অপেক্ষার পালা প্রায় শেষ হতে চলেছে । লাশবাহী লেগুনা বাজার পর্যন্ত এসে গেছে । কয়েকমিনিটের ভেতরেই গ্রামের মূল রাস্তার মুখে এসে পৌঁছবে । বাড়ির যুবক ছেলেদের কয়জন পালকি নিয়ে রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছে । বাকি যুবক-পুরুষ সবাই রাস্তার মুখ পর্যন্ত এগিয়ে গেছে । বাড়ির পেছনের পুকুর পাড় থেকে রাস্তা দেখা যায় । বাড়ির মেয়ে-মহিলাদের অনেকেই নাকে আঁচল চেপে পুকুর পাড়ে গিয়ে জটলা করে দাঁড়িয়েছে । রাস্তার মোচড়টায় এসে একটা লেগুনা গতি কমালো । পাড়ার সব বাচ্চা -কাচ্চা গিয়ে লেগুনাটাকে ঘিরে দাঁড়ালো ।এতক্ষণ ধরে রাস্তার পাশে বসে অপেক্ষমান মুরুব্বীরাও লেগুনাটাকে ঘিরে দাঁড়ানো বাচ্চা-কাচ্চার দলকে ''হেই ,হুই , দূর যা !" ধমক দিয়ে লেগুনার দিকে এগিয়ে গেলেন । লাশ বহন করতে যাওয়া পালকি বাহক যুবকেরাও এগিয়ে গেল । ততক্ষণে পুকুর পাড় জুড়ে কান্নার রোল পড়লো । লেগুনা ভরতি মানুষ । সবার পরনে রঙিন কাপড় । মেয়েদের চোখে কাজল টানা । উত্সবের আনন্দে ঝলমল করছে সবগুলো মুখ ।জামিলের ছেলের বিয়ে আজকে ।এরা সবাই জামিলের বাড়ির আমণ্ত্রিত আত্মীয়-স্বজন । মোচড়টা দিয়ে ঘুরে লেগুনাটা আবার গতি বাড়িয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে গেল । লাশের জন্য এগিয়ে আসা লোকজন আশাহত হলো । লাশ বহন করতে আসা ছেলেগুলোর দুই-একজন জামিলের উদ্দেশ্যে দুই-একটা কঠিন বাক্য উচ্চারণ করলো । কাঙ্ক্ষিত লাশবাহী লেগুনাটা একসময় আসলো । জাবেদ মিয়ার প্রায় পচে যাওয়া লাশটা চোখ উল্টে লেগুনার ভেতরে তার বউয়ের কোলে পড়ে আছে । সঙ্গে আর কেউ নেই । জাবেদ মিয়ার বউয়ের চোখের চারপাশের কালি স্পষ্ট বোঝা যায় । প্রায় বেঁহুশের ঘোরে বুকের উপরের আঁচল সরে গিয়ে দেখা যাওয়া ব্লাউজের ভেতরের শুকনা স্তন দুইটা আমাদের গা ছাড়া বিলাসিতাকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে কটাক্ষ করে । লাশ পালকিতে তোলে বাড়িতে আনা হলো । বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল আরো তীব্রতরো হলো । মৃত জাবেদ মিয়ার বউ কিছুক্ষণ পর পরই মুষড়ে পড়ে অজ্ঞান হতে লাগলো । মাত্র চারমাসের দাম্পত্য জীবন এরই মাঝে অতীত হয়ে গেল এই নারীর । পাড়ায় পাড়ায় দুই-চারদিন হয়তো জাবেদ মিয়ার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা হবে । প্রথম যৌবনে এক অসহায় নারীর অপূর্ণ দাম্পত্য সুখ নিয়ে আক্ষেপ হবে মনিরের মার ঘরের বারান্দায় বসে জটলা বাধা কম বয়সী বউদের নিচু স্বরের কানাঘুষায় । বাদ বাকি সবটুকু অতীত । স্রেফ অতীত । কেউ মনে রাখবে , কেউ রাখবে না । এটাই নিয়ম । ইতিহাস সবসময়ই থাকে গোটাকয়েক মানুষের নখদর্পনে । তারাই এর ভিত রচনা করে । এবং তারাই এটাকে যুগ যুগ ধরে চালিয়ে নেওয়ার জন্য ঢাক-ঢোল পেটাতে থাকে । তাই অসংখ্য মানুষের রক্ত আর ক্লেদ বুকে চেপে রেখে ইতিহাস ঠিকই কালোত্তীর্ণ হয় । কিন্তু স্রেফ একটা অতীত অতীতের মতোই ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে দিনে দিনে । যাহোক , উঠানের শেষ মাথায় চারটা বাঁশের খুঁটি গেড়ে এগুলোর সাথে চারটা বড় বিছানা চাদর টান টান করে বেঁধে আড়াল তৈরি করা হলো । এই আড়ালের ভেতর লাশটাকে গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরানো হলো । তারপর লাশটাকে আবার পালকিতে তোলে উঠানের মাঝ বরাবর রাখা হলো । একে একে জাবেদ মিয়ার দূর-দূরান্তের আত্মীয় স্বজন আসতে থাকলো এবং নতুন আগত মহিলাদের অনেকেই উঠানের মাঝখানে রাখা লাশটার উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলো । পাড়া -প্রতিবেশীরা এদেরকে সামলাতে গিয়ে সত্যি কথাগুলো বলতে বাধ্য হলো । আলফাজ পাগল গোছের মানুষ । সে চেঁচিয়ে উঠে বললো , " হাসফাতালো অতোডা দিন ফইরা রইলো , বাই-বাতিযা এখটা মানুশে গিয়া উঁকি দিয়াই দেখলো না ।" কথা সত্যি । এই কথার সাথে সাথে মৃত জাবেদ মিয়ার ভাই-ভাতিজার চোখ মুখ দেখেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল । লাশ দাফনের পরে মন মরা হয়ে বাড়ির ভেতর এখানে-ওখানে সবাইকে বসে থাকতে দেখা গেল । জাবেদ মিয়ার বউয়ের বড় ভাই ভোলাগন্ঞ্জে পাথর কোয়ারি তে কাজ করেন । বোনের জামাইয়ের মরার খবর শোনে এইমাত্র এসে পৌঁছেছেন তিনি । বিলাপরত বোনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন তিনি । নিজেদের পক্ষ থেকে যতেষ্টই করেছে জাবেদ মিয়ার শ্বশুর-বাড়ির লোকজন । জাবেদ মিয়ার ব্যয়বহুল চিকিত্সার টাকার জন্য জাবেদ মিয়ার বউ জাবেদ মিয়ার ভাগের একখন্ড জমিতে পর্যন্ত হাত দিতে পারে নি শুধুমাত্র জাবেদ মিয়ার ভাই-ভাতিজার বাধা আর তিরস্কারের কারণে । শেষমেষ নিজেদের সম্পত্তি বিক্রি করে চিকিত্সা করিয়েছে জাবেদ মিয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজন । একথা সবারই জানা । বোনের অসহায়ত্বের সঙ্গে সম্পত্তি হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব ভাইয়ের দুঃখবোধটাও তাই একই সুতার দুই প্রান্ত মাত্র । বোনের প্রতি ভাইয়ের এই আবেগঘন সমর্থন-দৃশ্যের সাথে আশেপাশের মাঝ বয়সী মহিলাদেরও সহানুভূতি দেখতে পাওয়া গেল । ঠিক এমন সময় জামিলের বাড়ির দিকে বিয়ের বাদ্য বেজে উঠলো । জামিলের বিদেশ ফেরত ছেলের বিয়েতে প্রচুর খরচা-পাতি করা হচ্ছে - কারা যেন বলাবলি করছিলো তখন রাস্তার মুখে বিয়েতে আসা জামিলের আত্মীয়-স্বজন ভরতি লেগুনাটা দেখে । বাদকের দলটাকেও নিশ্চয়ই ভালই টাকা দেওয়া হয়েছে তাহলে । পুরো গ্রাম জুড়ে ড্রামের ধিড়িম ধিড়িম শব্দের প্রতিধ্বনিই টাকার অংকের মোটামুটি বিশালত্ব প্রমাণ করে । এতদিন পরে চাচার বউয়ের প্রতি সহানুভূতির মাত্রা মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠলো জাবেদ মিয়ার ভাতিজাদের ।বাদ্যের বাজনায় বিরক্ত সুঠাম দেহগুলো লাটিসোটা নিয়ে এগিয়ে গেলো বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে । শেষ দৃশ্যটা দেখার জন্য আমিও তাদের পিছু নিলাম ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
গল্প পড়ে মনে icহলো লেখক জীবনের সুক্ষ দিক খুটনাটি গুলো এতো সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন যে মনের সেলুলয়েডে দৃশ্যের মতো তা ভেসে উঠেছে............অনেক ভাল লেখা তা বলাই যায়......রাজনকে ধন্যবাদ............
মিছবাহ উদ্দিন রাজন
জুঁইফুল , আপনার অন্যান্য মন্তব্যগুলোতেও দেখলাম , আপনি লেখাগুলো পড়ে অত্যন্ত সুচিন্তিত মতামত দিয়ে থাকেন । এতে একজন লেখক যে কতটুকু পরিমাণ উত্সাহিত বোধ করতে পারেন , আশাকারি আপনি এর পুরোটুকুই অনুধাবন করতে পারেন । অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে ।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
জীবন নাট্যের ছোট ছোট কাহিনীগুলোকে এত নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেছেন দেখে ভীষণ মুগ্ধতা নিয়ে গল্পটা পড়ে গেলাম যেন গল্পটা নয় কাহিনীটাই চোখের সামনে দেখছিলাম। খুব ভালো।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।