মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়ে গেল। এই বৃদ্ধ বয়সের সময় যেন আর কাটতে চায় না। সকালের আসা পত্রিকা নিয়ে খুঁটিনাটি প্রায় সমস্ত খবর পড়ে বেশ কিছুটা টাইম কাটিয়ে দিই। তবু কি সময় ফুরাতে চায়? ঘরের একটা মাত্র টি.ভি.—এক একজন একেক প্রোগ্রাম দেখতে চায়—তাই পারত পক্ষে টিভির সামনে গিয়ে আমি বসি না। তবে আমার একটা ব্যামো আছে—মাঝে মধ্যে কাগজ কলম নিয়ে বসতে হয়। ছাইপাঁশ যা পারি লিখে যাই। রাতে ঘুম না এলে সেই লেখাগুলি খুঁজেপেতে নিয়ে পড়ি। কখনও সখনও দেখি লেখাটা গল্প বলে চলে যেতে পারে।
সে দিন কাগজ কলম নিয়ে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। দু লাইন লিখি আর কাটি। এমনি ভাবে দু তিন পাতা লেখালেখি আর কাটাকাটিতে ভরে গিয়ে ছিল। তারই মধ্যে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ছোট বেলার এক ঘটনার কথা। ভাবলাম, লিখে ফেললে কেমন হয়? লেখা শুরুর আগে,আগা গোড়া ঘটনাটার কথা মনে করে নিতে চাইলাম। হাতে কলম নিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলাম আমার শৈশবের স্মৃতিতে। স্মৃতির পাতা মনে মনে পালটাতে পালটাতে নিজের মনেই হেসে উঠছিলাম। না,আর দেরী করা চলবে না, বয়সের ধর্মে স্মৃতি বিভ্রাট ঘটার আগেই কলম তুলে নিলাম হাতে।
একেবারে ছোটটি নই আমি। ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার দাদা, খোকন দা,আমার মাসতুত ভাই,পড়ে ক্লাস এইটে। দুজনের জুটি জমে ছিল ভালো।
বছরের দুবার লম্বা ছুটি পড়ত স্কুলে। এক হল গ্রীষ্মের ছুটি,আর এক হল পূজার। হয় আমরা যেতাম মাসিদের বাড়ি কালনায়, নতুবা মাসীরা আসতো আমাদের বাড়ি রানাঘাটে। এমনি ভাবে খোকন দা মানে মাসির ছেলের সঙ্গে আমার ছিল আলাদা এক সম্পর্ক। এক দিকে দাদা,অন্য দিকে ভালো বন্ধু। দুজনেই ছিলাম যেমনি চঞ্চল,তেমনি দুষ্টু। দুষ্ট বুদ্ধির আমাদের অভাব ছিল না।
খোকন দা বলত,‘দেখ তপন,যা আমরা সহজে পেয়ে যাই তার ওপর আমাদের টান থাকে না’।’
আমি জিজ্ঞেস করতাম,‘কেমন,কেমন,কেমন !’
--‘যেমন ধর ট্রেনে যাওয়া,টিকিট কিনে তো সবাই যাতায়াত করে--কিন্তু কখনো উইদাউট টিকিতে গিয়ে দেখেছিস?’
--‘ওরে বাবা ! ও তো ভয়ের ব্যাপার ! টি.সি.ধরে পিটাবে যে !’
--‘পিটালেই হল,আমরা ছোট,আমাদের গায়ে চট করে ওরা হাত দিতে পারবে?’ খোকন দা যেন অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে বলে চলে। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। তখনকার কথা শোন তা হলে।
সেবার ছোট মাসির সঙ্গে সেজ মাসির বাড়ি ত্রিবেণীতে গিয়ে ছিলাম। সেখানে একদিন থেকে ঘরে ফেরার কথা। সেজ মাসি আদর করে দুটো পাকা কাঁঠাল ধরিয়ে দিল ছোট মাসির হাতে। ছোট মাসি কাঁঠাল খেতে নাকি খুব ভালোবাসে।
কিন্তু এখন বোঝা টানবে কে? কি করে? নিজেদের পোটলা পুঁটলি তো ছিলই--সঙ্গে আরও দুই কাঁঠাল জুটেছে ।
ছোট কাঁঠাল হাতে নিলো খোকন দা। বড় কাঁঠাল আর একটা ব্যাগ ছোট মাসি নিলো,সঙ্গে একটা পুঁটলিও ছিল। নিজের টেনে নেওয়া সুবিধা হবে বলে ছোট মাসি কাঁঠালের বোঁটায় দড়ি বেঁধে এক কাঁধে ঝোলাল। আর বাকি দু হাতের এক হাতে পুঁটুলি অন্য হাতে ব্যাগ। আমি ছোট,তাই আমার হাতে শুধু ছোট কাঁঠালটাই ছিল।
স্টেশনের কাছে এসে দেখি,আমাদের গাড়ি আসছে। ওভার ব্রিজ দিয়ে তাড়াতাড়ি স্টেশনে পৌঁছবো বলে চললাম। জোরে জোরে হাঁটছিলাম। মাসির হাঁটার অভ্যাস ছিল। সেও জোরে জোরে হাঁটছে। কিন্তু একটা অসুবিধা হচ্ছিল তার। যখনি মাসি জোরে হাঁটে,কাঁধের কাঁঠালটাও এপাশ ওপাশ টালমাটাল হয়ে জোরে জোরে দুলতে থাকে। এ ভাবে তার চলার ব্যালেন্স বার বার যাচ্ছিল বিগড়ে।
ওভার ব্রিজ দিয়ে নাবতে নাবতে ট্রেন স্টেশন পৌঁছে গেলো। খোকন দা দৌড়ে গাড়ির কাছে পৌঁছল। কাঁঠাল কাঁধে দুলিয়ে মাসি অতি কষ্ট করে এগিয়ে আসছে। এদিকে গাড়ি ছাড়ার ভোঁ পড়ে গেছে!
মাসি তখন দেখি মাসি ছুটছে আর চীৎকার করে ট্রেনের ড্রাইভারকে হাত নাচিয়ে বলছে,ও ড্রাইভার সাহেব,ও ড্রাইভার সাহেব ! মাসির অবস্থা তখন দেখার মত,এক হাতে ব্যাগ,আর এক হাতে ছোট এক পোটলা,এক বগলে দোদুল্যমান বড় এক কাঁঠাল। এই অবস্থায় মাসি হাত নাড়িয়ে গার্ড সাহেবকে গাড়ি আর একটু থামাতে বলে যাচ্ছে।
ট্রেন ড্রাইভারের চোখ আগের থেকেই বোধ হয় পড়ে ছিল মাসির দিকে। দৃশ্যটা চোখে পড়ার মত ছিল বটে! ড্রাইভার না হেসে পারলো না,কয়েক মুহূর্ত গাড়ি মাসির রগর দেখেই থেমে গেল দেখলাম।
মাঝে মধ্যে এ ধরণের হাসি কান্নার দৃশ্য পথে ঘাটে দেখা যায় বটে! তাতে যান্ত্রিক ট্রেন পর্যন্ত কয়েক সেকেন্ড থেমে যেতে পারে! আর যাবে নাই বা কেন ! আখির যন্ত্র হলেও তার চালক তো হয় সাধারণ মানুষ।
ভালো ভাবে উঠে গেলাম ট্রেনে। তবে তাড়াতাড়িতে ভুল একটা হোয়ে গেছে--ট্রেনের টিকিট কাটতে মনে নেই। খোকন দা মাসিকে বলল,মাসি টিকিট তো কাটা হয় নি !
--কি করবো,এত তাড়াহুড়োয় আসা,তারপর আমার বগলের নীচে কাঁঠাল ঝুলছে--কি করি বল? পরের ট্রেনও তো ছিল সেই বিকেলে ! মাসি বলল।
খোকন দার ভয় হতে লাগলো,বলে উঠলো,পথে টিকিট চেকার যদি ওঠে?
মাসি বলেন,টিকিটের পয়সা ওর হাতে দিয়ে দেবো।
--ও মা,এমন হয় নাকি !
--কেন হবেনা রে,দেখলি না বগলে কাঁঠাল দুলিয়ে ট্রেন দাঁড় করিয়ে দিলাম !
--কিন্তু--
আর কিন্তু নয়,চুপ চাপ চল।
কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই নাকি সন্ধ্যা হয় ! মাঝ পথে টিকিট চেকার উঠলো। মাসিও দেখল।
--এবার মাসি? খোকন দা ভয়ে বলে ওঠে।
মাসি বলল,তুই এক কাজ করবি,যদি তোকে ধরে তুই বলবি মাসির কাছে টিকিট আছে। আর বেশী কিছু বললে তুই কেবল কাঁদতে থাকবি।
--আর যদি জিজ্ঞেস করে মাসিকে ডেকে আন,তখন ? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম।
ভুলেও আমার কাছে আসবি না,কোন কথা না বলে তুই শুধু কাঁদতে থাকবি,মাসি কথাগুলি বলে নিজের সিট ছেড়ে উঠে টি.সি.থেকে দূরে যাবার চেষ্টা করল। যাবার আগে খোকন দাকে বলে গেল,তোর জাগায় তুই বসে থাক চুপ চাপ!
খানিক পরেই টি.সি.খোকন দার কাছে গিয়ে বলল,খোকা টিকিট?
যেন শুনতে পায় নি এমনি ভাব করে অন্য দিকে তাকিয়ে খোকন দা চুপ করে থাকলো। মনে মনে তার খুব ভয় হচ্ছিল।
এবার টি.সি.ওর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে,খোকা টিকিট দেখাও !
এবার ন বছরের খোকন দা ভয় পেয়ে গেলো,কেঁদে বলল,মাসির কাছে টিকিট,আমার কাছে নেই।
টি.সি.ধমক দিয়ে বলে উঠলো,কোথায় তোর মাসি ডেকে আন তাকে।
জানি না কোথায় চলে গেছে! খোকন দা কেঁদে উঠলো,প্রথমে ধীরে,তারপর মনে পড়ে গেলো মাসিও কাঁদতে বলেছিল--ভ্যাঁ,ভ্যাঁ করে জোরে জোরে কেঁদে উঠলো। ছোট কাঁঠাল খোকন দার হাতে ছিল। টি.সি.বলল,‘তোর হাতে ওটা কি ?’
কাঁদতে কাঁদতেই খোকন দা বলে উঠলো,‘ছোট কাঁঠাল’,কাঁঠালের দিকে তাকিয়েই আবার টিকিটের কথা মনে হওয়াতে জোরে জোরে কান্না শুরু করল।
--‘আচ্ছা পাল্লায় পড়লাম তো’,টি.সি.বলল,‘কান্না থামা, চুপ করে বস!’
আরও জোর সুর টেনে কাঁদতে থাকলো খোকন দা।
টি.সি.বেচারা জোরে জোরে কান্নার আওয়াজে অতিষ্ঠ হোয়ে খোকন দার সামনে হাত জোর করে বলল,‘চুপ কর বাবা ! চুপ করে বস,আমায় কাজ করতে দে।’
কে কার কথা শুনে! চীৎকারের কান্না এক ভাবেই চলতে থাকলো।
আশপাশের যাত্রীরা কান্না থামাবার চেষ্টা করল। একজন বলল,‘চুপ করে বসে থাক,চেকার তোকে কিছু বলবে না।’
--‘তুই কোথায় যাবি?’--আর একজন যাত্রী জিজ্ঞেস করল।
উত্তরে,‘কালনা’,কথাটুকু বলে আবার কান্না শুরু করল খোকন দা।
টি.সি.আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। তার আগেই--‘মাসি! বলে ছোট্ট করে ডাক দিয়ে ইচ্ছাকৃত আবার কান্না শুরু জুড়ে দিল দাদা। এমন সময় চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে এক হকার ট্রেনের কামড়ায় উঠলো। কান্না থামাবার জন্যে টি.সি.বলে উঠলো,‘কান্না থামা,চানাচুর খাবি?’
তেমনি কান্নার সুর নিয়ে খোকন দা বলে উঠলো,‘হ্যাঁ’,অগত্যা এক প্যাকেট চানাচুর কিনে টি.সি.খোকন দার হাতে দিলো।
শান্ত হল দাদা। টি.সি.জিজ্ঞেস করল,‘মাসিকে না পেলে ঘর চিনতে পারবি তো?’
কিছু না বলে,ঘাড় নেড়ে খোকন দা সম্মতি জানাল। কালনা স্টেশনে টি.সি.খোকনকে নামিয়ে দিলো। স্টেশন থেকে বের হবার গেটের সামনেই মাসি খোকন দার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
২
খোকন দার গল্প শেষ হল,বলল,‘তপন,চল আমরা কোথাও ঘুরে আসি।’
--‘কোথায় ?’
--‘চল,ট্রেনে চড়ে বেড়িয়ে আসি।’
--‘কোন জাগায়?’
--‘দু চার স্টেশন পেড়িয়ে ঘুরেটুরে চলে আসবো।’
বললাম,‘টিকিট কেটে?’
--‘ধুর,টিকির কেটে কোন মজা আছে ! আমরা ডবলু.টি.তে ঘুরে আসবো।’খোকন দা শাবাশি দেখিয়ে বলে উঠলো।
--‘মানে উইদাউট টিকিটে?’ আশ্চর্য হলাম,বললাম,‘এখন টি.সি. ধরলে কিন্তু ছাড়বে না ! তোমার ওই গল্পের মত অত ছোট আমরা কিন্তু নই এখন !’
--‘আরে চল না,বিনা টিকিটে যাবার মজাই আলাদা!’
কেমন মজা একবার দেখে নেবার ইচ্ছে আমারও হল।
এমনি ঘরে একটু আধটু চুরি করে খাওয়ার অভ্যাস আছে। চিনি, পাউডার দুধ,মার রান্না করে রাখা ভাজা ভুজি চুরি করে খেতে মন্দ লাগে না।
মনে আছে একদিন আমি চুরি করে খেয়ে না নিই,মা সে জন্যে ঘরের ঠাকুরকে পূজা দেবার জন্যে নাড়ু বানিয়ে ঠাকুরের আসনের নীচে রেখে আমায় বলে রেখে ছিলেন,‘দেখিস পূজার নাড়ু,হাত লাগিয়ে ছোঁয়া ছানি করিস না যেন !’
আমি মনে বুদ্ধি খেলাতে লাগলাম,হাত না লাগিয়ে,আমার শরীরের ছোঁয়া না লাগিয়ে,কি ভাবে ঠাকুরের আসনের নাড়ু খাওয়া সম্ভব! অতঃপর বুদ্ধি খেলল,আমি রান্না ঘর থেকে সাঁড়াশি এনে তা দিয়ে চিপে ধরে নিয়ে বের করলাম নাড়ুর থালা। সাঁড়াশি দিয়েই দু চারটা নাড়ু আলতো ভাবে তুলে নিলাম হাতে। তারপর মুখে পুরে দিয়ে যথা স্থানে রেখে দিলাম নাড়ুর থালা। বলতে গেলে এসব চুরি করে খাওয়া খারাপ লাগত না।
তাই খোকন দার প্রস্তাবে রাজী হোয়ে গেলাম। দুজনে সটান চলে গেলাম রানাঘাট রেলওয়ে স্টেশনে।টি.সি.দাঁড়িয়ে ছিল গেটে। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সময় টিকিট দেখানোর তেমন চল নেই। বুক ফুলিয়ে দুজনে ঢুকে গেলাম প্ল্যাটফর্মে। দেখলাম একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম ব্যান্ডর কামড়ায় দু তিনটে কামড়া ছাড়া বাকী গুলোতে ভীষণ ভিড় রয়েছে। খোকন দার আগ্রহে আমরা চড়ে বসলাম ব্যান্ডর কামড়াতে।
গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমার মনের মধ্যে একটা কথাই খালি ঘুরে ফিরে আসছে,বিনা টিকিটে যাচ্ছি,টি.সি. ধরবে না তো ! কিন্তু খোকন দা বেশ নিশ্চিত দেখলাম। চুপচাপ বসে একই দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ লক্ষ্য করে আমিও তাকালাম। দেখি অনেক কাঁঠাল নিয়ে যাচ্ছে কেউ। পাকা কাঁঠাল,তার গন্ধে কামড়া ম ম করছিল।
--‘তপন ! আমায় ডাক দিলো’,খোকন দা।
আমি কাছে এসে বললাম,‘হ্যাঁ,বলো !’
--‘পাকা কাঁঠাল দেখছিস?’
--‘দেখলাম তো!’
--‘কত কাঁঠাল বল তো ! একেবারে উঁচু করে ঢাঁই করা।’
বসা থেকে উঠে পড়ল খোকন দা,‘বলল,চল দেখে আসি কাঁঠালের মালিক খানা কেমন,কোথায় বসে আছে !’
উঠে কাঁঠালের স্তূপ পার করে দেখলাম সব তাস খেলায় মত্ত হোয়ে আছে। চারজন খেলছে,আর দশ পনের জন দেখছে।
খেলোয়াড়ের একজন বলে উঠলো,‘গুরু ! আমি নাব্বো,তাস কে খেলবা ধরো।’
এগিয়ে আসা অনেক হাতের মধ্যে এক হাতে তাস দিয়ে গুরুর চেলা দাঁড়িয়ে গেলো আসছে স্টেশনে নাববে বলে। খেলোয়াড়দের মধ্যে আর একজন বলে উঠলো,‘তুমি তো এখানে নাব্বা,আমার তো সেই আখরি স্টেশন।’
--‘অনেক কাঁঠাল নিয়া যাচ্ছ গুরু!’ চেলা নামার আগে বলে চলে।
--‘হ,কাডালের যোগান দিমু শিয়ালদায়’,বলে কাঁঠালের মালিক,গুরু তাস খেলায় মন দিলো।
--‘কেল্লা ফতে’,খোকন দা চাপা স্বরে বলে ওঠে।
আমি ধীরে বলি,‘কি ব্যাপার !’
খোকন দা একটু সরে গিয়ে আমার ইশারায় ডাকে,আমি তার দিকে এগিয়ে যাই।
--‘বুঝতে পারলি তো কাঁঠালের মালিক কে?’ প্রশ্ন খোকন দার।
--‘না তো’,হ্যাঁ,করে খোকন দার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম।
--‘তোর দ্বারা কিচ্ছু যদি হয়’,তারপর বলল,ওই দেখ,তাস খেলছে মোটা লোকটা,মোটা মত গোঁফও আছে। ও হল কাঁঠালের মালিক।’
দেখে নিলাম আমি,কাঁঠালের মালিক,লোকটা গোঁফওয়ালা,সমানে বিড়ি টেনে যাচ্ছে.চোখ গুলো বড় বড়,সামান্য লাল।
তখন তাস খেলা বেশ জমে উঠেছে--দর্শক আর খেলোয়াড় মিলে বেশ হোই হল্লা হচ্ছে। গাড়ির কামরার সব যাত্রী এক জাগায় তাস খেলা নিয়ে মেতে আছে। ইতি মধ্যে চাকদা স্টেশন এস গেলো, সেই গুরুর চেলা লোকটা বড় দুটো ঝুড়ি নামিয়ে নিলো। ওতে কি ছিল ওপর থেকে বোঝা গেলো না। লতায় পাতায় ঢেকে ভালো করে প্যাক করা ছিল।
ট্রেন আবার ছেড়ে দিল। চোখে পড়ল,খোকন দা উঁচু করে রাখা কাঁঠালের স্তূপের পেছন দিকে এগিয়ে গেলো। সেখান থেকে আমায় ইশারায় ডেকে উঠলো। পা টিপে গেলাম ওখানে। খোকন দা বলল, ‘ধীরে বসে পড় ওখানে।’
দাদা একটা নরম কাঁঠাল বেছে ভাঙা শুরু করল।
আমি বসেছি ঠিকই,কিন্তু ওর রকম সকম দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছি। খোকন দার মুখে কাঁঠালের কোয়া। তাড়াতাড়ি খাবার চেষ্টা করছে। দু চোয়াল ফাঁক করে কাঁঠালের কোয়া চিবচ্ছিল আর গিলছিল। আমায় হাত দিয়ে,মুখ দিয়ে,চোখ দিয়ে সমানে ইশারা করছিল খাবার জন্যে।
ও দিকে তাস খেলা বেশ জমে গেছে। ওদের কথা বার্তা হোই হল্লায় আমাদের সামান্য চাকুম চুকুম শব্দ কারো কানে পৌঁছাবে না জানি।
কাঁঠালটা বেশ মিষ্টি। খোকন দার প্রায় আধা কাঁঠাল খাওয়া হোয়ে গেলো। আমি চার নম্বর কোয়া মুখে ঢুকিয়েছি,এমনি সময় গাড়ি এসে থামল কল্যাণী স্টেশনে। খোকন দা আমার হাত ধরে টান মারল--ফিসফিসিয়ে বলল ‘এবার ওদিকে চল। আমরা ভালো মানুষের মত তাসের আড্ডায় এসে দাঁড়ালাম।
কল্যাণীতে কেউ নাবল না,কেউ উঠলও না। গাড়ি আবার ছাড়ল।
ধীরে খোকন দা আবার পিছন দিকে সরে গেলো। বুঝলাম,কাঁঠালে এখনো পেট ভরে নি। যাই বলি না কেন,কাঁঠালটা কিন্তু বেশ মিষ্টি—সুস্বাদু। আমার ইচ্ছে হল আর দু কোয়া খাওয়ার। ধীরে ধীরে খোকন দাকে অনুসরণ করলাম। ততক্ষণে আমার আগের ভাঙা কাঁঠালটার নব্বই পার্সেন্ট খতম হোয়ে গেছে। আমি আর দুটো কোয়া পেলাম। খোকন দা দেখি উঠে দাঁড়িয়ে গেছে—মানে,তার পেট ফুলফিল হোয়ে গেছে। এদিকে আমি কোয়া বাছছি,তখনও হাতে ধরা কাঁঠালের এক কোয়া।
এমন সময় শুনতে পেলাম,কাঁঠালের মালিক খেলতে খেলতে বলে ওঠে,‘ভাঙা কাঁঠালের মত গন্ধ আসছে কেন রে ! এতক্ষণ তো এত বেশী গন্ধ আসে না !’ হোই হল্লার মধ্যেও কথাগুলি আমাদের কানে গিয়েছিল। এবার নিশ্চয় আসবে মালিক। শেষ কাঁঠালের কোয়া আমি,খোকন দা জোরে জোরে চাবিয়ে চলেছি। খোকন দা আরও কটা কাঁঠাল টিপে টিপে দেখছিল। এদিকে গাড়ি আবার স্লো হোয়ে এলো,তার মানে আবার কোন স্টেশন এলো। এমনি সময় হঠাৎ মালিকের গলা শুনতে পেলাম,‘কেডা রে?’
মালিক লোকটা উঠে এসে দেখে খোকন দা কাঁঠাল টিপে চলেছে।
--‘হেই তোরা কি করিস রে !’ বলে এগিয়ে আসে মালিক।
খোকন দা একটু চমকে উঠেই নিজেকে সামলে নেয়,‘বলে পাকা কি না দেখছি !’
--‘তোর দেহার কি আছে?’ সুর টেনে মোটা গলায় মালিক বলে ওঠে।
এবার আমায় দেখে মালিক,বলে,‘এই তুই কি খাচ্ছিস?’
আমি তখন কাঁঠাল কোয়া গিলাতে ব্যস্ত--মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না।
বড় বড় পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল কাঁঠালের মালিক। ইতিমধ্যে তার চোখে পড়ল আমাদের খেয়ে ফেলা কাঁঠালের অবশিষ্ট অংশের দিকে। লাফ মেরে সেটার কাছে গিয়ে খালি বোকা তার চোখে পড়লো,রক্ত গরম চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল,‘তোরা আমার...’বাকী কথা শুনতে পেলাম না। শুধু খোকন দার চীৎকার শুনতে পেলাম,গাড়ি থেমেছে, পালা,পালা’,বলেই দেখলাম খোকন দা গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেলো। কাঁঠাল মালিক আমায় ধরতে আসছে--প্রায় ধরবে ধরবে এমনি সময় আমি দিলাম ছুট,একে বারে গাড়ির দরজার সামনে।
পেছন থেকে‘ধর,ধর’,শুনতে পেলাম--ততক্ষণে দু তিন লাফ দিয়ে নৈহাটি স্টেশনে নেমে গেছি।
পেছন ফিরতে দেখি গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। কাঁঠালের মালিক হাত ছুঁড়ে,পা নাচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তখনও যেন কিছু বলে চলেছে!