ঘটনাটা ১৯৯২ সালের। বেনসন এন্ড হেডজ'স বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফাইনাল খেলা চলছিল। মার্চের ২৫ তারিখ রাতে হল থেকে খেলা দেখে ইমরান খান! ইমরান খান!
পাকিস্তান! পাকিস্তান!
বলে শ্লোগান দিতে দিতে বাড়ি ফিরছিলাম। পাকিস্তান ক্রিকেট টিম হট ফেভারিট, টান টান উত্তেজনায় ফাইনাল জিতলো, ভক্তদের আর পায় কে? আমাদের বাড়ির গেটে এসেও চিল্লাচ্ছিলাম, হঠাৎ বাড়ির কেয়ারটেকারের দিকে নজর যেতেই থেমে গেলাম। কেন যে সুবোধ ছেলের মতো থেমে গিয়েছিলাম, বুঝিনি সেইদিন!!!
তারপর থেকে খেয়াল করতাম, কেয়ারটেকার আনওয়ার মামা আমাকে আর বিশেষ পছন্দ করেন না। কোনো কথার উত্তর দেন না। পছন্দের মানুষ থেকে অবহেলা পেলে যেই অবস্থা হয়, আমার হলো সেই অবস্থা!
ওহ্! আনওয়ার মামার পরিচয়টা আগে দিয়ে নেই। আনওয়ার মামা এস.এস.সি পাশ এবং মুক্তিযোদ্ধা। বিপত্নীক, একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় থাকে। ছেলে মেধাবী ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে, হলে থাকে, মাঝে মাঝে বাবার সাথে দেখা করতে আসে। আমার বাবা আনওয়ার মামাকে পায় অফিসের এক পিয়নের মাধ্যমে, খুব বিশ্বস্ত লোক সে। চার-পাঁচ বছর ধরে আমাদের কাজ করতো। তাই খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। মামাকে প্রায়ই জিগ্যেস করতাম, শিক্ষিত হয়েও চাকরি করো না কেনো? মামা বলতো, সব কাজ কি আর সবাই করতে পারে? মামা কখনো ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতো না। শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে মামার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতাম, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কথা এড়িয়ে যেত। কখনো মাথা ঘামাইনি এ বিষয়।
সে রাতের পর থেকে মামার সাথে এক অদৃশ্য দুরত্ব তৈরি হয়েছিলো আমার। উচ্চশিক্ষার জন্যে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হই। ফ্লাইটে উঠার আগের রাতে আনওয়ার মামার সাথে দেখা করতে যাই । আমাদের মাঝে কথাগুলো ছিলো এইরকমঃ
আমি বললাম, মামা আমি কাল চলে যাচ্ছি ।
মামা জিগ্যেস করলো, কোথায়?
আমি বললাম , আমেরিকায় পড়াশুনার জন্য, কবে ফিরবো জানি না।
মামা বললো, আচ্ছা ঠিকাছে। সাবধানে থেকো।
আমি বললাম, মামা তোমাকে একটা কথা জিগ্যেস করি?
মামা বললো, করো।
আচ্ছা মামা, তুমি এতোদিন আমার উপর এত্তো রাগ করেছিলে কেন?
মামা বললো, কই না তো?
প্লিজ মামা, আমি যাওয়ার আগে তুমি সত্যি কথাটা বলো।
আমি অনেক আবেগ নিয়ে কথাটা জিগ্যেস করাতে মামা ভাবলেশহীনভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করলো, তখন আমি নতুন বিয়ে করেছি তোমার মামীকে। সেইসময় যুদ্ধের ডাক পড়ে, যুবা বয়স যুদ্ধের ডাকে তো সাড়া দিতেই হয়। তোমার মামী বাঁধা দেয়, খুব মন খারাপ করে আমার জন্যে। আমি তাকে কোনো মতে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে রওনা হই। আমার বাড়ি ছিল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর গ্রামে, মেলাঘর ক্যাম্পে যাই। ট্রেনিং এর মধ্যে আমাকে বদলি করে ৯নং সেক্টরে, মানে বারিশাল অঞ্চলে। আমি ছিলাম উত্তর অঞ্চলের লোক ডিউটি করি দক্ষিণ অঞ্চলে, তাই ইচ্ছা সত্ত্বেও যুদ্ধের ৯ মাস বাড়ির সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। কিন্তু জানতাম হানাদাররা ওতো দূ্র যাবে না। দেশকে যখন স্বাধীন করে বাড়ি ফিরি, গিয়ে দেখি তোমার মামী জীবনের অন্তিম দিন গুনছে! আমি যখন দেশের মানুষের জন্যে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি, তখন আমার গ্রামের চেয়ারম্যান আমার স্ত্রীকে সুনামগজ্ঞের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে দিয়ে আসে................
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনেক্ষন পর মামা আবার বলতে শুরু করে, দেশের মানুষদের মুক্ত করার অনেক বড় পুরস্কার পাই আমি(!)। তোমার মামী আমাকে দেখে কেঁদে উঠে আর আমার হাতটা ধরে অনেক কষ্ট করে তার জীবনের শেষ কথাটা বলে, “ ছেলেটাকে জন্ম দিতে আমার অনেক কষ্ট হয়, আপনি ওকে ফেলে দিয়েন না”।
আমি তখন চমকে উঠে বলি, রহমান যুদ্ধশিশু???!!!
নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মামা আবার বলতে শুরু করে, কয়েক বছর পর বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে জনসেবা করার সুযোগ পায় আমাদের গ্রামের সেই চেয়ারম্যান জামান মিয়া। তার কিছুদিন পর দেখি পাকিস্তানি খেলোয়াররা ক্কোনো খেলায় জিতলে গ্রামে আনন্দ মিছিল বের হয়(!)।
এরপর মামা আমাকে প্রশ্ন করে, এটাই কি স্বাধীনতা? এটাই কি আমাদের অর্জন?? এটাই কি আমাদের স্বপ্ন???
আমি তখন নির্বাক।
মামা আবার বললো, খোদার কি কেরামতি দেখো, ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ আমরা পাকিস্তানিদের অত্যাচারে কেঁদেছিলাম ভয়ে আর ২১ বছর পর সেই ২৫শে মার্চ তোমরা উদযাপন করেছো পাকিস্তানিদের জয়ে!!! পাকিস্তানি ধারকদের ঘৃণায় আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানেই তাদের অনুচরদের পেয়েছি। অনেক পরে আমি বুঝতে পারি সেই দুষ্টূ ধারকদের বিষদাঁতের ছোবলে তোমাদের কোমল মন বিষাক্ত হয়ে উঠছে। তোমরা আবার আমাদের নিয়ে যাচ্ছ পূর্ব পাকিস্তানে। তোমাদের কাছে স্বাধীনতার কোনো মূল্যবোধ নেই।
আরক্ত চোখে মামা আমার হাত চেপে ধরে বলে, তুমি কি আমাকে কথা দিতে পারো, ওইসব দালালদের মেরে একটা স্বাধীন বাংলা গড়বে তুমি? আমি কি পাকিস্তানি চরবিহীন স্বাধীন বাংলায় আমার শেষ নিঃশ্বাস ছাড়তে পারবো?
মাথানত করে উঠে আসি আমি। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর জানা ছিলোনা আমার।
এই ঘটনার প্রায় ৭ বছর পর দেশে ফিরে আসি। এসে খবর নিয়ে জানি, আনওয়ার মামা তার ছেলের সাথে চলে গেছে, ঠিকানা রাখার কেউ প্রয়োজনবোধ করেনি। কাজের চাপে আমিও আস্তে আস্তে ভুলে যাই আনওয়ার মামাকে।
তরুণ প্রজন্মের শাহবাগে আন্দোলনের ঘোষণার পর থেকে বার বার মনে পড়ছে আনওয়ার মামার কথা। মামাকে বলতে ইচ্ছে করছে, দেখ, মামা আমাদের কাছে স্বাধীনতার মূল্যবোধ আছে। তরুণরা পাকিস্তানিধারকদের একটা একটা করে বিষদাঁত ভাংছে। আমরা এখন আর পাকিস্তানিদের জয় উদযাপন করি না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে আমাদের বোধোদয় হয়েছে।
আমি জানিনা মামা তুমি সত্যিকারের স্বাধীন বাংলায় শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ছো কিনা। তবে আমি জানি আমি সত্যিকারের স্বাধীন বাংলায় মরবো। এটাই হলো আবহমান স্বাধীনতা!
১৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪