এও কি সম্ভব। জীবনের রঙ্গিন সময়ের শুরুতে একটা জীবন এভাবে হারিয়ে গেলো। মনের চিলেকোঠা থেকে কষ্টগুলো নিংড়ে বেড়িয়ে আসছে। বলছি এক ছোট্ট ঘটনা- একটি ছোট্ট নাম নিনা। জন্ম, আর ছোটোবেলা কেটেছে ফ্রান্সে, পড়াশুনা নিউইয়র্কে; তবে বংশগতভাবে বাঙালি। নাড়ীর টানে মাটির টানে পড়াশুনা শেষে দেশে ছুটে আসে নিনা। - ওয়াও এত ফ্যান্টাস্টিক একটা দেশ। এখানে না থেকে কেন যে আমি অন্য দেশে ছিলাম? দেশের মাটিতে পা দিয়ে নিনার বক্তব্য ছিলো এমনই। নিনা উঠেছিলো এক দূরসম্পর্কের মামার বাড়িতে। মামা- নিনা সেই যে ২ বছর বয়সে দেশের বাইরে গেলি আর এত্ত দিন পর এই দেশে ফিরলি। নিনা- মামা, এই দেশের কথা অনেক শুনেছি মায়ের কাছে। কিন্তু যখনই এই বাংলাদেশের কথা উঠত তখন কেন জানি নিজের কাছে খুব অন্যরকম ফিল হত। লাইক এস, এই দেশটা যেন আমার কত আপন। আমি যেন এই দেশে আরো বহুবার এসেছি। মামা- মারে এই দেশটাই যে এমন, সবাইকে আপন করতে পারে। শুধু পারলো না তর বাপ – মায়রে। বাদ দে এসব কথা। তোর মামি কিন্তু এখনই ডাকাডাকি শুরু করবে লাঞ্চের জন্য। নিনা- ভালো কথা মামা, নির্যাস কোথায়? ও এখন কলেজে পড়ে শুনেছি। (নির্যাস হল নিনার মামাতো ভাই। এতক্ষণ মামার কথা বলা হচ্ছে সেই মামা অর্থাৎ জামান মামার ছেলে।) মামা- হুম। নির্যাস ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। নিনা ঢাকায় এসেছিলো ২৯শে জানুয়ারি। আসার দুদিন বাদেই শুরু হল ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আমার সাথে নিনার প্রথম দেখা বা পরিচয় হয় ৬ ফেব্রুয়ারি। দিনটা ছিলো বুধবার। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বসে বাদাম খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম একটা মেয়ে এসে অপরাজেয় বাংলার চারপাশে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছে। আমার দৃষ্টি সেদিকে গেলো। কিছুক্ষণ অবলোকন করে আমিই এগিয়ে গেলাম মেয়েটির কাছে। জানলাম তার নাম, কোথায় থাকে, কি করছে? তবে অবাক করা বিষয় হল নিনা পরিচয়ের একেবারে শুরু থেকেই আমার সাথে খুবই সাবলীলভাবে কথা বলছিলো যেনো আমি ওর খুব চেনা পরিচিত কেউ একজন। যাই হোক আমারও নিনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। সেদিনই কথায় কথায় ওর কাছ থেকে জানতে পারলাম যে ও বিদেশে পড়া অবস্থায় বাংলাদেশের যুদ্ধের কথা শুনেছে, শুনেছে এ দেশের ভাষা শহীদদের কথা। আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম ও এত পরিস্কার বাংলা কিভাবে জানে? কিন্তু ও বলল নিউইয়র্কে একটা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ও পড়তো। আর তারপর সেখানকার বাঙালি ফ্যামিলির বাচ্চাদের বাংলা শেখানোর চাকরি নেয়। আর এ জন্যই ও এত পরিস্কার বাংলা বলতে পারে। যা হোক ওর সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। পড়ন্ত বিকেলে আমি ওর কাছ থেকে বিদায় নেই। আমি হলে চলে আসি আর ও বাসায় ফিরে যায়। আর ওকে আমি বলে আসি যে ওকে আমি ৫২’র ভাষা আন্দোলনের কথা জানাবো, জানাবো ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের কথা। আমি একটা গাঁধা। নিনাকে সেদিন আমার ফোন নাম্বারটা দেই নি এমনকি ওর ফোন নাম্বারটা নেওয়ার কথাটাও মনে ছিলো না। অনেকদিন ধরে ওকে খুজঁছি। একুশে ফেব্রুয়ারি তো এসেই গেলো। ওকে যে কি করে পাই কিছুই বুঝতে পারছি না। তারপর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকলেও সেই মাঝে অপরাজেয় বাংলা, শহীদ মিনার প্রাঙ্গনসহ পুরো ঢাবি খুঁজেছি কিন্তু নিনার দেখা পাই নি। এরপর আরো কয়েকটাদিন কেটে গেলো। নিনাকে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিলাম এবং যথাযথভাবে নিজের কাজে মনযোগ দিতে শুরু করলাম। একদিন আমার এক আত্মীয়কে দেখতে ঢাকা মেডিকেল যাচ্ছিলাম, হঠাৎ শুনি কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। প্রথমে খুব একটা খেয়াল না করলেও পরে দেখি নিনা আমাকে ডাকছে। রিক্সা থেকে নেমে ওর কাছে গেলাম। ও ওর কাজিন নির্যাসের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো। নিনা বললো ও অনেকদিন থেকে আমাকে খুঁজছে। নিনা- তুমি না বলেছিলে আমাকে ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা বলবে, মুক্তিযুদ্ধ্বের কথা বলবে। আর তোমাকে আমি খুঁজেই পাচ্ছি না। আমি তো ভেবেছি তোমার সাথে আর দেখা হবে না। যাই হোক ৫ই মার্চ নিনাকে আমি ঢাবি’র টি.এস.সি –তে আসতে বলি। বেলা ১১টা নাগাদ নিনা এসে পৌছায়। আমি ওকে নিয়ে চলে যাই শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। নিনার কাছ থেকে জানতে পারি ও ওর কাজিনের কাছ থেকে আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে বেশ অনেকটাই জেনেছে। আমি শুধু জানাই যে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে তৎকালীন ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য ঢাকা মেডিকেলের চত্বর থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়। আর সেদিন পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ আরো অনেক নাম না জানা ভাই। তাঁদের এই জীবন দানের জন্যই আমরা আজ পেয়েছি বাংলায় কথা বলার অধিকার। নিনা বিমোহিত হয়ে শুনছিলো কথাগুলো। যেন একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। একটা সময়ে এসে নিনাই আমাকে প্রশ্ন করলোঃ আচ্ছা আমি নেটে সার্চ করে ২১শে ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি ২৬শে মার্চের সম্পর্কে কয়েকটা আর্টিকেল পেয়েছি। তুমি কি আমাকে একটু বিস্তারিত বলবে? তখন আমি জানাই ২৬শে মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবস। ৭১ সালের ঐ দিনে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেয়া হয়। আমি ওকে ২৫শে মার্চের কালোরাত কথাটা উচ্চারণ করতেই ও আমাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলো। আমি ওকে বললাম ২৫শে মার্চ রাতে মিলিটারিরা নিরস্ত্র সাধারণ বাঙ্গালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাখির মত যাকে যেখানে পেয়েছে গুলি করে মেরেছে। জানো সেদিন সারা ঢাকা পরিণত হয়েছিলো লাশের শহরে। আমি নিনাকে যুদ্ধের কথা বলি, বলি রাজাকারদের জন্যই আমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম সেদিন। কেননা তারাই মিলিটারিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। রাজাকারদের বর্ণনার কথা শুনে প্রতিবাদ করে ওঠে, বলে- তুমি হয়তো ভুল বলছো। রাজাকাররাতো মুক্তিযোদ্ধাদের বিপদের সময় বাঁচিয়েছিলো। নিনার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম। আমি বললাম তোমাকে এই কথা কে বলেছে? সে যা জানালো তা হলঃ আমার বাবাইতো একজন রাজাকার। আর তিনি বেশ গর্বের সাথে এ কথাটা ফ্রান্সের লোকদের বলেছেন। আরো বলেন রাজাকাররা সাচ্চা মুসলমান। আমি জাস্ট নিনার কথাগুলো শুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম। বলে কি এই মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি টিভি দেখো না? নিনা আমাকে জানালো ও টেলিভিশনে বাংলা চ্যানেল দেখে না। আমি ওকে কিছুই না বলে ওর বাবার নাম জানতে চাইলাম। ও বলল ওর বাবার নাম হাশিম জোয়ার্দার। ওদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার একটা গ্রামে। ও এক্সাট গ্রামের নামটা বলতে পারলো না। সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমি ওকে আর কিছুই জানাই নি। ওকে রিক্সায় তুলে দিয়ে আমি হলে চলে আসি। তারপর আমি হাশিম জোয়ার্দারের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি কিছুই জোগাড় করতে পারি নি। আমার নিনার সাথেও মাঝে মাঝে কথা হত। আমি ওকে রাজাকার বা ওর বাবা সম্পর্কে আর কিছুই জানতে চাই নি। কেননা ওর হয়তো মন খারাপ হতে পারে। আর নিনা খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায় যার কারণে আমি চাই নি একজন ভালো বন্ধুকে হারাতে। ঐ দিনের নিনার সাথে আমার আরো চার পাঁচবার দেখা হয়। আমি ওকে ঢাকা ও তার আশেপাশের সব দর্শণীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখাই। আর স্বাধীনতা আন্দোলন বা এ সম্পর্কিত আর কোনো কথা নিনার সাথে আমার হয় না। দেখতে দেখতে ২৫শে মার্চ চলে আসে। নিনা আমাকে জানালো ওর ফিরে যাবার সময় হয়ে এসেছে। ২৮ মার্চ ও বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যাই হোক ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে নিনা আমার কাছে বিদায় নিতে আসলো। সেদিন ওর খুব মন খারাপ ছিলো। অনেকটা কান্না কান্না ভাব নিয়ে নিনা আমাকে বলে- তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু। আফটার অল তোমার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু জেনেছি। তাই তোমার জন্য খারাপ লাগছে। আর আমি আমার বাবা হাশিম জোয়ার্দার ওরফে হাশু রাজাকার সম্পর্কে সবকিছুই জানতে পেরেছি। তুমি আমাকে হয়তো ভুল বুঝতে পারো তাই তোমাকে এতদিন বলিনি। জানো আমি না এই বাংলা মা কে অনেক ভালোবাসি। আমি নিনার মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। এ কি নিনা কথা বলছে নাকি অন্য কেউ। আমি সেদিন আর কিছু বলতে পারিনি। মনে মনে ঠিক করি নিনার যাবার দিন এয়ারপোর্টে উপস্থিত হয়ে ওকে সারপ্রাইজ দেব। আমি ২৮শে মার্চ সকাল ৯টায় নিনার নাম্বারে কল দেই। কল রিসিভ করে নির্যাস। ও আমাকে ওদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সেখানে যেতে বলে। আমি সেই বাড়িতে উপস্থিত হয়ে হতভম্ব হয়ে যাই। আমার চোখ থেকে অজান্তেই টপ টপ করে পানি পড়তে থাকে। কফিনের মধ্যে কাফনের কাপড় পড়ে আছে নিনা। আমি ওর মামার কাছে জানতে চাইলাম কি করে এসব হল। ও তো গতকালও দিব্যি ভালো ছিলো। ওর মামা বলে- ও কয়েকদিন আগে থেকে শুধু ওর বাবা যুদ্ধের সময় কি করেছিলো সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করতো। কেন ওর বাবা দেশে আসতে চায় না? আমরা কেন গ্রামে যাই না? তারপর বাধ্য হয়ে আমি ওকে সবকিছু বলি। তখনও বুঝে উঠতে পারিনি ও এরকম একটা কাজ করবে। গত পরশু সবার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে ঘরে ঘুমাতে যায়। বুঝি নি ও চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে। ২৭ তারিখ আমরা ওর ঝুলন্ত লাশ পাই। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকি নিনার কফিনের দিকে। কফিন খুলে নিনার মুখটা শেষবারের মত আমাকে দেখতে দেয়া হয়। নিনার মামা আমাকে একটি চিরকুট দিয়ে বললেন এটা নিনার শেষ লেখা। চিরকুটটা ছিলো এরকম— “আমি বাংলাকে ভালোবাসি। আমি বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আমি এখন বুঝতে পারি কেন আমাকে এই দেশে আসতে দিতে চাইতো না আমার বাবা। তিনি একজন চিহ্নিত যুদ্ধোপরাধী। আমি জানি আমার বাবা কখনও আত্মসমর্পণ করবে না। তাই নিজের জীবন দিয়ে আমার বাবার কৃত অপকর্মের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করলাম। একজন রাজাকারের মেয়ে হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই আমার কাছে পরম আনন্দদায়ক। আমার মৃত্যুর জন্য আমার বাবা ই দায়ী।” আমি আজ চমকে দিতে চেয়েছিলাম নিনাকে আর নিনা চমকে দিল আমাকে সহ পুরো বাংলাকে। নিনা ঠিকই আজ ফিরে যাবে তবে জীবিত নয় লাশ হয়ে। নিনাকে এয়ারপোর্টে পৌছে দিয়ে মনে মনে শপথ করি আর কাউকে স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বলবো না, যুদ্ধপরাধীর কথা বলবো না। শুধু নিনার গল্পটা ছড়িয়ে দিব।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তাপসকিরণ রায়
গল্পের শুরুর দিকটা কিছুটা প্রবন্ধের মত লাগছিল--বলার ভঙ্গি ও প্যারাগ্রাফ ঠিক সাজানো বলে মনে হয় নি --তবে শেষ দিকটায় বেশ খুলে গেছে গল্পটি।একটা ছায়া বিষাদ ভাব মনকে খারাপ করে দিয়ে গেলো।সব গল্পই যে সর্বত ভাবে ভালো লেখা হবে এমন কোন কথা নেই।হাত আপনার ভালো এটা বলতে পারি।শুভেচ্ছা রেখে গেলাম আপনার জন্যে,ভাই !
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।