১.
রুমের জানালার ভাঙা কাচ দিয়ে আলো ছুটে এসে আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে রোদ। হঠাৎ করেই ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙার পরেও বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার অভ্যাস আমার পুরানো। তাই করছি অনেকক্ষণ যাবত। রোদের অত্যাচারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেই পড়লাম।
এই অত্যাচার আগে ছিল না, সেদিন বাড়ির সামনে ক্রিকেট খেলছিল পাড়ার ছেলেরা। আমি দেখছিলাম আর মজা পাচ্ছিলাম। অকস্মাৎ বল লেগে ভেঙে গেল জানালাটা। অবশ্য আমার বেশি দেরি করে ঘুমের থেকে উঠার স্বভাবটাও কিছুদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে।
আমার ভাই অরূপ ইদানীং বাসায় রাত করে ফেরে, ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। ওর শরীর মন থেকে নিঝরে বের হচ্ছে একুশের চেতনার রক্ত। ভাষা আন্দোলনের চেতনা গায়ে মেখে ও আর ওর বন্ধুরা তেজ দীপ্ত হয়ে উঠেছে। আমার গা জ্বালা করে। যুদ্ধ শব্দটা এত ঘৃণা করি যে বইয়ের পাতা থেকে খুঁজে খুঁজে শব্দটা কেটে দেই। বিশ্বযুদ্ধের নাশকতা কষ্টের কথা মনে করে।
আমার বাবার নাম অজয় চৌধূরী। তাঁর আছে রবীন্দ্রনাথ মূলক যুক্তি নিজেকে প্রথমে দাঁড় করায় মনুষ্যত্বের ডায়াসে তারপর বলতে থাকে বেঁচে থাকার কথা, ভাত মাছের কথা, হাড়ি পাতিলের কথা। আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। অবশ্য ভালোবাসার ক্ষেত্রে বাবা আমার হৃদয়ের মানুষ।
কিছুদিন আগে মনে হত আমি সব সময় সবার থেকে আলাদা কিছু করে বেড়াই। যেমন, আমি যখন জানালা খুলে তাকাতাম গাছের পাতারা আমাকে বসন্তের খবর দিতো, একটা পাখি ছিলো কালো সাদা মেটে রঙ এর সংমিশ্রণে। আমি ওর নাম জানতাম না। ওকে আমি দৃপ্ত বলে ডাকতাম ও আমাকে বৃষ্টির খবর বলে দিতে পারতো। আমি তো অবাক! সবাইকে অকস্মাৎ চমকে দিতাম আজ বৃষ্টি হবে জানিয়ে। একদিন ও আমাকে বললো ও নাকি প্রেমে পড়েছে। আমি বললাম একটা কথা বলবি ?
দৃপ্ত বললো, হ্যাঁ। তোর প্রতি আমার নিশ্চয় অধিকার আছে। ও বললো, আছে। আমি আশ্বস্ত হয়ে বললাম ভালোবাসা ছেঁড়ে দে। ও তেড়ে গিয়ে বললো সব পারবো তোর এটা মেনে নিতে পারবো না। যা তুই প্রেমের সাগরে ডুব দেয়। আমার ওসবের মধ্যে বিশ্বাস নেই। আমার ভালোবাসা হল। এই যে, একা একা পাখির সাথে কথা বলা আমার কাছে অসাধারণ লাগে এবং আলাদা। কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখলাম সবাই সবার থেকে আলাদা। সবাই তাঁর নিজস্ব চিন্তা ভাবনায় চলে। প্রতিটা মানুষের মধ্যে ভিন্নতা আছে, আলাদা করে ভিন্নতার অভিনয় করতে হয় না।
আমি লক্ষ্য করেছি, আমি কেমন যেন ভালোবাসতে ভয় পাই। ভালোবাসা আমার জন্য অপরাধ। মনে হয় কষ্ট পাবো। আমাকে যদি আমি সব কষ্ট থেকে দূরতম দ্বীপে রাখতে পারতাম। এই প্রার্থনায় বারবার আমার আত্মাকে সপে দেই সৃষ্টিকর্তার কাছে। প্রার্থনার শরীর নিয়ে।
প্রতিদিন কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে আদিত্য নামের একটি ছেলে। প্রেমপত্র নিয়ে। ওর প্রেমপত্রটি খুব পড়তে ইচ্ছে করে, কিন্তু আদিত্য দিতে সাহস পায় না। আর পড়াও হয় না। আমাকে আমি লুকিয়ে রাখি সব সময় সবার আড়ালে কিন্তু আদিত্য যখন কলেজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অণু বলে ডাকে তখন আর আমাকে লুকাতে পারি না। মনের দেয়াল ভেঙে উঁকি মারতে চায় বারবার আদিত্যের দিকে।
আমার নাম কলেজের সবাই জানে অনুপ আহমেদ অজয়। কিন্তু কেমন করে যেন আদিত্য আমার ঘরের খবর নিয়ে নিয়েছে। কারণ বাবা আমাকে ডাকতো অণু বলে। এই ডাক শুনলে এক ধরণের মায়া জালে আটকে যেতাম। মানুষের কোথা থেকে যেন স্পর্শ আসে। জড়িয়ে ধরে সমস্ত মনের পিণ্ড। চিমটি কাটে। গল্প বলে। নোকিয়া মোবাইলের মত সাপ খেলা করে মনের ভিতরের গহীনে। আমার নিজের মধ্যে আদিত্যের জন্য একটা জায়গা রয়েই গেল গোপনে।
আদিত্যের চোখ অনুবাদ করলে পনের রীমের কাগজ ভরে যাবে, যাতে শুধু লেখা থাকবে অণু, অণু এবং অণু। চোখ অনুবাদ করার তত্ত্বটা শিখেছি একদিন বিকেলে। দিন শেষে বিকেল নতুন একটা রূপ নিয়ে আসে। বিকেল আড্ডায় বসে রাতের আয়োজন করার অপেৰায়। আমি যত্ন করে একটি বিকেল পার করলাম অনুবাদ করার চেষ্টায়। সেই থেকে এই তত্ত্বটি আমার মধ্যে খুব ভালো করে ঢুকে গেল। এখন যা কিছু দেখি তাকেই অনুবাদ করতে ইচ্ছে করে। প্রথম এই থিওরিটা কাজে লাগিয়েছিলাম মাকে দিয়ে। আমার মা অনিতা। উনি কোন ব্যাপারে খোলাখুলি বলেন না। একটু কিছু হলেই ঘামটি মেরে বসে থাকেন। তাকে বোঝা বড় কঠিন তাই পরপর দুই সপ্তাহ তার উপর পরীক্ষা চালিয়ে অনুবাদ করতে সার্থক হয়েছিলাম। পরীক্ষার একসময়ে আমার মধ্যে জন্ম নিলো আরেক তত্ত্ব আমার আমি, সাহিত্যিক ব্যক্তিরা তার নামকরণ করেছে বিবেক। যার অনেক উপাদান জড়িয়ে আছে আমার ভাইয়ার মধ্যে। কোন অন্যায় আসলেই ভাইয়া বেড়িয়ে পড়ে স্বদেশের জন্য, হরতাল, মিছিল ও মিটিং করে। আমি এই সব ভাঙচুর থেকে নিজেকে আলতো করে সরিয়ে নিতাম। ভাইয়াকেও সরিয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম।
২.
আজ রাতের আকাশে তাঁরা বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোন জোছনা নেই। তারপরেও অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আকাশ। আগে থেকেই আমি একটা পাগলামি পুষতাম। একেকটা তাঁরাকে ভিন্ন ভিন্ন নাম ধরে ডাকতাম। আজ অনেকটা বিব্রত হচ্ছি কারণ চিহ্নিত করতে পারছি না চেনা তাঁরাগুলোকে। এর মধ্যেই হঠাৎ ধরা পড়লো নিশু নামে একটা তাঁরা। ওকে যতবার দেখি ঘুমের নেশা চেপে বসে দেহে। ওর পাশে যে তাঁরাটা ওকে ডাকি শর্মা বলে। ওর মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাই। এক রাতে, ঘুম ভাঙলো বিশ্রী বিশ্রী স্বপ্ন দেখে, সোজা দেঁৗড়ে ছাদে গেলাম শর্মাকে দেখতে। ওকে দেখে আমার সব ভয় পালিয়ে গেল। অথচ পাশের রুমে মা-বাবা শুয়ে আছে তাদের প্রতি ভরসা ছিল না। আমি রাতের পর রাত কাঁটিয়ে দিতে পারি তাঁরাদের সাথে গল্প করে। মনে হয় তাঁরারা আমার জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধু। আমার ভাইয়া আমাকে তাঁরা ভালোবাসার জন্য অনেকবার উপহার দিয়েছে। সে বলে, ক্ষুদ্রকে ভালবাসলে নাকি অনেক বড় হওয়া যায়। চাঁদের তুলনায় তাঁরা কত ক্ষুদ্র কিন্তু ভাইয়া বোধ হয় জানে না তাঁরা চাঁদেরও বড় কিন্তু দুরুত্বের কারণে ছোট দেখায়। আমার এই স্বভাবগুলো হয়তো বয়সের অনুভূতির খেলা। ভালো একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে ভালো হত। আবার ভাবলাম ভালোই তো লাগছে। যেখানে কোথাও কোন কূল নেই শুধু দূর থেকে দূরে ছুটে যাওয়া, আর ছুটে যাওয়া, অনাবিল আনন্দে ছুটে যাওয়া। এই জীবনই আমার আনন্দের জীবন।
৩.
আমি বেশির ভাগ সময়ই বাসায় একা থাকি। মা স্কুলে, বাবা অফিসে ভাইয়া স্বাধীনতা শব্দের পেছনে। আমাদের পাশের বাসায় থাকেন হানিফ উদ্দিন খান। রাজনীতি করেন। আমার ভাইয়া তার চোখের কাঁটা। বাবাকে মাঝে মাঝে বোঝাতে আসেন। বাবাও বোঝায়, কিন্তু ভাইয়াকে তার জায়গা থেকে একটুও নড়তে দেখিনি। আমিও বুঝাতাম লাভ হত না। মাঝে মাঝে হানিফ চাচা বাসায় চা খেতে আসতেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, কখনো কখনো সেই হাত লাজ লজ্জার মাথা ফাটিয়ে আমার কোমরের কাছে চলে যেত। আমি খুব বিব্রত হয়ে উঠতাম। হানিফ চাচা আমার চোখের মুখের এমনকি আমার ঠোঁটের প্রশংসা করতেন। আমি বিব্রত হয়ে রুমে চলে যেতাম। দরজা লাগিয়ে আয়নায় আমার রূপ দেখে আমিই মুগ্ধ হতাম। উজ্জ্বল চোখের দূতি, ঠোঁট যেন মনে হয় আমিই চিবিয়ে খাই। হানিফ চাচা বেশি বেশি বাসায় আসা শুরু করলো। আমি নিজেকে একটু আড়ালে রাখতাম তাকে দেখে। আগে ভালোই লাগতো, ভাইয়াকে বোঝাতে আসলে। আজকাল মনে হয় নিজেকে মোগলাই পরোটা আর হানিফ চাচা পুরানো ঢাকার ক্রেতা।
৪.
অনেকদিন জানালাটা খুলি না আলসেমিতে। আজ খুলতেই দৃপ্ত হাজির। আমি ডাকলাম ও পাখি, তুই, কেমন আছিস? ও কিছু একটা বললো, বুঝতে পারলাম না। ওকে দেখে ওর ভালোবাসার কথা মনে পড়লো। আর হঠাৎ আদিত্যের নাম উচ্চারণ হল দেহেতে। আমি আমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম অনেক সময় ধরে। হানিফ চাচা নিজের শেষ বয়সে এসে নিজেকে লোভীর মত উপস্থাপন করে আর আদিত্য ভালোবাসার বস্তু হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চেষ্টা করে মরছে। প্রতিপ্রহর নিজেকে লুকিয়ে রাখছি পশুর হাত থেকে এই একইরকম আমার স্বদেশও তো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা তা একবার চিন্তা করছি না। খুব অবাক লাগে আমিও আমার স্বার্থ দেখছি। ভাইয়া সচেতন হয়ে বিপ্লবের পথে যাচ্ছে আর আমি কোন পথে যাচ্ছি। তাহলে ভাইয়া সঠিক আর আমরা কি ? এখনো আমি জানি না। আমরা অথবা আমি কোন পথে যাচ্ছি? ঘরের বাইরে গেলেই আন্দোলন মিছিল, মিটিং, বেঁচে থাকার দাবী, ভাতের দাবী, শিক্ষার দাবী, চাকরীর দাবী ! আমরা সব কিছু থেকে বঞ্চিত ! না, এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। তাহলে কি করবো ! প্রতিবাদ করবো, নাকি মুখ বুঝে সহ্য করবো ! এই ভাবনার ঢোল পিটিয়ে পিটিয়ে গরম হয়ে আসতে শুরু আমার ভেতর। এক পর্যায় ক্লান্ত বিছানায় দেহ এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণেই ঘুম...
৫.
অনেকদিন হল সবাই একসাথে সারাক্ষণ থাকছি। অফিস, স্কুল ও কলেজ সব বন্ধ। রাস্তায় বেরুলেই হরতাল, মিছিল, ধর্মঘট যেন পদ্মার ঢেউ ছুটে আসে গায়ের উপরে। সমস্ত শহরটা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। এই সুবিধার্থে আমি সবার সানিদ্ধ্যে পাচ্ছি। অথচ ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে এই আনন্দের পেছনে পেছনে। আমরা কেউ খবর রাখিনি। হঠাৎ রটে গেল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলছে। মুহূর্তে মধ্যে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। ঢাকা স্টেডিয়াম হল যুদ্ধক্ষেত্র। সবার মুখে ভেসে ওঠে 'বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো' তাদের সবার কণ্ঠ মিলিয়ে একটি কণ্ঠে বেজে ওটা সেই ধ্বনি সবার হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা খেল। এই যুদ্ধের একজন যোদ্ধা আমার ভাইয়া। ওর মুখেই সব শোনা। ওর কথা শুনে আমার মধ্যে একটা আত্মপ্রত্যয়ের নকশা তৈরি হল। বাঁচতে হলে সংগ্রাম করতে হবে। ভাইয়াকে উৎসাহ দিতে লাগলাম।
আজ বিকেলের আকাশে দ্রোহের তাঁরা উঠেছে আমি ওকে দীপ্র বলে ডাকি। ওর দিকে তাকালে গায়ে আগুন জ্বলে উঠে। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। আমার বুক ফুলে উঠে। আমার মধ্যে ক্রমে ক্রমে বিপ্লব জেগে ওঠছে। আমি আমাকে হারাতে বসেছি। হঠাৎ করেই নতুন আমি তৈরি হচ্ছি। হাতের ভিতরেও হাত আছে, চোখের ভিতরেও চোখ, মনের ভিতরেও মন, দেহের ভিতরেও দেহ। তুমি কোন চোখে, কোন দেহে, কোন মনে, কোন হাতে আমাকে কখন কাজ করায় তা নির্ভর করে বিবেকের উপর।
আজ মেঘলা আকাশ, ঘন অন্ধকার শোকের ছায়া ঘিরে আছে আমাদেরকে। চারিদিকে আন্দোলনের ঝড়। বাসায় আম্মা খিচুড়ি রান্না করেছে। সবার মধ্যে কেমন যেন ফুরফুরে ভাব কেন জানি, বুঝতে পারছি না। মায়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম আজ বাবার জন্মদিন। আমরা সবাই আজ খুব আনন্দ করবো। ভাইয়া আর তার বন্ধুরা দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে মিটিং করছে বাসাতে বসেই। শেখ মুজিব ঘোষণা দিয়েছে তাদের স্বপ্নের দেশ গড়ায় শপথ নিয়ে লড়তে হবে। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ যেন আকাশ ফেটে পড়ছে শহর জুড়ে। যার যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাপিয়ে পড়ার ডাক। মুক্তির ডাক, স্বাধীনতার ডাক। আমাদের বাসায় জন্মদিনের আনন্দ। ভাইয়া আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আজ সুন্দর করে বাবার জন্মদিন পালন করবো। ভাইয়া বন্ধুরদের দাওয়াত করলো তার দু'টি উদ্দেশ্য কিভাবে আন্দোলন করা যায় তা আর এর মধ্যে বাবার জন্মদিন। মা আর একটু বড় করে আয়োজন করলো হানিফ চাচাকেও ডাকা হল। চাচা এসেই মুখের অবস্থা বৈশাখের মেঘ করে রাখলো। মনে মনে তার অসতিত্বের রক্ষা করার চিন্তায় ডুব সাঁতার কাটতে ছিলো। সব মিলিয়ে আমাদের ছোট মধ্যবিত্ত জন্মদিন শেষে আমরা সন্ধ্যার চাঁদের আনন্দে ডুব দিলাম। অনেকক্ষণ চাঁদের সাথে আড্ডা। তারপরে আমার মেয়ে বেলার পুতুল বের করলাম। ওর নাম প্রবাজন। ওর আজকে বিয়ে দেবো ভাবছি। এই সব মিলিয়ে আজকে, আমার শরীরের প্রতি ভাঁজ থেকে আনন্দ আর সরে যাচ্ছে না একটুও...
৬.
ভাইয়া আজকাল বাসায় ঠিকমত খায় না। শরীরটা কেমন যেন হয়ে গেছে। আমাদের পাশের বাসার লোভী চাচাটাও এখন আর তেমন দেখছি না। তার তাকানোর ভঙ্গিমা দেখলে মনে হয় আমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে পারতো তবেই তার শান্তি।
শহর জুড়ে কালো ছায়া নেমে আসতে লাগলো। সবাই কেমন যেন গম্ভীর। আলোহীন হয়ে পড়ছে ঝড়ের আগেকার মুহূর্তের মতো। নিজের সবটুকু শক্তি বিসর্জন দিয়েও সুখ ফিরে পাচ্ছি না। কেমন অচেনা জগতে হারিয়ে যাচ্ছি...
শর্মটার খবর নিতে গেলাম আজও ওর চেহারা মেঘে ডাকা। অনেক আগে থেকেই মেঘ আমার শত্রু আজ আবার নতুন করে ধরা দিল। কিন্তু বৃষ্টি আমার অতি মাত্রায় প্রিয় তাই একটার আনন্দে আরেকটা ভুলে যাবার মহড়া হতে থাকে মনের গহীনে। বৃষ্টিকে আমার অনেকটা উৎসব মনে হয়। যেন এলাকা জুড়ে ওদের আনন্দ মিছিল ছুটে যায়। সমস্ত শহরে বৃষ্টির দখল। হঠাৎ করে দখল শব্দটি আমি মেনে নিতে পারছি না। দখল! না, দখল না। আমরাই সবাই স্বাধীন থাকতে চাই। নিরেট স্বাধীন। প্রতিটি মানুষের মধ্যে স্বাধীন থাকার ইচ্ছা। আমার দৃপ্তের মত পুষে রাখে অথবা ওর চেয়ে আরও গভীরে জড়িয়ে থাকে মিশে থাকে স্বাধীন ভাবে বাঁচার প্রত্যয়।
বাবা বারান্দায় বসে ঝিমুচ্ছেন। যেন কোন আধমরা পৃথিবীর জলে ভেসে সবাই কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের মধ্যে নিজেই খুন হচ্ছি বারবার। আমাকে ছুঁয়ে দেখি আমি পাথর আমার ভাই সূর্যের আলোর রশ্মি গায়ে মেখে দৃঢ় হয়ে উঠছে। এক দূরতম প্রদীপকে চিনিয়ে আনার প্রত্যয় নিয়ে। আজ আদিত্য এসেছিল গেটের সামনে একটু দেখার জন্য। আমি ওর চোখ অনুবাদ করে পাই ভালোবাসা আর একটু দেখার তৃপ্তি। আর যতবার হানিফ চাচার চোখ অনুবাদ করতে যাই দেখি মাংস চোষা ঠোঁট। শকুনের মতো চেয়ে থাকা।
প্রতিটি মানুষের মাঝখান থেকে ভাগ করা। মানুষের এক পাশে স্বাভাবিক জোড় থাকলেও আর এক পাশে থাকে খানিকটা দুর্বল। যেমন ডান হাতে জোড় বেশি থাকলে বাম হাতে কম, বাম চোখে বেশি থাকলে ডান চোখে কম দেখে। এই রকম প্রতিটি অঙ্গের ক্ষেত্রেও ঘটে। প্রকৃতির মধ্যে তাকালে আলো ও অন্ধকার দুটো দিক। এই রকম আদিত্য ও হানিফ চাচার পার্থক্য। মনে মনে হয়তো আদিত্যকে ভালোবেসে ফেলেছি। না, কি হয়েছে বুঝি না। অনেক সময় নিজেকে বুঝতেও খুব কষ্ট হয়।
৭.
আজকের আকাশে আলো নেই। পৃথিবীকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। আমার আঙ্গুল পর্যন্তৱ পাথর হিম। চোখ দিয়ে অবিরত পানি ঝড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এক চিলতে রোদ জনালার ভাঙ্গা অংশ দিয়ে এসে সব উল্টো পালট করে দিলো। এখন আর চোখ থেকে পানি পড়ছে না। রক্ত পড়ছে মাথা থেকে। আমি আর অবাক হচ্ছি না রক্ত দেখে। অবাক হচ্ছি আমার ক্ষুধা লেগেছে টের পেয়ে। হাত তুলে দাঁড়াতে পারছি না চোখে ভাসছে হাজার হাজার মানুষ দৌঁড়াচ্ছৌড়াচ্ছে। চিৎকার করছে 'বাঁচতে চাই' বাচাও...বাঁচাও ...
আমার প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুক ফেটে ঝড় আসতে শুরু করল আর থাকতে পারছি না। মা কে ডাকবো। মা কোথায়? অকস্মাৎ অনুভব করলাম আমার গায়ের উপরে ড্রেসিং টেবিল এসে পরে আছে। হাত পায়ে জোড় পাচ্ছি না। নিজের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে টেবিলটা সরিয়ে চোখ তুলে তাকালাম। ঘরের দিকে।
এই ঘর আমাদের! এইখানে আমরা থাকতাম। নাকের মধ্যে বাতাসে ভেসে আসছে রক্তের ঘ্রাণ। হামাগুড়ি দিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই চোখে পড়লো দু'জোড়া খোলা চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। আমাকে ডাকছে ... খোলা আকাশ দেখতে। প্রিয় মাতৃভূমি, আমার সারা শরীর এখন চিৎকার করে কান্না করতে চায় অথচ আমি একটুও কাঁদতে পারছি না। আমার কষ্টগুলো পানি হয়ে ঝরাতে পারছি না। কারণ আমার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। আমার শরীরে একদম শক্তি নেই। হঠাৎ করে ভাবলাম অনুভূতির জন্যও দেহে শক্তি লাগে। আমি জ্ঞান ফিরে পাচ্ছি। ক্ষুধা মিটছে না বলে এখনো কান্না করতে পারছি না।
আস্তে আস্তে সব মনে পড়তেছে কালরাতের অন্ধকারের অত্যাচার! নিকষ কালো অন্ধকার আমাদের চারদিক থেকে জড়িয়ে ধরলো, হঠাৎ আকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো দানবেরা হিংস্র অস্ত্র নিয়ে। মুহূর্তেই ঘরের মধ্যে লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেলো, ভস্ম হলো সমস্ত, বাইরে কেবল চিৎকার চেঁচামেচিতে ভড়ে গেলো শহর। কেউ রাতের আকাশ দেখার সুযোগ পাইনি সেদিন। আমার শর্মাটা হয়তো এই অমানুষিক নির্যাতনের প্রামন্যচিত্র একেঁছে ওর চোখে। সবটুকু পরিপূর্ণ বর্ণনা শুনতে হলে ওকে দরকার। আমি যতটুকু জানি তা এই, হঠাৎ করে চিৎকার গুলি ও বোমা ফোটার শব্দ, দরজার উপরে রাইফেলের পিটানো শব্দ। চারিদিকে নাশকতার শব্দে ভরে উঠলো গোটা শহর। মায়ের চিৎকার বাবার নিস্তদ্ধতা। আর ড্রেসিং টেবিল আমার শরীরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। আর বাকি সময়ে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে রেখে বঞ্চিত করেছে এই সব দৃশ্যগুলো থেকে। দৃপ্ত কি এসেছিল আমাদের এই অসময়ে কষ্টের ভাগ নিতে। আর ভাইয়াই বা কোথায় ওরা তাহলে ভাইয়াকে নক্ষত্র করে দিলো, বাবা মায়ের মত। আমি এই সব কিছুই মানি না। আমি এই সব দৃশ্যগুলো স্বপ্নে দেখতেও রাজি হবো না। আমি ফিরে পেতে চাই আগের সকাল; আগের বিকেল; আগের স্বপ্ন। মা-বাবা, ভাইয়া, শর্মা, দৃপ্তি ও দীপ্র তোরা কি আমাকে ছেড়ে চলে গেলি। আদিত্য কি বেঁচে আছে। কি কোমল স্বপ্ন ছিল আদিত্যের। আহা আদিত্য তুমি কোথায়? বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তুমি বলোনি, তাই আমিও বলিনি। আমার প্রবাজনের বিয়ে দিবো ভাবছিলাম ওর বিয়েটাও কি আমি দিতে পারবো না। আমি এখন কোথায় যাবো। কার কাছে যাবো? আমি শূন্য হয়ে গেলাম গোটা শহর নিয়ে।
হঠাৎ আকাশে তাকাতেই দীপ্র। দীপ্র তুই এই দিনের বেলায় আমার কাছে। দীপ্র, আমি নিঃস্ব। হ্যাঁ বুঝতে পারছি বল আমাকে বল... কি! তুই আমাকে প্রতিবাদ করতে বলছি। আমি প্রতিবাদ করবো। একজন পাকসেনার এক ফোটা রক্ত আমি হাতিয়ে নিতে পারলেও আমি অনুপ, আমি মানুষ, আমি বাঙ্গালি এই পরিচয়টুকু দিতে পারবো পরপারে গিয়ে। হঠাৎ করেই প্রেরণা যোগালও একটি কণ্ঠ যে উচ্চারণ করেছিলো 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
কিন্তু আমি কার কাছে যাবো। আদিত্যের কাছে। হাঁ, আমি আদিত্যের কাছেই যাবো। নিজেকে খুব কষ্টে উঠিয়ে নিলাম। মা কে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করতেছে বাবাকেও অথচ আমি কি নিষ্ঠুর আগে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পানি খাচ্ছি। মায়ের মৃত দেহ যেন আমার কাছে তুচ্ছ। অথচ নিজের শরীরের মধ্যে মায়া উপচে পড়ছে। আমার ভালোবাসা ঘর জুড়ে লাফালাফি করছে। তবু মা_বাবাকে উপেক্ষা করে শরীর থেকে জমাট বাধা রক্ত পরিষ্কার করে নিলাম। দুই জোড়া মৃতচোখ আমার দিকে তাকিয়ে। স্বাধীনতার চেতনার সূর্যের আলো মেখে গায়ে। আমি ছুটলাম আদিত্যে দিকে। দরজা ফাঁক করতেই আলো ছুটে আসলো; পুরো ঘরটা দখল নিতে।
উদ্দেশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল। অনেক পথের পর হঠাৎ চোখ পরলো মহিলা হলের দিকে। আমার চোখ এখন অন্ধ। আমি আর পৃথিবী দেখতে চাই না। তারপরও আমাকে দেখতে হলো পথের লাশ। তারপরেও দেখতে হলো হলের ছাত্রীদের বস্ত্রহীন ক্ষত-বিক্ষত দেহ। কারো কারো জরায়ু ছিঁড়ে রক্ত ঝরছে। স্তনে নখের আঁচর। আমারা সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুইপার তাদের মৃত দেহ।
আমি ডেকে এক সুইপারকে বলেছিলাম, এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওদের। একটু ঢেকে নিয়ে যাও না কাপড় দিয়ে। ওদের একজন বলেছিলো, আমার চাদর একটা; কয়টা মেয়েকে ঢেকে নেবো বলো। ওদরে উপরও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পশু। যৌনতা রেখে ওদের মাংস খেয়ে ছিল সেদিন পশুগুলো।
আমাকে আগাতে বারণ করলো এক সুইপার সামনে নাকি মৃত মেয়েদের দেহ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সবাই। আমি ঘৃণা শব্দটি আর এখানে ব্যবহার করতে পারলাম না। ওরা সেই সীমানা পার হয়ে গেছে আগেই। আমি পেছনের দিকে ফিরে আসতে শুরু করলাম আমাকে বাঁচতে হবে পশুদের থেকে।
হঠাৎ করে হানিফ চাচার বাসার কথা মনে পড়লো। সবার এই পরিণতির পরেও তিনি ওই দলে যাবেন না, মানুষ এত নির্মম হতে পারে না; আমার বিশ্বাস। হানিফ চাচাকে সাথে নিয়ে আমার রুক্ষে দাঁড়াতে হবে একটি চেতনার মশাল নিয়ে আমি একটি পতাকা উড়াবো; এই দেশে। ভাইয়া, এই অত্যাচারের বিপক্ষে সংগ্রাম করেছে, মিছিল করেছে আমাকেই করতে হবে আমার ভাইয়ার হয়ে। আমি একটি পতাকা উড়ানোর জন্য একটি মিছিলের সাথে সাথে যাবো। অনুপ্রেরণা হবো মুক্তিবাহিনীর।
হানিফ চাচার বাসায় যেতে হবে; খুব কষ্ট হলেও। আস্তে আস্তে হানিফ চাচার বাসার দিকে যাচ্ছি। হানিফ চাচা ছাড়া এই মুহূর্তে কেউ নেই আমার। গেট খোলাই ছিলো দ্রুত ঢুকে পড়লাম। ভেতর থেকে মানুষের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বোধহয় হানিফ চাচা বেঁচে আছে। আগাতে আগাতে হঠাৎ শব্দ হলো গেট আটকানোর। আমার শরীর থেকে কি যেন ছুটে গেল আকাশে; এখানেই আমার মৃত্যু হবে নির্ঘাত। দ্রোহের তাঁরা দীপ্র কে সাথে নিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরের দিকে। আমার অবস্থান হানিফ চাচার বাসার ড্রয়িং রুমের দরজার আড়ালে। আমি শুনতেছিলাম হানিফ চাচার কথা সে বলছিলো, এই এলাকার মিশনের সকল নকশা তার হাতে করা এই সব বিষয়ে। আমাকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। আমার দুরন্ত হাত ছুটে গেল হানিফ চাচার দিকে হঠাৎ চোখে পড়লো একটা লোহার দণ্ড। তাই হাতে নিয়ে ঘাড়ের দিকে বসিয়ে দিলাম আঘাত আমার সবটুকু জোড় দিয়ে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতেই পেছন থেকে ছুটে আসতে থাকলো বুলেট। আমি এখন হানিফ চাচার রক্তে পিট ভেজা দেখছি। দুটো গুলি আমার কোমরে মধ্যে এসে বসে পড়লো। হঠাৎ করেই আমি চোখে কম দেখতে লাগলাম।
সমস্ত শক্তি আমার থেকে চুষে নিলো বুলেট দুটি। গা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম অনন্তদের ঘুমে। আমার অবস্থান এখন, দুই জায়গায়। দেহ পৃথিবীতে একদল শকুনদের সামনে আর আত্মা সৃষ্টি কর্তার কাছে। এরপর থেকে আমি অবাক! চোখ দিয়ে আমি আগের চেয়ে বেশি দেখতে পারছি; কান দিয়ে আমি আগের চেয়ে বেশি শুনতে পারছি। অথচ আমি মৃত। কথা বলতে পারছি না, চোখ নাড়াতে পারছি না। সৃষ্টিকর্তা আমার চোখ যে দিকে ফেলছে, তাই দেখছি। উঠে দাঁড়াতে পারছি না, শ্বাস নিতে পারছি না এতেই প্রমাণ হয় আমি মৃত। মৃত চোখ দিয়ে আমি শকুনদের দেখছি। বাবা-মা তো এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল; তাহলে মৃত হবার পর বাবা মা দেখেছে আমাকে। হানিফ চাচা বলে উঠলেন এমন সুন্দরী খাসা-মালকে মেরে ফেললেন। কত দিন দিলে রস লাগাই না। তার উত্তরে একপাক সেনা বললো, নেহি পরভল্যাম। সব ঠিক হোগা। ম্যা এ লারকি কা রস লে গা। সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে আমি দেখছি আমার মৃতদেহ নিয়ে ওদের মাংস চোষা উৎসব।
আমার তাঁরাগুলোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। মৃত অবস্থায় ওদের দেখতে কেমন লাগে। আমার আদিত্যই বা কেমন আছে। ও কি দেখলে আমার এই অত্যাচার সহ্য করতে পারতো।
দেহটা নিয়ে ওরা মেতে উঠেছিল। দানবের হাত ব্যস্ত হয়ে উঠলো আমাকে বস্ত্রহীন করার জন্য। আমার মৃত দেহটি এখন বস্ত্রহীন। আমার শরীরের দুর্গন্ধ ঘাম ওরা চেটে খাচ্ছে। এর আগের রাতে আমার শরীর ইঁদুর চেটে খেয়েছিল ড্রেসিং টেবিলের নিচে থাকা অবস্থায়। আমার শরীরটা যেন মোরগ-পোলাও টানা পনের মিনিট হলি খেলা শেষ করে; এই মাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি শুধু দেখতে পাই, শব্দ শুনতে পাই কিন্তু ওর অন্তবাসের নিচের দণ্ডটির আঘাত আমি অনুভব করতে পারি না। দানবটা এক শকুনকে বললো-এ বহত খাসা মাল হ্যাঁ। টেস্ট দ্যাট। শকুনটা ছুটে আসলো মুহূর্তেই। এই শকুনের দন্ডের আঘাতে আমার জরায়ু ছিঁড়ে গেছে। আমি রক্তাক্ত। অনুভূতিহীন। মৃত লাশ। কিন্তু আমাকে দিয়েও যৌনতা পূরণ। এরা এক এক করে আসতে শুরু করলো দানব; শকুন; শিয়াল। কিন্তু হানিফ চাচা যে এই দেহ পাবার জন্য কত ঘুরেছে। সে আসছে না যে। হঠাৎ মনে হল যে এই দেহের জন্য কত আশা করতো সে কি নেবে না এই দেহ ঘ্রাণ। আমার শরীর এখন উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে অনেকেই সাহস পাচ্ছে না। সিনিয়র অফিসারের সামনে এ কাজ তারা করতে পারে না তারা ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
আধ ঘণ্টা পরে আবার বুটের শব্দ। লম্বা ফিটফাট এক যুবক পাকসেনা নিজেকে আড়াল করে ঢুকছে এই রুমে। তার চোখ দেখে মনে হয়েছিল কত দিনের যেন ক্ষুধার্ত। আমাকে তার মত করে অনেকক্ষণ ছিবড়ে খেল। আমার আদিত্য তুমি আমাকে একটু দেখার জন্য ছুটে আসতে বহু দূর থেকে; আমি সেই অনুপ। যাকে তুমি অণু বলে ডাকো। আমি এখন মৃত। আমাকে সবাই যে যার মত খাচ্ছে। তুমি এখন দেখতে পারো আদিত্য তোমাকে আমি অনেক ভালবাসতাম কিন্তু তুমিও আমাকে বলনি; আমিও তোমাকে বলিনি তাই ভালোবাসা আরও গভীর হয়েছে; কারণ গোপন ভালোবাসা গভীর হয়। ক্লানত্দ হয়ে ফিরে গেছে যুবক পাকসেনা। আমাকে বোধ হয় ওদের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু হানিফ চাচা কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। দীর্ঘ ১৯ বছর আমি আমাকে সবার আড়ালে রেখেছি। আমার জামার নিচে দেহের বিভিন্ন জায়গা বড় হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। হঠাৎ সব লুট হয়ে গেল। কিন্তু আদিত্য পেল না। আর আদিত্য পাবে না কেন? আমি হয়তো আদিত্যের মত কোন স্বপ্ন পুরুষের জন্য রেখে ছিলাম এই দেহ। আর হানিফ চাচা সেও তো অনেক সুযোগ খুঁজেছে। কই সে এত বড় সুযোগ হারালো। আমার দৃপ্ত আমাকে অনেক ভালোবাসতো। শর্মা ওরা আমাকে বাঁচাতে পারতো। হঠাৎ হনহন করে ছুটে আসলো কে যেন হানিফ চাচা! হ্যাঁ হানিফ চাচাই তো। আমার দিকেই আসছে আজকে আমার ওড়না সরে যাবার অপেক্ষা করতে হবে না তার। এখন সব খোলাই আছে। সে দেরি না করে তাড়াতাড়ি এই মৃতদেহের উপর চড়ে উঠলো। একবারও ভাবলো না আমি মৃত, এই দেহ আর ভোগের জন নয়। এ কোন ধরণের শকুন ওরা। হয়তো শকুন বললে, আমাকে শকুন জাতি অভিশাপ দিবে ওরা শকুনের চেয়ে খারাপ। তার দীর্ঘ দিনের আশা পূরণ করলো মাত্র ছয় মিনিটে। সারা গায়ের জড়ানো বীর্য যেন চুষে খেল হানিফ চাচা। নোংরা দেহ নিয়ে আমি এখন শূন্য হয়ে আছি।
৭.
আমার মৃত দেহের অবস্থান খোলা মাঠে। আমার দেহ থেকে প্রচণ্ড গন্ধ আসতেছে। এই কারণে হয়তো আমি এই মাঠে তা না হলে হয় তো আমি আরও কিছুৰণ ভোগের কাজে থাকতে পারতাম। আমার সারা দেহ বীর্যে বীর্যে ভরে গেছে। কখনো কোন কাক এসে আমার মৃত দেহের বুকের কাছে এসে বসে। কিন্তু কখনই আমার দৃপ্ত আসে না। ও হয় তো কোন নতুন তরুনী পেয়ে গেছে তাকে বৃষ্টির খবর দেয়, বসন্তের খবর দেয়... আমি তো মৃত আমার কাছে আসবে কোন সাপ অথবা জোঁক। আমার আর কবর হয়নি। আমি এখন খোলা মাঠের আকাশ দেখছি পৃথিবীর। কি সৌভাগ্য আমার মৃত হয়ে পৃথিবী দেখার। নয় মাস পার হয়ে গেল কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, কামার কুমার সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই আমার মত মৃত মানুষের প্রতিশোধ নেবার জন্য। আমার ভাইও এর মধ্যে ছিল কি না আমি জানি না। তবে আমি ঘ্রাণ অনুভব করলাম লাল সবুজ পতাকার। মৃত লাশের। অনন্ত পৃথিবী মধ্যে একটি বাংলাদেশ হলো। স্বাধীন বাংলাদেশ। যে দেশের মাটিতে এখন আমাদের মত তরুণী পচে মাটি হয়ে আছে।
৮.
আপনাদের দেশের প্রতিটি মানুষ এমন স্বাধীন হলো যে তারা ভুলে গেল মনুষ্যত্ব। প্রিয় মাতৃভূমি, আমি মৃত অবস্থায় ধর্ষিতা হয়েছি কিন্তু তুমি! স্বাধীন সজিবভাবে বেঁচে থেকে বার বার ধর্ষিতা হচ্ছো। তোমার গা জুড়ে শকুনের আঁচর। তুমি কেমন করে বাঁচবে ? আমার মৃতদেহ পচে গলে এই মাতৃভূমির মাটিতে মিশে গেছে। বর্ষার জলে ধুয়ে ধুয়ে আমি এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাই। তোমাদের মানবতার ধ্বংসলীলা দেখি। তোমরা স্বাধীন। আমরা মৃত। যারা স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং ছিনিয়ে এনেছিল তাদের কেউ কেউ এখনো ঘুরে বেড়ায়; খালি পায়ে; মেঠো পথ দিয়ে। হাতে দু'কেজি চাল লবণ অথচ আজ হয়তো হলুদ ছাড়া খেতে তাদের তরকারি। এই মাটির ঘ্রাণে তারা এখনো জেগে উঠে স্বাধীনতার চেতনার খুঁটি ধরে কিন্তু এ ভূমির বাতাসে কেবল দুর্নীতির পচা গন্ধ। আমরা মৃতরা খবর পাই তোমরা বাংলাদেশে যে স্বাধীনতার চর্চা কর তা শুধু আমাদের ঘৃণা করতে শেখায়। তোমাদের উঁচু উঁচু কেদারায় বসে আছে শান্তি কমিটির কুত্তারা।
প্রিয় স্বদেশ,
আমি অনুপ। আদিত্য আমাকে অণু বলে ডাকতো। আমার জীবন বৃত্তান্ত শুনলেন আপনারা। আমার মৃত দেহের ঘ্রাণ এখনো আপনাদের ভাসানটেকের খোলা মাঠের মাটিতে। ইচ্ছে করলেই শুঁকে নিতে পারেন চেতনার ঘ্রাণ। আমি মরার পরে ধর্ষিতা হয়েছি। কিন্তু আমাদের ধ্বংসের নয় মাসে; অনেক ধর্ষিতার চোখ আপনাদের দেখছে। চোখের জল ফেলতে পারছে না। কারণ মৃতদের চোখে জল থাকে না। তাই কষ্টগুলো নিজের মধ্যে পুঁতে রেখে পাথর তৈরি করছে। কোনদিন হঠাৎ আকাশের তাঁরাগুলো থেকে পাথর ধ্বসে পড়ে আপনাদের উপর তা বলতে পারছি না। যাদের রক্তে মাংসে এ দেশের মাটি তৈরি হয়েছে। আর সেই মাটির যত্ন আপনাদের কাছে শূন্যের কোঠায়। আমি আমার বাবা মায়ের লাশ ছুঁয়ে একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। কোন কোন মুক্তিযোদ্ধা তার স্বদেশের জন্য নিজেকে তুলে দিয়েছে অস্ত্রের মুখে। তাদের প্রতিটি লাশের বিনিময়ে আপনারা এখন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মাথা উঁচু করে রাতের তাঁরা দেখছেন। মাছের খেলা দেখছেন। কিন্তু স্বদেশকে ঠেলে দিচ্ছেন নতুন অন্ধকারের ধূমজালে। স্বদেশের মধ্যে সেঁটে দিচ্ছেন অন্যায়ের হাতিয়ার।
আমরা ধর্ষিতারা, আপনাদের দেশ খাওয়ার মহড়া দেখছি। আজ আপনারা সীমা লঙ্ঘন করতে যাচ্ছেন। একটি শকুনকে আপনারা মাথায় তুলেছেন। প্রিয় স্বদেশবাসী, যে হানিফ চাচা আমার মৃতদেহ ভোগ করেছে। সে এখন আপনাদের প্রণোদনায় জাতীয় পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের মাটিতে। আমি আপনাদের অভিশাপ দিচ্ছি, কারণ আপনারাও শকুনের দলে গিয়ে আপনাদের শকুন চেহারা হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের সমর্থনে মন্ত্রী হচ্ছে শকুন। যারা প্রতিনিয়ত আমাদের আঘাত করেছে। যারা এই রকম হাজার হাজার পরিবার ধ্বংস করেছে, যারা আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। যারা আমাদের আজন্ম শত্রু। যারা আমাদের ঠেলে দিয়েছিলো অন্ধকারে। সেই সব যুদ্ধাপরাধীর আমাদের শহরে; আমাদের রক্ত মাংসের মাটিতে প্রকাশ্যে ঘাড় উঁচু করে হাঁটছে। কিন্তু আপনাদের হাত ওদের ঘাড় মটকে দিচ্ছে না। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। আমি আমার গা থেকে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি প্রতিশোধ শব্দটি; প্রতিশোধে আমার গায়ে আগুন জ্বলে উঠছে। প্রিয় স্বদেশবাসী, ওরা আপনার বোনকে মৃত্যুর পরেও ছেড়ে দেয়নি। ওরা আপনার মাতৃভূমিকে শশ্মানঘাট তৈরি করেছিলো।
পিঁপড়ার মতো খুন করেছে মানুষ। সেই সব যুদ্ধাপরাধী আপনাদের উঁচু আসনে বসে রাজনীতির আলাপ করছে। আর একটি দিন; যদি ওরা প্রকাশ্যে হেঁটে বেড়ায়, তাহলে আমার অভিশাপে আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। আপনাদের মিনতি করে বলছি; প্রিয় স্বদেশবাসী, আমার মাতৃভূমির মাটির কসম; আপনারা বদলা নিন। এই সব শত্রুর বিরুদ্ধে যারা এই, মাটিকে রক্তে লাল করেছে। ধর্ষিতা করেছে। শর্মা, তুমি কোথায় ? তুমি তো সব দেখেছ। আমার স্বদেশের কাছে খুলে বলো। সেই সব স্মৃতি-কাহিনী। দৃপ্ত তুমিও তো সব জানো, এই পৃথিবীর এই মাটির দানবের দখলের কাহিনী। আমার স্বদেশ জানুক তাদের পেছন ইতিহাস।
আমি হাত জোড় করে বলছি। প্রিয় স্বদেশবাসী, তোমরা বদলা নেবে যুদ্ধাপরাধীর। তোমরা বিচার করবে তাদের। আকাশের সব তাঁরা তোমাদের কাছে বিচার চায়। মাটির ঘ্রাণ শুঁকে দেখ ওরা প্রতিশোধ বলে চিৎকার করছে। বধ্যভূমির থেকে প্রতিরাতে লাশেরা আবার জেগে ওঠে, মিছিল করে। বিচার চায়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাইবার জন্য সবার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও বলছি; তোমরাও বলো 'আমরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই'।