বেদনার নীল

মা (মে ২০১১)

মোজাফফর হোসেন
  • ২২
  • 0
  • ২৫৮২
এখানকার তথাকথিত নিচু শ্রেণীর লোকদের সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ জমে উঠেছে; কেননা আমি ওদের মত নই, যারা গরীবদের কাছে গিয়ে তাদের দুরবস্থা নিয়ে ঠাট্টা করে তাদের বেদনা আরও বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য আমি জানি পৃথিবীর ধনী-গরীব এক হবার নয় এবং ওদের দুঃখ-কষ্টও ঘুচবার নয়; কেননা আমাদের সাথে সাথে প্রকৃতিও এই দুই শ্রেণীর মাঝে একটা হিম শীতল ব্যবধান বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে আমি মনে করি যারা আত্মসম্মানের খাতিরে গরীব অন্ত্যজদের কাছ থেকে দূরে থাকে তারা সেই সব কাপুরুষদের মতই হীন, যারা পরাজয়ের ভয়ে শত্রু থেকে দূরে লুকিয়ে থাকে।
সম্প্রতি একদিন আমি মাঠে গিয়েছিলাম। দেখি একজন বয়স্ক লোক বোঝা ওঠাতে পারছেনা। আমি কাছে যেতেই লোকটা কেমন সংকোচ বোধ করল; আমি জোর করে বোঝা উঠিয়ে দিলাম। বাবুদের মত ঠক করে ধন্যবাদ না দিলেও তার চোখে মুখে যে বিনয়ের ছাপ ফুটে উঠলো তাতে মনে হল আমি তার দেবতা।
সব মিলিয়ে আমি কিন্তু বর্তমানে বেশ সুখি; তারপরও মনটা কেমন জানি পালাই-পালাই করছে । ইচ্ছে করছে কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। সত্যি বলতে মানুষের এই মেপেজুখে চলা আমার আয়ত্তের বাইরে; একঘেয়েমি সুখকেও ঠিক মেনে নিতে পারিনা। তাই হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলাম, সিলেট যাব। নতুন পরিবেশে নিজেকে নতুন করে জানা হবে। সবকিছু প্রায় ঠিকঠাক, শুধু খারাপ লাগছে ঐ ঝুনু পাগলিটার জন্য। এখানকার সকলের চেয়ে ও আবার আমাকে একটু বেশিই ভালবাসে। বর্তমানে পাগলিটাও আমার কাছে বিশেষ কেউ হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে যত কোটি মানুষ ঠিক তত কোটি ভাষা আছে, আর তা হল চোখের ভাষা। মুখের ভাষায় আমরা সহজে পটি আর চেখের ভাষায় হয়ে পড়ি অসহায়। আমাকে ও বেঁধেছে চোখের ভাষায়। যে আমি ফুটন্ত জ্যোস্নার মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেছি অনুভূতিহীন, রঙধনু মাখানো সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছি আয়েশ করে, বহুবার হাতে নিয়েও পড়তে পারিনি শেষের কবিতা, উত্তম-সুচিত্রার সাগরিকা দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি অসময়ে, সেই আমি রাস্তার নোংরা এক পাগলীর ভালবাসাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি নিজের অজান্তেই; পৃথিবীর অনেক কিছু জানলাম, নিজের মনকে জানা হল না আজো !
বলতে দ্বিধা নেই, পাগলিটাকে বেশ আমি আপন করে ফেলেছি যদিও তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানিনা। লোক মুখে শুনেছি বছর বিশেক আগে ও এ অঞ্চলে এসেছে তারপর আর কোথাও যায়নি। হাঁটার সময় পুঁটলির ভিতর ঝুন্-ঝু্ন্ করে কি যেন একটা বাজে এজন্য সকলে ওকে ঝুনু পাগলি নামেই ডাকে। এতদিনেও একটা জিনিস আমি বুঝলাম না, ছোট বাচ্চাদের দেখলেই ও কেমন জানি ছটফট করে। এইতো সেদিন রাস্তা থেকে একটা বাচ্চা তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল, লোকজন তো মেরেই ফেলতো, শেষমেষ আমি হয়ে রক্ষা। এর আগেও ওকে আমি এমন ঘটনাার হাত থেকে বেশ কয়েকবার বাঁচিয়েছি। হয়ত তারই জন্যে ও আমাকে এত ভালবাসে। আমার চলে যাওয়াটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। জামা কাপড় গোছগাছ দেখে ভেবেছে আমি ওকে চিরদিনের জন্যে ছেড়ে যাচ্ছি। পাগলি তো তাই কোন কথাই বোঝানো গেলোনা, অভিমান করে ইনিয়ে-বিনিয়ে কি যেন সব বলে গেল!
ভোর ছ'টায় ট্রেন; তৈরী হচ্ছি এমন সময় একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলল, "ঝুনু পাগলিটা জড়ধফ ধপপরফবহঃ করেছে"। আমি আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। সংগাহীন এক ভালবাসার টানে ছুটে গেলাম তার লাশের পাশে। মনের অজান্তেই কয়েক ফোটা অশ্রু মিশে গেল রক্তে।
একি দুর্ঘটনা নাকি স্বেচ্ছায় হনন? আচ্ছা ওতো আমাকে প্রচন্ড ভালবাসতো, এমনতো হতে পারে আমি চলে যাচ্ছি বলেই..., নাকি এটা আমার দুর্বলতা! মাঝবয়সী এক লোক ওর এতদিনের সযত্নে লালন করা পুঁটলিটা ঝেড়ে ফেলল; বের হয়ে আসলো বাচ্চা ছেলের কয়েকটা পোষাক, একটা ঝুমঝুমি ও একটা ফটো, কিন্তু একি দেখছি! এতো আমার-ই বাল্যকালের ছবি তাহলে কি এই পাগলিটাই আমার...! কিন্তু তাই বা হয় কি করে আমার মা তো মারা গেছেন অনেক আগে। আর দেরি না করে চলে আসলাম বাবার কাছে; ছবিটা দেখা মাত্রই কেমন যেনো মুষড়ে গেলেন তিনি। অতঃপর চলে গেলেন অন্য এক জগতে : "কলেজে আমাদের প্রথম পরিচয়; ঘটনাচক্রে আমাদের ঘনিষ্টতা আড়ালে আবডালে আলোচনা-সমালোচনার বেশ জনপ্রিয় বিষয়ে পরিনত হয়। দুটি ভিন্ন সপ্রদায়ের এই সখ্যতা যেন সমাজের মাথা বঁ্যথার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরাও যেনো সমাজকে ভুল প্রমানিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলাম। এক পর্যায়ে আমরা পরস্পরকে ধর্ম, সামাজিক রীতি-নীতি, অর্থনৈতিক বাস্তবতা সবকিছু ছাড়িয়ে ভাবতে থাকি; যদিও জানতাম, দুটো মানুষ একটা পরিবার তৈরি করতে পারে, একটা সংসার তৈরি করতে পারে কিন্তু কখনো একটা সমাজ তৈরি করতে পারে না। সমাজ মানেই অনেকের সমষ্টি, দুইজন মিলে একাধিক হওয়া যায় অনেকে হওয়া যায় না। কিন্তু সেই সময়টাই ছিল এমন যেন আমরা কোনকিছুতেই দমবার পাত্র নই; বলা যেতে পারে 'লাভ ইন লাভ'। সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে করার; সমাধানটা হল এমন্#৬১৬৩০;একদিকে মস্িজদ অন্যদিকে মন্দির মাঝখানটা একান্তই দুজনার, তৃতীয় কোন ইসু্য থাকবেনা সেখানে। বেশ ভালই কাটছিল; তারপর জন্ম হল তোমার। তোমার আগমনে বেশ কিছু নিয়মেরও পরিবর্তন জরুরী হয়ে উঠল। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি হলাম না। আমি চাই তুমি বড় হয়ে আমার অনুসারী হবে, শিপ্রা চায় তার। শুরু হল কলহ, বিশৃংখলা। এক পর্যায়ে আমি আশ্রয় নিলাম পুরুষত্বের, সবকিছু একবাক্যে নস্যাৎ করবার সর্ব শক্তি যেখানে নিহিত। যে ক্ষমতা পরিবর্তনে ধর্ম পরিবর্তিত হয় সেখানে শিপ্রা তো একজন নারী! তাই জোর খাটিয়ে বললাম, হয় তুমি আমার সব কথা মেনে চলবে নতুবা সংসার ছাড়বে। শিপ্রা আমার কাছে আশ্রয় চেয়েছিল একজন মানুষ হিসাবে, একজন হিন্দু হিসাবে নয়, কিন্তু আমি ততদিনে সর্বাংশে একজন সমাজের কেউ; সমাজস্থ কিছু লোকের প্ররোচনায় শিপ্রাকে মারধর করে বাড়ী থেকে বের করে দিলাম। বছর খানেকের মাথায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে শিপ্রাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করি। এক সময় দেখা পেলেও কোন লাভ হয়নি কেননা ততোদিনে সে এক বদ্ধ উম্মাদ...! তাই অনেকটা ভেবে চিন্তে এবং তোমার অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে এতদিন তোমাকে আমি মিথ্যে বলে এসেছি। ইনিই তোমার গর্ভধারিনী...!"
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। পায়ের তলার মাটি যেন সরে সরে যাচ্ছে। বিশাল এক ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে সমস্ত দেহে। টলতে টলতে নেমে আসলাম রাজপথে। দুই আঙ্গুলের মাঝখানে জমে থাকা নীল বর্ণের রক্ত দেখে মাথার ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল। দৃষ্টি মেলে দিলাম শূণ্যে : চারিদিকে শুধু নীল আর নীল;আমার বেদনার নীল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোজাফফর হোসেন নাজমুল হাসান, ভালো লাগলো শুনে। ধন্যবাদ।
মোজাফফর হোসেন বিন আরফান, দুটোই চেষ্টা করি আর কি !ধন্যবাদ ভাই।
মোজাফফর হোসেন সুজন মাহমুদ, ধন্যবাদ।
নাজমুল হাসান নিরো বর্ণনাভঙ্গীতে পেশাদারিত্বের ছাপ। একদম অন্যরকম একজন চরিত্রের দেখা পাওয়া গেছে লেখায়। অন্যরকম চরিত্রটি খুব ভাল লাগল। আর অনুভূতির খুব গভীরে যাওয়ার দক্ষতা আছে লেখকের।
বিন আরফান. ৬১৬৩০ সহ আরো কিছু শব্দ মাথায় ধরল না. এছাড়া থিম, বর্ণনা, শব্দ চয়ন চমত্কার. মোট কথায় একটি পরিপক্ক গল্প. মূলত আপনি লেখক না কবি ? আমি দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছি. তবে দুটোই মনে হয়. চালিয়ে যান. শুভ কামনা রইল.
Sujon অদৃশ্য বন্ধন, যা স্রষ্টার সৃষ্টি ,ভাল লাগলো।
মোজাফফর হোসেন আপনি পড়েছেন দেখে আমার খুব্ ভালো লাগলো।
শাহ্‌নাজ আক্তার ভালো, শেষে এসে আমি হকচকিয়ে গেলাম .....
মোজাফফর হোসেন তৌহিদ উল্লাহ শাকিল, ভালো লাগলো শুনে। ধন্যবাদ ভাইয়া।
sakil অনেকটা ধরাবাধা জীবনের গন্ডির বাইরের বেশ কিছু কথা এসেছে আপনার লেখাতে . ভালো লেগেছে .চারিদিকে শুধু নীল আর নীল;আমার বেদনার নীল।

০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪