উত্তীর্ণ অতীত

ভোর (মে ২০১৩)

হিমেল রিছিল
  • 0
  • ৬৬
ওর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ায় আমার এই একটা সুবিধা হয়েছে। ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে কলম-খাতা-বই নিয়ে বসে পড়ি। রাতে জাগলেও কেউ কিছু বলতে আসে না। ও থাকলে রাতের সময়টুকুতে ওর জন্য কিছুই করতে পারতাম না। রাত জাগলেই বলত, এত রাত জেগে থাকতে নেই আবীর। শরীর খারাপ করবে তো। তোমার যে রোগা শরীর, কবে যে তোমার একটু বুদ্ধি-সুদ্ধি হবে বুঝি না। জবাবে আমি বলতাম, এই যে এখন হলো। এই যে লাইটটা নিভিয়ে দিলাম আর শুয়ে পড়লাম। শুভরাত্রি, সুইট ড্রিম বলে সে ঘুমিয়ে যেতে চাইত। আমি তাকে একটু বাধা দিয়ে বলতাম, আর কিছুক্ষণ জেগে থাক না প্রিয়। সে বলত, কালকে সকালে উঠতে হবে না? সকালে উঠে নাস্তা বানাতে হবে যে। তারপর আবার ক্লাশে যেতে হবে, ঘুমিয়ে পড়ো লক্ষ্মীটি।

বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিল সে। পড়ত ঢাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। কণা বলে ডাকতাম ওকে। ও একটু ঘুম কাতুরে ছিল বলে সে বেশীক্ষণ জেগে থাকতে পারত না। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই হাওয়া। তাকে আর দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যেত না। তার এই ঘুম কাতুরে স্বভাবের জন্য অনেক আগে ওকে একটা চিঠি লিখে অভিমানও জানিয়েছিলাম, লাভ হয়নি। চিঠিটা প্রায় এরকম ছিল-

প্রিয় ক,
এতক্ষণ তোমাকেই দেখছিলাম প্রিয়। তুমি ঘুমিয়ে গেছ, নিঃশব্দে, সমস্ত নির্জনতাকে কাছে টেনে, চারদিক অন্ধকার করে। আর আমি এই অন্ধকারেই তোমাকে দেখছিলাম। কী মিষ্টি তোমার মুখ! তোমার চোখ, নাক, ঠোঁট ওফ্ ওগুলো এক একটা নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বল করছে। তোমাকে যতই দেখছি ততই নতুন করে আবিষ্কার করছি। তোমার মাঝেই খুঁজে পাচ্ছি নতুন নতুন নক্ষত্র খুঁজে পাওয়ার আনন্দ।...আমাকে একা রেখে এভাবে ঘুমিয়ে পড়লে যে? খুব ক্লান্ত বুঝি? ঘুমাও, সকালটা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ, তুমি জাগলেই সকাল হবে, না জাগলে নয়। একটা হালকা চুমু তোমার গালে দিতে ইচ্ছা করছিল। দেখলাম তখনই তুমি ওপাশে মুখ ফিরালে।

ইতি
চিরদিনের তোমার আমি।

একবার ওকে কাছে ডেকে বললাম, কণা এসো না একটু রোদ-বৃষ্টি খেলা করি আজ।
- সে আবার কেমন খেলা?
- ধরে নাও এখন বৃষ্টি হচ্ছে, আবার রোদও আছে। ছাতা নিয়ে রাস্তায় দুজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটছি। এমন সময় এক দমকা হাওয়া এসে দুজনকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। ভেজা কাপড়ে তোমাকে বেশ...
- না বাবা আমি এই খেলা খেলতে পারব না। আমার সর্দি হবে। তুমি তো জানই আমি একটুও ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারি না।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তোমার সব কিছুতেই কিছু না কিছু জুড়ে না দিলে ভাল লাগে না বুঝি?
- জুড়ে দিলাম কই? আমি বুঝি অবাস্তব কিছু বলেছি?
- যথেষ্ট বলেছ। এবার শোন আমি বলি।
- আবীর শোন, কালকে না আমার বিকালে কোন ক্লাশ নেই। বিকালে কি একবার পার্কে ঘুরে আসা যায়?
- তুমি বললে কি আমি না করতে পারি?
- বাঃ মিষ্টি ছেলে।
- হুম, অপেক্ষা করো, তোমার জন্য আরো মিষ্টি কিছু দেব বলে ঠিক করে রেখেছি।
- আচ্ছা । তাহলে কি এবার ঘুমানো যায়?
-Why not?

বিয়ের আগে প্রায়ই ওকে নিয়ে পার্কে ঘুরতাম। পার্কে বসে বসে কত যে অলস সময় কাটিয়েছি তার হিসাব জানা নেই। একবার পার্কে বসে ওকে কাছে টেনে বললাম, তুমি কি আমার সাথে একটু ভাবতে বসবে? জোড় করছি না।
- কি রকম ভাবনা?
- এই ধরো, লেকের ধারে দুজনে হাত ধরে বসে আছি এই রকম। আচ্ছা আগে বলো তো আমার হাত রাখার ধরণটা তোমার মনে আছে? দাও না আগে হাতটা সেভাবে ধরি। ওমা হাত সরিয়ে নিলে কেন? লজ্জা পেলে বুঝি?
- লজ্জা যে নারীর ভূষণ।
Ñ ছিঃ তা হবে কেন? তাহলে তো তুমি তোমার অধিকার হারালে। পুরুষতন্ত্র তোমার অধিকার কেড়ে নিল তাহলে।
- তাহলে কি বেহায়া-নির্লজ্জের মতো সবার সামনে উজাড় করে দিতে হবে নাকি?
- তা হবে কেন, আমি বলছিলাম কি এতটা রক্ষণশীলতা তোমাকে মানায় না। আচ্ছা এভাবে আড় চোখে তাকাচ্ছ কেন?
- তোমাকে না আমার সহ্য হয় না।
- কেন? এর মধ্যে আবার সহ্য-অসহ্যের আগমন ঘটল কেমন করে?
- আচ্ছা তুমি কেন আমাকে আর আগের মতো ভালোবাস না?
- কী করে বুঝলে যে আগের মতো আর ভালোবাসি না?
-এই যে এখন আমার কথা তুমি ঠিকমতো শুন না, তারপর আবার আমার পাঠানো মেসেজগুলো আর ডাইরিতে টুকে রাখ না।
- ও এই কথা, এখন যে তুমি অনেক বেশী তপ্ত কথা শোনাও তাই।
- আর তোমার কথায় বুঝি মৌমাছির মধু ঝরে পড়ে?
- ছিঃ ছিঃ এভাবে শুধু শুধু রাগ করে মিষ্টি বিকালটিকে নষ্ট করছ কেন? এমন মিষ্টি বিকালে , মিষ্ট সময়ে এসো না দুজনে মিলে মিষ্টি কিছু সৃষ্টি করি।
- তুমি তো দেখছি মিষ্টির দোকান খুলে বসে আছ হে। তো মিষ্টি কিছু সৃষ্টি করব যে, এটার value কত?
- One ice-cream for one kiss.
- অসভ্য।
- কাছে এসো না সভ্য হই।
- ইস্ সাহস কত! আমি যেন প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। ইডিয়ট!
- Sweet, hot, honey.
- তুমি না বড্ড বাড়া বেড়ে গেছ।
- ও তাই? তাহলে কি ভালবাসার দাবি বলে কিছু থাকবে না?
- ভালবাসার দাবি বুঝি সবার সামনে আদায় করা লাগে?
- আচ্ছা তুমি একটু চোখ বন্ধ করো তো।
- কেন?
- আগে করেই দেখ না পরে কারণ বলছি।
- আচ্ছা করলাম।
- এবার মনে মনে দেখ, ঐযে গাছের ডালে দুটি পাখি। দেখতে পাচ্ছ?
- না।
- তুমি কি শুনতে পাচ্ছ ওরা কি বলছে?
- না।
- আচ্ছা তাহলে আমিই বলি। ওরা কী বলছে জানো? ঐ ছেলে পাখিটা মেয়ে পাখিটাকে বলছে, শুন, চুমু হচ্ছে মনের খাদ্য। এ খাদ্য না দিলে যে মনকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। চুমুতে মিষ্টি নেই, চিনিও মেশানো থাকে না তবুও পৃথিবীর সমস্ত ঝাল একত্র করলেও এর মিষ্টটা কখনোই কমে না।
- বাঃ তুমি তো দেখছি খুব রোমান্টিক।
- তোমার প্রেমিক বলে কথা।
- আচ্ছা! দুষ্টু ছেলে।
- তো দুষ্টু ছেলে কি তাহলে এবার রোমান্টিক কিছু করতে পারে?
- এ্যা বেটার সাহস কত!
- সাধ্যের বাইরে কি কিছু বলেছি?
- তুমি অনেক বেশী কথা বলো।
- তোমাকে ভালোবাসি বলেই তো।
- থাক আর বলতে হবে না।
- তাই তো তাই তো এটা তো কথা বলার সময় না, এটা তো চুমু খাওয়ার সময়।

এমনি করে হঠাৎ ওর গালে টপাটপ চুম্বন এঁকে দিতাম। ও তখন খুব লজ্জা পেত। কথা বলত না। এমনি করে বিকাল পেরিয়ে কখন যে সন্ধ্যা নেমে আসত টের পেতাম না।

তারপর বিয়ে, সংসার, সন্তান, চাকরী এমনি করে আমার সবুজ লাল সকালগুলো ভালই কেটে যাচ্ছিল। একদিন হঠাৎ ও অসুস্থ হয়ে পড়লে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার আমাকে কাছে ডেকে বলল, অনেক দেরি করে ফেলেছেন। ব্লাড লিউকোমিয়ার severe stage. বোধয় আর বাঁচানো সম্ভব নয়। আমি ভেঙে পড়লাম। আমি ভেবে পেলাম না এটা কখন কীভাবে হলো। কণা আমাকে এই ব্যাপারে আগে কিছুই বলেনি।

তারপর একদিন তিলে তিলে সাজানো সংসারটাকে তছনছ করে কণা অজানার উদ্দেশ্যে চলে গেল। আমি একা পড়ে থাকলাম। বিধাতাও কি তাই চেয়েছিল
কি-না জানি না।

আমি লিখছিলাম সেইসব দিনের কথা। ঘড়ির কাটাগুলো টিকটিক করে আবিরাম বেজেই যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘড়ির এলার্মের শব্দে ছেলেটার ঘুম ভেঙে গেল। কাছে এসে বলল, বাবা সকাল হতে চলল তুমি এখনো ঘুমাতে যাওনি? আমি বললাম, উঠে পড়লে কেন যাও শুয়ে পড়ো। ছেলেটি বলল, তুমি না ঘুমাতে গেলে আমিও যাচ্ছি না। ওর মুখের দিকে চেয়ে আমি আর না করতে পারলাম না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক ঘটনার নাটকীয় মুহুর্তটা মন ছুয়ে গেল....সুন্দর গল্প...নিখুত বুনন...ভালো লাগলো....
সূর্য কণার চলে যাওয়ার টুইস্টটা হৃদয় আদ্র করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সুন্দর বুননে গল্প ভালো লেগেছে।
এশরার লতিফ পরিচ্ছন্ন লেখাটি এক টানে পড়ে ফেললাম। ভালো লাগলো।
তাপসকিরণ রায় খুব খুব সুন্দর লিখেছেন,ভাই !ভাব,ভাষাশৈলী,লেখার ধারাবাহিকতা ভালো মেনটেন করেছেন।আমার কাছে পরিষ্কার ঝকঝকে একটি লেখা মনে হল।গল্প কবিতার পাঠক লেখকদের সাথে মেলামেশা রাখুন--চেনা পরিচয় বাড়ান।আগামীতে আপনার লেখার মুল্যাংকন নিশ্চয় হবে।শুভ কামনা থাকল,ভাই !

০৩ মার্চ - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪