।। ১।।
কফির মগটা উল্টে দিয়ে সাথিয়া উঠে দাড়িয়ে বললো- কনক সম্পর্ক গুলোকে আমি চায়ের কাপে ডুবিয়ে অনেক আগেই গলাধঃকরণ করে নিয়েছি। আর সে জন্যই কারো আবেগ আজকাল আমার কাছে শুধুমাত্র সিনেমার ডায়লগ মনে হয়। সম্পর্ক গুলো যেন গৎবাঁধা বারুদের মতো, আঘাত লাগলেই যার বিস্ফোরন হয়। তবে তোমার কথা ভিন্ন।
সত্যি বলতে সম্পর্ক থেকে আমি এখন অনেক দূরে। একটা সময় ছিল জীবন সংগ্রামের জন্য অভিনয় করতাম, হাসি মুখে বন্ধু কিংবা স্বজনদের সাথে। চোখে মায়াভরা পূর্নিমা এঁকে, ভালোলাগার মানুষের সাথে। সং সেজে, পাওনাদারদের সাথে। অনেক অভিনয়ের পরেই তবে আজ উর্বশী হয়েছি। আলোছায়ার এই সিনেমা ঘরে শুধু নৃত্য-গীত হয়না সেই সাথে পাপেরও রচনা হয়। এখানেও সম্পর্ক-সম্পর্কের একটা খেলা চলে। কর্মের আগে অনেক তোষামোদি। কর্ম ফুরিয়ে এলে আমরা কেউ কাউকে চিনি না।
কনক সাথিয়ার এমন দীর্ঘ কথা শুনবার পর, অনেকক্ষণ চেয়ে রইল ওর চোখের দিকে। ‘কেমন রহস্যময় একটা নদী যেন’ ওর চোখের দুটো ধারায়। এমন চোখে তাকিয়ে বললো, আপনি তো এমন কঠিন ছিলে না। কেমন করে বুকের ভেতর সমস্ত মায়াজাল ছাড়িয়ে বারুদ নিলেন?
ঘরের ভেতর ওরা দুটো মানুষ কথার ফাঁকে ফাঁকে নীরবতাকে টেনে আনছিল। আজ অনেক কিছু বলবে বলেই কনক এসেছে। তবে সাথিয়ার চোখ মুখে ব্যস্ততার ভার জানান দিচ্ছে আজ নিরবতা বুঝি অনেক কথা গিলে নেবে। কফির মগ দুটো হাতে নিয়ে সাথিয়া বললো- কনক আজ অনেক কিছুই বলবো, আপনি একটু বসুন আমি ভেতর থেকে আসছি।
।। ২।।
সাথিয়ার সাথে কনকের প্রথম পরিচয়টা স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়েছিল। সাথিয়া তখন রেডিওতে নতুন আর.জে কথাবন্ধু হয়ে জয়েন্ট করেছে, আর কনক অনলাইন পত্রিকার ফিচার পাতার সম্পাদক। পিসিতে কাজের ফাঁকে অনলাইন রেডিও শুনবার অভ্যাসেই আর.জে সাথিয়ার সাথে আড্ডার শুরুটা হয়। আর দশটা কথাবন্ধুর মতো সাথিয়া ঝটপট কথা বলতে না পারলেও বেশ সুরেলা কণ্ঠে অনেকক্ষণ ধরে বকাতে পারতো। অনেক কথার ভীড়ে, একদিন কনক সাহস করে ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিল। সপ্তাখানেক পরে ফেসবুকে বন্ধু হয়ে গেল ওরা। কাজের ফাঁকে ফেসবুকের জানালায় মাঝে মাঝে চ্যাট হতো। কনকের নিজের জানামতে গুছিয়ে ফিচার লেখা ছাড়া আর তেমন কোন গুন নেই, যা দিয়ে কোন মেয়েকে সে ইমপ্রেস করতে পারে। কথাবন্ধু সাথিয়ার মোহনীয় ভঙ্গির ছবি, সুন্দর সুন্দর গল্পকথার নেশায় ক্রমাগত ডুবে যায় সে। সুন্দর ফুল দেখলে ভেতরে থেকে অদৃশ্য ভালোলাগা যেমন করে হাতছানি দেয়, তেমনি সাথিয়ার সাথে অনলাইন আড্ডায় ভেতরে ভেতরে অদৃশ্য ভালোলাগা জন্মাতে থাকে। নিজের রুপ-রহস্য-গুন না থাকা স্বত্ত্বেও ইচ্ছে শক্তির প্রভাবেই মনে মনে সাথিয়াকে ভালোবেসে ফেললো সে। আর এভাবেই একদিন সব দ্বিধা-দ্বন্ধ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সাহস করে দেখা করবার অনুমতি চাইল।
পাবলিক লাইব্রেরীর ক্যাফেতে বসেছিল কনক। সাথিয়াকে চিনতে কোন অসুবিধা হয়নি ওর। ফেসবুক প্রোফাইলে ছবি দেয়াই ছিল। হাত তুলে হ্যালো বলতেই, সাথিয়া এগিয়ে এসে অভিবাদন জানাল। ওরা ক্যাফেতে না বসে, লাইব্রেরীর সিড়িতে গিয়ে বসলো। আশে-পাশে তখন নর-নারীর আলাপচারিতায় মুখরিত। ওরা যে কি বলে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। হাতের পেপারটা পাশে ভাজ করে রেখে, কনকই প্রথম বললো, আপনার কণ্ঠ কিন্তু আসলেই সুন্দর। কথাবন্ধু না হয়ে কণ্ঠশিল্পী হতে পারতেন? সাথিয়া বললো, কিছু একটা হবার ইচ্ছে ছিলনা, তাই হইনি। তাছাড়া কথাবন্ধু হওয়াটা বড় কিছু নয়। কনক বললো- কি যে বলেন, আপনি তো রিতিমতো সেলিব্রেটি! আর সে, তুলনায় আমি চুনোপুটি। সাথিয়া এবার মেঘরঙা চুল ছড়িয়ে মুচকি হাসলো। আকাশ থেকে চোখ ঘুড়িয়ে এনে বললো, আপনি চুনোপুটি নন রিপোর্টার। ইচ্ছে করলেই সাধারণ কাউকে সামান্য প্রতিভার মাত্রা দেখিয়ে সেলিব্রেটি বানিয়ে দিতে পারেন। আপনার লেখা পড়ি মাঝে মাঝে, ভেতরে কথার বাগান আছে। কনক বললো, বাগান-পুকুর আছে কি না জানিনা, তবে আমি হলাম গুণহীন সাধারণ চিন্তিত মধ্যবিত্ত বাঙালী। সাথিয়া উঠে দাড়িয়ে বললো, সব মধ্যবিত্তরাই চিন্তিত বাঙালী, আপনি কি কখনো ভেবেছিলেন কোনদিন রিপোর্টার হয়ে যাবেন? ভাবেন নি কিন্তু বেঁচে থাকবার জন্যই হয়ে গেছেন।
সেদিন পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বেরুবার সময় কনকের সেলফোন নম্বরটা সাথিয়া নিয়ে নিল কিন্তু ওরটা দেয়নি। কনক মুখফুটে বলতেও পারেনি। যাবার বেলায় শুধু বলেছিল আপনার চুল দেখে দুলাইন বলতে ইচ্ছে করছে? কপালে যদি বিব্রত হবার ভাব না আনেন তাহলে বলি। হাতে নেয়া আইসক্রিম ঠোঁটে ছুঁইয়ে সাথিয়া বলেছিল-বলেই ফেলুন, তবে আমি কবিতা পছন্দ করিনা। একথা শুনবার পর কনক বলেছিল খানিকটা অপছন্দ না হয় আজ আইসক্রিমের সাথে খেয়ে নিলেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘এত মেঘ কোথায় পেলে, যদি আকাশ হতাম উড়িয়ে দিতাম রোদের মতো। তোমার মেঘ চুলে গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত স্বপ্ন বুনে যেত’।
।। ৩।।
কনক তারপর থেকে বেশ ক’দিন সেলফোন পাশাপাশি-কাছাকাছি রেখে ঘুমাতো। যদি সাথিয়া ফোন দেয়। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। রেডিও অনুষ্ঠানে ওর প্রোগ্রাম থাকলেও সেখান থেকে কিছু জানা সম্ভব নয়। আর ফেসবুক থেকেও সাথিয়া অনুপস্থিত। কনক ভাবল একদিন রেডিও অফিসে গেলেই হয়ত দেখা হয়ে যাবে। প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন ফোন নম্বরটা নিলেই হতো। সাথিয়া হয়তো তাকে ভালোবাসবে না, কিন্তু সে যে ভালোবাসে সেটা অন্তত জানানো দরকার।
মহাখালী থেকে একটু দুরে রেডিও সারেগামা’র অফিস। কনক একদিন গিয়ে হাজির হলো। রিসেপশনে সাথিয়ার নাম বলতেই, অবাক চোখে ওকে বেশ কিছু প্রশ্ন করবার পরই বসতে বললো রিসিপশনিস্ট মহিলাটি। ভেতরে খবর পাঠানোর পর সাথিয়া চোখে মুখে অবাক নিয়ে হাজির। শঙ্খ খোলের শাড়ি পড়ে হঠাৎ নিজের বয়সটা যেন অর্ধেক কমিয়ে এনেছে সে। কাছে এসে বললো, আপনি হঠাৎ এখানে? কনক সাদাসিধে উত্তর আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো চলে এলাম।
কনকের হঠাৎ আগমন যে সাথিয়ার মুখে বিরক্তির রঙ মেখে দিয়েছে সেটা খানিক পড়েই বোঝা গেল চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে। প্রথমে কিন্তু বেশ সপ্রভিত ছিল। ওরা পাশের ক্যান্টিনেই বসেছিল। সাথিয়া ভাবছিল, সে হয়তো মনে মনে চাইছিল কনকের সাথে তার দেখা হোক তবে সেটা এত ঘন ঘন নয়। তাহলে তার জমানো স্বপ্নগুলো মলিন হয়ে যাবে। মুখে কফি নেবার পর সাথিয়া বললো, কনক বাবু আপনি আমার প্রেমে পড়ে যান নি তো আবার? কনক একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর চুপ মেরে গেল। সাথিয়া আবার বললো, প্রেমে না পড়াটাই ভালো। আর যদি পড়ে যান তাহলে কিন্তু; কনক মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো তাহলে যাই হয় হবে, সত্যি বলতে, আমি আপনার প্রেমেই পড়ে গেছি।
পৃথিবীটা এমন যে, এখানে প্রেমে পড়বার জন্য কোন কমিশন লাগে না, কোন শর্ত থাকেনা, কোন ভ্যাট দেয়া লাগে না। আর খুব সহজেই নদীতে ডুব দেবার মতো মানুষ খুব সহজেই প্রেমে পড়ে যায়। ফ্রি-তে প্রেমিকাকে স্বপ্ন দেখে যায়। প্রেমটা যেন অফুরান নির্মল হাওয়া, নাক ডুবিয়ে খেয়ে নাও পয়সা লাগবে না। বসে বসে এসবই ভাবছিল সাথিয়া। দুজন নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ। নিরবতা ভেঙে সাথিয়া বললো- কনক আমি আরো উপরে উঠতে চাই, নিজেকে আরো উন্নতশিরে দেখতে চাই। তার জন্য অনেক বছর লেগে যেতে পারে। যদি আপনার সম্ভব হয়, তাহলে ততদিন অপেক্ষায় থাকুন। লক্ষ্যে পৌছে যাবার সিড়ি পেলে, তখন ভেবে দেখবো আপনার সাথে প্রেম করা যায় কিনা।
রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। অফিস থেকে কনকের সাথেই বেড়িয়ে পড়েছিল সাথিয়া। ট্যাক্সি ডেকে দুজন এক সাথেই রওনা হয়েছিল। সারা পথ দুজন নিরবতা নিয়ে বসেছিল। শহরকে পেছনে ফেলে দুজনার অনুভুতি জোনাকির মতো আলো নিয়ে উড়ছিল। বাড়ি ফেরার পর কনকের মনে হলো প্রেমের দরকার নেই। কেউ তাকে ভেবে, অপেক্ষায় রেখে, কোন একদিন জানাবে তবেই প্রেম হবে। এভাবে হয় না। থাকুক প্রেম-প্রেমের জায়গায়। সাথিয়ার সেলফোন নাম্বার সেদিনও নেয়া হয়নি নয়তো, বুঝিয়ে বলা যেত। কিংবা কতদিনের অপেক্ষা সেটাও জানা যেত।
প্রতিদিন সন্ধ্যে পেড়িয়ে রাত হলেই কনকের মনে পরে যায় একদিন এমনি রাতে দুজন বাড়ি ফিরছিল ব্যাস্ত শহরকে পেছনে ফেলে। দুজনের নিরবতা দুজনের মাঝখানে এক অদৃশ্য ভালবাসার গান গাইছিল।
প্রতিদিনকার কর্ম ব্যাস্ততায় কনকের দিন পেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মন থেকে কিছুতেই সাথিয়াকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিল না। ভালোবাসার নির্লিপ্ত বাসনাগুলো অপেক্ষার আকাশ খুলে বসে থাকে। আর সে জন্যই প্রেমিক মন সহজে পরিশ্রান্ত হয় না।
বসন্তের এক রাতে কনকের সেলফোনে অচেনা নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এলো। ‘কনক, আমি ডুব দিলাম ক’মাসের জন্য। সম্ভব হলে অপেক্ষায় থাকবেন। আমার খোঁজ করতে হবেনা। ভালো থাকবেন-সাথিয়া’।
কর্মব্যস্ত জীবনে কনকের অপেক্ষা শুরু হয়। সাথিয়া রেডিওতে আর আসেনা। ফেসবুকেও বসে না। যে নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিল সেটাও বন্ধ। কনক বিষয়টা কারো সাথে শেয়ার করেনি বলে কাউকে কিছু বলতেও পারেনা। বেশ ক’মাস কেটে যাবার পর ওর মনে হয় কেউ ভালোবাসলে এভাবে উধাও হয়ে যেতে পারেনা?।
তাছাড়া সাথিয়া কিন্তু বলেনি সে কনককে ভালোবাসে। একজন কিনা উপরে উঠার জন্য সিড়ি খুঁজছে, আর সে তার অপেক্ষায় দিন গুনছে। কখনো কখনো কনকের মনে হয় সাধারণ মানুষগুলো সেলিব্রেটি হয়ে গেলে পুরোনো অনেক কিছুই বোধহয় মনে রাখেনা। দিন যায় বর্ষা শেষে বসন্ত আসে। এভাবেই কনকের জীবন ধীরে ধীরে ভালোবাসার মায়া জাল থেকে বের হয়ে আসে। ওদের পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সন চালু হয়ে যাওয়াতে কাজ আরো বেড়ে যায় কনকের। প্রিন্টেড ভার্সন হয়ে যাওয়াতে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় খবরের সন্ধানে। এবারের ঈদ সংখ্যার কাজ নিয়ে কনক কয়েকদিন শহর থেকে একটু বাইরে ছিল। অফিস ফিরতেই এক বন্ধু ফোন করে জানালো- তোর প্রিয় আর.জে সাথিয়া তো টালিগঞ্জের সিনেমায় নেমেছে। এ মাসেই ওর অভিনীত একটা সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। কনক ভেবেছিল বন্ধুরা মজা করছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি কনক। খবরের কাগজে ফিচারটা দেখে আস্বস্থ হলো। কনককে যেহেতু সাথিয়া খুজতে নিষেধ করেছিল সে জন্য এ নিয়ে আর অনুসন্ধানী দৃষ্টি সে কোথাও রাখে নি।
দীর্ঘ দু’বছর পর টালিগঞ্জের শুটিং ইউনিট গাজীপুর শুটিং স্পটে সিনেমার কাজে আসে। খবরটা পেয়েই সে ছুটে যায়। অনেক নিরাপত্তা বেষ্টনি পেড়িয়ে সাংবাদিক পরিচয় দেখিয়ে তবেই পৌছাতে পারে সে। কনক ভাবছিল সাথিয়া কি এখন তাকে চিনবে? আগে না হয় সাধারণ সেলিব্রেটি ছিল কিন্তু এখন সিনেমা মুক্তি পেলেই সে অসাধারণ হয়ে যাবে। এখন হয়তো কনককে দেখলে চিনতেই পারবে না। ভাবনার বেড়াজাল কাধে নিয়ে কনক এগোচ্ছিল। কনকের ভাবনার একটু বদল হলো। ওকে দেখেই সাথিয়া এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করলো। তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো কেমন ছিলেন এতদিন? কনকের অন্য কোন কিছুর ভাবনা মাথায় তখন নেই। মুখে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো, অপেক্ষায় ছিলাম আপনার জন্য।
সেখানে আর বেশি কথা হলোনা। একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে সাথিয়া বললো আগামী সপ্তাহের প্রথম রোববার আসবেন এই ঠিকানায় কথা হবে। কনক ঠিক বুঝে নিয়েছিল তার প্রেম আর হবার নয়। এবার তাকে থামতে হবে।
সপ্তাহখানেক ধরে নানাবিধ ভাবনায় মগ্ন ছিল কনক। সাথিয়ার সাথে দেখা হবার পরপরই নিজেকে গুছিয়ে নেবার ভাবনাটা মনে গেঁথে নিল। এভাবে জীবন চলে না। এবার নিজের দিকে খেয়াল দেয়া প্রয়োজন। কার্ডের ঠিকানা আনুযায়ী কনক সঠিক সময়েই পৌছে গিয়েছিল সাথিয়ার ফ্ল্যাটের সামনে। রাতের পথচলা তখন শুরু হচ্ছে। রাস্তার সোডিয়ামের লাইটের মতো অনেক বিষণ্নতা নিয়ে সাথিয়ার দরজায় বেল বাজিয়ে ছিল সে।
।। ৪।।
কনক এতক্ষণ বসে বসে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরোনো এসব কথাই ভাবছিল। অনেকক্ষণ বাদে সাথিয়ার ডাকে সম্বিত ফিরে পেল। পিছনে ঘুরে দেখলো সাথিয়ার হাতে দুটো ব্যাগ। কনক বলে উঠলো কোথাও যাচ্ছেন নাকি? আমি তাহলে পরে আরেকদিন আসি।
-পরে আর আপনি আমাকে কোথায় পাবেন?’
-কেন আপনি কি দেশ ছেড়ে দিচ্ছেন নাকি?
-হ্যাঁ চলে যাচ্ছি সব কিছু ছেড়ে। আর সেজন্যই আপনাকে ডেকেছি। আপনাকে আমার প্রথম দিন দেখেই ভালো লেগেছিল। আপনি বলেছিলেন আপনার মাঝে কোন গুন নেই। আপনার স্পষ্টবাদী কথা বলা, নিজেকে সরল ভাবে উপস্থাপন করা, অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকা এ ব্যাপার গুলোই আমার কাছে অনেক বড় গুন হিসেবে ভালো লেগেছিল। আপনার কবিতায় নিজের অনুভূতি খুজে পেয়েছিলাম। বলতে গেলে আমিই আপনার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটাকে অনেক কষ্টে চেপে রেখেছিলাম। আমার একটা স্বপ্ন ছিল একদিন অভিনয় শিল্পী হবো।
কনক এতক্ষণ কথা শুনছিল। চোখ ভর্তি বিস্ময় ওকে খুব নাড়া দিচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিল নিজেকে এতকাল ফেলনা মনে হতো, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার কাব্যের জমিনেও কেউ প্রেমে পরতে পারে।
সাথিয়া আবার বলতে শুরু করলো, র্যাম্প মডেলিং এ ঢুকেছিলাম। কিন্তু কে জানতো শরীর প্রদর্শন শুধু ক্যামেরার সামনেই নয়, পেছনেও দেখাতে হয়। সিনেমার রঙীন পর্দা আমাকে রঙীন জলে ডুবিয়ে দিল। মনটা ভেঙ্গে চুরমার হলো আর শরীর বলতে কিছু রইল না। যাকে ভালোবাসবো তার জন্য অপবিত্র অনুভূতি জমিয়ে রাখা যায়না। আইটেম গার্ল হয়ে গেলাম। হয়তো এটাই কপালে ছিল। সেদিন পর্যন্তও ভেবেছিলাম, অনেকদিন পেরিয়ে গেছে আপনি এতদিনে নিশ্চয়ই কাউকে খুজে নিয়েছেন। কিন্তু আমার ভাবনার উল্টোরথ দেখে আমি নিজেই বিস্মিত। এখন বুঝতে পারছি আপনি আমায় সত্যিই ভালোবাসতেন। কনক আমি রিয়েলি সরি, এতটা কষ্ট আপনাকে দেব সেটা কখনো ভাবিনি। নিকষ কালো রাতের মতো আমার সব কিছু ডুবে গেছে তাই আমাকে আর আপনার পাশে এখন বড্ড বেশি অপবিত্র লাগবে। কথাগুলো শেষ করে সাথিয়া চোখ মুছবার জন্য টিস্যু পেপারের বক্স নিয়ে এলো। কনক তখন মাথা নিচু করে বসে আছে। সাথিয়া কনকের পাশে বসে হাতটা ছুঁয়ে বললো, সকালের সূর্যের মতো হোক আপনার জীবন সমস্ত রাত আমার জন্য থাকুক। আমি চলে যাচ্ছি একেবারে। চোখভর্তি জল নিয়ে মাথা তুলে কনক বললো, তোমার কি না গেলেই নয় সাথি?
রাত দ্বিপ্রহর হতে চলেছে। রেলস্টেশনে দাড়িয়ে আছে কনক। সাথিয়া টিকেটি নিয়ে ট্রেনে গিয়ে উঠলো। মৈত্রী এক্সপ্রেস আর কিছুক্ষণ পরই ছেড়ে যাবে কলকাতার উদ্দেশ্যে। কনক কোনদিন এভাবে কাঁদেনি। আজ বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সাথিয়া চলে যাচ্ছে এদেশ ছেড়ে। আর কখনো আসবে না। নিজেকে এভাবে অবনতির আর এক সোপান নিচে নামিয়ে কাউকে ভালোবাসা যায় না। সিনেমার জগতে ছোক-ছোকানির বড্ড বার। কেউ কেউ সিড়ি টপকাতে গেলে পড়ে যায়। সাথিয়ার বেলাতে তা হয়নি। কিন্তু সে হারিয়েছে আপন স্বত্ত্বা। যার জন্ম জমিয়ে রেখেছিল কৌটো ভরতি প্রেম সেখানে আজ শূন্যতা।
ট্রেন যখন প্লাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছিল কনক তখন রাতের আকাশে চোখ রেখে গাইছিল ‘এত মেঘ কোথায় পেলে, যদি আকাশ হতাম উড়িয়ে দিতাম রোদের মতো। তোমার মেঘ চুলে গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত স্বপ্ন বুনে যেত’।