জিম বাবু-০২

বৈরিতা (জুন ২০১৫)

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
  • ১০
  • ৬৭
সততা ছিল। বিনয় ছিল। আর এখন --- আর এখন এসব কিছুই নেই। সব কিছু যেন কিসের টানে ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। উইপোকার ঢিবির মত। কচু পাতার পানির মত । তাসের ঘরের মত । কফিল উদ্দিন সাহেব বুঝতে পারছেন না, কেন এই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া? এই অবক্ষয়ের শেষ কোথায়? শেষ ঠিকানা কোথায়? কিসের আশায়, কোথায় ছুটে চলেছি আমরা!

এই মুহূর্তে তাঁর হৃদয়ে ঝড় বইছে। মহা কাল বৈশাখীর ঝড়! এ ঝড় কিভাবে থামাবেন তিনি বুঝতে পারছেন না। এই তো তিনি ছোট বেলায় গ্রামে দেখেছেন একটি মুরগি, একটি ছাগল কিংবা একটি গরু মারা গেলেও পাড়া শুদ্ধ মানুষ এসে ভিড় করত। সমবেদনা জানাত। আর এখন মানুষ মারা গেলেও কেউ আসতে চায় না। কেউ আসে না। নেহায়েত আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব ছাড়া। অনুভূতি গুলো আজ মরে গেছে অথবা মরে যাচ্ছে। পুরো গ্রাম ঘুরে বেরালেও এখন আর একটি খড়ের ঘর খুঁজে পাওয়া যায় না।
এর জায়গায় টিনের ঘর, ইটের ঘর জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু মানুষের হৃদয় থেকে কেড়ে নিয়েছে সবকিছু। আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, বিবেক। এখন গ্রামেও হানাহানির শেষ নেই। এক সময়ের সহজ, সরল অনাড়ম্বর মানুষ গুলো এখন আর কেউ কারো ভালো চায় না। মঙ্গল চায় না। কল্যাণ চায় না। অনিষ্ট চায়। ক্ষতি চায়। পথ নিয়ে, জমির আল নিয়ে, পুকুরের মাছ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, কুটনীতি নিয়ে, মোড়লগিরি নিয়ে এরা সারাক্ষণই ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকে।

মরিয়ম বেগম স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছ এত গভীর ভাবে?
না, তেমন কিছু নয়।
তেমন কিছু নয় মানে? তোমার মুখ দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে! আর আমি তো তোমার সহধর্মিণী। সাত বছর ধরে একই বিছানার ভিতরে ! সেই আমি বুঝতে পারব না ?
মরিয়ম বেগমের কথা শুনে কফিল উদ্দিন সাহেব না হেসে পারলেন না। বললেন, দেশের কথা ভাবছি। দশের কথা ভাবছি। আগে কী ছিলাম; এখন কী হয়েছি! সেই কথা ভাবছি। যন্ত্র আর যান্ত্রিকতা আমাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। সব কিছু!
মরিয়ম বেগম বললেন, অনেক কিছু দিয়েছেও! তা কি অস্বীকার করতে পারো?
না, তা পারি না। তবে যা পেয়েছি আর যা হারিয়েছি; এ দুটোর পার্থক্য যে অনেক বেশি!
তা হয়ত হবে! তবে এতে আমাদের দোষ কী?
দোষ, গুণের প্রশ্ন নয় মণি। আসল কথা হল ------এমন সময় জিম কথা বলে উঠল। মাম্মা, দাদু বাড়ি আর কতদূর?
সে অনেক দূর বাবা - -- বললেন কফিল উদ্দিন সাহেব।
আর কয় মিনিট লাগবে বাবা?
তিন চার ঘণ্টা লাগতে পারে!
ঘণ্টা কী?
জিমকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য কফিল উদ্দিন সাহেব উল্টো জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুমি বলতো মিনিট কী?
জিম বিজ্ঞের মত জবাব দিল, মিনিট হল সময়।
সময় কী?
এইবার জিম বিপদে পড়ল। মাকে জিজ্ঞেস করল, মা সময় কী?
মরিয়ম বেগম বললেন, সময় হল টাইম।
জিম বলল, বাবা সময় হল টাইম।
তাহলে ধরে নাও ঘণ্টাও হল টাইম। মিনিট কম টাইম। আর ঘণ্টা বেশি টাইম। কি বুঝতে পেরেছ জিম?
জিম বিজ্ঞের মত মাথা নাড় । সব বুঝতে পেরেছে।

ট্রেন এখন উল্কার গতিতে ছুটে চলেছে। ছুটে চলেছে গাছ পালা। আকাশের মেঘ। সেই সাথে সূর্য। ঝক ঝকা ঝক শব্দ হচ্ছে । কবি শামসুর রাহমানের ট্রেন চলেছে কবিতাটি মরিয়ম বেগমের বার বার মনে হচ্ছে। তিনি স্কুল টিচার ছিলেন।সেই সব দিনের স্মৃতিরা মনের মাঝে কিলবিল করছে। আসলে শিক্ষকতার চেয়ে ভাল কোন প্রফেশন হয় না। বিশেষ করে প্রাইমারি এবং হাইস্কুলে পড়ানোর মজাই আলাদা। কোমল মতি শিশুদের নিয়ে শিক্ষা দেয়া। এ যেন সত্যিই স্বর্গের মতন।

ভৈরব স্টেশনে বড় একটি যাত্রা বিরতি আছে। এখানে ইঞ্জিনের দিক পরিবর্তন করা হয়। এতে প্রায় ২৫-৩০ মিনিটের মত সময় লাগে। কফিল উদ্দিন সাহেব ঠিক করলেন, এই ফাঁকে বাবা মায়ের জন্য কিছু ফলমূল কিনতে হবে। মায়েরনাম আয়েশা বেগম। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এখনও আল্লাহর রহমতে অনেক শক্ত সামর্থ্য। মা আঙ্গুল খুব পছন্দ করেন। আর বাবার পছন্দ কমলা। এ দুটো অবশ্যই কিনতে হবে। কমন আইটেম। সাথে পছন্দ মত আর কিছু।
অবশ্য জামা কাপড় আগেই কিনে রেখেছিলেন। সে গুলো সাথে নিয়ে এসেছেনচ। আরও নিয়ে এসেছেন বড় বড় দুটি বাইম মাছ আর কিছু গরুর মাংস। মা -বাবার প্রতি কফিল উদ্দিন সাহেবের শ্রদ্ধা ভক্তি অতুলনীয়। এখনকার দিনে এমনটি আর সচরাচর দেখা যায় না। মরিয়ম বেগমও শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের মা বাবার মতই দেখেন।


চৈত্রের খরতাপে আকস্মিক বৃষ্টি হলে কৃষকের মনে যেমন খুশির ঢেউ লাগে; তেমনি রফিক সাহবের পরিবারে আনন্দের জোয়ার উথলে উঠেছে। দীর্ঘ দিন পরে একমাত্র সন্তান, পুত্র বধূ আর নাতিকে কাছে পেয়ে তাদের আজ খুশির শেষ নেই। বেলা প্রায় দুইটার দিকে কফিল উদ্দিন সাহেব সপরিবারে বাড়িতে পৌঁছেছেন। এ যেন হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড। মেঘ না চাইতেই জল। আয়েশা বানুর দুচোখে আনন্দের অশ্রু। আত্মীয় প্রতিবেশি দু চার জন ছেলে বুড়ো এসে ভিড় করেছে। সকলেরই চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। কফিল সাহেব সবাইকে চকলেট খেতে দিলেন। জিম কয়েকটি ছেলের সাথে খেলতে চলে গেছে।
মরিয়ম বেগম শাশুড়ি মার সাথে রান্না ঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কফিল উদ্দিন সাহেব বাবার সাথে প্রতিবেশিদের বাড়িতে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে আসছেন। মুরুব্বিদের কদমবুসি করছেন। কফিল উদ্দিন সাহেবের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সকলেই ধন্য ধন্য করতে লাগলো।
জিম ছাগল নিয়ে মেতে উঠেছে। প্রতিবেশি আলেয়াদের একটি ছাগল ও দুইটি ছাগলের বাচ্চা আছে। সেই ছাগলের পিঠে জিম বার বার উঠার চেষ্টা করছে। ঘাস খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কাঁঠালের পাতা খাওয়াচ্ছে। রশি ধরে টানাটানি করছে। ছাগলের মত শব্দ করছে। কখনও মোরগ দৌড়াচ্ছে। কখনো গরুর ঘাস খাওয়া দেখছে। নিজেই হাম্বা হাম্বা ডাকছে। কখনও ঘুড়ি উড়াচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে জিম এখন খুব ব্যস্ত। কোন ফুরসত নেই। খাওয়ার সময় নেই। ঘুমানোর সময় নেই। কথা বলার সময় নেই। কেউ ডাকলে সাথে সাথে বলে দিচ্ছে, আমি এখন ব্যস্ত আছি ------ ।
ওর কথা শুনে অন্যান্য ছেলে মেয়েরা সবাই হেসেই লুটোপুটি।
বিকেল বেলায় কফিল উদ্দিন সাহেব বাবাকে নিয়ে বের হলেন। বাজারের দিকে। অনেক দিন পর বাবা ছেলে একসাথে হেঁটে যাচ্ছে। রনিয়া বিলের পাশ দিয়ে। এই সেই রনিয়া বিল। যেখানে কফিল উদ্দিন সাহেবের এক সময়ের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একদা এক সময় এই বিলই ছিল চারপাশের গ্রামবাসীর জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন। এই বিলে সারা বছরই মাছ পাওয়া যেত। এখন আর সেই দিন নেই। বিলে মাছ নেই। পানিও নেই। শুধু বর্ষাকালে বিলে কিছু পানি পাওয়া যায়। এই বিলের ঠিক পশ্চিম পাশে কফিল সাহেব্ দের গ্রাম। গ্রামের নাম পাচলী পাড়া। এক কালে নাকি এ গ্রামে পাঁচ জন আওলিয়া বাস করতেন। এ জন্য এই গ্রামকে পাচলী পাড়া বলা হয়। গ্রাম থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে
সালিয়া নদী। বেশ খরস্রোতা ছিল সালিয়া। এখন আর নদী নেই বললেই চলে। মরে গেছে। বছরের অধিকাংশ সময়ই নদীর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। এই সালিয়ার উপরই বেঁচে ছিল শত শত হেক্টর আবাদী জমি। এখন গভীর নলকূপ থেকে সেচ দিতে হয়। চোরের ভয়ে সারা রাত জেগে নলকূপ পাহারা দিতে হয়। মাঝে মাঝে ডাকাত পড়ে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। মারও খেতে হয় আবার জিনিসও নিয়ে যায়!
পিতা পুত্র দিক পরিবর্তন করলেন। হাওরের দিকে ছুটলেন। সূর্য লাল। তার মানে অস্তাগামী। মাগরিবের নামাজের পূর্বেই ফিরতে হবে। জমি গুলো একদম ফাঁকা। কোন ফসল নেই। প্রাণহীন। খাঁ খাঁ করছে। তবু কফিল উদ্দিন সাহেব জুতা হাতে নিয়ে হাঁটছেন। খালি পায়ে। মাটির স্পর্শ নিচ্ছেন প্রাণ ভরে। এ মাটির মায়ায় তিনি আস্টে-পিষ্টে জড়িয়ে আছেন।
এ মাটিতেই তাঁর জন্ম। এ মাটিতেই বড় হওয়া। এ মাটিতেই মিশে যাওয়া। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে মুঠো করে মাটি ধরছেন। আর প্রাণের পরশ পাচ্ছেন। নিজের অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর কফিল উদ্দিন সাহেব নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, বাবা, আমাদের জমি গুলোর কী অবস্থা?
বেশির ভাগই বর্গা দেওয়া। আর কিছু বন্ধক।
বর্গাদাররা কী ঠিক মত ফসল দেয় বাবা?
রফিক সাহেব একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, না বাবা। ঠিক মত দেয় না। কিভাবেই বা দিবে! এখন তো অন্যের জমি চাষ করে তাদের পোষায় না। অনেক খরচ। কামলা পাওয়া যায় না। সঠিক মুল্য পাওয়া যায় না।
তবু তারা চাষ করে কেন বাবা?
কি করবে বল? তাদের তো আর কোন উপায় নেই।
কফিল সাহেবও বাবার মত একটি চাপা নিশ্বাস গোপন করলেন। তারপর বাবাকে বললেন, বাবা চলেন পাড়ার ভিতরে একটু ঘুরে আসি। অনেক দিন যাই না।
ঠিক আছে চল যাই।
পিতা পুত্র গ্রামের ভিতর দিয়ে পথ হাঁটছেন। অনেকেই রফিক সাহেবকে সালাম দিচ্ছেন। শিশু কিশোররা অধিকাংশই কফিল সাহেবকে চেনেন না । রফিক সাহেব ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। মনে গর্ব বোধ করছেন। রফিক সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন, তাঁর শৈশবের পাচলী পাড়া নেই। পুরো পুরো বদলে গেছে। মাটির ঘর নেই। খড়ের ঘর নেই।
লম্বা হাঁটির বিশাল বট গাছের নিচের সেই আড্ডাটি নেই। ছেলে মেয়ের দল নেই। গোল্লাছুট নেই। কাবাডি নেই। দাঁড়িয়াবান্ধা নেই। এক জায়গায় দেখা গেল কয়েকটি ছেলে ক্রিকেট খেলছে। অধিকাংশ ঘর বাড়ি আধা পাকা। কিছু কিছু পাকা। কফিল সাহেব বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা গ্রামের এত উন্নতির রহস্য কী?
রফিক সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, প্রত্যেক বাড়ি থেকেই দু এক জন করে বিদেশে থাকে। এখন সবারই কাঁচা পয়সা।সবারই বাড়ি ঘরের চেহারা বদলে গেছে। শুধু ---- আর না বলে থেমে গেলেন তিনি। পাছে ছেলে কষ্ট পায়!
কিন্তু কফিল সাহেবের বাবার চাপা কষ্টটা বুঝতে বাকি থাকল না। শুধু তাদের বাড়ি তাই বদলায়নি । এখনও সেই আগের মতই। কোন পরিবর্তন নেই। কোন উন্নতির ছোঁয়া নেই। যেই ছিল সেই আছে। এই সুযোগে কফিল সাহেব বললেন,
বাবা একটি কথা বলি?
বল ব্যাটা।
কফিল সাহেব আমতা আমতা করতে লাগলেন। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেন না। কেন জানি পারছেন না। অবশ্য এর আগেও এই প্রস্তাব তিনি বহু বার দিয়েছেন। কোন কাজ হয়নি। হয়ত এবারও হবে না।
ছেলেকে নিরব থাকতে দেখে রফিক সাহেব আবার বললেন, কি যেন বলতে চেয়েছিলে কফিল?
আবারো আমতা আমতা করে অবশেষে বলেই ফেললেন, বাবা, মাকে নিয়ে এবার আমার সাথে শহরে চলুন। আমি আসলে আপনাদের নিতে এসেছি। এখানে আপনাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমিও নিয়মিত আসতে পারি না। প্রাইভেট জব করি। কিন্তু আমার মন সারাক্ষণই আপনাদের কাছে পড়ে থাকে। আপনাদের জন্য আমার খুব কষ্ট হয় বাবা। খুব কষ্ট হয়।
এই বলে কফিল সাহেব এক অবাক কাণ্ড করে বসলেন, রাস্তার মাঝ খানেই পিতার দুই পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন ।

রফিক সাহেব ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। ছোট্ট শিশুর মত। ছেলে বেলার মত। মুখে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর গভীর স্নেহে বললেন, তোমার দুঃখ আমি বুঝি বাবা। এই জন্যই তোমাকে নিয়ে আমি গর্ব বোধ করি। অহংকার করি। তোমার মত সন্তানের পিতা হওয়া যে কোন পিতার জন্যই সৌভাগ্যের। কী করব আমি ঘর বাড়ি দিয়ে। কী করব আমি টাকা পয়সা দিয়ে। তুমিই আমার সব বাবা। আমি আর কিছুই চাই না
কফিল সাহেব আবারো বললেন, বাবা আমদের সাথে চলুন ----।
সে হয় না বাবা। কোনদিন হতে পারে না।
কেন হতে পারে না বাবা?
বাপ দাদার ভিটা ফেলে কী কেউ যেতে কফিল?
অনেকেই তো যায় বাবা!
সে আমার দ্বারা হবে না। আমি আর অনেকে এক না। আমি যদি যাই তোমার দাদা জান্নাত থেকে আমাকে অভিশাপ দিবেন যে!
কফিল সাহেব আর বলবেন? কিছুই ভেবে পেলেন না। চুপ করে হাঁটতে লাগলেন। মসজিদের মাইকে মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। খুব সুললিত কণ্ঠস্বর মুয়াঞ্জিন সাহেবের। কফিল সাহবের কেন জানি ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বেলালের (রা) নাম মনে হতে লাগল। পিতাপুত্র এক সাথে চললেন মসজিদ পানে।

পিতা পুত্র অনেক দিন পর এক সাথে খেতে বসেছেন। মা খাওয়াচ্ছেন। মরিয়ম বেগম পাশে বসে শাশুড়িকে সাহায্য করছেন। কফিল সাহেবের চোখ ছানাবড়া। তাঁর যত প্রিয় খাবার আছে; মা এই অল্প সময়ের মধ্যেই সব কিছুর আয়োজন করে ফেলেছেন। ভতুয়া শাক, কুদুরী শাক পর্যন্ত বাদ যায়নি। সব মিলে ১২ টি আইটেম। পরম মমতায় মাখানো প্রতিটি খাবার। কফিল সাহেবের সাধ্য কি না খেয়ে উঠে পরে? রফিক সাহেব মরিয়ম বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন, মা মা মণি আমার দাদু কোথায়?
ও ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা। সারাদিন খেলেছে। ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত।
খেয়ে ঘুমিয়েছে?
না বাবা। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।
এ তো মা তোমাদের ঠিক নয়। এতো টুকু বাচ্চা! না খেলে যে শরীর খারাপ করবে!
মরিয়ম বেগম এই কথার কোন জবাব দিলেন না। আয়েশা বানু স্বামীর কথার জবাব দিয়ে আদরের বউকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। তিনি বললেন, ঘুম ভাঙলে তখন খাইয়ে দেয়া যাবে।

এ নিয়ে আর কথা হল না। খাওয়া দাওয়ার পরে সকলে মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প গুজব করলেন । কথা যেন শেষই হতে চায় না । কফিল সাহেবের ছোট বেলার খেলার সাথি সুলতান মিয়া এসে একবার দেখা করে গেছে । রাতে ঘুমানোর সময় আয়েশা বানু পুত্র বধূকে বললেন, সাবধানে ঘুমিয়ে বউমা । চোরের খুব উপদ্রব । মরিয়ম বেগম খুব ভয় পেয়ে গেলেন । মুখে বললেন, আচ্ছা মা । এরপর শরীরে থাকা সামান্য গহনা খুলে শাশুড়ি মাতার হাতে দিয়ে দিলেন ।

পরদিনও জিমের একই অবস্থা। শুধু খেলা আর খেলা। কান্না কাটি নেই। রাগ নেই। খাওয়া নিয়ে ঝামেলা নেই। গোসলের চিন্তা নেই। সে যেন এক স্বর্গ রাজ্যে বাস করছে। কফিল সাহেব এক ফাঁকে বাজারে গেলেন। বাবা মায়ের জন্য অনেক কিছু কিনে ফিরলেন। খাবার জিনিস থেকে শুরু করে ঔষধ পত্র সবই। বেশি বেশি করে কিনলেন। ঘর বাড়ির জরুরী কিছু সংস্কার মূলক কাজ করালেন। খুব ব্যস্ত সময় পার করলেন।

পর দিন ভোরে ঢাকা চলে আসার সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। জিম কোন মতেই ঢাকা আসবে না।সে দাদা দাদুর সাথে গ্রামেই থাকবে। কোন দিনই ঢাকা যাবে না। মাকে বলে, মাম্মা তোমরা চলে যাও; আমি যাব না। যাব না। কোন দিন যাব না। মহাবিপদ। তার উপর আয়েশা বানু কেঁদে কুটে অস্থির। রফিক উদ্দিন সাহেবও গোপনে গোপনে চোখ মুছছেন। কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না। সংগোপনে।

এক প্রকার জোর করেই জিমকে নিয়ে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর অবশ্য জিমের কান্না এক সময় থেমে যায় । কিন্তু থামে না কফিল সাহেবের হৃদয়ের ক্ষরণ। বার বার বাবা মায়ের অসহায়, পবিত্র মুখচ্ছবি তাঁর সামনে ভাসছে। চাকুরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে মন চাইছে। এই ইটের শহরে কিটের মতন জীবন যাপনের কোন সার্থকতা তিনি অন্তত এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছেন না। বার বার নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন।


বাসায় ফিরে জিম সেই আগের মত শুরু করে দিয়েছে। তার এক কথা। আমি বাইরে যাব। আমি বাইরে যা। আমি দাদু বাড়ি যাব। মরিয়ম বেগম জিমকে শান্ত রাখার অনেক চেষ্টা করলেন। খেলনা এনে দিলেন। জিম ছুড়ে মারল।
বললেন, জিম, চলো বাবা আমরা টিভি দেখি।
জিমের সোজা উত্তর, না, আমি টিভি দেখব না। তুমি দেখ --- ।
সুন্দর কার্টুন হচ্ছে বাবা!
না আমি দেখব না। আমি দেখব না। আমি দাদু বাড়ি যাব। আমি বাইরে যাব।
কাঁদতে কাঁদতে এক সময় জিম ঘুমিয়ে পড়ল। পুরো বাসা জুড়ে নেমে আসে রাজ্যের নিস্তব্ধতা। গভীর রাতে জিমের জ্বর আসল। প্রবল জ্বর । ১০৪ ডিগ্রি। প্রচণ্ড উত্তাপে জিম প্রলাপ বকছে। আমি বাইরে যাব। আমি দাদু বাড়ি যাব।
মরিয়ম বেগমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেই সাথে কফিল উদ্দিন সাহেবের। জিমের এই অবস্থা দেখে তদের মাথা ঠিক নেই।কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। মরিয়ম বেগম তাড়াতাড়ি মাথায় পানি দিচ্ছেন। সারা শরীর স্পঞ্জ করে দিচ্ছেন।
আর কফিল সাহেব ছুটলেন পাঁচ তলায়। সেখানে একজন ডাক্তার থাকেন। এখন রাত আড়াইটা বাজে। কিভাবে একজন ভদ্র লোককে ঘুম থেকে ডেকে তোলা যায়? আর না তুলেই বা উপায় কী? এই সব ভাবতে ভাবতে কলিং বেলে চাপ দিলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রথম চাপেই ভিতর থেকে আওয়াজ আসল, এত রাতে কে?
অপু দা, আমি!
সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। চমকে গেলেন ডাঃ আপু। বললেন, আরে কফিল ভাই যে, কী ব্যাপার এত রাতে?
আপনি ঘুমাননি?
না, আমার ঘুম আসছিল না। মাঝে মাঝে এমন হয়। কী ব্যাপার বলুন তো?
কী আর বলব দাদা! এই মাঝ রাতে ছেলেটি প্রচণ্ড জ্ব । প্রলাপ বকছে।
ডাঃ অপু আর একটি কথাও বললেন না। ভিতরে প্রবেশ করলেন। একটি ব্যাগ হাতে নিয়ে সাথে সাথে বের হয়ে আসলেন।
জিমকে পরীক্ষা করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। ঔষধ দিচ্ছ। ১০ মিনিটের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা দাদা । এত রাতে আপনাকে কষ্ট দিলাম ।
কি যে বলেন কফিল ভাই! ডাক্তারদের আবার রাতদিন কীদ? হাসপাতালে যখন নাইট ডিউটি করি তখন? এসব কোন ব্যাপার না। তাছাড়া প্রতিবেশী হিসাবে আমার একটা কর্তব্য আছে না।

কফিল সাহেব ডাক্তার সাহেবের অমায়িক ব্যবহারে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কৃতজ্ঞতা জানানোর আর ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। পকেট থেকে বের করে পাঁচশ টাকার একটি নোট ডাক্তার সাহেবকে বিনয়ের দিতে গেলেন। কিন্তু তিনি বিনয়ের সাথে ফেরত দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো! জিম কি কোন কারণে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে?
কফিল সাহেব পুরো ঘটনাটি খুলে বললেন। ডাক্তার অপু খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, এই সমস্যা আজকাল অহরহ ঘটছে। একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে আমি এ ধরনের রোগী আরও অনেক পেয়েছি। এর দায়আমাদের সকলের। এই সমাজের। নগর সভ্যতার । সরকারের। রাষ্ট্রের। আমরা কেউ এর দায় এড়াতে পারি না।
আমরা শিশু জন্ম দিচ্ছি; কিন্তু শিশুর বেড়ে উঠার জন্য, যথাযথ বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারছি না। আমাদের শিশুরা সারাক্ষণ চার দেয়ালের ভিতরে বন্দি থাকে। আসলে এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়? এই ভাবে অনেক শিশু মানসিক সমস্যা নিয়ে বড় হয়। ফলে এক সময় তাদের মাঝে নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল হয়ে পড়ে। বেড়ে যায় অপরাধ প্রবণতা।
এখন কি করতে পারি অপু দা। আমাকে কিছু পরামর্শ দেন।
প্রথমতঃ জিমকে আপনার যতটা সম্ভব বাইরে নিয়ে যেতে হবে। ওর স্বাভাবিক বিকাশের জন্যই এটা খুব প্রয়োজন। নিজে নিয়ে যাবেন। ভাবীকে নিয়ে যেতে দেবেন। খেলতে দিবেন। হাসতে দিবেন। দুষ্টুমি করতে দিবেন।
দ্বিতীয়তঃ পারলে একজন কাজের মানুষ নিয়ে আসুন। যে সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিমকে নিয়ে একটু ঘুরে আসতে পারবে।
এবার কফিল সাহেব কথা না বলে পারলেন না। তিনি বললেন, আচ্ছা অপু দা, আপনিই বলেন, এই আগামাসি লেনে ঘুরে আসার জন্য একটু জায়গা কোথাও আছে কি?
তা নেই; তবু আপনাকে যতটা সম্ভব জিমকে নিয়ে বাইরে যেতে হবে। তা হলে ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। বললেন ডাঃ অপু।
কফিল সাহেব আবার বললেন, আমি আজই গ্রাম থেকে ফিরলাম । পুরো গ্রাম খুঁজেও একজন কাজের মেয়ের সন্ধান করতে পারলাম না ।
কফিল সাহেবের সংগে ডাঃ সাহেবও একমত পোষণ করলেন। তারপর দু জনই কেন জানি একসঙ্গে হেসে উঠলেন। জিম আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। জিমের শিয়রে অতন্দ্র প্রহরীর মত বসে আছেন মরিয়ম বেগম। যেন ছেলের কোন ক্ষতি কোনমতেই হতে দিবেন না তিনি। তিনি ভাবতে লাগলেন মানুষের সাথে তো প্রকৃতির কোনো বৈরিতা নেই, তাহলে কেন এমন হয়! তাহলে কী মানুষের সৃষ্ট সমস্যার কোপানলে পড়ে মানুষই আজ
কোণটাঁসা?

********


আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
হাসনা হেনা গাঁয়ের সে মমতা মাখা শ্যাম্ল ছায়া আর দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ কার না মন ছুঁয়ে যায়। ভাল হয়েছে। ধন্যবাদ।
অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানবেন
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক বেশ ভালো লাগলো।
সোহানুজ্জামান মেহরান অসাধারণ গল্প। ভালো লাগলো।শুভ কামনা রইলো।
শামীম খান গল্পে গ্রাম বাংলা আর মধ্যবিত্ত পরিবারের মমত্ববোধ দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে । এমন লেখা মনকে স্পর্শ করবে সবার । শুভ কামনা রইল ।
অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানবেন সুপ্রিয় শামীম ভাই।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি অনেক ভালো গল্প......মান সম্মত এবং মূল্যায়ন যোগ্য...শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম জসিম ভ......আপনাকে অনেক ধন্যবাদ......
অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানবেন সুপ্রিয় জ্যোতি ভাই।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ আমি আপনি যে ভাবে অনুভব করছি সে ভাবে যাদের অনুভব করা উচিৎ তারা করছে না । দুঃখ টা এখানেই । ভাল লাগল গল্পটা ।
অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানবেন শ্রদ্ধেয়।
আবুযর গিফারী গল্পকবিতায় আমি নতুন সঙ্গত কারণেই আপনার প্রথম পাঠক। ভালো লাগল।
অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানবেন আবুযর গিফারী ভাই। গল্প কবিতায় আপনাকে স্বাগত জানাই।।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,কিন্তু ভোটিং বন্ধ।পাতায় আমন্ত্রন রইল।
জুন তাহলে কী মানুষের সৃষ্ট সমস্যার কোপানলে পড়ে মানুষই আজ কোণটাঁসা?........ দারুণ দারুণ. খুব ভালো লাগলো।আপনার লেখা বরাবরই আমার ভালো লাগে। শুভ কামনা রইলো।
অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে জোনাইদ ভাই।
Fahmida Bari Bipu মমতামাখা আপনার গল্পটি খুব মন ছুঁয়ে গেল জসীম ভাই। শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে ফাহমিদা আপু ।।

১৯ ফেব্রুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৮০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী