শাদিপুর। একটি ছোট গ্রাম। বসতি হাজার পাঁচেক। স্বাধীনতা পর শিক্ষার ছোঁয়া লাগে নি সে গ্রামটিতে। তবে আর দশ বছরের ব্যবধানে শিক্ষার কিছুটা ছোঁয়া পায়। তাও অল্প। অবৈপ্লবিক শিক্ষা। প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল এবং একটি সরকারি আলিয়া মাদরাসা এবং একটি বেসরকরি কওমি মাদরাসা আছে এ গ্রামে। কিন্তু শিক্ষিতদের হার হাতেগুনা। জাগতিক শিক্ষার শিক্ষিতরা থাকলেও ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত নেই বললেই চলে। এক সময় আবার ঠিকই ডজন খানেক ইসলামি শিক্ষিতদের চোখে পড়ে। আর জাগতিক শিক্ষিতদের সংখ্যাও কম নয়। সব মিলিয়ে টিপসই এর বদলে স্বাক্ষর দেয়ার মতো লোক এখন পাওয়া যায় শাদিপুর, ছোট গ্রামটিতে।
কিন্তু এ গ্রামের নিশাদের কাহিনি ভিন্ন। পড়ালেখা আর একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে নিশাদ। যে কারণে, গ্রামের ছেলেবন্ধুদের সাথে তেমন মিশে না সে। কিন্তু বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে একা থাকতে পারে না নিশাদ। বন্ধুদের সময় দিতেই হয়। এভাবে বন্ধুদের সঙ্গ দিয়েই নিশাদ বড়ো হতে থাকে। কিন্তু এতোকিছু থাকার পরও নিশাদের কোনোকিছুই ভালো লাগে না। ছেলেবন্ধুদের সাথে সময় পার করলেও, নিশাদ কিন্তু সব সময় কিসের চিন্তায় মগ্ন থাকে। মানুষ বন্ধুদের চেয়ে বই নামক বন্ধুর সঙ্গ দিলে অনেক ভালো হবে, এ কারণেই নিশাদের যতো দুশচিন্তা। কিন্তু পারছে না। আর তাই মানুষ বন্ধুদের সময় দিলেও, তার মন ভরে উঠছে না। কিন্তু বই নামক বন্ধু নিশাদের সাথে সঙ্গ দিচ্ছে না। কারণ, বই নামক বন্ধুর সাথে খোলামেলা-মেলামেশা বন্ধুত্বের জন্যে নিশাদের সেই যোগ্যতা নেই। বইকেনা সামর্থ্যরে বাইরে থাকায় বন্ধুত্ব হয়ে উঠছে না নিশাদের, বইয়ের সাথে। বই নামক বন্ধু ধনি, নিশাদ গরীব। আর ধনি-নির্ধনের উঠাবসা একসাথে হয় না, এ তথাকথিত সমাজে। তাই নিশাদ এবং বই নামক বন্ধুর মাঝে দূরত্ব আছে অনেক।
এদিকে, মা একজন গৃহিনী আর বাবা দিনমজুর। দিন আনে দিন খায় যাদের সংসার চলে, তাদের আবার পড়ালেখা? এমনিতেই জীবন নির্বাহ করা যায় না। টানাপোড়েন সংসার। এমতাবস্থায় কিভাবে আদরের দুলাল নিশাদকে পড়াবে? তবুও নিশাদের বাবা সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করে; না খেয়ে, না পরে নিশাদকে পড়াচ্ছে। ক্লাসের পাঠ্যপুস্তক যেখানে কেনার সাধ্য নেই, সেখানে আর খাতা-কলম কেনা তো কঠিন থেকে কঠিনতর নিশাদের জন্যে। তার উপর আবার এক্সটা আউট বই কেনা তো “ মরার উপর খাড়ার গা”র মতোই। কিন্তু নিশাদের আউট বই কেনার পাগলামু কেউ জানে না। বিষন্নমনে প্রতিটি মূর্হুত কাটে নিশাদের। কাউকে বুঝতে দেয় না। তার একটাই উদ্দেশ্য, বাংলা সাহিত্যচর্চা করে লেখক হবে। তাই তার প্রচেষ্টা অব্যাহত।
পরে এক সময় পরিবার-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধব সবাই জেনে যায়, নিশাদের আউট বই পড়ার প্রবণতার কথা। অসামর্থ্যবান পরিবারের অক্ষমতা, বন্ধু-বান্ধুব দূরে চলে যাওয়া আর সমাজ তো আরো নির্মম! কেউই এগিয়ে আসে নি নিশাদের এই প্রশংসনীয় অভ্যাসের জন্যে। নিশাদ ভেবেছিলো, হয়তো মানুষ জানলে, কিছুটা উপকার হবে। কিন্তু মানুষ উপচিকীর্ষা প্রবণ। তাই তাদের থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা পায় নি। উপরোক্তদের থেকে নৈরাশ হলেও, নিশাদ কিন্তু হাল ছাড়ে নি। নিশাদ ভাবলো, আমার কাজে আমাকেই এগুতে হবে। কারণ, ধন হলেই দারিদ্রতা বিমোচনে উদারমনের লোক পাওয়া এতো সহজ নয়। আর জ্ঞানের কদর তো মূর্খরা করতে জানে না। যদিও শাদিপুর এলাকার কতিপয় মাতাব্বর এবং পন্ডিতম্মন্য মুর্খরা নামের আগে শিক্ষানুরাগি (?) লেখা দেখতে চায়! এই হলো সমাজের হালচিত্র।
অবশেষে, নিশাদ পরনির্ভরতা ছেড়ে দিয়ে, বাবার কষ্টার্জিত যৎসামান্য টাকায় পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। আর ভবিষ্যতের চিন্তা করে টিউশনি খুঁজছে। কোনোভাবে একটা টিউশনি পেয়ে গেলেই, মনের আশা পুরা হয়ে যাবে। একদিন আশা পুরা হয় নিশাদের। আস্তেধীরে টিউশনি করে জমাকৃত টাকা দিয়ে আউট বই কিনছে, পড়ছে এবং শিখছে। দিবানিশি। বিরতিহীন। নামাজের সময় নামাজ, কাজের সময় কাজ আর যথাসময়ে পড়ালেখা; এভাবেই নিশাদের সময় অতিবাহিত হতে লাগল।
একদিন ঠিকই নিশাদ অধ্যবসায় খাতা-কলম হাতে নিতে শিখেছে। দু’কলম লিখতে শিখেছে। ছোট-খাটো রচনা, গল্প-সল্গ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং টুকটাক কাব্যমালা লিখতে শিখেছে নিশাদ। পড়ছে, লিখছে, লিখছে এবং পড়ছে। ফলে নিশাদের লেখার মান আরো উৎকর্ষে পৌছে যায়। ফলে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা নিউজ পাঠাবার মতো যোগ্যতা হয়ে উঠে তার। ক্ষণিকের ব্যবধানে নিশাদ মফস্বল সাংবাদিক। নাম-যশ কুড়াতে বেশ সময় নিতে হয় নি তার। নিশাদ এখন জাতীয় পত্রিকার সংবাদকর্মি এবং নিয়মিত ফিচার লেখক। মাঝে-মধ্যে ইসলামি প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গল্প এবং কবিতা পাঠায়। সম্পাদকেরা যতেœর সাথে ছাপায়। সন্মামনা পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠে নি। এভাবে লেখতে লেখতে পরিবার, সমাজ নিয়েও নিশাদ লিখতে থাকে। দেশ-জাতির দু:খ-কষ্ট, ভালো-মন্দ এবং সার্বিক বিষয়ের উপর সমসাময়িক প্রতিবেদন তৈরি করে, অনলাইন অফলাইনের পত্রিকাগুলোতে পাঠালে, সম্পাদকেরা তাও ছাপাতে থাকে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ের তথাকথিত জনপ্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রপ্ররিচালকের টনক নড়ে। আর সেই লেখালেখিই নিশাদের কাল হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের দৃষ্টিতে সে হয়ে উঠে নাটকীয় এক বানোয়াট অপরাধি।
নাশিদ ধর্ম-কর্ম, স্বজাতি এবং দেশিয় উন্নয়নে বিশ্বাসি বলে, সে চাচ্ছিলো যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিবর্ধনের। শুধু সে সখের বশে লেখে নি, সেই ৭১’ সালে ৯ মাস যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের পাথারতুল্য তাজা রক্তের এবং মা-বোনদের ইজ্জত-সম্ভ্রবের বিনিময়ে বাংলা মাকে উপহার হিসেবে আমরা গ্রহন করেছি। সেই মাতৃভূমির স্বাধীনতার মাধ্যমে বুকে থাকা তার ছেলেরাও স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করার অধিকারী বটে। সেই স্বাধীনতার একটি স্বাধীনতা হলো, বাক স্বাধীনতা। তাও আবার আমরা ৫২’ সালের ভাষাযুদ্ধে বরকত, জব্বার ও সালামদের প্রাণের বিনিময়ে, সেই বাক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজকের সেই নিশাদ নামের সালামেরা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষাকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। টুটি চেপে ধরে রাখা হচ্ছে। নিশাদ তাদের একজন। তাকেও বাকরুদ্ধ করতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি হয়ে না উঠতে এবং তাদের কালো মুখোশ যাতে উন্মোচিত না হয়, সেই জন্যে সমাজপতিরা তাকে বেআইনীভাবে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়। ফলে ঐ লেখালেখির এক পর্যায়ে কোনো এক লেখাকে কেন্দ্র করে তাকে দেশদ্রোহি বানিয়ে নাটকীয়ভাবে অপরাধি সাজিয়ে নিশাদের হাতে হাতকরা পরায়! সেইদিন থেকে নিশাদ কারান্তরীণ। বাংলা সাহিত্যচর্চা করেছে, বিধায় তার খেসারত দিতে হচ্ছে নিশাদের।
অবশেষে জামিনে বের হয়ে আসে নাশিদ। বাড়ি ফিরে। ফেরার পর নিশাদ ভাবতে থাকে যে, মানুষ তার সন্তানকে প্রকৃত মানুষ তৈরির জন্যে মানব তৈরির কারখানা বিদ্যাপীঠে পাঠায়। আস্তেধীরে সে শিক্ষা-দীক্ষায় বড়ো হয়ে উঠে। সামাজিকভাবে সে মানুষের মতো মানুষ হয়ে, যখন নিশাদের মতো হাজারো মায়ের কল্যাণকামি সন্তানেরা মায়ের বুকে ফিরে এসে; সমাজের জন্যে কিছু করতে চায়, তখনই আসে শতো বাধা। যে শিক্ষা নামক দর্পণে সামাজিক ব্যাধি নির্ণয় করে, সমাজকে কলুষমুক্ত করতে চায়, আজ সে শিক্ষাই তাকে কন্ঠরোধ করলো। কলম যাতে সামনে আর কিছু না লেখতে পারে, সেইজন্যে হাতে পরিয়ে দেয়া হয় হাতকরা। নিশাদের বুঝতে আর বাকি রইলো যে, তারা তাদের কালো চেহারা, শিক্ষা নামক দর্পণে দেখতে চায় না বলে, আলোকিত মানুষটিকে অন্ধকারে পাঠিয়ে দেয়। নিশাদ বুঝলো, এ সমাজে সত্যকে সত্য বলা যাবে না আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলা যাবে না। সমাজের অসংগতি বিষয়গুলা প্রকাশ করা যাবে না। বলা যাবে না সাম্য-বৈষম্যের কথা। নিজেরাও ভালো হবে না। নিশাদের মতো ছেলেদের ভালো হতে দেবে না। মৃতবস্থায় জীবন কাটাতে চায়। জীবন্ত জীবন তারা চায় না। নিশাদ ভেবে কোনো কুল পায় না। যেনো এক অতল ভাবনার জগতে তীরহীন সাগরে ভাসছে। এর কোনো সমাধান পাচ্ছে না।
নিশাদ আরো ভাবে, তাহলে কি ঐ সমাজে ঘোরতর অন্ধকারে জীবন যাপন করাই শ্রেয় নয় কি? চোর, ডাকাত বা তাদের ছত্রছায়ায় বসে বসে সন্ত্রাসি করে কাটাতে পারলেই মনে হয় এটাকে জীবন বলে। নিশাদ যে শিক্ষা পেয়ে আলোকিত মানুষ হয়েছে, সেই আলোকিত মানুষটাকেই অপরাধি বানিয়েছে সমাজ (?)। মায়ের ভাষাকে বাক স্বাধীনতার মাধ্যমে প্রকাশ করতে, নিশাদ হয়ে গেলো দাগি এক অপরাধি। নিশাদ আরো ভাবে, যদি এই বই পড়া, শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে বাক স্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে দু’কলম লেখতে যেয়ে, আমাকে বাকরুদ্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে নিশাদ নামক মানুষটা আবার অমানুষ হয়ে যাওয়াটা ভালো নয় কি?। এই ভেবে নিশাদ মনে বড়ো কষ্ট নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে...। জীবনে এরচে বড়ো দু:খ কী আর হতে পারে, নিশাদের মনে সেই প্রশ্ন। এখন লেখবে কি লেখবে না, সেই ভাবনায় নিশাদ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।