বসন্তের বৈচিত্রময় সুন্দর শস্যফলা পরিপক্ক সকাল। অঢেল প্রেম আর মমতার ভেতর দিয়ে প্রষ্ফুটিত হচ্ছে প্রত্যাশার নতুন ফুল। স্থিতি আর প্রশান্তির প্রসন্নতায় প্রাণশক্তি নতুনকে আলিঙ্গন করছে। শাসকের শেকলে বিপন্ন পৃথিবী নির্বাসিত আঁধারের সাথে হেঁটে যাচ্ছে। পরষ্পর মহত্বের বীজ বপন করতে চাইছে কিন্তু জীবন ও সংগ্রাম খুবই কঠিন।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জব্বার আলী তার চাকুরী জীবনের সংগ্রহ এককালীন গ্র্যাচুয়েটির টাকা উত্তোলনের জন্য জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসারের দিকে যাচ্ছে। এক বছরের অধিক সময় সে চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছে কিন্তু এখনো টাকা উত্তোলন করতে পারেনি।
ইতিমধ্যে যে সব অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী টাকা উত্তোলন করেছে তারা অফিসারকে সুবিধা দিয়ে উত্তোলন করেছে। কয়েকদিন আগে সুবিধাভোগী অফিসারের স্থলে একজন সৎ অফিসার এসেছে। হয়তো জব্বার সাহেবের টাকা দ্রুত উত্তোলন হবে। সৎ অফিসারের কথা শুনে জব্বার সাহেবের মনে খুব আনন্দ।
স্বচ্ছ আলোর জ্যোতি যেন বিপন্নকে জাগিয়ে তুলছে। দুর্দশায় ক্লান্ত মর্মপীড়ার যেন জীবন সংগ্রামে তৃষ্ণাকে তৃপ্তি দিয়ে আলিঙ্গন করা। জব্বার অফিসে গিয়ে পৌচ্ছালো। অফিসার অনেক আইনের বই নিয়ে কঠিন ধারাগুলো দেখছে যেন কেউ অতিরিক্ত টাকা না তুলতে পারে।
আইনের শিথিল বা মানবতার ধারাগুলোর প্রতি সে কর্ণপাত করে না; কারণ তিনি সৎ অফিসার। তাই টাকা সরকারের ফান্ডে কিভাবে কেটে নেওয়া যায় সেটাই তার লক্ষ্য। অফিস করিডোরের টবে একটি না ফোটা কুঁড়ি শুকিয়ে যাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে ছিল ফুল হয়ে ফোটার। ইচ্ছে ছিল যৌবনপ্রাপ্ত ভালোবাসা নিয়ে ভ্রমরের সাথে খেলা করবে। বাহারী ফুলের সুগন্ধে নিরন্তর বাঁশির প্রেমধ্বনিত শুনবে। কিন্তু খুবতপ্ত রৌদ্রের তীক্ষè তাপে যে শুকিয়ে যাচ্ছে !
জব্বার আলী ভাবে এতো আইনের ধারা দিয়ে যদি অফিসার বিচার করে, আমাদের মতো চাকুরিজীবীরা কোনদিনও এককালীন টাকা উত্তোলন করতে পারবেনা। অফিসার বুঝেনা সেও একদিন অবসরে যাবে আর তার পরিণতি একই হতে পারে। অফিস সহকারী আর পিয়ন জব্বার আলীকে বললো, স্যার খুব সৎ মানুষ। আপনার ফাইল পার পাওয়া খুব কঠিন। আপনাকে পূর্বেও বহুবার বলেছিলাম, আগের অফিসারকে কিছু আর্থিক সুবিধা দিয়ে কাজটি করিয়ে নিতে।
কবি নাসির ওই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। জব্বার আলীকে দেখে এগিয়ে আসলো। কারণ জব্বার আলীর ছোট ভাই আর কবি এক সাথে দেশ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধের সময় কবির পিতা-মাতা ও ছোট ভাইকে শত্রুরা হত্যা করেছে।
কবি নাসির বললো, ছোট ভাইয়ের কাছে শুনেছি আপনি এখনো চাকুরী জীবনের শেষ সম্বলটুকু গ্র্যাচুয়েটির টাকা পাননি। আরো শুনেছি কয়েক দিন আগে একজন অফিসার এসেছে। তিনি নিজেকে সৎ ও ভালো মানুষ দাবী করেন। কথায় কথায় ধর্মের বাণী শুনায় কিন্তু দেশের সত্য ও মানবতার আইন বুঝেননা। মানুষকে কিভাবে কষ্ট দেওয়া যাবে সেই আইনগুলো খুঁজে খুঁজে বের করেন।
কবি আরো বললো, কয়েকদিন আগে ডিসি অফিসে একটি কাজের জন্য হোন্ডা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে একজন নির্বাহী কর্মকর্তা ও কয়েক জন পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমি না বুঝে তাদের অতিক্রম করে যাওয়াতে অফিসারের নির্দেশে কয়েক জন পুলিশ দ্রুত গতিতে হোন্ডা চালিয়ে আমার গতিরোধ করলো এবং আমাকে ডেকে নির্বাহী অফিসারের কাছে নিয়ে গেলো।
অফিসার আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স ও হোন্ডার নিবন্ধন দেখে সস্তোষ্ট হলো। কিন্তু পরক্ষণ-ই আমাকে বললো, মাথায় হেলমেট নেই কেন ? আমি বললাম ভূল হয়ে গেছে আর এই ভূলের কারণে আমাকে দুইশত টাকা জরিমানা করা হলো। আমি বললাম, অফিসার আপনার পুলিশ কর্মকর্তার মাথায়তো হেলমেট নেই। তাদের জরিমানা করার প্রয়োজন আছে কি ?
শিক্ষক বললো, এভাবেই আমাদের দেশ চলছে; যিনি আইন প্রয়োগ করেন তিনি নিজের জন্য আইন মানেন না। কিভাবে সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে উঠবে। কিভাবে সমাজ ব্যবস্থার নাগরিক সার্বজনীন কল্যাণ পাবে। জাতির ভেতর থেকেই জাতিকে যেন জুলুম করছে, আর দেশকে কুলষিত করছে।
কে দেবে বৈপ্লবিক দৃষ্টির আলো ? কে দেবে প্রজ্বলিত পৃথিবীর সন্ধান ? কে সরাবে অন্যায় অসাম্যের অপশক্তি।
লোভলালসা বুকে নিয়ে দেশের টাকা চুরি করে জনগণের সেবা করলে কিভাবে বর্ণহীন ভাতৃত্বের ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। পরাধীন নাগরিক কিভাবে সমাজ ব্যবস্থায় অধিকার ফিরে পাবে। ক্লান্ত পৃথিবী ক্লান্ত আমাদের দেশ ও জাতি সর্বপ্রকার অত্যাচার অবিচার আর জুলুম নিরবে সহ্য করে ?
দুঃখ-কষ্ট আহত রক্তপাতে শুধু শুধু জীবনের বলিদান হয় সত্য ও ন্যায় স্থাপন হয় না।
প্রলোভন পূর্ণ মোহগ্রস্থ জীবনগুলো লালসায় আকৃষ্ট, তারা দেশ ও সমাজ বিরোধী শত্রু রাজতন্ত্র সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের অসত্য ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের পুঁজি সংগ্রহ করে। গরিব ও এতিমকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। ধূর্ত সংলাপ দিয়ে ধর্মকে জড়াতে চায়।
কিন্তু ধর্মতো প্রশান্ত আতœার সত্যদর্শন। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রাম। অন্যায় অবিচার শোষন ও লুষ্ঠনের বিরুদ্ধে কঠিন আন্দোলন। শিক্ষক অতিকষ্টে বললো, কালো বৃত্তবান ও ভন্ড আমলাদের শোষণে-শোষণে দেশের গরিব ও এতিম যেন মোক্ষম যন্ত্রণায় কাঁদছে। দাস মুক্তির ভেতরই দাস প্রথার লুকানো এক কাহিনী !
ক্ষমতা নির্যাতন আর ভন্ডামিতে অতিষ্ট নিপীড়ন গরিবের শরু হয়ে শাসক ভন্ড ঈশ্বর সাজে কেউ কেউ ধর্মের মুখোশ পড়ে মিথ্যা জারিজুরি করে। হিংসা পাপ আর ভেদাভেদ সৃষ্টি করে, শুধু লেবাসেই মানবরূপ, ভেতরে অসত্য আর ভন্ডামী। উত্তপ্ত নগর আর স্তব্ধ প্রকৃতি যেন ভন্ডদের অন্যায় অবিচারের কারণে সমাজকে অসহায় করে ফেলেছে। সব খানেই যেন শুধু পক্ষপাতী। সত্যকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। সমাজের চিত্তবৃত্তে অসংখ্য প্রকারভেদ। কঠোর সংগ্রাম আর যুদ্ধ করে এখনো সত্যের সাক্ষাত মেলেনি।
দূর্গম পথের পরিচয় কিভাবে জাতি খুঁজে পাবে। পরাধীনতার ভেতর থেকেই যেন সত্যকে পাওয়ার সংগ্রাম করছে। অন্যায় ক্ষমতাধরের অধীনতা থেকে মুক্তির জন্য। মনে রেখো, সত্য কণ্টকাকীর্ণ ও দূর্গম কঠিন। ভন্ড নেতা আর আমলারা মিথ্যা বাক্য বিক্রি করে অসৎ উপার্জন করে। ধর্মান্ধরা সত্যবাণীর উল্টা-পাল্টা ব্যাখা দেয় আর মনগড়া মতবাদ দিয়ে মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে।
মুক্তিযোদ্ধা নাসির বললো, কয়েক দিন আগে জানতে পারলাম ভূমি অফিসে একজন সৎ অফিসার এসেছে। দীর্ঘদিন যাবত আমার একটা জমির নাম খারিজ করতে পারি নাই। অফিসে গেলেই টাকা দিতে হয়। কোথায় টাকা পাবো ? বাবার অনেক জমি ছিল, স্বাধীনতার পর অভাবের কারণে বিক্রি করে খেয়েছি আর কিছু জমি আছে ওই টুকুর উপর বাড়ি করে বসবাস করছি।
জমির নাম খারিজ না থাকায় ঠিকমত খাজনা দিতে পারি নাই। সৎ অফিসার এসেছে জেনে ভূমি অফিসে গেলাম। খুব ভদ্র একজন মহিলা, অফিসের চেয়ারে বসে আছে। কর্মচারীদের কাছ থেকে জানতে পেলাম, এই ভদ্রমহিলা ভূমি অফিসার। আমি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম ও পরিচয় দিলাম। তিনি আমাকে বসতে বললেন, আমি আমার জমি সংক্রান্ত সকল বিষয় খুলে বললাম, অফিসার সন্তোষ প্রকাশ করে বললো, কোন অসুবিধা নেই আমি আইন দেখে জমির নাম খারিজ করে দেবো।
আমি নিয়মমত কাগজ পত্রাদি জমা দিলাম আর অফিসে সপ্তাহে-সপ্তাহে ঘুরতে লাগলাম। কিছু দিন পর অফিসারের সাথে দেখা করলাম। অফিসার অফিস সহকারীকে ফাইল আনতে বললো, ফাইল নিয়ে অফিস সহকারী এসে বললো, ম্যাডাম এটা আইনে পড়ে না। অফিস সহকারীর পরামর্শ শুনে অফিসার আমাকে বললো দুঃখিত আপনার কাজ সম্পাদন করতে বেশ দেরী হবে।
নির্জন দুপুর বেলা। এই শহরের রাজপথ এখন জনশূণ্য। দেশ স্বাধীনের জন্য এই পথ ধরে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষে ছোট ভাই বোন আর প্রিয়তম পিতাকে এখনো খুঁজে পাইনি। আমি দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলাম বলে, স্বাধীনতা বিরোধীরা আমার স্বজনদের মিলিটারীর হাতে তুলে দিয়েছিল। কোথায় তাদের হত্যা করা হয়েছিল, তাও জানি না। আমি অফিস সহকারীকে বললাম, জমির সমস্যা কি ? অফিস সহকারী বললো, তেমন কিছু না আপনি চাইলে আমি, জমির নাম খারিজ করে দেবো। ম্যাডাম সৎ কিন্তু আইন বুঝে না আমরা এই অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা যে ভাবে বলবো অফিসার সেভাবেই কাজ করে দেবে।
মুক্তিযোদ্ধা নাসির মনে মনে ভাবে, একজন অফিসার টাকা না খেলেই বুঝায় সে একজন সৎ মানুষ কিন্তু সে বুঝে না যে, কাজগুলো ভালোভাবে সম্পাদন না হওয়া পর্যন্ত ওই সততার কোন মূল্য নেই। যে মানুষ নিজের মূল্য নিজেই করে, ভাল মানুষ সাজে কিন্তু সমাজের কাছে তার কর্মের কোন মূল্য নেই। কারণ সে আইন বুঝে না। অফিস সহকারীর কাছ থেকে আইন জেনে নিতে হয়।
পরের দিন আমি কিছু টাকা সুদের উপর লোন নিয়ে অফিস সহকারীকে দিলাম। অফিস সহকারী খুব খুশি হয়ে বললেন, আপনাকে আর আসতে হবে না। আমি আপনার কাগজ পৌঁছে দেবো। একদিন পর সন্ধ্যায় অফিস সহকারী আমাকে ফোন করলো, এবং বললো, আপনি কোথায় ? আপনার কাজটি হয়ে গেছে। আমি বললাম, শহরের নতুন মার্কেটে আছি। ওখানেই একটু অপেক্ষা করুণ, কাগজ পৌছে ,দেবো।
সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্ষুধার্ত নগর জেগে উঠছে, ভাতের জন্য অনাহারীরা আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছে। না খাওয়া কংকাল অনাহারীর দেহের উপর দিয়ে ঝলমল নাগরা পড়া শাহী শেরওয়ানী গায়ে চাপিয়ে বৃত্তবান আর ভন্ডধর্মবাজরা হেঁটে যাচ্ছে। গরীবের বিবেক শুধুই ফরিয়াদে কাঁদে।
ধূর্তবাজ ক্ষমতাশালীরা ভানুমতির যাত্রা ও নাটকের কাহিনীর মতো মানুষকে আশ্বাস দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে, রাজদন্ডের ধারালো অস্ত্রের ভয়ে নকল তপস্যকারীরা ধর্মকে ভিন্ন পথে বিনিময় করছে। নৈতিকতার মূল্যবোধকে মুছে দিতে চাইছে। এভাবেই কি চলমান সময় দেশও সমাজ এই অসত্যকে ধরে রাখবে ?
দূর্নীতির টাকা দিয়ে সেবা মিথ্যাসমাজ প্রেম আর দেশপ্রেমের ব্যাখা দিয়ে কতবার জাতিকে ধ্বংস করবে ? কবে দাসমুক্তি আর ভাতৃত্বের সাম্য জাতির আকাঙ্খায় মিলিত হবে ? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অফিস সহাকারী নিজে এসে জমির নাম খারিজের কাগজ পত্রাদি পৌঁছে দিয়ে গেলো।
কিন্তু শিক্ষকের এককালীন চাকুরির টাকা কি কখনো পাবে ? না আমার মতো সুদের উপর টাকা লোন করে তার কাজ সম্পাদনা করতে হবে-!
২১ অক্টোবর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৯৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী