সময়ের আবর্তন

অসহায়ত্ব (মে ২০২০)

রাজু
  • ৩৩

আলিয়ার বয়স ১৩ বছর। পরীর মত দেখতে হয়েছে । সবার আদরের ফুটফুটে একটি কিশোরী । আহ্লাদী একটা মেয়ে । বাবা-মার চোখের মণি। বিশেষ করে বাবার পাগল প্রাণ । যত আবদার আর খুনসুটি সব বাবার কাছেই । স্কুলে কী হল, বান্ধবীরা কে কী করলো সব এসে বাবাকে আগে বলবে তারপর অন্য কাজ । বাবাকেও সব শুনতে হয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও। দুরন্ত আর ডানপিটে আলিয়ার দিন এভাবেই কেটে যাচ্ছিল।


একদিন স্কুল থেকে বাবার সাথে রিক্সায় আসার সময় বায়না ধরেছে বার্গার আর আইসক্রিম খাবে । রিক্সা থামিয়ে বাবা মেয়ের জন্য বার্গার নিয়ে আসলো । মেয়ের ঠাণ্ডা লাগবে ভেবে আইসক্রিম আনেনি । আলিয়া আইসক্রিম না পেয়ে রাগ করে বার্গার রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললো । কোথা থেকে দুজন তার সমবয়সী বাচ্চা ছেলে এসে রাস্তায় ফেলা বার্গারটি কুঁড়িয়ে নিয়ে দুজনে ভাগ করে খেতে শুরু করল। আলিয়া আর তার বাবা সবটাই দেখতে পেল । মেয়ের এমন রাগ দেখে বাবা বিচলিত । আর আলিয়া তার ফেলে দেয়া বার্গার অমনভাবে ঐ দুইজন ছেলের খেতে দেখে সেও বিচলিত ।


বাসায় এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা ওরা কারা? আমার ফেলে দেয়া বার্গার রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এভাবে খেয়ে ফেললো । ওদের ঘৃণা লাগেনি খেতে?
আলিয়ার বাবা বুঝতে পারছে না কী বলবে তাকে, কেন এমন প্রশ্ন করলো বুঝতে পারছে না। আলিয়ায় মনে কী চিন্তা কাজ করছে তাহলে? মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা গরীব, ওদের বাবা-মা খেতে দিতে পায় না বলে ওরা এতো অসহায় । তাই তোর বার্গারটি রাস্তা থেকে তুলে খেয়ে নিয়েছে ক্ষুধার কারণে ।
ওরা অসহায় কেন বাবা? ওদের বাবা খেতে দিতে পারে না কেন?
আলিয়ার বাবাও অসহায়বোধ করছে, মেয়েকে কী উত্তর দেবে এমন প্রশ্নের। একমাত্র মেয়ে তার। মেয়েকে কিছু বলতে যাবার আগ মুহূর্তে আলিয়ার মা এসে বললো , ওরা পড়াশোনা করে না ঠিক মত তাই ওদের বাবা-মা খেতে দেয় না। তুইও যদি ঠিক মত পড়াশোনা না করিস তাহলে তোকেও খেতে দেবো না ।
আলিয়া মায়ের এমন কথা শুনে কাঁদো কাঁদো চোখে নিজের ঘরে চলে গেল রাগ করে । আলিয়ার বাবা ওর মাকে বললো, মেয়েটাকে তুমি এভাবে না বললেও পারতে । আজকে ও যা দেখেছে সেটা ওর এই ছোট্ট বয়সে প্রথম দেখেছে । আমাকে এমন প্রশ্ন করেছে যে আমি কোনো সঠিক জবাব দিতে পারছি না।
কেন কী দেখেছে? পাল্টা প্রশ্ন করে আলিয়ার মা ।
আইসক্রিম কিনে দেইনি বলে বার্গার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আর সেটা রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে ওর বয়সী দুইটা ছেলে খেতে শুরু করেছিল । তোমার মেয়েকে তখন বিচলিত দেখলাম এমন দৃশ্য দেখতে পেয়ে।
আরে... এসবতো রোজকার ঘটনা । আজকে প্রথম দেখেছে । ধীরে ধীরে সব সয়ে যাবে । তাছাড়া তোমার লাই পেয়ে পেয়ে মেয়েটা এমন হচ্ছে দিন দিন। সেই খেয়াল আছে? আজকে বার্গার ফেলেছে, কালকে আরও কতকিছু ফেলবে ।
আল্লাহ্‌ মালুম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আলিয়ার বাবা । মেয়েতো আমার একটাই । ওকে লাই দেবো নাতো কাকে দেবো । যাও, রুম থেকে ডেকে নিয়ে আসো । খেতে দাও ওকে সাথে আমাকেও।



কালু আর জাবেদ দুই বন্ধু । একই বস্তিতে থাকে । কালুকে সবাই কালু নামেই ডাকে । ওর মা এমনকি ওর বাবাও কালু নামে ডাকে । ওর ভাল নাম কী কালু নিজেও বলতে পারে না । কালুর বাবা বাস ড্রাইভার ছিল । দুর্ঘটনায় একটা পা হারিয়ে এখন কোনো কাজ করতে পারে না। কালুর মাকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে । তাদের এক ছেলে এক মেয়ে । মেয়েটার বিয়ে দিয়েছে এক বাস ড্রাইভার এর সাথে । বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে। বাবা ভিক্ষা করে বলে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে । ভাইটাও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় বলে যোগাযোগ রাখে না ।


কালু নিজের অংশের বার্গারটুকু খেয়ে জাবেদকে বলে, দেখছস, মাইয়াটা কত্ত সুন্দর। পরীর মত । কী সুন্দর ঘেরাণ আসতাছিল ।
জাবেদ জানে , কালুর একটু মেয়ের দোষ আছে । কোন মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়ে যায়, আজগুবি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে । কালুর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বলল, বন রুটিটা কত্ত নরম আর ভিতরে মাংস আর সালাদ দেয়া আছিলো । খাইতে কত মজা নারে কালু ?
হ রে দোস্ত । এমন বন রুটি জীবনে খাই নাই । ইসস... মেয়াটা যদি নিজের হাতে খাওয়ায় দিত, মনে হইতো বেহেশতে আয়া পরছি ।
ধুর খানকীর পোলা! জাবেদ রাগ করে গালি দেয় কালুকে ।


রাস্তার পাশ দিয়ে এক মুরুব্বী যাচ্ছিলো । যেতে যেতে বিড়বিড় করতে লাগলো, দেশের কী অবস্থা! এগুলা দেখার কেউ নাই। এসব টোকাই গুলার কারণে ক্রাইম বাড়ে । বাপ-মার কোনো ঠিকানা নাই । কীসব ভাষায় কথা বলে ।
বুড়োর কথায় ক্ষেপে গিয়ে কালু বলে উঠে , বুইড়া মাঙ্গের পোলারে ধাক্কা দিয়া বাসের নিচে ফালায় দিয়া আহি, চলতো দোস্তো!


জাবেদ কালুকে থামায়, আরে থাম ব্যাটা । বুইড়া হালায় আর কয়দিন বাঁচবো। থাক বাদ দে । চল মাঠে যাই, নিমাই খামু।
চল,ভাল কথা কইছস , ভরা পেটে নিমাই ভাল লাগে। চল মাঠে যাই, বুইড়া মাঙ্গের নাতিরে মাফ কইরা দিলাম ।



সম্পূর্ণ ঘটনাটা একমনে দেখে যাচ্ছিলো আরিফ । একটা জব ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসে মীমের জন্য অপেক্ষা করছিল । ৭ বছর ধরে সম্পর্ক । একটা চাকরী না হবার কারণে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারছে না মীমের বাসায় । ইন্টার্ভিউ দিয়ে অসহায় হয়ে বসে আছে বার্গারশপে । আজকে অনেকদিন পর মীমের সাথে দেখা হবে। মীমকে দেয়া নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই এসে বসে আছে । আরিফের কিছুই ভাল লাগছে না । আজকের ইন্টার্ভিউ দিয়ে আসা চাকরিটাও হবেনা মনে হয় । মীমকে কী বলবে তাই আগে আগে এসে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল ।
ঠিক তখনই দেখতে পেল এক বাবা তার কিশোরী মেয়ের জন্য বার্গার কিনে নিল । মেয়ে আইসক্রিম না পেয়ে রাগ করে দম্ভভরে ফেলে দিল রাস্তায় । কালু আর জাবেদ নামের দুজন ছেলে কুঁড়িয়ে নিয়ে খেতে শুরু করে দিল । তারা বার্গার নামটা পর্যন্ত জানেনা । বন রুটি বলে যাচ্ছিলো অনবরত । একটু আগ পর্যন্ত ছেলে দুটির নাম জানত না আরিফ। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটার উপর রাগ করে এত সহজেই মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে কালু সেটা ভাবছিল আরিফ । কতটা নির্মম সত্য , কতটা অসহায় এমন দৃশ্য দেখা তার মত একটা বেকার ছেলের পক্ষে । ভাবনায় ছেদ পড়লো মীম চলে আসায় । আরিফের হাতে একটা বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল যেভাবে এসেছিলো একটা শাদা লাক্সারিয়াস গাড়িতে করে । শুধু বলে গেল, আমি অসহায়,আমি আর কিছু করতে পারলাম না আরিফ...


একটা পরীর মত আহ্লাদী মেয়ের বাবা অসহায় হয়ে চলে গেছে অনেক আগেই।
কালু আর জাবেদ চলে গেছে কোন মাঠে যেন নিমাই খাওয়ার জন্য।
মীম এসেই সবকিছু ছিন্ন করে চলে গেল।
আরিফও উঠে দাঁড়িয়েছে চলে যাওয়ার জন্য। হয়তো এভাবেই চলে যেতে হয় একলা পথিকের মত। কেউ দেখে না তাদের অসহায়ত্ব ।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী মনোমুগ্ধকর লিখনী, ভালো লাগলো। সবাইকে নিয়ে এই মহামারীতে সাবধানে থাকবেন ও ভালো থাকবেন। শুভকামনা প্রিয়।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মানুষের অসহায়ত্ব কেবল সে নিজেই দেখতে পারে । অন্যের চোখে সহজে ধরা পড়ে না। এমন আবর্তন কারো না কারোর সাথে চলতেই থাকে...

০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪