-আপনার জন্য, যদি কিছু মনে না করেন…
মৃত্তিকা তাকিয়ে দেখলো, কাকভেজা ছেলেটি হাসিমুখে তার হাতের সিক্ত কদমগুচ্ছু বাড়িয়ে আছে তার দিকে। কি যে হল, মৃত্তিকা মৃদু হেসে অতিচেনা ফুল গুলো নিয়েই আবদার জুরলো বৃষ্টিতে ভিজে হাটার জন্ন্য। ভার্সিটি পার হয়ে শাহাবাগের মোড় ছেড়ে আরো অনেক দূর… অনেক গল্প কথা সেদিন।
আজকেও মৃত্তিকা হেটে এসেছে বহুদুর, শুধু সেদিনের মত জয় আর কদমগুচ্ছ নেই সাথে। আজ আছে চোখের জল যা সেদিন ছিলনা, ভাবল মৃত্তিকা। আবার একটু হাসিও পেল মনে করতে গিয়ে, সেই প্রথমদিন যখন মিনার চাচা বলেছিল, কিরে বুড়ি, তোরে কদম দিছে কে? তখন মৃত্তিকার মনেও ঐ একই প্রশ্ন, কে? অতটা পথ যার সাথে হাঁটা, কথা বলা তবুও নামটাই যে জানা হয়নি! মৃত্তিকা সে রাতে ভালোমত ঘুমাতে পারেনি ঐ সব ভেবেই। তারপর দিন ভার্সিটিতে মনে মনে অনেক খুজলো কিন্তু কোথায় সেই ছেলেটা? এক সময় যখন চিন্তা বাদ দিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য ক্যান্টিন থেকে বের হলো তখন মিতুল বলল, তোকে জয় ভাইয়া খুজছে আর তুই দেখি এখানে!
-জয়টা আবার কে, চিনলাম না তো?
-চিনিস না! তুই যে কোন ধ্যানে থাকিস! ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে থার্ড ইয়ারে পড়ে।
-তুই চিনলি কিভাবে?
-আরে, সেতো তুখোড় বিতার্কিক, সবাই চেনে আর তুই… আচ্ছা তুই আবার না চেনার ভান করছিস না তো? তুই চিনিস না অথচ জয় ভাইয়া তোকে হারিকেন লাগিয়ে খুঁজছে, ঠিক মিলছে না!
-সে পড়ে দেখা যাবে এখন যাইরে…
-সেকি, তোকে যে খুজঁছে!
-তো আমি কি করব, কে না কে খুজঁছে, দেখিও নি বোধহয়… খুজুঁক… আমি গেলাম…
কিছুদূর যেতেই দেখা মিলল, সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে… আজ আর হাতে কদম নেই…
-চলো হাটি (যেন এমনটা প্রায়ই হয়)
-আজ তো বৃষ্টি নেই
-সে কি আর আমার দোষ?
-কিন্তু কদম তো থাকতে পারতো…
-ইসস! এমন ভুল আর কখখনো হবে না, আমি রাজকন্যার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
-রাজকন্যা! রাজ্য নেই, রাজা নেই… তার আবার…
-তবুও তুমি রাজকন্যা। আমি সব কিছু জয় করে নিতেই ভালোবাসি। জয় করলে তো রাজকন্যাই জয় করব। ওহহ… তোমাকে তো আমার নামটাই বলা হয়নি, আমি জয়।
-হুমম… অন্যের মুখে শুনতে হলো।
এরপর প্রতিদিন ভার্সিটি থেকে শাহাবাগ মোড় পর্যন্ত হাটা আর একগুচ্ছ ফুল নিয়ে বাড়ি ফেরা।মাটির মতোই মৃত্তিকার মনে বসন্ত আর শরতের খেলা। জয় এর পাগলামি থেকে কিছুই বাদ যায়না। বেইলী রোডে নাটক, রাস্তার ফুচকা, যখন তখন আইসক্রীম, কবিতা বলা, রাস্তায় রাস্তায় হাটা, পার্কে বসে বাদাম খাওয়া, কখনো চুল ধরে, কান ধরে টানা, চিমটি, খুনঁসুটি আর হেরে গলায় গান গাওয়া, রিক্সা আর সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো, এমনকি বাসের ছাদে চড়া… এমন আরো কত কি, সব পাগলামীতে মৃত্তিকাও সায় দিত আর ভাবতো আহা এইতো জীবন! কখনো কালো মেঘের আনাগোনার কথা ভাবলেও মৃত্তিকার বিশ্বাস ছিল, জয় ঠিকই সব কিছুকে জয় করতে পারবে।
অথচ আজ, আজ দুই বছর পর জয় বলল…
-মৃত্তিকা আমি পারলাম না, অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কাউকেই বোঝাতে পারলাম না, মানাতে পারলাম না। আমি একা কি আর সমাজ কে বদলাতে পারি বল? আমায় ক্ষমা কর।
-নাহ, তোমার তো দোষ নেই। তুমি বরং আমার কারোনেই আজ প্রথম পরাজয়ের সাথে পরিচিত হলে!
মৃত্তিকা আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটা দিলো বাড়ির পথে। আর মনে মনে ভাবে,
বাবা-মা নেই, জন্ম পরিচয় নেই এমন মেয়েকে কেউ একটু ভালোবাসতে পেরেছে এই তো বেশী। পড়াশুনাও করতে হয়েছে মিথ্যে বাবা-মার পরিচয়ে। তবুও সত্যটুকু জানতে বড় ইচ্ছা হচ্ছে আজ।
বাসায় ফিরেই তাই মৃত্তিকা মিনার চাচাকে খুব করে ধরলো, জানাতেই হবে আজ। আগের মত মিনার চাচা আর না করলো না। স্বযত্নে রাখা একটা পুরনো চিঠি এগিয়ে দিয়ে বলল, আজ থেকে পনের বছর আগে আমার ঘরের এই ভাঙ্গা বারান্দায় তোকে পেয়েছিলাম, সাথে শুধু এই চিঠিটাই ছিল।
মৃত্তিকা,
ইচ্ছে ছিল তোমায় মুক্তি বলে ডাকি কিন্তু তোমাকে হতে হবে মাটির মত, সহ্য করে যেতে হবে সব তাই তোমার নাম দিলাম মৃত্তিকা। ৭১ সালে আমি ছিলাম ১৬ বছরের কিশোরী। যুদ্ধের সময় অনেকের মত আমারও জায়গা হল আর্মি ক্যাম্পে। দেশ স্বাধীন হলে আমি কিছুদিন সরকারি আশ্রয় ক্যাম্পে ছিলাম, তখন তুমি আমার গর্ভে। ভাইয়ে্র কাছে শুনলাম বাবা-মা বেঁচে নেই। ভাই বলল দুই মাস পরে এসে নিয়ে যাবে, এখন নতুন করে বাড়ি ঠিক হচ্ছে, সামনেই বিয়ে তার। দুইমাস পর যখন আমি ছোট্ট তোমাকে নিয়ে বাড়ি গেলাম তখন দেখলাম বিশাল বাড়ি হয়েছে। বললাম এত টাকা পেলেন কোথায়? ভাই বললো, তোর ক্ষতিপূরন হিসাবে সরকারি কিছু টাকা পেয়েছিলাম তাতেই। সিড়িতে পা রেখেই কেঁপে উঠলাম, চেয়ে দেখলাম, আমার সত্বীত্বের দামে যে গড়া এই বাড়ি! তবুও সেখানে জায়গা হলোনা আমার বা তোমার। আমার ভাবী আর প্রতিবেশীদের প্রতিবাদে। জায়গা নেই পথেও, তোমার পিতৃপরিচয় যে দিতে পারি নাই। আমি বাঁচলে, তুমি বাঁচবেনা। তুমি গর্ভে থাকাকালীন আমি মরতে পারিনি তোমার জন্য। আজো মারতে পারলাম না তোমায়। দেশ মুক্ত হলেও তোমাকে মুক্তি দিতে পারলাম না। পারলে তোমার মায়ের এমন অপরাধ ক্ষমা করো।
- এক অপরাধী মা
এতকাল ধরে নিজের জন্য কেঁদে আসা মৃত্তিকা আজ কাদলো তার অসাধারণ আর মমতাময়ী মায়ের জন্য। আর বলল, মা আমাকে বাচাতে তোমায় মরতে হলো, আমার এ অপরাধ তুমি ক্ষমা করে দিও। আর আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কোনদিন এই সমাজে কোন অবস্থান চাইবোনা, চাইবোনা কোন ভালোবাসা। নিজেকে মুক্ত করে নিলাম এদের থেকে। আমি এখন থেকে মৃত্তিকা নই, আমি মুক্তি।
বাইরে তখন অঝোর শ্রাবণ, যেন উঠোনের গাছটাতে ফুটে থাকা কদম গুলোকে শুদ্ধ করবেই, এই সমাজ আর সমাজের মানুষ গুলোর কলঙ্ক থেকে।