জাকাতের কাপড়

শাড়ী (সেপ্টেম্বর ২০১২)

দিপা নূরী
  • ৩৮
  • ৮৩
সামনের ঈদে নিজেদের কিছু দরকার নেই। আছে নাতীনাতনীদের অনেক চাওয়া। লাল শাড়ী চুড়ি ফিতা জামা পোলাও মাংস। অভাবী সংসার। খাওন দাওন ঠিক মত হয় না। ঈদ আসলেই বাড়ে পোলাপান আর নাতীনাতনীর বায়না।

বিয়ে হইছে আজ চল্লিশ বছর। কোন দিন ভাল একটা কাপড় কিনে দিতে পারেনি রমিজ উদ্দিনের বৌকে। তার বিয়ের বয়সের আগেই বিয়ে দিয়েছে তার বাবা। আগের দিনের মানুষ তার এক আত্মীয়ের সাথে কথা দিয়েছিল। তার মেয়েকে বৌ করে নিবে। সেই কথা রেখেছে, ছেলের অল্প বয়সে। আর বৌএর বয়স তখন আরো কম। বিয়ে কি তা হয়তো বুঝেইনি। প্রথম বাচ্চা হওয়া পর হয়তো বুঝেছে বিয়ে। সংসার। স্বামীর সংসার করতে করতে বেড়েছে জ্ঞান, বুদ্ধি। পাঁচ পোলা চার মেয়ের ঘরে এখন অনেক গুলো নাতীনাতনী। কিন্তু ভাল শাড়ী পড়া আর হয়নি।

ও গুলমত, গুলমত তোর বাবার জ্বর অইছে। ওষধ নিয়ে আয় - আমার কাছে কোন টেহা নাই। ওষধ আনবাম কেমনে। বিয়ে করা ছেলে মেয়েরা যে যার মতো আলাদা। তাদের সংসার নিয়ে তারা ব্যস্ত। রিক্সা চালানো মাটি কাটা দিন মুজুরী করে সংসার চালায়। তাদের সংসার নিয়ে তারা ব্যস্ত। নিজেরা কষ্ট করে চলে। বাবামাকে খাবার কাপড় দিতে পারে না। বৃদ্ধ বয়সে তাদের সেবা করতে পারে না। অসুখে বিসুখে তাদের ঔষধ কিনে দিতে পারে না। গার্মেন্টসে চাকুরী করার সময় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখনো এক ছেলে দুই মেয়ের বিয়ের বাকী।

কৈ গেলিরে রাকিব । আয় হুইনা যা। দৌড়ে এসে চার পাশ থেকে ঘিরে ধরে নাতী-নাতনীর দল। দাদা আমারে চুড়ি কিনা দিবা। দাদা আমারে টুপি, দাদা আমারে লুঙ্গি ইত্যাদি বায়না। বৃদ্ধ রমিজ উদ্দিন তার নাতী-নাতনীদের খুব আদর করে। নিজেরা না খেয়ে থাকলেও তাদের জন্য কিছু না কিছু যোগার করে আনে। হাতে টাকা না থাকলেও শান্তনা দিয়ে বলে। দিমু দিমু সবুর কর। সামনে ঈদে। মনটা ভালো নেই। ঈদ যত কাছে আসে তাদের মনো কষ্ট আরো বেশী করে বাড়তে থাকে। শুধু এবার নয়। প্রতি বছর প্রতি বার। কেন যে ঈদ আসে। বুড়াবুড়ি কথা বলে আর কষ্টের নিঃশ্বাস ছাড়ে।

ঈদ আহে আমাগো গরীব মাইনসের অভিষাপ হয়া। যত সুখ বড় লোকের। রমিজের বৌ অবাক হয়ে বলে - এ তুমি কি কও। অভিষাপ কও ক্যান - অভিষাপ না তো কি। সারা বছর না খাইয়া থাকলেও পোলাপান রাগ করে না। কিছু চায় না। ঈদ আইলে তাগো চাওনের শেষ থাহে না। কিছু দিতে পারি না। ওগো কান্দা দেইহা আমার দুইচক্ষে পানি আহে। কৈ হারা বছর তো চক্ষে পানি আহে না। মনের কষ্ট গুলা দাউ দাউ কইরা জ্বইলা উডে না। ঈদে সুখ কই। আনন্দ কই । খালি কষ্ট আর কষ্ট। বছর বছর ঈদ আহে আমাগো টিটকারী করার লাইগা। ধনী গরীব এর তফৎ চোহে আঙ্গুল দিয়া বুঝানের লাইগা। চোহের পানি ঝরার লাইগা। রাতের ঘন অন্ধকারের মতো বুড়া বুড়ির হতাশার পাথর আরো বড় হতে থাকে।

এইবার ঈদের আগৈল রইজত আলী কুতুব আলী আর জরিনার লগে আমিও ঢাহা যামু। হুনছি ম্যালা কাফড় আর অনেক টেহা পাওয়া যায়। হ আমিও হুনছি। আমি গেলে আরো বালা অয়। যদি পোলাপানগর লাইগা কোন কাপড়ের যোগার করন যায়। যাকাতের কাপড় যদি পাওয়া যায়। বুড়াবুড়ি দুজনে কথা বলে সিদ্ধান্ত পাকা করে।

ঈদের তিন দিন আগেই তারা ঢাকা চলে আসে। মহিলা আর পুরুষ আলাদা গ্রুপ করে ঘুরে। সারাদিন ঘুরাঘুরির পর তাদের ঠিকানা রেল ষ্টেশনে ফিরে আসে। এখানেই তারা রাতে থাকে। দুই বাড়িথন একশ টাহা আর দুইডা কাপড় পাইছি। বুড়ির কথায় রমিজ উত্তর দিয়ে বলে হ আমিও তিনডা লুঙ্গি পাইছি। কিছু টেহাও পাইছি। বুড়াবুড়ি নাতীদের হাতে কিছু দিতে পারবে ভেবে আনন্দিত হয়। এবার ঈদ ভালো ভাবে কাটবে।

এবাড়িতে ও বাড়িতে চেয়ে তারা বেশ কয়েকটি কাপড় আর কিছু টাকা পায়। তারা খুশি হয়। মধ্যরাতে প্লাটফর্মে ঘুমায়। ভোরে উঠে আবার শুরু করে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরা। লোক মুখে তারা শুনতে পায় কোন এক বাড়িতে জাকাতের কাপড় দিবে। খুব সকালে গিয়ে লাইন ধরতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি তারা ঘুমিয়ে পড়ে।

এই তোমরা লাইন হয়ে দাঁড়াও। পুরুষ মহিলা আলাদা আলাদা লাইন করো। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে সিঁড়ির উপর থেকে কয়েক জন লোকের কথায় তারা লাইন হয়ে দাঁড়ায়। অন্য ভিক্ষুকদের সাথে তারা ভোরেই এ বাড়িতে আসে। তবু তারা সামনে দাঁড়াতে পারেনি। সামনে থেকে দু এক জন কমতে থাকলেও বাড়তে থাকে পিছনে লোকের সংখ্যা। বাড়তে থাকে ভিড় ধাক্কা ধাক্কি। দুজন দু লাইনে দাঁড়ায়। কেউ কাউকে দেখতে পায় না। তাদের সামনে যেতে হয় না। পিছনের লোকদের ধাক্কায় তারা সামনে চলে যায়। একের পর এক ধাক্কা সামলাতে বৃদ্ধ বয়সে সহ্য করতে পারে না। সুস্থ সবল মানুষে গুলোর সাথে তারা পেরে উঠে না।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চাপ আরো বেড়ে যায়। দুটি লাইন ভেঙ্গে এক হয়ে যায়। পিছনের এক ধাক্কায় সামনের লোক গুলো মাটিতে পড়ে যায়। বৃদ্ধ লোক পদপৃষ্ট হয়ে চাপা পরে। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু হয়। চারদিকে ছুটা ছুটি শুরু হয়। কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারে না। সবাই নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। পায়ের চাপে পিসে সাথে সাথেই পাঁচ জন মরে যায়। বৃদ্ধটিও আধমরা হয়ে পড়ে থাকে। লোকজন ধরাধরি করে মেডিক্যালে পাঠায়। জ্ঞান ফিরে তার স্ত্রীর খোজ নেয় কেউ তার সংবাদ দিতে পারে না। সে ফিরে আসে সেই স্থানে। কেউ কোন সন্ধান দিতে পারে না। একজন লোক তাকে বলে - এখানে তিন জন মহিলা আর দুই জন বৃদ্ধ লোক মারা গেছে। লাশগুলো এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছে। সেখানে গিয়ে দেখতে পার।

মানুষের পায়ের চাপে নাক মুখ থেতলে গেছে। তাদের কাপড়ে রক্ত লেগে আছে। বৃদ্ধ রমিজউদ্দিনের ছানি পড়া ঝাপসা চোখ জলে আরো ঝাপসা হয়ে আসে। মর্গে নিঃস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে তার স্ত্রী। নতুন জামার বদলে বাড়িতে নিয়ে আসে দাদীর লাশ।

বাড়িতে আসা মাত্রই শোনে। ঈদে নতুন জামা কাপড় না দিতে পেরে। বৌ বাচ্চার সাথে ঝড়গা করে তার নাতনীকে হত্যা করেছে তার এক ছেলে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নিলাঞ্জনা নীল সুন্দর লিখেছেন
ভালো লাগেনি ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২
প্রিয়ম অনেক অনেক সুন্দর একটা বাস্তব গল্প , ভালো লাগলো |
ভালো লাগেনি ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১২
golpo নিষ্ঠুর চারিপাশের নিত্য দৃশ্য ।শুভেচ্ছা
ভালো লাগেনি ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সিয়াম সোহানূর অনন্য ভাষা ও বুননে চমতকার গল্প ।
ভালো লাগেনি ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১২
জগজিৎ গল্পটায় শুধু প্রতিবারের দু:খজনক ঘটনাটি ফুটে উঠেনি একইসঙ্গে এই সময়ের কিছু বাস্তবতা উঠে এসেছে,,,,ভালো লাগলো,,,(পাল্টে দেবার স্বপ্ন আমার এখনো গেলোনা,,,,হাল ছেড়োনা বন্ধু বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে,,,)
ভালো লাগেনি ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সাবিহা ইসলাম Jebu ভাল লাগলো
ভালো লাগেনি ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১২
মোহসিনা বেগম বাংলাদেশের এই অবস্থার উত্তরণ কবে হবে আপু ?
ভালো লাগেনি ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২
বাংলাদেশের এই অবস্থার উত্তরণ হবে মরনের পরে।
ভালো লাগেনি ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১২
helen zaman অসাধারণ আপু.....আমার লেখার প্রতি একটু খেয়াল রাখবেন ।শুভানুধ্যান ।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২
মাসরুর মুস্তাফি এত সহজ ভাষায় যে কষ্টের অশ্রু ঝরান যায় তা তো আগে জানতাম না...অনে...ক ভালো লাগলো... কারন চকচকে সভ্যতার ভেতরকার এ তিক্ত জীবন নিয়ে আর কজন বা কলম ধরে...
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২
আলম ইরানি আমাদের দেশের রিয়্যাল চিত্র ।সালাম ও শুভেচ্ছা আপু ।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

১৬ মার্চ - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪