এমন পাগলের মত কর না প্লিজ। আমাকে একটু বিশ্বাস কর।

আফনান তিন্নির মুখের অনেকটা কাছে মুখ এনে বলল, আচ্ছা, বিশ্বাস করলাম। খুশি তুমি? তোমাকে আমি এখন থেকে আর কিছু বলব না। খুশি তুমি?

আফনান দৌড়ে ঘরের বাহিরে গিয়ে এশ ট্রে টা নিয়ে এসে তিন্নির সামনে বিছানায় এশ ট্রে টা উপুড় করে ফেলে বলল, এই যে এখানে ১৪ টা সিগারেট খাওয়া ছাই ছিল। এখন ১৬ টা। এর জন্য কিছু বলব না। খুশি তুমি?

বাথরুমে গিয়ে বালতিটা এনে ভেজা লুঙ্গী বিছানার উপর ফেলে বলল, এই যে লুঙ্গী ভিজিয়ে রাখা, এর জন্যও তোমাকে কিছু বলব না। খুশি তুমি?

তিন্নি কিছু বলে না। আফনান পাগলের মত করছে। এসব কি ঘটছে না ঘটছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আফনানকে কিছু বলে লাভও নেই। আফনান কিছু শোনবার জন্য অপেক্ষাও করল না। বাহিরে বের হয়ে গেল। তিন্নি অনুভূতিহীন হয়ে নিশ্চুপ বসে থাকে। বিছানার উপর ছড়িয়ে রাখা, সিগারেট আর ভেজা লুঙ্গীটার দিকে শুধু চোখ বুলায়। কাঁদতে কাঁদতে বিছানা পরিষ্কার করে।

একটু পরে আদনান, আফনান দুজনে একসাথে বাসায় আসে। আদনানের হাতে একটা প্যাকেট। আফনান বলল, প্যাকেটটা নাও। আজ আমরা কাবার পার্টি করব।

তিন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। খানিক আগের আফনান অনেক স্বাভাবিক। এখন হেসে হেসে কথা বলছে।
কাবাব পার্টি চলছে। আফনান নানা রকম হাসির কথা বলে হাসছে। আদনান মনে হচ্ছে, ভাইকে দেখাবার জন্য জোর করে হাসি ফুটাচ্ছে মুখে। আর তিন্নি অবাক হয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে আবার সেই ছয় সাত মাসের আগের আফনান। যে অনেকখানি ভালবাসে তিন্নি কে, অনেক খানি ভালবাসে আদনানকে। সময় টুকু বেশ গেল। আফনান আর একবারের জন্যও সন্ধ্যার ব্যাপার নিয়ে কিছু বলল না। মনে হচ্ছে কিছুই হয় নি এমন। তিন্নিও সেসব মনে করতে চায় না। অনেক দিন পর একটু স্বাভাবিক আচরণ করছে আফনান।
রাত বাড়ছে। আফনান আর তিন্নি গল্প করছে। ভালবাসার গল্প, ভাললাগার গল্প। আফনান এর মাঝে একবার বলল, তিন্নি, আমি আসলে সরি। এমন করতে চাই না। তবুও।
- না না ঠিক আছে। তোমার উপর আমি কখনও রাগ করি না। আচ্ছা একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না।
- হ্যাঁ বল।
- কাল তো তোমার অফিস বন্ধ। আমার ফ্রেন্ড রিতু, ও বলছিল ওর পরিচিত একজন ভাল সাইকিয়াটিস্ট আছে। চল তুমি আর আমি তার কাছে যাই। দেখো, সাইকিয়াটিস্ট এর কাছে যাওয়া খারাপ কিছু না। সুস্থ বা অসুস্থ সবার জন্য কাউন্সিলিং জিনিসটা ভাল। চল একবার দেখা করে আসি।
- আচ্ছা, তুমি যা বল। অবশ্যই যাব।

তিন্নি আলতো করে জড়িয়ে ধরল আফনানকে। আফনানও জড়িয়ে ধরায় সায় দিল। তিন্নির মনে হচ্ছে অনেকটা বছর, অনেক যুগ পর, ভালবাসার মানুষটাকে নিজের করে কাছে পাচ্ছে। আফনান সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আফনান আবার আগের মত হয়ে যাচ্ছে।

ঘড়ির কাঁটার দিকে কাটিয়ে কিছু হিসেব করছে আফনান। রাত এখন ৩ টা ১২। তিন্নি পাশে গভীর ঘুমে ঘুমাচ্ছে। আফনানের চোখে ঘুম নেই। ঘুম আসবার কথা না। ঘুমিয়ে থাকা তিন্নির গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল আফনান। কত অবুঝ চেহারার একটা মেয়ে। কত ভালবাসে আফনান এই মেয়েটাকেই। মেয়েটাও মিথ্যে ভালবাসার অভিনয় করে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা মাথায় মেয়েটাকে খুন করে ফেলবে আফনান। চিরতরে পাঠিয়ে দিবে হারিয়ে যাবার দেশে। তবে কোনভাবেই বুঝতে দেয়া যাবে না, আফনানের মনের ব্যাপার গুলো। হাসি খুশি থেকে তিন্নির সব কথা শুনতে হবে। ভাল থাকার ভান করতে হবে। ভালবাসা খুব বাজে একটা জিনিস। এখানে ত্যাগের কোন ব্যাপার স্যাপার নেই। আমার জিনিস মানে পুরোটাই আমার। কারও ভাগ এখানে সহ্য হয় না। স্বার্থপর না হলে ভালবাসা যায় না।


- স্যার, দুজনকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। আমার অনেক কাছের দুজন মানুষ। একটু দেখবেন প্লিজ। আর সরি স্যার, আপনার সিডিউল ছাড়াই এদের পাঠাবার জন্য। কিছু মনে করবেন না। আসলে বেশী আপন মনে করি স্যার, একটু বেশী অধিকার দেখাই সবসময়।

তিন্নি আর আফনানের দিকে তাকিয়ে এপ্রোন পরা ছেলেটা বলল, তোরা যা। দুলাভাইকে নিয়ে যা। আমার একটু কাজ আছে। আমি বলে দিছি। গেলেই হবে।
তিন্নি মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা।
- আবার দেখা হবে। আপনাদের বাসায় একদিন যাব। শুনেছি তিন্নি অনেক ভাল রান্না করে। একদিন খেয়ে আসব।

বলে আফনানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটা। আফনান শুকনো মুখে হ্যান্ডশেক করল। মুখে কোন কথা বলল না।
আফনান তিন্নি হাঁটছে পাশাপাশি হাসপাতালের বারান্দা ধরে।
- তুমি না বললে, তোমার বান্ধবী রিতুর পরিচিত ডাক্তার।
- না আসলে...।
- হাহা। তুমি কিন্তু জানো, আমার সামনে কেউ কথা বললে, মোবাইলের ওপাশের কথা আমি সবই শুনতে পারি। এই ছেলেটার নামই রিতু, এটা বললে এতো ক্ষতি হত? আমরা যার কাছে যাচ্ছি, তিনিই ছেলেটাকে রিতু বলে ডাকছিল, মোবাইলের ওপাশ দিয়ে।
- আসলে তোমাকে বলতে ভয় লাগছিল। কি মনে কর তুমি। আমার ছেলে বন্ধু একজন......।
- আমাকে ভয় পাবার কি আছে? আমি কি বাঘ ভাল্লুক?
- না। তবুও। রিতু অনেক ভাল ছেলে।
- হ্যাঁ কথা বলেই বুঝতে পারলাম। তা ছেলে মানুষের নাম রিতু হয় কি করে?
- আসলে ওর ডাক নাম রিতুশ। অদ্ভুত নাম, তাই আমরা কলেজে থাকতে ওর নাম দিয়ে দিলাম রিতু। সেই রিতু এখনও চলছে।
- হাহা। বেশ মজার তো।

তিন্নি আফনানের হাসি দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচল। ভয় লাগছিল খুব, তিন্নির ছেলে বন্ধুকে কিভাবে না কিভাবে নেয়। আসলেই আফনান বদলে গেছে, আগের মত ভাল হয়ে গেছে। আফনান ভিতরে ভিতরে জ্বলছে। প্রচণ্ড জ্বলছে। কিন্তু তবুও নিজেকে সামলে রাখতে হবে।


- আপনাদের দুজনের কথা শুনলাম। সমস্যা গুলো শুনলাম। পরিবারের সবার ব্যাপারে জানলাম। আশা করি কেউ ই মিথ্যা বলেননি। মিথ্যা বললে, চিকিৎসা আপনাদেরই ব্যাহত হবে। আসলে প্রতি মানুষের ভিতরই হতাশা বোধ, ঘৃণা, দুঃখ, ক্রোধ, হিংসা এসব থাকে। হোক অল্প বা হোক বেশী। আর সব মানসিক সমস্যা গুলোর মূলে থাকে এসব। আমার ভিতর যেমন কিছু সমস্যা আছে, আপনার ভিতর আছে, আবার রাস্তা দিয়ে খিল খিল করে হাসতে থাকা যে মানুষটা দেখছেন তার ভিতরেও আছে। কারও ভিতর একটু বেশী, কারও ভিতর কম। যে জিনিসটা সবার ভিতর আছে, সেটা নিয়ে বোধ করি ভয় পাবার কিছু নেই। ভয় পাবার কথা না। আমরা ভয় পাব সেটা, যেটা শুধু আপনার একার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকভাবে ঘটছে। আচ্ছা, আমি ছোটটা দিয়ে শুরু করি, আপনার ছোট ভাই মানে আদনান। ওর আচর আচরণ শুনে মনে হল, ও সোশ্যাল ফোবিয়ায় ভুগছে। এই সমস্যার মানুষ গুলো কারও সাথে মিশতে পারে না ঠিক ভাবে। একা থাকতে চায়। একাকীত্বে নিজের একটা জগৎ তৈরি করতে চায়। সমস্যাটা নিজেকে ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে না পারার অক্ষমতা থেকে। আমার যতটা সম্ভব মনে হচ্ছে, বাবা মা মারা যাবার পর, ওর ভিতর সমস্যাটা দেখা দিয়েছে প্রকট আকারে। সোশ্যাল ফোবিয়া থেকে ও আস্তে আস্তে ডিপ্রশনের দিকে চলে যাচ্ছে। এবার আসি, তিন্নি, আপনার ব্যাপারে। আপনি হতাশ থাকছেন। যার কাছ থেকে প্রচণ্ড ভালবাসা আশা করছেন, তার থেকে অবহেলা পাচ্ছেন। আফনানের আচরণে মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এটাও একটা মানসিক সমস্যা। হতাশা বোধ থেকে আত্মহত্যা প্রবণতা। মেডিকেলের ভাষায় আপনার সমস্যাটাকে বলে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। ভয় পাবার কিছু নেই, সমাধান একটু পরেই দিচ্ছি। এখন আসি, আসল রুগির ব্যাপারে। এতক্ষণ পারিপার্শ্বিক কথা গুলো বললাম। এবার আফনান, আপনার ব্যাপারটা বলি। বিয়ের পরে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক, বা বিয়ের আগে প্রেমিক প্রেমিকা সম্পর্ক। এই সম্পর্ক গুলো ভেঙে যাবার প্রধান কারণ হচ্ছে, সন্দেহ বা অবিশ্বাস। স্ত্রী স্বামীকে সন্দেহ করছে, কিংবা স্বামী স্ত্রীকে। ব্যাপারটা প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক। মনে করছে, অন্য কারও সাথে তার সম্পর্ক আছে। হুট হাট ইনবক্স চেক, কল লিস্ট দেখা, কখন কার সাথে কথা বলছে সেসব খবরদারী করা। সবকিছুতে মনের মধ্যে একটা সন্দেহ চেপে রাখা। ঘরের মধ্যে অপরিচিত কিছু দেখলেই এটা সেই তৃতীয় ব্যক্তির কাজ বলে মনে করা। আগে কারও সম্পর্ক ছিল কিনা তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা। না থাকলেও, জোর করে কিছু চাপানো। কাছের বন্ধু বা কাজিনদের সাথে সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা। সবসময় একটা সন্দেহের বাতিক দেখে, অতিরিক্ত অধিকার বোধ খাটানো। সেই অধিকার দেখাতে গিয়ে, এক সন্দেহে মুড়িয়ে ভালবাসার জায়গাটা অনেক দূরে তাড়িয়ে দেয়া। ব্যাপারটা হতে পারে, অতিরিক্ত ভালবাসা থেকে। ব্যাপারটা হতে পারে, অন্য কারও কোন কথা শুনে। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার, যাকে ভালবাসেন তাকে নিয়ে ভয় হবে। তবে অস্বাভাবিক ব্যাপার হল, যখন এটা চরম পর্যায়ে চলে যায়। আপনার ক্ষেত্রে যেটা হল। এই যে সমস্যা গুলো বললাম, আপনার আছে। আশেপাশে আরও অনেকের আছে। এটাকে বলে ওথেলা সিন্ড্রোম। যে কোন কারণে হোক, আপনি ওথেলা সিন্ড্রোমের একদম শেষ পর্যায়ে চলে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, আপনার আশ পাশ থেকে এমন কিছু দেখেছেন, ফলে আপনার উপর জিনিসটা প্রভাব ফেলছে। অন্য কারও স্ত্রীর ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটতে দেখে, আপনার স্ত্রীর উপর সেসব খাটিয়ে নিজের করে রাখতে চাচ্ছেন। তবে আপনি বুঝতে পারছেন না, আপনি এভাবে আরও দূরে তাড়িয়ে দিচ্ছেন আপনার স্ত্রীকে। আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, সিগারেট বা ঐ লুঙ্গী নিয়ে। আমার যতটা মনে হয়, আপনি নিজেই লুঙ্গীটা ভিজিয়েছিলেন। এই রোগে আক্রান্ত মানুষরা যা করে আর কি। অনেকে অন্য নাম্বার থেকে ভালবাসার মানুষকে কল বা মেসেজ দিয়ে পরীক্ষা করে, আসলেই সে ভাল কিনা। আপনার অবিশ্বাস বোধের কারণে, আপনি অবচেতন ভাবেই হয়ত কাজটা করেছেন। আর সিগারেট ওখানে ১৬ টাই ছিল। আপনাকে অবিশ্বাস করানো দরকার আপনার মনের, তাই হয়ত বার বার মাথার ভিতর এটা ঢুকিয়ে দিচ্ছিল, না ওখানে ১৪ টা ছিল, ১৬ টা নয়। আশা করি, ভুল গুলো ভেঙেছে। একটু নিজে চিন্তা করে দেখুন, অযথা সন্দেহ করে কি শান্তি পাচ্ছেন? নিজে কষ্ট পাচ্ছেন, অন্যকেও দিচ্ছেন। আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালবাসেন, অনেক ভালবাসেন। এখানে বিশ্বাস থাকবে, কেন অবিশ্বাস টেনে আনবেন? একটা সাধারণ জিনিস দেখেন। যে মেয়েটা আপনাকে ভালবাসে সত্যি, সে অন্য একটা ছেলের সাথে কথা বলল মানেই সে, সেই ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়াল না। আপনি একটা মেয়ের সাথে কথা বললেন মানেই আপনি তার প্রেমে পড়ে গেলেন না। সবসময় সব কিছু নিজের সাথে তুলনা করে দেখবেন, তাহলে আর এসব জটিলতা আসবে না। আমি আপনাকে কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, নিয়মিত খাবেন। আর আমার সাথে আবার এক সপ্তাহ পর দেখা করবেন। এই এক সপ্তাহ, অফিসে যাবার কোন দরকার নেই। পরিবারের সাথে কাটাবেন। তিন্নিকে সময় দিবেন, একান্ত ভাবে থাকবেন, দরকার হলে কোথাও বেড়াতে যাবেন। সবসময় একটা উৎসব উৎসব ভাব রাখবেন। দেখবেন সব ঠিক। আর আপনার ছোট ভাইটার সাথে অবশ্যই বেশী বেশী কথা বলবেন। বেশী একা থাকতে দিলে সমস্যা হবে। বোধ করি, তিনজনের সমাধান হয়ে গেল। আফনান, আপনার উপর তিনটা মানুষের ভাল থাকা। আশা নিজে ভাল থাকবেন, এদেরও ভাল রাখবেন। আমার চেম্বার থেকে বের হবার পর থেকে আপনি সুস্থ মানুষ। একদম সুস্থ। ঠিক আছে?

আফনান তিন্নি দুজনেই মুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনে গেল। সাধারণ কিছু কথা, কিন্তু মাথার ভিতর একদম গেঁথে দিল। এতক্ষণ ধরে বলে গেলেও, বিরক্তি লাগল না। একদম না। চেম্বার থেকে বের হয়েই আফনান তিন্নির হাতটা ধরল। হাসপাতাল থেকে যাবার আগে আগে, রিতুর সাথে দেখা করে গেল। আফনান রিতুকে বলল, এই যে পুরুষ রিতু, আপনি কালকে আমাদের বাসায় আসছেন। যত কাজ থাকুক, দুপুরে দাওয়াত। আপনার বান্ধবী রান্না করে খাওয়াবে।
রিতু একটু মাথা চুলকে তিন্নির দিকে তাকাল। তিন্নি ঠোঁটের কোণায় আলতো হাসি দিয়ে, আফনানের হাতটা অনেক শক্ত করে ধরল।
এরপর দুজনে সারাদিন অনেক শপিং করল। ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু কিনল। তিন্নির আবদারে একটা শো পিস কিনল। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে একটা বাচ্চা মেয়ে। আফনান দুষ্টামির ছলে বলে, কি মেয়ে চাচ্ছ নাকি?

তিন্নি লজ্জায় মুখ লুকায় কিছু বলে না। তিন্নির খুব ভাল লাগছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কষ্টে না। আনন্দে। এখন কাঁদলে আফনান ঠিক চোখের জল মুছে দিবে। এই সুখটুকুও চায় তিন্নি। সুখের মাঝেও মনে হয়, আর একটু সুখ চাই। অনেক ভালবাসার মাঝেও মনে হয় আর একটু ভালবাসা চাই। তিন্নির মনে হচ্ছে নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের, এই দিন দশেক হবে।
পুরোটা সময় তিন্নি সাথে থাকলেও, ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনবার সময় তিন্নিকে দাঁড় করিয়ে রেখে গেল আফনান। বলল, তুমি দাঁড়াও, আমি ওষুধ নিয়ে আসি।
-আমিও আসি।
- আহা, তোমার যেতে হবে না। এখানে দাঁড়াও, ২ মিনিটই তো।

ওষুধ নিয়ে এসে তিন্নির দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিল আফনান। গালে একটা আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে বলল, তোমাকে সত্যি ভালবাসি।
- আমিও।
-------------
তিন্নি সকাল থেকে রান্না করছে। খাবে মাত্র চার জন। তবে আয়োজন অনেক। আফনান একটু পর দেখে যাচ্ছে কি রান্না হচ্ছে। রান্নার খোঁজ নেবার অজুহাতে একটু পর পর পিছন থেকে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরছে। আর বলছে, সত্যি বলছি তোমাকে ভালবাসি।

তিন্নি পাগলামি দেখে হাসে আফনানের। রান্না বান্না প্রায় শেষ। অতিথি শুধু রিতু। এখনও আসে নি। আফনান একটু আগে বের হল, বলে গেল, কিছু কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে আসি। ঘরে আছে শুধু আদনান। আদনানের সাথে সকাল থেকে আফনান আর তিন্নি একটু পর পর এটা ওটা বলছে। আদনান সেই আগের মত চুপচাপ। কিছুই বলে না। এখন আবার ব্যাগ গুছাচ্ছে। তিন্নি গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথাও যাচ্ছ আদনান?
- হ্যাঁ একটু পর ভার্সিটিতে যাব।
- কেন? আজ না বলছি কোন ক্লাস করার দরকার নেই। একদিন ক্লাস মিস দিলে কিছু হয় না। আজ আমরা দুপুরে সবাই এক সাথে খাওয়া দাওয়া করব।
- ভাবী, একটা জরুরী ল্যাব আছে। করেই চলে আসব। আমিও তো চাচ্ছি আপনাদের সাথে একসাথে বসে খাবার খেতে। কিন্তু ল্যাব মিস দিলে সমস্যা হয়ে যাবে।
- যাও, তাহলে আর কি বলা। তবে তোমার ভাইয়া শুনলে কিন্তু রাগ করবে।
- ভাইয়াকে পরে আমি ম্যানেজ করব।
- তুমি কিছু নিয়ে চিন্তিত আদনান?

হঠাৎ এই প্রশ্নে চমকে উঠল আদনান। এদিক ওদিক একটু তাকিয়ে বলল, না কি নিয়ে চিন্তা করব?
- না , কেমন যেন অস্থির লাগছে তোমাকে। এমন দেখিনি কখনও তাই জানতে চাইলাম।
- না কিছু না। আসলে কাল রাতে ঘুম হয় নি তো, তাই।
- কেন?
- এমনি।

তিন্নি আর কিছু বলল না। ঘর থেকে চলে আসল আদনানের। নিজের ঘরে গিয়ে গোসলে চলে গেল।

আদনান তার কিছুক্ষণ পরেই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বের হবার জন্য দরজা খুলতেই দেখল, একটা লোক দাঁড়িয়ে। কলিং বেল টিপতে যাবে সেই অবস্থায় আদনান দরজা খুলল। আদনান এই লোককে চিনে না। হয়ত যাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে, এ সেই।
- এটা আফনান সাহেবের বাসা না?
- জ্বি।
- আমি রিতু। আফনান সাহেবের পরিচিত আর তিন্নির বন্ধু।
- আচ্ছা। বসেন। ড্রয়িং রুমে। ভাইয়া বাহিরে আছে চলে আসবে।

রিতু ঘরের ভিতর আর আদনান বাহিরে চলে গেল।


এখন সন্ধ্যা। ঘরের ভিতর মানুষে মানুষে ভরা। আদনান ব্যাগ নিয়ে কোনমতে ঘরের ভিতর ঢুকল। সবার ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে। দু এক জন পুলিশও দাঁড়িয়ে। খাবার টেবিলটার চারদিকে মানুষগুলো।টেবিলের উপর খাবার সাজানো। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। সব নজর খাবার টেবিলটার উত্তর দিকে। ওখানে তিনটা লাশ পড়ে আছে। লাশ গুলো রক্তে ভেজা। একটা লাশ তিন্নির, একটা আফনানের, আর একটা রিতু নামের ঐ লোকটার। আদনান ব্যাগ রেখে ধুপ করে বসে পড়ল। দুজন আদনানকে ধরে ফেলল। আদনানের হাত ধরেছে একদিক দিয়ে রিনি, অন্য পাশ দিয়ে রিনির মা। রিনিরা আদনানদের ফ্ল্যাটের ঠিক বিপরীত পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। মানুষ তিন জনকে নিশংস ভাবে খুন করা হয়েছে। তিনজনেরই গলার কাছ দিয়ে কাঁটা চামচ ঢুকানো। লাশ গুলো দেখে আদনানের মাথা ঘুরছে। রিনির মা আর রিনি আদনানকে ধরে রুমে নিয়ে গেল। রিনির মা আদনানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ভেঙে পড়ে না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।

আসলে সব কিছু ঠিক হয় না। সব কিছু ঠিক হবার না।

লাশ গুলোর পাশে কাউকে ঘিরতে দিচ্ছে না পুলিশ। লাশ গুলো প্রথম দেখে ইলেক্ট্রিশিয়ান আর পানির কাজ করা ছেলে দুটো। দরজা খোলা ছিল, বাহির থেকেই লাশ গুলো দেখা যাচ্ছিল। ওরাই খবর দেয় পুলিশে। পুলিশ আসতে আসতে লোকে ভরে গেছে। এদের এভাবে মারবে কে সেটা একটা চিন্তার বিষয়। আর এক সাথে তিন জনকে এভাবে মারা সম্ভব? পুলিশের একজন অফিসার লাশ গুলোর আশেপাশে ঘুরছেন। কাঁটা চামচ ছাড়াও আর কিছু পাওয়া যায় কিনা সেটা খুঁজে দেখা। একটা অর্ধেক খাওয়া সিগারেট, আফনানের কান ঘেঁষে। আর একটা জিনিস চোখে পড়েছে। তিন্নির পায়ের কাছে একটা রক্তে ভেজা শার্ট। শার্টের সাইজ অনেক বড়। এই পরিবারের যে দুজন, আফনান আদনান দুজনেই আকারের দিক দিয়ে ছোট। রিতুরও একই অবস্থা। তার মানে অন্য কারও শার্ট। এই দুইটা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না।

পরদিন সাংবাদিক এসে বাসার আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে। আদনানের সাথে কথা বলতে চায়। আদনান কিছু কিছু যা বলে, তাতে বোঝা যায়, আফনান আর তিন্নির সম্পর্ক খারাপ ছিল। তবে এদের তিন জনের সাথেই কার শত্রুতা থাকতে পারে সে ব্যাপারে ও নিশ্চিত না। সাংবাদিকদের
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Syed Injamul Huq আপনি চালক লেখক , আমাদের সব বললেননা ।ধাধায় রাখলেন ?
ভালো লাগেনি ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬
হাহা কমেন্টে বাকিটা আছে
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
ইমরানুল হক বেলাল অসাধারণ একটি গল্প লিখেছেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়েছি।ভালো লাগলো। আপনার শুভকামনা করি। ভোট রইল ।
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬
ধন্যবাদ। চেষ্টা করেছি। দোয়া করবেন।
রেজওয়ানা আলী তনিমা গল্পটা পড়ে অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছিল , কমেন্টে বুঝলাম অনুমান ঠিক. খুব ভালো লাগলো , অনেক শুভেচ্ছা
ভালো লাগেনি ১২ জানুয়ারী, ২০১৬
ধন্যবাদ। হ্যাঁ পুরোটা আসে নি। কমেন্টে দিয়েছি বাকিটা। :)
এম,এস,ইসলাম(শিমুল) ভিষণ সুন্দর লেগেছে,,, অসাধারণ,, ভোট ও শুভকামনা রইল কবি। আমার ক্ষুদ্র পাতায় আমন্ত্রণ রইল কবি।
ভালো লাগেনি ১০ জানুয়ারী, ২০১৬
ধন্যবাদ। :) অবশ্যই।
ভালো লাগেনি ১২ জানুয়ারী, ২০১৬
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ লেখায় সাবলীল ভাবটা খুব ভাল লাগল । ডিটেকটিভ গল্পেরও স্বাদ পাওয়া গেল । এক কথায়, সুন্দর ! ভোট রেখে গেলাম ।
ভালো লাগেনি ৫ জানুয়ারী, ২০১৬
ধন্যবাদ। ভাল লাগা জানবেন।
ভালো লাগেনি ৮ জানুয়ারী, ২০১৬
রিয়াদুল রিয়াদ বাকী অংশ সাংবাদিকদের অনেকেই বলছে, লাশ গুলোর সাথে যে শার্ট পাওয়া গেছে, সেটা আফজাল সাহেবের। লোকে বলছে। আফজাল সাহেব রিনির বাবা। রিনির পরিবারের সাথে আফনানের কোন সমস্যা ছিল কিনা। আদনান উত্তর দেয় জানে না। পরের প্রশ্নটা আসে, আদনান আর রিনির ভিতর নাকি ভালবাসার সম্পর্ক আছে? এটা কি সত্যি? যদি সত্যিই হয় তাহলে এই জেদ ধরেই আফজাল সাহেব, আফনানদের খুব করল কিনা। আদনান আর কোন উত্তর দেয় না। দরজা আটকিয়ে শুয়ে পড়ে। আদনান জানে পরের দৃশ্য গুলো কি হবে। পোস্ট মর্টেন রিপোর্ট এ আসবে, তিন জনের শরীরে বিষক্রিয়া পাওয়া গেছে । বিষ দেয়া হয়েছিল অজ্ঞান করার জন্য। এরপর কাঁটা চামচ দিয়ে মারা হয়েছে। গলা আর বুকের মাঝখানটায় কাঁটা চামচ বিঁধিয়ে দেয়া হয়েছে। যে শার্ট পাওয়া গেছে, সেটা রিনির বাবার। যে সিগারেট পাওয়া গেছে সেটাও রিনির বাবার খাওয়া। পুলিশ রিনির বাবাকে গ্রেপ্তার করবে। রিমান্ডে নেয়া হবে। হয়ত স্বীকার করে নিবেন, ভালোয় ভালোয়। কিংবা করবেন না। আদনান নিজের ঘরের টেবিলটার নিচ দিয়ে একটা ছবি বের করল। বাবা আর মায়ের ছবি। ছবিটা মুছে, একা একা কথা বলতে লাগল, আম্মু, আব্বু তোমরা ভাল আছ? আমি এতদিন ভাল ছিলাম না, আজ অনেক ভাল। অনেক ভাল। বাবা মায়ের ছবিটা বুকের সাথে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল আদনান। বাবা মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, আফনান বেঁচে গেল। তখন থেকেই মনে হত, কাজটা আদনানের সৎ ভাইয়ের করা। আফনানের করা। সব টুকু কাজ আফনান করেছে। আদনান ছোট বেলা থেকে দেখেছে, বাবা এতো ভালবাসার পরও বাবাকে সহ্য করতে পারত না আফনান। আফনানের মা মারা যাবার পর, আফনানের বাবা আর একটা বিয়ে করেন। সেই ঘরের ছেলে আদনান। আর একটা বিয়ের জন্যই হয়ত বাবাকে সহ্য করতে পারত না আফনান। সহ্য করতে পারত না আদনানের মা কে। সবসময় উঁচু গলায় কথা বলত। ভালবাসা দেখাত বাবা মা, তবুও এড়িয়ে চলত আফনান। তবে আদনানকে ভালবাসত আফনান। একদম আপন ছোট ভাইয়ের মতই দেখত। তাই কখনও এমন চিন্তা আসত না, বাবা মায়ের কোন ক্ষতি আফনান করবে। কিন্তু সেই আফনান বাবা টাকে মেরে ফেলল, মাকে মেরে ফেলল। নিজে বেঁচে চলে আসল। বলে দিল সড়ক দুর্ঘটনা। আফনান সেদিন কাঁদে নি, কেঁদেছে আদনান। বাবা মা মারা গেল, আফনানের কষ্ট হয় নি, কষ্ট হয়েছে আদনানের। বাবা মা মারা যাবার তিন মাস না যেতেই বিয়ে করে বউ নিয়ে আসল আফনান। কতটা নিষ্ঠুর। কতটা খারাপ। আফনানকে সহ্য হত না আদনানের। বউকে নিয়ে আসল, বিয়ে করে। তার সাথে সারাদিন হাসি ঠাট্টা তাও পছন্দ হত না। আদনান ভিতরে ভিতরে বাবা মায়ের জন্য কষ্ট পাচ্ছে, আর আফনান বউ নিয়ে সুখে থাকবে সহ্য হত না আদনানের। অনেক দিন ধরেই চাইত, আফনান আর তিন্নির সম্পর্ক নষ্ট হোক। অনেক কিছু করেছে খুব সাবধানে। কিন্তু বিশ্বাসের পাল্লা ভারী থাকাতে কখনও সম্পর্কে চিড় ধরে নি। কিন্তু বেশীদিন তা থাকে নি। টেবিলের উপর সিগারেটের ছাই ফেলেছিল আদনান। সেদিন ভাবী ঘুমাবার পর, সিগারেট ধরিয়ে রুমের ভিতর গন্ধ করে রেখেছিল আদনান। জানত একটু পরেই আফনান আসবে। কাবাব নিয়ে আসার আগে, আদনানই ভাইয়ের একটা লুঙ্গী বাথরুমে পানিতে ভিজিয়ে রেখেছিল। অবিশ্বাসের বীজ আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, অসুখী রাখা। কিন্তু হঠাৎ করেই সব ঠিক ঠাক হয়ে গেল। আফনান, তিন্নি আগের মত হয়ে গেল। এতদিনের সব বদলে গেল। তাই এবার একটু ঘুরিয়ে কিছু করল। এবার রাগটা মাথায় খুব করে চাপল। বাবা মা কে যে মারল, তার সুখ কোন ভাবেই মানা যায় না। আগের দিন অনেক কষ্টে টেট্রোডটক্সিন যোগাড় করল। খাবারের সাথে একটু মিশিয়ে দিলেই সব, সব শেষ। তিন্নির রান্না শেষে গোসলে, আর আফনান বাহিরে, সুযোগটা কাজে লাগাল। টেবিলে সাজিয়ে রাখা সব খাবারে টেট্রোডটক্সিন মিশিয়ে দিল। এরপর নিশ্চিন্তে বেড়িয়ে গেল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে। ফিরে আসল এক ঘণ্টা পর। ততক্ষণে বিষের কাজ হয়ে গেছে। নিচে লুটিয়ে পড়ে আছে তিন জন। আফনান, তিন্নি আর সেধে সেধে মরতে আসা রিতু। কাজ তখনও বাকি। রিনিকে খুব পছন্দ আদনানের। তবে রিনির বাবাটা কেমন যেন। নিয়মিত রিনিকে মারে, রিনির মাকে মারে। রিনিদের বাসায় মাঝে মাঝে আদনান যায়, তা নিয়ে নানা কথা বলে। আগের দিন রিনিদের বাসায় গিয়ে লুকিয়ে একটা রিনির বাবার শার্ট আর এশ ট্রে তে রাখা একটা আধ খাওয়া সিগারেট নিয়ে আসে। রিনির বাবা মানে আফজাল সাহেবের শার্ট হাতে জড়িয়ে কাঁটা চামচ গুলো তিনজনের গলার ভিতর ঢুকিয়ে দিল। আধ খাওয়া সিগারেটটা ফেলে রেখে গেল। এরপর নিশ্চিন্তে দরজাটা খোলা রেখে বাহিরে চলে গেল। নিশ্চিত ফেঁসে যাবে আফজাল সাহেব। রিনিকে আর কেউ মারবে না। ভালবাসার মানুষটাকে মারবে না। বাবা মা ভালবাসার মানুষ। রিনি ভালবাসার মানুষ। এই মানুষ গুলো এখন সুখে থাকবে, অনেক সুখে। কষ্ট এদের ছুঁয়ে যাবে না আর। এদের সুখ দেখে সুখে থাকবে আদনান। তবে সুখ লাগছে না কেন যেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বার বার চোখ ভিজে আসছে। ভিজে আসার কথা না। তবুও আসছে। কানের কাছে বাজছে একটা মোটা ভারী কণ্ঠ। বলছে, ভাইয়া তোর কিছু লাগবে? তোর কি নিজে থেকে কিছুই চাইতে ইচ্ছা করে না আমার কাছে? সারাক্ষণ মন মরা হয়ে বসে থাকিস। এই বয়সের ছেলেরা থাকবে হাসি খুশি চঞ্চল। বাবা মা নাই কি হইছে? আমি আছি, তোর ভাবী আছে। বাজছে একটা মিষ্টি মেয়েলী কণ্ঠ, বলছে, আমার জানো, প্রতিদিন সকালে একবার করে মনে হয় মরে যাই। পরে আবার ভাবি মরে গেলে, এই পাগল দুইটাকে রান্না করে খাওয়াবে কে? কান চেপে ধরে বসে থাকে আদনান। তবুও খুব তীব্র চিৎকার হয়ে কণ্ঠ গুলো কানের কাছে বাজছে। মায়া বাড়াতে চাচ্ছে। আদনান সুখী হতে চায়। মায়া বাড়াতে না। তবুও একটা কালচে ব্যথা বুকের ভিতর সাই সাই করে বাড়ছে। এমন একটা কালচে ব্যথায় এতকিছু করল। এখন আবার এমন একটা কালচে ব্যথায় ধুঁকছে। মায়া বড় খারাপ জিনিস। হুটহাট অপ্রিয় মানুষ গুলো ঘিরেও বেড়ে উঠে। কিছু স্মৃতি বিস্মৃত হয় না কখনও। খুব ধারালো মুখটাতেও, কখনও কৌতুক, কখনও বেদনা খেলা করে। মনের জটিল বিষয় গুলোই, মনের রোগ।
ভালো লাগেনি ৩ জানুয়ারী, ২০১৬
মায়ের ছবিটা বুকের সাথে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল আদনান। বাবা মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, আফনান বেঁচে গেল। তখন থেকেই মনে হত, কাজটা আদনানের সৎ ভাইয়ের করা। আফনানের করা। সব টুকু কাজ আফনান করেছে। আদনান ছোট বেলা থেকে দেখেছে, বাবা এতো ভালবাসার পরও বাবাকে সহ্য করতে পারত না আফনান। আফনানের মা মারা যাবার পর, আফনানের বাবা আর একটা বিয়ে করেন। সেই ঘরের ছেলে আদনান। আর একটা বিয়ের জন্যই হয়ত বাবাকে সহ্য করতে পারত না আফনান। সহ্য করতে পারত না আদনানের মা কে। সবসময় উঁচু গলায় কথা বলত। ভালবাসা দেখাত বাবা মা, তবুও এড়িয়ে চলত আফনান। তবে আদনানকে ভালবাসত আফনান। একদম আপন ছোট ভাইয়ের মতই দেখত। তাই কখনও এমন চিন্তা আসত না, বাবা মায়ের কোন ক্ষতি আফনান করবে। কিন্তু সেই আফনান বাবা টাকে মেরে ফেলল, মাকে মেরে ফেলল। নিজে বেঁচে চলে আসল। বলে দিল সড়ক দুর্ঘটনা। আফনান সেদিন কাঁদে নি, কেঁদেছে আদনান। বাবা মা মারা গেল, আফনানের কষ্ট হয় নি, কষ্ট হয়েছে আদনানের। বাবা মা মারা যাবার তিন মাস না যেতেই বিয়ে করে বউ নিয়ে আসল আফনান। কতটা নিষ্ঠুর। কতটা খারাপ। আফনানকে সহ্য হত না আদনানের। বউকে নিয়ে আসল, বিয়ে করে। তার সাথে সারাদিন হাসি ঠাট্টা তাও পছন্দ হত না। আদনান ভিতরে ভিতরে বাবা মায়ের জন্য কষ্ট পাচ্ছে, আর আফনান বউ নিয়ে সুখে থাকবে সহ্য হত না আদনানের। অনেক দিন ধরেই চাইত, আফনান আর তিন্নির সম্পর্ক নষ্ট হোক। অনেক কিছু করেছে খুব সাবধানে। কিন্তু বিশ্বাসের পাল্লা ভারী থাকাতে কখনও সম্পর্কে চিড় ধরে নি। কিন্তু বেশীদিন তা থাকে নি। টেবিলের উপর সিগারেটের ছাই ফেলেছিল আদনান। সেদিন ভাবী ঘুমাবার পর, সিগারেট ধরিয়ে রুমের ভিতর গন্ধ করে রেখেছিল আদনান। জানত একটু পরেই আফনান আসবে। কাবাব নিয়ে আসার আগে, আদনানই ভাইয়ের একটা লুঙ্গী বাথরুমে পানিতে ভিজিয়ে রেখেছিল। অবিশ্বাসের বীজ আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, অসুখী রাখা। কিন্তু হঠাৎ করেই সব ঠিক ঠাক হয়ে গেল। আফনান, তিন্নি আগের মত হয়ে গেল। এতদিনের সব বদলে গেল। তাই এবার একটু ঘুরিয়ে কিছু করল। এবার রাগটা মাথায় খুব করে চাপল। বাবা মা কে যে মারল, তার সুখ কোন ভাবেই মানা যায় না। আগের দিন অনেক কষ্টে টেট্রোডটক্সিন যোগাড় করল। খাবারের সাথে একটু মিশিয়ে দিলেই সব, সব শেষ। তিন্নির রান্না শেষে গোসলে, আর আফনান বাহিরে, সুযোগটা কাজে লাগাল। টেবিলে সাজিয়ে রাখা সব খাবারে টেট্রোডটক্সিন মিশিয়ে দিল। এরপর নিশ্চিন্তে বেড়িয়ে গেল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে। ফিরে আসল এক ঘণ্টা পর। ততক্ষণে বিষের কাজ হয়ে গেছে। নিচে লুটিয়ে পড়ে আছে তিন জন। আফনান, তিন্নি আর সেধে সেধে মরতে আসা রিতু। কাজ তখনও বাকি। রিনিকে খুব পছন্দ আদনানের। তবে রিনির বাবাটা কেমন যেন। নিয়মিত রিনিকে মারে, রিনির মাকে মারে। রিনিদের বাসায় মাঝে মাঝে আদনান যায়, তা নিয়ে নানা কথা বলে। আগের দিন রিনিদের বাসায় গিয়ে লুকিয়ে একটা রিনির বাবার শার্ট আর এশ ট্রে তে রাখা একটা আধ খাওয়া সিগারেট নিয়ে আসে। রিনির বাবা মানে আফজাল সাহেবের শার্ট হাতে জড়িয়ে কাঁটা চামচ গুলো তিনজনের গলার ভিতর ঢুকিয়ে দিল। আধ খাওয়া সিগারেটটা ফেলে রেখে গেল। এরপর নিশ্চিন্তে দরজাটা খোলা রেখে বাহিরে চলে গেল। নিশ্চিত ফেঁসে যাবে আফজাল সাহেব। রিনিকে আর কেউ মারবে না। ভালবাসার মানুষটাকে মারবে না। বাবা মা ভালবাসার মানুষ। রিনি ভালবাসার মানুষ। এই মানুষ গুলো এখন সুখে থাকবে, অনেক সুখে। কষ্ট এদের ছুঁয়ে যাবে না আর। এদের সুখ দেখে সুখে থাকবে আদনান। তবে সুখ লাগছে না কেন যেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বার বার চোখ ভিজে আসছে। ভিজে আসার কথা না। তবুও আসছে। কানের কাছে বাজছে একটা মোটা ভারী কণ্ঠ। বলছে, ভাইয়া তোর কিছু লাগবে? তোর কি নিজে থেকে কিছুই চাইতে ইচ্ছা করে না আমার কাছে? সারাক্ষণ মন মরা হয়ে বসে থাকিস। এই বয়সের ছেলেরা থাকবে হাসি খুশি চঞ্চল। বাবা মা নাই কি হইছে? আমি আছি, তোর ভাবী আছে। বাজছে একটা মিষ্টি মেয়েলী কণ্ঠ, বলছে, আমার জানো, প্রতিদিন সকালে একবার করে মনে হয় মরে যাই। পরে আবার ভাবি মরে গেলে, এই পাগল দুইটাকে রান্না করে খাওয়াবে কে? কান চেপে ধরে বসে থাকে আদনান। তবুও খুব তীব্র চিৎকার হয়ে কণ্ঠ গুলো কানের কাছে বাজছে। মায়া বাড়াতে চাচ্ছে। আদনান সুখী হতে চায়। মায়া বাড়াতে না। তবুও একটা কালচে ব্যথা বুকের ভিতর সাই সাই করে বাড়ছে। এমন একটা কালচে ব্যথায় এতকিছু করল। এখন আবার এমন একটা কালচে ব্যথায় ধুঁকছে। মায়া বড় খারাপ জিনিস। হুটহাট অপ্রিয় মানুষ গুলো ঘিরেও বেড়ে উঠে। কিছু স্মৃতি বিস্মৃত হয় না কখনও। খুব ধারালো মুখটাতেও, কখনও কৌতুক, কখনও বেদনা খেলা করে। মনের জটিল বিষয় গুলোই, মনের রোগ।
ভালো লাগেনি ৩ জানুয়ারী, ২০১৬
রিয়াদুল রিয়াদ পুরো গল্পটা আসে নি।
রুহুল আমীন রাজু বেশ ভালো লেগেছে গল্পটি . আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইলো .
ফয়েজ উল্লাহ রবি খুব ভাল লেগেছে,শুভেচ্ছা রইল।আর ভোট রেখে গেলাম।
ভালো লাগেনি ১ জানুয়ারী, ২০১৬
ধন্যবাদ, :)
ভালো লাগেনি ৩ জানুয়ারী, ২০১৬
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম।পাতায় আমন্ত্রন রইল।
ভালো লাগেনি ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫
ধন্যবাদ। :)
ভালো লাগেনি ৩ জানুয়ারী, ২০১৬

১৪ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪