চারদিকে হৈ-হুলোড়, ছোট ছোট বাচ্চাদের আনন্দঘন চেঁচামেচি। বড়রাও ব্যস্ত নানা কাজে। বাড়ীর উঠোনে প্যান্ডেল সাজাতে ব্যস্ত ডেকোরেশনের কর্মীরা। তারা রাত-দিন কাজ করছে। ডেকোরেশনের এক কর্মী সাবরিনের আব্বাকে বলে, আঙ্কেল পিয়ারা গাছের বড় ঢালডা কাইটা ফেলতে হইব-নইলে প্যান্ডেলটা ডক হইব না। সাবরিনের আব্বা বলেন, কী বলো? আমার মেয়ের প্রিয় গাছের ঢাল কেটে ফেলতে হবে? ডেকোরেশনের কর্মচারী আবার বললো, হ আঙ্কেল, না অইলে প্যান্ডেল টেপ খাইয়া থাকব। ডক লাগব না। অহন কি করুম কন? সাবরিনের আব্বা জমির সাহেব অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করলেন। মনে মনে ভাবলেন পেয়ারা গাছটা আমার আদরের একমাত্র মেয়ের প্রিয় গাছ। মেয়ের প্রিয় গাছ-আর আমার প্রিয় মেয়ে। একমাত্র আদরের মেয়ে আমার। মেয়েটার আদর, সোহাগের কমতি নেই। জীবনের নানারকম চিন্তা-টেনশনে জর্জরিত হয়ে যখন জমির সাহেব একেবারে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। এমন হতাশা যে-তা যেন শিকারী হায়েনার মতো তাকে কামড়িয়ে কাকড়িয়ে খাচ্ছিল। এমন সময় জন্ম হলো সাবরিনের। মেয়ে জন্মের পর যেন সব চিন্তা, টেনশন, হতাশা ও আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া দুঃখগুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে শুরু করলো। মনে হয় সব হতাশা, দুঃখ ও ব্যর্থতার গ্লানী মুছে দেয়ার জন্য মহান আল্লাহ্ তা’আলা সরাসরি উপহার হিসেবে সাবরিনকে জমির সাহেবের কাছে পাঠিয়েছেন। এ জন্যেই জমির সাহেব তার মেয়েটাকে আদর, স্নেহে, ভালবাসা ও শিক্ষা-দীক্ষাসহ কোনো কিছুতেই অপূর্ণ রাখেননি। মেয়েটা যখন যা চাইতো-তা তিনি সাধ্য মত তার সামনে হাজির করতেন। এমন আদরের মেয়ের বিয়ের প্যান্ডেলটা টেপ খেয়ে থাকবে? বেঢপ লাগবে? নাহ্, এটা কখনো হতে পারে না। জমির সাহেব মেয়েকে ডাক দেন, সাবরিন মা-মনি এদিকে এসো। সাবরিন বলে, কেন আব্বু? আচ্ছা, আসছি। সাবরিন এগিয়ে এলে জমির সাহেব বলেন, মা-মনি তোমার প্রিয় পেয়ারা গাছের ঢালটা যে কেটে ফেলতে হবে। সাবরিন, ওহ্ কেন আব্বু? এই যে দেখ না, ঢালের জন্য স্টেজটা সোজা করা যাচ্ছে না। সাবরিন বলে, ওটা তো আমার প্রিয় গাছ। জবাবে জমির সাহেব বলেন, মা-মনি আমিতো সেটা জানি। জানি বলেই তো তোমাকে ডেকে আনলাম। ঢালটা কেটে ফেলুক? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাবরিন বললো, আচ্ছা ঠিক আছে আব্বু বলে ঘরের ভেতরে চলে গেলো সে। জমির সাহেব হুকুম দেয়া মাত্রই ডেকোরেশনের কর্মীরা পেয়ারা ঢালটা টাস-টুস করে কেটে ফেললো। বিয়ের স্টেজ, প্যান্ডেল, নানা ডিজাইনের রঙ্গিন বাতি থেকে শুরু করে সবকিছুই সুন্দর হওয়া চাই। জমির সাহেবের একমাত্র আদরের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। ইংরেজীতে বলে টাইম ইজ ফ্লি অর্থাৎ সময় বাতাসের গতিতে চলতে থাকে। পুরো এক সপ্তাহ প্রস্তুতি ও নানা কাজ শেষে সুন্দর একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। বর ও কনে পক্ষের অতিথিদের খানা-পিনা শেষ। কয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধু ও ভগ্নিপতিরা সাবরিনের বরকে ঘিরে স্টেজে বসে আছে। তাদের খানা-পিতার স্পেশাল আয়োজন চলছে। সাবরিনের বড় চাচা সামি উদ্দিন এসে দুলার ভগ্নিপতিদের বললো, চল বাবারা বর বাবাজিকে নিয়ে এসো-খাবার রেডি। দুলা ধীর পায়ে হেটে খাবারের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। তবে, তাকে কেউ ধরতে হয়নি। অনেককেই দেখা যায় বিয়ের দিন একা হাটতে পারে না। নার্ভাস হয়ে যায়। ভগ্নিপতিরা হাত ধরে এদিক-সেদিক নিয়ে যায়। সাবরিনের বর দেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যাপারটা খেয়াল করে জমির সাহেব। মনে মনে তিনি খুশি হন। আদরের একমাত্র মেয়ের বরের চালচলন-হাটার স্টাইল অনেক সুন্দর ও ভদ্র। জমির সাহেব এমনই চেয়েছিলেন। তার মেয়ের বর হবে সুন্দর, ভদ্র ও স্মার্ট। আল্লাহ্ তা’আলা মনে হয় তার মনোবাসনা পুরণ করেছেন। বিয়ের আয়োজনের সব পর্ব শেষ। ঘনিয়ে এলো সাবরিনকে বিদায় দেয়ার মূহুর্ত। জমির সাহেবের বুকের বাম পাশে কেমন যেন একটা জখম অনুভূত হয়। কে যেন তার হৃদপিন্ডকে বড় একটা হাতুড়ি দিয়ে জখম করেছে। সে জখমের কথা তিনি কাউকে বলকে পারেন না। নিরবে সহ্য করছেন। সাবরিনের আম্মা, চাচি, খালা ও প্রতিবেশী মহিলা শোর করে কাঁদতে থাকেন। জমির সাহেবের স্ত্রী বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, সাবরিনরে ও আমার সাবরিন তুই কোথায় যাস-আমাদের সবাইকে ফেলে। জমির ছেলে জাহিদ ও শহীদও আপা আপা বলে কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে পারেন না শুধু জমির সাহেব। একমাত্র আদরের মেয়ের বিদায় বেলায় তিনি যেন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছেন। কে যেন তার বুকে বিশাল এক পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। কাউকে সান্তনা দিতে পারছেন না। নিজেও শান্ত হতে পারছেন না। কতো বড় বড় সমস্যা তিনি মোকাবেলা করলেন। জীবনে কতো ঘাত-প্রতিঘাত পার হয়ে এ পর্যন্ত আসলেন। কতো মানুষ আর কতো আত্মীয়-স্বজনের বিপদে-আপদে তিনি সাহায্য-সহযোগিতা করলেন। সে আত্মীয়-স্বজনরাই তাকে আঘাত করেছে। পেশাগত জীবনেও তিনি বহু মানুষের ধোকাবাজির শিকার হয়েছেন। সরলতার সুযোগ বহু মানুষ তার ক্ষতি করেছে। কিন্তু তিনি কখনো বিচলিত হননি। দুঃখবোধ করেননি। ভেঙ্গে পড়েননি। মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখেছেন অবিরত। আজ দেখি একমাত্র মেয়ের বিদায় বেলায় তিনি অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। তার যেন মনোবল, শক্তি সবকিছু কমে গেছে। তিনি কাঁদতেও পারছেন না আর মনের গোপন অশান্তি ও দুঃখের কথা কাউকে বলতেও পারছেন না। সাবরিন ছাড়া তার ঘরটা যেন একেবারে শূণ্য। সাবরিন সারাদিন পুরো ঘরটাকে মাতিয়ে রাখতো। মূহুর্তের জন্য কোথায় গেলে পুরো ঘরটা নিরব, নিস্তব্দ হয়ে যেতো। আজও একই অবস্থা। পুরো ঘর ও বিয়ে বাড়ীটা নিরব, নিস্তব্দ। মেয়েকে বিদায় দিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন আহ্হা বিয়ের সময় মেয়েকে বিদায় দেয়া যে কতো কষ্ট সেটা তিনি আগে কখনো উপলব্ধি করতে পারেননি। মেয়ে সাবরিনের বিদায়ের পর জমির সাহেবের জীবন থেকে বড় একটা কিছু যেন হারিয়ে গেছে। সেটা তিনি জীবনের সমস্ত রোজগার দিয়ে এমনকি দুনিয়ার সব সম্পদ ও টাকার বিনিময়ে কিনতে পারবেন না। এনব ভাবতে ভাবতে তিনি পনের বছর আগের স্মৃতি মনে করতে লাগলেন। ছোট্ট মেয়ে সাবরিন। সারাদিন বাড়ি মাতিয়ে রাখে। বাবা-মা, দাদু ছাড়াও বড় বাবা-বড় মাও তাকে বেশ আদর করে বলা যায়। সবার আদরে ভারি দুষ্ট হয়ে উঠেছে সে। তার প্রাণচঞ্চল, উচ্ছ্বল উপস্থিতি অন্য শিশুদরেও মাতিয়ে রাখে। বাবা-মায়ের আদর-স্নেহের কমতি নেই। বড় বাবা-মার আদরতো আছেই। আর বড় বাবার কাছেতো সাবরিনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই তোলা যাবে না। সাবরিন ইদাদিং সবাইকে গালী দেয়। সাবরিনের বাবা-মা এবং বাড়ির কারো মধ্যে গালী দেয়ার প্রবণতা নেই। এ নিয়ে সাবরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বাবা বলে মেয়েটা গালী শিখলো কোত্থেকে? মা বলে কোত্থেকে আর? আমাদের পাশের বাড়ির নুরুল হক, আবুল হাসেমের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে শিখেছে। সাবরিনের বাবা বলে এসব ছেলে-মেয়েদের সাথে ওকে মিশতে দাও কেন? সাবরিনের মা বলে মিশতে না দিয়ে কি পারা যায়? পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়ে এখানে আসে। ওদের কি দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া যায়? তাছাড়া আমাদের ঘরে তো আর সাবরিনের সমবয়সী কেউ নেই। শুধু সানজিদা আছে। সে তো সাবরিনের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। পড়ে ক্লাস এইটে। সাবরিন কার সাথে খেলবে? জমির সাহেব অর্থাৎ সাবরিনের বাবা বলে এ দেখি ভারি সমস্যা। মেয়েটার মুখ থেকে গালী ছাড়িয়ে ফেলতে হবে। বড় বাবা বলে আরে না-এতো চিন্তা কিসের? মাত্র ৫বছর বয়স সাবরিনের। আরেকটু বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের পরিবারের কারো মধ্যে গালী দেয়ার স্বভাব নেই। বড় হয়ে সাবরিনও আর গালী দেবে না। একটু দুষ্ট হলেও সাবরিনের ব্রেন খুব শার্প। সাবরিনের তাসলিমা আফা অর্থাৎ করিম সাহেবের ভাতিজি জামাই-এর নাম আবু আহমেদ। জামাই আবু আহমেদ বাড়িতে বেড়াতে আসলে সাবরিন বলে আব্বু আবু এসেছে। জমির সাহেব বলে আবু বলে না আম্মু। বলো আবু ভাইয়া এসেছে। বড়দের নাম ধরে ডাকে না। জমির সাহেব মেয়েকে বলে আম্মু তোমার জন্য যে বই এনেছি এগুলো তুমি পড়? সাবরিন বলে হ্যা আব্বু পড়ি। আব্বুকে ইংরেজি কবিতাটা শোনাও তো দেখি। সাবরিন আবৃত্তি করে বলে টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার ............। এতোটুকুই। আর বলতে পারে না। সাবরিনের আব্বু মানে জমির সাহেব বলেন, ঠিক আছে আম্মু-অনেক সুন্দর হয়েছে। তুমি পুরো কবিতাটা শিখবে, কেমন? আচ্ছা আব্বু বলে দৌড় দেয় সে। জমির সাহেব মনে মনে ভাবছে: তার মেয়েটার জন্ম হয়েছে-সেদিনের মতো মনে হচ্ছে। অথচ পাঁচ বছরের কাছাকাছি হতে চললো। পাঁচ বছর পূর্ণ হলেই সাবরিনকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। মেয়েটা জন্ম নেয়ার আগে জমির সাহেব ভাতিজা-ভাতিজীদের প্রচন্ড আদর-¯েœহ করতো। এখন তাদের আদর কিছুটা কমে গেছে। আদর-স্নেহে পুরোপুরি ভাগ নিয়েছে সাবরিন। তিনি ভাবেন আগামী ১২ বছর পরের কথা। তখন সাবরিন সাবালক হবে। ভাল লেথাপড়া করাতে হবে। তাকে বিয়ে দিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে চোঁখে ঘুম এসে যায় জমির সাহেবের। ঘুম ঘুম ভাব থেকে জেগে উঠে মনের অৎান্তে ডাক দিয়ে উঠেন সাবরিন ও সাবরিন কোথায় রে তুই মা। জমির সাহেবের চোঁখ বেয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে।
৩০ মে - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪