শাহাবাগের মোড় ঘুরে শিশুপার্কের সাথে যে ফুটপাত সেটা ধরে হাঁটছিলাম হঠাৎ একটা ছেলে আমার সামনে এসে বলল স্যার আফনে আমারে একটু সাহায্য করবেন। আফনাকে দেখে ভালো মানুষ মনে হইছে। আমার মা ডা অসুখে পইড়া রইসে। আমার মারে একটু হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা কইরা দেন না স্যার। আমার মা স্যার ঐখানে ঐ বিরিজের পাশে অসুখে পইরা রইসে, স্যার। আপনের ঘরেও তো মা আছে। স্যার আমারে একটু সাহায্য করেন না। মায়ের কথা বলাতে ছেলেটার দিকে একটু তাকালাম। এখন বৈশাখ মাস। এমনি এক বৈশখে আমার মা ও এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। সে দিনটার স্মৃতি আজও আমাকে আনমনা করে তোলে। হটাৎ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। সম্বিত ফিরলো ছেলেটার ঝাঁকুনিতে। সম্বিত আসতেই ওকে জিজ্ঞাস করলাম কোথায় তোমার মা। ও বললো স্যার ঐ যে ঐ বিরিজডার পাশে শোয়ায়া রাখছি। স্যার আপনি একটু সাহায্য করেন না। মায়ের কথা বলাতে আমার মনে অন্য আর কোনো চিন্তা ঢুকলো না। আর তাছাড়া আমি আজই বেতন পেয়েছি তাই পকেটও বেশ গরম। কোনো কিছু চিন্তা না করেই আমি ওকে বললাম চল তোর মায়ের কাছে চল দেখি তোর মায়ের কি অবস্থা। আমি ছেলেটার পিছন পিছন ফুট ওভারব্রিজের কাছে এসে দাড়াঁলাম কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। তখন ছেলেটাকে বললাম কিরে তোর মা কই। ছেলেটাও এদিক ওদিক তাকিয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। বলল স্যার এইহানে রাইখা আমি আফনার কাছে সাহায্য চাইতে গেসিলাম। এহন তো দেহি না। ও স্যার আফনে আমার মারে খুঁইজা দেন। ছেলেটা কান্না শুরু করলো- ও মা, মারে তুই কই, মা, মা। আমিও সাত পাঁচ কিছু না ভেবে ছেলেটার মাকে খুঁজতে লাগলাম। আমি ছেলেটাকে সাথে নিয়েই খুঁজতেছিলাম। এদিক ওদিক খুঁজতে আমি ফুট ওভারব্রিজ থেকে একটু দূরে একটা নির্জন স্থানের কাছে চলে আসি। তারপরই কয়েকজন লোক এসে আমাকে ঘিরে ফেললো। তখন আমি ছেলেটার দিকে তাকাই দেখি সে ঐ লোকগুলোকে বলছে – লন মামু আইজক্যা জব্বর একটা মাল ধরায়া দিলাম। হালার কাছে অনেক ট্যাকা। বহুত কষ্ট হইছে হালারে কব্জা করতে। তারপর যা হবার তাই হোলো। আমার বেতনের টাকা , সাথে থাকা মোবাইল ফোন সবই গচ্ছা গেলো। সাথে জুটলো কিছু স্বাভাবিক উত্তম-মধ্যম। গরম পকেট ঠান্ডা হয়ে গেলো। একবুক হতাশা নিয়ে ফুটপাত ধরে এগুচ্ছি। আর কিছু হারানোর ভয় নেই। হটাৎ মায়ের মুখটা অনেক মনে পড়ছে। মায়ের সব সময়কার বলা উপদেশগুলোও খুব মনে পড়ছে –“বাবা, রাত-বিরাতে বাইরে ঘুরে বেরাস না। রাতে আমাদের এই চেনা শহরটা অন্য রকম হয়ে যায়।” হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১২:৩৫ বাজে। উর্মি হয়তো এতক্ষনে আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে খাবার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। উর্মি আমার বউ। আমার বিয়ে হয় তিন বছর। মেয়েটা আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে। ভেবেছিলাম ওকে নিয়ে কাল একটু শপিং এ যাবো। কিন্তু এখন তো আর যাওয়ার মত অবস্থা নেই। ভাবছি আর হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রমনা পার্কের কাছে চলে এসেছি বলতে পারি না। রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে। আজ এই পৌনে একটার সময় ই ঢাকার এই ব্যস্ত রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। অথচ সারাদিন কতই না ব্যস্ত থাকে রাস্তাটা। কতক্ষন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতেই বাসায় পৌছুলাম। ঘড়ির কাটাঁটা তখন রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই। উর্মির সাথে কোনো কথা না বলে হাত-মুখ ধুঁয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। এক ঘুমে সকাল আটটা। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে অফিসে চলে গেলাম। বউকে আর কিছুই বলিনি। সারাদিন অফিসে কাজের মধ্যে এত ডুবে ছিলাম যে গতরাতের ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গেছি। আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হলাম। তবুও বের হতে হতে সন্ধ্যে ৬টা বেঁজে গেল। শাহাবাগ দিয়ে যাওয়ার সময় কি মনে করে নেমে গেলাম। আসলে গতকালের ঘটনাটা শাহাবাগের কাছে আসতেই মনে পড়ে গেলো। তাই নেমে পড়লাম ঠিক যেখানে ছেলেটা আমাকে ধরেছিলো ঠিক সেখানে। ছেলেটার মায়ের কথাটা খুব মনে পড়ছিলো। মায়ের অসুখের কথা বলে কোনো ছেলে ব্যবসা করতে পারে আমি সেটা আমার মনকে বলে বুঝাতে পারছি না। আমি ওভার ব্রিজের আশ পাশ দিয়ে হাঁটছি যদি ছেলেটা বা তার মাকে খুজে পাওয়া যায়। আমি আসলে প্রমান পেতে চাচ্ছি যে কোনো ছেলে তার মায়ের অসুখ নিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারে কি না? কিছুক্ষণ খোঁজ করার পর আমিই ছেলেটাকে পেয়ে গেলাম। ছেলেটা আমাকে দেখে ভয়ে জড়োসঁড়ো হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম যে ও আমাকে চিনতে পেরেছে। আমি ওর কাছে গিয়ে ওকে বললাম তুই ভয় পাস না আমি তোকে কিছুই বলবো না। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞাস করলাম আচ্ছা তুই যে আমাকে কাল বললি যে তোর মা খুব অসুস্থ। কথাটা কি সত্যি বলেছিলি। ছেলেটাতো হা হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বুঝলাম যে ও হয়তো মনে মনে আমাকে পাগল ভাবছে। ভাবছে যে এই লোকটার কাল এতবড় ক্ষতি করলাম আর সে কিনা আজ আমার মার কথা জিগায়। ছেলেটা হঠাৎ আমার পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে। স্যার আমারে মাফ কইরা দেন স্যার, আমি আর কোনোদিন এই কাম করুম না স্যার। যাই হোক আমি ওকে কোনোভাবে শান্ত করাই। তারপর ও আমাকে বলে যে ওর মা বাবার কথা ওর মনে নেই। ও নাকি আগে এ ধরনের কাজ করতো না। মানুষের কাছে ভিক্ষা করতো। কিন্তু মানুষ ভিক্ষা না দিয়ে লাত্থি গুতা দিত বেশি। তাই ও এখানে সেখানে ছিনতাইকারীদের সহায়তা করে। এতে ভালো টাকাও পায় সে। শুধু তাই নয়, টাকা পেলে ও যে কোনো কাজ ই করতে রাজি। এতটুকু একটা ছেলের কাছে আমি এই কথাটা শুনে হতভম্ব। আমি ছেলেটার কাছ থেকে সরে আসি এবং বাসায় যাওয়ার জন্য বাসে উঠি। আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে , কিভাবে সম্ভব মায়ের নামে মিথ্যা কথা বলে অন্য একটা মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া। আমাদের সমাজের কি এধরনের ঘটনায় কোনো দায়বদ্ধতা নেই। যে ছেলেটার আজ মায়ের কাছে আদর যত্ন পাওয়ার কথা ছিলো সে কি না আজ মায়ের অসুখের কথা বলে ছিনতাইকারীদের কাছে লোকজনকে ধরিয়ে দেয়। আমাদের কি কারও কোনো দায়বদ্ধতা নেই সমাজ থেকে এই ধরনের সমস্যা দূর করার। এই উঠ, এত বেলা হয়ে গেছে তুমি এখনো ঘুমাইতেসো, কি হইছে তোমার। তুমি অফিস যাবা না। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখো কয়টা বাজে। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল ৯টা বাজে। উর্মি ......।উর্মি । কি হইসে বল? বলবো মানে, আমি বাসায় আসলাম কখন? আমি তো বাসে ছিলাম। কি তোমার কি মাথা খারাপ হইসে নাকি! তুমি না গতকাল রাত ২টার দিকে বাসায় আসলা। তারপর ঘুমায়া পড়লা। আমি সকাল থাইকা তোমারে ডাক দিতাছি অফিসে যাওয়ার জন্য তুমি ঘুম থেকেই উঠলা না। কি কিছু খাইছো নাকি কালকে? আমি বুঝলাম আমার ছেলেটার সাথে আবার কথা বলা তারপর বাসার উদ্দেশ্যে বাসে উঠা সবই কল্পনায় আমার অবচেতন মনের খেলা ছিলো। তারপর আমি উর্মিকে গতরাতে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে বেতনের টাকা খোয়ানোর ঘটনাটা বললাম। আর মনে মনে ভাবলাম হয়তো কল্পনায় যা দেখেছি সেটা সত্য। তবে সাধ থাকলেও আমার মত বেতনভোগী কর্মচারীদের পক্ষে সমাজের এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য অগ্রসর হওয়া দুঃস্বপ্ন। অতঃপর সেই ৯-৫টার জীবন শুরু।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আশিক-উজ-জামান
কষ্ট করে আমার লেখাটা পড়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। আমার লেখাটা যদি আপনাদের কাছে সামান্যতমও ভালো লেগে থাকে, তবে এতেই আমি সফল। আর বোন জুঁইফুল আপনার পরামর্শটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। সকলকে ধন্যবাদ।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
ভালো লেগেছে ভাইয়া, আপনার গল্পটা। মাঝে মাঝে প্যারা করবেন। তাতে গল্প পরিচ্ছন্ন লাগে। দিনলিপি টাইপের এই গল্পটা অবশ্য প্যারা ছাড়াও মানায়। আরো লিখুন, আপনার গুনী লেখা দিয়ে আমাদের মন ভরিয়ে দিন সেই শুভকামনা। পুরস্কার পাওয়ার জন্য লিখবেন না, লিখুন, গল্পকার হয়ে উঠার জন্য। এতে একদিন পুরস্কারও আসবে, প্রশংসাও।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।