অনলাইনে সংবাদটা পড়েছিল জয়া, এরপর থেকে ওর মনটা এত বেশী খারাপ হয়েছে যে কোন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। শীতের মধ্যেও ও রীতিমত ঘামছে, চোখে মুখে তীব্র জ্বালা, বার দুয়েক ট্যাপ খুলে বরফ ঠান্ডা জল চোখেমুখে ছিটিয়েছে, তবুও চোখের জ্বালা কমেনি। এখানে ওর বন্ধু বলতে কেউ নেই, এক ছেলে আর এক মেয়ে, দুজনেই ফটর ফটর ইংলিশ বলে, বাংলা বলেও না, বাংলা কথা খুব বেশী বুঝেও না, কাজেই ছেলেমেয়ের সাথে মনের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আলাপ করে কোন লাভ হবে না। আর স্বামী? সে তো স্বভাবে জয়ার বিপরীত। জয়া যেমনি কোন কিছুর শেষ না দেখে ছাড়ে না, জয়ার স্বামী, মানে পুলক, যে কোন সমস্যায় শুরুতেই পরাজয় মেনে নেয়, তার একটাই কথা, “ মেনে নাও”।
জয়ার স্বামী পেশায় ইঞ্জিনীয়ার, অনেক বছর হয়ে গেছে বিদেশে মোটা বেতনের চাকরী করছে, আগে চাকরী করতো মালয়েশিয়াতে, সাত বছর হলো আরও বেশী বেতনের চাকরী নিয়ে চলে এসেছে বাহরাইনে। বাহরাইন আরবদেশ হলেও ভিনদেশী মেয়েদের চলাফেরায় খুব বিধিনিষেধ নেই, এখানে প্রচুর ভারতীয় আছে, যদিও তাদের বেশীর ভাগই নন বেঙ্গলী, তবুও বাহরাইনে জয়ার খুব একটা খারাপ লাগে না। মাঝে মাঝেই দুবাই বেড়াতে যায়, দুবাই তো দুবাই, মনে হয় যেন ধন রত্নের উপর সাজানো মরুদ্যান। জয়ার স্বামী এত বেশী রোজগার করে যে টাকাপয়সা নিয়ে জয়াকে মোটেও ভাবতে হয়না। সে ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার দিকটা খুব ভালো করে তদারকি করে। ছেলে মেয়েকে আমেরিকান স্কুলে পড়াচ্ছে, জয়ার ইচ্ছে ছেলেমেয়েকে একসময় আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়ে ওরা দুজন বাংলাদেশে ফিরে যাবে। অবশ্য ইদানিং সেই ইচ্ছেটুকুতে শংকা দেখা দেয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, যদিও সরকারে আছে জয়ার প্রিয় দল আওয়ামীলীগ, কিন্তু হালচাল দেখে মনে হয় যেন খোদ আওয়ামীলীগেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটছে, এরাই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে বসে আছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে, মেয়ে এবং মহিলাদের পোশাকের ধরণ পালটে যাচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে বাংলা-আরবী সংস্কৃতির নতুন এক মিশেল।
মাসখানেক আগে বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী, আমেরিকা গেছিলেন সরকারী সফরে অথবা ব্যক্তিগত সফরে, সরকারী কাজের বাইরে একদিন এক ঘরোয়া সাংবাদিক সম্মেলনে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মাই ডিয়ার ভঙ্গীতে আলাপচারিতা করছিলেন। জয়ার ধারণা বাংলাদেশের মন্ত্রী-মিনিস্টার, রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের প্রায় সকলেই কাজের নামে ঠনঠনা হলেও কথায় খুব সেয়ানা। কথার প্যাঁচে পারলে তাঁরা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এক নাম্বার আসনে বসিয়ে দেয় আর কি। তেমনই কথার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন সেই মন্ত্রী। স্রোতে ভাসতে থাকলে তো ভালো-মন্দ খেয়াল থাকেনা, মন্ত্রী সাহেবেরও নিজের ভালো-মন্দ সম্পর্কে হুঁশ ছিল না। উনি ধরেই নিয়েছিলেন, অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই উনার দলের লোক, খুব প্রিয়জন, (দলের লোকও তো শতভাগ বিশ্বস্ত বা প্রিয় হয়না) তাই আবেগের বশে বিবেক বন্ধক দিয়ে পবিত্র ধর্ম ইসলামকে অবমাননা করে কী কী নাকি বলেছিলেন। ব্যস! বিস্ফোরণ ঘটে তখনই, সাথে সাথে অনলাইন মিডিয়াতে ভিডিও ক্লিপসহ খবর রটে যায়, ফেসবুকে খবর রটে যায়, মন্ত্রী সাহেব নিজে মুসলমান হয়ে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেছেন। সেই সংবাদ জয়া তখনই ফেসবুক থেকে জেনে যায়।
জয়া নিজেও ধর্মভীরু, তবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন সম্পর্কে খুব বেশী সচেতন না। ও মনে মনে সব সময় ঈশ্বরকে স্মরণ করে, যে কোন ধর্মীয় স্থানে গেলে তা যে ধর্মেরই হোক, প্রথমে মাথা নীচু করে প্রণাম করে, তারপর ঘুরে ঘুরে মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা, গীর্জার স্থাপত্যশিল্প দেখে মুগ্ধ হয়! ও নিজে বিশ্বাস করে যে ধর্ম হচ্ছে চেতনা, ধর্মীয় চেতনা মানুষকে উদার করে, মহৎ করে, সততা শেখায়, নিরহংকারী হতে বলে। নিজে সনাতন ধর্মের হলেও অন্য ধর্ম সম্পর্কে ওর মনে একই শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে।
ছোটবেলা থেকেই জয়া এমন এক সুন্দর পরিবারে, সুন্দর পরিবেশে বড় হয়েছে যে ও ভাবে, “ আমার মূখ্য পরিচয় প্রথমে একজন মানুষ হিসেবে, দ্বিতীয়তঃ বাঙ্গালী হিসেবে, তৃতীয়তঃ সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে। প্রথম এবং দ্বিতীয় পরিচয় নিয়ে জয়া যতখানি উচ্ছ্বসিত, গর্বিত বোধ করে, তৃতীয় পরিচয়টুকুকে ঠিক ততখানি মনের কুঠুরীতে রেখে দিতে ভালোবাসে। ফলে কারো সাথেই ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা বা বাক-বিতন্ডা করার প্রয়োজন বোধ করে না। ও সব সময় নিজেকে পরিচয় দেয় বাঙ্গালী হিসেবে, ও নিজেকে পরিচয় দেয় ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে, কারণ বাংলাদেশ এবং ওর জন্ম একই দিনে, একই সময়েই হয়েছিল।
জয়ার মন খারাপের শুরুটা হয় অনলাইন ভিডিওতে মন্ত্রী সাহেবের বিশ্রম্ভালাপ শুনে। মন্ত্রী সাহেব উচ্চশিক্ষিত, সজ্জন, তুখোড় রাজনীতিবিদ, বাকপটু, জ্ঞানী এবং সবচেয়ে বড় কথা উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বে ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপারটুকু ভীষণই সেনসিটিভ হয়ে উঠেছে, তার ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়ছে, বাংলাদেশের মানুষ আগেও ধার্মিক, সহনশীল, উদার ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক কারণেই হোক, অথবা অর্থনৈতিক কারণেই হোক জনগণের মাঝে সেই উদারতা বা সহনশীলতার মাত্রা অনেক নীচে নেমে গেছে। এখন খুব সহজেই বারুদে আগুন জ্বলে উঠে। মন্ত্রী সাহেবের সেদিনের আসরে বলা কয়েকটি কথাতে সারা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সবখানেই বাংলাদেশী মুসলিম কমিউনিটিতে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে।
ফেসবুক এবং অনলাইন পত্রিকা পড়ে জয়া সবই জেনেছে, তখন থেকে মন খারাপ শুরু। ওর খুব খারাপ লাগছিল এই ভেবে, এতবড় এক মুক্তিযোদ্ধাকে কথার প্যাঁচে ফেলে আজ কোথায় টেনে নেয়া হচ্ছে, উনি কেন বলতে গেলেন এসব কথা! উনি তো জনগণের নেতা, উনি জনগণের নাড়ি বুঝে কথা বলবেন না? ধর্মভীরু জনগণের মনে কষ্ট দিলে কি ফল ভালো হয়? সত্যি সত্যি ফল ভালো হয়নি, মন্ত্রী সাহেবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, সে আগুনে জল ঢালতে সরকার প্রধানকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছে। সরকার প্রধান মন্ত্রী সাহেবের মন্ত্রীত্ব বাতিল করেছেন, মন্ত্রী সেই যুবক বয়স থেকে সারা জীবন যে রাজনৈতিক দলের হয়ে জান লড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই রাজনৈতিক দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, এবং দেশে প্রবেশ করিবা মাত্র তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়েছে। অপমানের আর বাকী রইলো কি। সরকারের কাজ সরকার করেছেন।
জয়া এসব সংবাদ রোজই পড়ে, ওর নিজের মনে কী হয় তা তো আর কাউকে বলা যাবে না, তাই মনের কথা মনেই চেপে রেখেছে। একটা বিষয় জয়াকে অবাক করেছে, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি বোধ হয় আর ইহজীবনে তার ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফিরে পাবেনা, জয়ার আরও বেশী খারাপ লেগেছে যখন ওর পাশের ফ্ল্যাটের ডঃ প্যাটেল সেদিন পুলককে কাছে পেয়ে কোলাকুলি করে বলেছিল, “ মহান ভারত তো মঙ্গল গ্রহে মহাযান পাঠিয়ে দিল, আমেরিকার চাইতে আমরা তো আর এক চুলও পিছিয়ে নেই”।
জয়া মনে মনে ভাবছিল, ভারত মঙ্গলে যান পাঠায়, বাংলাদেশের জনগণ জীবিত রাজাকারের মুখ দেখে চান্দের বুকে। এসব কথা তো উচ্চারণ করার জো নেই,
পুলক বলবে, “ আরে, রাখো তো, ১৬ই ডিসেম্বারে কী শুধু তুমিই জন্মেছো, আর কেউ জন্মায়নি? সারাক্ষণ শুধু মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বিজয় দিবস, বঙ্গবন্ধু---তুমি ছাড়া আর কাউকেই তো দেশপ্রেম নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখিনা, সেদিন তো গেছিলে নাফিস সাহেবের বাড়ির দাওয়াতে, ভেতরে তোমরা মহিলারা তো বসেছিলে, কে কে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছে, আমাকে বলো”।
জয়া বলেছিল, “ কেউ বলেনি, তাই বলে কি আমিও বলবো না? তোমার শুনতে ইচ্ছে নাহয় তো তোমাকে বলবো না, ফেসবুকে আমার অনেক বন্ধু আছে, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলে”।
-এটাই তো সমস্যা, সবাই ফেসবুকে বসে বসে হাতী মারে, ঘোড়া মারে। কই, কেউ কি পেরেছে মন্ত্রী সাহেবের পক্ষে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলতে? বলবেই বা কেন, আমিও মনে করি উনি কাজটি ঠিক করেননি।”
পুলকের কথায় জয়ার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল, বলতে ইচ্ছে করেনি যে মন্ত্রী সাহেবের বিরুদ্ধে যা কিছু শাস্তি গ্রহণ করা হয়েছে, তাই তো যথেষ্ট, উনাকে কেন আবার গ্রেফতার করা হবে? জামাতীরা এখন উনার মাথার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইস! সত্যি সত্যি যদি মন্ত্রী সাহেবকে জেলে যেতে হয় এত তুচ্ছ কারণে, যদি সত্যি সত্যি সৌদি আরবের মত করেই মন্ত্রী সাহেবের গর্দান কেটে ফেলা হয়, উফ! ভাবা যায়! শুধুমাত্র রাজাকারদের খুশী করার জন্য একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জেলে নেয়া হলে, এ তো মুক্তিযোদ্ধার অপমান, মুক্তিযুদ্ধের অপমান, বাংলা মায়ের অপমান।
দুই
আজ ডিসেম্বারের নয় তারিখ, আর মাত্র সাত দিন পরেই জয়ার জন্মদিন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বার বিকেল সাড়ে চারটার সময় জয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিল, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। আর মাত্র সাত দিন পরেই জয়ার জন্মদিন, ২০১৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বার, রোজ মঙ্গলবার জয়া ৪৩ বছরের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে চুয়াল্লিশতম বছরে পা রাখবে। জন্মদিন নিয়ে এত আদিখ্যেতা জয়ার শ্বশুরবাড়িতে কেউ করেনা, এমনকি জয়ার স্বামীও না। জয়া করে আদিখ্যেতা, কারণ ও মনে করে, বাংলাদেশ এবং ওর জন্ম যেহেতু একই দিনে, প্রায় একই সময়ে, তাই ওর জন্ম নিয়ে আদিখ্যেতা করার অধিকার আছে।
জয়ার মা বেঁচে নেই, ওর যখন নয় বছর বয়স, এক বিকেলে ওর মা দুম করে চেয়ার থেকে পড়ে যায়, পড়ে গিয়েই মরে যায়। জয়ার চোখে দেখা প্রথম মৃত্যু, মায়ের মৃত্যুটা এতই আকস্মিক ছিল যে জয়ার মনেই হয়নি মা ওদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে। মাকে যতদিন পাশে পেয়েছে, মায়ের কাছে জয়া নিজের জন্মের কথা শুনতে চেয়েছে, কতবার শুনেছে, তবুও যেনো আশ মেটতো না।
মা বলেছিল, জয়া নাকি মায়ের দ্বিতীয় সন্তান, প্রথম সন্তান গর্ভেই মারা গেছিল। জয়া শুনেছে, ওটা ছিল মায়ের ছেলে, ছেলে সন্তান হতে গিয়েও হলো না, মা অনেক দুঃখ পেয়েছিল, অনেক দিন নাকি কেঁদেছিল। এর দেড় বছর পর জয়া মায়ের গর্ভে আসে, তখন সময়টা ছিল মার্চের মাঝামাঝি। বাবা নাকি তখন কাজ নিয়ে দারুণ ব্যস্ত থাকতো, সাংবাদিক ছিল তো, তাই খবরের পেছনে ছুটে বেড়িয়েছে। এরপর তো ২৫শে মার্চের কাল রাত্রিতে পাক সেনাদের ঠা ঠা ঠা গুলী, ঢাকা শহরের মানুষজন মরে সাফা।
ঢাকার টিকাটুলিতে দুই রুমের একখানা বাসাতে জয়ার বাবা-মা ভাড়া থাকতো, ২৫শে মার্চের রাতে কোন এক ফাঁকে জয়ার বাবা নাকি কী সব কাগজপত্র খুঁজতে বাসায় ফিরেছিল, এর কিছু সময় পরেই শুরু হয়ে যায় গোলাগুলী। গুলীর শব্দ এত বেশী স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল যে জয়ার মা ভয়ের চোটে খাটের নীচে গিয়ে ঢুকেছিল, সারা রাত ওখানেই ছিল। পরদিন না, তার পরের দিন স্বামী-স্ত্রী কিছু পথ পায়ে হেঁটে, কিছু পথ রিক্সায় চেপে সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছে যায়। নদীর পাড়ে অসহায় মানুষের ভীড়, সবাই ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কে কোথায় যাচ্ছে কেউ জানেনা। জয়ার মা’কে নিয়ে জয়ার বাবা কেরাণীগঞ্জে তার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠলো। এরপর ধীরে সুস্থে মাসখানেক পর স্বামী-স্ত্রী চলে গেলো ফরিদপুর নিজেদের গ্রামের বাড়ীতে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষজন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গেছিল, অনেকে আগরতলা হয়ে কলকাতা চলে গেছিল। ততদিনে গ্রামের বাড়ির সকলেই বুঝেছে, জয়ার মায়ের শরীর খুব খারাপ, মায়ের পেটে আবার সন্তান খেলা করে, মা দূর্বল শরীরে অনাগত সন্তানের ছটফটানিতে ক্লান্ত থাকেন। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল, হঠাৎ এক সকালে মা খেয়াল করে, মায়ের পাশে কেউ নেই। বাবাকে অনেক দিন পর্যন্ত খোঁজা হয়েছিল, কেউ কোন সন্ধান আনতে পারেনি, কিন্তু মা বুঝেছিল বাবা মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। এর কয়দিন আগেই মায়ের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বাবা বলেছিল, উনি মুক্তিযুদ্ধে যাবেন। মায়ের সাথে বাজী ধরেছিল, যদি মায়ের গর্ভের সন্তানটি ছেলে হয়, তাহলে বাবা যুদ্ধে মারা যাবে না, আর যদি সন্তানটি মেয়ে হয়, তাহলে বাবা বাঁচুক বা না বাঁচুক, দেশ স্বাধীন হবে।
ডিসেম্বারের ষোলো তারিখে আঁতুড়ঘর থেকে নবজাতকের কান্না শোনা যায়, যন্ত্রণা ভুলে মা দাইকে জিজ্ঞেস করেন, কী বাচ্চা হলো? ‘লক্ষ্মী মা’ এসেছেন শোনার পর মায়ের মনে হলো, বাবা বলে গেছিল কন্যা সন্তান হলে দেশ স্বাধীন হবে। তবে কী দেশ স্বাধীন হবে? কন্যার বাবা বেঁচে আছে তো! এমন ভাবনার মাঝেই উঠোনে হই হই শোনা গেল, জয় বাংলা শ্লোগান শোনা যেতে লাগলো, মায়ের অবসন্ন দেহে শিহরণ জাগে, চেনা কন্ঠস্বর শুনে মায়ের দুই চোখে জলের ধারা নামে, ইচ্ছে করে এক দৌড়ে ঘরের বাইরে ছুটে যায়, দাইকে জিজ্ঞেস করে, বাইরে কার কন্ঠ শোনা যায়? দাই জানায়, “লক্ষ্মীর বাপের গলা, লক্ষ্মী ঠাইরেণ আসছে তোমাগোর বাড়িতে, পাগলা বাপে কতদিন বাইরে থাকবো”?
আজও, ৪৩ বছর পরেও জয়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে, কীভাবে বাবার অনুমান সঠিকভাবে মিলে গেলো! বাবা বলেছিল কন্যা জন্মালে দেশ স্বাধীন হবে, কন্যা জন্মালো যে মূহূর্তে, তার কিছুক্ষণ আগেই পাক বাহিনী সারেন্ডার করেছে, যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে জয়ার বাবা ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়ির উঠোনে পা দিয়েছিল, জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে সারা বাড়ি কাঁপিয়ে তুলেছিল, কন্যার নাম রেখেছিল ‘বিজয়া’, বিজয়া থেকে ডাকনাম হলো ‘জয়া’, বাবা বলেছিল “বাংলাদেশের বিজয় লগ্নে আমার কন্যার জন্ম, ও যেন জয়ের প্রতীক হয়েই বেঁচে থাকে অনন্তকাল”।
জয়ার মা মারা গেছেন জয়ার নয় বছর বয়সে, বাবা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে, জয়া তখন ওর স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই কাটাচ্ছিল মরুভূমির দেশ বাহরাইনে, প্রতি বছর দেশে যেত, বাবার সাথে মাসখানেক কাটিয়ে আবার ফিরে আসতো। এখনও যায়, তবে প্রতি বছর যাওয়া হয়না। এখন যা অবস্থা, মনে তো হচ্ছে বাংলাদেশে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে থাকার বদলে বাহরাইনে স্বাভাবিক পোশাকে চলার মধ্যেই অনেক আনন্দ। ভাবে ঠিকই, তারপরেও জন্মভূমির টানেই বাংলাদেশকে ভুলতে পারে না, বারে বারে পেছন ফিরে তাকায় আর কাঁদে, আমার বাংলাদেশ, আজ এ কী হাল হলো তোমার!
তিন
জয়ার দুই চোখ আটকে গেলো হোম পেজে, রাকিব ভাই একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেখানে উনি বলেছেন, মন্ত্রীসাহেব নাকি নিজেকে আইনের হাতে সঁপে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। উনাকে যখন কোর্ট প্রাঙ্গনে নেয়া হচ্ছিলো, তখন নাকি দুই আইনজীবী, যাদের দুজনের বাবা মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার ছিল, সেই দুই রাজাকারের দুই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা সাবেক মন্ত্রীর গায়ে থুতু ছুঁড়েছে, জুতা নিক্ষেপ করেছে। রাকিব ভাইয়ের মাথা গরম হয়ে গেছে, রাজাকারের পুত্রদের ঊদ্দেশ্যে চরম গালি দিয়েছে।
এই ভয়টাই তো জয়া পাচ্ছিলো, রাজাকাররা যদি সত্যি সত্যি মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করে! করলো তো অপমান, কত্তবড় সাহস রাজাকারের পুত্র দেয় মুক্তিযোদ্ধার গায়ে থুতু? জয়া দেখলো, রাকিব ভাইয়ের স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেছে রিটা দিদি।
লিখেছে, “ এখন অনুতপ্ত হয়ে লাভ কি, সেই রাজাকারের পোলারে ঘাড় ধরে টেনে এনে ওকে দিয়ে থুতু চাটাইতে পারলে বাঙ্গালী বাঘের বাচ্চা”।
এই তো, জয়া এই তো চেয়েছিল, এখন দেখা যাবে মাদারীর খেল, একটু পরেই মারজানা ফেরদৌস রুবা, নুরুন্নাহার শিরীন আপা, লুৎফুন ভুঁইয়া হেনা, বন্যা খান কমেন্ট করবেই করবে। জয়ার খুব ভালো লাগে এই বন্ধুদের কমেন্ট পড়তে। ঐ তো রাকিব ভাই ফিরতি লিখেছে, “ দিদিভাই, আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত, আগে বুঝিনি, সবার সাথে সাথে আমিও মন্ত্রী সাহেবের ঊদ্দেশ্যে ধর্ম অবমাননা করার জন্য খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছিলাম, তাই বলে আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের গায়ে থুতু ছুঁড়বে রাজাকারের পোলা, আমরা কী মইরা গেছি? মুক্তিযোদ্ধার অপমান তো সইবো না”।
আর সাত দিন পরেই জয়ার জন্মদিন, ষোলোই ডিসেম্বার, বাংলাদেশের বিজয় দিবস, জয়ার জন্মদিবস, পুরোপুরি ৪৩ বছর পেরিয়ে গেছে বাংলাদেশ এবং জয়ার জন্ম, জয়া তার পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে কত আদর সমাদর পায়, অথচ আজও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধারা নিজের দেশের মানুষের কাছে এভাবে লাঞ্ছিত হয়? জয়া শুনেছে মন্ত্রী সাহেব (সাবেক) নিজের জন্য কোন আইনজীবী গ্রহণ করেননি, অথচ ধর্ম রক্ষা করার দাবী নিয়ে উনার বিপক্ষে ১৬৭ জন আইনজীবী দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের সকলের এক কথা, এই নাস্তিকের পক্ষে কেউ দাঁড়াবেনা, সকলেই চায় এই নাস্তিকের ফাঁসী হোক।
জয়া লেখার টেবিলে গিয়ে বসলো, ওর এক বন্ধুর বাবাকে একটা চিঠি লিখবে। বন্ধুর বাবা জয়ার চোখে দেখা সবচেয়ে বড় আলেম, উনার পাশে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া যায়। পেশায় উনিও ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবী, জয়া জানে, জয়ার চিঠি পড়ে চাচা খুশী হবেন, উনি বুঝবেন জয়া উনার কাছে কী চাইছে।
শ্রদ্ধেয় চাচা,
আমার সালাম নিবেন। আপনার তো মনে আছে, বিজয় দিবসের আরেক নাম জয়ার জন্মদিবস। আগামী বিজয় দিবসে আমার বয়স হবে ৪৩, কি বিশ্বাস হচ্ছেনা? বাংলাদেশের বিজয় এসেছিল ’৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বার, কত বছর হলো? ৪৩ বছর হলো তো? আসলে আপনারা সকলেই ’৭১ কে ভুলে যেতে বসেছেন, ৭ই মার্চ, ২৬ শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বার এবং ২১শে ফেব্রুয়ারী, সবই ভুলে যেতে বসেছেন। আজ এমনই অবস্থা হয়েছে দেশের যে, ’৭১ এর রাজাকার শিরোমণিকে চেয়ারে বসিয়ে যথাযথ আরাম দিয়ে চার পুলিশ চেয়ার কাঁধে আদালতে পৌঁছাতো, এরপরেও রাজাকার কাশি দিলে পুলিশ পিতলের চিবরদানি রাজাকারের মুখের সামনে ধরতো, হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতো, বিচারক বিচারের রায় পিছিয়ে দিত, একসময় রাজাকার সম্রাটকে ৯০ বছরের আরামদন্ড দিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভি ভি আই পি রুমে রেখে দুই বছর আরাম দেয়া হলো। রাজাকারের প্রেশার বাড়ে, ডাক্তারদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়, এরপর আরও কত কিছুই হলো, শেষ পর্যন্ত রাজাকারের চাহিদা অনুযায়ী তার মরণের পর তার লাশ বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদে নেয়া হলো। কেন এত সম্মান দেয়া হলো তাকে? সে কী করেছিল? সে ’৭১ সালে ইসলাম ধর্ম রক্ষার নাম করে পাকিস্তানী সেনাদের সাহায্য করেছিল নিজ দেশের অসংখ্য মুসলিম ভাইদের হত্যা করতে, অসংখ্য মুসলিম মা-বোনদের ধর্ষণ করতে, সে নিজেও কত অমুসলিমদেরকে জোর পূর্ব্বক ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করেছিল, কত অমুসলিম নারীকে ধর্ষণ করেছিল। তেমন একজন রাজাকার শিরোমণির পক্ষে আইনী লড়াই করতে নেমেছিল শ’খানেক আইনজীবী, আর আজ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে দাঁড়ানোর মত কোন আইনজীবী নাকি নেই, সকলেই নাকি ধর্ম অবমাননার ভয়ে অস্থির।
চাচা, আইনজীবী হয়ে যদি ধর্মের দোহাই দিয়ে বিচার আচার করেন, তাহলে চোর, ডাকাত, খুনীদের পক্ষে মামলা লড়েন কোন যুক্তিতে? আমাদের আলোচ্য মুক্তিযোদ্ধা আসামী তো খুন করেননি, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ভাঙ্গেননি, উনি খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়েও ধর্মকে অবমাননা করে কিছু বলেননি। তারপরেও স্বীকার করছি, উনি অন্যায় করেছেন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। যদিও বাংলাদেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের জানমাল, মান-সম্ভ্রম, কুমারীর ইজ্জত, মন্দির, দেব-দেবীর মূর্তি প্রতিদিন ভাংচুর হচ্ছে, চরম ক্ষতি হচ্ছে, কারা করছে? বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে থেকেই নির্বাচিত ধার্মিকেরা। কই, তখন তো আপনাদের কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগেনা?
চাচা, বীর মুক্তিযোদ্ধার অপমানে অন্য কোন মুক্তিযোদ্ধা অপমানিত হয়েছে কিনা জানা নেই, কিন্তু ফেসবুকে কিছু মানুষ কিন্তু খুব অপমানিত বোধ করেছে। তাদের একজন রীটা রায়। আমার এই বন্ধু লিখেছে,
“আইনের হাতে আত্মসমর্পণকারী, '৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী সাহেবের গায়ে কোন এক আইনজীবী থুতু ছুঁড়েছে, আরেকজন জুতা ছুঁড়েছে, ( এতে অবশ্য আইন অবমাননা হয়নি!! বাংলাদেশের আইন বলে কথা), এটা আমাদের জন্য লজ্জার, অপমানের। অথচ আমরা অপমানিত হচ্ছি না।
"মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করি" শ্লোগানধারীদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার এহেন অপমানে উল্লসিত হয়েছে, এমনকি 'মুক্তিযোদ্ধা'দের মধ্যেও কেউ কেউ উল্লসিত হয়েছেন, কারণ তাদের কাছে লতিফ সিদ্দিকীর 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' পরিচয়ের চেয়েও অনেক বড় পরিচয় 'ধর্ম অবমাননাকারী' হিসেবে। ধর্ম অবমাননার ফলস্বরূপ লতিফ সিদ্দিকী সাহেব অলরেডি সাজা পেয়েছেন, উনার মন্ত্রীত্ব বাতিল করা হয়েছে, প্রাণপ্রিয় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এরপর উনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়েছে।
উনি সবই মেনে নিয়েছেন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন, তারপরেও উনার গায়ে রাজাকারের পোলার থুতু আর জুতা ছুঁড়ে দেওয়াতে কতিপয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাস দেখে আমাদের ডাবল অপমানিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমরা তা হচ্ছি না, আমরা দাবী করছি যে "মুক্তিযুদ্ধ করেছে বলেই কি সে যাহা খুশী তাহা বলবে, যাহা খুশী তাহা করবে, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করবে?"
না, মুক্তিযুদ্ধ করেছে বলেই কারো যাহা খুশী বলা, যাহা খুশী করার অধিকার নেই। যাহা খুশী বলার জন্য লতিফ সিদ্দিকী সাহেবের সকল রকমের রাষ্ট্রীয় তকমা বাতিল করা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, উনিও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আত্ম সমর্পণ করেছেন, এখানেই একজন সত্যিকারের 'মুক্তিযোদ্ধা'র সাথে তথাকথিত চেতনাধারীদের পার্থক্য। আমি মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে ভোট দিলাম।
কারণ আমি প্রকাশ্যে সর্বপ্রথম মানুষ, এরপর জন্মসূত্রে বাঙ্গালী, তারপর মনে মনে হিন্দু ( ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত বোধ)। আমার কাছে প্রথমে মানবতা, পরে আমার বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সবশেষে মানবতা, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর সাথে কোন আপোষ নেই।
চাচা, জানেন, সেদিন ফেসবুকে সোহেল রানা নামের এক ছেলে আমাকে নোংরা ভাষায় কমেন্ট করেছে। কেন জানেন? আমি আলোচ্য মুক্তিযোদ্ধা সাহেবের পক্ষে তিন লাইনের একটি স্ট্যাটাস লিখেছিলাম। সেই ছেলে আমাকে গালি দেয়াতে আমার প্রথমে খারাপ লেগেছিল। এরপর ওকে আমি ইনবক্সে পালটা মেসেজ পাঠিয়েছি। শুরু করেছি ‘তুই’ সম্বোধণ করে, ও হয়তো অনলাইনে ছিল, সাথে সাথে উত্তর দিয়েছে। আমি আবার লিখেছি, সে ফিরে লিখেছে, তিন বাক্য বলার পরেই বুঝেছি এই ছেলে বোকার বেহদ্দ, ওকে চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো বলেছি, হুমকী ধামকী দিয়েছি, সে ভয় পেয়ে গেছে। নিজে থেকেই আমাকে ‘আন্টি’ ডাকতে
শুরু করেছে, বলেছে ওর আম্মা ছাড়া আর কেউ এভাবে বকেনি।
আমার মায়া লাগে, বললাম, তুই আমার সন্তানের বয়সী বলেই তোর সাথে এত কথা বলছি, নাহলে তোকে অনেক আগেই ব্লক করে দিতাম। ওর ওয়ালে কভার পিকচারে ছবি দিয়েছে, রক্ত দিয়ে লেখা আরবীতে কিছু একটা’। বলেছে ওর ব্যবসা ভালো যাচ্ছেনা তাই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল। বার বার মাফ চাইছিল। ওকে কিছু টিপস বাতলে দিলাম কী করে ব্যবসাকে কিছুটা দাঁড় করানো যায়, আমি আবার এসব খুব ভালো বুঝি।
হঠাৎ করেই সোহেল রানা প্রশ্ন করলো, “আন্টি, আমাদের মুসলমানদের এত সমস্যা কেন, এত যুদ্ধ কেন, কই অন্য কোন দেশের মানুষ ত এত অশান্তিতে নাই আমাদের মত, আপনাদের ইন্ডিয়াতেও হিন্দুরা এত অশান্তিতে নাই, আমার অনেক মন খারাপ লাগে”।
ওকে বললাম, সোহেল তোমার বয়স মাত্র ২৩ বছর, একেবারে বাচ্চা এক ছেলে, সারা জীবন সামনে পড়ে আছে, এখন তোমার লেখাপড়া করার কথা, খেলাধূলা, আনন্দ ফূর্তি করার কথা, নাটক, সিনেমা দেখবে, গান শুনবে তা না করে তুমি কী করছো, কে কোথায় ইসলামকে অবমাননা করে ফেলে কিনা, সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছো, তোমার ওয়ালের কভার পিকচারে তোমার মায়ের ছবি দিতে পারতে, নাহলে আব্বার ছবি, নাহলে কোন সুন্দর জায়গার ছবি, তা না দিয়ে তুমি কী ছবি দিয়েছো, রক্তে লেখা আরবী ভাষায় কিছু কথা যার মানে হয়তো তুমিও জানোনা। তুমি নও শুধু, তোমার বয়সী, এর চেয়েও কম বয়সীদের জীবনের স্বাভাবিক চলাফেরার গতিকে রুদ্ধ করে, বাঁচার কথা না বলে তোমাদেরকে শেখানো হচ্ছে মরে গেলে কী কী পাবে?
একটা কথা বলি শোন, আমি কিন্তু আল্লাহ, ভগবান, গড সব এক বলেই মানি। আমি বিশ্বাস করি, সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে মানুষ বানিয়েছেন আগে, এরপর আমাদের জন্য দেশ নির্বাচন করেছেন, এরপর আমাদেরকে মুসলমান বা হিন্দু বা বৌদ্ধ, খৃসটান পরিবারে পাঠিয়ষতান। এভাবেই আমরা আগে মানুষ, পরে যার যার দেশ, তারপরে যার যার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে জন্মেছি।
-তাই তো!
-কিন্তু অতি ধার্মিকরা আল্লাহ বা ভগবানের নিয়মকে অগ্রাহ্য করে, তুমি যেহেতু মুসলমানদের অশান্তির কারণ জানতে চেয়েছো তাই মুসলমানের কথা বলছি, আসলে এই কথা সবার জন্যই প্রযোজ্য। মুসলমান সবার আগে আল্লাহর দেয়া তিন নাম্বার চয়েস দিয়ে জীবন শুরু করে, তারা ভাবে তারা আগে মুসলমান, এইজন্যই হয়তো আল্লাহ নিজেই এত নারাজ হন, পৃথিবীতে মুসলমান দেশগুলোতেই এত অশান্তি হওয়ার কারণ এটাই, তারা কেউ আল্লাহর সিরিয়াল মানেনা।
-আন্টি আপনার কথা শুনে আমার চোখে পানি আসছে।
-
তোমাকে সৌদি আরবে নিয়ে গেলেও যদি তুমি ভাবতে পারো যে তুমি আগে মানুষ, পরে বাংলাদেশী, এরপরে মুসলমান, তখনই আল্লাহ তোমার সকল নিয়ত কবুল করবেন, এর আগে না, কারণ এটা আল্লাহর ইচ্ছেতেই হয়েছে। তোমাকে দুই হাত, দুই পা দিয়ে পাঠিয়েছেন কাজ কর্ম করে খেটে খাওয়ার জন্য, ধর্ম কর্ম করার বয়স তো দেরী আছে। সকল কাজ বাদ দিয়ে শুধুই দর্ম করলে হবে? উনি তো মানুষকে পাঠান পৃথিবীটাকে সুন্দর করে রাখার জন্য, মুসলমান জনগণ ভাবে উলটো, তারা ভাবে কত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে বেহেশতে যাওয়া যায়, বেহেশতে যাওয়ার লোভে পবিত্র ইসলামের নামে কত ছেলে সুইসাইড বম্ব বেঁধে আত্মাহুতি দেয়
ওরা কী বেহেশতে যায় ভেবেছো, ওরা দোজখেও যেতে পারেনা, কারণ ওরা আল্লাহর নিয়তকে অবহেলা করেছে, ওরা পবিত্র ইসলামকে অপমান করেছে, আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন কি বোমা বেঁধে মরে যাওয়ার জন্য?
-আন্টি গো, আমি আপনার ছেলে হইতে চাই, আপনারে অনেক খারাপ কথা কইছি, আমারে মাফ দেন আন্টি, আইজ আমার মনে হইতাছে আপনার দেখা পাইছি আল্লাহর ইশারাতেই। আমি আমার পচা কম্নট এখনই মুছে দিতেছি, আর কালকেই দেখবেন আমার ওয়ালে আমার মায়ের ছবি। আপনার কথামত আমি ব্যবসার যত্ন করবো, আপনি আমারে মাফ করেন, আমার পাশে থাকেন আন্টি।
চাচা, পরের দিনই দেখি সোহেল রানা তার ওয়ালে অপরিচিত আরবী শব্দের ছবি বদলে নিজের মায়ের সরলমতি চেহারার ছবি পোস্ট করেছে।
চাচা, দেখলেন তো, আমি হারিনি, সোহেল রানাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছি, ও বেঁচে গেলো, এখন ও বড় হবে। আপনাকে এতকিছু কেন লিখলাম, বলেন তো! সোহেল রানার সাথে কথা বলার পরদিনই যেমন ওর পরিবর্তন দেখেছি, আপনার মাঝেও প্রত্যাশিত পরিবর্তন দেখতে চাই ( বুঝতে পারেননি চাচা, বীর মুক্তিযোদ্ধার পাশে দাঁড়াবেন, নাহলে বিবেকের কাছে কি জবাব দিবেন?) এবং তা আগামী বিজয় দিবসের আগে, জয়ার জন্ম দিবসের আগে। এটাই হবে জয়ার বিজয়!