এক
---
পৌষের সকাল। কুয়াশার চাদরে ডোবে আছে প্রকৃতি। দৃষ্টিসীমা যদিও দশ মিটারের মাঝে সীমাবদ্ধ তবুও সুয্যি মামা প্রায় পনের কোটি কিলোমিটার দূর হতে যে তার দৃষ্টি মেলে ধরেছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। পাড়ার বিভিন্ন বয়সের মানুষ ঘুম হতে জেগে একটু রোদের আশায় পিয়ালদের বাংলো ঘরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায়।এখানে সূর্যের আলো সর্ব প্রথম এবং অনেক্ষন তার অস্তিত্ব জানান দেয় বলে মানুষজন এখানেই এসে জমায়েত হয়। রাস্তা থেকে কে কি বলে সবই শোনা যায় বাংলো থেকে।
একটা কাক তীব্র শীতের কষ্টের কারনে হোক কিংবা ক্ষুধার যন্ত্রনার কারনে হোক উচ্চস্বরে কা কা করছে। বিছানায় শুয়ে থেকে কম্বল মুড়ি দিয়ে পিয়াল শুনতে পাচ্ছে কাকের ডাক, সেই সঙ্গে মায়ের কন্ঠস্বর। মা কাআক তাড়ানোর জন্য দুহাতে তালি বাজাচ্ছে আর বলছে, ছিৎ! ছিৎ! যাহ!যাহ! এই বিহান বেলা কাউয়া ডাকার আর যাইগা পাইলো না। না জানি কুন অলুক্ষনে খবর লইয়্যা আইছে।
মায়ের তাড়া খেয়ে কাক হয়তো উড়ে গেছে কেননা পিয়াল আর কাকের কাকা শুনতে পাচ্ছে না। কুসংস্কারে যদিও পিয়ালের বিশ্বাস নেই তবুও অলুক্ষনে খবর ঠিকই আসল। কাক চলে যাবার পর পিয়াল আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার এই দফা ঘুম ভাংলো গ্রামের কুটনা বুড়ী খ্যাত সালেহার মার কন্ঠস্বর শুনে। এতক্ষনে সূর্য তার কিরন ভাল করেই বিলাতে শুরু করেছে। আর সে জন্যেই পিয়ালদের বাংলোর পাশে পাড়ার মানুষের ছোট খাট একটা হাট বসে গিয়েছে। আর ওই হাটেই হার ভাংলো সালেহার মা যার কারনে ২য় দফা ঘুম ভাঙলো পিয়ালের। সে বলছে, শুনছ নিগো তোমরা! শুনছনি মিয়ারা! রইছের মার ছোট্ট মাইয়াতো পেট বাজাইছে।
তার এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই যেনো আকাশ হতে পড়লো। অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের সামলে নিয়ে তারা নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাতে আরম্ভ করল। যদিও কারো কথা কেউ যে শুনছেনা, সবাই যে নিজেদের তাৎক্ষানিক পতিক্রিয়া জানাতে ব্যাস্ত এই ব্যাপারে পিয়ালের সামান্যত সন্ধেহ নেই। এক সাথে সবাই কথা বললে যেমন শ্রোতা থাকেনা, এখানেও হয়েছে সেই অবস্থা। পিয়াল তারপরও যে কথা গুলো শুনেছে তা হলো- কেউ বলছে, পাড়াটা জাহান্নামে গেলো; কেউ বলছে, আর শান্তিতে থাকা গেলোনা, পাড়াতে ব্যাশ্যাবৃত্তি শুরু হয়ে গেলো; কেউ বলছে এতো বিশাল একটা বেশরিয়া কাজ হয়ে গেলো, এর বিচার অবশই করতে অইব শরিয়া মতো।
আর শুয়ে থাকতে পারলোনা পিয়াল। সে এক লাফে বিছানা ছেড়ে রাস্তায় চলে যায়। সালেহার মার কাছে জিজ্ঞাসা করে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে। তার কথার জবাবে মহিলাটি বলে, সত্য কইতাছিনা মানে! নিজের চউক্ষে দেকছি হে বমি করতাসে।আর পেট বড়তো সবাই দেখে। হেরে অবশ্যই দুর্রা মারন লাগবো।
সারাদিনে গ্রামের প্রতিটা ঘরেই রইছের মার ছোট্ট মেয়ে যাকে পড়ার সবাই সামি বলে ডাকে তার খবর ছড়িয়ে পড়ে। বসন্তে ঝিঝি পোকা যেমন সারাদিন অনবরত ডেকে চলে তেমনি সামির কাহিনি সারাদিন মানুষের মুখে মুখে ডাক পারল। তাকে নিয়ে রাস্তায় কথা হয়, মাঠে কথা হয়, কথা হয় পাড়ার মসজিদে। সব যায়গায় একটায় আলোচনা যে মায়ে পাড়ায় বেশ্যাগিরী শুরু করে পাড়ার ইজ্জত ও ইসলামের ইজ্জতে হাত দিয়েছে তাকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।১০০ দুররা মারার পর তাকে তওবা পড়তে হবে। হাজার যায়গাই হাজার আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত আসলো মসজিদ থেকে। মসজিদের হুজুরের সাথে আলোচনা করে পাড়ার মান্য গন্য ও কিছু জগন্য ব্যাক্তিগন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামি জুম্মার নামাজের পর তাকে দুররা মারা হবে। সামিকে কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করেনি।এই দুররা মারার খবরও পাড়াময় ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি।
দুই
---
গত রাতে গ্রামের বাড়ি এসেছে পিয়াল।বিসিএস পাস করে সে এখন সরকারী কলেজের লেকচারার।চাকুরী পাবার পর এই প্রথম গ্রামে এসেছে গতকাল রাতে। সারাদিন আত্বীয়-স্বজনের বাসায় বেড়ানোর পর রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। আড্ডা দিতে দিতে রাত কখনযে প্রায় একটা বেজে গেছে টের পায়নি। তবে আড্ডা যেহেতু শেষ হয়েছে সেহেতু বাড়ি যেতেই হবে।
রাস্তায় হাটছে পিয়াল।তীব্র শীতে জমে যাচ্ছে সে।তবুও জ্যাকেটের পকেটে হাত রেখে ধীর পায়ে হেটে যাচ্ছে সে। যেই পথে যাচ্ছে সে সেই পথে যেতে হলে ঝুলান জঙ্গল নামে এক জঙ্গল পাড় হতে হয়। তার পূর্ব পুরুষদের কেউ কেউ নাকি এই জঙ্গলে ভূত ঝুলে থাকতে দেখেছে এই জঙ্গলে, যার কারনে এই জঙ্গলের নাম ঝুলান জঙ্গল।সে ভূত বিস্বাশ করে না, কাজেই এই জঙ্গল পাড় হওয়া তার জন্য কোন ব্যাপার না তবে এই জঙ্গলের যে বস্তুটিকে সে ভয় পায় তা হচ্ছে শিয়াল।তবে একটি বা দুটি শিয়ালে তার ভয় নেই, তার ভয় শিয়ালের পাল।রাতে তারা পাল ধরে হাটা চলা করে।এত ভয় তবুও বাড়িতো যেতেই হবে আর বাড়ি যেতে হলে জঙ্গল পাড় হতেই হবে।অতি সাবধানে সে গাছ-গাছালির ভিতর দিয়ে হেটে যাচ্ছে যেন শিয়ালের টের পেলে গাছে উঠে যেতে পারে।
বাতাস নেই। গাছের পাতা নড়া চড়ার কথা নয়।কিন্তু গাছের পাতা নড়ছে জঙ্গলের গাছের পাতা নড়ার শব্দ মানে কোনো পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে অথবা গাছে চড়ে যে সকল প্রানী তারা নড়া চড়া করছে। গাছের নড়া চড়া পাখির ডানা ঝাপ্টানোর কারনে হয়ে থাকলে মানুষের পায়ের আওয়াজে হয়ে থাকলে বন্ধ হয়ে যাবার কথা কিংবা পাখি উড়ে যাবার কথা। দুটির একটাও হচ্ছে না, কিন্তু পাতার নড়া চড়া বন্ধ হচ্ছে না। আওয়াজ যেহেতু গাছের উপর থেকে আসছে সেহেতু শিয়াল বা অন্য কোন মাটি চড়ে বেড়ান প্রানীর নয়।এই জঙ্গলে বানরও নেই। তবে কি ভুত! নাহ্ পিয়াল কখনো প্যারানরমাল কিছুতে বিশ্বাস করে না। তাই সে গাছের ডালের দিকে তাকায় অন্ধকারে সে দেখতে পারছে একটা ছায়া ঝুলে পা নড়া চাড়া করছে, আর গাছের পাতায় সেটা আওয়াজ তুলছে। কেও মনে হয় ফাসিতে ঝুলছে। ফাসিতে ঝুলার পড় সবায় নাকি বাচতে চেষ্টা করে, সেও হয়ত করছে, কিন্তু কেও তাকে না বাচালে বাচতে পারবে না। আর রাস্তার বেসির ভাগ মানুষের ফাসি নেবার কারন তার মৃত দেহযেন মানুষ অতি সহজেই খুজে পায়।
ফাসিতে ঝুলে থাকা একটি মানুষকে দেখে কোন প্রকার চিন্তা না করেই পিয়াল তার শৈশবের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মানুষটিকে ফাসির দড়ি হতে মুক্ত করে। মানুষটি যে একটি মহিলা সে বুঝতে পারে। কি বলবে সে ভাবছে তবে তার আগেই মহিলা বলে উঠে-
আপনে আমারে বাচাইতে আইলেন ক্যান? আমার এই জীবনের কি কোন দাম আছে? আমারে শাস্তি দিব ঠিকাছে কিন্তু আমার পরিবারে যে এক ঘরে রাখব এইডা আমি মানতে পারমু না। আমার অপরাধের শাস্তি আমিই পাইতাম চায় আমার পরিবারের মুক্তি দিতাম চাই। আমারে মরতে দ্যান।
যদিও সামিকে দেখেনি পিয়াল তবুও মেয়েটির কথার ভঙ্গি শুনে বুঝতে বাকি রইলনা এই মেয়েটিই সামি। পিয়াল চিন্তা করে কথা বলতে শুরু করল-
ঠিক আছে বোন, তোমার সব কথাই সত্য কিন্তু আত্মহত্যাই কি সব সমস্যার সমাধান?
মেয়েটি মাথা নাড়ে। পিয়াল আবার বলে, ‘তোমার এই ঘটনা যে ভাবেই ঘটুক, ব্যাপারটি যদি তোমার নিজের জীবনে সীমাবদ্ধ তবে আমি তোমাকে আত্মহত্যা করতে বারন করতাম না, কিন্তু এখন আত্মহত্যা করা মানেই তো আরেকটি মানুষকে হত্যা করা। তুমি নিজেকে হত্যা করতে পার কিন্তু একটা নিষ্পাপ শিশু যে তোমার মাধ্যমে পৃথিবীর আলো দেখতে চাইছে, যে বড় হয়ে কি হবে তুমি জাননা তাকে তো হত্যা করতে পার না। সে এমন কিছু করতে পারে যার কারনে সারা পৃথিবীর মঙ্গল হবে। তুমি ঠান্ডা মাথায় আমাকে সব খুলে বল, দেখি আমি তোমার জন্য কি করতে পারি। আমি কথা দিচ্ছি তোমার ও তোমার সন্তানের মঙ্গলের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। তুমি কি আমাকে চিনেছ?
- না।
- তুমি বড় বাড়ির পিয়ালের নাম শুনেছ? আমি পিয়াল।
- ভাই চিনছি।
- দয়া করে কিছু না লুকিয়ে তোমার জীবনের সত্য কথা গুলি বল।
- ভাই আপনি মানুষ না ফেরেস্তা কেও তো আমাকে আপনার মত জিজ্ঞাস করল না আমার ক্যান এমন হইছে, এমন কি যারা আমায় জন্ম দিছে তারাও না। সবাই শুধু বেশ্যা বেশ্যা কইয়া গালি দিছে।
একথা বলে মেয়েটি ফুফিয়ে কেদে উঠল। তার কান্না নিশিত রাতে এই জঙ্গলে কিছুটা করুণ মুহুর্ত তৈরি করে বাতাসে মিলিয়ে গেল। সামি তার কান্না থামিয়ে বলল,
- ভাই এর জন্যে আমাদের পাশের বাড়ির রকি দায়ি।
- রকি! সেতো ভালো ছেলে। তুমি বুঝার পর রকির সাথে যোগাযোগ করেছ?
- না।
- যোগাযোগ না করে কেন এই আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছ? তুমি জান ভালবাসা পবিত্র? আর এই পবিত্র ভালবাসার ফসল তোমাদের সন্তান। কিছুদিন পরে এই ফসল তোওমরা ঘরে তুলবে। তোমরাই এই সমাজ কে পরিবির্তন করবে।
- ভাই রকির সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ পাইনি।
একথা শুনে পিয়াল বাড়িতে না যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সামিকে বুঝিয়ে রকির সাথে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য ঐ জঙ্গল হতে রকি যে শহরে থাকে ঐ শহরে রওনা দেয়।
তিন
-----
ভোর হয়েছে। রকির বাসার সামনে দারিয়ে আছে পিয়াল আর সামি। রকি সামির ঘটনা জেনেছে গত রাতে। সে সামিকে ভালবাসে আর ভালবাসাকে সম্মান জানাতে ও সামিকে বাচানোর জন্য আজ ভোরে বাড়ি যওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। তার ভবিষৎ শাস্তি সম্পর্কে অবগত হয়েও সে পিছু সরে আসেনি। পিয়ালের সঙ্গে সামিকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়েছে সে।একে অপরে কাহিনি শুনে, অতপর তাদের ভালবাসা উপলব্দি করে পিয়াল কিছুটা অবাক হয়েছে।
বিয়ের সাজে কাজি অফিসের সামনে দাড়িয়ে আছে বর-কনে। তাদের সঙ্গে আর একজন আছে, যে কিনা হতে পারে ধর্মীয় নেতা, সমাজ সংস্কারক, বড় কোন বিজ্ঞানী, বিশ্বখ্যাত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ কিংবা সাহিত্যিক। তাদের প্রতি পিয়ালের শুভ কামনা। আর আপনাদের প্রতি অনুরোধ, “যদি আপনার এলাকায় এমন হয় তবে অনুগ্রহ করে ভবিষ্যতের কোন মহামানব কে ধ্বংশ করবেন না।
১৩ জানুয়ারী - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪