সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফেরার কথা বলে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়া ছেলেটি রাত বারোটা অবধি ঘরে না ফেরায় মায়ের মন ক্রমশঃ সংকুচিত হতে থাকে। বেশ কয়েকবার পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। ছেলেটার কিছু হয়ে যায়নি তো!
বিছানায় শুয়ে থাকলেও কান খাড়া করে থাকে কখন এসে দরজায় টোকা দিবে। ছেলেটার দীর্ঘদিনের অভ্যাস কোনদিন বাসায় ফিরতে রাত গভীর হলে কলিংবেল না বাজিয়ে আলতো করে দরজায় টোকা দেয়া। যাতে করে পরিবারের অন্য সদস্যদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মায়ের দু'চোখ জড়িয়ে যায়। আবার ঘুম ভাঙে। কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করে।
তিন ছেলের মধ্যে দিরাজ মেজো। আর এক মেয়ে লাইজু। বড় ছেলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে নিখোঁজ। ছোট ছেলে কানাডায় পড়াশোনার জন্য গিয়ে আমেরিকান এক মেয়েকে বিয়ে করে আজ দশ বছর দেশে পর্যন্ত আসার নাম নেই সিরাজের। ছেলে মাঝে মাঝে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সবার সাথে কথা বলে। এটাই সান্ত্বনা। তাতে কি মায়ের মনের চাহিদা মেটে? কতদিন মা পরীবানুকে সে দেশে ঘুরে আসার কথা বলেছে ছেলে। কিন্তু পরীবানু বিমান চড়ায় ভয়ের কথা বলে সম্মতি দেয় না। নেপথ্যে স্বামীর প্রতি গভীর টান অনুভব করে। দেশ স্বাধীন হবার পর অভাব অনটনের সংসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দিনদিন শরীর আরো ভেঙ্গে যায়। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে আশি সালে মৃত্যুবরণ করে। সেই থেকে সন্তানদের দায়িত্ব পরীবানুর কাঁধে।
পরীবানু ঘুমের ঘোরে বেঘোরে কত দুঃস্বপ্ন দেখে। তার নিখোঁজ সন্তান মিরাজ আয়াত এসে আঁচলে মুখ লুকিয়ে বুকের দুগ্ধ পান করবে। মিরাজ যুদ্ধের সময় মাত্র দুই বছর বয়সী। হানাদার বাহিনী এক রাতভোরে কামান বুলেট ডিনামাইট দিয়ে ঘরবাড়ি উড়িয়ে দিতে দিতে এগিয়ে আসছে দেখে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে থাকে গাঁয়ের লোক সকলে। আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভূমিকম্পের মত কেঁপে কেঁপে ওঠে মাটি। ভয়ে শিউরে ওঠে। কোনরকমে দরকারি জিনিসপত্র চটের বস্তায় করে গ্রামের সকলের সাথে রহমত মিয়াও স্বপরিবারে পাড়ি জমায় ভারতে আশ্রয় শিবিরে। সিমান্ত পার হওয়ার পর মনে হয় বেঁচে আছে। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে মিরাজকে পথেই ফেলে এসেছে। পুরো রসুলপুর গ্রাম জনমানব শুন্য। সবাই একসাথে ভারতের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে। পরদিন মিরাজের বাবা রহমত মিয়া আবার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় সকল ভয়ডর উপেক্ষা করে। এসে দেখে গ্রামশুন্য লোকালয় বিরাণ। পশুপাখি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই। এই ছাইয়ের মধ্যে কোনটি মানুষের পোড়া মাংস আর কোনটি গবাদিপশুর তা বোঝার কোন উপায়ই নাই। বোবা কান্নায় পাথর হয়ে যায় রহমত মিয়া। তথাপিও সীমান্তের ওপারে স্ত্রী-সন্তানদের কথা ভেবে আবার পাড়ি জমায়।
সীমান্ত অতিক্রমের তিন কিলোমিটার আগে বনগাঁও নামক স্থান পার হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দূর থেকে ভেসে আসে গুলির সাঁইসাঁই ঠ্রা ঠ্রা ঠ্রা শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রহমত মিয়া। বুঝতে পারে দূর থেকে আসা বুলেট তার বাম পায়ের মাংসপেশি ভেদ করে বেরিয়ে গেছে একখন্ড সতেজ মাংশ নিয়ে। তারপর শরীরের সমুদয় শক্তি সঞ্চার করে পরণের শার্ট দিয়ে ক্ষতস্থান ভালো করে বেঁধে রক্তাক্ত অবস্থায় শরণার্থী শিবিরে পৌঁছানোর পর অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আগে থেকে অবস্থান নেয়া গ্রামের লোকজন বাঁশ দিয়ে স্ট্রেচার বানিয়ে শিবিরের মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। মোটামুটি মাস দেড়েক পরিচর্যার পর সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে ওঠে। পরীবানুর শিশুপুত্র মিরাজের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
রহমত মিয়া স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে শরণার্থী শিবিরে রেখে দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সদলবল স্বসস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসে দেশ স্বাধীন হবার পর ভারত গিয়ে পরিবার নিয়ে আবার দেশে ফেরত আসে। কিন্তু যুদ্ধোত্তর সময়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সনদপত্র সংগ্রহ করার মত চিন্তা পর্যন্ত করেনি। দেশ থেকে এর প্রতিদান নিবে কেন এমন চিন্তা থেকে। সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ না নেয়ায় কিছু লোকের কাছে রহমত মিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিছক গালগল্পে পরিণত হয়।
কন্যা লাইজু যুদ্ধের সময় এক মাস বয়সী ছিলো। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যাবার পর শ্বশুরবাড়ীতে তাদের ঠাঁই না হওয়ায় পিতার বাড়ীতেই বসবাস আজ দুই বছর ধরে দুই পুত্র কন্যাকে নিয়ে। পরীবানু লাইজুর কক্ষে গিয়ে দিরাজের না ফেরার খবরটি জানালে সেও বিছানা ছেড়ে মাকে নিয়ে বারান্দায় যায় আর অপেক্ষায় থাকে কখন ভাই আসবে।
ততক্ষণে দিনের প্রথম আলো ফুটতে আরো কিছু সময় বাকী আছে। মন আরো বেশী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। চব্বিশঘণ্টা সময় অতিবাহিত হতে চলেছে। মিরাজ এখনও পর্যন্ত বাড়ী ফেরেনি। পাশের বাড়ীর মতি মিয়াকে খবর পাঠায় পরীবানু। মতি মিয়া পরীবানুর স্বামী রহমত মিয়ার চাচাতো ভাই। খুবই বিশ্বস্ত। পরীবানুর পরিবারের সুখ-দুঃখের ভাগিদার মতি মিয়া প্রয়োজনে ঠিকঠিক পাশে থাকে। তাকে পাঠিয়ে দেয় প্রধান রাস্তার মাথা পর্যন্ত। মতি মিয়া সকাল নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আবার বাড়ীতে চলে আসে। পরীবানুর মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। কোন প্রশ্ন না করেই বুঝতে পারে এখনও তার ছেলে ফিরে আসেনি আনমনে কত কি ভাবতে ভাবতে আবার শয়নকক্ষে যায়, আবার বারান্দায় আসে।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে আসে তবু দিরাজ বাড়ী ফেরে না। লাইজু বারবার তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে সংযোগ পাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। উৎকন্ঠা আরো বাড়ে।
লাশবাহী একটি ফ্রিজার এ্যাম্বুলেন্স বাড়ীতে ঢুকতেই ওঁ ওঁ ওঁ শব্দ পরীবানুর কানে আসে। পরীবানু এক দৌড়ে ঘর থেকে বাহির হয়ে উঠানে আসতেই গাড়ীর সাদা গ্লাস খুলে দেয়া হয়। মুহূর্তেই পরীবানুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মুখে কিছুই বলতে পারে না। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ঢাকা থেকে বাড়ী ফেরার পথে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে সঙ্গ্বাহীন অবস্থায় হসপিটালে নেয়ার পথেই একজন লোক মারা যাওয়ার খবর শুনে নিউজ কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিক দেখে দিরাজকে আঞ্জুমান-ই-মুফিদুল ইসলামের গাড়ীতে করে ঠিকানা দিয়ে লাশ বাড়ীতে পাঠায়। কারণ ঐ সাংবাদিক দিরাজকে চিনতো। পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র পাওয়ার জন্য দিরাজ বেশ কয়েকবার বিখ্যাত সাংবাদিক বখতেয়ারের সাথে যোগাযোগ করেছিল।
লাশ ধোয়ার দায়িত্ব পড়ে মতি মিয়ার ওপর। দিরাজ যাকে মতি চাচা নামেই সম্বোধন করতো। মতি চাচা তার ছোটবেলা থেকেই খেলার সঙ্গী। দিরাজ একবার ছোটবেলায় আমগাছ থেকে পড়ে গিয়ে ডান হাত ভেঙ্গে যায়। হাতে পাত লাগানো অবস্থায় আছে। মতি মিয়ার তা খুব মনে আছে। লাশের গোসলের সময় মতি মিয়া দিরাজের গায়ে সাবান দেয়ার সময় বুঝতে পারে ডান হাত সম্পূর্ণ ভালো। কোন কাটা ছেঁড়ার দাগ পর্যন্ত নেই দেখে বাম হাত ভালো করে পরখ করে। এখানেও কোন কাটা ছেঁড়ার দাগ নেই দেখে পর্দার ঘের থেকে বাহির হয়ে এসে তার মা পরীবানুর সাথে ছোটবেলায় হাত ভাঙার বিষয়ে কথা বলে আরো নিশ্চিত হয়। কিন্তু গতরে কোন দাগ না থাকার কারণে মতি মিয়ার মনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে। পরীবানুও কোন কূলকিনারা পায় না। চিন্তায় পড়ে যায় হুবহু দেখতে একই রকম লাশের মানুষটি কে?
পরক্ষণেই মায়ের মনে পড়ে যায় মিরাজ আয়াত এবং দিরাজ হায়াত দুই পুত্র সন্তানের জমজ হয়ে জন্মগ্রহণ করার কথা। এটা আর যাই হোক দিরাজের লাশ নয়। তার হারিয়ে যাওয়া নয়নমণি শিশুপুত্র মিরাজ আয়াতের।
মানুষের মনে ব্যাপকতর কৌতূহল। পরিচিত অপরিচিত সকলের মধ্যে ব্যাপক আলোচনায় উঠে আসে চমকপ্রদ এ ঘটনা। এ খবরে গ্রাম ছড়িয়ে সর্বত্র সরগরম হয় আলোচনা।
ভীড় ঠেলে লাশের কাছে এসে দেখে সম্পূর্ণ একই আদলের একটা লোক খাটিয়ায় নিথর দেহে পড়ে আছে। দিরাজ বুঝতে পারে না এই লাশের পরিচয় কি? এখানেইবা কেন আনা হয়েছে। কেউ আর দিরাজকে খেয়াল করছে না। সবাই মিরাজকে নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। দিরাজ ঘরে প্রবেশ করতেই পরীবানু আঁতকে ওঠে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দিরাজ কিছু বলে ওঠার আগেই মা বলতে শুরু করে মিরাজরে দেখছো বাবা! ফিরা আইছে। আমার কাছে। তার মায়ের কাছে। তয় জিন্দা না লাশ হইয়া। দিরাজ মাকে সান্ত্বনা দিয়ে গোসল সেরে সবাইকে নিয়ে লাধের জানাজায় যায়। ফিরে এসে কাহিনী শুনে নিজেই তহবম্ভ হয়ে যায়। মায়ের মুখে সব সময় শুনতো। কিন্তু তার স্মৃতিতে একদমই মনে থাকে না ভাইয়ের কথা।
মা পরীবানু বারবার পেয়েও হারানো সন্তান মিরাজের কথা ভাবতে থাকে। স্বামী রহমত মিয়ার স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। প্রবাসী ছোট ছেলে সিরাজের কথা মনে করে।
আজ সরকার রহমত মিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ ও প্রচার করে। রহমত মিয়া জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি! মৃত্যুবরণের পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হওয়া তাঁর ভাগ্যে জোটেনি।
দিরাজ হায়াত মুক্তিযোদ্ধা পিতার মৃত্যুর পর পদে পদে বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরে সকল কাগজপত্র সংগ্রহ করে আবেদন করে। ফলে সরকারি সকল নথিপত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা রহমত মিয়ার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। গ্রামের সকল লোক প্রতিদিন পরীবানুর খোঁজ খবর নিতে আসে। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া স্বামীর মুখে শোনা গল্প অবিশ্রান্ত মানুষজনকে বলে যায়। স্মৃতিচারণ করে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে স্বামী এবং হারানো পুত্রের কথা মনে করে।
তারপরও পরীবানুর গর্বে বুকটা ভরে ওঠে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে বাকি জীবন পার করে মরতে পারবে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তার স্বামীর অবদান জাতি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে রাষ্ট্রীয় দিবস সমূহে। মুখটা যেন ঝলমলে মায়াবী আলোয় চকচক করে ওঠে। অজান্তেই মুখ ফুটে বের হয় জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার ধারাবাহিক পটভূমি নিয়ে রচিত হয়েছে।
২৪ নভেম্বর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
২২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।