মহৎ পিতা

ব্যথা (জানুয়ারী ২০১৫)

এনামুল হক টগর
  • ৩৮
পৃথিবী শুধু ভালোবাসার কথা শুনতে চায়। প্রেম আর বিরহকে স্মৃতি করে রাখতে চায়। তারপরও পৃথিবী বার বার প্রশ্ন করে। জ্ঞানের জিজ্ঞাসায় হেঁটে যায় নিজেকে চেনা আর জানার জন্য, উত্তরসূরীদের কষ্টকে লাঘব করার জন্য।
পিতা একটি মহৎ শব্দ। যার ভেতর একটি শিশুর জীবন যৌবন আর জ্ঞান আবর্তিত হয়। তার অ¯ি—ত্বের ভেতর থেকে মহৎ গুনাবলী জেগে ওঠে।
মানুষ তার পিতার কাছে সব সময় ঋণী থাকে। আমিও আমার পিতার সভ্যতা আর মহত্বের কাছে ঋণী, পিতার স্বপ্নের ভেতর সন্তানের কল্যাণ বসবাস করে।
বহুদিন আগের কথা, তখন আমি দূরন্ত কিশোর। নুতন দিন আর চেতনার স্বপ্ন আমার সামনে এসে দাঁড়াতে শুরু করছে। প্রতিদিনের উত্তপ্ত সূর্য আমাকে আলো দিচ্ছে যেন শরীর থেকে আঁধার ভেঙে যৌবন উঁকি দেবে।
বাবা অফিসে যাওয়ার আগে আমাকে বললো আজকে বেতন পেলে বাড়িতে কাঁঠাল কিনে আনবো। তুমি বিকেলে নতুন ব্রীজের মাথায় অপেক্ষা করো। আমি অফিস শেষ করে কাঁঠাল ক্রয়ের জন্য ব্রীজের মাথায় আসবো।
বাবার কথায় আমি দুপুর থেকে ব্রীজের মাথায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা আসবে কাঁঠাল কিনে বাড়িতে নিয়ে আসবো, ভাই বোন সবাই মিলে মজা করে কাঁঠাল খাবো। দুপুর থেকে অনেক মানুষ কাঁঠাল কিনে তার বাড়ির স্বজনদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে।
আমাকে দেখে আমার এক বন্ধু হেদায়েত এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। হেদায়েতও বহুদিন কাঁঠাল খায়নি, কাঁঠাল খাওয়ার প্রতি তারও খুব ইচ্ছে। আমি বললাম বাবা আসলে বড় দেখে একটা কাঁঠাল ক্রয় করবো তুই আমার সাথে বাড়িতে গিয়ে পেটভরে কাঁঠাল খাবে। হেদায়েতের মনে এক রঙের আনন্দ, আজ সে পেটভরে কাঁঠাল খাবে। মনে হচেছ অনেক বছর হেদায়েত কাঁঠাল খায়নি।
ক্ষুধা আর দীর্ঘ পিপাসায় জীবন যেন হেদায়েতের মনকে গভীর চেতনা দিচ্ছে। নিঃশব্দ ব্যথায় শরীর ছুঁয়ে স্বপ্ন যেন জীবনকে ডাকছে। হেদায়েত বুঝেনা যে জীবনের ভেতরই মৃত্যু লুকিয়ে থাকে। শুধু মানবিক ভালোবাসা পৃথিবীতে বেঁচে থাকে।
জীবন স্বপ্ন দেখে সংসার বাঁধে এক সময় মৃত্যু তার বন্ধু হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। ইশারায় তাকে ডাকে, তারপর একসাথে চলে যায়। আমার আরো দুইজন বন্ধু তাদের বাবাসহ কাঁঠাল কিনতে এসেছে। বাবাও অফিস থেকে এসে গেছে, আমি আর হেদায়েত বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবার মনটা বেদনায় ক্লান্ত, মলিন হয়ে আছে। আমার বন্ধুরা সবাই কাঁঠাল কিনে নিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলাম বাবা কাঁঠাল ক্রয় করবেনা, বাবা একটু করুনার চোখে তাকালো, মনে হলো তার দেহের ভেতর এক দুঃখের নদী বেদনার গান গাইছে। কোন নকল ফুলের গন্ধহীন ঘ্রাণ বাবার মনকে ক্ষত-বিক্ষত করছে। ক্ষুধা আর ইচ্ছে যেন এক দুখীনি মায়ের কান্নার মতো কিছুই বুঝে না।
মমতার বিশ্বাসী প্রার্থনা যেন বহু বছর ধরে ক্লান্ত, বাবা বললো বেতন হয়নি। আমি জানি আমাদের কোন গচ্ছিত সঞ্চয় নেই, বাবার বেতন ছাড়া কিভাবে কাঁঠাল কিনবো হেদায়েত তার নিজ বাড়িতে ফিরে গেলো।
আমি বাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে আসলাম। বাবা বললো বেতন পেলে বড় কাঁঠাল কিনে দেবো। কয়দিন পর বাবা ঠিকই বেতন পেয়েছে কিন্তু কাঁঠাল কিনা হয়নি। কারণ বেতনের চেয়ে দোকানে বাঁকির পরিমান বেশী ছিল। দোকানদারের কথার কারণে মা বেতনের সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে বাঁকি পরিশোধ করে দেয়।
তারপর বহুদিন হেদায়েতের সাথে দেখা হয়েছে। হেদায়েতের ভাগ্যে কাঁঠাল জোটেছে কিনা জানিনা।
স্বাধীনতার পরে বড় বোন বাবাকে একটি রেডিও কিনার কথা বললো। দুর্বার ছিল আমাদের প্রিয় অনুষ্ঠান। তখন সন্ধ্যা ৭.৩০ মি: রেডিওতে দূর্বার অনুষ্ঠান হতো। আমাদের বাড়ির পাশে অনেক প্রতিবেশীদেরই রেডিও ছিল কিন্তু আমাদের রেডিও কিনার টাকা না থাকায় আমরা দূর থেকে গান শুনতাম। বাবা রেডিও কিনে দেওয়ার কথা বলেছিল কিন্তু অর্থের অভাবে কিনে দিতে পারিনি।
আমি এখন মাঝ বয়সী মানুষ। সেই ব্রীজের রাস্তা দিয়ে এখনো হেঁটে যাই। বর্ষার ঋতুতে সেখানে এখনো কাঁঠালের বাজার বসে। আমি ওই রাস্তা দিয়ে যাই আর চেয়ে চেয়ে দেখি কাঁঠালের বাজার কাঁঠাল ক্রয়ের জন্য কোন অসহায় কিশোর বাবার জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। কোন না কোন অনাহারী কিশোরতো অবশ্যই চেয়ে থাকে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পাড়লে হয়তো কোন এক দিন একটি অনাহারী কিশোরকে একটি কাঁঠাল কিনে দিতাম।
সময়ের সাথে সাথে জীবন যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য হেঁটে যাচ্ছে। মুক্তির অনুভূতিতে অপ্রস্ফুটিত জয়-পরাজয়গুলো খেলা করছে। গভীর অবরুদ্ধ প্রেমের আহবানে। অন্বেষন আর ভালোবাসা দ্বারা তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। কর্মময় শ্রমজীবী মানুষের স্রোতে।
আমরা আট ভাই দুই বোন, অরুণ নামের মহৎ ভাইটি শিশুকাল থেকেই বেহেস্তের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, হয়তোবা আমাদের জন্য রাহমানের দরবারে সুপারিশ করবে। আমরা সাত ভাই দুই বোন এখনো বেঁচে আছি। আগে-পিছে প্রতিদিন আল্লাহ আমাদের রিজিক পৌছে দেয়। বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রতিদিন প্রতিরাতে আমাদের খবর নিত যে আমরা সবাই খেয়েছি কিনা।
আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে কেউ না খেয়ে থাকলে বাবা মা আদর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেই এবং শেষ পর্যন্ত খাওয়াতেন। অনেক দিন পড়ে আমরা এখন সবাই বড় হয়েছি যার যার মতো সংসার হয়েছে। সবাই আলাদা আলাদা খাওয়া দাওয়া করে। সময়ের সাথে পরাজিত হয়ে কেউ সরারাত অনাহারে থাকলেও আমরা তার খোঁজ নেই না। এক সময় যে ভাই বোন না খেয়ে থাকলে আমাদের ঘুম হতো না কিন্তু আজ তারা কেমন থাকে কেউ তার খোঁজ খবর নেই না।
অবশেষে বড়বোন প্রতিদিন মেজভাইকে দিয়ে গাছের জাম বিক্রি করে ১৬০ টাকা দিয়ে একটা চায়না রেডিও কিনা হলো। আর সেই থেকে আমাদের বাড়িতে একটি রেডিও হলো। সেই রেডিও দিয়ে আমরা প্রতিদিন গান শুনতাম।
আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে পাখিরা উড়ে যেত, মর্মভেদ চেতনার নিগুঢ় থেকে আল্লাহ আমাদেরকে আলো দিত আর সভ্যতার আগামীকে চেনার জন্য যেন জ্যোতির্ময় নূরে প্রতিফলনে বিরহের প্রেম ব্যকুল করে তুলতো।
একদিন দুপুর বেলায় পাশের বাড়িতে গিয়ে দাঁড়ালাম দেখলাম ওদের বাড়িতে অনেকগুলো ডিম রান্না করছে। বাড়ির প্রতিটি সদস্যের জন্য হয়তো একটা করে। আমার ডিম খাওয়ার খুব ইচ্ছে হলো। বাবা অফিস থেকে ফেরার পর বললাম ডিম খেতে ইচ্ছে করছে বাবা কললো কিনে দেবো। কয়েক দিন পর মায়ের হাতে দুইটি ডিম দেখলাম। মা বললো তোদের সবার জন্য ডিম দুইটি রান্না করবো। মা অনেকগুলো আলুর সাথে দুটি ডিম রান্না করলো এবং খন্ড খন্ড করে আমাদের সবার থালায় দিল আমরা বাবা মায়ের স্নেহ আর মমতাকে ভালোবেসে খুব তৃপ্তির সাথে ওই রান্না করা ডিম দিয়ে খাওয়া দাওয়া করলাম।
মাঝে মাঝে মা আমাকে রান্নার জন্যে সরিষার তৈল আনতে দোকানে পাঠাতো। আমি একটি ছোট বোতল নিয়ে দোকানে যেতাম এবং খুব অল্প পয়সার তেল নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। অল্প বলতে তেলটুকু বোতলের তলাতেই পড়ে থাকতো।
আমি যখন রাস্তা দিয়ে আসতাম তখন কিছু কিছু মানুষ আমার হাতের বোতলের দিকে তাকাতো আর মিটমিট করে হাসতো। বহু বছর পরে সে সব মানুষগুলো দরিদ্র হয়ে গেছে। বুঝিনা কি জন্য তারা দরিদ্র হয়েছে।
মহান আল্লাহ তার অফুরন্ত নিয়ামত থেকে তাদের জন্য করুনা দান করুক এবং তাদেরকে ক্ষমা করুক যেন আগে পিছে তারা রিজিক পেতে থাকে।
বাবা অল্প টাকা বেতন পেতো তাই অল্পতে আমাদের সন্তুষ্ট আর ভাগ্যকে মেনে নিতে হতো। তারপরও বাবা ছিল আমাদের আদর্শের এক মহৎ আগামী। স্বর্গের ক্ষমতায় ঘেরা এক আলোকিত সত্তা। হাজার জীবনের রঙ থেকে বাবা যেন আলাদা এক পরমাতœার ছাঁয়ার নিচে মুক্ত জাগরণ।
জাতির প্রত্যাশার ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে আছে অনাগত সকালের দৃপ্ত বার্তা। চেতনার আলো থেকে নতুন ফসল ফলে চিরজাগ্রত শক্তির মূল উৎসকে আতœতাত্তি¡ক আতœবিশোধন জ্ঞানে জাতিকে অপরিসীম প্রজ্ঞা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বলছে বাবা আর জীবনের ভেতরই জীবনকে রক্ষার আলো প্রজ্বলিত করার কথা বলেছে। বাবার অঙ্কুরিত স্বপ্নের সম্ভাবনাগুলো উত্তরসূরীদের ভেতর বিস্তার লাভ করছে। বাবা দেশকে গভীর ভাবে ভালবাসতেন। স্বাধীনতার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার কাজ করেছেন। ১৩ বছর বয়সে বড় ভাইকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছিলেন। বাবা তার অন্ত:করণ দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তা এবং তার রবকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন ও আল্লাহর প্রিয় প্রতিনিধি রাসুল (স:) কে ভালোবাসতেন। সালাত কায়েম ও শরিয়ত মেনে চলার পথ অনুসরণ করতেন। আমাদের প্রিয় আদর্শের মাতাকে সম্মান ও মর্যাদা দিতেন। সন্তানদেরকে অধিক ভালোবাসতেন। ঠিক সমপরিমান ভালোবাসতেন স্বজন প্রতিবেশী ও দেশের মানুষকে। বাবার মহত্ব যেন মানুষকে মহৎ করে তোলে। বাবার মেধা ও সততাকে অন্বেষণ করে দেশ যেন এগিয়ে যায়। আর ভাগ্যহীন অসহায় মানুষগুলো যেন কর্ম দিয়ে সম্মান অর্জন করতে পারে আর পৃথিবীর বুকে উঁচু হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবেই বাবার স্নেহ ভালোবাসা ও মহৎ দেশ প্রেমের স্বপ্ন সার্থক হবে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাইদুল আলম সিদ্দিকী কিচ্ছু বলার নেই; শুভকামনা...।
ভালো লাগেনি ২৫ জানুয়ারী, ২০১৫
জাতিস্মর ভাই আপনি অনেক অনেক অনেক চমৎকার লেখেন। আপনার পরবর্তী জীবনে সেই কাঁঠাল বাজারের দৃশ্য আমার অন্তর ভিজিয়েছে। হৃদয় দিয়ে লেখা আমি সেখানেই রাখলাম। আপনি আরো লেখেন। শুভ কামনা। আমারো একটা ছোট্ট গল্প আর একটা ছোট্ট কবিতা আছে। সময় পেলে পড়ে দেখবেন।

২১ অক্টোবর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৯৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪