মানসী,
কেমন আছিস তোরা! চিঠি পেয়ে নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হবি যে এখানে আমি ভালো আছি। কিছুক্ষণ আগেই হোটেলে ফিরেছি, বাইরে কি ঠান্ডা, হাঁড়ে কাঁপন ধরানো ঠান্ডা। নিউজে দেখলাম, উত্তর আমেরিকাতেও একই অবস্থা। আমি যেখান থেকে তোকে লিখছি, সে স্থানটির নাম ‘কাঠমান্ডু’,নেপালের রাজধানী। কাঠমান্ডু শহরে স্নো নেই, কিন্তু শীতের কি দাপটরে। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। প্রায় কুড়ি বছর আগে জ্যোতি, পুটুসকে নিয়ে এসেছিলাম, তখন কিন্তু এত ঠান্ডা ছিলনা। আবহাওয়ায় কত পরিবর্তন এসেছে। জানিস, যে হোটেলটিতে উঠেছি, এটি আসলে কোন এক ধনীর গেস্ট হাউজ, এক বন্ধুর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এসেছি। ভালো কথা, আমি কাঠমান্ডু এসেছি গত পরশু, ঢাকা ফিরে যাব আগামী পরশু এই গেস্ট হাউজের লিভিং রুমে পুরণো আমলের ফায়ার প্লেস আছে, ইলেকট্রিক নয়, একেবারে কাঠের আগুন জ্বলে, সারাক্ষণই ধিকি ধিকি করে জ্বলছে, হোটেলের রুম পরিষ্কার করতে আসে যে নাক চাপা, গোলাপী বর্ণ মেয়েটি, ওর নাম মনীষা। মনীষার সাথে আমার খুব খাতির হয়েছে, ও নেপালী ভাষায় কথা বলে, আমি বাংলায় কথা বলি। কেউ কারো কথা বুঝিনা অথচ সবই বুঝি। হা হা হা! কি মজা, তাইনা! ওর কাছে শিখে নিয়েছি কীভাবে এই ফায়ারপ্লেসের আগুন উসকে দিতে হয়, কীভাবে আগুন ছাইচাপা দিতে হয়।
বাইরে থেকে ফিরেছি বলেছিনা? কোথা থেকে ফিরেছি জানিস! আট হাজার ফিট উঁচু পাহাড় থেকে ফিরে এসেছি, নাগরকোট পাহাড়, দুই ঘন্টা পাহাড়ের চূড়োয় কাটিয়ে এলাম, দাঁতে দাঁত লেগে খট খট করছিল। ফায়ারপ্লেসের আগুন উসকে দিতেই ঘর বেশ গরম হয়ে উঠেছে। মনীষা কফি মেকারে কফি ফুটিয়ে রেখে গেছে, দারুণ সুন্দর গন্ধ ছড়িয়েছে, লাল টুকটুকে কফি মাগে কফি ঢেলে ঘন দুধ আর এক চামচ চিনি মিশিয়ে নিয়ে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসেছি, আমার একটা লাল টুকটুকে থ্রো ছিল, তুই দিয়েছিলি, সেটি সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। লাল থ্রোটি সারা গায়ে পেঁচিয়ে নিয়েছি। আহা! এত আরাম লাগছে, মনে হচ্ছে স্বর্গীয় সুখ বোধ হয় এমনই হয়।
হা হা হা! এটুকু পড়েই নিশ্চয়ই বুঝে গেছিস, এই মুহূর্তে আমি খুব ভাল মুডে আছি। ওহো! বলতেই ভুলে গেছি, আইপডে গান ছেড়েছি, “ ভালোবেসে যদি সুখ নাহি, তবে কেন মিছে ভালোবাসা”! হ্যাঁরে, অনেকদিন পর আমার খুব ভাল লাগছে, আশপাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসকেও অনেক মূল্যবান মনে হচ্ছে, যেমন ধর, দেখতে পাচ্ছি একটি পিঁপড়ে পিলপিল করে এগিয়ে যাচ্ছে ফায়ার প্লেসের দিকে। বুঝতে পারছিনা ওর পাখা গজিয়েছে কিনা, নাহলে আগুনের দিকে যাচ্ছে কেন। দ্যাখ, কত ছোট ব্যাপার, এই মুহূর্তে এটি নিয়ে ভাবতেও ভাল লাগছে। ঠিক করেছি, পিঁপড়েটি আগুনে ঝাঁপ দেয়ার আগ মুহূর্তে ওকে চিমটি দিয়ে তুলে নিয়ে আসবো, এনে কিচেনের কাউন্টার টপে ছেড়ে দেবো, কয়েকটি চিনির দানা দেবো, চিনির দানা মুখে পেয়েই ও আবার বেঁচে থাকার আগ্রহ ফিরে পাবে। এই মুহূর্তে হয়তো ওর মনে অনেক দুঃখ আছে, পিঁপড়েটি ছেলে নাকি মেয়ে তা অবশ্য বুঝতে পারছিনা, সে যে লিঙ্গেরই হোক না কেন, হয়তো সঙ্গীর উপর অভিমান করে আগুনে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিল, চিনির দানা মুখে পেয়েই ও ভাবতে শুরু করবে আগুনে ঝাঁপ দিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, জীবন অনেক সুন্দর, পৃথিবী অনেক সুন্দর, ভালোবাসাময়। এক সঙ্গী যাবে, আরেক জনের সাথে পরিচয় হবে, পরিচয় থেকে ভাব বিনিময়, ভাব বিনিময় থেকে ভালোবাসা। এভাবেই তো সকলের ভালোবাসা জমে জমে পৃথিবীটা ভালোবাসাময় হয়েছে, জীবন ভালোবাসাময় হয়েছে, তাইনা? আমার কি মনে হয় জানিস, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীকে ভালোবাসবার জন্য কেউ না কেউ থাকে, খুব কাছে অথবা অনেক দূরে। এই পিঁপড়েটি কি জানে যে ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, ওকে বাঁচাবো বলে পণ করেছি। ওকে যদি আমি এই মুহূর্তের ভালোবাসাটুকু না বাসতাম, একটু পরেই ও আগুনের শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যেতো, কিন্তু ওর মৃত্যুর সময় হয়নি বলেই ও আমার নজরে এসেছে। এখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, পিঁপড়ে বাঁচাও প্রকল্প বাস্তবায়নে। একটু অপেক্ষা কর মানসী, এই কুট্টি পিঁপড়েমনিকে কিচেনের কাউন্টার টেবিলে ছেড়ে দিয়ে আসি।
ছেড়ে এলাম পিঁপড়েমনিকে, বেশ কিছু চিনি ছড়িয়ে দিয়ে এসেছি, ও খাবে, ওর সঙ্গী-সাথীর জন্য নিয়ে যাবে। এতক্ষণ যদিও দার্শনিকের মত কথা বলেছি, তবে কথা কিন্তু ভুল বলিনি, দার্শনিকরা তো ভুল কথা বলেওনা। অবশ্য আমরা প্রত্যেকেই তো যার যার সুবিধামত দার্শনিক হয়ে যাই। জানিস, আজ পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় আমার অনেক পছন্দের একজনের সাথে দেখা হয়ে গেল, ও-ও বেড়াতে এসেছে, টিনা, জাকির মামার মেয়ে। দেশে নয়, পাহাড়ের চূড়োতে উঠে ‘টিনার সাথে দেখা হলো, কত বছর পর। টিনা অনেক বড় হয়ে গেছে, একজনের বউ, আরেক জনের মা হয়ে গেছে, এক টিনাকে দেখেছিলাম ফ্রক পরা অবস্থায়, সেই টিনা আজ ত্রিভূজ হয়ে গেছে, ভালোবাসার ত্রিভূজ। টিনার চোখে মুখে সুখ উপচে পড়তে দেখে ভালো লেগেছে, মনে হয় ওর মায়ের মত সুখী হয়েছে।
খুব ভোরে গিয়েছিলাম নাগরকোট পাহাড়ে। হিমালয়ের চূড়া দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ৮,০০০ ফিট উঁচুতে ওঠাই সার হয়েছে, হিমালয়ের চূড়া মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছিল। দর্শনার্থীদের সাথে আমিও অপেক্ষা করছিলাম, বাড়ী ফেরার তাড়া তো নেই, আর অত উঁচুতে তেমন শীতও করেনা, কাজেই এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছিলাম। প্রায় ২০ বছর আগে পুটুস আর পুকুনকে নিয়ে আমি আর জ্যোতি এখানে এসেছিলাম। সেবার কিন্তু চট করেই হিমালয়ের চূড়ো দেখতে পেয়েছিলাম, মেঘের আড়াল ছিল না। একটা কথা মনে পড়ে গেলো, খুব হাসি পাচ্ছে, সেবার তো জীবনে প্রথমবার অত উঁচুতে উঠেছি, কি সরু পথ, বাস চলে একেবারে পথের কিনার ঘেঁষে, একটু এদিক ওদিক হলেই বাস ৫/৬ হাজার ফিট নীচে পড়ে যাবে। কি অপরূপ দৃশ্য, প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছিল, আমি পুটুস আর পুকুনকে নিয়ে বাস থেকে নেমে যেতে চাইছিলাম, জ্যোতিকে বার বার বলছিলাম,
চল, বাস থেকে নেমে পড়ি, বাকী পথ হেঁটে উঠবো, আমরা জীবনের অনেক কিছু তো দেখেছি, আমাদের বাচ্চা দুটো জীবনের কিছুই দেখেনি, বাস যদি খাদে পড়ে যায়------
শেষ পর্যন্ত আমরা বাস থেকে নেমে পড়েছিলাম, দুই কিলোমিটার পথ চারজনে হেঁটে হেঁটে উঠেছি। সেদিন টের পেলাম, বাতাস কত নির্মল হতে পারে, সতেজ বাতাসের আলাদা স্বাদ আছে, গন্ধ আছে, আমরা চারজনেই বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখি তুষারঢাকা পর্বতমালা, কি অপরূপ দৃশ্য! এমনসব অভিজ্ঞতা জীবনে হঠাৎ করেই ঘটে যায়। আজ অবশ্য সেবারের মত কিছুই ঘটেনি, কোন অনুভূতিও কাজ করেনি, একা এসেছি, যা হবার হবে ধরণের অ্যাটিচিউড ছিল, এবার আর বাস থেকে নামিনি, নির্মল বাতাস বুক ভরে টানতে টানতে পাহাড়ের চূড়ায় উঠিনি। তুষারঢাকা পর্বতমালাও দেখিনি। একা একা হাঁটছিলাম, আনমনে কত কথাই ভাবছিলাম। দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেছি, তবুও মহারাজ দর্শন দেননি, আর অপেক্ষা না করে নেমে আসবো ভেবেই এগোচ্ছিলাম, তখনই টিনাকে দেখলাম চার বছরের একটি ছেলের হাত ধরে এগিয়ে আসতে। দূর থেকে চিনতে পেরেই টিনাকে ডাকলাম, পাশে বসিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। টিনার সাথে গল্প করতে করতে টের পাচ্ছিলাম, মনের অস্থিরতা কেটে যাচ্ছে, হিমালয়ের চূড়া দেখার জন্য অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করলোনা, নির্মল বাতাস বুক ভরে টেনে নিয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ হোটেলেই ফিরে যাই, একা একা প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়না।
২)ছোট মাসীর প্রাণের বন্ধু মুনিয়ার বড় মামার মেয়ে টিনা। ওকে দেখেছি সেই কুট্টি বয়স থেকে। আব্বু-আম্মুর হাত ধরে বেড়াতে আসতো মুনিয়াদের বাসায়। আমার কাছে মনে হতো ছোট একটি পুতুল বুঝি হেঁটে হেঁটে আসছে। আমি তো প্রায়ই মামাবাড়ীতে চলে যেতাম, ছোট মাসীর পায়ে পায়ে ঘুরতাম। ছোট মাসীর বন্ধু হলেও কাছাকাছি বয়সী হওয়ায় মুনিয়া আমারও বন্ধু হয়ে উঠেছিল। উঠোনে বসে আমরা একসাথে রান্নাবাটি খেলতাম। তখন দেখতাম, মাঝে মাঝে বাড়ীর গেটে ধবধবে সাদা একটি গাড়ী এসে থামতো, গাড়ী থেকে নামতেন সুদর্শন এক ভদ্রলোক, স্টাইলিস্ট একজন মহিলা, আর একটি ফুটফুটে সুন্দর পুতুল। ওরা এলেই “ বড় মামা আসছে” বলেই মুনিয়া খেলা ছেড়ে উঠে যেত, ওর সাথে সাথে মাসীও চলে যেত। আমি যেহেতু ছোট মাসীর পায়ে পায়েই ঘুরতাম, তাই মাসীর পায়ের টানে আমিও মুনিয়াদের বাসায় চলে যেতাম। মুনিয়ার বড় মামা আর মামীকে দেখলেই বুঝা যেত, উনারা স্বপ্নলোকের মানুষ, আমাদের মত সাধারণ মানুষ নয়। মামা দেখতে দারুণ সুন্দর হলেও মামী কিন্তু মোটেও সুন্দরী ছিলনা। তবে উনাদের দুজনকে দেখলেই প্রথম যে কথা মনে হতো, ‘সুখী মানুষ’, সুখী মানুষ নিশ্চয়ই দেখতে এমন হয়। মুনিয়া বলতো, “ প্রেম করে বিয়ে করলে নাকি সুখী হওয়া যায়না, কথাটা ঠিক না, আমার বড়মামা আর বড় মামী তো প্রেম করেই বিয়ে করছে, কিন্তু উনাদের মত সুখী কাপল আমি কোথাও দেখিনি। বড় মামার মত একজন মানুষের সাথে বিয়ে হলে আমিও সুখী হবো”।
আমি সুখী মানুষ দেখতে ভালোবাসি, কিন্তু আশেপাশে সুখী মানুষ দেখতে পেতামনা, সবার সংসারে শুধু ক্যাঁচ ক্যাঁচ, ভ্যাঁজ ভ্যাঁজ চলতোই, আমার বাবা মায়ের মধ্যেও ক্যাঁচ ক্যাঁচ হতো, তাই মুনিয়ার দেখাদেখি আমিও জাকিরমামা আর মায়ামামীকে আদর্শ সুখী দম্পতী হিসেবে দেখতে শুরু করি, কোন এক অজানা কারণে উনাদের দুজনেই আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমাকে দেখামাত্র দুজনে বলতেন, “ এই যে পারমিতা, তুমি আমাদের পরম মিতা”।
জাকির মামা ছিলেন ভীষণ ধনীলোক, নিজের মালিকানাধীন দুটি জাহাজ ছিল, সাথে অন্যান্য ব্যবসা তো ছিলই, মামীর তো আর কোন কাজ ছিলনা, ঢাকা শহরে দুটি বাড়ী, বাড়ী ভর্তি আয়া-চাকর, নিজে হাতে কোন কাজ করতে হয়না, যে কোন উছিলায় আমেরিকা, লন্ডন বেড়াতে চলে যান, উনারা তো সুখী হবেনই। আমাদের বাবা-মায়ের তো আর সেই উপায় ছিলনা, ফার্মেসী থেকে যা আয় হতো, তা দিয়ে সংসার, সমাজসেবা আরও কত কি করতে হতো। আমেরিকা, লন্ডন তো আর বেড়াতে যাওয়ার উপায় ছিলনা, দুই তিন বছর পর পর একবার হয়তো কলকাতা যাওয়া হতো, সেখানেও তো কোথাও সুখ ছিলনা। আত্মীয়-স্বজনদের সকলেই দিন আনি দিন খাই ধরণের অবস্থায় ছিল। কাজেই কারো বাড়ীতে গিয়ে কয়েকদিন থাকার মত পরিস্থিতি ছিলনা। এইজন্যই জাকির মামা আর মায়া মামীকে স্বপ্নলোকের মানুষ মনে হতো। তবে আমি কখনওই উনাদের বড়লোকী দেখে আহ্লাদিত হতামনা, আমার ভালো লাগতো দু’জনের মধ্যেকার মধুর সম্পর্ক। বিশ্বাস কর মানসী, উনাদের দুজনের মধ্যে কোন ভনিতা ছিলনা, মামী বেশী কলকল করতেন, মামা শুধু হাসতেন, সে কি সুন্দর হাসি, একেবারে শিশুদের হাসির মত নির্মল হাসি। আরেকটা মজার কথা বলি, এই মামী জাকির মামাকে কি নামে ডাকতো, বলতো! পারবিনা বলতে, লাখ ডলার বাজী ধরলাম, ভাবতে ঠাক আর চিঠিটা পড়তে থাক।
মায়া মামী খুব ভালো ঘটকালী করতে পারতেন, ছোট মাসীর বিয়ের ঘটকালীও মায়া মামী করেছেন। পাত্র মামীর বান্ধবীর ভাই, লন্ডনে থাকে, দেশে এসেছে বিয়ে করতে, বিয়েতে কোন যৌতুক চায় না, শুধু সুন্দরী একটি বউ চায়। আমার মাসী তো খুব সুন্দরী, এক দেখাতেই পাত্র কুপোকাত হয়ে গেছে। বিয়েটা পাকাপাকি করতে পেরে মামা এবং মামী, দুজনেই মহাখুশী, বিয়ের আসরে উপস্থিত থেকে ছোট মাসীর বিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন। বিয়ের পর মেসোর সাথে তো মাসী লন্ডনে চলে যায়। মুনিয়ার বিয়ে হয়ে যায়, আমারও য়ার মামার বাড়ী যাওয়া হয়না, জাকির মামা আর মায়া মামীর সাথে দেখাও হয়না। এরপর তো আমি নিজের জীবনের পথ খুঁজে পেলাম, চলে এলাম আমেরিকা।
তিন বছর আগে দেশে বেড়াতে গেলাম, ছোট মাসীও তখন দেশে ছিল। মাসীর কাছে জানতে পারলাম, জাকির মামার আলজাইমার হয়েছে, কাউকে চিনেননা। কথাটি শুনে আমার মন এত খারাপ হয়ে গেলো। মাসীকে নিয়ে গেলাম উনাদের গুলশানের বাড়ীতে। দরজা খুলে দিল দারুণ সুন্দরী এক তরুণী, যতই বড় হোক, এ যে সেই পুতুল টিনা, তা আর কাউকে বলে দিতে হলোনা। টিনা অবশ্য আমাকে চিনতে পারেনি, তবে ছোট মাসীকে চেনে, দেশে এলেই মাসী মায়া মামীদের সাথে দেখা করে যায়।
টিনা আমাদের দুজনকে সরাসরি মামার শোবার ঘরে নিয়ে হাজির করলো। মামীও সেখানেই ছিলেন, মাসীকে বসতে বলেই আমাকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন। অনেক বছর পর মামী আমাকে দেখলেন, মামী একই রকম আছেন দেখতে, নরম বিছানায় আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকা মানুষটি যে জাকির মামা, তা বুঝতে পারলাম উনার হাসি দেখে। সেই চেনা হাসি, তবে হাসির মধ্যে একটু অস্বাভাবিকতা আছে। কারো দিকে তাকাচ্ছেননা, হাসছেন আর বলছেন, “ দেশটা চোরে ভরে গেছে, সবখানে চোর”। একই কথা বার বার বলছেন। আমি মামার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, ডাকলাম ‘ মামা, বড় মামা, আমি পারমিতা, সেই যে বলতেন, “পারমিতা, তুমি আমার পরম মিতা”, আমাকে চিনতে পারছেননা?” মামা হাসছেন আর বলছেন, “ দেশটা চোরে ভরে গেছে, সবখানে চোর”।
টিনা আমাদের সবার জন্য চা-জলখাবার এনে দিল, মামী একটি প্লেটে কিছু খাবার তুলে মামার কাছে গিয়ে বসলো, পরম যত্নে মামার গলায় টাওয়েল জড়িয়ে দিল, খাবারের বাটী মামার মুখের সামনে নিয়ে ডাকলো, “এই যে আমার ‘ইহা-উহা’, দেখো কে এসেছে, পারমিতা এসেছে, তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে, তুমি একটু তাকাও মেয়েটার দিকে”।
“দেশটা চোরে ভরে গেছে, সবখানে চোর”।
টিনা ঠাট্টা করলো, “আব্বু, তুমি পারমিতা দিদিকে চোর বলছো? হা হা হা!
---টিনার ঠাট্টায় যোগ দিতে পারলামনা। আমার বুকের ভেতরে কি যে কষ্ট হচ্ছিল, আলজাইমার অসুখটার কথা তো জানি, এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ তার অতীত, বর্তমান ভুলে যায়, এমনও হয়, আলজাইমার্স আক্রান্ত রুগী শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও ভুলে যায়, একবার শ্বাস নিয়ে দ্বিতীয়টি নেয়ার কথা ভুলে যায় বলে শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর কথা তখন ভাবছিলামনা, ভাবছিলাম আমার চিরচেনা সেই দেবপুরুষটি আজ কাউকেই চিনতে পারছেননা, অতীতের কিছুই মনে নেই, আদরের মেয়ে টিনাকেও চিনেন না, কাউকে নাম ধরে ডাকেননা, একটিমাত্র কথাই বলে যাচ্ছেন যা সুস্থ অবস্থায় উনার মাথায় খুব গভীরভাবে গেঁথে গেছিল। যে বুলি আউড়ে যাচ্ছেন, সেটি কোন ভালোবাসার বুলি নয়, সমাজের কুৎসিত কিন্তু বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠেছে।
মামীকে জিজ্ঞেস করলাম,
মামী, ঠিক কবে লক্ষ্য করলেন যে সামথিং ইজ গোয়িং রং?
বেশ অনেক বছর তো হয়ে গেলো, প্রথম প্রথম এটা সেটা খুঁজে পেতো না, নিজেই রেখেছে, অথচ মনে করতে পারতো না, আমি তেমন একটা গুরুত্ব দেইনি। ভাবতাম, এমন ভুলভাল তো আমরা প্রতিদিনই করি। কিন্তু ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়া লক্ষ্মণ বাড়তেই থাকে, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে বললাম, নিউরোলোজিস্ট দেখালাম, ধীরে ধীরে জানা গেলো, আলজাইমার্সের পূর্ব লক্ষ্মণ। বড় ধাক্কা খেলাম হজ্জ্ব করতে গিয়ে।
-কি রকম?
-তোর মামা তো ব্যবসা-বানিজ্য, সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল, পরিশ্রমী মানুষ, একফাঁকে বলেওছিল হজ্জ্ব করতে যাবে, কিন্তু যাবো যাবো করেও সময় বের করতে পারছিলো না। এরপর তো এই সমস্যা ধরা পড়লো, আগে জিনিসপত্র খুঁজে পেতোনা, এরপর দেখলাম চেনা পথ-ঘাট আর চিনতে পারেনা, পুরানো কর্মচারীদের নাম ভুল করে, আমার মনে হলো সমস্যা বাড়বার আগেই হজ্জ্বটা সেরে আসি, সুস্থ অবস্থায় হজ্জ্ব করার নিয়ত করেছিল, আমি তার স্ত্রী, এটা আমার দায়িত্ব তার নিয়ত পূর্ণ করার ব্যবস্থা করা। সাথে আরও দুই চারজন আত্মীয় নিয়ে হজ্জ্ব করতে গেলাম। আমাদের হজ্জ্বের কতগুলো অংশ আছে, একটার পর একটা করতে হয়। একদিনের কথা বলি, বিশাল ময়দানে তাঁবুর পর তাঁবু, লাখ লাখ মুসল্লী তাঁবুর মধ্যে মোনাজাত, আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে সময় কাটায়। আমিও একদিন মোনাজাত করছিলাম, পাশেই তোর মামা। চোখ খুলে দেখি মানুষটা নেই, তখনও সে এতটা অসুস্থ নয়, ভাবলাম, তাঁবুর বাইরে বেরিয়েছে হয়তো, আমি আবার মোনাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কি জানি খচ খচ করছিল, মোনাজাতে মন দিতে পারছিলামনা। তাঁবুর বাইরে বের হয়ে এলাম, আশেপাশে কোথাও তাঁকে দেখলামনা, আমার বুকের ভেতর মনে হলো বিশাল বড় সাইজের এক পাথরের ধাক্কা খেলাম। ঐ মুহূর্তে মনে হলো, সে হারিয়ে গেছে, চিরতরে হারিয়ে গেছে। সব কিছু ভুলে চীৎকার করে তাকে ডাকতে লাগলাম, “ তুমি কই? শুনছো, তুমি কোথায়? আশেপাশে তো হাজীদের ভীড়, সকলের নিজস্ব তাঁবু আছে, সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায়, অন্য তাঁবু থেকে ওর ভাই বেরিয়ে এলো, আমার বোনের স্বামী বেরিয়ে এলো, সবাই ছুটোছুটি শুরু করেছে। আমার তখন পাগলের মত অবস্থা। প্রায় এক ঘন্টা পর একজন মিশরীয় ভদ্রলোকের হাত ধরে ‘উহা’ ফিরে আসে আমার কাছে।
-মামী, আপনি এখনও মামাকে ‘উহা’ বলে ডাকেন?
-ডাকি, কিন্তু ‘উহা’ বুঝতে পারেনা।
-মামী, জানেন, আমি আপনার এই ‘উহা’ ডাকার গল্প কতজনের কাছে করেছি। সাধারণতঃ আধুনিক বউয়েরা তাদের স্বামীকে ‘জান’, ‘জানু, ‘হানি’ জাতীয় কমন শব্দে ডাকে। একমাত্র আপনি মামাকে ‘উহা’ বলে ডাকেন, এই সম্বোধন এর আগে কাউকে করতে শুনিনি, আমিও চেষ্টা করেছিলাম জ্যোতিকে ‘উহা’ নামে ডাকতে, পারিনা। আপনার মত হয়না।
-হা হা হা! তাই বুঝি? কিন্তু আমার ‘উহা’ তো আর কিছু বুঝেনা।
-বুঝে ঠিকই, নাহলে শুধু আপনাকেই চিনে কি করে? আর তো কাউকে চেনেনা, এমনকি টিনাকেও না, শুধু আপনাকে চেনে।
-হ্যাঁ, আল্লাহর অশেষ রহমত, তাঁর স্মৃতিতে আমার মুখটা এখনও বেঁচে আছে। দ্যাখ, একেবারে তো শিশুর মত হয়ে গেছে। হাত মুখ ধুয়ে দিতে হয়, দাঁত ব্রাশ করে দিতে হয়, গোসল করিয়ে দিতে হয়, খাইয়ে দিতে হয়,--------
-মামী, আপনি যখন কোথাও বেড়াতে যান, মামাকে কি বাড়ীতে রেখে যান?
-মাথা খারাপ? ‘উহা’কে ছাড়া আমি কোথাও যাইনা, এইজন্য ইদানিং আমি সব অনুষ্ঠানে যাইওনা। খুব ঘনিষ্ঠ, আপন কেউ ডাকলে সেই ডাক ফিরাতে পারিনা,‘উহা’কে নিয়ে যাই। আমি তো ভাবতেই পারিনা, কোন অনুষ্ঠানে আমি আছি, আমার পাশে ‘উহা’ নেই। একমাত্র ‘মৃত্যু’ ছাড়া আর কেউ আমাদেরকে আলাদা করতে পারবেনা।
-মামী, সেদিন মিশরীয় হাজী মামাকে কোথায় খুঁজে পেলো, জানা হলোনা।
-ওহ, ভুলে গেছি, তোর মামা সেদিন আমাদের তাঁবু থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করছিল বোধ হয়। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গেছিল। তাঁবুতে ফেরার কথা মনে হতেই ফিরে আসছিল, কিন্তু তাঁবুগুলো তো সবই একরকম দেখতে, ফলে চিনতে পারছিলনা, পথ ভুলে গিয়ে আরও বেশী হারিয়ে গেলো। এই তাঁবুর দরজা দিয়ে উঁকী দেয়, ঐ তাঁবুর দরজা দিয়ে উঁকী দেয়, কোথাও আমাকে দেখতে পায়না। চারপাশে এত এত হাজী, কেউ তো আর বুঝতে পারেনি ‘উহা’ হারিয়ে গেছে। ঐ মিশরীয় হাজী সাহেব দূর থেকে লক্ষ্য করেছে যে একজন দিশেহারা মানুষ প্রতিটি তাঁবুর ঢাকা সরিয়ে দেখছে। সে তখনই বুঝে গেছে, এই মানুষটি নিজের তাঁবু খুঁজে পাচ্ছেনা। তখন সে উহার হাত ধরতেই উহা আমার নাম বলেছিল।
-ইংলিশে বলেছিল?
-হ্যাঁ, তখনও তো সব ভুলে যায়নি, যাই হোক মিশরীয় ভদ্রলোকই শেষ পর্যন্ত ‘উহা’কে আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এরপর থেকে আমি ‘উহা’কে আর এক মুহূর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করিনি।
-আপনার চাকুরী?
-চাকুরী ছেড়ে দিয়েছি।
আমার স্মৃতি হাতড়ে যেটুকু পেয়েছি, মামীকে সদা হাস্যোজ্জ্বল, দারুণ স্মার্ট, কথাবার্তায় খুবই কলবলে দেখেছি, আর আগেই তো বলেছি, মামা আর মামীকে দেখে মনে হতো স্বপ্নলোকের মানুষ, এত সুখী ছিলেন। সেই সুখী দুজনের একজন একেবারে নিষ্প্রভ, নীরব, অনুভূতিহীন হয়ে গেছে, মামী সেটি কীভাবে নিচ্ছেন বুঝতে পারছিলামনা। যে দু’ঘন্টা ঐ বাড়ীতে ছিলাম, মামীর আচরণে কোন অসঙ্গতি দেখলামনা, এত কথা বললেন অথচ চেহারায় কোথাও কোন ক্লান্তি বা গ্লানির এতটুকু ছাপ দেখিনি, দুঃখের কোন ছাপও দেখিনি। আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
“মামী, আপনি তো জানেন, মামা আর কোনদিন ভাল হবেনা, মামা আপনার কোন কথায় সাড়া দেন না, একেবারে অবোধ শিশুর মত হয়ে গেছে, সব কিছু আপনাকে করে দিতে হয়, শিশু তো তবুও বড় হতে হতে সবকিছু শিখে ফেলে, মামার ক্ষেত্রে তো তা হবেনা। এটি যখন ভাবেন, তখন কি ক্লান্তি আসে? হতাশা আসে?
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মামীর মুখের চেহারা বদলে যেতে লাগলো এবং এক সময় উনি হু হু করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,
“পারমিতা, এমন সরাসরি প্রশ্ন তোর আগে কেউ করেনি। তোকেই বলি, এই মানুষটার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল চল্লিশ বছর আগে। পরিচয় থেকে পরিনয়, পরিনয় থেকে আলজাইমার্স হওয়ার আগে পর্যন্ত সে আমাকে সুসময়ে-দুঃসময়ে তার হৃদয়ে ধরে রেখেছে, এমনভাবেই রেখেছে যে আজ সব কিছু ভুলে গেলেও, সবাইকে ভুলে গেলেও আমাকে ভুলেনি। আজ সে অসহায় শিশুর মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমার অপেক্ষায় থাকে, গোসল করতে গেলেও বাথরুমের দরজা একটু ফাঁক করে রাখি, যেন আমাকে খুঁজতে গিয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে না যায়। দ্যাখ, বিছানাটা বাথরুমের দরজার মুখোমুখি রেখেছি যাতে ‘উহা’ বুঝতে পারে আমি কাছাকাছি আছি। আমি যদি মন খারাপ করি, বিরক্ত হই, ক্লান্তি বোধ করি তাহলে ‘উহার’ হৃদয়ের অমর্য্যাদা করা হবে, ভালোবাসার অমর্য্যাদা হবে। আমি মন খারাপ করি, অন্য কারণে, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে, আজ উহার এই অবস্থা, তবুতো আমি বেঁচে আছি, যদি আমি মরে যাই, তখন উহার কি হবে রে পারমিতা! ওতো আমাকে ছাড়া আর কাউকে চিনে না, কোন কাজেই সে অন্য কারো সাথে কো-অপারেট করবেনা। অন্য কারো হাতে খাবেনা, কারো হাতে মুখ ধোবেনা, কিছুই করবেনা। একটু দোয়া করিস, যতই কষ্ট হোক মেনে নিতে, তবুও উহার আগে যেন আমার মৃত্যু নাহয়।
-মামী, আমি অনেক দুঃখিত, এই প্রসঙ্গ তোলা উচিত হয়নি। আপনার চোখে জল দেখে আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে যাচ্ছি। আমরা কেউই নিজেদের ভবিতব্য জানিনা, আপনাকে আজ দেখে আমার অন্তর শুদ্ধ হলো, কিশোরীবেলা থেকে আপনাদের দুজনকে ‘স্বপ্নলোকের সুখী মানুষ’ হিসেবে দেখে এসেছি, আজও আপনাদের দেখে স্বপ্নলোকের সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করবেন।
মানসী, হুট করেই তো দেশে চলে এলাম, কিছুটা অভিমান তো ছিলই, সকলের উপরই অভিমান, এমনকি তুই যে আমার প্রাণের সই, সত্যি কথাই বলি, তোর উপরও অভিমান জন্মেছিল। কেন জানি মনে হয়েছিল, আমি একা, আমার পাশে কেউ নেই, আমার স্বামী-সন্তান, ভাই-বোন, বন্ধুদের কেউই নেই, আমাকে কোণঠাসা করে দিয়ে সবাই আড়ালে সরে গেছে।
দেশে আসার আগে তোকে বলে আসিনি, পুটুস আর পুকুনকে জানাইনি, শুধু গুড্ডি আর জ্যোতিকে বলে এসেছি। বলে এসেছিলাম, দেশে চলে যাচ্ছি, আমেরিকার জীবন সমাপ্ত। দেশে এসেছিলাম নির্বাচনের আগে, নির্বাচন হলো, নির্বাচনের পর যখন সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হলো, যশোরের মালোপাড়া, দিনাজপুরের কর্নাইসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গরীব হিন্দুদের উপর দুর্বৃত্তরা আক্রমন করলো, মালোপাড়ার বাড়ীঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল, তখন কি যে অপমানিত বোধ করেছি। যে দেশে আসার জন্য স্বামী সন্তানের সাথে রাগ করে চলে এলাম, তাপসীকে আসতে দিসনি বলে তোদের উপর অভিমান করলাম, সেই দেশেই কিনা হিন্দুরা আক্রান্ত হলো! হিন্দুরা আক্রান্ত হবে, এই কথাই তো জ্যোতি বলেছিল। মনে হয়েছে, জ্যোতিই জয়ী হলো, আমি পরাজিত হয়েছি। কিন্তু দুইদিন না যেতেই সারা দেশে যেভাবে প্রতিবাদের জোয়ার উঠলো, গণজাগরণ মঞ্চ, রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ, বিভিন্ন সংগঠণ থেকে সকলে পৌঁছে গেলো দূর্গত এলাকায়, বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রতিবাদের ঝড়, ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড়, বিশ্বাস কর, আমার মনে হলো, জয় আমার হয়েছে, আমি জয়ী হয়েছি, আমার বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার জয় হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের সাথে আমিও গিয়েছিলাম মালোপাড়ায়। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাঁদা তুলেছি, বলতো কত তুলেছি, থাক, টাকার পরিমান বলবোনা, তবে ভালোবাসার পরিমান বলি, এক সাগর ভালোবাসা চাঁদা পেয়েছি, সেই এক সাগর ভালোবাসা পৌঁছে দিয়েছি দুঃখী মানুষগুলোর কাছে।
এবার লেখা শেষ করতে চাই। ক্ষিদে পেয়েছে, মনীষা বোধ হয় মুরগীর ঝোল রাঁধছে, ওর রান্না ভালোই লাগে, শুধু টমেটো বেশী দিইয়ে ফেলে, আমি অত টক খেতে পারিনা। কিন্তু সোনামুখ করে খেয়ে নেই, আমি যখন খেতে বসি, মনীষা আমার পাশে বসে থাকে, কখন কোনটা লাগে, তা এগিয়ে দেয়ার জন্য বসে থাকে। খাওয়া শেষ হতেই সে ঘর পরিষ্কার করে আমার শিয়রে এসে বসে মাথার চুলে বিলি কেটে দেয়। নেপালী সংগীত গুনগুন করে গেয়ে শোনায়, গানের মানে বুঝিনা তবে এটুকু বুঝি, গানের সুরে ভালোবাসার কথা লেখা আছে, আমিও ওকে গেয়ে শুনাই, “ ভালোবেসে যদি সুখ নাহি, তবে কেন মিছে ভালোবাসা”।
তোর পারমিতা
বিঃদ্রঃ জ্যোতিকে জানাবিনা, আমি চলে আসছি। হঠাৎ করে পৌঁছে যাব, জে এফ কে থেকে ফোন করবো, “ আমি জে এফ কে’তে পৌঁছে গেছি, আমাকে নিয়ে যাও”। হা হা হা! ভালোবেসে যদি সুখ নাহি, তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালোবাসা!