নির্বাসনের নিমন্ত্রণ

পরিবার (এপ্রিল ২০১৩)

নির্বাসিত নীল
  • 0
  • ২৩
দল বেঁধে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট পাখি। দেখতে অনেকটা টুনটুনি পাখির মত। কিন্তু এ পাখিগুলার নাম কি? তারা আকাশে না উড়ে ঘরের ভেতরই বা উড়ছে কেন? আশ্চর্য!! পাখিগুলো একটা আরেকটার সাথে কথাও বলছে। সেটাও স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে। এসবের মানে কি?
রিদম। এই শালা উঠ। দিনে দুপুরে এত ঘুম কিসের রে?
রিদম চোখ মেলে তাকাল। তার সামনে অপু বসে আছে। ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ। পাখি আসার প্রশ্নই আসে না। তারপরও সে ভাল করে এদিক-ওদিক দেখে নিল। না ঘরে কোনো পাখি নেই। তার মানে এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল।
অপু বলল এই অসময়ে ঘুমচ্ছিস ব্যাপার কি? শরীর খারাপ করে নি তো? রিদম শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল না শরীর ঠিকই আছে। দেখতো এখন কয়টা বাজে? অপু মোবাইল দেখে বলল চারটা তেরো।
ও। তা তুই এই ভোর বেলা কোত্থেকে এলি? অপু চোখ কপালে তুলে বলল ভোর বেলা মানে! এখন বিকাল চারটা তেরো বাজে। কয়টা বাজে? চারটা তেরো। বুঝলি?
বিকাল চারটা তেরো বাজে মানে! রিদম কিছুই বুঝতে পারছে না। কি বলছে এসব? রিদম বোকার মত তাকিয়ে আছে অপুর দিকে। অপু রিদমের মুখের সামনে নাক এনে কেমন যেন মুখ বিকৃতির মত ভঙ্গি করল। রিদম জিজ্ঞেস করল কি? অপু বিছানার পাশে থাকা টেবিলের নিচ থেকে একটা বোতল বের করে দেখিয়ে বলল এইটা কি?
এইটা “ব্ল্যাক ভেলভেট” এর একটা খালি বোতল। রিদম বলল তুই মনে হয় এইটা আজই জীবনের প্রথম দেখলি?
শালার আমি দুই পেগ হুইস্কি গলায় ঢাললেই নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনা। আর তুই কিনা দেবদাস সেজে পুরা এক বোতল সাফাই করে দিলি ?
রিদম তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। বলল দোস্ত আমিতো আমার পার্বতীকে ভুলে চন্দ্রমুখীর দেখা পেতে চেয়েছিলাম শুধু। কিন্তু দু পেগ হুইস্কিতেও যখন চন্দ্রমুখীর দেখা পাচ্ছিলাম না। তখন নিজের অজান্তে কখন যে পুরো বোতলটা সাফাই করে দিয়েছি বুঝতেই পারি নি।
তাতেও কি চন্দ্রমুখীর দেখা পেয়েছিস?
না পাইনি। তবে একদিন ঠিকই পেয়ে যাব। আশা করতে দোষ কি বল?
ভালোই বলেছিস। আশা করতে আবার দোষ কি! আশায় আশায় বাঁধি বাসা। হে হে হে…
রিদম বলল থাম! আর বাসা বাঁধতে হবে না। খালা রান্না করে চলে গেছে না আছে দেখ। থাকলে চা দিতে বল আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। আর কষ্ট করে দরজা জানালাগুলো খুলে দে একটু আলো বাতাস আসুক।


রিদম আর অপু বারান্দায় বসে আছে। অপুর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের ধোয়ায় রিদমের বিরক্ত লাগছে। ইদানীং এমন হয় কেউ তার সামনে বসে সিগারেট ফুঁকছে অথচ সে ফুঁকছে কিংবা তার ফুকতে ইচ্ছে করছে না। তখন তার বিরক্ত লাগে। মাঝে মাঝে চরম রাগও লাগে। সেলিনা খালা চা নিয়ে এসেছে। লিকার একটু বেশী হয়েছে। তবে খেতে খারাপ লাগছে না। অপু বলল রিদম আজকে রাতের কথা তোর মনে আছেতো নাকি?
কি কথা ?
ভুলে গেলি! রাত ১২টা ১মিনিটে সবাই মিলে প্রিয়ন্তির জন্মদিন পালন করবে। এবং আমরাও সেখানে যাচ্ছি।
ও। তা আমরা কখন যাচ্ছি ?
এই ধর রাত দশটার দিকে।
ও। এখন বাজে বিকেল পাঁচটা। তাহলে আরো পাঁচ ঘণ্টা বাকি আছে। এর মধ্যে অনেক কিছুই করতে হবে। চল যাই।
কোথায় ?
ওর জন্মদিনের গিফট কিনতে।



রিদম আর অপু পাঁচ তলার সিড়ি ভেঁঙ্গে নীচে নামল। কালো রঙের একটা “Mitsubishi Eclipse” গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটা রিদমের পঁচিশতম জন্মদিনে তার বাবার দেয়া উপহার। রিদম বলল দোস্ত গাড়ির চাবিতো আনতে মনে নাই। তুই একটু থাক আমি দৌড় দিয়ে নিয়ে আসি।
ঠিক আছে। দেরী করিস না।
হুম। তুই বরং দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়।


রিদম বাসায় এসে গাড়ির চাবি নিল। তখন ভুল করে মানি ব্যাগটাও নেয়া হয়নি এখন সেটাও নেয়া হল। ভাগ্যিস সে মোবাইল ফোন ব্যাবহার করে না। না হয় দেখা যেত সে এটাও ভুল করে ফেলে গেছে। রিদম মোবাইল ফোন ব্যাবহার করে না। কারন এতে তার মাথায় পেইন হয়। শুধু মোবাইল ফোন না। সে কানে হ্যাডফোন লাগিয়ে গান শুনতেও পারে না। তার এ সমস্যাটা প্রায় বছর খানেক ধরে হচ্ছে। সে ডাক্তারের কাছে যাবে যাবে করেও আলসেমীর কারনে যাওয়া হচ্ছে না।
রিদম “ইম্পেরিয়াল”এর নতুন একটা বোতল খুলে এক পেগ গলায় ঢেলে ভিজিয়ে নিল। তারপর দরজা লাগিয়ে নীচে নামল। অপু বলল কি রে একটা চাবি আনতে আধ ঘন্টা সময় লাগে ?
না মানে চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই একটু দেরি হয়ে গেল। চল যাই।
হ্যা চল। এই একটু দাড়া। কেমন পরিচিত একটা গন্ধ নাকে লাগল। তুই বাসা থেকে এখন আবার পাগলা পানি খেয়ে এসেছিস?
এত বক বক করিসনাতো চল।



প্রিয়ন্তির জন্মদিনের পার্টিতে অনেক লোকজন চলে এসেছে। বেশির ভাগ মানুষই রিদমের অচেনা। বাড়িটাও সাজিয়েছে বলার মত। সাধারনত এমন ভাবে বিয়ে বাড়ি সাজান হয়। কিন্তু জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ভাবাই যায় না। অপু কয়েক জন তরুনীর ভিড়ে মিশে গেল। তার স্বভাবটাই এমন যে কারও সাথে চট করে মিশে যেতে পারে। কিন্তু রিদম মাঝে মাঝে চেনা মানুষগুলোর সাথেও সহজ হতে পারে না। প্রিয়ন্তিকে এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। সে আজ বাচ্চাদের নীমা জাতীয় কিছু একটা পরেছে। মাথায় রানীদের মত মুকুট। ওকে দেখতেও বাচ্চাদের মতই মনে হচ্ছে। প্রিয়ন্তি রিদমের সামনে এসে চিৎকার দিয়ে বলল রিদম! সত্যি তুই এসেছিস? আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছি না। আমাকে একটা চিমটি কাটবি প্লিজ?
রিদম বলল চিমটি কাটতে হবে না। আমি সত্যিই এসেছি।
আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
রিদম হাসল। বলল শুভ জন্মদিন। এই নে তোর জন্য সামান্য উপহার।
ওয়াও! ডায়মন্ড রিং? থ্যাংক ইয়্যু দোস্ত।
তোর পছন্দ হয়েছে ?
তুই এনেছিস আর আমার পছন্দ হবে না? আসলে তুই যে এসেছিস এটাই আমার সব চেয়ে বড় গিফট। এর কাছে এই রিং কিছুন না বুঝলি? চল ভেতরে যাই। ওখানে সবাই আড্ডা দিচ্ছে।
হ্যা চল যাই।


এখন রাত ১১টা ২৮ মিনিট। কেক কাটা হবে ১২টা ১ মিনিটে। এখনো ৩৩ মিনিট বাকী। আধাঁ ঘন্টা অনেকটা সময়। সবাই যে যার মত কাজে ব্যাস্ত। শুধু রিদম একা এক কোনায় বসে আছে। তার হাতে হুইস্কির গ্লাস। প্রিয়ন্তি এদিক-ওদিক ছুটা-ছুটি করছে। তার সাথে সাথে আরেকটা মেয়েও আছে। সে নীল শাড়ি পরেছে। শাড়ির সাথে মিল রেখে নীল চুড়ি আর টিপও আছে। বুঝাই যাচ্ছে মেয়েটা খুব গুছানো টাইপের। রিদম প্রিয়ন্তিকে ডাকল।
প্রিয়ন্তি বলল, কি রে! ওদিকে সবাই মজা করছে। আর তুই এদিকে একা বসে কি করছিস?
তোকে দেখছিলাম। তোর ছুটা-ছুটি দেখছিলাম। আচ্ছা এবার তুই কত বছরে পা দিলি বলতো?
উহু। বলব না। তুই জানিস না? মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই।
ও জিজ্ঞেস করতে নেই বুঝি?
উহু।
রিদম বলল প্রিয়ন্তি কবিতা শুনবি ?
কি প্রেমের কবিতা?
হুম নষ্ট প্রেমের কবিতা বলতে পারিস।
হঠাৎ প্রেমের কবিতা! কি ব্যাপার বলতো? তুই আবার আমার প্রেমে পরে যাস নি তো?
পরলে ক্ষতি কি বল? যাক গে! কবিতা শুন……

তোমাকে দেখার জন্য আমার দুই
চোখে সহস্র চোখের জাদু
এত বস্তের মধ্যেও দেখি তুমি ভাস্কর্যের মত নগ্ন,
শাড়ি ব্রা-র আবরনী ভেদ
করে আমি দেখি তোমার আবৃত স্তন
আপেলের মতো মসৃন উরু,
জলপ্রপাতের মতো নাভিমূল;
নিমিষে আমার চোখ দেখে নেয় তোমার
দেহের শিল্প, গোপন রহস্য, শরীরের পুরাকীর্তি।


প্রিয়ন্তি বলল, ছিঃ এত কুৎসিত ভাবে কেউ লিখতে পারে? কার কবিতা এটা ?
রিদম বলল, আমার গুরু 'মহাদেব সাহা’র।
কি বললি তোর গুরু? তুই আবার উনার শিষ্য হলি কবে?? হুম?
যেদিন উনার এই কুৎসিত কবিতাটা সম্পুর্ন মুখস্ত করেছিলেম সেদিন।
গুড! ভেরী গুড! আচ্ছা রিদম এবার সত্যি করে বলতো এই কবিতা শুনিয়ে আমাকে কি বুঝাতে চাচ্ছিস?
রিদম বলল, প্রিয়ন্তি তোর ব্রা-বিহীন জামার ভেতর ধবধবে সাদা মসৃন স্তনযুগল ফুলে ফেপে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার একটু উপরেই আছে স্নিগ্ধ গোলাপের পাপড়ির মত ভেঁজা দুই ঠোঁট। এমন পরিবেশে যেকোনো পুরুষকে উত্তেজিত করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। তোর ঐ ভেঁজা ঠোঁটে একটা চুমু খেতে দিবি আমায় ?
ছিঃ তুই কি করে বলতে পারিস? এত সুন্দর করে কেউ এমন নোংরা কথা বলতে পারে আমার জানা ছিল না। এসব বলতে তোর একটুও লজ্জা করল না?
লজ্জা! সে'ত তোর করা উচিত। আসে-পাশে তাকিয়ে দেখ মানুষগুলো কিভাবে তোর দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে নেই। আমি যদি পুরো নগ্ন হয়েও দাঁড়িয়ে থাকতাম তখনও মানুষগুলোর মধ্যে আমাকে দেখার জন্য এতটুকু কৌতুহল থাকত না। কিন্তু তুই অতি রুপবতী একটা মেয়ে। তোর সামান্য নগ্নতাও তাদের কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত বিশাল ব্যাপার।
আপনি ঠিক বলেছেন। আমিও একই কথা প্রিয়ন্তিকে বারবার বলছিলাম। কিন্তু ও পাত্তাই দিল না।
নীল রঙের শাড়ি পরা মেয়েটা এসে মাঝখানে কথা বলছে। রিদম জিজ্ঞেস করল আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।
প্রিয়ন্তি বলল, ও আমার কাজিন। ওর নাম রিদমী। আর রিদমী ও আমার খুব ভালো বন্ধু। তোর কাছে যার কথা বলেছিলাম সেই রিদম। তোরা কথা বল আমি একটু আসছি।
রিদম বলল, আপনার নাম রিদমী তাই না?
হ্যা।
আমার নাম রিদম। আর আপনার নাম রিদমী। তাহলে কি দাড়াল? রিদম+ ী (দীর্ঘ ই কার) = রিদমী। ওয়াও! বিউটিফুল।
রিদমী হাসল। বলল, প্রিয়ন্তি আপনার কথা এত বলেছে যে, প্রথমে আপনাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম।
ও তাই?
হুম। আচ্ছা আপনি কি করছেন? মানে সময় কাটছে কি ভাবে আপনার?
আপাদত দেবদাস সেজে চন্দ্রমুখী খুঁজে বেড়াচ্ছি। এতেই সময় কেটে যাচ্ছে।
প্রিয়ন্তির কাছে শুনেছি আপনি নাকি খুব ভালো ছবি আঁকেন। একবার নাম-ডাক হয়ে গেলে এক একটা পেন্টিং অনেক টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু শুনলাম এখন নাকি আর ছবি আকঁছেন না। কেন জানতে পারি?
দেখুন মিস রিদমী। আমি আর্থিক ভাবে খুব একটা দুর্বল নই। তা ছাড়া প্রথম পরিচয়ে কারো সাথে আমি আমার ব্যাক্তিগত বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে চাইনা। আপনার সাথে কথা বলে ভাল্লাগল। কিছু মনে করবেন না এখন আমি মদ্য পান করব। আপনার সাথে আর কথা বলতে চাচ্চি না।
তার মানে আপনি আমাকে চলে যেতে বলছেন?
হুম বলছি। কারন আমার মদ্য পানের দৃশ্য আপনার মত রুপবতী দেখুক সেটা আমি চাইছি না।
আপনি কিন্তু আমার সাথে অভদ্র আচরন করছেন?
হ্যা করছি। কেননা ভদ্রতা শেখানো হয় এমন কোনো স্কুলে আমি কখনো ভর্তি হয়নি।
প্রিয়ন্তি এসে বলল তোরা এখনো গল্প করছিস? চল চল কেক কাটব। রিদম দেখতো ড্রেস চেইঞ্জ করে এসেছি। এবার বল ঠিক আছে কিনা?
হুম। ঠিক আছে। তবে সাদা শাড়িতে কেমন যেন একটা বিধবা ভাব চলে এসেছে। জন্মদিন!! তুই রিদমীর মত একটা নীল রঙ্গের শাড়ি পরতে পারলি না? রিদমী অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নিল। মনে হয় হাসি থামানোর চেষ্টা করছে।
প্রিয়ন্তি বলল হুহ! আমার সব কিছুতেই তুই কোনো না কোনো ত্রুটি বের করবি এটা আমি জানতাম। তারপরও যে কেন তোকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। হুহ!!! চল যাই।
প্রিয়ন্তি শোন…
আবার কি ?
বিধবা হলেও তোকে খুব সুন্দর লাগছে। তুই কি জিনিস! তুই যখন ত্যানা পেচিয়ে ঘুরে বেড়াস তখনও তোকে প্রিন্সেস ডায়নার মত মনে হয়।
অনেক হয়েছে। তুই আমাকে সুন্দর বলেছিস আমি এতেই মহা খুশি। প্রিন্সেস ডায়নার সাথে আর তুলনা করিস না বাবা। চল যাই…
রিদমী বলল আপনাকে একটা কথা বলব?
না! হাতে একদম সময় নেই। আপনি বরং অর্ধেকটা কথা বলুন। হো হো হো…
থাক আর বলব না।
ওকে। আপনি চাইছেন না যখন থাক। চলুন যাই প্রিয়ন্তি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।


রিদমের রাতে খুব ভালো ঘুম হয়নি। সে তার প্রাক্তন প্রেমিকা কৈশরীকে স্বপ্ন দেখেছে। সে এক ভয়ানক স্বপ্ন! কৈশরীর একটা মেয়ে হয়েছে। চাঁদের মত ফুটফুটে মেয়ে। সে মেয়ে নতুন কথা বলা শিখেছে মাত্র। কৈশরী ছাদের উপর দোলনায় মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে। রিদম ছাদের দরজার সামনে দাড়াতেই মায়ের কোল থেকে মেয়েটা রিদমকে বাবা বলে ডেকে উঠল। কৈশরী বলছে মা এটা তোমার বাবা না। কিন্তু তারপরও মেয়েটা তাকে বাবা ডেকেই যচ্ছে। এমন সময় রিদমের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তারপর বাকী রাত তার ঘুম আসেনি। সে নতুন এক বোতল ব্ল্যাক-ভেলভেট এর সাথে রাত কাটিয়ে দিল।


রিদম ল্যাপ্টপ নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। সে প্রথমে মেইলগুলো চেক করবে। অপু আসলে তাকে অবশ্যই স্বপ্নের সম্পুর্ন ঘটনা খুলে বলবে। অপু নিশ্চয় এর সুন্দর একটা ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারবে।
দরজায় কে যেন বেল বাজাচ্ছে। এত সকালে কারো আসার কথ না। খালা আসলে নিশ্চয় বেল বাজাবে না। কারন উনার কাছে ঘরের একটা চাবি দেয়া আছে। তা ছাড়া দশটার আগে খালা কখনও আসে না। এখন বাজে সকাল ন’টা তাহলে কে আসল? অপু আসে নি তো? রিদম চেয়ার ছেড়ে দরজা খুলতে গেল। দরজার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার নাম জামাল। সে এ বাড়ির দাড়োয়ান। রিদম বলল কি ব্যাপার জামাল তুমি?
স্যার! একজন ম্যাডাম এই প্যাকেটটা দিতে বলেছে।
রিদম অবাক হয়ে বলল আমাকে দিতে বলেছে?
জ্বি স্যার।
জামাল তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?
না স্যার। ম্যাডাম আপনার নামই বলে গেছে।
আচ্ছা দাও। রিদম হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল। ভেতরে কি হতে পারে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। জামাল তুমি ম্যাডামকে আগে কখনো আসতে দেখেছো ?
জামাল বলল, না স্যার আগে কখনও দেখিনি। তবে প্যাকেটের সাথে একটা চিঠি ছিল। এই নিন।
চিঠি!
জামাল রিদমের হাতে চিঠি দিয়ে চলে গেল। রিদম প্রথমেই চিঠিটা খুলল। তাতে যা লেখা……

আমি জানি আপনি প্রথমেই চিঠিটা পড়বেন। কারন কে আপনাকে গিফট পাঠাল সেটা জানা আপনার জন্য জরুরী। এবং আপনি এখন তাই করছে। কি আমি ঠিক বলছি তো? হি হি হি… জানেন! সবাই বলে আমার হাসিটা নাকি মোনালিসার মত। আমি জানি আপনার কাছেও তাই মনে হচ্ছে। কি মনে হচ্ছে না? থাক বাদ দিন বলতে হবে না! কিন্তু শুনুন মিঃ রিদম চৌধুরী চিঠি পড়ে কোনো লাভ নেই। আমি এখনই আপনার কাছে ধরা দেব না। এবার প্যাকেটটা খুলুন। আপনার জন্য ছোট্ট একটা রঙ তুলির সেট পাঠিয়েছি। এটা অবহেলায়, অযত্নে রাখলে চলবে না। আপনাকে এটা দিয়েছি কারন আমি চাই আপনি আমার একটা ছবি একে দিবেন। ঠিক মোনালিসার মত। যদিও আমি জানি আপনি দুবছর আগেই ছবি আকা ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তবে আমার ছবিটা কবে পাব সেটাই হল মূল কথা। আশা করছি অতি শিগ্রই আপনি ছবি আকার কাজে হাত দিবেন। হাত না দিয়ে অন্য কোনো উপায় ও নেই। কেননা আপনি আমার নজরে পরেছেন। যাইহোক, আপনার জন্য শুভকামনা রইল। আর শুনুন আপনার সম্পর্কে আরো খোজঁ-খবর নেয়ে হচ্ছে। ভালো থাকবেন।

ইতি
…+ী


রিদম কাগজে মোড়ানো প্যাকেটটা খুলল। ভেতরে খুব সুন্দর একটা রঙ তুলির বক্স। তার মধ্যে ছোট, বড়, মাঝারি সহ বিভিন্ন রকমের ব্রাশ। রিদম দু বছরেরও বেশী সময় পর আজ হাতে ব্রাশ নিয়েছে। তার ভেতরটা কেমন যেন করছে। পুরনো ক্ষতে নতুন করে আঘাত লাগলে যেমনটা হয়।
দরজা খোলার শব্দ হল। তার মানে এখন খালা এসেছে। রিদম বলল খালা একটু কফি বানিয়ে দিবে?
দিতেছি। বাবা আইজ কি রান্ধুম ?
খালা তোমার যা ইচ্ছা তাই রান্না কর।
এই বৃদ্ধ মহিলাটাকে রিদমের খুবই পছন্দ। কারন উনি কাজের কথা ছাড়া তেমন একটা কথা বলে না। কাজকর্মেও খুব গুছগাছ। তা ছাড়াও উনার আরেকটা ভালো গুন হল উনি অন্য কাজের মহিলাদের মত হেন-তেন কোনো আবদার নিয়ে কখনো আসে না।
খালা বলল, বাবা ঘরেতো লবন নাই। শেষ হইয়া গেছে। আমি নিচে থেইকা নিয়া আসি।
ঠিক আছে খালা কফিটা দিয়ে তারপর যাও।
আইচ্ছা।


রিদম ল্যাপ্টপে ইমেইল ওপেন করল। অনেকগুলো ইমেইল এসেছে। এর মধ্যে তার বাবার ইমেইল-ই চারটা। সবগুলো ভালো করে পড়তে হবে। তারপর সময় নিয়ে একটা একটা করে উত্তর দিতে হবে।
এই নাও তোমার কফি।
রিদম ল্যাপ্টপ থেকে চোখ সরিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকাল। না উনি চামরা শুকিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ খালা নয়। যে কফির মগ হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে সে অত্যান্ত রুপবতী এক তরুনী। তার পরনে কালো রঙের জিন্স প্যান্ট আর সবুজ রঙের টপ্স। এই পোশাকে মেয়েটাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। রিদম হাত বাড়িয়ে কফির মগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল আপনি কে?
আমি কে মানে? তুমি আমাকে চিনতে পারছনা? আমি চারুলতা। তোমার চারু।
রিদমের চোখ কপালে উঠে গেল। মেয়েটা তাকে তুমি তুমি করে বলছে কেন? আবার বলছে তোমার চারুলতা। রিদম ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছে। বলল আপনি খালার সাথে এসেছেন?
আমি খালার সাথে আসব কেন? আমি একাই আসতে পারি। তোমার কি হয়েছে বলতো?
আমার কিছুই হয়নি। তা আপনি আমার কাছে কোনো কাজে এসেছেন? যদিও আমার কাছে আপনার তেমন কোনো কাজ থাকার কথা না।
চারুলতা বলল, তোমার কিছু না হলে এমন উল্টা-পাল্টা কথা বলছ কেন?
রিদম কফির মগে চুমুক দিয়ে একবার ভাবল মেয়েটা এমন ভাবে কথা বলছে কেন? মনে হচ্ছে সে আমাকে অনেক দিন ধরে চেনে। আচ্ছা এর ভেতর কোনো রহস্য নেই তো?
চারুলতা বলল, কফি কেমন হয়েছে?
হুম কফি ভাল হয়েছে।
আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। তাই এত ভাল হয়েছে। আচ্ছা আমরা কবে বিয়ে করছি ?
রিদম বলল, আপনারা কবে বিয়ে করছেন সেটা আমি কি করে বলব ? তা ছাড়া আমরা বলতে আপনি কাকে বুঝাচ্ছেন আমার কাছে এটাও ঠিক পরিস্কার না।
চরুলতা বলল, আমরা মানে আমি আর তুমি। এভাবে আর কয়দিন এক ছাদের নিচে থাকব? বিয়ে করতে হবে না? বিয়ে না করলে মানুষজন কি বলবে?
কি হচ্ছে না হচ্ছে রিদম কিছুই বুঝতে পারছে না। দেখুন মিস চারুলতা আপনার কথা বার্তা আমি কিছুই বুঝতেই পারছি না। আপনাকে আজই আমি প্রথম দেখলাম। এর মাঝে বিয়ের কথা কোত্থেকে আসছে ? আপনার আসল উদ্দেশ্যটা কি বলবেন প্লিজ?
চারুলতা বলল, আমার আসল কিংবা নকল কোনো উদ্দেশ্যই নেই। তুমি আমাকে বিয়ে করছ কিনা সেটা বল।
বললামই তো আপনাকে আমি চিনি না। সেখানে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না।
তার মানে তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?
অবশ্যই না।
তাহলে আমি কিন্তু ছাঁদ থেকে লাফ দিয়ে আত্তহত্যা করব।
রিদম বলল প্লিজ আপনি বরং গিয়ে তাই করুন। কেননা আপনার অর্থহীন বক বক শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর কেউ একজন ঘন্টা বাজিয়ে বলছে; তোমার যাত্রার সময় হয়ে গেছে। মানুষিক ভাবে প্রস্তুতি নাও।


চারু! তুই এখানে? আমরা তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমাদের সবার মাথা খারাপের মত অবস্থা। কি করছিস এখানে?
চারুলতা রিদমকে দেখিয়ে বলল আপু ও আমাকে বিয়ে করবে না বলছে।
ভদ্র মহিলা বলল, রিদম সাহেব আমি খুবই দুঃখিত। চারু আমার ছোটবোন। ও মানুষিক ভাবে সুস্থ নয়। পাগল বলতে পারেন। আসলে একটা ছেলে ওর সাথে প্রতারনা করে। তারপর থেকে ও এমন হয়ে গেছে। যাকে তাকে ঐ ছেলে ভেবে যা তা করে বসে। ওর ব্যাবহারে আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
রিদম বলল, আমি কিছু মনে করি নি। আপনার নামটা জানতে পারি?
আমি শ্যামা। আপনার পাশের ফ্ল্যাটে থাকি।
শ্যামা আমি আপনার কাছে একটু সাহায্য চাইতে পারি?
হ্যা অবশ্যই। বলুন কি সাহায্য করব?
টেবিলের উপর দেখুন একটা নাম্বার লেখা আছে অপু নামে। আমি টেলিফোনের কানেকশন খুলে রেখেছি। আপনি কষ্ট করে লাইনটা লাগিয়ে ওকে এক্ষুনি আসতে বলুন। রিদমের হাত থেকে কফির মগটা পরে গেছে। তার চোখ অস্বাভাবিক লাল দেখাচ্ছে। শ্যামা খানিকটা ভীত গলায় বলল, আপনাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে।
হ্যা। আমি অসুস্থ। কিন্তু আমার অসুস্থতার ঝামেলায় আপনাকে জড়াতে চাচ্ছিনা। আপনি অপুকে ফোন করে চলে যান। যা করার ও এসেই করবে।
কিন্তু……। শ্যামা কথা শেষ করার আগেই রিদম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল কোনো কিন্তু না। যান! অপুকে ফোন করে আপনি চলে যান।
যাচ্ছি।




রিদম চোখ মেলল। সে হাসপাতালের সাদা বিছানার এর উপর শুয়ে আছে। পাশে বসে প্রিয়ন্তি রিদমের চুলে পরম মমতায় বিলি কেটে দিচ্ছে। রিদমকে চোখ খুলতে দেখে প্রিয়ন্তি বলল থ্যাংক্স গড! জানিস আজ দু-দিন পর তোর জ্ঞান ফিরেছে। এখন কেমন আছিস ?
ভালো। এই দু-দিন তুই এখানেই ছিলি ?
হ্যা আমি ছাড়া তোর আর থাকার আছেই বা কে? যাগ গে! ওসব কথা এখন থাক। তুই এত বড় একটা অসুক বাধিয়ে বসে আছিস। অথচ আমাদের কিছুই জানানোর প্রয়োজন বোধ করিস নি? প্রিয়ন্তির চোখের কোনায় জল দেখা যাচ্ছে। যেকোনো সময় কাজলের প্রাচির ভেঙ্গে জল গড়িয়ে পরবে। একজন রুপবতীর চোখে জল মানায় না। অন্তত রিদমের মত মানুষের জন্যতো নয়ই। রিদম পরিস্থিতি পরিবর্তন করার জন্য বলল প্রিয়ন্তি সেদিন ত্যানার মত দেখতে তোর ঐ জামাটা পরে আমার সঙ্গে যাবি?
প্রিয়ন্তি বলল, তুই হাসপাতালে পরে মরতে বসেছিস। আর এখনও কিনা তোর মুখ থেকে এমন নোংরা কথা বের হয় কি করে?
রিদম বলল, কি করব বল? আমি যে মানুষটাই নোংরা হয়ে গেছি।
অপু কেবিনে ঢুকে রিদমের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। এ হাসির মানে কি রিদম বুঝল না। অপু বলল, রিদম তোর একটা চিঠি এসেছিল।
কার চিঠি?
এই নে দেখ।
রিদম হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। এইটা কৈশরীর চিঠি। সে কিছুক্ষন তার গালে চিঠিটা চেপে ধরে রাখল। কারন চিঠির উপর এখনো নিশ্চিয় কৈশরীর হাতের স্পর্শ লেগে আছে।
অপু বলল, আসার সময় একটা খবর শুনে এসেছি। তোর পাশের বাসায় চারুলতা নামে একটা মেয়ে ছিল। সে নাকি গত কাল ছাঁদ থেকে পরে সুইসাইড করেছে।
রিদম এমন ভাব করল যেন সে কিছুই শুনেনি। সে কৈশরীর চিঠি খুলে পড়তে লাগল।

রিদম,
শুরুতে জানাই কাঠ গোলাপের শুভ্র শুভেচ্ছা। একসময় আমরা দুজনারই এই লাইনটি খুব পরিচিত ছিলো। কিন্তু আজ সব কিছুই কেমন অপরিচিত মনে হয়। আচ্ছা কেমন আছ তুমি? জানি ভাল নেই। আমি কেমন আছি সেটাও তুমি জানতে চাওনা। তাও আমি জানি। তাই ওসব আজ উহ্য থাক। ভাবছো এতদিন পর হঠাৎ কেন চিঠি লিখলাম? আমি তোমাকে অনেকগুলো ইমেইল করেছি। কিন্তু তুমি কোনোটারই কোনো উত্তর দাও নি। তাই ভাবলাম আগের মত যেমন ডাইরীর পাতা ভরে চিঠি লিখতাম। আজও তেমন একটা চিঠি তোমার কাছে লিখি। যেখানে গুছানো কথাগুলো এলমেলো ভেবে লেখা থাকবে। তাই এই চিঠি লিখা। জান রিদম আমার কোলে চাঁদের মত ফুটঁফুঁটে একটা মেয়ে এসেছে। বাবুর কি নাম রেখেছি জান? বাবুর নাম তোমার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছি রক্তিমা। ওরা সবাই বলে রক্তিমা নাকি দেখতে আমার মত হয়েছে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় ও তোমার মত হয়েছে। সারাক্ষন আমাকে জালাতন করে। ঠিকমত খেতে চায়না। ঘুমোতে গেলেও ঘুম পাড়ানী গান না গেলে সে ঘুমোবে না। আচ্ছা!! বলতো এই পুচকী মেয়ে গানের কি বুঝে? মেয়েটা এত দুষ্টু হয়েছে যা বলার মত। ঠিক ওর বাবার মত। আমাকে এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেবেনা। হলেই চিৎকার চেচা-মেচী করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে।
আচ্ছা রিদম তুমিতো আগে আমার মনের কথা বুঝতে পারতে। এখন কি কিছু বুঝতে পারছ? না পারলেও অসুবিদা নেই। আমি নিজেই বুঝিয়ে বলছি। তুমি কি জান রক্তিমার আসল বাবা কে? শুনলে তুমি অবাক হবে। আমাকে পাগল কিংবা অন্য কিছুও ভাবতেও পার। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আজ আমি সব কিছু বলতে চাই। সেদিন তুমি মতাল হয়ে আমাকে কলঙ্কিত করেছিলে। তাপর এম.বি.এ করার জন্য দেশের বাইরে চলে গেলে। আমার কোনো বাঁধা-নিষেধ শুননি। যখন জানলাম আমার ভেতর আরেকটা আমি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। তখন তোমার সাথে অনেক বার যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। দিনের পর দিন ঘরের কোনায় মুখ লুকিয়ে তোমার অপেক্ষায় শুধু এই গান গেয়েছি “ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে”। কিন্তু চাবি খুলতে তুমিতো আসনি। নিরুপায় হয়ে বাবা-মা তখন আমার বিয়ে দিয়ে তোমার লেপন করা কলঙ্ক মুছে দিতে চাইলেন। তখন পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, আমি বাবা-মা’র ঘরে যেন একটা মেয়ে হয়ে জন্মাইনি, জন্মেছি একটা কলঙ্কের বোঝা হয়ে। তারা এই বোঝা কোনো ভাবে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। শেষ পর্যন্ত আমিও আর তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারিনি। সম্পুর্ন অজানা-অচেনা একটা মানুষকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলাম। কারন তখন আমার বাবা-মা’র প্রতি কর্তব্যের কাছে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা পরাজিত। তবে যাই বলি না কেন, সে মানুষটা না থাকলে আজ পৃথিবী জুড়ে আমার কোনো অস্তিত্ত থাকত না। একটা মানুষ জেনে শুনে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। সারাজীবন সে মানুষটার কাছে আমি ঋনী হয়ে থাকব। এ কথা ভাবতেই আমার অসস্থি লাগে। তবে এ অসস্থির মাঝেও যে একধরনের আনন্দ আছে। এ সব কথা তোমাকে বলেই আর লাভ কি ? কোনো লাভ নেই। শুনো, আমরা দেশ ছেড়ে বিদেশে নির্বাসনে এসেছি। নির্বাসন বলছি কারন, আজকাল সব জায়গাই আমার কাছে নির্বাসনের মত মনে হয়। যাই হোক, তোমার নিমন্ত্রন রইল। ইচ্ছে হলে তোমার মেয়েকে এসে এক নজর দেখে যেও। তবে কখনও বাবার অধীকার নিয়ে এসো না। কারন সে অধীকার তুমি হারিয়ে ফেলেছ। শুনেছি আজ-কাল নাকি মদ খাওয়া ধরেছে। এই বাজে নেশা অবশ্যই ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। আর একটা কথা, আমার চেয়েও ভালো একটা মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হবে। এটুকু আশা আমি করতেই পারি। ভালো থেকো।

ইতি
কৈশরী।


রিদম চিঠি ভাজ করে বালিশের পাশে রাখল। অপু বলল, রিদম আমার মনে হয় এখন তোর বাবাকে যত তারাতারি সম্ভব দেশে আসার কথা বলা উচিত। কারন এই সময় তোর পাশে উনার থাকা খুব দরকার।
রিদম হাসল। বলল আমি তোদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি তাই না রে ?
অপু কিছু বলল না। সে তার মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল। হঠাৎ করে প্রিয়ন্তি বাচ্চা মেয়েদের মত কাদঁতে শুরু করল।
রিদম বলল প্রিয়ন্তি তুই কাদছিস কেন ?
কই কাদছি না তো।
তুই আমাকে ক্ষমা করে দিবি প্রিয়ন্তি ?
প্রিয়ন্তি কাদতে কাদতেই বলল এখানে ক্ষমার কথা আসছে কেন ?
কারন আমি মনে হয় এই জন্মে আর তোর হতে পারলাম না। আমি জানি প্রিয়ন্তি, রঙতুলির সেট সহ আরো কত গিফট বক্স সাথে একটা চিঠি এ সবই তোর দেয়া ছিল। নিজেক আড়াল করার জন্য তুই রিদমীকে শুধু ব্যাবহার করছিস। রিদমী আমাকে সবই বলেছে। আর এও বলছে তুই আমাকে অনেক ভালবাসিস। কিন্তু তুই একবারও মুখ ফুটে আমাকে এই কথাটা বলিসনি। কেন বলিসনি তুই?
প্রিয়ন্তি বলল,আমি ভয়ে বলিনি। বলতে পারিনি। যদি তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস।
রিদম হাসার চেষ্টা করল। বোকা মেয়ে এখনতো বলতে পারিস। কি বলবি না? যে মানুষটাকে তুই এত ভালবাসিস অথচ তোর ভালবাসার কথাটা তাকে বলতেই পারলি না। এজন্য তোর নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে না?
হচ্ছে।
আমার বাসায় যেতে খুব ইচ্ছে করছে। আমাকে বাসায় নিয়ে যাবি প্রিয়ন্তি ?
কিন্তু এই অবস্থায় তা কি করে সম্ভব? তোর কি লাগবে বল আমি আনার ব্যাবস্থা করছি।
না আমাকেই যেতে হবে। শুধু একবারের জন্য প্রিয়ন্তি। আমাকে নিয়ে যা প্লিজ।



রিদম তার বেডরুমে দাঁড়িয়ে আছে। দু পাশ থেকে তাকে ধরে প্রিয়ন্তি আর অপু দাঁড়িয়ে আছে। তারও একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন নার্স। আর একজন ডাক্তার। রিদম প্রিয়ন্তিকে বলল, পশ্চিম দেয়ালের কালো পর্দাটা একটু সরিয়ে দিবি ?
হ্যা দিচ্ছি।
প্রিয়ন্তি কালো পর্দাটা সরিয়ে দেখল সেখানে দুইটা পেইন্টিং ঝুলছে। একটা কৈশরীর। সেখানে লেখা “আমার হারিয়ে যাওয়া পার্বতী” তার পাশের ছবিটা হল প্রিয়ন্তির। সেখানে লেখা “প্রিয়ন্তি তুই কি আমার হুইস্কির গ্লাসে ভেসে উঠা চন্দ্রমুখী হবি?”
প্রিয়ন্তি ছুটে এসে রিদমকে জড়িয়ে ধরে বলল আমি হব। আমি তোর চন্দ্রমুখী হব।
রিদমের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও সে বলে যাচ্ছে। কারন তার হাতে আর সময় নেই। প্রিয়ন্তি আমার যে আরেকটা কাজ বাকী আছে। কিন্তু আমার মৃত মা উপর থেকে আমাকে ডাকছে। মনে হচ্ছে সে কাজটা আমার পক্ষে করে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। তুই আমার হয়ে শেষ কাজটা করে দিবি বল?
আমি তোর সব কাজ করে দেব। তুই এবার একটু শান্ত হ’
রিদম পকেট থেকে কৈশরীর চিঠিটা বের করল। খামের উপর লেখা ঠিকানা প্রিয়ন্তিকে দেখিয়ে বলল এই ঠিকানায় আমার মেয়ে রক্তিমা আছে। কৈশরীকে বলিস ঈশ্বর চান নি আমার মত অমানুষের ছায়া আমার মেয়ের উপর পরুক। তাই ওর নিমন্তণ রক্ষা করতে পারিনি। তুই গিয়ে আমার মেয়েকে দু-চোখে প্রান ভরে দেখে আসবি। কৈশরীকে বলিস সে যেন আমার মেয়েকে পৃথিবীর শ্রেষ্ট মায়েদের আদর দিয়ে বড় করে। আসার সময় তুই আমার হয়ে আমার মেয়েটার কপালে একটা চুমু দিস। পারবি না বল?
প্রিয়ন্তি ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার চোখের জলে অসময়ে বর্ষা নেমে আসবে। সে বলল, হ্যা পারব।
রিদমের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। প্রিয়ন্তি আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে। তুই ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবি আমায়?
প্রিয়ন্তি রিদমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গান গাইতে লাগল -
“খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে?”


পরিশিষ্টঃ প্রিয়ন্তি তার পুরনো ডাইরীর অসমাপ্ত লেখাটা শেষ করল আজ। তার চোখের কোনে পানি এসে জমাট বাধঁছে। কাচেঁর মোটা ফ্রেমের চশমার দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। প্রিয়ন্তি ডাইরীটা বন্ধ করে শাড়ির আচলে চোখ মুছে যাচ্ছে। তার চোখের জল দেখে এই অসময়ে আকাশও বুঝি কেঁদে উঠল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক গল্পটা বেশ দীর্ঘ হলেও সুন্দর বুনন আর অপরিসীম ভালবাসায় কাহিনীটা বেশ প্রানবন্ত হয়েছে...গল্পকারকে অভিনন্দন এই আসরে....আর অনেক ভালো লাগা...শুভ কামনা....
অনেক ধন্যবাদ।
এফ, আই , জুয়েল # সৌজন্যতা ও অসৌজন্যতার মিশেলে অনেক সুন্দর একটি গল্প । এর প্রেম বিরহের মধুময় রুপটা দারুন ভাবে ফুটে উঠেছে । লেখার হাত বেশ ভাল । শব্দ ও ভাষার ব্যবহার অনেক সুন্দর । লেখককে ধন্যবাদ ।।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
মোঃ কবির হোসেন নির্বাসিত নীল ভাই আপনার গল্পটা পড়ে মুগ্ধ হলাম, একটা কঠিন প্রেমের কাহিনী কঠিন বিরহের মধে দিয়ে সমাপ্তি ঘটল, গল্পটি আমার কাছে অনেক ভাল লাগল. ধন্যবাদ.
সুমন কোন প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা পড়লাম মনে হলো। গল্পটা আগাগোড়া একটা তরঙ্গ ধরে চলেছে, কোথাও আরোপিত বা ঝুলে গেছে মনে হয়নি। অনেক সুন্দর একটা গল্প।
অনেকককককক ধন্যবাদ...।।
আরমান হায়দার অনেক বড় গল্প লেখার জন্য ধন্যবাদ। এখন চোখ বুলিযে গেলাম । পড়ে পড়বো ইনশাল্লাহ!
এখানে এটাই আমার প্রথম গল্প তাই একটু বড়......... মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
এশরার লতিফ আপনার গল্পে পাঠক না থাকার মূল কারণ হলো শব্দ সংখ্যা: ৪১২০। এত বড় গল্প সময় করে পড়ে অনেকের পক্ষেই সম্ভব না। উচ্চবিত্ত সমাজের কিছ্বটা অসংযত জীবন যাত্রার সাথে মধ্যবিত্তের আবেগ মিশানো একটা গোছানো গল্প। ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ। আসলে এখানে এটাই আমার প্রথম গল্প। বড় ছোট'র ব্যাপারটা মাথায় ছিল না। তাই খামখেয়ালীপনায় একটু বড়ই হয়ে গেল আরকি...।

১৬ মার্চ - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী