একটি গ্রাম, শীত এবং কিছু জীবন

শীত (জানুয়ারী ২০১২)

sakil
  • ৬০
  • 0
  • ৭২

ভোর হতে তখন অনেক বাকি । চারদিকে সুমধুর আজানের ধ্বনী শুনা যাচ্ছে। রাতজাগা কিছু পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ নীরবতাকে ভেদ করে শুনা যায় অনেক দূর পর্যন্ত । চারদিকে ঘন কুয়াশার চাদর জেন জড়িয়ে রেখেছে প্রকৃতিকে । এই সময়ে ঘুম থেকে উঠতে কারো মনে চায় না । কিন্তু জব্বার আলী কে উঠতেই হবে । না উঠে উপায় নেই । বলতে গেলে পুরো বছরে এই সময়ে তার কাজ । এই সময়ে ঠিক মতো কাজ না করলে সারা বছর উপোস থাকতে হবে । তাই আলস্যে কে বিদায় দিয়ে উঠে পড়ল জব্বার আলী । সামনের পুকুরের পানিতে অজু করে বাড়ীর পাশের মসজিদে গেল ফজরের নামাজ পড়তে । ভোরে ফজরের নামাজ পড়ায় যে কত আনন্দ তা যারা না পড়ে তাঁরা বুঝতে পারবে না । নামাজ পড়ে সোজা বাড়ির ভেতরে মাচান থেকে বাশের তৈরি বাক্সটা রশি দিয়ে কোমরের সাথে বেঁধে খালি পেটে হাটা দিলেন চৌধুরী বাড়ীর দিকে।
রাস্তা কুয়াশায় ভিজে আছে । জব্বার আলি খালি পায়ে কুয়াশা মাড়িয়ে হেঁটে চলছেন অনায়াসে। ঠাণ্ডায় পায়ের পাতা গুলো চিমিয়ে গেছে । পায়ের এখানে সেখানে অনেক দাগ। নখগুলো মরে গেছে অনেকাংশে। তবু পথচলায় থেমে নেই জব্বার আলী । লক্ষ্যে যতদ্রুত সম্ভব চৌধুরীদের বাগান বাড়ি। এরপর যেতে হবে নজু মুন্সী , এরপর চেয়ারম্যান বাড়ি । সবশেষে হাটে। তাই চলার গতি বেশ দ্রুত। পরনে লুঙ্গি কাঁচা মারা শরীরে হাতাওয়ালা জাম্পার । এই শীতের সকালে তখন বেশিরভাগ মানুষ গভীর ঘুমে মগ্ন।
বড় রাস্তা পেরিয়ে চৌধুরীদের বাগানে তখন ও আধার খেলা করছে । জব্বার আলী গামছাটাকে শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে ধীরে ধীরে খেজুর গাছে উঠতে লাগল দক্ষতার সাথে। কোমরের পেছনের দিকে একটা আংটার মত । খেজুরের রসে ভর্তি হাড়ি সেই আংটার সাথে আটকিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলেন নিচে। এভাবে একটার পড় একটা গাছ বাইতে লাগলেন অনেক দ্রুত। বিশ মিনিটে প্রায় দশটি গাছের রস নামিয়ে আনলেন। এরপর নিজের ভাগ কলসিতে নিয়ে বাকী রস চৌধুরীদের ঘরের সামনে রেখে এলেন । এরপর এইভাবে নজু মুন্সী , চেয়ারম্যান বাড়ী সব জায়গায় রস নামিয়ে নিজের ভাগের রসটুকু নিয়ে ছুটলেন হাটে । সূর্য উঠার পূর্বেই হাটে যেতে হবে ।
প্রতি বছর শীত এলে এলাকার খেজুর গাছ ছিলেন জব্বার আলী । আজ আর তার নাম জব্বার আলী নেই । সবাই তাকে গাছি বলে ডাকে । সকলের ডাক শুনতে শুনতে নিজে কখন যে জব্বার আলী থেকে গাছি হয়ে গেছেন সেই কথা তার মনে নেই । প্রতিদিন বিকালে গাছে উঠে সামান্য ছিলে হাড়ি পেতে দিতে হয় , তারপর সকালে সেই রস নামাতে হয় । এত কষ্টের বিনিময়ে তিনি পান মাত্র অর্ধেক রস । রসের হাড়ি ও তাকেই কিনতে হয়। সেই অর্ধেক রস হাটে নিয়ে যান । সেখানে কাঁচা রস বিক্রি হলে কিছু পয়সা মেলে । আর বিক্রি না হলে বাড়িতে এনে সেই রস জ্বালিয়ে খেজুরের গুড় তৈরি করেন তার স্ত্রী রাহেলা খাতুন । পুরো বছরের কাজ বলতে এই । এছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে নারিকেল গাছ বেছে দেন । তাতে দুই একটা নারিকেল পান । তবে শীতের এই সময়ের রোজগারের উপর পুরো বছর সংসার চলে । তবে ইদানিং আর আগের মত রস মেলে না । আগে যেখানে প্রতি গাছে প্রায় এক হাড়ি রস মিলত সেখানে এখন মাত্র আধা হাড়ির মত মেলে । এছাড়া পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা রাতের বেলা রস নিয়ে যায় । অনেকে আবার হাড়ি ভেঙ্গে দেয় । কিন্তু তিনি গরিব বলে কাউকে কিছু বলতে পারেন না । সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করে যান নিরবে।

পহেল এবার জেদ করেছে গ্রামের বাড়ি যাবে । কিন্তু তার মা কিছুতেই রাজী নয় । শহরের ছেলে গ্রামে গিয়ে কি বিপদে পড়ে তার কি কোন ঠিক আছে । তাই তিনি চাননা তার একমাত্র ছেলে গ্রামে বেড়িয়ে আসুক । এই নিয়ে পহেলের মা পহেলের বাবার সাথে বেশ কথা কাটা কাটি করেন । তাতে লাভের কিছুই হলনা । বরঞ্চ বাশার সাহেব ছেলের গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে মত দিয়ে দিলেন । বাশার সাহেব গ্রাম ছেড়ে শহরে আছেন আজ দীর্ঘ দিন। গ্রামের সাথে তেমন কোন যোগাযোগ তার নাই। একমাত্র বিধবা বোন গ্রামে থাকে তাদের বাড়িতে । ছেলে যখন জেদ করেছে , ঘুরে আসুক কয়দিন গ্রামে ভাবলেন বাশার সাহেব।
পহেল গ্রামে যাবার ব্যাপক প্রস্তুতি নিল । গরম কাপড় জ্যাকেট হাত মৌজা কোন কিছু নিতে ভুলল না । সবাই জানে পহেল একা যাবে , কিন্তু পহেল জানে তার সাথে আর কে যাবে । পহেলের বান্ধবী মীরা তার সাথে যাবে । এই কথা ওরা দুইজন জানে ।
মীরা'র বাবা-মা লন্ডনে থাকে । মীরা ঢাকার বাড়ীতে তার খালাম্মার সাথে থাকে । বড়লোকের একমাত্র মেয়ে । শখ হয়েছে শীতের কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসবে । পহেলের সাথে মীরার সম্পর্ক বেশ কয়েক বছরের। মীরা কে শাসন কিংবা বাঁধা দেবার কেউ নাই । সে নিজের মত করেই চলে । তার খালাম্মা এসব ব্যাপারে তেমন একটা নাক গলায় না । তিনি তার সোসাইটি মানে , নারী উন্নয়ন নিয়ে সেমিনার মিটিং এসব নিয়ে ব্যাস্ত । বোনের মেয়ের দিকে খেয়াল রাখার তার সময় নেই ।
গত পরশু ভার্সিটিতে পহেল মীরাকে গ্রামে যাবার কথা বলেছে । এরপর থেকেই মীরার জেদ মীরা ও সাথে যাবে। কিন্তু শহরের মেয়ে নিয়ে গ্রামে গেলে শেষে কি হয় তা নিয়ে বেশ চিন্তিত পহেল । অবশেষে মীরার জেদের কাছে পরাজয় মানতে হল পহেল কে ।
গ্রামে যাত্রার দিন যথা সময়ে দুইজনে বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছেছে । এরপর শুরু হল গ্রামে অভিমুখে যাত্রা। শহরের ব্যাস্ততা আর কোলাহল কে পেছনে ফেলে বাস ছুটে চলল মফস্বলের সেই গ্রামের দিকে । দুপুর দুইটা নাগাদ বাস তাদের বাজারে এসে পৌঁছেছে । এরপর রিকশা করে গ্রামের বাড়ির দিকে চলছে দুইজন।
পহেলের ফুফু প্রথমে ভাতিজার সাথে মেয়ে দেখে ঘাবড়ে গেল , কিন্তু তিনি বেশ চালাক মহিলা তাই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বললেন না সেই সময়ে । রাতে খাওয়ার পর মীরা যখন বাথরুমে গেল তখন তিনি পহেলকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলেন । জবাবে পহেল বলে উঠল
"আমি জানতাম তুমি এই নিয়ে প্রশ্ন করবে , ও আমার সাথে পড়ে গ্রাম দেখার বড় শখ তাই নিয়ে এলাম । কিছু মনে করো না । এই সমাজে এখন ও ছেলেমেয়েদের অবাধ স্বাধীনতায় বাঁধ সাধে তা আমার অজানা নয় ।ওকে আমার খালার মেয়ে বলে সকলের সাথে পরিচিত করে দিও । "
"হুম বুঝেছি । তোরা শহরে থাকিস বাপু , এতসব কি আমাদের বুঝতে হয় । তুই এসেছিস তাতেই আমি খুশি "বললেন পহেলের ফুফু।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর উঠোনে ফায়ার ফ্লেসের মত আগুন জ্বালানোর ব্যাবস্থা করলেন পহেলের ফুফু। প্রচন্ড শীত । শুকনো খড় (গ্রাম্য ভাষায় যাকে নাড়া বলে ) দিয়ে আগুন ধরালেন । আর সেখানে নানা ধরনের শুকনো পাতা । আগুনের শিখা লকলক করে জ্বলছে । অনেক পোকা সেই আগুনের উপর হুমড়ি খেয়ে পরছে । আগুনের তাপে পহেল এবং মীরা দুইজনের শীত অনেক কম লাগতে লাগল । পাশের বাড়ি থেকে ছোট ছোট দুইটি বাচ্চা এসে আগুন পোহাতে লাগল । সেই সাথে পহেল ফুফুর কাছ থেকে গ্রামের একটি ধারনা নিয়ে নিল । ছোট ছেলেমেয়ে দুইটি আগুনের মাঝে কি যেন ফেলে দিল । ঠুস ঠুস শব্দে সেগুলো ফুটতে লাগল । কিছুখন পর একটি লাঠি দিয়ে সেই জিনিসটি বের করে আনল আগুনের ভেতর থেকে ।
"এগুলো কি ?" পহেল বলে উঠল।
হালুক(শালুক , শাপলা পাতার লতার নিচের যে অংশ মাটিতে থাকে সেই মুলে কালো বিচি )বলে উঠল ছেলেটি।
"এটা কি করবে "
"খামু"
তখন পহেলের ফুফু বলল –" পহেল এগুলো শালুক , বাচ্চারা দিনে মাঠ থেকে কুড়িয়ে এনেছে এখন খাচ্ছে । তুমি এসব খেতে পারবে না বাবা। "
"না ফুফু গ্রামে এসে না খেলে তো হবে না । "
"ঠিক আছে , এই সোনাই একটা এদিকে তোর ভাইজানরে দে"
সোনাইর হাত থেকে শালুক নিয়ে মুখে দিল পহেল । কেমন বিশ্রী একটা তেতো সাধে পুরো মুখ ভরে গেল , কিন্তু লজ্জায় কিছু না বলে বলল –" বেশ তো তোমাদের হালুক"

ঘন কুয়াশায় চারদিক আচ্ছন্ন। রাস্তা পুরো দেখা যায় না , এখানো সামনের কোন কিছু দৃষ্টি গোচর হতে বেশ সময় লাগে । সেই কাক ডাকা ভোরে পহেলের ঘুম ভেঙ্গে গেছে । তাই অনিচ্ছা স্বত্বে ও কম্বলের নিচ থেকে উঠে গ্রামের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে ট্রাউজার , হাতে দস্তানা , মাথায় কান টুপি , শরীরে দামী জ্যাকেট । শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সকল উপায় । বাড়ির সামনে দিয়ে খালি একটি গেঞ্জি গায়ে দিয়ে কাঁধে ভার নিয়ে একটা লোককে যেতে দেখে সালাম দিল পহেল ।
অচেনা লোককে দেখে থমকে দাঁড়ালো জব্বার আলী । "তুমি কে বাবা " সালামের জবাব দিয়ে বলল সে।
"আমি পহেল । এই বাড়ীর ছেলে" । পাশের বাড়িটিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল।
"ও তুমি বুঝি আমাগো বাশার মিয়ার পোলা"
"হ্যা । গ্রাম দেখতে এসেছি । আপনি বুঝি বাবাকে চেনেন । "
"একসময় মোরা বন্ধু ছিলাম , তয় অ্যাই অহন গাছি , জব্বার গাছি। তা বাজান গ্রাম দেহেন, অ্যাই অহন রস নামাইতে যাই, বিয়ালে (বিকালে ) আইমু। "
পহেল গ্রামের পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল । গ্রামের মানুষ গুলো এই প্রচন্ড শীতে অনায়াসে চলাফেরা করতে পারে কিন্তু তাদের মত শহরের লোকেরা পারে না । আসলে এই লোক গুলোই প্রকৃত খাঁটি লোক। এদের চাহিদা খুবই সামান্য । রাস্তার পাশে সবুজ একটি ক্ষেতে দুইজন কিশোর রশি দিয়ে কি যেন করছে । পহেল তাদের দিকে এগিয়ে গেল।
'এই যে তোমরা কি করছ?তোমাদের ঠাণ্ডা লাগছে না '
'না ।আমাগো ঠাণ্ডা লাগেনা , দেখছেন না গম খেতের কুয়াশা নামাচ্ছি 'কিশোর দুইজন একই সুরে বলে উঠল ।
'আচ্ছা এটা তাহলে গম ক্ষেত '
'হ্যা '
'তোমাদের নাম কি '
'আলী, ওর নাম বাসেত'
'আচ্ছা ' বলে পহেল সামনের দিকে অগ্রসর হল । রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে এখন সব শীতের সব্জীতে ভরপুর। পাতাকপি, ফুল কপি, গাজর , মুলা , ধনিয়া এসব শীতের সব্জি এতদিন ঢাকার বাজারে দেখে এসেছে , আজ স্বচক্ষে দেখতে পেল ।হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে সরষে ফুলের মাঠ। এসব দেখতে দেখতে শীতের প্রকোপ ভুলেই গেল পহেল । বাড়ি থেকে অনেক দূর চলে এসেছে । সামনে রেললাইন । রেললাইনের পাশে ছোট চায়ের দোকান । শহরের লোক এমন দোকান দেখলে নাকসিটকাতে ভুলবে না । কিন্তু গ্রামের সাধারন মানুষ গুলো নির্বিঘ্নে বসে চা খাচ্ছে সাথে টোস্ট বিস্কুট কিংবা ভাপা পিঠা ।
দোকানে বসে চা পান করছিল ছিল মজিদ। রাস্তার পাশে পহেলকে দেখে বুঝে নিল গ্রামে বেড়াতে এসেছে । তাই নিজে উঠে গেল পরিচিত হতে । সামান্য সময়ের মধ্যে দুজনে বেশ জমিয়ে তুলল পাড়ার দোকানটায় নানা গল্পে । সবাই পহেলের কথা শুনছে মনোযোগ সহকারে । সেই সাথে মাঝে মাঝে আসছে ধোঁয়া উঠা গরম গরম ভাপা পিঠা এবং গরুর দুধের অমৃত চা।
এরপর পুরো গ্রাম ঘুরে দেখল পহেল মজিদের সাথে । শীতে গ্রামের মানুষের সবচেয়ে কষ্টের যেটা হল সেটা হচ্ছে শীত বস্ত্র । পহেল চিন্তা করল এই ব্যাপারে মীরা'র সাথে আলোচনা করবে বাড়ি গিয়ে । গ্রামের অসহায় শীত বস্ত্র হীন মানুষদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করল শহরের চারদেয়ালে বন্দি থাকা পহেল । এরপর মজিদ কে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে এল পহেল ।
এসে যা দেখল তাতে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল । ফুফু কত রকমের পিঠার আয়োজন করেছে । ফুফুর সাথে তাল মিলিয়ে গ্রামের মেয়েদের মত পিঠা বানাতে সহযোগিতা করছে মীরা । এই মীরা কি সেই মীরা ? পরনে শাড়ি , হাতে কাচের চুড়ি , চুল বেনী করা , তাতে লাল ফিতা । ভাবতে সময় লাগে পহেলের ।

দুই সপ্তাহের অধিক হয়ে গেল । পহেল এবং মীরা বেশ আনন্দের সাথেই তাদের দিনগুলো পার করছিলো । গ্রামের অসহায় মানুষের একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলল দুইজনে মিলে । সাথে সার্বক্ষণিক সহযোগিতায় থাকল মজিদ । মজিদ বেশিদুর লেখা পড়া করেনি তবে এই দুইজন কে তার বেশ ভাল লেগেছে । সে দিন এবং রাতের বেশীর ভাগ সময় পহেল এবং মীরা'র সাথেই কাটায় । মাঝে মাঝে রাতে পহেলের সাথেই থেকে যায় ।
অন্যদিকে গ্রামের কিছু লোক একটি মেয়েকে নিয়ে পহেলের ঘুরাঘুরিকে অন্যভাবে দেখতে লাগল । তারা ভাবল মীরাকে দেখে তাদের গ্রামের পর্দানশীল মেয়েরা বিগড়ে যাবে । এছাড়া গ্রামের কিছু বখাটে যুবকের দৃষ্টি পড়েছে মীরা'র উপর ।
একদিন পহেলকে ডেকে কয়েকজন মুরুব্বী সেইসব কথা বললেন । বললেন
'বাবা এটা শহর নয় , তুমি এই গ্রামের বাশার মিয়ার ছেলে , গ্রামের কিছু ব্যাপার তোমার জানা দরকার , এভাবে খোলামেলা ভাবে একটা মেয়ে নিয়ে ঘুরাঘুরি বেশ দৃষ্টি কটূ দেখায় '
পহেল যা বুঝার বুঝে গেল । এসব ভণ্ড মানুষদের সম্পর্কে সে নানা পত্রিকায় পড়েছে । এরা শুধু ঝামেলা পাকাতে জানে । আসলে ধর্ম সম্পর্কে ও এদের জ্ঞান সীমিত । তারপর ও গ্রাম বলে কথা । তাই সেই কিছুদিন মীরাকে ছাড়াই বাইরে বেরুল ।
গতকাল রাতে গাছি জব্বার আলী তাদেরকে তাজা লাল রস খাইয়েছে । সে যে কি অমৃত স্বাদ । কেউ না খেলে বিশ্বাস করবে না । গাছি জব্বার মিয়া রাত বিরাতে পহেলকে বাড়ির বাইরে যেতে বারন করেছে , কিন্তু পহেল কারো কথা শুনলেতো ।
পহেল এবং মীরা ঢাকায় তাদের কিছু বন্ধুকে ফোনের মাধ্যমে সহযোগিতার কথা বলেছে । শহরের সেই সকল বন্ধুরা কিছু টাকা তাদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে । তাই দিয়ে আজ ওরা তিনজন মিলে বেশ কিছু শীত বস্ত্র কিনেছে ।
আজ রাতে এসব শীতবস্ত্র বিতরন করা হবে । মীরা , পহেল এবং মজিদ পাশের গ্রামে সেগুলো নিয়ে চলল । তখন সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে । এই মিষ্টি রোদ ওদের কাছে বেশ ভালো লাগল । তিনজনে তিনটি ব্যাগে করে শীতবস্ত্র গুলো বয়ে নিয়ে চলল অসহায় মানুষদের জন্য । সেই গ্রামে পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । তারপর লিস্ট অনুযায়ী একে একে সকলকে সামান্য করে করে শীত বস্ত্র প্রধান করল ওরা ।
এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নয়টা হয়ে গেছে । গ্রামে এই সময় গভীর রাত । সকলে ঘুমের রাজ্যে । সারাদিনের ক্লান্ত ময় শরীর এখন বিশ্রামে । কুপি গুলো আলো নিবিয়ে ফেলায় শুধু জোনাক পোকার আলো দেখা যাচ্ছে । সেই সাথে বইছে শীতের হাওয়া । তিনজনে নিজেদের গ্রামের দিকে পথ চলছে কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে ।
*******************
রাস্তায় ওত পেতে আছে গ্রামের কিছু বখাটে তরুন । তারা জানে এই পথ দিয়ে ফিরবে পহেল এবং মীরা । পহেলের ব্যাবস্থা করবে দুইজন । আর বাকি দুইজন মীরা কে নিয়ে যাবে মাঠের মাঝে সেলু মেশিনের ঘরে। ঠাণ্ডায় বসে থাকতে থাকতে তাদের পায়ে ঝুমুনি এসে গেছে । এছড়া একটার পর একটা গাঁজার স্টিক চলছে অনবরত ।
এমন সময় সামান্য দূরে পহেলদের কথার আওয়াজ শুনতে পেল তারা । আধার রাতে ঘাপটি মেরে বসে রইল তারা ।
মজিদ সামনে মাঝে মীরা পেছনে পহেল । তিন জন দেখে সিদ্ধান্ত পাল্টাল তারা । তিনজনে মিলে আচমকা পহেল এবং মজিদ মিয়াকে লক্ষ্য করে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিল সজোরে । পহেল সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল । মজিদের গাঁড়ে লেগেছে সেও অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারালো । মীরা চিৎকার দিতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে একজন ওর মুখ চেপে ধরে মাঠের দিকে টেনে নিয়ে গেল । অজ্ঞান পহেল এবং মজিদ নির্জন রাস্তার মাঝে পড়ে রইল ।

জব্বার আলীর আজ ভাল লাগছে না সন্ধ্যে থেকেই । গত কয়েকদিন ধরে চৌধুরী বাড়ির বাগানের গাছ গুলো থেকে কে যেন রস নিয়ে যায় চুরি করে । তাই আজ ভেবেছেন পাহারা দিবেন । তার এত কষ্টের রস কে চুরি করে , তা একবার দেখা দরকার ।
কালো জাম্পারটা ( যেটা আজ পহেল দিয়েছে ) পরে হাতে একটি শক্ত লাঠি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুলেন জব্বার আলী । গ্রামের রাস্তা দিয়ে না গিয়ে মাঠের মাঝ দিয়ে হাটতে শুরু করলেন । শুকনো মাঠ । এখানে সেখানে ধানের মূড়া ছাড়া আর কিছু নেই । কিছুদিন আগে ধান কাটা হয়ে গেছে । খেতের আইল ধরে আঁধারের মাঝে দিব্যি পথ চলতে লাগলেন অনায়াসে।
সেলু মেশিন ঘরে সিগারেটের আগুনের ফুলকির মত জ্বলতে দেখে দিক পরিবর্তন করলেন জব্বার আলী । হ্যা সেখানে কেউ আছে । ঘন ঘন সিগারেটের আগুন দেখে বুঝলেন একজন নয় কয়েকজনই আছে । এত রাতে কি করছে তারা এই মাঠে । কৌতূহলের বশে এগিয়ে চলতে লাগলেন জব্বার আলী । একটি বিড়ির জন্য নিজের মনটা উসখুস করছে । কিন্তু এখন বিড়ি ধরালে সেখানে অবস্থিত লোকজন তার উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে । তাই অতি সন্তপর্ণে এগুতে থাকেন তিনি ।
কাছাকাছি হতেই গোঙ্গানির শব্দে তার মন শঙ্কিত হয়ে উঠল । বেড়ার ফাক দিয়ে দেখলেন শহরের মেয়েটাকে হাত , মুখ বেধে উলঙ্গ করে রেখেছে তাদের গ্রামের কিছু বখাটে ।একজন চেপে বসেছে মেয়েটার শরীরের উপর। এবার আর চুপ না থেকে তিনি বলে উঠলেন
' কে রে তোরা কি করছিস'
হঠাৎ যেন ভুত দেখেছে এমন ভাবে সেখানের পাঁচ জন লোক চমকে উঠল ।
"ছিঃ ছিঃ তোরা একি করছিস বাপ, একটা মাইয়্যারে তোরা "কথা আটকে গেল জব্বার আলীর । পেছন থেকে ঠিক মাথায় আঘাত করেছে একজন । এক আঘাতেই জব্বার আলী মাটিতে পড়ে গেলেন এবং সাথে সাথেই মারা গেলেন । জব্বার আলীকে মৃত দেখে ওরা ভয় পেয়ে গেল । এবং সকলে পালিয়ে গেল । আর তখন সেখানে পড়ে আছে বিব্রস্ত্র মীরা । তার শরীরের উপর দিয়ে এতক্ষণ অনেক ধকল গেছে । নরপশুরা একের পর এক তাকে কুড়ে কূড়ে খেয়েছে । সেই অজ্ঞান ভাবটা এখনো কাটেনি তার।দুই পায়ের মাঝে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ এবং শরীরের নিচ অংশে কষ্টময় ব্যাথা । ধীরে ধীরে চোখ মেলে জব্বার গাছি কে দেখতে পেল মীরা । কিন্তু একটু নড়ার শক্তি নাই তার শরিরে । পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে । আর চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু ধারা , সেই অশ্রু সম্ভ্রম হারানোর । আস্তে আস্তে শীত লাগতে লাগল শরীরে । কিন্তু শরীরে উপর যে অত্যাচার করেছে তাতে কি আর বেঁচে থাকা যায়। তবু ও বেঁচে থাকার জন্য উঠে দাঁড়াল মীরা। মৃত জব্বার আলীর শরীর থেকে লুংগীটা খুলে নিল নিজের উদাম শরীর ঢাকতে ।
পরদিন সকালে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পহেলকে পাওয়া গেল পথের ধারে মৃত অবস্থায় সাথে অজ্ঞান মজিদ মিয়াকে । মীরা'র লাশ পাওয়া রাস্তার পাশের বট গাছের মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় ।মাঠের মাঝে সেলু মেশিন ঘরে পাওয়া গেল জব্বার গাছির লাশ। পুলিশ এসে নির্দোষ মজিদ কে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল থানায়। তার বিরুদ্ধে দুইটি মামলা হল । একটি হত্যা এবং অন্যটি ধর্ষণ ও হত্যা ।
পরিশিষ্ট ঃ
দুই বছর পর
একরাতে গাঁজা খেতে বসে সব বলে দিল লোকমান। সেই আসরে পুলিশের একজন ইনফরমার ছিল সে থানায় গিয়ে সব বলল । পুলিশ পুরো দলটিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল ।
অসহায় মজিদ মিয়া বিনা দোষে দুই বছর সাজা কেটে জেল থেকে বেরিয়ে এল । তার জীবনের দুইটি বছর এবং হারিয়ে যাওয়া সন্মান কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না , না দেশ , না দেশের মানুষ । রাগে দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে পথ চলতে লাগল মজিদ । সেই সময়টা ও ছিল শীতকাল । এতকিছুর মাঝে ও পহেলের দেওয়া জাম্পারটা পুলিশ ফিরিয়ে দিয়েছে আসার সময় । যেটা পহেল এবং মীরা সেদিন দিয়েছিল তাকে। রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধ শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে আর ভিক্ষা করছে। মনের অজান্তে নিজের জাম্পারটা খুলে সেই ভিক্ষুক কে দিয়ে দিল মজিদ । এরপর অজানা গন্তব্যে হাটতে লাগল আনমনে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন পুরোটুকু পড়লাম, ভাল হয়েছে। এবার কি একটু তাড়াহুড়া ছিল?
ভালো লাগেনি ২২ জানুয়ারী, ২০১২
sakil ধন্যবাদ Md. Iqbal Hossain .
sakil @ ইমাদাদুল ইসলাম @ আহমেদ ইউসুফ @ এবং শ্রদ্ধেয় @ নীরব ভাইকে অনেক ধন্যবাদ মুল্যবান মন্তব্যের জন্য
sakil মামুন ভাই ঠিক ধরেছেন গল্পের শেষ দিকে একটু তাড়াহুড়া ছিল . আর হ্যা আমার সময় কম . সময়ের সাথে ছুটতে এমনি হয় .সত্যি একটি ঘটনার অবতারনা করতে গিয়ে জব্বার মিয়ার লুঙ্গি খুলতে হল । অনেক ধন্যবাদ ।
মামুন ম. আজিজ নাটকীয়তা গল্পটাকে শেষের দিকে জমজমা্‌ট করে তুলল। মিরার নিজের কাপড়গুলো আশেপাশে পড়ে থাকার কথা, মৃত জব্বার মিয়ার লুঙ্গি খোলার দরকার কি ছিল?,....শেষ একটু তাড়াহুড়াও দেখাল লেখক। সেটা আরেকটু প্রলম্বিত করলে ভাল হত। শুভকামনা শাকিল
sakil @ সেলিনা ইসলাম @ আনিসুল হক মানিক এবং এফ আই জুয়েল আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
sakil @ আমার আমি @ মোহন চৌধুরী এবং আশা আপনাদের কে ও অনেক ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
sakil @ সীমা আপু @ বিন আরফান এবং @ সালেহ মাহমুদ ভাই আপনাদেরকে অনেক অনেক অভিনন্দন । গল্প পড়ে সুন্দর মতামত প্রদান করায় ।
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
sakil অনেক ধন্যবাদ @ সাজিদ খান @ তানি হক এবং @আলভী গল্পটি সম্পকে আপনাদের মুল্যবান মন্তব্যের জন্যে ।
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪