একটা ভয় অথবা খুনের গল্প

ভৌতিক (ডিসেম্বর ২০১৮)

সুমন আফ্রী
  • ৪২
চীৎকার দিয়ে জেগে ওঠে কেরামত মিয়া। দরদর করে ঘামতে থাকে এই হালকা শীতের মাঝেও। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ২ বছর বয়সী বাচ্চাটাও জেগে ওঠে চীৎকারের শব্দে তার মায়ের সাথে। কেরামতের স্ত্রী রহিমা বেগম কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। কি হলো আজ তার স্বামীর? এমন করে তো কোনোদিন তিনি চীৎকার দিয়ে উঠেননি! আজ কি হলো তার? রহিমা বেগম স্বামীর গায়ে হাত রেখে বলে, "কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগতেছে? এরকম করে চীৎকার করে উঠলেন কেনো? বাবুটাও ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।"

বাবু! রহিমা বেগমের কোনো কথায় যেনো কেরামত মিয়ার কানে যায়নি। বাবুর কথাটা শুনতেই দেহটা কেঁপে উঠলো যেনো। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, "বাবু? কোথায় আমাদের বাবুটা? বাবু! বাবু!"

রহিমা বেগম কিছুই বুঝতে পারেনা। মনে মনে একটু ভয়ও পেয়ে যায় এই মাঝ রাতে স্বামীর অদ্ভুত আচরণে।
আঙুল দিয়ে বাবুকে দেখিয়ে দেয় রহিমা বেগম, "এই তো আমাদের বাবু"।
বাবুকে দেখামাত্রই কেরামত মিয়া একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে কোলে তুলে নেয়।
তারপর সারা মুখে চুমুর পর চুমু খেতে লাগে। আর শুধু বলতে থাকে "তোমার কিচ্ছু হবেনা বাবু। কিচ্ছু হবেনা!"

রহিমা বেগম এইবার সত্যি সত্যই ভয় পেয়ে যায়। বাবুকে নিয়ে কি তাহলে কেরামত কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছে? নাকি সে বাবুর কোনো রোগের কথা তার কাছে লুকিয়েছে যার জন্য বাবুটা মারা যেতে পারে? কিচ্ছু ভেবে পায় না রহিমা বেগম। প্লাস্টিকের জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে স্বামীর হাতে দেয়। এক নিঃশ্বাসেই সবটুকু শেষ করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে।

রহিমা বেগম স্বামীর পাশে বসে।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে আপনার? আপনি কি কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?"
কেরামত মিয়া আস্তে করে বলে, "হু।"
রহিমা বেগম "তওবা তওবা" বলতে বলতে বলে ওঠে, "কন কি? সকাল হলেই হুজুরের কাছে যাবো। এখন বলেন কি দেখলেন?"

কেরামত মিয়া শুরু করেঃ
"আমার বাবুটা খুব অসুস্থ। আমরা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি হাসপাতালে। কিন্তু পিছন থেকে বিশাল বিশাল কয়েকজন মানুষ আমাদের গাড়িটাকে টেনে ধরছে। সামনে যেতে দিচ্ছেনা একটুও। আমি গাড়ি থেকে নেমে কান্নাকাটি করছি, তাদের পায়ে ধরছি। ধরার পর একটু ছেড়ে দিয়েই আবার কয় মিনিট পিছন থেকে টেনে ধরছে। আমি আবার কান্নাকাটি করছি, ওরা আবার ছেড়ে দিচ্ছে। এইভাবে করতে করতে যখন হাসপাতাল থেকে আর একটু দূরে তখন সেই মানুষদের মধ্যে থেকে একজন এসে জানালায় ঘুষি মেরে গাড়ির কাচটা ভেঙে ফেলল। ড্রাইভারকে মারধোর করে ফেলে রাখলো রাস্তায়। আর আমাদের কাছ থেকে কেঁড়ে নিলো আমাদের বাবুটাকে! কেঁড়ে নিয়েই ছুড়ে দিলো সামনের একটা জলাশয়ে। সেই জলাশয় আমি কোনোদিন দেখিনি। পুরো পানি কালির মতো কালো। মনে হচ্ছিলো যেনো মবিলের পুকুর!"

ঘটনার সবটুকু শোনার পর রহিমা বেগম "আল্লাহ" বলে আর্তনাদ করে উঠে বাবুটাকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে। আর কেরামত মিয়ে ডুবে যায় গভীর চিন্তায়। কিছুই ভালো লাগছেনা তার। এমন ভয়ানক স্বপ্ন কেনো দেখলো সে? সে কি কোনো পাপ করেছে? নাকি কোনো শিশুকে হত্যা করেছে? ভাবতে ভাবতে ১৪ ইঞ্চি রঙীন টিভিটা ছেড়ে দেয় এই রাতের বেলায়। টিভি চালু করার পরেই একটা লেখায় চোখ আটকে যায় কেরামত মিয়ার। বারবার স্ক্রল করছে, "সিলেটে শ্রমিকদের গাড়ি আটকানোর ফলে মারা গেছে ৭ দিনের এক শিশু"!

একবার, দুইবার- বারবার দেখতে লাগলো খবরের শিরোনামটা। বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। শিরদাড়া বেয়ে একটা ভয়ের স্রোত নেমে গেলো। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। কেরামত একের পর এক চ্যানেল পাল্টাতে লাগলো। একটা চ্যানেলে আসতেই সে দেখতে পেলো একটা প্রায় পরিচিত বাচ্চার মুখ। বয়স কত হবে? ৫ দিন বা সাত দিন। খবরের উপস্থাপক বলছে, বাচ্চাটা নাকি মারা গেছে। ভ্রু কুচকে গেলো। চোয়াল ঝুলে পড়লো কেরামত মিয়ার। এই সেই বাচ্চাটা না? যাকে আজ শ্রমিক ধর্মঘটের সময় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো? এই বাচ্চাটার গাড়ি সিলেট শহরের কয়েক জায়গায় থামানো হয়েছিলো? কেরামত মিয়া সবই জানে। কারণ, সিলেটের ধর্মঘট সফল করার দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হয়েছিলো। কোথাও কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটলেই ফোন আসছিলো তার কাছে। একটা ফোন এসেছিলো মিন্টুর কাছ থেকে, "ভাই, একটা এ্যম্বুলেন্স আটকে রাখছি। ভিতরে ৭ দিনের এক বাচ্চা। বাবা-মায় পায়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। কি করবো?" কেরামত ধমক দিয়ে বলেছিলো, ২০ মিনিট আটকে রাখ! তারপর ছাড়বি! ওরা জানে না, আজকে পরিবহন ধর্মঘট?

একটু একটূ করে সবই মনে পড়ছে কেরামত মিয়ার। টিভিতে যে বাচ্চার ছবি দেখাচ্ছে সেই বাচ্চাটার গাড়ি কেরামত মিয়া নিজেই একবার আটকেছিলো। কয়েকমিনিট পর অবশ্য ছেড়েও দিয়েছিলো। কিন্তু এই একই গাড়ী যখন বারবার আটকের খবর আসছিলো, আর সবাই বলছিলো যে, বাচ্চার বাবা-মা কান্নাকাটি করছে তখন তার মেজাজ চড়ে গিয়েছিলো সপ্তমে! তাই সে এবার বিশ মিনিট আটকে রাখার হুকুম দিয়েছিলো। তারপর রাত হলে বাসায় এসে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে।

কিন্তু এই ভয়ংকর স্বপ্নটাই তাকে ঘুমাতে দিলোনা। কেরামত মিয়া মনে হয় বুঝতে পারছে কেনো সে এমন ভয়ংকর স্বপ্নটা দেখেছে। রহিমা বেগম কেরামত মিয়ার পাশে এসে বসতে বসতে বলে, চলেন ঘুমাই। বাবুটা ঘুমিয়েছে। এতো রাত জেগে টিভি দেখলে আপনার শরীর খারাপ হবে। কেরামত মিয়া কিছু বলে না রহিমা বেগমকে। শুধু আঙুলটা নির্দেশ করে টিভির স্ক্রলের দিকে। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বলে, আমি খুন করেছি, রহিমা। আমি এই বাবুটাকে খুন করেছি...!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রণতূর্য ২ ভালো লিখেছেন। আমার পাতায় আমন্ত্রন রইল।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মানুষের পাপগুলো নিজেদের অজান্তেই মনে স্থান করে নেয়। সেই পাপগুলোই ভয় হিসেবে প্রকাশ পায় বিভিন্নভাবে। এই গল্পে একজন পিতার সন্তানের প্রতি ভালোবাসার সাথে সাথে তাকে হারানোর ভয় এবং অন্য একজন শিশুকে হত্যার অপরাধে তার নিজের আত্মদহন প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে।

২৩ জুন - ২০১২ গল্প/কবিতা: ২৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪