ঈদের বাজার অনেক ভীড় । কালু মিয়া আনমনে হাঁটছে ।হাতে বেশ মলিন একটি বাজারের থলে। কি কিনবে এখনো ভাবছে।পুরো শরীর ঘেমে একাকার। পরনের লুঙ্গীর নিচে একটি গিঁট দেওয়া। সম্ভবত দিন দুয়েক হল ছিঁড়ে গেছে। বেশ পুরানো শার্টের পেছন দিক ভাঁজ হয়ে উপরের দিকে অনেকটা উঠে গেছে। পিঠের দিকে কালো কালো বিন্দুর দাগ গুলো স্পষ্ট। মাথার চুল গুলো অগোছালো উস্কু খুস্কু হয়ে আছে। রেল লাইনের ধারে ভ্রাম্যমান সব্জি দোকানে স্তরে স্তরে সাজানো সব্জি দেখে কেনার ইচ্ছে জাগে কালু মিয়ার। এক কেজি শসার দাম জিগ্যেস করে দোকানীকে।দাম শুনে হতবাক হয়ে যায় কালু মিয়া। এক কেজী শসার দাম পঞ্চাশ টাকা !দেশটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেল নাকি। মন খারাপ করে অন্য দোকানের দিকে পা বাড়ায় কালু মিয়া। কোন কিছুই কেনা হয়না তার। বাজারের ব্যাগ হাতে থেকে যায়।দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। হন্য হয়ে এই দোকান থেকে সেই দোকানে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে পড়ে কালু মিয়া।ইফতারের সময় হয়ে আসে । হোটেল গুলোতে বাহারী ইফতার দেখে খেতে ইচ্ছে জাগে । কিন্তু পকেটের কথা ভেবে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখে সে।সামনেই পাইলট স্কুলের মাঠ। তার পাশে একটি গভীর নলকূপ । কালু মিয়া আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় স্কুলের বারান্দার পাশে। হাতের ব্যাগটি বারান্দার সামনে সিঁড়িতে রেখে কলের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নয়। কলের ঠাণ্ডা পানি প্রশান্তি এনে দেয়। পাশের মসজিদে মাগরিবের আযান হচ্ছে , কলের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ইফতার করেনিল কালু মিয়া। শরীরটা এখন বেশ চাঙ্গা লাগছে। মসজিদের মাঠে নামাজ পড়ে নিল গামছা বিছিয়ে।আল্লাহ পাকের দরবারে অনেক কিছু চাইবার ইচ্ছে হল , কিন্তু কি বুঝে কিছুই চাইল না কালু। আস্তে আস্তে আবার বাজারের ভেতরে ঢুকলেন । না এবার কিছু কিনতেই হবে। বাড়িতে রুপা’র মা বসে আছে তার জন্য।আর রুপার মাকে ঘিরে বসে আছে অনেকগুলো অভুক্ত মানুষ মানে তার ছেলে মেয়ে। এক দোকানে সামান্য কিছু পোকায় খাওয়া শসা মিলল বিশ টাকা কেজিতে,অন্য দোকানে কিছু বেগুন । পাশের গ্রামের রহম আলীর ছেলে প্রতিবারের মত এবার ও বেশ কিছু তরকারী দিল বিনামুল্যে। রহম আলীর ছেলের মনে অনেক দয়া । বাজারে তরকারির দোকান দিয়েছে বছর দুই হল। আগে বাজারে রুপাকে নিয়ে আসত কালু মিয়া , সেই সময় একদিন রহম আলীর ছেলে মনা’র সাথে দেখা । প্রথম দেখাতেই কালু মিয়াকে চাচা বলে সম্বোধন করে । এরপর নিজের দোকানের বেশ কিছু পুরানো সব্জি দিয়ে দেয় কালু মিয়ার ব্যাগে। এরপর থেকে যখনি বাজারে আসে মনা কালু মিয়াকে কিছু না কিছু দেয়। সেটা কি কালু মিয়া দারিদ্র বলে নাকি মনা মিয়া অন্য কিছু ভেবে দেয় তা বুঝতে পারে না কালু । নিজের দারিদ্রতা আর অসহায়ত্বের কাছে যুদ্ধ করতে করতে এসব ভাবার সময় নেই তার। ঈদের জন্য কি কিনবে ভাবে কালু। প্রতিটি দোকানের সামনে সাজানো সেমাই আর লোভনীয় প্যাকেট জাত পন্য দেখে সেগুলো কেনার ইচ্ছে জাগে। কি মনে করে এক দোকান থেকে এক প্যাকেট সেমাই কিনে নেয় কালু।দোকানি বলে উঠে সেমাইয়ের সাথে চিনি এবং দুধ ও কিনতে হয়। কালু মিয়া আবার চমকে উঠে। এক পোয়া চিনি আর মার্কস ব্র্যান্ডের ২৫ গ্রামের এক প্যাকেট দুধ ও নেয়। কারন কোন কিছু ইচ্ছে হলে তা অসম্পূর্ণ রাখতে নেই। হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরে কালু। *********************
রুপা’র উঠতি বয়স । তার বয়সী মেয়ে গুলো কত সুন্দর করে সেজে গুঁজে প্রতিদিন বিকালে গ্রামের রাস্তায় হাটতে বেরোয়। তাদের দেখে রুপার ও সাজতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তারা তো গরীব। রুপার বাবা বলে গরীবদের নাকি ওভাবে সাজতে নেই। রুপা একটি গ্রামীণ সংস্থায় কুটীরশিল্পের কাজ করে । বাঁশ দিয়ে তৈরি করে হাতপাখা, বাঁশের ছাটাই,বিছানা,মোড়া এবং অন্যান্য জিনিস। বিনিময়ে সামান্য কিছু টাকা পায়। সেই টাকা থেকে সামান্য সামান্য করে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছে। এবারের ঈদে নিজে একটি শাড়ী কিনবে বলে। রুপার বাবা অন্যের কাজ করে যা পায় তাতে তাদের সংসার চালানো দায়। রুপার চার ভাই এবং দুই বোন । বোন গুলো এখনো ছোট। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার নিয়ে থাকে। বাবা মা এমনকি ভাই বোনদের ও কোন খোঁজ নেয় না। গঞ্জের পাশের রাইস মিলে চাকুরী করে সে, বেতন ও ভালো পায়। রুপার মা অনেক গুলো সন্তানের জন্ম দিয়ে এখন একেবারে অসুস্থ।ঠিক মতো না খেতে পারায় শরীর কংকালের মত হয়ে গেছে। রুপার বাকি দুই ভাই গ্রামের মাদ্রসায় পড়ে । তাই তারা কোন কাজ করতে পারে না। রুপার এবং তার বাবার রোজগারে টেনেটুনে সংসার চলছে।পাশের গ্রামে মনা মাঝে মাঝে কাঁচের চুড়ি মাথার পিতা এনে দেয় চুপিসারে। রুপা কেন জানি মনা’কে উপেক্ষা করতে পারে না । ছেলেটা ভাল। গঞ্জের বাজারে তরকারীর দোকান আছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাব ও দিয়েছে। রুপা তার বাবাকে এমনবাস্থায় রেখে বিয়ে বসতে রাজী নয়। সে চায় তার ভাইয়েরা কেউ আয় রোজগার করুক তারপর না হয় বিয়ে বসা যাবে। মনা তাতে ও রাজী । ঈদের সময় মনা বলেছে এবার ছবি দেখাতে নিয়ে যাবে সিনেমা হলে। ঈদের বেশী বাকি নেই । রুপা ভাবে দুয়েক দিনের মধ্যে গঞ্জে যাবে । এছাড়া বাবা মায়ের জন্য ও কিছু কিনবে। আজ বিকেলে মনা দেখা করতে আসার কথা।কারন আজ রুপার বাবা কালু মিয়া বাজারে গেছে । তাই রুপা বেশ সেজেছে। কপালে লাল টিপ, বেনী করা চুলে লাল দুইখানি পিতা, নাকে বালা সেই সাথে মায়ের পুরানো একটি শাড়ী। স্কুলের পেছনের বাঁশ বাগানে মনার জন্য অপেক্ষা করে রুপা। এভাবে সেজে যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিল তখন রুপার মা বলেছিল সাবধানে থাকিস মা । একা একা বাঁশ বাগানে কেমন জানি ডর করতে লাগল রুপার। বাঁশবাগানের অন্য পাশে তখন গ্রামের বেশ কিছু বখাটে এই রোজার দিনে বসে বসে নেশা করছিল। তাদের কেউ একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পুকুরের পাশে এসে রুপাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে গিয়ে সকল কে বলে । সবাই তখন নেশায় ভুদ হয়ে আছে। সকলে এসে রুপাকে ঘিরে ধরে। রুপা তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবে তার ও কোন উপায় নেই। সকলে রুপাকে নিয়ে হাসি তামাসা শুরু করে । একসময় চার চারজন জোয়ান ছেলের লালসার শিকার হয় রুপা । বাঁশবাগানের গভীর জঙ্গলে তারা রুপাকে নিয়ে যায়। একের পর এক রুপাকে ভোগ করতে থাকে । অসহায় রুপা চিৎকার করে কিন্তু সেই চিৎকার গ্রামের মানুষের কানে যায় না । এক সময় রুপার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এবার সকলে ভয় পেয়ে যায়। রুপার শরীর তখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সকলে বেশ ভয় পেয়ে যায়। আর সেই ভয়ে তাদের নেশা কেটে যায়। সকলে তখন তাড়াহুড়া করে রুপা’কে তার পরনের শাড়ী দিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়। সেই সময় তারা মনা’কে দেখতে পায়।মনার আসতে আজ দেরি হয়।বাজারে রুপার বাবাকে দেখে তাকে কিছু সব্জি দেয় , তারপর দোকান বন্ধ করে শাড়ী কিনতে যায় । রুপাকে বাঁশবাগানে দেখতে না পেয়ে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে থাকে মনা । মনার হাতে একটা শাড়ীর প্যাকেট। মনাকে দেখে তাদের মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। সকলে মিলে মনাকে রুপার কাছে নিয়ে আসে, যেখানে রুপাকে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মনা রুপাকে দেখে চিৎকার করে উঠে তখন সকলে মিলে মনাকে মারধর শুরু করে চিৎকার চেঁচামেচি করে। তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন গ্রামের দিকে খবর দিতে ছুটে যায়। মনাকে বাকি তিনজন তার হাতের শাড়ী দিয়ে গাছের সাথে বেধে রাখে। ইতিমধ্যে গ্রামের লোকজন এসে জড় হয় সেই বাঁশবাগানে। তারা তিনজন বলে উঠে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় তারা রুপার চিৎকার শুনতে পেয়ে বাঁশবাগানে আসে । কিন্তু তারা আসার পূর্বেই মনা রুপাকে ধর্ষণ করে মেরে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে। মনা পালিয়ে যাবার সময় তারা হাতে নাতে তাকে ধরেছে। তার হাতে তখন লাল শাড়ীর প্যাকেট টা ছিল। মনা বোধহয় শাড়ীর লোভ দেখিয়ে রুপাকে ফুসলিয়ে বাঁশবাগানে নিয়ে এসেছিল। তার পর তারা মনাকে ধরে সেই শাড়ী দিয়ে গাছের সাথে বেধে রেখেছে । গ্রামের লোক এই কথা শুনার পর মনাকে বেদম প্রহার শুরু করে । মনা চেঁচিয়ে যতই বলে আমি কিছু জানিনা ক্ষিপ্ত গ্রামবাসী ততবেশী তার উপর চড়াও হয় এবং গন পিটুনির একপর্যায়ে মনা মারা যায়। মনার বাঁধন খুলে দিয়ে সেই শাড়ী দিয়ে মনার লাশ ঢেকে রাখে গ্রামের মানুষ বাঁশ বাগানের মাটিতে ।রুপার লাশ তখন ঝুলছে বাঁশ বাগানের মাঝে একটি গাছের মাঝে। এদিকে থানায় খবর যায়। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যাবে সেই অপেক্ষায় আছে গ্রামের সকলে। অন্যদিকে রুপার বাবা কালু মিয়া তখন বাজারের ব্যাগ নিয়ে গ্রামের পথ ধরে হেঁটে আসছে। পুলিশের একটি জিপ কালু মিয়াকে পাশ কাটিয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
রুপার লাশ তখন ঝুলছে বাঁশ বাগানের মাঝে একটি গাছের মাঝে। এদিকে থানায় খবর যায়। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যাবে সেই অপেক্ষায় আছে গ্রামের সকলে।
অন্যদিকে রুপার বাবা কালু মিয়া তখন বাজারের ব্যাগ নিয়ে গ্রামের পথ ধরে হেঁটে আসছে। পুলিশের একটি জিপ কালু মিয়াকে পাশ কাটিয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যায়। ......সুন্দর কাহিনী গল্পের বিবরনও ভাল....আমার কবিতার সাথে থিমটার সাদৃশ্য দেখে পুলকিত হলাম.....তোহিদুল্লা ভাই অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে.......
রোদের ছায়া
এর আগের কোনো এক সংখ্যাতে প্রায় এরকমই একটা গল্প লিখেছিলেন মনে হচ্ছে ........আপনার লেখায় গ্রামীন পটভূমি বেশ নিখুত ভাবেই ফুটে উঠে ...........ভালো লাগলো গল্পটি ...
মাসরুর মুস্তাফি
অসাধারন শাকিল ভাই, গল্পটি পড়বার সময় মনে হয়েছে আমি যেন ঐ বাঁশবাগানেই আছি, কাকভাঙা কোন বাঁশ কিংবা নিষ্পলক মস্ত আকাশ হয়ে সব কিছু অবলোকন করছি... মনের পর্দায় ওঠার মত জীবন্ত এক চিত্রকল্প.....
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।