নিশি কুটুম

রাত (মে ২০১৪)

রীতা রায় মিঠু
  • ১৬
  • ১৭
গুঞ্জন ঘুমিয়ে পড়েছে, মশারীর একপাশের অল্প জায়গা বাদ রেখে বাকী চারপাশ ভাল করে গুঁজে দিলেন নন্দিতা, মশারীর বাইরে বের হওয়ার আগে আরেকবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন, নাহ! কোন মশা উড়তে দেখা যাচ্ছেনা, বিছানা থেকে নামবার আগমুহূর্তে মশারীর য়ালগা অংশটুকুতে কাঁধের আঁচল দিইয়ে হাওয়া দিতে লাগলেন যেন মশারীর বাইরে অপেক্ষমান মশারা মশারীর ভেতর ঢুকার কোন সুযোগ না পায়। খাট থেকে নেমে নন্দিতা গায়ের আঁচল যথাস্থানে রাখতে রাখতেই সুইচবোর্ডটার কাছে গেলেন। আরেকবার ঘুমন্ত গুঞ্জনের দিকে তাকালেন, মেয়েটা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে, ওর পাশেই অঘোরে ঘুমুচ্ছে মলয়, নন্দিতার ছেলে। মলয় আজ কিছুই খায়নি, শরীরটা বোধ হয় ভালো নেই, আজই সকালে মিষ্টি এসেছে, কত বছর বাদে এলো মেয়েটা, মিষ্টির সাথেও মলয়ের কথা হয়নি। কাল সকালে কথা বলবে বলে শুয়ে পড়েছে।
ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, গত বছর নন্দিতার বড় জা’,মানে মিষ্টির মা হঠাৎ করেই মারা গেলেন। বড়জা নন্দিতাকে খুব ভালোবাসতেন, বড়দি বাংলাদেশে থাকলেও নন্দিতার কাছে মনে হতো, বড়দি বুঝি আশেপাশেই আছেন। মিষ্টি আজই এসেছে, একেবারে কোন সংবাদ না দিইয়ে। মিষ্টিটাকে দেখেই নন্দিতার বুকের ভেতর হু হু করে উঠেছে, কিন্তু মেয়ের সামনে নিজকে সামলে নিয়েছেন। সুইচ বোর্ডে হাত রাখলেন, ঘরের উজ্জ্বল আলোটা নিভিয়ে দিতেই সারাঘর নিকষ কালো হয়ে গেলো, এত অন্ধকার যে প্রথম ধাক্কায় কিছুই নজরে আসেনা, এই রকম নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে বুকে একধরণের ধাক্কা লাগে, নন্দিতার বুকটাও ধ্বক করে উঠলো, হাতের নাগালেই ছিল সুইচবোর্ড, আরেক সুইচে টিপ দিতেই হালকা নীল বাতি জ্বলে উঠলো, ধীরে ধীরে অন্ধকারও আবছা হয়ে এলো, মশারীর ভেতরে গুঞ্জন এখনও কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে, ঘুমের মধ্যেই অভ্যাসবশতঃ মলয় তার ডানহাত দিইয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছে। ওদের ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিলেন।
বারান্দার বাতিটা এখনও জ্বলছে, দরজার ফাঁক দিইয়ে মিষ্টির শাড়ীর আঁচল দেখা যাচ্ছে। নিঃশব্দ পায়ে নন্দিতা বারান্দায় এলেন, ঘরের দিকে পিঠ দিইয়ে বসে আছে মেয়েটা, একরাশ চুল সারা পিঠময় ছড়িয়ে আছে, মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে, মিষ্টির মাথার চুলগুলো তির তির করে উড়ছে, কি সুন্দর একরাশ চুল, রেশমের মত নরম, নন্দিতা এগিয়ে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই মিষ্টি নন্দিতার হাত জাপটে ধরে বলল, কাকীমা, তুমি এখনও ঘুমুওনি?
নন্দিতা বললেন, অন্যদিন এ সময় শুয়ে পড়ি।
-এত সকাল সকাল শুয়ে পড়ো কেন?
-কি করবো, গুঞ্জন ঘুমালেই আমার ছুটি, তোর কাকু তো শুয়ে পড়ে সেই সন্ধ্যারাতেই, মলয়ও ঘুমিয়ে যায়, আমার আর কিছু করার থাকেনা।

-কাকীমা, সম্পার কাছে যাও না কতদিন হলো?
-আসছে মাঘে চার বছর হবে।
- গৌতমটা চলে গিয়ে সম্পার জীবনটা খুব কঠিন হয়ে গেলো
-তোদের দু’বোনেরই ভাগ্য কঠিন, তুই-ইবা কোথা দিইয়ে ভাল আছিস শুনি। একজনের স্বামী থেকেও নেই, আরেকজনের কপালে শাঁখা সিঁদুরই নেই। হ্যাঁরে, মিষ্টি, অমিতের সাথে তোর কথা হয়?
-হবেনা কেন কাকীমা, এই তো এখানে আসবার দুদিন আগেই তো ফোনে কথা হলো। তোমাদের এখানে বেড়াতে আসার কথা বললাম। অমিত তোমাকে আর কাকুকে প্রণাম জানিয়েছে।
-তুই কি অমিতের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা কিছু ভাবছিস?
-আপাততঃ ভাবছিনা, আমার ‘পাহাড়চূড়া’কে দাঁড় করাচ্ছি, অনেক সময় দিতে হয়।
-হ্যাঁরে মিষ্টি, পাহাড়চূড়ায় কতজন বুড়োবুড়ি আছেরে?
-এই মুহূর্তে সব মিলিয়ে ২৮ জন আছেন।
-আমার খুব ইচ্ছে করে, একবার যাই, দেখে আসি পাহাড়চূড়া।
-হুম! খুব সহজ এবং ছোট্ট ইচ্ছে, কিন্তু পূরণ করা কঠিন। কাকীমাগো, তোমার ভাগ্য দড়ি দিইয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা, কাকু শয্যাশায়ী, তুমি কোথাও গেলে কাকুকে দেখবে কে, মলয়কে ভাত রেঁধে দিবে কে, গুঞ্জন কার কাছে ঘুমাবে!
-বাদ দে, এবার বল, ভুলেই ত গেছিলি, তা এত বছর পরে আমাদের কথা মনে পড়লো কি করে?
-হা হা হা! এত বছর মনের দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম, মা মারা যাওয়ার পর মনের দরজা একটুখানি ফাঁক করতেই তোমাদের কথা মনে পড়ে গেলো, চলে এলাম। কত বছর পর এলাম বলো তো, পাক্কা কুড়ি বছর পর এলাম।
-কুড়ি বছর আমাদের না দেখে থাকতে পারলি?
-পেরেছি তো, এখন আর পারছিলামনা, তাই চলে এলাম। আচ্ছা কাকীমা, আশেপাশেই কোথাও কেউ একজন কাঁদছে, কে কাঁদছে গো?
-বুধিয়ার বউটা কাঁদছে, বুধিয়ার কথা মনে আছে তোর? দাস বাবুর ছেলেকে ডাকতো, চন্দন হ্যায়?
-হা হা হা! খুব মনে আছে, চন্দনের বোনটা ঘর থেকেই আওয়াজ দিত, ‘নকক্ষে’ বলে। হ্যাঁ গো কাকীমা, নিনি’র খবর কি? মেয়েটা কি বিয়ে করেছে শেষ পর্যন্ত?
-অনেক কেচ্ছা আছে, শুনে ভালো লাগবেনা তোর।
-আচ্ছা, আগে বুধিয়ার কথাই বলো।
-ঐ তো বললাম, বুধিয়ার বৌ কাঁদছে, গত বছর ওদের আট বছরের মেয়েটাকে বাঘে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে সারাক্ষণ বুধিয়ার বউ কাঁদে।
-হোয়াট? বাঘে নিয়ে গেছে?
-হ্যাঁ, বাঘে নিয়ে গেছে।
- কাকীমা, এখানে বাঘ আসে নাকি? হাতী আসতো, তাই বলে বাঘ?
-অ্যাই, আস্তে কথা বল, হাতী বলিসনা, বল, মহাকাল।
-ওহো, তোমরা তো আবার হাতীকে হাতী বলোনা, ঠিক আছে, মহাকালই বললাম, এখন বলো, মহাকালের সাথে বাঘমামাও কীভাবে আসতে শুরু করলো? তোমাদের এই হাসিমারা বাগানের অ্যাডমিনিস্ট্রেটাররা কি নাকে তেল দিইয়ে ঘুমায়? আবাসিক এলাকায় বাঘ ঢুকে মানুষ নিয়ে যায়?
-বসিয়েছে খাঁচা
-দু একটা বাঘ ধরা পড়েছে?
-নাহ! এখনও ধরা পড়েনি, বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে ছাগলে পোষায় না। বাঘেরা চালাক আছে।
-কাকীমা, সত্যি সত্যি একটা বাচ্চা মেয়েকে বাঘে নিয়ে গেল? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আহারে! চা-বাগানের জীবন কত কঠিন! এর আগেরবার শুনে গেলাম, মহাকাল তোমাদের লাইনে এসে কত বাড়ীঘর পা দিইয়ে মাড়িয়ে দিইয়ে গেল, দুজন কুলীকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে আছাড় মারলো।
-বুধিয়ার মেয়েটা সেদিন ওর চাচীর ঘরে তরকারী আনতে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বুধিয়ার বৌ কেরোসিনের বাতিটা নিয়ে সাথে বেরও হয়েছে, হিসি পেয়েছে’ বলে মেয়েটা একটু ঝোপের দিকে গিয়ে বসতেই বাতাসের ঝাপটায় বাতিটা নিভে গেছে। বুধিয়ার বৌ বাতিটা ফের জ্বালানোর জন্য ঘরে ঢুকেছে কি ঢুকেনি, মেয়ে চীৎকার করে উঠেছে। বৌ দৌড়ে বেরিয়ে শুনে চীৎকারের আওয়াজ ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। বৌ তো গলা ফাটিয়ে চীৎকার, চীৎকারের আওয়াজে চারদিক থেকে লাইনের লোকজন বেরিয়ে এসেছে, লাঠিসোটা নিয়ে চা-বাগানের দিকে ছুটে গেছে। কাছেই মেয়েটাকে পাওয়া গেছে, ঘাড় ভেঙ্গে ফেলে রেখে গেছে, তাজা মেয়ে, ঘাড় মটকানো। ভাবলেই শরীর অস্থির করে আমার। এইজন্যই সন্ধ্যার আগেই গুঞ্জনকে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলি।
-কাকীমা, মলয় কি বিয়ে করবেনা বলে ঠিক করেছে?
-জানিনা, এই নিয়ে কোন কথা বলেনা। সকালে কাজে যায়, সন্ধ্যার পর বাড়ী ফিরে মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে, তারপর খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে।
-নেশা করে?
-কি জানি, বুঝতে পারিনা।
-গুঞ্জন মামনি ওর মায়ের কথা কিছু জিজ্ঞেস করেনা?
-খুব চাপা স্বভাবের হয়েছে তো, এমনিতে কিছু বলেনা, তবে প্রায়ই সন্ধ্যা হলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর বাবা বোধ হয় ওকে বুঝিয়েছে যে মা আকাশে তারা হয়ে আছে।
- গুঞ্জনের দিকে তাকালে খারাপ লাগে, বুঝতে পারিনা, এমন ফুলের মত ফুটফুটে মেয়েকে ফেলে রেখে ও গেলো কি করে! চলে যাওয়ার পর মেয়ের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি?
-মিষ্টি, ঘুমাবিনা?
-ঘুমাবো যখন ঘুম পাবে। বারান্দায় বসে থাকতে খারাপ লাগছেনা, কত কথাই যে মনে পড়ছে। অদিতিকে দেখা হলোনা, খুব সুন্দরী ছিল বোধ হয়, তাইনা গো!
-হুম, এই রূপই কাল হয়েছে, দুইটা সংসার ভেঙ্গে খান খান হয়েছে।
-ম্যানেজার সাহেবের বউ-বাচ্চাদের কোন খবর জানো?
-বাচ্চা-কাচ্চা ছিলনা, বৌ বেশীর ভাগ সময় বাপের বাড়ীতেই থাকতো, আমি দেখিনি বউ, মানুষের মুখে শুনেছি, বৌ নাকি দেখতে খুব বেশী সুন্দর ছিলনা, এদিক বিচারে আমাদের বাড়ীর ঠাইরেন তো একডাকে সেরা ছিল, কে জানতো রূপের তলায় এমন অন্ধকার ছিল। আমার পোড়াকপাল, মেয়েটাও শাখা সিঁদুর খুইয়ে বসে আছে, ছেলেটাও অপমানের বিষে কালো হয়ে আছে।
-থাক, কাকীমা, মন খারাপ করোনা, যার যার কর্মফল সে সে ভোগ করবে, আমরা শুধু বলি, যে যেখানে আছে, ভালো থাকুক।

- চা খাবি?
-নাহ! তোমার কষ্ট হবে। সারাদিনে তোমার কত খাটুনি হয়, বরং ঘুমাতে যাও।
-ঘুম কি আর হয়, এপাশ-ওপাশ করেই রাত পোহায়।
-ঐ বাড়ীর নিনি’র কথা কি যেন বলছিলে! বাগানের কম্পাউন্ডার বাবুর ছেলের সাথে ওর প্রেম ছিল তো, সেই ছেলে তো আবার গলায় ফাঁস লাগিয়ে সুইসাইড করেছিল।
-তোর মনে আছে এতকাল আগের কথা?
-মনে থাকবেনা কেন, আমি আর সম্পা রাত জেগে এইসব গল্পই তো করতাম!মনে আছে তোমার, কিছুসময় পর পর কাকু হাঁক দিত, কী রে! সারারাত শুধু পুটুর পুটুর করেই কাটিয়ে দিবি, ঘুমাবিনা? নিনি এখন কোথায় আছে গো!

-কোথায় আছে কেউ জানেনা, গত বছর বাপের সাথে রাগ করে বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে।
-কি সব কান্ড হয় এখানে, এত ছোট জায়গায় ঘটনা তো সব বড় বড়! আহারে! দাস কাকু তো ভীষণ ভালো মানুষ, এই মানুষের সাথে রাগ করা যায় নাকি!

-বাইরে থেকে আমরা মানুষের কতটুকুই বা জানি, এমনিতে তো দাস দাদা খুবই ভাল মানুষ, কিন্তু পুরুষের খাসলত, নারীসঙ্গ চাই, দাস বৌদি কোথাও বেড়াতে গেলে রাতের বেলা কাজের বৌটাকে ঘরে ডেকে নেয়। এই নিয়েই বাপ-মেয়েতে মন কষাকষি।

-ছি ছি! দাস কাকীমা কিছু বলেননা?
-কাকীমা কি বলবে, কাকীমা তো আর মিষ্টি, অদিতি, নিনিদের যুগের মেয়ে না, কাকীমা হলো আমার মত মূর্খ যুগের নারী, স্বামী যখন কাকীমাকে বেড়াতে যেতে বলে কাকীমা বেড়াতে যায়, স্বামী যখন ফিরতে বলে ফিরে আসে। কাকীমার কোন অভাব তো নেই, খাওয়া-পরা, শাড়ী-গয়না, সিঁথির সিঁদুর সবই জ্বলজ্বল করে, তাই অভিযোগও নেই।
-নিনি কোথায় গেলো কেউ জানেনা! সুইসাইড করেনি তো!
-খুব হয়েছে, এবার ঘুমাতে যা, নিনি’র জন্য ভাবতে হবেনা, নিনি ওর মামাতো ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে গেছে।





মিনিট দশেক আগেই নন্দিতা ভেতরবাড়ীতে চলে গেছেন, বাথরুম ঘুরে এসে শুয়ে পড়েছেন বোধ হয়। কাকীমা উঠে যাওয়ার সাথে সাথে মিষ্টি বারান্দার আলো নিভিয়ে দিল, বাইরে ভীষণ অন্ধকার, রাস্তায় কোন বাতি নেই, ফ্যাক্টরী লাইনে আলোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কুলী লাইনের এ পাশটা অন্ধকারে ডুবে থাকে। মিষ্টির কাকু এই কোয়ার্টারেই ৫০ বছর কাটিয়েছেন, কাকুর এক ছেলে মলয় এবং এক মেয়ে সম্পা। একটা মাত্র কন্যা রাইমনি’কে নিয়ে সম্পা থাকে বর্ধমান, ওর স্বামী গৌতম বছর তিনেক হলো গত হয়েছেন, ওদের দুটিতে ভীষণ মিল ছিল, হঠাৎ হার্ট অ্যাট্যাকে গৌতমটা চলে গিয়ে সুন্দর একটা জুটি ভেঙ্গে গেলো। গৌতম বেঁচে থাকতেই সম্পা ওখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতো, সেই চাকরীটাই এখনও করছে। মলয় এই বাগানে বড়বাবুর পোস্টে চাকরী করছে, ফ্যাক্টরী লেইনে বাসা পেয়েছিল, যায়নি। এ বাড়ীতে মা-বাবার সাথেই রয়ে গেছে। বিয়ের পর অদিতির সাথে চুটিয়ে দশ বছর সংসারও করেছে, বুঝতেই পারেনি কখন যে অদিতি বাগানের সুদর্শন ম্যানেজারের প্রেমে পড়ে গেছিল। এক সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখে বিছানা ফাঁকা, অদিতি নেই, সেই যে অদিতি হারিয়ে গেলো, আর ফিরে এলোনা। দেখতে দেখতে গুঞ্জন বড় হয়ে যাচ্ছে, সাত বছর পূর্ণ হয়েছে, ক্লাস টু’তে পড়ে, রোজ সকালে বাবার মোটর বাইকে চেপে স্কুলে যায়।

‘বিজলীবাবু’র পোস্ট থেকে রিটায়ার করার পর মিষ্টির কাকুর স্বাস্থ্য ভাঙ্গতে শুরু করে, এখন তো একেবারেই শয্যা নিয়েছেন। কাকীমা কাকুর যত্ন-আত্তি করেন, রান্না-বান্না করেন, একটা মাত্র নাতনিকে মায়ের আদরে বড় করার চেষ্টা করে যান। কাকীমার স্বাস্থ্যই টিকবে কতদিন কে জানে! এই বাড়ীটা ছিল মিষ্টির কাছে এক স্বপ্নবাড়ীর মত ব্যাপার। সুখ আর শান্তি চাতদিকে ছড়ানো ছিল। আজ মনে হচ্ছে স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি, স্বপ্নগুলো ভেঙ্গেও গেছে।
পাঁচ বছর হলো মিষ্টি আমেরিকা থেকে পাকাপাকিভাবে চলে এসেছে, অমিতের সাথে অভিমান করেই এই চলে আসা। প্রায় পনেরো বছরের সংসার ছিল, বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। দুজনের মধ্যে মানসিক ব্যবধান অনেক বেড়ে গিয়েছিল, আমেরিকা থেকে চলে এসে বাবার বাড়ীতেই উঠে প্রথমে। একমাত্র সন্তানের প্রস্তাবে সাড়া দিইয়ে মিষ্টির বাবা বাড়ীটা মিষ্টিকে দানপত্র করে দেন। মিষ্টি বাবার বাড়ীতেই ‘পাহাড়চূড়া’ নামে বৃদ্ধদের জন্য আনন্দআশ্রম বানিয়েছে, বৃদ্ধাশ্রম নয়, আনন্দাশ্রম, মিষ্টির নিজস্ব ভাবনা, নিজস্ব স্বপ্ন দিইয়ে তৈরী প্রতিষ্ঠান ‘পাহাড়চূড়া’। গত পাঁচ বছরে ‘পাহাড়চূড়া’ বেশ দাঁড়িয়ে গেছে। সম্পার সাথে মিষ্টির নিয়মিত যোগাযোগ হয়, এখানকার সংবাদ সম্পা যতটুকু জানে, ততটুকু মিষ্টিও জানে। কাজ করতে করতে মিষ্টি হাঁফিয়ে উঠছিলো যেন, সম্পার সাথে কথা বলে, প্ল্যান করে তবেই আজ এখানে এসেছে, কাকু বা কাকীমা জানেনা, সম্পাও আগামীকাল সকালে এসে পৌঁছাচ্ছে। সকালে ঘুম ভেঙ্গেই অবাক হয়ে যাবে সব। ভেতরবাড়ী থেকে কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা, তার মানে কাকু, কাকীমা, মলয়, গুঞ্জন সবাই ঘুমুচ্ছে, ঘুম নেই মিষ্টির চোখে।

চা-বাগানে সন্ধ্যা হতে না হতেই চারদিক শান্ত হয়ে যায়, বড্ড তাড়াহুড়ো করে রাত নেমে আসে। ঘড়িতে পৌনে বারোটা বাজে, মিষ্টির জন্য এ রাত কোন রাতই নয়, চিটাগাংয়ের বাড়ীতে মাঝে মাঝে এসময়ে ও রাতের খাবার খায়, মা মারা যাওয়ার পর এই সমস্যা হয়েছে, যার যার সুবিধেমত জীবন-যাপন করে। এখন বুধিয়ার বউয়ের কান্না শোনা যাচ্ছেনা, ছোট মেয়েটার জন্য কাঁদতে কাঁদতে বোধ হয় বেচারার চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আহারে! সন্তান জন্ম দেয়া কত গৌরবের, সেই গৌরবের ধন বাঘের পেটে চলে গেছে, ভাবা যায় না! মিষ্টির দুঃখ আর বুধিয়ার বউয়ের দুঃখে কি কোন তফাৎ আছে? অবশ্যই তফাৎ আছে, মিষ্টি তো বুঝবেইনা সন্তান কি জিনিস, ওর সন্তান হয়নি আর বুধিয়ার বউয়ের সন্তান জন্মেও সন্তান থাকেনি। মিষ্টির বুকে চাপ বাড়ছে, অদিতিরও তো একটা বাবু হয়েছিল, কি ফুটফুটে দেখতে হয়েছে গুঞ্জন, কই অদিতি তো গুঞ্জনের দিকে তাকালোনা, চলে গেলো প্রেমিকের কাছে। মিষ্টির গর্ভে কোন সন্তান জন্মালোনা, তাই কি অমিত ওকে ঠকিয়েছে! কিন্তু সন্তান না জন্মানোর জন্য তো মিষ্টি দায়ী না, তবুও অমিত তার ল্যাবের সহকর্মীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লো!
আচ্ছা, দাস কাকীমার তো ছেলেমেয়ে আছে, দাস কাকুও খুব ভালো মানুষ, তারপরেও কেন দাস কাকু মাঝে মাঝেই কাকীমাকে আত্মীয় বাড়ী বেড়াতে পাঠায়! ঘরে নিনি’র মত একটা বড় মেয়ে থাকার পরেও কাকু পার্বতীয়াকে নিয়ে ঘরে খিল আঁটে! উফ! বাইরেটা কি নিকষ কালো, কোথাও একটু আলোর চিহ্নও নেই। আজ কি অমাবস্যা নাকি! কে জানে, পূর্ণিমা যে নয়, সেটা মিষ্টি ভালোই জানে। পূর্ণিমা হলে ভীষণ ভালো হতো। পূর্ণিমার রাতে চা-বাগানের চারদিক রহস্যময় আলোয় ভরে যায়। চাঁদের আলো তো থাকেই, তার উপর কোথা থেকে যেন আরও আলোর আভা ছুটে আসে, আলোর বন্যায় ভেসে যায় হাসিমারা চা-বাগান! মাথা আউলা করা সৌন্দর্য্য! অমিতকে নিয়ে যেবার এলো, পরদিনই ছিল পূর্ণিমা, মিষ্টি, সম্পা আর অমিত সারারাত এই বারান্দায় বসে আড্ডা দিয়েছিল। অমিত তখন মিষ্টিকে খুব ভালোবাসতো, তখনও ওরা আমেরিকা যায় নি, অমিত খুব একটা রোমান্টিক ছিল না, তবে মিষ্টিকে চোখে হারাতো।

আজ পূর্ণিমা নয়, অমাবস্যা কিনা জানা নেই। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে আছে। মিষ্টির বুকটার মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, সব হারাণো কষ্ট, ভীষণ জলতেষ্টা পেয়েছে। জলের কুঁজো রান্নাঘরে রাখা আছে, এক গ্লাস জল না হলেই নয়। আজ সারারাত এই বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিতে মন চাইছে, ইস! এক কাপ চা হলে কত ভাল হতো, কাকীমা তখন চায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিল, কাকীমাকে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে করেনি তাই চা খাবেনা বলে দিয়েছে। প্রায় কুড়ি বছর পর এখানে এলো, চা-পাতা, চিনি কোথায় রাখা আছে কে জানে! চা-বাগানের সব বাড়ীতে হীটার আছে, এই হীটারগুলো জ্বালাতে গেলে মিষ্টির ভয় লাগে, যদি কারেন্ট শক করে! কাল সম্পা আসুক, দুই বোনে একসাথে যত খুশী ততবার চা খাবে। এখন বরং জল খেয়ে আসা যাক। মিষ্টির চোখ দুটো বারবার বাইরের দিকে চলে যাচ্ছে, নাক বরাবর একটি বিন্দুতে গিয়ে থামছে, সেখানে দুটো আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। মিষ্টির একটু একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, আলোর বিন্দু দুটো স্থির, একটুও নড়ছেনা, কিসের আলো এটা! বারান্দার লাইট অফ করা আছে, লোহার জালি দেয়া গেটটাও বন্ধ, চা-বাগানের রাত, গভীর নিশুতি রাত, কুলী লাইনের রাস্তায় আলো জ্বলে না, আলোর বিন্দু দুটো এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। মিষ্টির শরীরের গন্ধ কী ঐ পর্যন্ত পৌঁছেছে?মিষ্টির গায়ের গন্ধ আর বুধিয়ার মেয়ের গায়ের গন্ধ এক হওয়ার কথা নয়, বুধিয়ার মেয়ের গায়ে ছিল তাজা রক্তের গন্ধ, আর মিষ্টির গা থেকে বের হওয়ার কথা ফরাসী সুবাস, একটু দূরের অন্ধকারে যিনি ঘাপটি মেরে বসে আছেন, ফরাসী সুবাসে উনি কী বিভ্রান্ত, এগিয়ে আসবে কিনা বুঝে উঠতে পারছেনা। মিষ্টির জলতেষ্টা কমে গেছে, এখন দৃষ্টি ঐ আলোর স্থির বিন্দু দুটোর উপর!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আখতারুজ্জামান সোহাগ দারুণ একটা গল্প পড়লাম। প্রথমে শুধু সংলাপ দিয়েই গল্প এগোচ্ছিল, শেষটায় কিছু বর্ণনা পেলাম। কাহিনীর ভিতরে ডুবে যাওয়ার জন্য যা যা দরকার সবই রযেছে। শুভকামনা লেখিকার জন্য।
সকাল রয় কিছু বানান গুলো ভুল না হলে দারুনএকটা সৃষ্টিকর্ম হতো
মিলন বনিক ছোট ছোট ঘটনাপ্রবাহগুলোকে অত্যন্দ চমৎকার নান্দনিকতায় ছোট ছোট বাক্যে ফুঠিয়ে তুলেছেন.....প্রতিবারের মতোই মুগ্ধ....
গুণটানা নৌকা তৃতীয় প্যারার পড়ে কেমন যেন পড়ার গতি হারিয়ে গেলো আবার বিজলীবাবু’র পোস্ট থেকে রিটায়ার থেকে গতি ফিরে পেলাম । সব মিলিয়ে চমৎকার গল্প ।
বশির আহমেদ বরাবরের মতই আপনার গল্প পঠককে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে । অনেক সুন্দর গল্প । দিদি তোমাকে শুভেচ্ছা ।
Gazi Nishad অনিন্দ্য গল্প। ভীষণ ভালোলাগা রেখে গেলাম।
রোদের ছায়া নানা রকম মানুষের জীবনের অন্ধকার দিক সাবলীল ভাষায় বলে গেলেন। আর শেষ দিকে নিশি কুটুমের জ্বলজ্বলে চোখ সব মিলে অনবদ্য একটি গল্প। অশেষ শুভকামনা।
আপেল মাহমুদ পাকা হাতের লেখা। শেষটায় কিছু শুন্যতা অনুভব করলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক ধন্যবাদ আপেল মাহমুদ ভাইয়া!
সেলিনা ইসলাম নিত্যদিনের টানাপোড়েনের পাশাপাশি অতীতের অনেক কথাই নির্ঘুম রাতের নিঝুমতাকে প্রাণ এনে দিয়েছে নন্দিতা আর মিষ্টি'র কথপোকথন। "তোমাদের এই হাসিমারা বাগানের অ্যাডমিনিস্ট্রেটাররা কি নাকে তেল দিইয়ে ঘুমায়?" মিষ্টি'র এই সরল উক্তি স্বাভাবিক একটা মানুষকে একটা জন্তু তুলে নিয়ে যায় অথচ আমাদের দেশে কারো কোন দ্বায়ভার নেই । চা বাগানের রহস্যময় গল্প বেশ দক্ষ হাতেই লেখা হয়েছে...ভাল লাগল। শুভকামনা রইল
তোমার মত সাহিত্য বোদ্ধার কাছ থেকে এমন গঠণমূলক মন্তব্য পেয়ে ভাল লাগছে।

১৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী