এবি ব্যাংকে সুজাতার চাকরীর বয়স প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেছে। সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা, সপ্তাহের পাঁচ দিন এই নিয়মেই ও অফিস করে, নিয়মের ব্যাপারে সুজাতা খুবই ডিসিপ্লিন্ড, কখনও অফিসে লেট হয় না, ছুটির আগে অফিস থেকে বের হয় না। উত্তরার সাত নাম্বার সেক্টরে শেলটেকের একটি অ্যাপার্টমেন্টে ওরা স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলে মোটামুটি সুখেই দিন কাটাচ্ছে। সংসারে বাড়তি কোন লোক নেই, এমন কি ঘর পরিষ্কারের লোকও নেই। ভ্যাকুম ক্লিনার, ওয়াশিং মেশিন, ডিশ ওয়াশার থেকে শুরু করে আধুনিক সুবিধার সব উপকরণই বাংলাদেশে কিনতে পাওয়া যায়, সংসারে একেকজন একেক কাজে হাত লাগালে কাজের মানুষ রাখার দরকারই হয় না।
অফিস থেকে ফিরে সুজাতা প্রথমেই কিচেনে ঢুকে চূলোয় চায়ের কেটলী চাপায়, এরপর অফিসের পোশাক পালটে হাত মুখ ধুয়ে খুব কড়া লিকারের এক কাপ চা তৈরী করে, চায়ের কাপ হাতে ও চলে যায় কম্পিউটার রুমে, চায়ের কাপে দু চুমুক দিতে না দিতেই পাপলু’র গিটারে ট্রিং ট্রিং বাজনা শুরু হয়। সুজাতা আয়েস করে চায়ে চুমুক দেয় আর ছেলের গীটার শোনে। এ সময় বাড়ির কেউই সুজাতাকে বিরক্ত করে না। আধঘন্টা সময় ও পাপলু’র রুমে কাটিয়ে ফের কিচেনে ঢুকে, রাতের রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রান্না সুজাতাকেই করতে হয়, কারণ মায়ের হাতের রান্না ছাড়া দুই ছেলের চলে না। সুজাতার স্বামী সুজয়ের অবশ্য কোন কিছু নিয়ে বায়নাক্কা নেই, আলু ভর্তা দিয়েও যদি তাকে ভাত খেতে বলা হয়, সুজয় সোনামুখ করে খেয়ে নেয়। কখনও বলে না, “ আর কিছু নেই?”। তবে প্রতিদিন খাবার টেবিলে তিন চার পদের বাহারী আইটেম সাজানো থাকলে সুজয়ের মুখের চেহারা বদলে যায়।
সুজয় খেতে ভালোবাসে তবে নিজের খাওয়া নিয়ে কারো উপর জুলুম করেনা, ছোটবেলা থেকেই সুজয় এরকম। বিয়ের পর সুজয়ের মা সুজাতাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, “ বৌমা, আমার ছেলেটা খুবই মুখচোরা স্বভাবের, মুখ ফুটে কারো কাছে কিছু চায় না, এমনকি খেতে বসেও আরেক টুকরো মাছ বা মাংস চাইবে না। অথচ ও খেতে ভালোবাসে। বৌমা, আজ থেকে ওকে তোমার জিম্মায় দিয়ে দিলাম, নিজের মনের মত করে ওকে গড়ে নিও, শুধু খাওয়া দাওয়ার বেলায় এই বুড়ি শাশুড়ির অনুরোধটুকু রেখো, ওকে একটু যত্ন করে খাওয়াইও”।
সেই থেকে সুজাতা স্বামী-সন্তানকে যত্ন করে খাওয়ায়। খাওয়ার টেবিল ঘিরে চারটি চেয়ারের একটিতে বসে সুজয়, একটিতে শুভ্র, একটিতে পাপলু আর অন্যটিতে সুজাতা। খাওয়ার সময়ের পুরোটা জুড়েই সুজাতার মন খুব ভেজা নরম থাকে। ছেলে দুটো খুব আয়েস করে খায়, আর মায়ের রান্নার প্রশংসা করে, সুজয় মুখে কিছু বলে না, কিন্তু থেকে থেকেই বাটি থেকে তরকারী পাতে তুলে নেয়। সাজানো সংসার, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরী করে, শুভ্র সামনের বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করবে, ওর রেজাল্ট এত ভালো যে পাশ করার আগেই বড় কোম্পানী থেকে জব অফার পেতে শুরু করেছে। শুভ্রর ইচ্ছে এখনই চাকরী নয়, আগে পিএইচডি করবে, স্টেটসের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করছে। জি আর ই স্কোর তো দারুণ হয়েছে, খুব ভালো ইউনিভার্সিটিতেই চান্স পেয়ে যাবে। পাপলু বিবিএ পড়ছে, এই ছেলেটা ক্লাসের রেজাল্ট খুব ভালো করছে, সাথে বিভিন্ন কারিকুলার একটিভিটিতে পারদর্শিতার ছাপ রেখেই চলেছে। সুজাতার খুব গান শেখার শখ ছিল, কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে যা হয়, লেখাপড়ার দিকেই খুব বেশী মনোযোগ দিতে হয়, গান বাজনা শেখানো অতিরিক্ত খরচ হিসেবে ধরা হয়। সুজাতার গান শেখা হয়নি, কিন্তু খালি গলাতেই সুজাতা চমৎকার গান করে। ছোট ছেলেটা মায়ের এই গুণ পেয়েছে, সুজাতা ছেলেকে শিক্ষক রেখে গান, বাজনা শেখাচ্ছে। পাপলু খুব ভালো গিটার বাজাতে পারে, ওরা সমবয়সী কয়জন মিলে ব্যান্ড গ্রুপ করেছে। বিভিন্ন ফাংশানে ওরা স্টেজ শো করে।
বছর দুই আগে এক সন্ধ্যায় সুজাতার সুখের সংসারে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটে গেলো! সেদিনও সুজাতা অফিস থেকে ফিরে কিচেনে ঢুকে নিজের জন্য কড়া করে এক কাপ চা বানিয়েছিল, চায়ের কাপ হাতে ও পাপলুর রুমে ঢুকেছিল। বিকেলের এই সময়টাতে পাপলু গিটার প্র্যাকটিস করে। সেদিন পাপলুর ঘরে ঢুকে পাপলু’কে দেখতে না পেয়ে সুজাতার খেয়াল হ’লো, ইউনিভার্সিটিতে পাপলুদের আজ কি একটা প্রোগ্রাম আছে। সুজাতার দুই ছেলেই নিজেদের দৈনন্দিন প্রোগ্রাম সম্পর্কে মা’কে বলে রাখে। যদি কোনদিন বাড়ি ফিরতে দেরী হয়, দুইবার তিনবার করে মা’কে ফোন করে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে জানায়। আজকের প্রোগ্রামের কথাও পাপলু গতকালকেই জানিয়েছিল। বেখেয়ালে সুজাতা ভুলে গেছে।
চায়ের কাপ হাতে রুম থেকে বেরিয়ে আসার আগ মুহূর্তে কম্পিউটার টেবিলে কিছু কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে দেখে সুজাতা কাগজগুলো গুছিয়ে দিতে গিয়ে ছোট একটি কাগজে পাপলু’র হাতের লেখা দেখে থমকালো, “ অসহ্য! বিবি ইউ আর গোয়িং টু মাচ। গো টু হেল উইথ হিম, হোয়াই আর ইউ বদারিং মি?”
সুজাতার মনটায় ধ্বক করে উঠলো, বুকটাতে কাঁপন শুরু হয়েছে। পাপলু আর বিবি’র মধ্যে বন্ধুত্বের বাইরে বন্ধুত্ব হয়েছিল, এই কথা সুজাতা জানতো, পাপলুই বলেছে। প্রায় দেড় বছর টিকেছিল বন্ধুত্বের বাইরের বন্ধুত্বের সম্পর্কটুকু। দুজনের সম্পর্কের মাঝখানে তৃতীয় কেউ ঢুকেছিল নাকি বিবি নিজেই অন্য কারো প্রতি ঝুঁকেছিল, তা সুজাতা জানেনা। শুধু পর পর কয়েকদিন পাপলুকে উদভ্রান্তের মত দেখে জানতে চেয়েছিল, কি হয়েছে। পাপন বলেছিল, বিবির সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার কথা।
সম্পর্ক তো ভেঙ্গেই গেছে, তাহলে আজ কেন পাপলুর টেবিলে এমন একটি লেখা পাওয়া গেলো! বিবি কেন বদার করছে পাপলুকে। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো এমন নিলাজ কেন? এত অস্থিরতাই বা কেন?
সন্ধ্যা সাতটার দিকে সুজাতা পাপলু’র ফোনে কল দিল, রিং টোনে পাপলু’র গিটারের সুর বাজছে,
“ঐ দূর দিগন্ত পাড়ে, যেথা আকাশ মাটিতে কানাকানি, তোমার আমার শুধু এমনি করেই জানাজানি”
এই রিং টোন নিয়ে সুজাতার মনে বেশ একটা গর্বের ব্যাপার আছে। বেশ কিছুদিন আগে সুজাতা ইউটিউবে গিয়ে মোঃ রফি’র কন্ঠে গাওয়া গানটি শুনছিল। পাশেই পাপলু নিজের কাজ করছিল। হঠাৎই জানতে চেয়েছিল, “ মা, দিগন্ত মানে কি?”
সুজাতা বলেছিল, “ সন্ধি বিচ্ছেদ করো, দিক+অন্ত= দিগন্ত, খুব সরল মানে হচ্ছে, বিশাল দীর্ঘ কোন পথ যেখানে শেষ হয়েছে, সেই সন্ধিস্থল।“
“মা, তুমি যে গানটি শুনছো, এর মানে করতে পারবে?”
-তুই পারবি?
-আমি আমার মত করে মানে করছি, দেখো হয় কিনা। আমার কাছে দুই মানে। এক মানে, বাবা হলো আকাশ, তুমি মাটি। আরেক মানে, দাদা আর আমি আকাশ, তুমি একা মাটি। তার মানে, আমরা সবাই মিলে একটা আকাশ, আর তুমি একাই মাটি, আমাদের সাথে তোমার কানাকানি, তোমার বুকে আমরা মিশে আছি।
সুজাতা চমকালো, পাপলু এত গভীরে ভাবে?
চার পাঁচদিন পরেই পাপলু বলেছিল, “ মা, আমার নাম্বারে কল দাও”
সুজাতা বলেছে, “ কেন, ফোন খুঁজে পাচ্ছিস না?
-না, পাচ্ছি না। কল দাও।
সুজাতা কল দিল, তখনই রিং টোন বেজে উঠলো গিটারের সুরে, “ঐ দূর দিগন্ত পাড়ে, যেথা আকাশ মাটিতে কানাকানি, তোমার আমার শুধু এমনি করেই জানাজানি”।
পাপলুর প্যান্টের পকেটেই ছিল ফোন, মা’কে রিং টোন শোনাবে বলে এই দুষ্টামী করেছে। সুজাতার দুই ছেলেই খুব ভালোবাসে মা’কে, তবে পাপলুর ভালোবাসা টের পাওয়া যায়, মা’কে খুশী করতে সে কত রঙ ঢঙ যে করে। শুভ্র খুব শান্ত, ওর চোখের তারায় ভালোবাসা চমকায়, কিন্তু ও প্রকাশ করতে পারে না।
আজও গিটারে গানের সুর শুরু হতেই পাপলু ফোন ধরলো, জানালো যে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বাড়ি ফিরছে। ছেলেটা সারাদিন বাড়ি ছিল না, ঘরে ঢুকেই খেতে চাইবে, সুজাতা খুব দ্রুত চিকেন চাউমিন বানালো, সাথে অল্প করে ডিমের হালুয়া। এই দুটোই পাপলু’র পছন্দের আইটেম। বিকেলে পাপলুর লেখা সেই চিরকুট পড়ে এমনিতেই মনটা খারাপ হয়েছিল, ভেবেছিল আজ পাপলুকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে, জীবনে এমন ঘটেই থাকে, যাকে খুব বেশী ভালো লাগে তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরী হয়, আবার মন ও মননে বিরোধ দেখা দিলে সে সম্পর্ক ভেঙ্গেও যায়, তাই বলে এতদিনের ভালো লাগার মানুষটা তো শত্রু হয়ে যেতে পারে না। বিবিকে নিয়ে মনে কোন ক্রোধ বা হতাশা পুষে না রাখাই উচিত। বিবির তো অন্য কাউকে ভালো লাগতেই পারে, তবে যে মেয়ে অন্য আরেকজনকে পাওয়ার আকাংক্ষায় তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামিও না।
রাত নয়টা বাজতেও পাপলু ঘরে ফিরেনি, সুজাতার বুক দুরদুর করছিল, কে জানে, ছেলেটা কি বিবির উপর পুরনো রাগ পুষে রেখে নিজের ক্ষতি করছে কিনা! ও তো কখনও এত দেরী করেনা বাড়ি ফিরতে! সুজাতা অবশ্য বিবি সংক্রান্ত কোন কথা সুজয়কে বলেনি।
রাত আটটার পর থেকে পাপলু ফোন ধরছে না শুনে সুজয় অবশ্য বলেছে, নেটওয়ার্কে সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু সুজাতার ভেতর ফোঁপাচ্ছে, শুভ্র এরই মধ্যে পাপলু’র খুব ঘনিষ্ঠ দুই তিনজন বন্ধুকে ফোন করেছিল, তারা সকলেই বলেছে রাত আটটা পর্যন্ত ওরা ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসে আড্ডা দিয়েছে, এরপর যে যার মত চলে এসেছে, পাপলু তখনও আড্ডাতে ছিল।
সে রাতে আর কারো খাওয়া হলো না, ঘুম এলো না, তিনজনেই পাপলু’র জন্য অপেক্ষা করে সোফায় বসেই রাত কাটিয়ে দিল।
সকাল ছয়টার দিকে সুজাতা কিচেনে ঢুকে চূলায় চায়ের কেটলি বসালো। কাল রাত বারোটার পর থেকে সুজাতা একরকম ধরে নিয়েছে, পাপলু খুব বড় রকমের বিপদে পড়েছে। ঘরের কেউ জানে না, পাপলু মা’কে বলেছে বিবি খুব প্রভাবশালী এক ছাত্রনেতার প্রেমে পড়েছে, সেই ছাত্রনেতা এতই প্রভাবশালী যে পুলিশও তাকে জমা দিয়ে চলে। এই ছাত্রনেতাকে শুধু পুলিশ না, অনেকেই খাতির করে, সুন্দরী মেয়েরা তাকে ঘিরে থাকে, তেমন একজন প্রভাবশালী নেতার চোখে বিবিকে ভালো লেগেছে, বিবি এতেই মুগ্ধ হয়ে পাপলু’কে টা টা জানিয়ে চলে গেছে সেই নেতার কাছে। ভালোই তো চলছিল সব কিছু, আজ কেন পাপলু লিখলো, গো টু হেল উইথ হিম। আমাকে বদার করছো কেন? বিবি কি করেছে? কেন আবার পাপলুকে জ্বালাচ্ছে? সেই নেতা কি ওর কাছ থেকে যা নেওয়ার সব নিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে? এখন মেয়ে আবার পাপলুর কাছে ফিরতে চাইছে? পাপলু কি অত সস্তা?
শুভ্রর মোবাইল বাজছে, কেটলি থেকে চায়ের কাপে চা ঢালছিল সুজাতা, রিং হওয়ার আওয়াজে এতটাই চমকে উঠলো যে কেটলী থেকে গরম চা ছাঁকনি ধরা বাম হাতের উপর পড়লো। সাথে সাথে হাতের চামড়া জ্বলে উঠলো, কিন্তু সুজাতা এতটুকু শব্দ করলো না। ভীত চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে রইলো, শুভ্র’র কপাল কুঁচকে আছে, কেমন উদভ্রান্ত ভঙ্গীতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলছে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কোথায়, কোথায়? ঢাকা মেডিক্যালে? ঢাকা মেডিক্যালে কেন? কী হয়েছে? আমি আসছি”।
এরপরের দুই দিনের কোন ঘটনাই সুজাতা জানতে পারেনি। শুভ্র যখন স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে, গতকালের কুঁচকানো শার্ট প্যান্ট পরা অবস্থায় দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ই সুজাতার হাত থেকে চায়ের কেটলী পড়ে যায়, ছাকনি পড়ে যায় এবং সুজাতার দেহটাও এলিয়ে মেঝেতে পড়ে যায়।
সুজাতা যখন মাথা ঘুরিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে, হাতের ধাক্কায় কেটলীটাও মেঝেয় পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলেছিল। সুজয় বাথরুমে ছিল, শুভ্র’র বেরিয়া যাওয়া বা সুজাতার পড়ে যাওয়া সম্পর্কে কিছুই জানতো না। নিস্তব্ধ বাড়িতে কেটলির ঝনঝন আওয়াজ দরজাবন্ধ বাথরুমের দেয়ালেও প্রতিধ্বনি তুলেছিল। ভেজামুখে টাওয়েল না চেপেই সুজয় ‘কি হলো’ বলে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। কিচেনে ঢুকে মেঝের উপর বাঁকা শরীরে সুজাতাকে পড়ে থাকতে দেখে সুজয় ঘাবড়ে গেলো। ‘শুভ্র, শুভ্র এদিকে আয় তো বাবা’ বলে নীচু হয়ে সুজাতার মাথা কোলে তুলে আলতো করে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকতে লাগলো, “ সুজাতা, সুজাতা, কি হয়েছে, সুজাতা”।
শুভ্র এলো না, সুজয় সুজাতার অচেতন দেহটাকে পাঁজাকোলে তুলে বেডরুমের দিকে গেলো। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাটিতে করে জল এনে দুই চোখে জলের ঝাপটা দিতেই একটু পরে সুজাতা দুই চোখ খুলে তাকালো। উদভ্রান্ত দৃষ্টি, চারদিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে, হঠাৎ এক ঝটকায় সুজাতা শোয়া থেকে উঠে বসলো, সুজয়কে জিজ্ঞেস করলো, “ শুভ্র ফিরেছে?”
সুজয় বলল, “ শুভ্র কোথায় গেছে? তুমি কি করে পড়ে গেলে? মাথা ঘুরিয়েছিল? সারারাত জেগেছিলে, এমনিতেই লো ব্লাড প্রেশার তোমার। এখন কেমন লাগছে?”
-সুজয়, শুভ্র ফিরে নি?
-শুভ্র তো কাল রাতেই ফিরেছে, পাপলু ফিরেনি। আজ হয়তো একটু পরেই পাপলু ফিরে আসবে। এত টেনশান করলে চলে?
-সুজয়, আমার পাপলু’র অনেক বড় বিপদ, শুভ্রকে কে জানি ফোন করেছে, শুভ্র এক ছুটে বেরিয়ে গেছে।
-কী বলছো আবোল তাবোল! দাঁড়াও আমি দেখছি, শুভ্রকে ডাকছি।
এরপরের ঘটনাগুলো সুজাতার কাছে অজানা রয়ে গেছে। সুজয় যখন শুভ্র’র খোঁজে বেডরুম থেকে বেরিয়ে গেলো, সুজাতা আবার জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়লো। সুজাতার অবচেতন মনে তখনও শুভ্রর উৎকন্ঠিত উচ্চারণে “কোথায়, কোথায়? ঢাকা মেডিক্যালে? ঢাকা মেডিক্যালে কেন? কী হয়েছে? আমি আসছি” কথাগুলো অনুরণিত হচ্ছিল। মায়ের মন, ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে পাপলুকে খুঁজতে লাগলো।
সুজয়ের মোবাইল রাতের বেলায় সাইলেন্ট মোডে থাকে, পুলিশের কাছ থেকে সুজয়ের নাম্বারেই প্রথম কল এসেছিল, রিং বাজেনি তাই সুজয় টের পায়নি। সুজয়ের সাড়া না পেয়ে পুলিশ শুভ্র’র নাম্বারে কল করেছে। শুভ্রকেই জানিয়েছে, একটি তরুণের মৃতদেহ টঙ্গি রেলস্টেশানের কাছেই রেললাইনের উপর পাওয়া গেছে। তরুণের প্যান্টের পকেটে থাকা মানিব্যাগে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডিতে পাপলু’র ছবি সহ নাম পাওয়া গেছে, সাথে থাকা বুক ব্যাগে কয়েকটি নোট খাতা, ডায়েরীতে একই নাম পাওয়া গেছে, মৃতদেহের খুব কাছাকাছি পড়ে থাকা মোবাইল ফোনের কল লিস্ট চেক করে তবেই শুভ্রকে কল দিয়েছে। পুলিশ বলেছে, তরুণের মৃতদেহ ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে নেয়া হয়েছে, শুভ্র গিয়ে যেন লাশ সনাক্ত করে।
ঢাকা মেডিক্যালে পৌঁছে শুভ্র পাপলুকে সনাক্ত করেছে, চিনতে না পারার কোন কারণ নেই। পাপলু’র সারা দেহে কোন কাঁটাছেঁড়া নেই, মুখেও রক্তের দাগ নেই, শুধু ঠোঁটের কোণায় নীল হয়ে আছে, ঘুষি দিলে যেমন হয়। শুভ্র কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কাকে বলবে, কী বলবে? বাবাকে কী ফোন করে বলবে যে পাপলু সুইসাইড করেছে? মা’কে কি বলবে যে পাপলু সুইসাইড করেছে? পাপলু সুইসাইড করলো কেন? পাপলু সুইসাইড করবে কেন? ডেডবডির পোস্টমর্টেম করবে, আরও কি কি জানি বলছে পুলিশের অফিসার। শুভ্র বুঝতে পারছে না কি বলবে সে। পোস্ট মর্টেম মানে লাশকাটা ঘরে নিয়ে ডোম পাপলু’র দেহটাকে ফালা ফালা করে কাটবে, এরপর ডাক্তার পরীক্ষা করবেন, পাপলু’র দেহের ভিসেরা রিপোর্ট তৈরী করবেন, তাতে শুভ্র’র কী লাভ হবে? পাপলু কি বেঁচে উঠবে? পাপলু কি ঘরে ঢুকেই মা’কে বলবে” মা, অনেক সরি মা, কাল রাতে বন্ধুর বাসায় দেরী হয়ে গেলো, আমার ফোনে চার্জ ছিল না, তাই তোমাকে ফোন করতে পারিনি”!
পাপলু’র অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানা দেখে পুলিশ অফিসারের বুকে হয়তো ধাক্কা লেগেছে, যদিও ধাক্কা লাগার কথা না। এমন ডেডবডি প্রতিদিনই তারা দেখে। পুলিশ অফিসার শুভ্র’র কাঁধে হাত রাখলো, খুব নরম গলায় বলল, “ শুভ্র, বী স্ট্রং! আদরের ছোট ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরার বদলে ভাইয়ের ডেডবডি সনাক্ত করতে আসার মত কঠিন শাস্তি আল্লাহ কেন দেন, জানিনা। আল্লাহ বা ভগবান আমাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেন। প্রতিদিন এমন কত জনকেই এখানে আসতে হয় প্রিয়জনকে সনাক্ত করতে, আমাদেরকে পাশে দাঁড়িয়ে এই কঠিন শাস্তির দৃশ্য দেখতে হয়। পুলিশে চাকরী করলেও আমাদেরও সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, এমন কঠিন দৃশ্য দেখতে হয় তাই দেখি, কিন্তু বুকে ধাক্কা লাগে। আদরের ভাইয়ের পোস্ট মর্টেম করতে দিতে মন চাইছে না হয়তো, কিন্তু পোস্টমর্টেম করার দরকার আছে। ইউ নেভার নো, আপনার ভাই হয়তো সুইসাইড করেনি, মৃত্যুর কারণ জানতে হলেও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দরকার আছে।“
এরপর সবকিছুই রুটিনমাফিক সম্পন্ন হয়ে গেলো। পোস্টমর্টেম শেষ হতেই সুজয়, সুজয়ের দুই ভাই, সুজাতার এক ভাই, শুভ্র, পাপলু’র কয়েকজন বন্ধু পাপলু’র ডেডবডি নিয়ে পোস্তগোলা শ্মশানে চলে গেলো, মৃত পাপলু’কে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়নি, কারণ তখনও সুজাতার জ্ঞান ফিরেনি, ডাক্তার সুজাতাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সুজাতার শারীরিক অবস্থা মনিটর করছে, বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এসেছিল, ডাক্তারের পরামর্শে সবাইকে আরও পরে আসার অনুরোধ জানিয়ে শুধু সুজাতার মা’কে সুজাতার পাশে রাখা হয়েছে।
দুই
সুজাতার যেদিন খুব ভালো করে জ্ঞান ফিরলো, সুজাতার মা মেয়ের শিয়রের পাশেই বসেছিলেন। সুজাতা নিজে নিজেই বিছানায় উঠে বসলো, সুজাতার মা বিধবা মানুষ, একবেলা আলোচালের ভাত খেয়ে শরীর এমনিতেই শীর্ণ হয়ে গেছে, গত ছয়দিন ঠায় বসে আছেন মেয়ের শিয়রের পাশে, খাওয়া নেই, ঘুম নেই, মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। প্রথম কয়দিন নীরবে চোখের জল ফেলেছেন, এখন চোখের জলও শুকিয়ে গেছে, নাতি চলে গেলো, মেয়েটাও না জানি চলে যায়! একমাত্র মেয়ের ঘরের আদরের নাতি পাপলু, কী ফুটফুটে ছেলেটা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল, বাসায় ফেরার পথে কারা জানি পাপলুকে মাথার পেছন দিকে লোহার রড দিয়ে বাড়ি মেরে মাথাটা ফাটিয়ে মেরে ফেলেছে। এরপর ছেলেটাকে রেললাইনের উপর ফেলে দিয়ে চলে গেছে। হাসপাতাল থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে নাকি বলেছে, মাথায় পেছন থেকে কেউ আঘাত করেছে, সেই আঘাতজনিত কারণে পাপলুর মৃত্যু হয়েছে।
সুজাতা উঠে বসতেই মা জিজ্ঞেস করলেন, “ মনা, ঘুম ভাঙ্গলো? মুখ ধুবি, জল এনে দেব?
সুজাতা বলল, মা, তুমি কবে এসেছো?
সুজাতার মা ভীষণ বুদ্ধিমতী, একটুও গলার স্বর না কাঁপিয়ে বললেন, আমি কাল সন্ধ্যেবেলা এসেছি, তোর শরীর ভাল না শুনে আর থাকতে পারলাম না। এখন কেমন লাগছে শরীর?
-মা, পাপলু’কে কি বাড়িতে এনেছিল?
সুজাতার মা নিজেকে আরেকবার সংবরণ করে নিলেন। বললেন, মনা, পাপলু’র কথা পরে বলবো। তুই আগে চোখে মুখে একটু জল দে। তোর পাপলু কি শুধু তোর একার? আমাদের না? পাপলু আমাদেরকে একা ফেলে চলে গেছে, তুইও চলে যেতে বসেছিস। শুভ্র, সুজয়কে কার কাছে রেখে যাবি? ওদের কেউ নেই তো, আমি বুড়ি কয়জনকে বেঁধে রাখবো? বলেই তিনি হু হু করে কাঁদতে লাগলেন।
সুজাতা বলল, মা, পাপলু’র ফোনটা কি পাওয়া গেছে?
সুজাতার মা উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, দাঁড়া দেখছি, সুজয়কে জিজ্ঞেস করে দেখি।
সুজাতা বলল, মা, কাল রাতে পাপলু এসেছিল। তুমি তখন আমার বালিশে মাথা দিয়ে শুয়েছিলে। পাপলু আমাকে ডাকতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, দেখি বেচারা মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাতে বাড়ি ফিরতে পারেনি তো, তাই আমাকে ভয়।
আমি বললাম, আর কখনও রাত করো না, আমার ভয় লাগে।
ও বলল, “ মা এই কানে ধরছি, আর কখনও বাইরেই যাব না, আমি ঘরেই থাকবো। বাইরে গেলেই বিবির সেই বয়ফ্রেন্ড আমাকে আবার মেরে ফেলবে”।
সুজাতার কথা শুনে সুজাতার মা চমকে গেলেন। পাপলু’কে যে কেউ মেরেছে, তা সুজাতার জানার কথা না। সুজাতাকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে সুজাতার মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। মেয়ের মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, এরপর এক গ্লাস গরম দুধ খাওয়াতে হবে, ডাক্তার অমনই বলে গেছেন। আজই প্রথম শুভ্র আর সুজয় ঘন্টাখানেকের জন্য বাইরে গেলো। ফিরে আসার সময় হয়েছে। পাপলু’র ফোনের কথা মনা কি বললো, উনি বুঝতে পারেন নি। জলের বাটি হাতে মেয়ের কাছে এসে বসলেন, নিজের থানের আঁচল জলে ডুবিয়ে তা নিঙড়ে মেয়ের মুখ মুছিয়ে দিলেন। এরপর দুধের গ্লাস মেয়ের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, “ মনা, তোর কথা আমি বিশ্বাস করেছি। পাপলু গতরাতে আসেনি, ও আরও আগেই এসেছে। আমার সাথেও কথা বলেছে। আমার কাছে খেতে চেয়েছে। আমি ওকে তিনবেলা খেতে দিয়েছি। শুধু দুধ ভাত খেতে দিয়েছি। ওর বোধ হয় দুধভাত খেতে আর ভালো লাগছিল না, তাই গতরাতে তোকে ডেকে তুলেছে। তুই ওকে ভালো মন্দ রেঁধে খাওয়াস। এখন তুই এই দুধটুকু খেয়ে নে, নাহলে শরীরে বল আসবে কোত্থেকে?
সেসময় সুজাতার মা পাশে থাকায় সুজাতা খুব দ্রুত সেরে উঠেছিল। বাচ্চাদেরকে রূপকথার গল্প বলে মায়েরা যেভাবে খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, সুজাতাকেও তার মা ঠিক তেমনি করে ছেলেভুলানো গল্প বলে খাওয়াতো।
তিন
বিকেল পাঁচটায় সুজাতার অফিস ছুটি হয়, আজ এক ঘন্টা আগেই সুজাতা বাড়ি চলে এসেছে, বাড়ি ফিরে আজ আর কিচেনে ঢুকেনি, সরাসরি চলে গেছে পাপলুর রুমে। পাপলু’র রুমে গত দুই বছরে সুজাতা ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করে্না, রুমটির চতুর্দিকে পাপলুর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে, সুজয় বা শুভ্র সইতে পারে না। কিন্তু সুজাতা প্রতি বিকেলে এই রুমে এসে আধঘন্টা সময় বসে থাকে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, সুজাতা বুঝি চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবছে। আর সুজাতার কাছে মনে হয়, পাপলু ওকে গিটার বাজিয়ে শুনাচ্ছে। সুজাতা কখনও ফরমায়েশ করেনা, পাপলু নিজে থেকেই মায়ের প্রিয় গানের সুর গিটারে বাজিয়ে শোনায়। আধঘন্টা সময় ওর ঘোরের মধ্যেই কেটে যায়। এই নিয়ে অবশ্য সুজয় বা শুভ্র কখনও কোন প্রশ্ন করে না।
শুভ্র এমনিতেই শান্ত স্বভাবের, ছোট ভাইয়ের মৃত্যু ওকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করে দিয়েছে। পিএইচডি করার স্বপ্ন ছিল, সব কিছু ঠিক থাকলে এখন ওর আমেরিকায় থাকার কথা ছিল। বাবা, মা’কে এভাবে রেখে শুভ্র আমেরিকা যেতে চায়নি। গত বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরীতে ঢুকে গেছে। সকালে অফিস যায়, বিকেল নাগাদ ফিরে আসে, আগেই চুপচাপ স্বভাবের ছিল এখন আরও চুপ থাকে। নিজের রুমে বসে নিজের কাজ করে যায়। সুজাতা একদিন শুভ্র’র রুমে ঢুকেছিল বিছানার চাদর পালটে দেয়ার জন্য, বালিশের কভার খোলার সময় যেইনা বালিশ ধরে টান দিয়েছে, দেখে বালিশের নীচে পাপলু’র ছবি সাজিয়ে রাখা, একেবারে ছোট থেকে বড় পর্যন্ত, সব বয়সের ছবি, সুজাতা বালিশের কভার বিছানার চাদর যেমন ছিল তেমনি রেখে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
না, সুজাতা কাঁদেনি, সুজাতা পাপলুর জন্য কাঁদেও না। কারণ সুজাতা জানে, পাপলু ঘরেই আছে, ও বাইরে বেরোয় না। খাবার টেবিলে এখনও ওরা চারজনেই খেতে বসে, পাপলুকে সুজাতা ছাড়া আর কেউ অবশ্য দেখতে পায় না। পাপলুর প্লেটে খাবার তুলে দেয় সুজাতা, পাপলু কী সোনামুখ করে সবটুকু ভাত খেয়ে নেয়, কিছু ভাত রেখে দেয় থালায়, যেন পরদিন কুকুরদের খেতে দেয়া যায়। এই বাড়ির নীচ তলায় গেটের পাশেই একটা কুকুরকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়, দারোয়ানকে বলা আছে, সকালে ময়লা নিতে আসে যে মেয়ে, তাকে সুজাতার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়, সুজাতা সেই মেয়ের হাতে প্রতিদিন পাঁচ টাকার একটা নোট গুঁজে দেয়, সাথে পাপলু’র থালার ভাত, মাছ, তরকারী। মেয়েটা সব খাবার নিয়ে নীচে চলে যায়, কুকুরকে দিবে কেন, এক থালা ভর্তি ভাত, মাছ নিজেই খেয়ে নেয়।
পাপলুর রুমটি আয়তনে খুব বেশী বড় নয়, এক পাশের দেয়াল ঘেঁষে একখানা সিঙ্গল সাইজের ডিভান পাতা আছে, উলটো পাশে চারকোণা টেবিলে পাপলুর গীটার, তবলা, হারমোনিয়াম সাজানো আছে। আরেক কোণে কমপিউটার টেবিলে ২০ ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রিনের ডেস্কটপ কম্পিউটার, সাথে গদি মোড়া রিভলবিং চেয়ার, এর পাশেই দেয়ালজোড়া বুকশেলফে থরে থরে সাজানো গল্প-উপন্যাস, কবিতার বই, কিছু ট্রফি, কিছু মেডেল, পাপলুরই সব। গানে, কবিতা লেখায়, বিতর্ক প্রতিযোগীতায় পাওয়া পুরষ্কার।
ফোনটা এখনও কমপিউটার টেবিলেই রাখা আছে। অনেকদিন ফোনটা পুলিশের জিম্মায় ছিল। পাপলুর মৃত্যুর পর সুজাতা যখন মোটামুটি সুস্থ, অফিসে যেতে শুরু করেছে, ( ওহ ভালো কথা, পাপলুর মৃত্যুর পর সুজাতার ব্যাংকের জিএম এসেছিলেন, সুজাতা তখন অচৈতন্য, উনি বলে গেছিলেন, সুজাতা নিজ থেকে যেদিন কাজে যেতে চাইবে, ঠিক সেদিনই যেন যায়।),
একদিন শুভ্র মায়ের কাছে এসে বলল,
“ মা, আমি আমেরিকা যাব না। ইউনিভারসিটির অ্যাডমিশান অফিসকে জানিয়ে দিয়েছি।
-ওহ, ঠিক আছে, যেতে ইচ্ছে না হলে যাওয়ার দরকার নেই। তবে তোর পিএইচডি করার এত শখ ছিল, জি আর ই স্কোর এত ভালো হয়েছে, তবুও যাবিনা?
-না, আমি এখন অন্য একটি কাজে হাত দেবো।
-কি কাজ?
-পাপলুকে যারা খুন করেছে, তাদের মুখোশ খুলে দেবো।
-সে কি? পাপলুকে কারা খুন করতে যাবে? কিসব ঝামেলায় জড়াতে চাস বাবা!
-মা, তুমি কি পাপলু আর বিবির মধ্যে যে গোলমাল চলছিল, তা জানতে?
-থাক শুভ্র, আমার পাপলুকে বিবির ভালো লাগেনি, ও সরে গেছে। কাউকে সারাজীবন ভাল লাগতেই হবে, এমন কোন কথা তো নেই।
-না মা, সেটা না। তুমি জানো না, আমি জানি। পাপলু আমাকে সব কথা বলতো। ইদানিং সেই মেয়েটার সাথে ওর বয়ফ্রেন্ডের বোধ হয় ঝগড়া হয়েছিল, মেয়েটা কত বড় বেহায়া, আবার পাপলুকে পটাতে চেয়েছিল। পাপলু ওর দিকে আর ফিরে তাকাতে চায়নি বলে রাগে সেই বয়ফ্রেন্ডের কাছে পাপলুর নামে উলটাপালটা কথা লাগিয়েছে। সেই বয়ফ্রেন্ড তো হোমরা চোমরা বাপের ছেলে, অঢেল পয়সা, কাউকে পরোয়া করে না। পাপলুকে নাকি একদিন হুমকীও দিয়েছে। আমার ধারণা, পাপলুর এক্স গার্ল ফ্রেন্ড আর ওর বয়ফ্রেন্ডের চেলা চামুন্ডারা পাপলুকে মেরে ফেলেছে। আমি থানায় ডায়েরী করবো, কেস আদালতে উঠাবো, সত্য বেরিয়ে আসুক। আমাদের পাপলুকে ফিরে পাবো না, কিন্তু পাপলুর প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার বিচার চাইবো।
-বাবা, আমি তো এত ঘটনা জানতাম না, শুধু সেদিন পাপলুর টেবিল গুছাতে গিয়ে ওর হাতে লেখা একটা চিরকুট পেয়েছিলাম, তোর বাবার নজরে যেন না পড়ে, তাই চিরকুটটা সরিয়ে ফেলেছিলাম।
-কি লেখা ছিল?
-তুই যা বললি, তেমন কথাই।
-তোমার মনে আছে কোথায় রেখেছিলে?
-তা মনে আছে, তবে আমি চাইছি না তুই নতুন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস।
-মা, আমাকে কাজটা শুরু করতে দাও, পাপলুর জন্য আমার ভেতর পুড়ে খাক, নিজের মনে শান্তি পেতে চাই বলেই খুনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই। তুমি কাগজটা বের করে দিও। পুলিশ কমিশনারের সাথে আমার কথা হয়েছে, আমি লড়তে চাই।
সেই কেইস চলছে, পুলিশ পাপলুর ফোন নিয়ে গেছিল, ফোন কল ট্র্যাক করার জন্য, বেশ কয়েকমাস পর ফোন ফিরিয়ে দিয়েছে, কতটুকু কি করা যাবে কে জানে। শুভ্রর জন্য দুশ্চিন্তা হয়।
এখনও পাপলুর গিটার বাজানোর সময় হয়নি, মনটায় আজ ভীষণ অস্থিরতা ছিল, চা খেতেও ইচ্ছে করছে না, হালকা পাতলা দেহটাকে ডিভানে এলিয়ে দিয়ে সুজাতা কিছুক্ষণের জন্য দুই চোখের পাতা বন্ধ করলো। হঠাৎ বুকটায় ভীষণ শূন্যতা অনুভব করলো, এমন শূন্যতা গত দুই বছরে একবারও মনে হয়নি।
অফিসে লাঞ্চ আওয়ারে খাওয়ার জন্য সুজাতা ঘর থেকেই খাবার নিয়ে যায়। আজ ভুল করে লাঞ্চ বক্স ডাইনিং টেবিলে রেখেই অফিসে চলে গেছিল। দুপুরে পূর্ণিমা থেকে কিছু স্ন্যাকস আনাবে ভেবেই ফরিদকে ডেকেছিল, ব্যাগ ঘেঁটে ছোট্ট টাকার থলেটা বের করার সময় ফোনের দুই নাম্বার বাটনে চাপ পড়েছিল বোধ হয়, সুজাতা টের পায়নি। কিন্তু হঠাৎ সেই পরিচিত গিটারের সুর ভেসে আসে, “ ঐ দূর দিগন্ত পাড়ে, যেথা আকাশ মাটিতে কানাকানি, তোমার আমার শুধু এমনি করেই জানাজানি”।
সুজাতা ভীষণ চমকে উঠে, বুক ধুকপুক করতে থাকে, এদিক সেদিক তাকায়, পাপলু এখানে কখন এলো? ঠিক তখনই খেয়াল হলো, গিটারের সুর ভেসে আসছে ওর ব্যাগের ভেতর থেকে। ব্যাগ খুলে দেখলো, ওর ফোন থেকে আওয়াজ আসছে। টাকা বের করার সময় স্পিড বাটনে চাপ পড়ে যাওয়ায় তা পাপলুর ফোন নাম্বারে চলে যায়, পাপলুর রিং টোন বেজে উঠে।
সুজাতার দুই চোখের কোল বেয়ে জল গড়াচ্ছে, এত জল ছিল চোখে। ছোট্ট পাপলু বলেছিল, দিগন্ত যদি হয় শেষ সীমা, আকাশ যেখানে মাটিতে গিয়ে মিশে, তাহলে ওরা সবাই আকাশ আর সুজাতা একা মাটি, ওদের তিনজনকে সুজাতা একা বুকে ধরে রেখেছে। সুজাতা আর পারলোনা ডুকরে কেঁদে উঠলো, “ পাপলু বাবা, আমার ছোট্ট বাবা, তোর কথাই সত্যি হয়ে গেলো রে বাবা, তুই আকাশে চলে গেলি, আমি সব যন্ত্রণা বুকে সয়ে মাটি হয়ে আছি। বাবারে, তুই কেন চলে গেলি বাবা। বাবা, তুই আমাকে কত্ত ভালোবাসিস রে বাবা, আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না বলে তুই আমার বুকের মধ্যে বাসা বেঁধেছিস, বাবা আমি তোকে বুকের ভেতরে রেখে দিয়েছি, তুই ঠিকই বলেছিলি বাবা, আকাশ মাটিতে কানাকানি, তোমার আমার শুধু এমনি করেই জানাজানি। বাবা, আমরা তো এখন শুধু কানাকানি করেই বেঁচে আছি বাবা, পাপলু, বাবা আমার অনেক কষ্ট, বাবা তুই কেন আমাকে মাটি বানাতে গেলি”।