-হালটা ধর বাপ। জোহরের আযান হইয়া গেছে, নামাজটা পইড়া আসি।’ খেতের আইলে গামছাটা বিছিয়ে বাপজান নামাজে দাঁড়িয়ে পড়তেন। সালাম ফিরিয়েই চলে আসতেন। ‘সর এইবার বাপ, যা একটু জিরা’…..আবার সেই হাল ধরে জমি চাষে ব্যস্ত হতেন কৃষক বাবা আমার। উপরে গনগনে রোদ। মাটি চিরে প্রকৃতির কাছ থেকে কড়ায় গণ্ডায় দাবী আদায়ে লড়া এক সৈনিকের ঘামে ভেজা গা চিকচিক করত সূর্যের চোখ ঝলসানো আলোতে। প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত হুররর….ডায়ে….ডায়ে….বায়ে….বায়ে, হালের বলদগুলোকে বশে রাখার মেঠো আওয়াজ ।
ভাবছে সফিজ মিয়া। ছোটকালের ক্ষেতিবাড়ির গল্প। এসব আজকাল খুব বেশী মনে পড়ছে তার, চোখ ভিজে আসে।। কত কষ্টের মধ্যে কৃষক বাপ লেখাপড়া করিয়েছেন, শিক্ষিত করেছেন। মাঠের কাজে ছেলেকে আসতে দিতেন না। স্কুল ছুটির দিনগুলোতে মাঝে মাঝে বাপকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েই যা কিছু চাষবাসের অভিজ্ঞতা তার।
তারপর অনেক গল্প। নিজেকে তৈরী করার সংগ্রাম। গ্রাম থেকে শহরে আসা। প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে টিকে থাকা। চাকরি-বাকরির চেষ্টা। শেষমেশ পূরাণ ঢাকার এক ব্যবসায়ীর নজরে পড়া। সৎ ভদ্র পোলা পরিচয়ে আপন করে নেয়া। আট দশটা কাহিনীর মত বেপারীর জামাই বনে যাওয়া।
সততার সাথে ব্যবসা করতেন শ্বশুর রহিম মিয়া। চাল-ডালের পাইকার। বড় মোকাম ছিল। উচিত দাম দিতেন বিক্রেতাকে। মজুদ করতেন, সময়ের প্রয়োজনে, সংকট সৃষ্টির জন্য নয়। নিজের মুনাফার উদ্দেশ্য ঠিক রেখে বাণিজ্য করতেন। কিন্তু কখনই অযৌক্তিভাবে দাম বাড়াতেন না। কোন রকম ব্যবসাটা হলেই মাল ছেড়ে দিতেন। টুপি পড়েন মাঝ বয়স থেকে, জোব্বা ধরেছেন কিছুদিন হল। দেখানো লেবাস না। ধর্মের প্রতি অনুরাগ আছে।
শ্বশুর হজ্বে যাবেন। ছেলে নেই। যাওয়ার আগে বড় জামাইয়ের হাতে ব্যবসার দায়িত্ব তুলে দিয়ে গেলেন। ছোট জামাই আপত্তি করে নি। প্রথমতঃ বড় ভায়রা সফিজ মিয়ার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। দ্বিতীয়তঃ ছোটজন ফূর্তিবাজ মানুষ। ওসব নিয়েই থাকে। শ্বশুর হজ্ব থেকে আর ফিরলেন না। মুরব্বিরা বললেন, আল্লাহ পাক তারে কবুল কইরা নিছে। নিতেই পারে, তিনি সজ্জন মানুষ। যদিও তেমন অসুখ বিসুখ ছিল না তার। সৌভাগ্যবান তিনি, বর্তমান নিয়মে পবিত্র ভূমিতে রয়ে গেলেন চির সমাহিত হয়ে।
সবার সাথে শোকের কান্নায় সফিজ মিয়া আলাদা থাকল না। শ্বশুরের ছায়ার অভাবটা, মায়ার টানটা দিলে টের পেল সে। আড়ালেও কষ্টটা বযে নিয়ে গেল। আবার কোন এক ফাঁকে স্বস্তির একটা নিশ্বাসও ফেলল।…মানী’র মান আল্লায় বাঁচায়, আব্বাজান ফিরে আসলে বেশকিছু বিষযের উত্তর কীভাবে দিত, তা নিয়ে পেরেশান ছিল সে।
ব্যবসার বেশ কিছু টাকা শ্বশুরের অজান্তে শেয়ার ব্যবসায় খাটিয়েছিল। ওখানকার লাগাতার ভরাডুবি কাটল না। টাকার হিসাব মেলাবে কী করে, এই চিন্তাটি বেশ কিছুদিন ধরেই তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। হজ্বে যাবেন বলে নিজেকে আস্তে আস্তে দুনিয়াবি কাজ থেকে সরিয়ে নিতে থাকেন রহিম মিয়া। রমজানের আগ থেকেই সফিজ মিয়া প্রায় পূরা ব্যবসা দেখতে শুরু করে। বিপদ থেকে বাঁচার জন্য এ সময়ে ছোট্ট একটা কারবার করে বসল সে। অন্য লাইনের কয়েক জনের সাথে জানাশোনা ছিল। নিজের সংস্কার আর শ্বশুরের নীতির কারণে তাদের সাথে মিশতো না। এবার আর নিজেকে ঠেকাতে পারল না। ছোলা’র বাজার-মজুদের একটা বড় অংশ তারা কয়েকজন মিলে ‘সাইড’ করে ফেলল রোজার ঠিক আগে। ব্যবসা হয়ে গেল স্বপ্নের মত। শেয়ার বাজারে লসের কয়েকগুণ উঠে আসলো।
ওখানেই থেমে যেতে পারত সে। রক্তের স্বাদ পেলে শ্বাপদ দমে থাকতে পারে না। সফিজ মিয়াও পারল না। নষ্টচক্রের ছড়ানো জালে আটকে থাকল। এখন তিনটা গুদামে মশুর ডাল, দরজায় বিরাট তালা। এ সময়ে সেখানে থাকার কথা চাল, দরজা থাকবে খোলা। ধান-চাল বিকিকিনির মওসুম এটা। কৃষক নতুন ধান নিয়ে বাজারে ঘুরছে, ক্রেতা নেই। সফিজ মিযার দল নির্বিকার, বাজারে হাওয়া খেয়ে বেড়ায়। আরো একমাস মশুর ডালের বস্তাগুলো গুদামে ঘুমাবে। এর মাঝে কৃষকের নগদ অর্থের প্রয়োজন, ঋন পরিশোধের চাপ, অপরদিকে বাজারে ক্রেতার অভাব-এই তিনের ভারসাম্যে ধান/চালের মূল্য ঠেকবে তলানীতে। ‘মিয়া’রা সক্রিয় হবেন। আগুন মূল্যে ডাল বেরুবে, পানির মূল্যে নতুন চাল ঢুকবে গুদামে।
শ্বশুর ফিরে এসে ব্যবসার পুরো হিসাব বুঝে নিয়ে সম্পত্তির ফয়সালা করবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ব্যাপারগুলো ধরা পড়ে গেলে কী হবে সে চিন্তা থেকে দারুনভাবে মুক্তি পেল সফিজ মিয়া। তবে সে এতটা পচে যায়নি এখনও। শ্বশুরের জানা ওসিয়তগুলো পুরো করল। ভায়রাকেও ঠকায় নি। সব নিয়তই মোটামুটি পালন করল।
নিরালায় বসলেই আজকাল ‘বাজান’ এসে ভর করে তার উপর। বাজান ছিলেন জাত কৃষক। কোন কামলা না নিয়ে নিজেই লাঙল চালাতেন। সারাটি জীবন সঠিক পথে হাল ধরেছেন। আজ কলের লাঙল হলেও লাইনটা ঠিক রাখতে হয়, তা না হলে পুরো জমির উর্বরাশক্তির সুষম বন্টন হবে না। রোয়ার সময় লাইন সোজা না রাখলে ঠিকমত চারা বাড়বে না। ফলন ভাল হবে না। কৃষকরা উচিত পথেই আছে। ফসল মাড়িয়ে সময়মত বিকিকিনির হাটে নিযে আসছে। কোনক্রমে খরচটা উঠিয়ে খুশি মনে ফিরতে চায় ঘরে। অথচ তা হয়ে ওঠে না ‘মিয়া’দের ভেল্কিবাজী বেলাইনের খেলাতে।
‘মিয়া’দের দলে সফিজ মিযা’র আজকাল হাঁসফাঁস লাগে। দেশপ্রেমবোধ আর জংধরা মননে টান পড়ে। নষ্ট চিন্তায় বিবেক হয়ে ‘চিরন্তন কৃষক’ প্রতিনিধি হিসেবে বাপজান এসে হানা দেয়। ফিরতে ইচ্ছে করে সফিজ মিয়ার। বাজানের ধরিয়ে দেয়া হাল’টা আবারও হাতে নিতে ইচ্ছে করে। এখন আর একা বহন করার শক্তি নেই তার। কামাই কীভাবে করতে হয় সেটিরই চর্চা ছিল এতদিন, তাছাড়া সব ভুলেছে। ‘মিয়া’ ভাইদের ঘাড় ধরে কৃষকের মাঠে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে হয়, ‘আয়, একবেলা জমি চাষ দেই।’ কৃষক ভাইদের বলবে, ‘তোমরা জিরাও একদিন।’
ভাবতে ভাবতে বাস্তবে ফেরে। সে নিজেই এবার আল্লাহর ঘরে যাচ্ছে। ইহরাম বেঁধে ঘর থেকে বের হবে। খুব একটা সময় হাতে নেই। ছেলেকে কাছে ডাকে। দাদার গল্প শোনায়। নানার সম্বন্ধে তেমন কিছু বলার নেই, অনেকটাই দেখেছে নতুন কর্ণধার ছেলে। তারপরও সময় নিয়ে সবটা তুলে ধরে। অকপটে বলে দেয় নিজের উত্থান কাহিনী, চলমান কায়-কারবার।
বিদায় নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় ছেলের দিকে তাকায়। বুঝতে চেষ্টা করে, ছেলে কী তার ফেরার অপেক্ষায় থাকবে? নাকী দোয়া করছে তার বাবার হজ্ব কবুলের সাথে সাথে তারেও যেন আল্লাহ কবুল করে নেন!
চলার পথে চারিদিক দেখতে দেখতে যায়। অনিয়মগুলো আগে স্বাভাবিক মনে হত। নষ্টচক্রে ছিল সে, নিজেই অনিয়মের রাজ্য বানিয়েছিল। আজ সবকিছুই উল্টো লাগছে তার। এত উল্টোর মাঝে ছেলে তার পারবে কীভাবে এই দুশ্চিন্তাটি নিয়ে আল্লাহর পথে রওনা দেন।
সমস্ত ইচ্ছাশক্তি এক করে বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে সফিজ মিয়া ছেলেকে বলে যান, ‘বাবা হালটা ঠিক পথে চালাস।’
০২ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪