মায়ের মমতা

মা (জুন ২০১৪)

এনামুল হক টগর
  • 0
  • 0
  • ৫৪৭
আমি যখন সৃষ্টি জগতের শূন্যের মধ্যে ঘুরছিলাম পরম সত্তার নিগূঢ় রহস্য ভেদে। কোন এক সময় সূক্ষতত্ত্ব সৃষ্টি জগতের প্রবৃত্ত ধারণ করে বিসুখ বিমুক্ত পথে ভাসতে ভাসতে যার দেহে আমি বসবাস শুরু করলাম তিনি আমার মমতাময়ী মা।

তার দেহের রক্ত থেকে আমাকে খাদ্য দান করলো। আস্তে আস্তে তার দেহের ভিতর আমি বড় হতে থাকলাম এবং দেহ থেকে বের হয়ে এক সময় পৃথিবীর মুখ দেখলাম। আমি জানি তিনি আমার জীবনের সবচেয়ে মমতাময়ী দয়ালু মহাজগতের এক মহৎ আত্মা।

আমার ভেতরে যা জ্ঞান প্রজ্ঞা আদর্শ কল্যাণ সেবা নিয়োজিত আছে, তার জন্য আমি তার কাছে চির ঋণী। তিনি ছিলেন এক মমতাময়ী সুন্দর মনের মানুষ। তিনি ঈশ্বরকে ভালবাসতেন, ঈশ্বরের প্রতিনিধিকে ভালবাসতেন, ভালবাসতেন সমগ্র মানবজাতি, আর জীব-জড় উদ্ভিদকে। তেমনি তার প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসতেন সন্তানদেরকে।

মা আমার জীবনের সবচেয়ে বেশী প্রেরণা জুগিয়েছেন। তাই তিনি আমার আদর্শের প্রিয় বন্ধু, বাস্তব আত্মবিশ্বাসের এক নিগুঢ় পথ। আমার জীবনের যা কিছু সুন্দর যা কিছু উত্তম যা কিছু কল্যাণকর তা আমার মায়ের দান।

আমার বাবা ছিলেন ছোট চাকুরিজীবী, পাবনা শহরের ছোট পথ দিয়ে তিনি হাটতেন। মা ছোট বেলায় বই ভালোবাসতেন, তার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। মা ছিলেন দক্ষ ও আদর্শ রমণী। তিনি মানুষের দোষ-ত্রুটি তেমন ধরতেন না। আমরা ছোট বেলা কোথাও মার খেলে তিনি অপরকে কিছু না বলে আমাদেরকে শাসাতেন।

আমার মায়ের সবচেয়ে ভাল দিকটা হলো মানুষের ভাল ও কল্যাণকর দিকটা নিয়ে আলোচনা করা। একদিন আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে, আমি মায়ের সাথে ঘাসের উপর পাটি বিছিয়ে বসে আছি। মা বলল ঐ দেখ সুন্দর চাঁদ আকাশে ঝলমল করছে। যেন তার জন্মের সৌরভ ছড়াচ্ছে। অনন্ত আকাশ থেকে তার কথাগুলো ভেসে আসছে। তার স্বপ্নগুলো মানুষের মনে বিচিত্র রূপে খেলা করছে।

আমি মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে মাকে বললাম তুমি আমাকে গল্প শুনাও। মা বললো কিসের গল্প, রূপকথা না বাস্বব কোন গল্প। আমি বললাম রূপকথা আর বা¯—ব দু’টি গল্পই বল। মা বললো ঐ যে চাঁদের কথা বললাম তার দেহের উপর একটি বুড়ি বসে থাকে। সবাই অনুভব করে কেউ তাকে দেখতে পায় না।
মা আরও বললো, জীবন একটা বা¯—বতার ¶ণকাল ! যা সুখ দুঃখ কষ্ট আর স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে। জ্ঞান জীবনের মাঝে ফুল ফোটায় অরণ্যে অফুরš— ফসল ফলায়। প্রাচীন অন্ধকার ভেঙে ছিঁড়ে আনে গতিময় দিন। তুমি একদিন বড় হবে দেশ সমাজ জাতি আর পৃথিবীর কল্যাণে কাজ করবে। কঠিন দেয়াল ভেঙে মানুষের কাংখিত জীবন নির্মাণের পথ তৈরি করবে।

তোমার জন্মের শেকড়ে জ্ঞানের আলো জ্বালাবে। তোমার পূর্ব পুর“ষদের মুক্তির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে। কারণ পূর্ব পুর“ষের কাছে আমরা ঋণী। তাদের রেখে যাওয়া সম্পদই আমরা ভোগ করি। সত্যের মাটিতে গড়ে তুলবে আবাদের নতুন খামার। যেখানে মাটির নীড়ে শস্যেরা সুগন্ধ ছড়াবে। পৃথিবীর দীর্ঘ রা¯—া জুড়ে তোমার কর্মের ধ্বনীময় শব্দ শোনা যাবে।

নতুন সদায় কিনে একদিন বধুর ঘরে ফিরে যাবে ভালবাসার প্রাণবন বাঁশি বেজে উঠবে তোমাদের ঘরে। নতুন শেকড়ে চারা গাছ বেড়ে উঠবে তোমাদের সংসারে। ভবিষ্যতে সাঁকো বেয়ে তোমরা ছুয়ে যাবে মাটি ও মানুষকে ভালবেসে।

মা শেষ রাতে আল­াহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। কোন কোন সময় শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমি মাকে প্রশ্ন করতাম এই গভীর রাতে প্রার্থনা অবস্থায় তুমি কি কিছু দেখ ? মা বললেন স্রষ্টার দর্শন পাওয়ার চেষ্টা করি। তার সৃষ্টির নিগুঢ় তত্ত¡ অনুসন্ধান করি ! আমি বললাম তুমি কি কখনও তার সন্ধান পেয়েছ ? মা বললেন অনুভব করি জ্যোতির্ময় এক নূরের।

মা বলল- আল­াহ ¯^য়ং বলেন “আল­াহ আসমান ও জমিনের আলো। তার আলোর সাদৃশ্য যেন প্রদীপদানীর ন্যায়; যার মধ্যে একটি প্রদীপ রয়েছে। প্রদীপটি যেন একটি কাঁচের মধ্যে সংর¶িত। কাঁচটি যেন একটি উজ্জ্বল ন¶ত্র বিশেষ, প্রদীপটি জৈতুন গাছের তৈল দ্বারা প্রজ্জ্বলিত, যা পূর্ব ও পশ্চিমের ন্যায়। তৈল সর্বদাই আলো দান করে, যদিও তাকে কোন অগ্নি স্পর্শ করছে না। ইহা আলোর উপর একটি আলো। আল­াহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তার আলোর দিকে পরিচালিত করেন। আল­াহ মানুষের জন্য এমনি ভাবে উপমা দিয়ে থাকেন। আল­াহ সর্বজ্ঞ সর্বজ্ঞানী।”

মাকে বললাম আমি কি কখনও এই আলো অনুভব করতে পারবো। মা বলল কঠিন সাধনা করতে হবে। উন্নত চরিত্র গঠন করতে হবে। মানুষের দেহই তার মূল কিতাব ! তাকে সাধনা দ্বারা আলোকিত করতে হবে। জেনে রাখ সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অসংখ্য পদার্থের সমš^য়ে সৃষ্টি করেছেন। তাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি দেহ যাহা তোমরা চর্ম চ¶ু দ্বারা দেখতে পাও। আপরটি র“হু বা আত্মা। যা বাহ্য চ¶ু দ্বারা দেখা যায় না। জ্ঞান চ¶ু আলোকিত করে তাকে উপলব্ধি করতে হয়।
এই দুইটি পদার্থের মধ্যে সুন্দর আর অসুন্দর থাকতে পারে। শরীরের অঙ্গঁ প্রতঙ্গঁগুলো সুন্দর ও স্ষ্টু হলে উহাকে সুন্দর গঠন বলা হয়। আর আত্মার অভ্যাš—রিন গুনাবলী সুন্দর হলে উহাকে উন্নত ¯^ভাব বা চরিত্র বলা যায়। মানব দেহ বা হৃদয়ের যাবতীয় প্রকৃতি বা প্রবৃত্তিগুলো যথারীতি সুসামঞ্জস্যভাবে বিকশিত না হলে সে দেহ বা হৃদয়কে সুন্দর বলা যায় না।

সাধনা দ্বারা মানুষের ভেতরে বাহিরে জ্ঞান শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। জ্ঞান শক্তি বৃদ্ধি পেলে মানুষ সত্য-মিথ্যা বুঝতে পারে, ভালো মন্দ বুঝতে পারে, ধর্ম অধর্মের পথ সঠিকভাবে জানতে পারে। মানুষের অš—রে বুদ্ধিসত্তার শক্তি পূর্ণপ্রাপ্ত হলে তার হৃদয় আলোকিত হয় এবং সুন্দর ভাগ্যের সেরা হেকমত রূপ অমূল্য রতেœর ছবি দেখে। হেকমত অর্থ সত্যিকার সত্য জ্ঞান।

আমরা আট ভাই দুই বোন। ছোট বেলায় তর“ন নামের ভাইটি পৃথিবীর মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেঁচে আছি আমরা সাত ভাই দুই বোন।

বাবা ছোট চাকুির করতো আর মা আমাদের ও সংসার দেখা শোনা করতেন। বাবার বেতনের টাকা আর আমাদের অল্প জমির ফসল দিয়ে কোন মতে সংসার চলতো ।

একদিন আমাদের বাড়িতে একটি দুধের গর“ অসুস্থ্য হয়ে গেলো, তখন বেলা বারোটা, আমার স্কুল আর বাড়িতে ব্যবহার করার মতো একটি মাত্র জামা ছিল। জামাটা সকালে মা পরিষ্কার করেছে। রোদে না শোকানো পর্যš— জামাটা গায়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এমন সময় গর“ অসুস্থ হয়ে গেলো। আমি কিছু¶ণ আগে গোসল করে এসেছি। আমার পরণের দুইটি প্যান্ট ছিল তাও পুরাতন কাপড় দিয়ে বানানো।

আমি ভেজা প্যান্টটি খুলে শুকনা প্যান্টটি পরার সাথে সাথে মা বলল গর“ অসুস্থ্য তোমার বাবাকে সংবাদ দাও।

বাবা মেন্টাল হাসপাতালে চাকুির করতেন। মেন্টাল হাসপাতাল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় চার মাইল দুরে। মাকে বললাম বাবার কাছে যাবো কিন্তু গায়ে দেওয়ার কোন জামা নেই, একটি মাত্র জামা তাও ভেজা।

মা বললেন চৌকির উপর যে চাদর পাড়া আছে তা গায়ে দিয়ে তোমার বাবার কাছে গিয়ে খবর দাও। তখন গরমের দিন চাদর গায়ে দিয়ে বহুদুর পথ হেটে যাওয়া খুবই কষ্টকর।

তার পরেও মায়ের কথা মতো চাদরটা গায়ে দিয়ে বাবার হাসপাতালের পথে হাটতে শুর“ করলাম। অনেক চিকিৎসার পরও মায়ের আদরের গর“টি বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সেই গর“টির স্মৃতির বেদনা আজও আমার বুকে দহন আনে।

মাঝে মাঝে বাবার অফিসে যেতাম। ছোট বেলায় বল খেলা খুব পছন্দ করতাম। বাবা ছিলেন স্টোরকিপার। তার স্টোরে অনেক বল থাকতো। একদিন একটা পরিত্যাক্ত বল বাবাকে না বলে নিয়ে আসলাম এবং বাড়িতে লুকিয়ে রাখলাম। পরের দিন বাবা যখন অফিসে যাচ্ছিল তখন মা ঐ বলটি বাবার হাতে তুলে দিলেন। আমি খুব কষ্ট পেলাম আমার চোখে অশ্র“ ঝরলো। আমার অবস্থা দেখে মা বলল বেতন পেলে তোকে নতুন বল কিনে দেবো।

তারপর বাবা বহু বছর বেতন পেয়েছে কিন্তু আমার জন্য নতুন বল কিনা হয়নি। কারণ আমাদের সংসার ছিল খুব অভাবের। মায়ের ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে তা কিনে দিতে পারতেন না। বাবা এখন অতীত ইতিহাস। বাবার মতো মাও অনেক বছর আগে পবিত্র মাটির বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গভীর রাত আল­াহ যখন শেষ আসমানে নেমে আসে। আর তার বান্দাদেরকে ডেকে ডেকে বলে ওঠো ওঠো প্রার্থনা কর, আমার কাছে ¶মা চাও, অন্ন চাও, বস্ত্র চাও, ঋণ মুক্তি চাও, তুমি যা চাইবে আমি তাই দেবো।

শেষ রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেলে আমি উপলদ্ধি বা অনুভব করি- মা যেন ঈশ্বরের সাথে মিশে তার আর্শীবাদ নিয়ে আমাদের জন্য দোয়া করছে। বেঁচে থাকো তোমরা, তোমাদের জন্য কল্যাণ আর সুপথ আসুক। আমি সেই জ্যোর্তিময় নূরের দিকে তাকিয়ে মা মা বলে ডাকি। যার পায়ের নীচে আল­াহ আমাকে জান্নাত দিয়েছেন।

মা যেন আল­াহ পাকের জ্যোতিময় সত্তা। মা সৃষ্টি কর্তার এক প্রিয়তম ¯—ম্ভ। মা পরম সত্যের এক অনুসন্ধান মর্মভেদ।

মা সকল সš—ানদের খাওয়ানোর পর নিজে ঠিক মতো খেতেন কিনা আমার জানা নেই। তবে মায়ের দোয়ায় আমরা আজ বড় হয়েছি। আমাদের সংসারে এখন অনেক খাদ্য ভান্ডার যা মায়ের দোয়ায় আল­াহ আমাদের দান করেছেন।

বাবার কবরের পাশেই মায়ের কবর। আমরা নিয়মিত বাবা মা’র কবর জিয়ারত করি। আমার স্ত্রী সš—ান ভাই বোন ভাগ্নে ভাতিজারা সবাই নিয়মিত কবর জিয়ারত করে। আমরা যখন মায়ের কবর জিয়ারত করি তখন আল­াহ যেন আসমান থেকে তার রহমতের দরজা খুলে দেন। আমাদের চোখে জল আসে যা গড়িয়ে মায়ের কবরের উপর পরে। মায়ের কবর যেন জান্নাতের এক নিয়ামত পূর্ণ বাগিচা। যেখানে প্রেমময় পাখির সুমধুর কলরব ঐশী জ্ঞানের চেতনায় বিকশিত হয়। নিঃশব্দ তত্ত¡জ্ঞানের অতল গহবরে নিশ্চুপ যেন মা জেগে আছে আল­াহর ধ্যানে। মনে হয় সত্যিকার আশেক তার মাশুকের বিরহে জ্বলে পুড়ে নির্বাণ হয়ে যাচ্ছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

২১ অক্টোবর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৯৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪