পেটের ব্যাথাটা ভালোই ভোগাচ্ছে নুরুন্নাহার বেগমকে।
সাথে বুকের ব্যথাটাও যোগ হয়েছে ইদানিং।
ব্যাথাটা যখন যখন শুরু হয়, মনে হয় ঠিক একটা ঘুর্ণিঝড়ের মত, তার কলিজার ভিতর কোন একটা বিন্দু থেকে শুরু হয়ে মুহুর্তেই ব্যাথাটা পাক খেতে খেতে শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অলিগলি ঘুরে তার বুক, কলিজা, হৃদপিণ্ড ছাপিয়ে হাত, পা, চোখ, সমস্ত শরীর, মাথার মগজের প্রতিটি কোষের গভীরে ছড়িয়ে পড়ে।
পেটের ব্যাথাটা শুরু হলে নুরুন্নাহারের মনে হয় এখন বেচে থাকা যন্ত্রনার আর কষ্টের, আর পেটের ব্যাথাটা ছাপিয়ে বুকের ব্যাথাটা অনুভূত হলে তার মনে হতে থাকে বেঁচে থাকার মত লজ্জার ব্যাপার আর হয় না।
তিন ছেলের সংসারে বুকের ব্যাথার কষ্টটা নীরবে চেপে যান নুরুন্নাহার। কিন্তু পেটের ব্যাথা বড় অবুঝ। সে কিছু বুঝতে চায় না। ছেলের বউদের বাকা কথা, ছেলেদের মৌনতা কিছুই বুঝতে চায় না।
গত কয়েক মাস ধরেই পেটের ব্যাথাটা ভোগাচ্ছিল নুরুন্নাহার বেগম কে। এর পিছনে বেশ কিছু পয়সা কড়ি খরচ করতে হয়েছে। হিসাবের টাকা থেকে খরচ করা এই উটকো খরচার দায়ভার কে বহন করবে, তা নিয়ে যখন নিত্যই ছেলে, ছেলের বউদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়, তখন নুরুন্নাহারের বুকের মধ্যে কলিজার ভিতর ব্যাথার কুন্ডলী ডানা মেলতে থাকে। তা পাক খেতে খেতে এক সময় দু চোখ দিয়ে অশ্রু হয়ে ঝরে, অথবা দীর্ঘশ্বাস হয়ে সে কুণ্ডলী পাকানো ব্যাথা বাতাসে মিলিয়ে যায়, কিন্তু নুরুন্নাহারের বুকের ব্যাথা কমে না। নতুন করে আবার ব্যাথার কুন্ডলী জন্ম নেয়, অশ্রু, দীর্ঘশ্বাস, এ যেন এক চক্রের মত।
প্রথমে ছোট খাট ব্যাথা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ছোট ছোট কথা আর ছোট ছোট ব্যাথা বলার মত কেউ যে আর নেই এখন তার। যাকে ছোট খাট ব্যাথার কথা অবলীলায় বলে দিতে পারতেন সময়ে অসময়ে, হয়তো খেতে খেতে অথবা ঘুমাবার আগে গল্প করতে করতে অথবা বিকেলে বারান্দায় ছায়ার মত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে; সেই সুখ- দুখের, বেলা অবেলার সঙ্গী মানুষটি চলে গেছে না ফেরার দেশে, আজ প্রায় আট মাস হলো। হঠাৎই একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন পাশের মানুষটির কোন সাড়াশব্দ নেই। হয়তো নুরুন্নাহারের ঘুমের কোন ব্যাঘাত ঘটাতে চাননি, তাই নিঃশব্দে চলে গেছেন। তিনি চলে গেছেন, নুরুন্নাহার বেগমের তাই আর ছোট ছোট দুঃখের কথা কাউকে বলা হয় না। পেটের ব্যাথাটাও তাই চেপে গিয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ একদিন এমন তীব্র ব্যাথা শুরু হলো যে, আর চেপে রাখতে পারলেন না। ছোট ছেলেটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন। ব্যাথা কমানোর জন্যে ঔষধ। টানা চার মাস খেতে হবে। এর মধ্যে বাকি টেস্ট গুলোও করিয়ে ফেলতে হবে। টেস্ট দেখে যদি প্রয়োজন হয় একটা অপারেশনের দরকার হতে পারে। তবে তার জন্যে শরীরকে প্রস্তুত হতে হবে। সে জন্যে আরো কয়েক মাস ঔষধের উপর থাকতে হবে।
সমস্যা হচ্ছে পরবর্তী চার মাসের ঔষধ কে যোগাড় করবে? প্রতিদিন প্রায় ৩০০ টাকার মত ঔষধ লাগে। এক একটা ট্যাবলেটের দামই ৭৫ টাকা।
ছোট ছেলেটির ইচ্ছের কোন কমতি নেই । কিন্তু ছাপোষা চাকুরী তার। নুন আনতে পানতা ফুরায়। কোনমতে নিজের সংসার চলে। লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু এই ছেলেটির আর সব কিছুই ভালো। তার মনটাও ভালো।
কিন্তু সমস্যা হলো যাদের করার মত মন থাকে, তাদের সামর্থ্য থাকে না। আর যাদের সামর্থ্য থাকে, তাদের ঈশ্বর সেই মন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান না। তাদের মনের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতার বড় অভাব।
তার বড় ও মেজো ছেলে দুটোর মনও হয়তো দৈর্ঘ্য, প্রস্থে আর উচ্চতায় খুব বড় নয়। কিংবা তাদের মনের প্রশস্থতা তাদের বউ দুটোর মনের স্বল্পায়তনের ঘোরপাকে আটকে থাকে। ডানা মেলতে পারে না। ধার করা কালো ছায়ায় তাদের মনের উজ্জ্বল চাঁদ আস্তে আস্তে ঢাকা পরে গেছে।
প্রতি মাসে ছেলেদের মাঝে মিটিং বসে। কোন মাসে কে মায়ের দায়িত্ব পালন করবে। তিনি মিউজিকাল চেয়ার খেলার বালিশের মতো। পাশের জনকে বুঝিয়ে দিতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে সবাই।
অথচ আট মাস আগেও ঘটনা এরকম ছিলো না। তিনি ছিলেন। মাথার উপর ছায়ার মত তিনি ছিলেন। যেমনটা ছিলেন গত ৫১ টি বছর। তিনি চলে গেলেন প্রিয় কামিনি গাছটার তলার বিছানায়। আর তার পর থেকেই নুরুন্নাহারের ব্যাথা শুরু, পেটের, বুকের।
২)
নুরুন্নাহার তার ঘরে বসে আছেন। পুরনো একটা খাটের উপর বসে আছেন। তার ঘরে আসবাবপত্র বলতে এই একটা খাট আর তার সামনের দিকের দেয়ালের পাশে কোনমতে খাড়া হয়ে থাকা একটা কাঠের আলমারী। জরাজীর্ণ খাট আর আলমারী দুইটার গায়ের রঙ উঠে গেছে অনেক আগেই। জায়গায় জায়গায় পোকায় কেটেছে। ছেলেদের অনেক আপত্তির মুখেও তিনি এ দুটো রেখে দিয়েছেন, অনেক স্মৃতি জমে আছে বলে। মাঝে মাঝে এগুলোর গায়ে হাত দিলে তার হাতে ধুলো লাগে, আর সবার কাছে এগুলি নিছকই ধুলো হলেও, তার কাছে এগুলো স্মৃতি, এই ধুলোর মাঝে লেগে আছে তার অনেক দিনের দুঃখ-সুখের সঙ্গীর স্পর্শ। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হয় যে এই ঘরে আসবাব আসলে তিনটা। একটা পুরোনো খাট, একটা ভাংগা আলমারী আর একটা ভাঙ্গা পুরনো নুরুন্নাহার। যে কোন সময় ভেঙ্গে চুর হয়ে যাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন।
নুরুন্নাহারের এসব আপাত চিন্তা ভাবনার পিছনে যে চিন্তাটা তার মনের ভিতরটাকে মাঘের শীতের ঠান্ডার মত অসাড় করে দিচ্ছে তা হলো, তার ঔষধ শেষ হয়ে গেছে। আজকের ডোজ বাকী আছে। কিন্তু কাল সকালের ঔষধ নেই। ঔষধ খেলেই পেটের ব্যাথাটা চাপা পড়ে থাকে। যখন ব্যাথাটা উঠে আসে তখন আর দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। আর তখন তার মনে হয় এক দৌড়ে তাদের গ্রামের বাড়ির কামিনি ফুল গাছটার নিচে গিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘তুমি ঐখানে শুয়ে আছো কেন? আমার না পেটের ব্যাথাটা আজকাল অনেক বেড়েছে। মাঝ রাতে ব্যাথাটা অনেক বাড়ে। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। আমার ঔষধ ও শেষ হয়ে গেছে। দেখতে পাও না তুমি ?’
যে চলে যায়, সে কিছু দেখতে পায় কি না নুরুন্নাহার জানে না, কিন্তু সে কিছু করতে পারে না এটা সে জানে। তাই পেটের ব্যাথাটাকে সহ্য করতে না পেরে নুরুন্নাহারকে ছেলেদের কাছেই যেতে হয়।
৩)
নিজের ছেলের সাথে দেখা করতে যাবার আগে এরকম কাচুমাচু মুখ করে যেতে হয় জানলে পৃথিবীর কোন মা হয়ত ছেলের জন্মই দিতেন না। কিংবা কে জানে হয়ত দিতেন। মায়েরা হয়তো এমনি হয়। কিংবা এমন হয় বলেই তারা মা। কিংবা এমন না হলে মাতৃত্বের মাহাত্মই মুখ থুবরে পড়ে।
কাচুমাচু মুখে ছেলের কাছে যাচ্ছেন নিজের বেঁচে থাকার সরঞ্জাম চাইবার জন্যে। নুরুন্নাহারের বুকের ভিতর কুণ্ডলী পাকানো ব্যাথাটা আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠতে শুরু করেছে। জীবনের প্রতি কেমন যেন একটা ঘেন্না ধরে যায়। তবু জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। যে কোন মূল্যে জীবন বেঁচে থাকতে চায়। বেঁচে থাকাতেই তার আনন্দ।
- মামুন ঘরে আছিস?
- হ্যা মা, ভিতরে আসো।
নুরুন্নাহার বেগমের গলা বসে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কিভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। অথচ তিনি কি বলবেন তা সবাই জানে। তিনি জানেন, মামুন জানে, শিখা-মামুনের বউ-সেও জানে।
- কিছু বলবে মা?
- হ্যা, বলছিলাম যে, সকালের ঔষধ তো নেই। আজ রাতেই শেষ হয়ে যাবে। তোকে জানাতে আসলাম।
- আগামী সপ্তায় কি আমার পালা?
- হ্যা, এ সপ্তায় তো ছোটটা দিলো। গেলো সপ্তায় ছিলো মেঝোর।
কথাগুলো বলতে বলতে নুরুন্নাহারের গলা ধরে আসে।
- ঠিক আছে মা, আমি কাল অফিস থেকে আসার পথে নিয়ে আসব।
শিখা এতক্ষন চুপ করে ছিল। আর যেন পারলো না। শিখাকে জ্বলে উঠতে হয়, এই বুঝি নিয়ম।
-মা, ঔষধের জন্যেও আপনার বড় ছেলের কাছে আসতে হয়? মেডিকেল টেস্টের পুরো টাকাটাতো ওর পকেট থেকেই গেলো। আপনার বাকী দুই ছেলেতো কিছুই শেয়ার করেনি। এখন ঔষধ টা অন্তত তারা কিনে দিতে পারে।
- আহ, শিখা, কি শুরু করে দিলে এসব? মা, তুমি কি আর কিছু বলবে?
শিখার তেজ বাড়ে। যে তেজে কোন আলো জ্বলে না, আছে শুধু অন্ধকার।
-তুমি থাম। মাসের হিসাবের টাকা। তার মধ্যে তোমার একার সব দায় পড়েছে নাকি? সংসারতো আর তুমি চালাও না। কটা টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দাও। আমি বুঝি সংসার চালানোর কি কষ্ট।
শিখা জ্বলে উঠে। আর নুরুন্নাহার পুড়ে কয়লা হতে থাকেন। তার বুকের ভিতর সেই বিন্দু থেকে ব্যাথাটা আবার ঠিক একটা ঘুর্ণিঝড়ের মত, পাক খেতে খেতে শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অলিগলি ঘুরে তার বুক, কলিজা, হৃদপিণ্ড ছাপিয়ে হাত, পা, চোখ, সমস্ত শরীর, মাথার মগজের প্রতিটি কোষের গভীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আর তার মনে হচ্ছে বেচে থাকা খুব লজ্জার, বড় অপমানের।
মামুন কি বলবে কিছু বুঝে উঠে না। কোন নৌকায় পা দেবে ঠিক ঠাহর করতে পারে না। তার দুই নৌকাতেই পা রাখতে হয়। তাই সে ক্ষীন কন্ঠে বলে,
- মা, ফিরোজকেও তো বলতে পারো একটু খেয়াল রাখতে। ওরতো আরেকটু দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ। আমি একা কত দিক সামলাবো বল।
নুরুন্নাহার অসহায় বোধ করেন। নিজের শরীরটাকে তার অনেক ভারী মনে হয়। মনে হয় তিনি পানিতে ডুবে যাওয়া কোন মৃতদেহ। এই মাত্র ভেসে উঠেছেন। তার পেট পানিতে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। তার সমস্ত শরীর ফুলে ফেপে বিশাল আকার ধারন করেছে। একটু একটু গন্ধও আসতে শুরু করেছে। আর তিনি জানেন না, তিনি কোথায় যাচ্ছেন। ঢোল হয়ে যাওয়া বিশাল শরীর নিয়ে তিনি ভেসে চলেছেন পানির সাথে সাথে।
এই সব অসহায় দুর্বিসহ মুহুর্তে তার মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরনো খাট আর ভাঙ্গা আলমারীর ঘর ছেড়ে তিনি চলে যান, সেই কামিনি গাছের নিচে, যেখানে তার জন্যে কেউ একজন অপেক্ষা করে আছে, যেখানে পেটের ব্যাথা নেই, বুকের ব্যাথা নেই, আছে শুধু কামিনি ফুলের নেশা লাগানো সুবাস আর গা জুরানো ঝিরি ঝিরি বাতাস। আর আছে ছোট ছোট কথা আর ছোট ছোট ব্যাথা বোঝার মত একজন মানুষ।
৪)
নুরুন্নাহার বেগমের বুঝি তন্দ্রার মত এসেছিল। নিঃশব্দ অন্ধকার ঘরে বিছানার সঙ্গে যেন মিশে ছিলেন। পেটের ব্যাথাটাকে এখন আর আমলে নিতে চান না। তিনি ভাবেন তিন তিনটি ছেলেকে পেটে ধরার সময় তিনি কি পরিমান ব্যাথা সহ্য করেছেন। সেই তুলনায় এ ব্যাথা তো কিছুই না। তিনি ঠিকই সহ্য করতে পারবেন। দরজার ঠক ঠক শব্দে ক্লান্ত চোখ দুটো মেলে তাকান।
- মা, জেগে আছো?
- কে মামুন? বাবা আয়। এখানে বোস। ছেলেকে কাছে ডেকে বসান তিনি। - কিছু বলবি?
- মা, তোমার প্রেসক্রিপশানটা দাও। আমি অফিস থেকে আসার পথে ঔষধ নিয়ে আসব। শিখার কথায় তুমি কিছু মনে করো না। ও আসলে এমনি। কথার কিছু ঠিক থাকে না।
- নাহ, আমি কিছু মনে করি না।
- প্রেসক্রিপশানটা দাও।
নুরুন্নাহার বেগমের মুখে প্রশান্তির হাসি। মামুন একটু অবাক হয়। মা তো আর এমন করে হাসে না। আট মাস আগে মা এভাবে হাসতেন। বাবা চলে গেছেন, সাথে মায়ের হাসিটাও নিয়ে গেছেন।
নুরুন্নাহার বেগম একটা ছোট্ট পেয়ালা এগিয়ে দিলেন ছেলের দিকে। সেখানে কুটি কুটি করে ছেড়া কিছু কাগজ।
- এই যে প্রেসকিপশান।
মামুন কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। কিছুক্ষনের জন্যে বোবা হয়ে যায়।
- ছিড়ে ফেলেছি। এটা থাকলে বুকের ব্যাথা বাড়তেই থাকবে। এর চেয়ে পেটের ব্যাথাই ভালো। তিন তিনটা ছেলেকে পেটে ধরেছি। অনেক ব্যাথা সয়েছি। এই ব্যাথাও সয়ে নিব। বুকের ব্যাথা সইতে পারবো না।
মামুন প্রাণ হীন একটা মানুষের মত বসে থাকে।
নুরুন্নাহার বেগম বিছানায় শুয়ে চোখ বুঝলেন। দক্ষিনের জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে অচঞ্চল বাতাস। চার পাশে কেমন যেন কামিনি ফুলের মোহময় সুঘ্রান।