প্রায় প্রতিদিন শিল্পীর সাথে ফোন কথা হত। কলেজ খোলা থাকলে চুটিয়ে আড্ডা। আর বন্ধ থাকলে ভরসা ছিল ফোন। তখনও মোবাইল ফোন সকলের হাতে হাতে ছিল না। এত বাহারি কিংবা এত এত ফিচারও না। তখন বেশি সংখ্যাক ফোনই ছিল ফিচার ফোন। অনেকে বলত বাটন ফোন। তার মধ্যে যারা অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের ছিল তাদের হাতে ছিল স্লাইডিং কিংবা ফোল্ডেবল ফোন। আর ছিল কালো লাল নীল সাদা এবং ছাইরঙা।
তখনো আমার কোন নিজস্ব ফোন ছিল না। ফোন দোকানে ছিল কথা বলার ব্যবস্থা। আমরা কথা বলতাম দুই টাকা মিনি রেটে। তারও আগে আগে এই রেট ছিল ছয় টাকা। যা ভ্যাটসহ পড়তো বাড়তি নব্বই পয়সা। চুটিয়ে প্রেম তখনও হয়নি। কেমন যেন একটা আসক্তি কাজ করতো। কথা বলতে ভিতর থেকে কেউ উদ্বুদ্ধ করত।
এক সময় ভিতরের সেই যাদুটা বের হয়ে এল। আর আমিও ফোন কিনলাম। সিমেন্স কোম্পানির। সব মিলিয়ে হাজার চারেক টাকা হবে। বেশ উৎফুল্ল আমি। যাক এবার আর দোকান নয়। বাসায় শুয়ে বসে ফোন করে কথা বলা যাবে। দারুণ জমবে সেই কুসুম কুসুম প্রেম। আহা কি পুলক বোধ কাজ করতে থাকে আমার ভিতর বাহিরে। কেমন যেন শীত লাগা ভাব। বয়ে যায় ধীরে হিমালয় থেকে ফিরে আসা হিম প্রবাহ। আমি যেন আমার ভেতর থাকি না! কেউ একজন আমাকে হরণ করেছে। আমার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে চলে যায়। ভাবতে থাকি কে এই আমি যে দেহের ভিতর বাস করি। আবার উড়াল মারি শুন্যে! আবার ফিরে আসি ক্ষণে ক্ষণে। এই উপদ্রব আমাকে জাগিয়ে রাখে রাতের পর রাত।
কলেজ বন্ধ থাকে। আমিও উতল হই হাওয়ার মত। ভ্রমরের মত। ফুলের সুবাস আরো কাছে টানে। নতুন কেনা ফোন দিয়ে কল করি। ওপ্রান্ত থেকে কেউ এত স্বচ্ছ ও পরিষ্কার গলায় বলে ওঠে হ্যালো!
শিহরিত হই। আন্দোলিত হই। মুহূর্ত সময় পর সেই আনন্দে মলিনতা যোগ হয়। কষ্ট বাড়ে। আক্ষেপ বাড়ে। আমি যেন নিথর হই। যেন শুন্যে উড়ে যাচ্ছি। আমাকে কেউ আর টেনে রাখতে পারবে না। আমি আমার ভর টের পাচ্ছি না। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি এটা আমার নাম্বার এখন থেকে এই নাম্বারে পাবে। এটা নতুন ফোন। একনাগাড়ে কথাগুলো বলা শেষ হতেই ওপ্রান্তের সেই কন্ঠ জানিয়ে দিল আর ফোন করার দরকার নেই! ব্যস রাজ্যের অভিমান মনে ভর করে। পাশে থাকা জালালকে কিছুই বলা হয়নি। তারপর থেকে অনবরত ফোন বেজেই চলছে সেদিকে আমার খেয়াল নেই। বারবার ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি আর সেও ফোন করে চলে। রাত কি দিন অনবরত অসংখ্য ফোন আসে তার পিতার সেই ফোন থেকে। এ প্রান্তে আমি আর ফোন কল রিসিভ করি না। এত বেশি কষ্ট নিয়েও নিজেকে চালিয়ে রাখতে আমাকে অনেক কসরত করতে হয়। কাউকে বলা হয় না সেইসব কথাগুলো।
আমার অভিমান তাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন সে কল করে যায়। আমার ফোনে রিং বাজে। ধরতে কেউ একজন তাড়না দেয় তো অন্য দশজন বাধ সাধে। আমি অসহায় হয়ে পড়ি। আগের চেয়ে অনেক অসহায়। এক্ষেত্রেই কেউ যেন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আমার। আমি আমার ভিতর থেকে বাহির হতে চাই। পারি না।
এভাবে সে ক্ষান্ত দেয়। তাও হয়তো নয়। আমি কল ব্লক করে দেই। কখনো স্ক্রিনিং করে রাখি। তার ফোনকল আসে। ফোনে শব্দ হয় না। কেউ তা টেরও পায় না। একদিন বিকাল বেলায় অন্য একটি নাম্বার থেকে ফোন আসে। আমিও রিসিভ করি। বুঝতে পারি সেই সুমিষ্ট কন্ঠের মেয়েটি আমারই প্রেমিকা। কথা বলি। নির্মোহ ভাব বাক্যে। সে বুঝতে পারে না। আমি বলি আমি বলছি। সে মন প্রাণ খুল সব কথা বলে যায় একনাগাড়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনে যাই। হুঁ হুঁ করি।
সে বলে তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। ছেলে পক্ষ এসে দেখে আংটি পরিয়ে দিবে ঠিক তখনই সে চিৎকার করে ওঠে। সে কিছু বলে না। তার মা সেন্স হারিয়ে ফেলে। পাত্রপক্ষ উঠে চলে যায়। এভাবেই কয়েকটা বিয়ে ভেঙে যায়। সে আমার অপেক্ষায় আছে। আমাকে ছাড়া কাউকে সে মানতে পারবে না। আমি যেন.....
তখনই আমি বলে উঠি আনন্দ ভাইকে কিছু বলতে হবে?
এই কথা শুনে সে নির্বাক থির হয়ে পড়ে। কার সাথে কথা বলছে এতক্ষণ? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। হ্যালো....হ্যালো করে। আমি ফোন কেটে দেই। মাঝেমধ্যে ফোন করে তার কন্ঠ শুনি। আবার কেটে দেই। সে বুঝতে পারে না। কিন্তু চাপা কষ্ট আর অভিমান আমাকে অনেকটাই স্ববিরোধী করে তোলে। একদিকে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি অন্যদিকে তাকে। তারপরও সেদিনের সেই কথায় অভিমান ভর করায় আজ অবধি সাক্ষাতে তাকে কিছুই বলা হয়নি।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা এসে গেছে। প্রথম দিন সে গেইটের ভিতর ঢুকে পথের একপাশে দাঁড়িয়ে রইল আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। আমি হেঁটে চলে যাই নির্বিকার ভঙ্গিতে। সে কিছু সিনক্রিয়েট করতে পারে মনে ভয় কাজ করে। সে কিছু না বলায় যেন একটা ভার নেমে গেল। যথারীতি পরীক্ষা শেষ।
ভাইভার দিনক্ষণ চূড়ান্ত হল। ঠিক তার আগের দিন একটা এসএমএস আমার ফোনের ইনবক্সে। খুলেই দেখি Sorry ঠিক তারই নিচে লেখা FK. আর কিছু লেখা নেই। আমি বুঝলাম সেই পাঠিয়েছে। যাতে বুঝতে পারি সেজন্য ইংরেজি অক্ষরে FK লিখেছে তার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে।
ভাইভার দিন আমি সাধারণ ভাবেই ভাইভা সম্পন্ন করলাম। আজই পরীক্ষা শেষ। শিক্ষা হীবনের ইতি! মানতে পারছিলাম না। এই প্রাণের ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে হবে। বন্ধুদের সাথে দেখা হবে না। শিল্পীর সাথেও না!
অভিমানে আমি জমে পাথর হয়ে গেছি। অথচ তার সাথে কত স্মৃতি! এ যেন বিচ্ছেদের ধারণার বাইরে অবিচ্ছেদী একটা খেলা। প্রেম হয়। ভালোবাসা হয়। সম্পর্ক থাকে না। আমি তাকে দূর থেকে ভালোবেসে যাই। নিখাঁদ সেই ভালোবাসা শুধু কাব্যে গল্পেই দৃশ্যমান হয়। বাস্তবে তার কোন পরশ কেউ পায় না। আমি আজো তাকে ভালোবাসি। ভিতরের রূপ কেউ বোঝে না। ভিতর কেউ দেখে না। ওপরে আমি কেবলই খোলস!
রেজাল্ট হয়। দুইজনই পাশ করি। সে বিয়ে ঠেকাতে বি-এড কোর্সে ভর্তি হয়। সাথে ভর্তি হয় বন্ধু জালাল। সেখানেও কেউ একজন তাকে ফলো করে। সে পাত্তা দেয় না। প্রায়শঃই সে বলতো জালালের কাছে আমি তাকে দেখতে যাব। আসমার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। শিল্পী বান্ধবী। আমার ক্লাসমেট। আসমা আমাকে সকল ইনফরমেশন দিত। আমি ভাবতাম তার সাথে যোগাযোগী তাই আমলে নিতাম না।
পরে শুনি জালালও তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। সে পাত্তা দেয়নি। সে ঘটনা নিয়েও লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে। লাকসাম কতবার গিয়েছি। তাদের বাড়িতেও যাওয়া হয়েছে। জংশনের আলো ঝলমলে বাতি আজো মন কাড়ে। যেতে ইচ্ছে হয়। যাওয়া হয় না। সময় হয় না। আর ট্রেনের হুইসেল শুনলেই মনে পড়ে যায় পাশেই তাদের বাড়ি। লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া। কত ঘোরাঘুরি।
আজ আর অভিমান করে কি হবে। তার সংসার, স্বামী, সন্তান নিয়ে বেশ সুখ। আকুলি বিকুলি সুখ! আমাকে অসুখী করে না।
তুমি ভালো থেকো তারাদের মত। আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে। রিচিক আর রোজের মা হয়ে। আমি আমার মতই থাকব। তোমাকে অন্তরে পুষে!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
প্রায় প্রতিদিন শিল্পীর সাথে ফোন কথা হত।
২৪ নভেম্বর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
২২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।