গান গাওয়ার ক্ষেত্রে ১৪৪ ধারা জারি করলেন বাবা। তা না হলে গানই আমার আকাশ হত। মায়ের মুখে গান শুনিনি কখনো তবুও গানের প্রতি ভালোবাসার অভাব হয়নি বরং একটু বেশীই ছিল। রোজ তাই ক্লাস শেষ হলে গানের স্কুলের বারান্দায় বসে থেকে পাঁচটায় বাড়ি ফিরতাম মা’র বকুনি উপেক্ষা করেই।
সৌম্য সবসময় ঘরের পশ্চিম দিকের পাটিতেই বসতো। চোখ বুজে মাথা দুলিয়ে গান গাইতো আর প্রতিটা গান শেষ হলেই আমার দিকে চোখ বড় করে তাকাতো, যেন বোঝার চেষ্টা শ্রোতার মনের কথা।
একদিন সৌম্য বলল, তুই আমার গান হবি?
ব্যস, হয়ে গেল গানে গানেই ভালোবাসা!
এরপর গান শোনা আর গানের স্কুলের বারান্দায় সীমাবদ্ধ থাকলো না। পথে পথে ঘুরে, পথ ভুলে বিকেল পাঁচটার বদলে সন্ধ্যে হত বাড়ি ফিরতে। ঐ কদম বাগান পেরিয়ে কৃষ্ণচূড়ার রংয়ে রাঙ্গা আগুন রাস্তা ধরে কত হেটেছি, কত গল্প কত গানে দুলতো যেন কৃষ্ণচূড়া, কদমগুচ্ছ। ঐ ভুল পথেই একদিন এক বাউল হেটে গেলো গান গেয়ে আর হাতে একতারার টুং টাং সুর। মাথায় বড় বড় ঝাকড়া চুল আর গায়ে ময়লা ছেড়া-ফাটা গেরুয়া রঙের আলখেল্লা।
সৌম্য উদাস কন্ঠে বলল, বড় হয়ে বাউল হব রে আমি। ঐ বাউল পাড়ায় একটা ছাউনি ফেলে আমরা দু’জন ঘর বাধবো আর...
-আর কি! অমাবশ্যায় বা জ্যোৎস্না রাতে সেই ছাউনির বারান্দায় বসে আমরা দু’জন গান বাধবো?
সৌম্য হেসে বলে, বাউলের জীবন কত কঠিন জানিস? শুধু কি ঐ ছাউনি, কত অজানা পথে পথে ঘুরতে হবে। অত কষ্ট করে পারবি বাউলের ঘরনী হতে?
মুখ বাকিয়ে হাত নেড়ে বলি আমি, তোর ছেড়া ফাটা ময়লা আলখেল্লার ভেতর উদাস বুকে মাথা রাখতে পারলেই আমার সব পাওয়া হবে।
-তাই! এত ভালোবাসিস?
-উপায় কি? তুই তো আর বাসবি না!
ঝুম করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে। সৌম্য দৌড়ে একটা বড় কচু পাতা খুঁজে এনে আমাদের মাথার উপর ধরলো। আর বললো, তোকে এই এমনটা ভালোবাসি। বৃষ্টি লাগবে না, কচুর পাতায় ঢেকে রাখবো। আবার হঠাৎ করে কচুর পাতা ফেলে দিল, আমি ভিজতে ভিজতে উৎসুক নয়নে ওর দিকে তাকাই। সৌম্য আমার হাতটি ধরে বলে, ঐ কচুর পাতার মত অত অল্প নারে। তোকে এই বৃষ্টির মত ভালোবাসি। বর্ষার সব বৃষ্টি। তো জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত বর্ষা আসবে তার সমান ভালোবাসা তোকে দিলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ
সংসারে আর সব কিছুর মত জীবনেও হিসেব করেই চলেন বাবা। উচ্চ-মাধ্যমিক শেষ হতেই তাই বেশি দিন না করেই আমাকে পুতুলের মত সাজিয়ে বিয়ে দিলেন উচ্চ প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে। কিছুই পারিনি কান্না ছাড়া। সৌম্য তখন গানের ভিড়ে একাকী পথে। কান্নাই যখন আমার একমাত্র উপায়, তখন জীবন নামের এই নতুন মানুষটিই খুব ভালোবেসে আমার সেই কান্না মুছে দেবার শত চেষ্টা করে যায়। সে চেষ্টা আমি বুঝি, ভালোবাসার তীব্রতাও। সে আমায় বুকের কাছে নিয়ে মাথায় হাত রাখে মমতায়। জীবন যেন এমন ভাবেই আমার জীবনটাই সাজিয়ে দেবে ভালোবাসায়। তবু আমার হৃদয়ের নোনাজলের স্রোত থামে না।
ক’দিনের মধ্যে বিয়ের হইহুল্লড় একটু স্থিত হলেই, যাবার আগ মুহুর্তে আমাদের হানিমুনের জায়গাটা বদলালো। সবাই অবাক, সাথে আমিও। জীবন উচ্ছিসিত হয়ে বলল, আমার সোনা বউ যে বাউলের গান শুনতে সেই কবে থেকে ব্যাকুল। তাই আগে গানের আসর জমুক পরে দূরে যাবো। আমি অবাক! জীবন কি করে জানলো আমার ব্যাকুলতা? জীবন মুখ উজ্জ্বল করে বলে, কাউকে অনেক ভালোবাসলে তার মনের কথাও জানা যায়, বুঝলে পাগল মেয়ে। পরে জেনেছি যে শুধু ভালোবেসে নয়, আমার গোপন চিঠি পড়েই সে অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে। আর সব জানার পরও থেমে যায়নি, বরং আমায় ভালোবেসে দ্বিতীয় জীবন দিতে চাইছে।
আমিও কি পাচ্ছি না নতুন জীবনের স্বাদ!
পেলেও তো আর নতুন কে আমার করতে পারছি না। বর্ষা তো আমার জীবনের সবখানে কবে থেকেই জুড়ে আছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ
এক পাশে লালন ফকিরের মাজার আর এক পাশে বাউল পাড়া, আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, নদীর বিস্তৃণ তীর। আমাদের বাংলোটাও চমৎকার। সে বাংলোর আঙ্গিনায় রাতে বসল বাউল গানের আসর আর আমার মনে শুরু হল বাউল খোজা। জীবনও খুজছিলো উন্মুখ হয়ে। অদুরে গাছের নিচে বসে আমরা বাউলের গান শুনতে লাগলাম। আধ-ময়লা ছেড়া গায়ের আলখেল্লা, দাড়ি-চুল আর বয়সের ভিড়ে আমার চলতে থাকলো সৌম্যের খোঁজ। কত বাউলের কত গান, আমি শুধু শুনে শুনে কাদলাম। জীবন স্বযত্নে চোখ মুছে দেয়। কিন্তু কোথায় সৌম্য!
অনেক রাতে আসর ভাঙ্গে। আকাশে মেঘের আনাগোনা, আজো বৃষ্টি হবে। মাঝে মাঝে ঠান্ডা বাতাস ছাড়ছে তাতে শরীর হিম হয়ে যায়। কাল সকালেই চলে যাব এখান থেকে। আমি বারান্দায় অন্ধকারে একা বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। মনে মনে বলে উঠি- সৌম্য, তোর ঐ ছাউনীতে আমায় দেখতে চাস না বলেই লুকিয়ে রইলি! আনমনে ভাবতে ভাবতেই চমকে উঠি, সামনেই জীবন দাঁড়িয়ে। আলতো করে আমার গালে হাত ছুয়ে ও হাসে। আমি উঠে পা বাড়ালাম ঘরের দিকে। জীবন হাত ধরে রাখলো, খুব পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল- পাগল মেয়ে, একটুও পারলে না ভালোবাসতে আমাকে।
আমি কেঁপে উঠি। কি বলবো আমি, এর উত্তর যে আমার কাছে কুয়াশায় মোড়ানো।
জীবন এবার ঘুরে পা বাড়িয়েই আবার একটু থেমে বলল, আমি কিন্তু তোমায় খুব ভালোবেসে ফেলেছি। কতটা শুনবে? ঐ আকাশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
আমি নির্বাক, যেন পাথরের মুর্তি।
আরো বলল- তবে কি জানো, আর কোন জন্মে আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে চাইবো না। কেনো জানো? আর জনমেও তোমাকে আমার কাছে আটকে রাখলে তা তোমার আর সৌম্যের প্রতি বড় অবিচার হইয়ে যাবে না!
জীবন ঘরে চলে গেছে আর আমি ঠায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারে বারান্দায়। আমার চোখের জল টপ টপ করে ঝরে পড়ছে। কিন্তু এখন তা মোছার জন্য জীবন পাশে নেই। অথচ জীবন জানল না এ জলের প্রতিটা ফোঁটা তার তরেই ঝড়ছে।
তবে সে জল গড়িয়ে বুক ভাসানোর আগেই এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল, ধুয়ে-মুছে দিল চোখের জল।
০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪