ময়নার গন্তব্য

আমি (নভেম্বর ২০১৩)

এনামুল হক টগর
  • 0
গ্রীষ্মের সকাল। তীক্ষ্ণ রোদ্দুর। জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো সূর্যটা জ্বলছে। খন্ড কালো মেঘ আকাশে উড়ে যাচ্ছে। ক্ষত-বিক্ষত আঘাতে হয়তো বৃষ্টি ঝড়বে পরস্পর গর্জনের ধ্বনি দিয়ে। মনে হয় ঘুমিয়ে আছে আহত ক্ষুধাতুর দেবতা।
ইছামতির পাশে অনাহারী শ্রমিক দুষিত বিষ-বাষ্পে শ্বাস নিচ্ছে। বিখ্যাত এই নদীর কান্না থেকে ভেসে আসে জীবনের দিনলিপি, আসন্ন মুক্তির বার্তা। তা পৃথিবীর ঘরে ঘরে পৌছে দিতে হবে। মানবিক সংগ্রাম আর আত্মপ্রেমের বিশাল বিপ­বে ময়না কাচারিপাড়া-র কদমতলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

পথের একপাশে শিক্ষিকা সাবিরা বাড়ি। তার সাথে প্রায়ই স্কুলের যাতায়াতের পথে ময়নার দেখা হয়, তখন তার সাথে কিঞ্চিত সুখ-দুঃখের কথা হয়। যুগের ইতিহাস বুকে নিয়ে আত্ম-মর্যদার লড়াইয়ে ময়না নগর আর গ্রামের রাস্তায় রাস্তয় হেঁটে যাচ্ছে।

গত কয়েক মাস আগে তার প্রথম স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট সংসার। বাবা ছিল উন্মাদ। মা ভিক্ষা করে জীবন যাপন করতো।

ভিক্ষা করা অনেক টাকা জমানো ছিল ময়নার মায়ের। তার মৃত্যুর পর সেই অর্থের মালিক হয় ময়না। সে বর্তমানে ওই টাকায় কাপড়ের ব্যবসা করে। অবশ্য কোনো দোকানপাট নিয়ে নয় বরং নগর, বাজার আর মানুষের বাড়ি-বাড়ি কাপড় বিক্রয় করে। কাপড় বিক্রয়ের আয় দিয়ে সংসার চলার পর কিছু সঞ্চয় জমা করে যা দিয়ে সে ভবিষ্যৎ গড়বে।

গত সপ্তাহে সে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে। জামাইকে নগদ কিছ টাকা যৌতুক দিয়েছে। জামাই ব্যবসা করে।

দিন যায় রাত যায় ময়না ছুটতে থাকে। যৌবনের অচিন বেদনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কালো রাত্রির বুকে চাঁদ ওঠে। বাইরে আওলা হাওয়া। অলীক ¯^প্নরা বুকের গভীরে যৌবনের দাউ দাউ পিপাসা পৃথিবীর বুকে গিয়ে বিঁধে। মাটির বুকে ক্ষয়ে যাওয়া দগ্ধ চেতনায়।

অনেক পথ অসংখ্য মানুষ ছোট ছোট গ্রাম, যুদ্ধে জ্বলে পুড়ে যাওয়া ব্রীজ, হারানো ¯^জন রক্তাক্ত বেদনা ভরা স্মৃতিগুলো ময়নার বুকের ভেতর কাঁদে। রা¯—ায় অনাহারী উপোস মানুষগুলো হেঁটে যাচ্ছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। লুন্ঠিত বিধ্ব¯— গ্রামগুলো এখনো জেগে আছে নতুন সভ্যতার আশায়।

গতকাল রিকশাচালক রতনের সাথে ময়নার প্রথম পরিচয়। তার রিকশায় চড়ে সে কয়েক বাড়িতে কাপড় বিক্রয় করে। কাপড় বিক্রয় শেষে রতনের রিকশাতে ময়না নিজ বাড়িতে ফিরে যায়।

ভাড়া দিয়ে রতনকে সে সন্তুষ্ট করে। রতন বেশী ভাড়া পেয়ে মনে মনে খুশি হয়, বলে আগামী কাল আবার এসে তোমাকে তোমার ব্যবসার কাজে নিয়ে যাবো।

মনে মনে ময়না রতনকে পছন্দ করে। তর“ণ যৌবনভরা এক যুবক রতন। কঠিন মাটির রা¯—া দিয়ে সে রিকশা চালিয়ে যায়। অনেক তর“ণ আর বৃদ্ধকে পেছনে ফেলে।

রতনের বুকের ভেতর অভাব আর ক্ষুধা কাঁদে। শরীরের চামড়া ছিঁড়ে ছিঁড়ে রক্ত ঝড়ে। শান্ত হাওয়া প্রিয়তমা জীবনের আশায়। জীবনের চূড়ান্ত সংগ্রামে রতন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। পথে পথে কঠিন সময় জীবনের ধ্বনি।

ময়না তাকে একটি রিক্শা কিনে দিতে চায় বিনিময়ে তাকে বিয়ে করতে হবে। নিষ্ঠুর নির্মম প্রতিরোধ রতনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ¯^নির্ভর দিক নির্দেশনার এক বা¯—ব জীবন তার মুখোমুখি। নিজের একটি রিক্শা থাকলে হয়তো রতন নির্ভরশীল হয়ে দাঁড়াবে।

জীবনের আশায় জীবনের ভালোবাসায় রতন কয়েক দিনের মধ্যে ময়নাকে বিবাহ করে। চলতে থাকে দুই জনের জীবন সংসার। তুলনাহীন জীবন বয়ে চলে জীবনের পথে।

রতন সারাদিন কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে। জীবনের ¯^াদ গ্রহন করতে গভীর রাত পর্যন্ত ময়না জেগে থাকে। জানালার বাহিরে শাশ্বত সৃষ্টির খেলা খেলছে প্রকৃতি। অনন্তকাল ধরে চলছে এই খেলা।

সকালে উঠে রতন রিক্শা নিয়ে শহরের দিকে ছুটে যায়। বিচিত্র রঙের কার“কার্য আলোময় সকালের পথ ধরে। পৃথিবীর সব দুঃখ আর বেদনা বুকে নিয়ে। ইছামতির বুক দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ছুটে যাচ্ছে দীর্ঘ পথের সন্ধানে।

দিন শেষ সন্ধ্যা নামে আ¯ে— আ¯ে— গভীর রাত হয়। রতন আর ফিরে আসে না। ময়নার কঠিন বুকের পাঁজরে কষ্টগুলো জমা হতে থাকে। অজানা ভালোবাসার বিস্ময় বোধন। গ্রামে এখন ছিমছাম রাত্রি। শ্বাশত শ্যামল প্রান্তর দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। আলোগুলো আঁধার ভেদ করে জ্বলছে।

ময়নার মনে সাহস বাড়ে। আগামী সকালের পথ ধরে সে আবার শাড়ি নিয়ে শহর ও গ্রামের দিকে হাঁটে। ময়না জানে ভালোবাসা চিরকাল বেঁচে থাকে। কখনো জেগে উঠে কখনো মরে যায়। তারই মাঝে মানুষ তৃষাতুর ধৈর্যধারণ করে বেঁচে থাকে।

স্নেহময় এক দীর্ঘ জীবন আর দীর্ঘ মরণকে সাথে নিয়ে। এই সুন্দর পৃথিবী আর তুলনাহীন ঈশ্বরের দর্শণ দেখে পরম প্রেমের আশায় ¯—ব্ধ দিনের আলো। রোদে পুড়ে কালো চশমা স্মিত হাসি দেয়।

মুক্তির বিপ­বী দিনগুলো গুনে। অজানা পাড়ি দিয়ে সঠিক গন্তব্যে হেঁটে যেত হবে মানুষ গুলোকে। দিন যায় রাত যায় ময়নার ব্যবসা চলতে থাকে। একদিন শাড়ি নিয়ে ঈশ্বরদী থেকে ফেরার পথে ড্রাইভার সামছুলের সাথে পরিচয় হয়।

সামছুল দেখতে খুব সুন্দর। সামছুলের নিজ¯^ সংসার আছে। বাড়িতে স্ত্রী সন্তান আছে। তবুও ময়নার দিকে তার দৃষ্টি। অল্পদিনের পরিচয়ে সামছুলের সাথে ময়নার বিয়ে হয়। সামছুল আর ময়নার ঘর সংসার চলতে থাকে।

জীবনের মাঝামাঝি দিনগুলো প্রতিকুল পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে তারা চলতে থাকে। অন্ধকারের বুকে ক্ষীণ আলো ছড়ায় সামছুল। দুর্বল চেতনায় ময়নার পাঁজরের ছোট ছোট হাড় গুলো জেগে উঠেছে। বুকের খাঁচায় প্রতিটি শ্বাস আন্দোলিত হচ্ছে।

যেখানে ¯^প্নগুলো জেগে থাকে পবিত্র ফুলের মতো। পৃথিবীর বুকে শান্ত নিবিড় স্নেহময় বাতাস বইছে। প্রেমিক-প্রেমিকা দীর্ঘ প্রেমে মাধুরী জ্বেলে হেঁটে যাচ্ছে।

নগরের রা¯—ায় পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। আ¯ে— আ¯ে— জগত বদলে যাচ্ছে ময়নার চোখের সামনে। বিপ­বের আগুন জালিয়ে কেউ কেউ বেঁচে আছে আর কেউ কেউ সুন্দর সমাজ গড়ে মরে গেছে।

স্ত্রী-সন্তানের চাপে কিছু দিনের মধ্যে সামছুল ময়নাকে ত্যাগ করে নিজ সংসারে চলে যায়। আবার ময়না একা হয়ে যায়। সুপ্ত জীবনের অতল গহŸর যৌবন খেলা করে। ময়না একা জেগে থাকে এক উত্তপ্ত ক্ষুধার্ত রাতে। যেখানে প্রাণ কাঁদে নিদার“ণ হাহাকারে। জীবনের সমারোহ আড়ম্বর মহা সময়ে। যারা আঁকড়ে ধরে আছে জীবন।

দেবতার দূর্গ আর আঁধার রাতের মাঝপথ ধরে সুন্দরী রক্ষিতা আর নগরের ফেরিওলা হেঁটে যাচ্ছে। চাঁদের জোছনার ভালোবাসার প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে। ¯^প্ন বীজের মুকুল বিকাশ চেতনায়। জানালার বুক ভেদ করে ময়না দূর দিগšে— তাকায় বিক্ষোভ-আবেগে।

অন্ধকার রাতে বিধ্ব¯— প্রকৃতি অর্ধদগ্ধ ক্ষত চিহ্ন আহত বুকে জেগে আছে। বাতাসে নীল অস্ফুট তৃষিত ধ্বনি। সবুজ জনপদের চারি পাশে বিপুল অরণ্য। ময়নার নিঃসঙ্গঁ চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা অশ্র“ ঝরে।

অতন্দ্র রাত্রির বিষাদ প্রতিক্ষায়। অসমাহিত দূর আকাশ ময়নাকে হাত তুলে ডাকে। সাম্রাজ্যবাদের ধবংস-স্তুপ ভাঙ্গাচোরা ইতিহাস পেরিয়ে।

স্মৃতির মাঝে কেঁদে ওঠে অতিবিষন্ন দুঃ¯^প্ন। বিষাক্ত আর্তনাদ আর পতঙ্গঁ সর্বনাশে। ভয়ংকর রাত্রির অন্ধকার ব্যবচ্ছেদে ময়নার জীবন-যৌবন জ্বলছে উত্তপ্ত বেদনায়।

পরের দিন সকালে ময়নার শরীরটা ভালো না। গ্রামের ডাক্তারের কাছ থেকে ঔষধ এনেছে। সামান্য জ্বরের মধ্য দিয়ে দিনটি অতিবাহিত হয়। রাতের বেলায় একটু সুস্থতা বোধ করে ময়না। ছেলে ইমরানকে বলে, তুমি ভালো করে লেখা পড়া করবে। বা¯—ব এক কঠিন সময়, এই সময়ের সাথে তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে।

মায়ের পরামর্শ ইমরান মাথা নত করে শোনে।
ঘুম থেকে উঠে ময়না গ্রামের স্কুলের শিক্ষিকা সাবিরার কাছে যায়। সন্তান কি ভাবে মানুষ করবে, তার পরামর্শ নিতে। সে বাড়ি থেকে রান্না করা কিছু খাবার নিয়ে গেছে শিক্ষিকার জন্য।

রান্না করা খাদ্যগুলো দুপুরে খাবে বলে শিক্ষিকা জানায়। সে সন্তান মানুষ হওয়ার ব্যাপারে আদর্শ নীতিগত কিছু পরামর্শ দেয় ময়নাকে।

শিক্ষিকার কাছ থেকে জেনে আসা পরামর্শগুলো ময়না তার সন্তানকে ধীরে ধীরে বলে।

শিক্ষিকা বলেছে, শিক্ষা হচ্ছে আঁধার পৃথিবীর মাঝে আলোকিত প্রাণ। আদর্শ মানুষ হিসেবে তোমার সন্তানকে গড়ে তুলো। সত্য পরায়ণ আর ন্যায় নিষ্ঠার মধ্যে তাকে হাঁটতে শেখাবে। সে যেন ভিক্ষুকের মতো রা¯—ায় হাত পেতে টাকা না সংগ্রহ করে।

পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করতে শেখাবে। হিংসা, বিদ্বেষ আর ব্যাভিচার থেকে সন্তানকে দূরে রাখবে। মহান সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে শেখাবে। দূর্নীতি অন্যায়কারী আর সন্ত্রাসীর প্রতি কঠোর হতে শেখাবে। জীবনের গভীরের সত্যটা যেন সে চিনতে পারে। অনেক দুঃখ কষ্টের মাঝে সে যেন ধৈর্য ধারন করতে শেখে।

যারা কোন কারণ ছাড়া মানুষের প্রতি কঠিন, নির্দয়, নির্মম হয় তাদেরকে ঘৃণা করতে শেখাবে। অতিরিক্ত বিশ্রাম আর বিলাসের ব্যাপারে তাকে সর্তক করে দেবে।

শিক্ষিকা আরো বলে, মানুষের দেহ হলো মাটি আর তার ভেতরের আত্মা হলো বীজ। মাটির ভেতরে বীজ আলো ছড়ায়। তা দ্বারা বিশ্ব আলোকিত হয় এবং জীবনের গভীরে ডালপালা ছড়ায়, সবুজ পাতার বুকে মুকুল আসে, সবুজ ছড়ায় এক সময় ফলে পরিণত হয়ে, ধীরে ধীরে পূনাঙ্গ জীবন গঠন করে।

ভাবনার দৃশ্যমান মনোজ্ঞ অনুভূতিতে সৃষ্টির নতুন দুয়ার খুলে যায়। যা মানুষের ভেতরে রয়েছে একটি অপরটি সাধনা দ্বারা জাগরণ করতে হয়। তা দিয়ে মধুর সৌরভ ছড়ায় এবং সত্যিকার পথের সন্ধান পাওয়া যায়।

মায়ের মুখে শিক্ষিকার কথাগুলো শুনে সন্তান আগামীর পথে হাঁটতে থাকে।
দিনের আলো প্রখর হচ্ছে। জগতের সব জীব, জড় ব¯— জেগে আছে। নিপীড়ণের নিগড় থেকে মুক্তির চেতনায়। জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনকে প্রশ্ন করে বিচিত্র নিয়মে।

আ¯ে— আ¯ে— সূর্য পশ্চিম আকাশের দিকে হেলে যায়। পাশের গ্রামের যুবক জামাল এসেছে মৌচাক থেকে মধু ভাঙ্গতে। ময়নার আম গাছে মৌমাছি চাক বেঁধেছে।

চাকে পরিপূর্ণ মধু রয়েছে। জামাল ময়নাকে বলে, চাক থেকে মধু সংগ্রহ করে যা আসবে, তা তোমার অর্ধেক আর আমার অর্ধেক, রাজী?

চাকের অর্ধেক মধু পাওয়ার আশায় ময়না মৌচাক ভাঙ্গার অনুমতি দেয়।
জামাল বয়সে যুবক। অঢেল যৌবনের চেতনা তার। ময়নার বুকের মাঝে উঁকি দেয়। গোধুলী শেষে সন্ধ্যা আসে, আ¯ে— আ¯ে— রাত গভীর হয়, ঐ আকাশে চাঁদ হাসে।

বিস্মিত রাতে জোছনা ছড়ায় ভালোবাসার রূপ। ময়না জেগে থাকে তন্ময় অনুভূতিতে, অসুন্দর ভয়ংকর ধ্বংসের মতো। রাত্রির আলো হরণকারী যৌবনের গান নির্র্বিকার শোকে জ্বলে ওঠে।

বুকের গভীরের প্রেমগুলো নীলাকাশে ভেসে যায়। বিচিত্র বর্ণের সহস্র প্রেমিকের সমাধির পাশে বিমলিন আকাশের রূপ, শুধু সূর্যের আলোতে লুকায় ওরা অন্তর্হিত। অতৃপ্ত রাত্রির অঢেল বেদনা-বিষাদে জেগে আছে ময়না।

এক সময় বি¯ি^ত রাত্রির গোপন রহস্য ¯^প্ন বুকে নিয়ে ময়না ঘুমিয়ে পড়ে। ¯^প্নের ভেতর সে দেখে, সুন্দর রূপালী চাঁদ উতলা নদীর বুকে হাসছে। তীরে চন্দন বৃক্ষের শাখায় শুভ্র-শ্বেত পুষ্প ফুটে আছে। দিগন্ত পথ
বি¯—ীর্ণ সবুজ, মায়াময় ধবনি আর উড়ন্ত পাখিদের গানে।

জীবনের অংকুরিত আগামী কলেবর জাগরণ ময়নার বুকে এসে বিঁধে। হাসনাহেনা, গোলাপ, চামেলী, বকুলের গন্ধ আওলা বাতাসে ভেসে আসে যৌবনের ধ্বনি প্রতিধ্বনি দিয়ে।

বৃক্ষের সবুজে ভূমিষ্ট হয়েছে কত জীবন। বৃক্ষের উত্তাপে ঝড়ে পড়েছে কত মরণ।

¯^প্নের অজস্র সমৃদ্ধির পথে হেটে আসছে জামাল। হঠাৎ সকালে ময়নার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বেড থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বাড়ির পাশে গাছগুলো দেখতে যায়। এক বিস্ময় ব্যাপার জামাল ভোরের পথ ধরে মৌচাকের সন্ধানে ময়নার বাগানে এসেছে।

আগের দিন মৌচাক ভাঙ্গার সময় ময়নার দৃষ্টি চাহনি জামালের হ্নদয় ছুঁয়ে যায়। ময়না গভীর ভাবে জামালকে দেখে। জীবনের পরিপূর্ণ ক্ষুধা তার মনে গভীরে জেগে ওঠে। সোনালী সকাল ঘুমহীন রাতের সাথে বন্ধুত্ব গড়েছে।

এ-ভাবে ¯^প­-পরিচয়ের মধ্য দিয়ে দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সুখের সংসার করতে থাকে দুজন। বিকেলে জামাল আর ময়নার ছেলে এক সাথে ঘুরে বেড়ায়। বয়সে দুইজন তর“ণ।

এখন গাছে তেমন ফুল না থাকায় মৌচাক খুব কম: তাই জামালের হাতের অবস্থা ভালো না। ময়না শাড়ি বিক্রয়ের লাভ থেকে প্রায় প্রতিদিন জামালকে কিছু হাত খরচ দেয়।

সূর্যের শান্ত আলো সুদূরে পাখা মেলেছে। ক্লান্ত সন্ধ্যার কিছু পর কাপড় বিক্রয় করে ময়না ঘরে ফিরেছে। আজ শহর ও গ্রামে তেমন কাপড় বিক্রয় হয় নাই। ময়নার হাতে অল্প টাকা, সে জন্য জামালকে সে আজ টাকা দিতে পারেনি।

অভিমানে জামাল মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। ময়না আজ টাকা না দেওয়ায় মন খারাপ তার। টাকাই যেন জামালের ভালবাসা। টাকা ছাড়া সে কিছু বুঝে না । সকালে ঘুম থেকে উঠে সে মৌচাক ভাঙ্গাঁর কথা বলে বেরিয়ে যায়।

দিন যায়, রাত যায় এভাবে বহুদিন, বহুরাত কেটে যায় জামাল আর ফিরে আসেনা। তার অপেক্ষায় দিন শেষ করে ময়না আবার নতুন সংসার করে, আলাউদ্দিনের সাথে একই নিয়মে।

আলাউদ্দিন চলে গেলে সংসার গড়ে আবুলের সাথে। কিছু দিন পর আবুলও চলে যায়।

এছাড়াও সে সংসার করেছিল আজাদ ও সামাদের সাথে। অল্প দিনের ব্যবধানে তার ¯^ামীরা এভাবে তাকে ত্যাগ করে চলে গেলে, তার প্রথম ¯^ামীর স্মৃতিগুলো জীবনের গভীরে বেদনায় ভেসে ওঠে। সে ছিল তার সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতীক।

আজ সকালে ময়নার মেয়ে এসেছে। মায়ের জন্য শ্বশুর বাড়িতে নানা কথা শুনতে হয় তাকে। মেয়ে দুইদিন থাকার পর শ্বশুর বাড়িতে চলে যায়। ছেলের জন্য একটি ভালো খাট তৈরী করা ময়নার বহুদিনের ইচ্ছে।

কাঠের গাছগুলো বড় হয়েছে। ইচ্ছা করলে এখন গাছ কেটে খাট নির্মাণ করা যায়। একদিন সকাল বেলা কাঠ মিস্ত্রি জাহিদ ময়নার বাড়িতে আসে। বাড়ির বাগানে গিয়ে কাঠের গাছগুলো দেখে এবং বলে, এই গাছ গুলো কেটে খাট নির্মাণ করা যাবে।

ময়নার কথা মত কাঠ মিস্ত্রি জাহিদ খাটের কাজ আরম্ভ করে । মিস্ত্রির বাড়ি দূরে হওয়ার সে প্রতিদিন দুপরে খাবার দেয়। কয়েক দিনের মধ্যে তারা দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং এক পর্যায়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

জাহিদ ছিল খুব চতুর সব সময় ময়নাকে সন্তষ্ট করে চলতো। আ¯ে— আ¯ে— জাহিদের প্রতি ময়না দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার প্রতি বিশ্বাস আনে। জাহিদ বলে খাট নির্মাণ শেষে গাছগুলো বিক্রয় করে কাঠের ব্যবসা করলে অনেক টাকা উপার্জন হবে।

তা-দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে নির্ভরশীল হবো এবং ছেলে ইমরানের লেখা পড়া খরচ চালানো ভবিষ্যতের জন্য অসুবিধা হবে না।

জাহিদের কথা ময়না মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে এবং কাঠের গাছগুলো বিক্রয় করে সব টাকা তার হাতে তুলে দেয়। গাছ বিক্রয়ের টাকাগুলো নিয়ে জাহিদ গোপনে রাজধানী ঢাকা শহরে দিকে যাত্রা শুর“ করে।

ময়না অপেক্ষা করে প্রতিদিন অপেক্ষা করে। জাহিদ ফিরে আসবে, কিন্তু জাহিদ আর কোন দিন ফিরে আসেনি!

সময়ের সাথে চলতে চলতে ময়নাকে এখন বেশ বয়সী মনে হয়। ছেলে ইমরান বড় হয়েছে। এখন সে যে-কোন সমালোচনা মুলক কাজে মাকে নিষেধ করে।

ময়না আশায় থাকে, সত্যকারের সংসারের জন্য, সে পথ চেয়ে থাকে। পেছনে সবুজ অনুপম স্মৃতিগুলো কাঁদে, ক্লান্ত-জীবনের ইতিহাস নিয়ে। নির্বিকার পৃথিবীর বুক আর্তনাদে জ্বলছে: কোন অদৃশ্য গভীর প্রেমের রহস্যে।

কত রৌদ্র-তাপ-শিশির ভেঙে নতুন দীপ্ত সজিব সম্ভারের খোঁজে।
ভোরের নতুন আলোয় সূর্য হাসে। রা¯—ার পাশে বৃক্ষের ছায়ায় পথিক দাঁড়িয়ে থাকে। আশ্রয়ের ক্লান্ত পাখি যন্ত্রণা বুকে নিয়ে গেয়ে যায় মুক্তির গান।

ক্ষুধার্ত দিন শেষে রাত আসে: ময়না জেগে থাকে একা একা। গভীর নি¯—ব্ধ মুহূর্ত অনাহারী শিশুর কান্না, তৃষাতুর ক্লান্ত শরীর তার। দুর্বোধ্য, বেদনা আর তীব্র যন্ত্রণায় গভীর আহত করে বুকের ব্যথা।

নিঃসঙ্গতার নিবিড় স্পর্শে পৃথিবী ঘুমায় ক্ষুধা আর যন্ত্রনা ভ্রাতৃত্বের সাথে বন্ধুত্ব করে। শিশুটি পাশের বাড়ির জীর্ণ কুটিরে জেগে আছে। তার কান্নায় তৃষ্ণার্ত বাতাসে শোর তোলে ময়নার অস্পষ্ট চোখ। দগদগে যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত মৃত্যুর চিহ্ন উঁকি দেয় তার শরীরে।

আকর্ণ বি¯—ৃত লেলিহান শিখায় জীবন ও শরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে রক্তাক্ত লাল হয়। নিজের চেনা মুখ, আজ অচেনার মতো, জীবন ও মৃত্যুর অতল গভীরে ফিরে ফিরে এক হয়ে দাঁড়ায়; গভীর ভালোবাসার আলিঙ্গনে। তবুও জীবন বয়ে চলে আগামী চলমান গতিতে।

মাটির আসমানে ফুল ফোটে ¯^চ্ছ দর্পণের মতো। আকাশে নতুন চাঁদ অতীত দিনের পুরণো কথা মনে করে দেয়। রূপালী নদীর আঁকা বাঁকা স্রোতের মতো। ময়নার আনন্দ আর দুঃখের দুটি চোখ দিয়ে চেয়ে দেখেÑ চেনা অচেনা বহু দূরের পথ।

যেখানে অদৃশ্য আত্মগোপন করে আছে জীবনের রহস্য কৌশলগুলো: যার দেহের ভেতর বাঁচার অধিকার, যুদ্ধের ক্ষত নির্ভুল অভিব্যক্তি জীবন ও সময়ের মুখোমুখি দাঁড়ায়।

শতাব্দীর পুরাতন পথ আর নতুন নির্মাণ গুলোর সাথে সংগতি রেখে আগামী নতুন শতকের চিন্তা আর ¯^প্ন নিয়ে ময়না ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়ে নিঃশব্দ রাতের গভীরে।

¯^প্নের ভেতর অচেনা নগর বিষণœ দিন ভেসে আসে, পরিত্যক্ত রাজপথ মধ্য যুগের মতো মনে হয়। মানুষের ক্রন্দন ধ্বনি আর বন্য পশু শুয়োরের ডাক, ক্ষুধার ঘন্টা বাজে অনাহারীর বুকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক অনেক অনেক সুন্দর গল্প...ডিটেলস বুনন...খুব ভালো লাগলো....
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন মনে হচ্ছিল যেন বাস্তব! খুব ভাল লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল।
এফ, আই , জুয়েল # এদিক---ওদিক---সেদিক----,, চারিদিকের রঙ লাগিয়ে সুন্দর আবহ তৈরীর দারুন একটা লেখা । ধন্যবাদ ।।
মৌ রানী ভালো লাগলো।
কবি এবং হিমু জীবন যুদ্ধরত এক নারীর জীবনটা খুবই সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন,ভালই লাগলো।কিন্তু ময়নাকে অনেক বেশি বার বিবাহ বন্ধনে জড়ানোটা কিছুটা বেমানান মনে হল।
জাকিয়া জেসমিন যূথী অনেক বড় হলেও এক ময়নার জীবনের অনেক চড়াই উতড়াই মাখানো জীবনের এই রুপরেখা সমৃদ্ধ গল্পটা ভালো লাগলো।

২১ অক্টোবর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৯৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪