শরতের নির্মুক্ত গগনে চন্দ্র উদিত হয়েছে। চন্দ্র যেন তার আপন উজ্জ্বল প্রভা ছড়িয়ে এই সত্য প্রচার করেছে, বৃহত্তের নিকট ক্ষ্রদ্রের পরাজয় ঠিক এমনিভাবেই পৃথিবীতে ঘটে থাকে। আর অধিক শক্তিশালী দুর্বলকে হস্তত করে নেয়।
গৃহের প্রদীপ অনাদরে অবহেলায় এক কোণে নিবু নিবু জ্বলছে। তবু প্রদীপ শত অবহেলা অনাদরের মাঝেও কখনো তারা সেবার পথ থেকে বিচুত্য হয় না, কখনো অভিমান করে দূরে সরে যায় না, কিংবা কখনো বলে না, আজ আলো দেব না। বরং অন্ধকারে নিজেকে দহন করেই আলোকিত করে।
চন্দ্রলোকিত রাতে সাদা মেঘ ভেসে ভেসে এদিকে ওদিকে যাচ্ছে। এমন রাতে ঘর ছেড়ে সবাই বাইরে পাটী বিছিয়ে জড়ো হয়েছে। কারো হাতে তালপাখা, কারো হাতে বৎআসের পাখা। কেউ গল্প বলছে, শিশুরা মায়ের কোলে মাথা রেখে গল্প শুনছে কেউবা ধূমকেতুর গতিবিধি লক্ষ্য করছে। অপর প্রান্তে অনেক দূরে খোলা প্রান্তরে জোনাকির আলো খেলা করছে। উঠোনের শিউলী ফুলও তার সৌরভে ব্যাকুল করে তুলছে মানুষের হৃদয় মন।
এমন পূর্ণিমারাতে তারাভরা আকাশে দুই পরিবার মিলিত হয়েছে একই উঠোনে। বড় ভাইয়ের নাম অন্তর এবং ছোট ভাইয়ের নাম হৃদয়। অন্তর ভালোবেসে বিয়ে করেছেন তোড়াকে। তোড়ার বাড়ি সন্ধ্যানদীর ওপাড়ে রায়পুর গ্রামে। ফুলের তোড়ার মতই সাজানো তার জীবন। নানা বর্ণের, নানা বৈচিত্রের গুণাবলীতে পূর্ণ তার জীবন। তোড়া স্বভাবে সরল, হাসি খুশিতে প্রাণবন্ত। তোড়া প্রতিদিন নদীতে জল নিতে আসতেন। মাঝে মাধ্যে আন্তরের সাথে দেখা হয়ে যেত। এপাড়ে অন্তর, ওপাড়ে তোড়া আর মাঝখানে নদী নীরবে বয়ে যেত। মাঝে মাঝে কথা হত, ভাব বিনিময়ও হত। অতঃপর ভালবেসে দু’জনে চিরকালের ঘর বেঁধেছেন। সেই ঘরে নতুন অতিথি রূপে এসেছে সন্ধি। তারা তাকে নিয়ে বেশ সুখী।
ছোট ভাই হৃদয় বিয়ে করেছে সিঁথিকে। তাদের প্রচুর ধন সম্পদ আছে অথচ সুখ নেই। অব্যক্ত বেদনা তাদের হৃদয়কে ঘিরে রেখেছে। অঢেল ধন সম্পদ সত্ত্বেও বংশের বাতি জ্বালানোর মত কেউ নেই।
তবু সন্ধিকে নিয়ে তাদের আনন্দ। সন্ধি যেন তাদেরই সন্তান। সকাল হলেই সিঁথির নিকট ছুটে আসে আর ফিরে যায় রাত্রে। সন্ধিও সিঁথিকে মা বলেই ডাকে এবং হৃদয়কে বাবা বলেই ডাকে।
অগ্নিকাণ্ডের মত হঠাৎ খুব সকালেই অন্তর জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলতে লাগল।
চারা তুলে নিয়ে যাও।
না, তুলব না।
তুলবে না মানে?
কেন তুলব? আমি কী অন্যায় করেছি?
অন্যায় করনি? আমার এই জমিতে চারা রোপন করছ কেন?
দুই ভাই কাকাডাকা ভোরেই চারা রোপন নিয়ে বাকবিতণ্ডায় মেতে উঠলেন। এ কোলাহলে ঘুমন্ত ধরণী যেন জেগে উঠল। গ্রামবাসী শয্যাত্যাগ করে ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। একজন রসিক ভঙিতে বলে উঠলেন, কে এত সকালে তারার স্বরে গান করে রে? ভৈরবী সুরে গাইতে পারে না?
আরেকজন পাঁকা চুলযুক্ত এক বৃদ্ধ এসে কাঁপা গলায় বলেন, কি হয়েছে, এত সকালে?
অন্তর বললেন, ও আমার জমিতে চারা রোপন করেছে।
হৃদয় প্রতিবাদের সুরে বললেন, ও মিথ্যা বলছে। আমি আমার জমিতেই চারা রোপন করেঠি।
অন্তর ধমক দিয়ে বলেলন, থাম। দখল করলেই বুঝি তোমার জমি হয়ে গেল? কাগজ পত্র আছে?
কাগজ পত্র না থাকলেও সকলে বলবে, এ আমার জমি। কারণ এত বছর ধরে এ জমি ব্যবহার করে আসছি।
বেশ করেছ। তুমি দখলদার, দখল করতেই থাকো। তোমার টাকার জোর আছে, দেহের শক্তি আর দখল করার ক্ষমতা আছে। তাহলে করবে না কেন? পারলে দখল সমস্ত পৃথিবীকেই হাতের মুঠোই নিয়ে নাও।
কথা শুনে হৃদয় আ
র স্থির থাকতে পারলেন না। লাঠি দিয়ে অন্তরকে আঘাত করে বসলেন। আঘাতে অন্তর মাটিতে পড়ে গেলেন।
আজ তাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে তা তিরিশ বছরে কোন দিনও দেখা যায়নি। তাদের মত এত মিল, এত সদভাব, এত প্রেমের বন্ধন, এত ভ্রাতৃত্ববোধ তা কারো মধ্যে দেখা যায়নি। গ্রামের সকলেই তাদের দেখে বলতেন, মানিক জোড়। বড় হয়ে সংসারা করা পরও তাদের উদারতা, সাহায্য-সহযোগিতা, ভ্রাতৃপ্রেম, ভালোবাসা ও অনুরাগ হ্রাস পায়নি।
আজ সামান্য বিবাদের কারণে তাদের সম্পর্কের সেতুবন্ধন ফাটল ধরেছে। পরিণামে সন্ধি তার মা সিঁথিকে এক মুহূর্তের জন্যও কাছে পাচ্ছে না, পাচ্ছে না আদর যত্ন, ভালোবাসা। বরং দু’জনের মাঝখানে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল গহ্বর।
স্থানের দূরত্ব অতি সহজেই পেরিয়ে যাওয়া যায়, অতি সহজেই কাছে যাওয়া যায় কিন্তু অন্তরে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তা পেরিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন।
সন্ধিকে কাছে না পেয়ে সীঁথি অসহায় হয়ে পড়েছেন। কাজে কর্মে মন মরা হয়ে থাকেন এবং বিষণ্ণ মনে ভাবেন, যাকে না চেয়েও কাছে পেতাম, তাকে এত করে চেয়েও কেন কাছে পাই না।
সন্ধি কাছে নেই, হৃদয়ও তাকে একা রেখে বাইরে গেছেন। সিঁথির মন তাই বিষাদে পূর্ণ। বেদনায় নীল হয়ে গেছে তার হৃদাকাশ, মেঘে ঢাকা পড়েছে উজ্জ্বল মুখশ্রী। শিউলী ফুলে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ও পাড়ে। গভীর আশায় পথ চেয়ে আছেন। সন্ধি যদি ভুল করেও একবার মা বলে ডাকে। যদি মায়ের টানে ছুটে আসে।
পথে হৃদয়ের চোখে পড়ল সিঁথির মাতৃহৃদয়েরকান্না। এমন করুণ দৃশ্য দেখে তার হৃদয়জমিন ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠল। কি গভীর ক্ষত তার মুখে চোখে এবং হৃদয়ে। বন্যার জল শুকিয়ে গেলেও যেমন নদীর বুকে রেখা থাকে, তেমনি সিঁথির মুখে চোখেও সন্ধি যাওয়ার পর রেখা ফুটে উঠেছে। হৃদয় মনে মনে ভবলেন, হায় একি করলাম আমি!
০৪ মার্চ - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪