অন্ধকার স্বাধীনতা

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১৩)

শাহ আকরাম রিয়াদ
  • ১৩
  • ৫৪
“আইচ্ছা বাজান! স্বাধীনতা কি?”
ছোট্ট মেয়েটির মুখে এমন প্রশ্নে হতচকিত হল স্কুল শিক্ষক আমজাদ আলী। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ছোট্ট রাহীর গোলগাল মুখটির পানে। রাহী তার একমাত্র মেয়ে। বয়স সবেমাত্র সাত বছর তিন মাস। এইটুকু বয়সে খুব চঞ্চল, চটপটে। একস্থানে স্থির হয়ে বসার মেয়ে সে নয়। এই এখন তার পোষা ময়না পাখিটি নিয়ে খেলা করছে। তাকে খাবার দিচ্ছে।
রাহী আবার তাড়া দিলো আমজাদকে।
-কও না বাজান! স্বাধীনতা কি?
-কইতাছিরে মা কইতাছি। আগে ক এইডা তুই কই শুনছস?
-মিলিগো রেডিওতে এক ব্যাডা মোডা গলায় চিল্যাইয়া চিল্যাইয়া কইতাছে-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ওইখান থেইক্যাইতো শুনছি।
-ও। ওই ব্যাডা হইল আমাগো শেখ সাব।
-শেখ সাব কেডা বাজান?
-শেখ সাব আমাগো নেতা।
-ও আমাগো ফজলু কাকার মত নেতা?
-আরে পাগলি! এই নেতা, সেই নেতা না। এই নেতা হইল দেশের নেতা।
-ও দেশের নেতা! কথাটি বলে ময়না পাখিটিকে খাবার দেওয়ার জন্য আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলো। খাবার দিয়ে আবার এসে আমজাদ আলীর পাশে বসে রাহী।
-বাজান কওনা, স্বাধীনতা কি?
-মারে! স্বাধীনতা অনেক বড় কথা, তোরে ক্যামনে বুঝাই।
নিজের অজান্তেই একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমজাদ আলীর বুকের ভেতর থেকে। কিছুক্ষণ পর আবার শুরু করে রাহীর ময়না পাখির খাঁচার দিকে তাকিয়ে।
-স্বাধীনতা হইলো ধর তোর এই পাখিটারে যদি খাঁচার থেইক্যা ছাইড়্যা দেছ তাইলে সে উইড়তে পারবো, ডানা দুইডারে ছড়াইয়া বাতাসে ভাসতে পারবো, ইচ্ছে মত যেইখানে খুশি সেইখানে যাইতে পারবো। যা খুশি তা খাইতে পারবো, যে গাছের ডালে খুশি বইতে পারবো। এইটাই হইলো হের স্বাধীনতা|
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে আমজাদ আলী থামলেন ।
আর তার মুখের দিকে চোখ দুটো বড় করে অবাক হয়ে চেয়ে রইল ছোট্ট রাহী।
-তাইলে এইডারেই স্বাধীনতা কয়!
-এইটাই হইলো স্বাধীনতা| তয় মানুষের স্বাধীনতা আরও বড়। বড় হইলে আস্তে আস্তে সব জানবিরে মা।
এমন সময় পিছনে এসে দাঁড়াল আমজাদ আলী স্ত্রী রাহেলা।
-বাপ-মাইয়্যায় কি এত কথা কও?
-আরে তোমার মাইয়্যা রেডিওতে শেখ সাবের ভাষণ হুইন্যা আমারে জিগায় স্বাধীনতা কি?
-চলো হাত মুখ ধুঁযে ভাত খাইতে চলো, দুপুর যাই বিকাল অইতাছে, হেই খেয়াল আছে বাপ-মাইয়্যার।
-হ চলো, চলরে মা।
-তোমরা যাও, আমি আইতাছি।
বাবা-মা চলে যাওয়ার পর খাঁচার কাছে এসে দাঁড়ালো রাহী। তারপর খাঁচাটি ধরে বলল
-ও ময়না! ময়না পাখি আমার! একদিন তোরে আমি স্বাধীনতা দিমু। একদিন তোরে ছাইড়্যা দিমু। তুই আকাশে ডানা দুইডারে ছড়াইয়া উড়বি। তোর যেখানে খুশি তুই চইল্যা যাইবি। সত্য কইতাছি তোরে একদিন ছাইড়া দিমু।
ময়না পাখিটি যেন রাহীর কথা বুঝতে পারল। তাই সে খাঁচার ভিতরে ডানা দুটিকে ঝাপটাতে লাগলো।
রাহী খাঁচাটি ছেড়ে ভাত খাওয়ার জন্য চলে গেলো।
ভাত খেতে খেতে আমজাদ রাহেলাকে বলল।
-দেশের অবস্থা বেশী ভালা না। যে কোন সময় একটা গণ্ডগোল হইতো পারে। তুমি রাহীরে লইয়া বাপের বাড়ি থেইক্যা কয়দিন বেড়াইয়া আসো।
রাহীর থালায় ভাত দিতে দিতে রাহেলা অনুযোগের সুরে বলল-
-গণ্ডগোল হইলে শহরে হইবো, আমাগো এইখানে কি গণ্ডগোল হইবো। আমি তোমারে রাইখ্যা কোথাও যামু না।
-তোমারে লইয়া আর পারি না, তুমি সবকিছু আগে থেকেই বুঝে ফেলো। শেখ সাবের ভাষণ হুইন্যাতো মনে হইল এবার আর ছাড় দিবো না। শুনতাছি তারে নাকি আ্যরেষ্টও করবো। তাই কইছিলাম বাপের বাড়ি কয়দিন বেড়াই আসার কথা।
রাহী চুপচাপ ভাত খাচ্ছিল। বাবা-মা কথার এক পর্যায়ে সে বলে উঠল-
-বাজান! আমি আমার পাখিটারে স্বাধীনতা দিমু। খাঁচা থেইক্যা ছাইড়্যা দিমু। সে আকাশে ডানা ছড়াইয়া উড়বো। আমি চাইয়্যা চাইয়্যা তারে দেখমু।
তার কথা শুনে বাবা-মা দুজনে একযোগে হেসে উঠলো।
আমজাদ আলী বাম হাত দিয়ে রাহী মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল-
-হ’ রে মা, তাইলে ভালা কাম হইবো।



আমজাদ ঘরের বারান্দায় বসে ছিঁড়ে যাওয়া মাছ ধরার জাল ঠিক করছিল। এমন সময় ফজলু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আমজাদ আলীর কাছে। এসেই হাফাতে হাফাতে বলল-
-ভাইজান! শহরে নাকি গণ্ডগোল শুরু হইয়্যা গেছে। যারে পাইতাছে গুলি কইরা মাইরা ফালাইতাছে।
-কার কাছ থাইক্যা শুনছস্ এ খবর।
-আমাগো শাহজাহান ভাই ঢাকা থেইক্যা পরিবার লইয়্যা পলাইয়া আইছে। হেই-ই খবরটা কইলো।
-শাহজাহান কই এখন?
-হে বাড়িতে গেছে, বিকেলে তোমার সাথে দেখা করবো কইছে।
বিকেলে শাহজাহান আসে আমজাদের সাথে দেখার করার জন্য। ছোটবেলা থেকে দুজনে একসাথে বড় হয়েছে, পড়াশোনা করেছে। শাহজাহান এসে আমজাদকে বুকে জড়িয়ে কোলাকোলি করল। রাহেলা বাড়ির উঠোনে তার হাতের কারু কাজ করা শীতল পাটিটি বিছিয়ে দিলো। তারপর আমজাদ, ফজলু, শাহজাহান সেখানে বসে কথা আরম্ভ করলো।
শাহজাহান কথা আরম্ভ করল-
-কুকুরের মত গুলি করে মানুষ মারছে শুয়োরের বাচ্চারা। একটা বাচ্চাও তাদের হাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছে না। যে যেভাবে পারছে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। এখনই আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। শহর শেষ করে হারামজাদারা নাকি গ্রামের দিকে আক্রমণ করছে।
এক পর্যায়ে আমজাদ শাহজাহানকে লক্ষ্য করে বলল-
-আমরা ক্যামনে শত্রুর মোকাবেলা করমু? আমাগো অস্ত্র-শস্ত্র কিছুইতো নাই।
-আমজাদ মনোবল থাকলে অস্ত্র-সন্ত্র ব্যাপার না। আমাদের গ্রামের যুবকদের এক হয়ে গ্রামটাকে রক্ষা করতে হবে। ফজলু, তুই বদরুল, সাকের, বাদল, আজহার সবাইকে খবর দে। আমি সন্ধ্যার পর স্কুলের মাঠে কথা বলব সবার সাথে।
শাহজাহান গ্রামের যুবক-তরুণ ছেলেদের যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বলল। তার নেতৃত্বে ১০/১২ জনের একটি দল তৈরি হল যুদ্ধে যাবার জন্য। সে দলে আমজাদ ও ফজলু দুই ভাই একসাথে যোগ দিল। তাদের গ্রামটি তখন পর্যন্ত আক্রমণের কোন আশংকা ছিল না। তাই আমজাদের বহু পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও রাহেলা রাহীকে নিয়ে বাপের বাড়ী যেতে চায়নি। তার এক কথা
-মরণ যদি হয় ওখানে গেলেও হবে, তার চেয়ে আমি তোমার ভিটায় মরমু।
আর কথা বাড়ায় না আমজাদ। রাহীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-মারে! তুই বাহিরে বেশি ঘোরাঘুরি করবি না। তোর মার লগে ঘরেই থাকবি।
-তোমরা কই যাও বাজান?
-তোর লাইগ্যা স্বাধীনতা আনবার যাইতাছি।
-স্বাধীনতা দিয়া আমি কি করমু বাজান?
-তুই তোর মত হাসতে পারবি, তোর মত তুই খেলতি পারবি, আবার বাহিরে ঘোরাঘুরি করতে পারবি, স্কুলে যাইতে পারবি। আরও কত কি করতে পারবি।
-ও হেইর লেইগ্যা তোমরা যাইতাছো।
-হরে মা হ।
-তাইলে যাও, স্বাধীনতা নিয়া তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরা আসো।
-আইচ্ছা।
বিদায় নিয়ে আমজাদ আর ফজলু বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।

আমজাদরা চলে যাওয়ার কিছুদিন পর গ্রামে কিছু পাকিস্তানি দোসর মাথা ছাড়া দিয়ে উঠল। তাদের নেতৃত্বে ছিল কাদের মিয়া। যারা যারা যুদ্ধে গিয়েছিলো তাদের পরিবারের লোকজনকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানি ও হুমকি ধমকি প্রদান করত কাদের মিয়া। এক পর্যায়ে গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প করলো। কাদের মিয়া তাদেরকে আদর-আপ্যায়নের পূর্ণ ব্যবস্থা হাতে নিলো। গ্রামের যুবতী মেয়েদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় কাদের মিয়ার লোক। একদিন আমজাদ আলীর বাড়িতে কাদের মিয়ার প্ররোচনায় হানা দেয় পাকিস্তানী সৈন্যরা। সে পাকিস্তানীদের বলে এই বাড়ির দুইটা যুবক ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। রাহেলা পাকিস্তানী সৈন্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে রাহীকে লুকাতে বললো। তারপর সে একটি ধারলো চুরি নিয়ে দরজা খুলে দরজা আগলে দাঁড়াল। পাকিস্তানী সৈন্যরা রাহেলার রূপ দেখে কুতকুতে চোখে তার দিকে তাকালো। আর কাদের মিয়াকে পাঠাল রাহেলাকে ধরে আনার জন্য। কাদের মিয়া দুই তিনজন লোক নিয়ে তাকে ধরা জন্য এগিয়ে গেলে রাহেলা চিৎকার করে শাসালো
-আর এক পা আগালে খুন করে ফেলবো!
কাদের মিয়া শয়তানের হাসি হেসে উঠল।
-আমাগোরে ডর দেহাইয়্যা লাভ নাই, আপোষে ক্যাম্পে চল। ভালা হইবো তোমার।
-কুত্তার বাচ্চা! তোর মাইয়্যাগোরে নিয়া যা ক্যাম্পে।
কাদের মিয়া রাগে গর গর করতে থাকে। তারপর সাথের লোকদেরকে চেঁচিয়ে বলে উঠে
-ওই শুয়োরের বাচ্চারা! খাড়াইয়া কি তামাশা দেখস! শালীরে ধইর‌্যা লইয়া আয়।
রাহেলাকে ধরার জন্য লোকগুলো এগিয়ে যেতেই রাহেলা তার হাতে থাকা চুরিটি নিজের পেটের ভেতরে গভীর ভাবে ঢুকিয়ে দিলো। তারপর ঢলে পড়লো বারান্দায়। রক্তে ভাসতে লাগলো পুরো মেঝে। ঘটনার আকস্মিকতায় কাদের মিয়া হতবাক হয়ে গেলো। মায়ের এই অবস্থা দেখে ছোট্ট রাহী আর লুকিয়ে থাকতে পারল না। চিৎকার করে মা মা বলে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো-
-মা তুমি এইডা কি করলা! আমি এহন কার কাছে থাকমু মা। কে আমারে খুকী কইয়া ডাকবো?
রাহীর মুখের পানে চেয়ে রাহেলা অনেক কষ্টে মুখ খিঁচে বললো-
-তু..ই.. বা..হি..র হ..ই..ছস ক্যা..!
এই কথা বলে নিথর হয়ে গেলো রাহেলা।
পাকিস্তানী সৈন্যরা এই অবস্থায় রাগে ফেটে পড়লো। এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে আমজাদের ঘর লক্ষ করে। এরপর তারা চলে যায় সেখান থেকে। রাহীর ছোট্ট দেহটি এলোপাথাড়ি গুলির আঘাতে কেঁপে উঠলো। ঘটনাক্রমে এলোপাথাড়ি করা গুলির একটি গুলি রাহীর বাম হাতের বাজুর মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে গেলো। রক্ত ঝরতে লাগলো ছোট্ট দেহটি থেকে। পাকিস্তানী সৈন্যরা চলে যাবার কিছুক্ষণ পর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল রাহী। তারপর ঘরের বেড়া ধরে ধরে হাটতে লাগল। তার শরীর থেকে অবিরত রক্ত ঝরছে। তবুও থামছে না সে। বহু কষ্টে ঘরের ভেতর ঢুকলও। কিছুক্ষণ পর ঘরের ভেতর থেকে তার পোষা ময়না পাখির খাঁচাটি নিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এলো। তারপর আস্তে আস্তে বারান্দায় বসে পড়লো। কোলের উপর খাঁচাটিকে তুলে নিলো। পাখিটি কেমন যেন ছটফট শুরু করলো। পাখির খাঁচার দিকে চেয়ে রাহী ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল-
-তোরে কইছিনা.. একদিন..তোরে আমি স্বাধীনতা দিমু..। তুই আকাশে ডানা ছড়াইয়া উড়বি, খেলবি...। আমি তোরে দুর থাইক্যা চাইয়্যা চাইয়্যা দেখমু..। তোর যেখানে খুশি সেখানে উইড়্যা যাইবি..।
কথা গুলো বলে খাঁচার দরজা খুলে দিলো। পাখিটি বেরিয়ে উড়াল দিলো আকাশে। উড়তে উড়তে বহুদূর মিলিয়ে গেলো। রাহী একদৃষ্টে চেয়ে রইল আকাশের পানে। দেখছে সেখানে জ্বলছে তার স্বাধীনতার সূর্য। তার চোখে মুখে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই সূর্য। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বারান্দায় পড়ে থাকা মায়ের দেহের পাশে গিয়ে মাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ, সাদা হয়ে যাচ্ছে তার ছোট্ট শরীরটি। ধীরে ধীরে চোখ দুটো মুদে এলো। তার দুচোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। যে ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে না।


যুদ্ধ শেষে আমজাদরা ফিরে এলো গ্রামে। বাড়িতে একরকম দৌড়তে দৌড়তে আমজাদ আর ফজলু ছুটে এলো। চিৎকার করতে লাগল
-কইরে রাহী মা, কই তুই? দেখ তোর লাইগা আমি স্বাধীনতা লইয়্যা আইছি!
উঠানে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ডাকার পরও কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো আমজাদ। বারান্দার কাছে এসে থমকে গেলো সে। মেঝেতে রক্তের কালশিটে বড় দাগ আর তার পাশে শূন্য পাখির খাঁচা পড়ে আছে। বুকের মাঝে হঠাৎ একটা শূন্যতা অনুভব করলো সে। এরমধ্যে আশপাশের পাড়া প্রতিবেশীরা এসে জড় হলো। তাদের চোখ ভরে উঠলো জলে। আমজাদ একদৌড়ে ঘরের ভিতরে গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকলো
-রাহী.. রাহী... রাহেলা.. রাহেলা।
এই রুম ও রুম খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আমজাদ। তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো ফজলু।
-ভাইজান ওরা আর বাইচ্যা নাই।
ফজলুর কথা শুনে আমজাদ কেঁপে উঠলো।
হাত দিয়ে ঘরের পাশের দুইটি নতুন কবরের দিকে ইশারা করল ফজলু
-ওরা ওই খানে শুয়ে আছে।
কবর গুলো দেখে এক নিমিষে পাথর হয়ে গেলো আমজাদ। আর কোন কথা বলল না। চোখে এক ফোটা পানিও বের হলো না। ফজলুর সাথে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো কবরের কাছে। পেছনে পেছনে পাড়া প্রতিবেশীরা এগিয়ে চলল।


ও বড় দাদা...বড় দাদা। তুমি কানতাছো ক্যা?
১০ বছরের নাতনী মাইশার ডাকে চেতন ফিরে এলো আমজাদের।
-কি দাদু ভাই?
-তোমারে হেই কখন থেইক্যা ডাকতাছি, তোমার কোন খবর নাই। তুমি কানতাছো ক্যা?
-কই কানতাছি দাদু ভাই।
-এ যে তোমার চোখে পানি।
ছোট হাত দিয়ে চোখের পানি গুলো দেখালো মাইশা।
এই মেয়েটি তার ছোট ভাই ফজলুর ছেলের মেয়ে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে। খুব মিষ্টি মেয়ে। সারাক্ষণ বড় দাদু ভাইয়ের সাথে গল্প গুজবে তার দিন কাটে। আমজাদ বহুবার রাহীর কথা মাইশাকে বলেছে। মাইশাও বারবার রাহী ফুফুর গল্প শুনতে চায়। যুদ্ধ শেষে কিছুদিন পর সর্বহারা আমজাদ স্বাভাবিক হলে পাড়া প্রতিবেশী তাকে আবার বিয়ে করতে বলে। কিন্তু সে কিছুতেই আর বিয়ে করতে চায় না। তার সবকিছু জুড়ে জড়িয়ে আছে রাহী আর রাহেলা। তাই অগত্যা পাড়া-প্রতিবেশী ফজলুকে বিয়ে করালো। সে থেকে আজ অবধি আমজাদ আলী, ফজলুর সংসারে একসাথে থাকে, অবসর হওয়া অবধি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিল। এখন পাড়ার বিভিন্ন শ্রেণীর ছেলে মেয়েদের টিউশনি পড়ায় তার বাড়িতে।
তার আজ রাহীর কথা মনে হতে মনে পড়লো, বড় হলে রাহীকে যে স্বাধীনতার কথা বলবে ভেবেছিলো, সে স্বাধীনতা আজ সম্পূর্ণ বিপরীত স্রোতে বহমান। যে স্বাধীনতা দেখবে ভেবেছিলো আমজাদ, সে আসেনি। তার নিজের কথায় সে ভাবে, তার পেনশনের টাকার জন্য সে কত বার গিয়েছিলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। কত ছুটোছুটি করেছে বিভিন্ন দপ্তরে, কোন ভাবেই সে পেনশনের এ কয়টা টাকা পাচ্ছে না। স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলছে না তাকে। শুধু আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু বলে বলে ঘুরাচ্ছে। শুধু একদিন এক দপ্তরের পিয়ন তাকে ইশারায় কাছে ডেকে বলল- স্যার শুধু শুধু কষ্ট করছেন। কিছু খরচাপাতি করুন, পেনশনের টাকা পেয়ে যাবেন। আমজাদ পুরোপুরি হতাশ হলো। ভাবছে আর যাবে কি যাবে না। এভাবে হয়রানি হতে আর ভাল লাগেনা এই পড়ন্ত বয়সে। স্বাধীনতার ৪২ বছরের ইতিহাসে আজ এবেলায় এসে স্বাধীনতার সচিত্র তার কাছে হাস্যকর মনে হলো। চারিদিকে আজ সে যেভাবে দুর্নীতির অবাধ স্বাধীনতা দেখতে পায়। ঘুষ খাওয়ার স্বাধীন প্রতিযোগিতা দেখতে পায়। প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে দলীয় ক্যাডারদের অস্ত্র মহড়ার স্বাধীনতার ছবি দেখতে পায়। দেখতে পায় বিশ্বজিৎ নামক যুবককে কুপিয়ে কুপিয়ে খুনের স্বাধীনতার দৃশ্য। কর্তৃপক্ষের স্বাধীনতায় পোশাক শ্রমিকদের পুড়ে কয়লা হওয়ার দৃশ্য ভেসে উঠে। আশীর্বাদ পুষ্টদের টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির স্বাধীনতা দেখতে পায়। স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের উত্ত্যক্ত-কারী বখাটেদের স্বাধীনতা দেখতে পায়। লাগামহীন মিথ্যে অঙ্গীকারের স্বাধীনতা দেখতে পায়। জ্বালাও, পোড়াও হরতাল-অবরোধ ডাকার অবাধ স্বাধীনতা দেখতে পায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধির স্বাধীনতা দেখতে পায়। এইসব স্বাধীনতার ভীড়ে তার স্বপ্ন জড়ানো স্বাধীনতা আকাশ-পাতাল ব্যবধান। যে সবুজ স্বাধীনতার কথা রাহীকে বলবে ভেবেছিলো সে স্বাধীনতা আজ অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতা আজ স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। তাই তার চোখে আজ জল।

~~~~:::::~~~~
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ কবির হোসেন প্রিয় শাহ আকরাম রিয়াদ ভাই একটা হৃদয়স্পর্শী গল্প পরলাম. ধন্যবাদ-আবার দেখা হবে.
মামুন ম. আজিজ রিয়েলিষ্টিক গল্প। ইতিহাসের কথা বলে......সুন্দর সংগঠন।
তাপসকিরণ রায় ভাই! সুন্দর গল্প লিখেছেন।ভাব,ভাষা কাহিনীর ধারাবাহিকতা সব কিছু ভালো লেগেছে।আপনাকে জানাই অনেক শুভেচ্ছা।
এশরার লতিফ স্বাধীনতা, আত্মত্যাগ, স্বপ্নভঙ্গ মর্মস্পর্শীভাবে বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে.
নিলাঞ্জনা নীল খুব সুন্দর হৃদয়স্পর্শী
ওবাইদুল হক গল্প অনেক সূদুর প্রবাসের মত তবে তার মাঝে আসল রুপ লুকিয়ে আছে । অনেক অনেক ধন্যবাদ ্
অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা
সূর্য গল্পের প্লাটফর্মটা বেশ বড়, যদিও ফ্লাশব্যাকেই গল্পের পটভুমি তবে সময়কালটা হলো বর্তমান।আর এই দীর্ঘ সময়কে ছোট গল্পে ধারন করতে গেলে যেটা হবার এ গল্পেও তাই হয়েছে মানে কিছুটা সিনেম্যাটিক (নাটকের দৃশ্যায়নের মতো খন্ডে খন্ডে)। এই দুটো সময়ের আকাঙ্খা আর প্রাপ্তীতে অবশ্যই অনেক অপূর্ণতা রয়ে গেছে। এর দায় আমাদের সকলের। আমরা সবাই বিচ্যুত হয়েছি সঠিক গন্তব্যের দিক থেকে। সবাই নিজের ভাগটা আদায়ের পাশাপাশি আরো বেশি পাওয়ার আকাঙ্খায় স্বাধীনতার চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধে যারা সব হারিয়েছেন তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। একটা একটা জাতীর জন্য কলঙ্কের। রিয়াদ ভাল লাগলো তোমার গল্প।
অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ বর্ণনা ও সংলাপ মাধুর্যে পরিচ্ছন্ন একটি কথার শিল্প । ভাল লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা
সুমন গল্পের করুণ পরিণতিতো রোজই দেখতে পাই। কবে যে সত্যিকার স্বাধীন হব আমরা। আবেগী ঝরঝরে গল্পের জন্য ধন্যবাদ জানাই।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
মিলন বনিক -তোরে কইছিনা.. একদিন..তোরে আমি স্বাধীনতা দিমু..। তুই আকাশে ডানা ছড়াইয়া উড়বি, খেলবি...। আমি তোরে দুর থাইক্যা চাইয়্যা চাইয়্যা দেখমু..। তোর যেখানে খুশি সেখানে উইড়্যা যাইবি..। এই কথাগুলোই আবেগ আপ্লুত হয়ে পরেছিলাম....খুব ভালো লাগল গল্পটা....অনেক শুভকামনা...
অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা

২১ ফেব্রুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪