কর্ণেল ভাইয়ের স্বপ্ন

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১৩)

রীতা রায় মিঠু
  • ২২
  • ৪০
আজ পারমিতার মন খারাপ, এবং মনটা খুব বেশীরকম খারাপ। ঘরে কেউ নেই, কর্তা চলে গেছেন ইউনিভার্সিটিতে, গুড্ডি গেছে স্কুলে। ল্যাপটপে ফেসবুক খোলা রেখেই পারমিতা কিচেনে এলো। কিছুই করার নেই, চায়ের কেটলীটাই চূলায় চাপিয়ে দিল। মানসীকে ফোন করবে কিনা বুঝে উঠতে পারছিলনা। দুই বন্ধুর মধ্যে চিঠি দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটি বেশ অনেকদিন ধরেই বন্ধ আছে। ফোনেও কথাবার্তা কম হয় ওদের। মানসী ফোনে কথা বলতে বেশী পছন্দ করেনা, পারমিতা নিজেও খুব বেশী ফোন ব্যবহারের পক্ষে নয়। তারপরেও দু’বান্ধবীর তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ নেই, কোন না কোনভাবে কাজ চলছে। আসলে পারমিতা ইদানিং ফেসবুকেই বেশী সময় কাটায়, দিন দিন রাজনীতির সর্বনাশা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। যদিও দিনের কোন এক সময় সে বাইরে যায়, বাজার করে ফেরার পথে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নিউইয়র্ক শাখা অফিসে ঢুঁ মেরে আসে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের সাথে কথা হয়, ওখান থেকেই মাঝে মাঝে নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই ও ফেসবুকে স্ট্যাটাসের ঝড় তোলে। একেকটা স্ট্যাটাস লিখে, এই নিয়ে কমেন্টের ঝড় বয়ে যায়। এইসব স্ট্যাটাস লিখে কার কি লাভ হয় কে জানে, পারমিতার ভাল লাগে। মনে হয়, দেশ থেকে ১৫,০০০ মাইল দূরে থেকেও দেশের মধ্যেই আছে।
ফেসবুকে ইদানিং এক ধরণের স্নায়ু যুদ্ধ চলছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্ত আর বিপক্ষ শক্তির মধ্যে। পারমিতা আগেও ফেসবুকে সময় কাটাতো, তবে এখনকার মত নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে নয়। আগে ও ব্লগে লিখতো, পত্রিকায় কলাম লিখতো, সেই হিসেবেই ফেসবুকে গল্প, গান, কবিতা নিয়ে কিছুটা সময় কাটাতো। কিন্তু এ বছর ফেব্রুয়ারীর পাঁচ তারিখে যখন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায় বেরোবে বলে শোর উঠলো, তখন নিউইয়র্কে মাঝরাত, পারমিতা ‘আমার ব্লগ’ নামের ব্লগে একটা লেখা পোস্ট করছিল। খেয়াল করলো, বেশ কিছু ব্লগার তখন কাদের মোল্লার বিচারের রায় শোনার অপেক্ষায় লাইভ পোস্ট করে যাচ্ছে। পারমিতাও সেখানেই থেমে গেছিল। এরপর তো সবই ইতিহাস, শাহবাগে ব্লগাররা অবস্থান নিল, প্রজন্ম মঞ্চ তৈরী হলো, গণজাগরণ হলো, নিজেও একজন ব্লগার হিসেবে এগুলো নিয়ে পারমিতা খুব এক্সাইটেড ছিল।
দেশে থাকতেই পারমিতা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অফিসে আসা যাওয়া করতো, ছাত্রাবস্থায় ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল, নব্বই সালের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। বরের সাথে আমেরিকা চলে আসার পরেও দেশের জন্য ওর টান একই রয়ে গেছে। সংসার বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে এসেছে অনেক আগেই, ওর বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তাই এখনও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে।
সেই শাহবাগ মঞ্চ, প্রজন্ম মঞ্চ, গণ জাগরণ মঞ্চ নিয়ে যখন চারদিকে তুমুল উত্তেজনা, ঠিক তখনই বহ্নিশিখার সাথে পরিচয়, মানসী পাঠিয়েছিল বহ্নিশিখাকে পারমিতার কাছে। বহ্নিশিখা একজন যুদ্ধশিশু, পাশের বাড়ীর রাজাকার কমান্ডার দিনের পর দিন ওর মাকে রেপ করেছিল, পাক আর্মীর ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল। বহ্নিশিখাকে নিয়ে ওর মা একটি মিশনারী গ্রুপের সাথে আমেরিকা চলে আসে। এখানেই ওর মা মারা যায়। বহ্নিশিখার জন্য ডায়েরী রেখে যায় যেখানে সেই রাজাকার কমান্ডারের নাম-পরিচয় দেয়া ছিল। মানসীর সাথে বহ্নিশিখার পরিচয় হয়েছিল, মানসীই বহ্নিশিখাকে পারমিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পারমিতাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি, দেশের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন সদস্য ‘স্বাধীন’ এর সাথে বহ্নিশিখার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। পারমিতা জানতো, স্বাধীন জান-প্রাণ দিয়ে বহ্নিশিখাকে সাহায্য করবে। পারমিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বহ্নিশিখা দেশে যায়, সেই ডামাডোলে রাজাকার কমান্ডারকে খুঁজে বের করে, স্বাধীনকে সাথে নিয়ে সেই কমান্ডারের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও ঠুকে আসে।

তখনই পারমিতা ফেসবুকে সরব এবং ব্যস্ত হতে থাকে, ব্লগে লেখালেখি বেড়ে যায়, ওর লেখার হাত আছে, পলিটিক্যাল পরিবারের মেয়ে হিসেবে রাজনৈতিক ধ্যান-ধারনাও পরিষ্কার, তাই লিখালিখি করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়না। ধীরে ধীরে দেশের জন্য পারমিতার প্রাণ উতলা হয়, আমেরিকান বিলাসী জীবন পানসে লাগতে থাকে। এদিকে ফেসবুকে বন্ধু রিকোয়েস্ট আসতেই থাকে, কাউকেই পারমিতা চেনেনা, অচেনা থেকে সকলে চেনা হয়ে যায়। পারমিতার একটি জিনিস খুবই পজিটিভ, ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হলেও বিপক্ষ শক্তিকে কখনও গাল-মন্দ করেনা। খুবই ভদ্র ভাষায় ওর মতামতকে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। ফলে আওয়ামীপন্থী ছাড়াও অন্যান্য মতানুসারীরাও পারমিতার বন্ধু হতে চায়।
এভাবেই বন্ধুত্ব হয় তুহীনের সাথে। তুহীনের প্রোফাইলে ওর কোন ছবি নেই, প্রোফাইলে বাংলাদেশের পতাকার ছবি। এমনই পারমিতার অবস্থা, ও শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি খুঁজে বেড়ায়। প্রোফাইল পিকচারে বাংলাদেশের পতাকা দেখলেই হলো, আওয়ামীলীগ নাকি বিএনপি তা বিচার করেনা, বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। পারমিতা বিশ্বাস করে, রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হলেও দেশপ্রেমের ব্যাপারে সকলেই তো এক বিন্দুতে আছে, তাতেই হলো। পারমিতা তখনও জানেনা, তুহীন দেখতে কেমন, তুহীনের বয়স কত, তুহীনের প্রফেশান কি, কিছুই জানেনা অথচ তুহীনের সাথে অনলাইনে চ্যাটিং হয়। তুহীন খুব ঝুলোঝুলি করতে থাকে, পারমিতার কাছ থেকে একটি রাখী পাওয়ার জন্য। তুহীনের বোন নেই, ওরা দুই ভাই, পারমিতার প্রোফাইল এবং ওয়াল অনেকদিন থেকেই তুহীন ফলো করেছে, পারমিতার দেশপ্রেমে অভিভূত হয়ে ওর মনে হয়েছে, পারমিতা নামের এই নারী তার বোন, তার দিদি। পারমিতা শুধুই বলতো, “ হ্যাঁ, অবশ্যই আমি তোমাদের দিদি”।
কিন্তু এই এতটুকু কথাতে তুহীনের মন ভরতোনা। শুধু বলতো, “ তুমি আমাকে রাখী বেঁধে দিবে কিনা বলো”।
পারমিতা সহজেই রাজী হয়েছে তুহীনকে ছোট ভাই হিসেবে গ্রহণ করতে। ফেসবুকের সবাইকেই পারমিতা ভাই-বোন হিসেবেই দেখে। বন্ধুরাও ওকে ‘দিদি’ বলে ডাকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, আর কয়দিন পর পারমিতাকে নামে কেউ চিনবেনা, সবাই ওকে জানবে ফেসবুক দিদি নামে।
ধীরে ধীরে পারমিতা জানতে পারে, তুহীন প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা, বিবাহিত, দুটি ফুটফুটে কন্যার বাবা সে। তুহীনকে খুব আপন মনে হয়, তুহীন এমনভাবে দিদি ডাকে, এমন জোর দিয়ে বলে, দিদির হৃদয়ে শুধু সে থাকবে ছট ভাই হয়ে, আর কেউ থাকতে পারবেনা, দিদি ওর কাজলাদিদি, এগুলো শুনলে পারমিতা গলে গলে যায়।



আজ মন খারাপের কারণও তুহীন। সকালেই তুহীনের সাথে অনলাইন চ্যাটিং হয়েছিল। সেই থেকে পারমিতার মনটা ভারী হয়ে আছে। এই ভার কিসের ভার, কষ্ট নাকি হতাশার ভার, বুঝে উঠতে পারছেনা। গত সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়, তখন বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ছ’টায় তুহীন একটি এস এম এস পাঠিয়েছিল,
“দিদি, তোমাকে মনে পড়ে, খুব খুব মনে পড়ে”।
পারমিতা লিখেছে, “দিদিকে তো মনে পড়বেই, দিদি যে ছোট ভাইটিকে নিয়ে সব সময় ভাবে”।
পরের এস এম এস, “তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো, কিন্তু কখনও প্রকাশ করোনা, তুমি আছো শুধু আওয়ামীলীগ আর শেখ হাসিনাকে নিয়ে, আমার কোন খোঁজ নাও না। ফেসবুক ওপেন করলেই দেখি, তুমি একটার পর একটা স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছো, শুধুই পলিটিক্যাল স্ট্যাটাস, আমার এই ৪২ বছরের জীবনে আমি কোন মেয়ে বা নারীকে এতটা রাজনীতি সচেতন হতে দেখিনি”।
তুহীনের এই এস এম এস পেয়ে পারমিতা কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থেকেছে। এটা ঠিক, বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ফেসবুকে ভীষণ ঝড় উঠেছে। পারমিতা গত এক বছর হলো, ফেসবুকে দারুণভাবে অ্যাকটিভ হয়ে উঠেছে। শুরুতে ছোট ছোট গল্প, কবিতা লিখে নিজের ওয়ালে পোস্ট করতো, কিন্তু ফেব্রুয়ারীতে দেশে যখন প্রজন্ম মঞ্চ তৈরী হলো, যা থেকে গণজাগরণের সূত্রপাত, পারমিতার মুক্তিযোদ্ধা মন তৎপর হয়ে উঠলো। ফেসবুকে ওর স্ট্যাটাসের ধরণ বদলে যেতে লাগলো। পরিচিত বন্ধুরা আড়ালে চলে গেলো, অপরিচিতরা বন্ধু লিস্টে যোগ হতে থাকলো, পারমিতাকে ‘দিদি’ ডেকে সকলেই ওর ভাই হতে চাইলো। ভাইদের প্রতি পারমিতার দূর্বলতা আজন্মের। সেজন্যই খুবই সহজে অপরিচিত ছেলেগুলোর হাতে ‘রাখী’ বেঁধে দিয়ে পারমিতা ওদের ‘দিদি’ হয়ে গেলো।

তুহীনও এভাবেই পারমিতার ভাই হতে চেয়েছে। ‘দিদি’ বলে ডাকলে তো আর ফেরানোর উপায় নেই, পারমিতা পারেওনা কাউকে ফেরাতে, তুহীনকেও ফেরায়নি। ভাই বলে ডেকেছে। কিন্তু তুহীন এত অল্পতেই তুষ্ট নয়, মেসেজের পর মেসেজ পাঠিয়ে গেছে, দিদি’র কাছ থেকে ‘রাখী’ পাবার জন্য। দিদি শুধু মুখ ফুটে বলবে, “ হ্যাঁ, তোমার হাতে রাখী পরিয়ে দিলাম”। পাগলা ভাইকে পারমিতা শেষ পর্যন্ত বলেছে, “ হ্যাঁ, তোমার হাতে রাখী বেঁধে দিলাম, আগামী ভাই ফোঁটার সময় তোমার হাতে সত্যি সত্যি রাখী বেঁধে দেবো, হলো তো?”
তুহীন কি খুশী! তখনও পারমিতা জানেইনা তুহীন কে, ওর পেশা কি? একদিন কথায় কথায় জেনেছে, তুহীন বিজিবি’র লালমনিরহাট শাখার সর্বাধিনায়ক। তখন ফেলানী হত্যার বিচার এবং কোচবিহারের আদালতে বিচারের রায় নিয়ে বাংলাদেশে চলছে তুমুল হৈ চৈ।

তুহীনই জানিয়েছে, বিএসএফ অনেক অন্যায় আচরণ করে ঠিকই, এদিক থেকে বাংলাদেশীদেরাও কম অন্যায় করেনা। প্রায় প্রতিদিন তুহীনকে ঐপারে যেতে হয়, পতাকা বৈঠক করার জন্য। অফিসারে অফিসারে মৈত্রী সিদ্ধান্ত হয় ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশীদের মধ্যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এবং দরিদ্র জনগণ সব জেনেও ভারত সীমান্তে ‘অন্যায় ও অনধিকার প্রবেশ’ করতে চায়, এই নিয়ে কতিপয় লোভী বিএসএফ সদস্যের সাথে ঘুষ আদান-প্রদানে গোলমালও হয়, পাওনা-দেনায় গোলমাল হলেই ঐপারের সীমান্ত রক্ষীদের রাইফেল গর্জে উঠে। তাই বলে এপারের বিজিবির সদস্যরাও বসে থাকেনা। সংখ্যায় কম হলেও বিজিবির রাইফেলের গুলীতেও ঐপারের নিরীহ মানুষ মারা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে মানুষ মারা যায় অনেক বেশী।

পারমিতার চোখে ভাসে এক অকুতোভয় সৈনিক হাসিমুখে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ‘দিদি’ গো বলে ডাকছে। ওর চোখে জল চলে আসে, দুই হাত বাড়িয়ে দেয় তুহীনের দিকে। তুহীন কি খুশী হয়! এভাবেই একসময় পারমিতা আর তুহীন ভাই-বোনের দৃঢ় বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়। পারমিতার তো অনেক ভাই, কিন্তু তুহীনের এই একটাই বোন, পারমিতা। তাই দিদির প্রতি ওর আবদার দিন দিন বেড়েই চলে। দিদির ফোন নাম্বার চেয়ে নেয়, যখন-তখন ফোন করে জানতে চায় দিদি কেমন আছে, ভাইকে ভুলে গেছে কিনা। এভাবেই সাত মাস পেরিয়ে যায়।

গত মাসে তুহীন বিজিবি থেকে সেনাবাহিনীতে চলে এসেছে। পদোন্নতি হয়ে কর্নেল র্যাংমক পেয়েছে। সেই সংবাদ তুহীন দিদিকে জানিয়েছে সবার আগে। লিখেছে, “ দিদি, আমি কর্নেল র্যাং কে প্রমোশান পেয়েছি, আগামী সপ্তাহে আমাকে ব্যাজ পড়ানো হবে, এই সংবাদ আমি শুধুমাত্র আমার বাবা, স্ত্রী আর তোমাকে জানালাম। ফোন অন রেখো, ব্যাজ পরানো হয়ে গেলেই তোমাকে ফোন করবো”।

ফেসবুকে প্রায় প্রায় তুহীন ইনবক্সে মেসেজ করে। যেহেতু সে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আছে, তাই কখনও রাজনৈতিক কমেন্ট করেনা। কিন্তু হাবে ভাবে বুঝিয়ে দেয়, ও আছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির পাশে। অনেকবার বলেছে, “ দিদি, আমি তো মুসলমানের ঘরে জন্মেছি, ইসলাম জন্মান্তরে বিশ্বাস করেনা, কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করে জন্মান্তরে বিশ্বাস করতে। ইচ্ছে করে এই জন্মে এক মায়ের গর্ভে আমরা না জন্মেও ভাই-বোন হয়েছি, পরের জন্মে যেন এক মায়ের পেটেই আমরা জন্মাই। জন্মান্তর সত্যি না হলে তো আমার এই ইচ্ছেটাও পূরণ হবেনা। অথচ জন্মান্তর আদৌ আছে কিনা, তাও তো কারো জানা নেই। আমি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই, এর আগে কোনদিন আমি দুর্গাপূজার মন্ডপে যাইনি, তোমাকে পেয়ে আমি এ বছর বউ-মেয়েদের নিয়ে দুর্গাপূজা দেখতে বেরিয়েছি, কি যে ভাল লেগেছে। তোমার মত এমন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষকে কাছে পেয়েছি, ফেসবুকে না এলে তোমাকে কোথায় পেতাম।


কাল সন্ধ্যার মেসেজে এও জানিয়েছিল যে পারমিতাকে নিয়ে ও ভীষণ এক দুঃস্বপ্ন দেখেছে, তাইতেই সাত সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু অফিসে ছিল বলে স্বপ্ন নিয়ে কথা বলা হয়নি। পরে কোন এক সময় পুরো স্বপ্নের কথা সে ইনবক্সে পাঠিয়েছে। তা পড়ার পর থেকেই পারমিতার মন খারাপ। দেশে যাবে বলে সকল রকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, দেশে সবাই পারমিতাকে নিষেধ করছে এই সময়ে দেশে না যেতে। বিশেষ করে মা আর বাবা, দুজনেই একেবারে হায় হায় করছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৈনিক হিসেবে এখনই পারমিতার দেশে যাওয়া উচিত। বিজয় দিবস করতে পারবেনা, অন্তঃতপক্ষে শহীদ দিবস আর স্বাধীনতা দিবস তো পালন করা উচিত। সকলের নিষেধ সত্বেও পারমিতা যাবে বলে পণ করেছে, তুহীনকে জিজ্ঞেস করেছিল। তুহীন বলেছে, ওর এক মন চায় দিদিকে দেখতে, আরেক মন চায় দিদি নিরাপদে থাকুক। আজ তুহীনের স্বপ্নের বর্ণনা পড়ার পর থেকে পারমিতা দোটানায় পড়ে গেছে।

তখনই পারমিতার মনে হলো, মানসীর সাথে তুহীনের স্বপ্নটা নিয়ে কথা বলা যায়। স্বপ্ন স্বপ্নই, মাথা না ঘামালেও চলে, তবে তুহীনের স্বপ্নে কিছু একটা ইঙ্গিত আছে, কেউ একজনকে না বলা পর্যন্ত বুকটা হালকা হচ্ছেনা। মানসীর কথা মনে হতেই খেয়াল হলো, আজ তো সোমবার, মানসী কি ওয়ালমার্টে গেছে, নাকি আজ ওর অফ ডে! ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে দেখে নিল, আজ মানসীর অফ ডে। মানসীদের কাজের শিডিউল তিন সপ্তাহ আগেই দিয়ে দেয়, মানসীর কাছ থেকে শুনে নিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কেটে রাখে পারমিতা। যেদিন মানসীর অফ ডে থাকে, দুই বন্ধু টেলিফোনে একনাগাড়ে অনেকক্ষণ গল্প করে যায়। ওর মেয়ে তাপসীরও বোধ হয় বাংলাদেশে যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে! কি সিদ্ধান্ত হলো কে জানে!




চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পারমিতা বেডরুমে চলে গেলো। বিছানার উপর ল্যাপটপ খোলা আছে, আজকের রাজনৈতিক স্ট্যাটাস অর্ধেক লেখা হয়েছে। চায়ের কাপ সাইড টেবিলে রেখে সেল ফোনের ডিজিট টিপে মানসীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। দুই রিং হওয়ার পরে মানসীর ঘুম ভাঙ্গা কন্ঠ শোনা গেলোঃ
-কীরে! এত সকালে!
-তুই তো আমার চেয়ে এক ঘন্টা পিছিয়ে আছিস, আমার এখানে এখন বাজে বেলা এগারোটা, সকালের বাকী নেই।
-তোর গলার স্বর এমন শোনা যাচ্ছে কেন? মন খারাপ?
-গলার স্বর কেমন শোনা যাচ্ছে জানিনা, তবে মন চিন্তিত।
-তুই কিন্তু বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো, আমাকে চিঠিও লিখিসনি। এদিকে আমিও খুব দুঃশ্চিন্তায় আছি তাপসীকে নিয়ে।
-কি হয়েছে তাপসীর? বাংলাদেশে যাওয়ার টিকিট হয়ে গেছে না?
-হ্যাঁ, সেই নিয়েই চিন্তায় পড়ে গেছি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কবীর চাইছেনা মেয়ে দেশে যাক।
-সে কিরে! আমি তো একই ব্যাপারে খুব টেনসড আছি। আমার তো দেশে যাওয়ার ইচ্ছে, ফেসবুকে বসে বসে এতদিন খুব রাজনীতি করেছি, এখানে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাথে কাজ করেছি, এখন নির্বাচনের সময় দেশে না গেলে তো নিজের বিবেকের কাছেই দায়বদ্ধ থাকবো। তোর সাথে বেশ কিছুদিন কথা হয়নি, আমার কর্নেল ভাইয়ের কথা মনে আছে তো?
-মনে আছে, তবে তোর যেরকম হাজার হাজার ভাই চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সবার নাম মনে রাখা তো চারটিখানি কথা নয়। আমার আবার স্মরণশক্তি একটু কমই আছে।
-সে জানি, অংকে কাঁচা ছিলি, স্মরণশক্তিও কম ছিল, কত ছেলে তোর পেছনে লাইন দিয়েছিল, তাদের সবার নাম তোর মনে আছে? মনে নেই, কিন্তু আমার মনে আছে।
-তোর তো সবই মনে থাকে। এখন তোর কর্নেল ভাইয়ের কথা বল। কি হয়েছে তার? কি যেন নাম, তুহীন না?
-হ্যাঁ, তুহীন, যাক, আমার ভাইয়ের নাম মনে আছে। শোন, তুহীন কাল আমাকে একটা এস এম এস পাঠিয়েছিল, “ তোমাকে মনে পড়ে দিদি।“ আমি বলেছি, কি ব্যাপার, এই সাত সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলো যে!
তুহীন বলে, তোমাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখছিলাম, ভাগ্যিস ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে, তাই এই স্বপ্ন দেখা থেকে মুক্তি পেলাম।
-কি স্বপ্ন?
-আমি বললাম, আমাকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখলে ভাই? মরে গেছি? সে বলে, “ মরে গেলেও তো জানতাম, তুমি মরে গেছো, আমি স্বপ্নে দেখেছি, তুমি হারিয়ে গেছো। কোথাও খুঁজেও পাচ্ছিলামনা। ঘুম ভাঙ্গতেই আমার খুব কান্না পেয়ে গেলো।
-এই কি রে! তোর এই ভাইয়ের বয়স কত? এমন বাচ্চাদের মত কথা বলে!
-আমার ভাইয়ের বয়স কত, তা তো আমি জানিনা, আমি জানি, সে আমার ছোট ভাই। ও কথাও বলে ছোট ভাইয়ের মত। বললাম, কি স্বপ্ন দেখেছো? সে বলে, তোমাকে ফেসবুকে মেসেজ লিখে জানাবো, এখন আমি যাচ্ছি গলফ খেলতে।
-গলফ? গলফের নাম শুনলেই এরশাদ চাচ্চুর কথা মনে হয়। হা হা হা হা! কি সুন্দর গলফ খেলতো আর ছাত্রদের উপর ট্রাক তুলে দেয়ার নির্দেশ দিত।
-হুম! সবই কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে রে মানসী। কোথায় গেলো সেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, আজ স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে দেশ বিভক্ত হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আর বিপক্ষ শক্তিতে। আমি ইদানিং খুবই হতাশা বোধ করি। কত উদ্দীপনা নিয়ে গণ জাগরণ মঞ্চ গঠিত হয়েছিল, কি উৎসাহ নিয়ে আমি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাথে কাজ করে গেছি, তোর সেই অগ্নিকন্যাকে ঠিক জায়গামত পৌঁছে দিয়েছি, সংবাদ পেয়েছি, ওর মায়ের সম্ভ্রম নষ্টকারী রাজাকারের বিরুদ্ধে ও মামলা করেছে। কোথা দিয়ে কি হয়ে গেলো, এত কষ্টের অর্জন বুঝি নষ্ট হয়েই যাচ্ছে।
-কিছু মনে করিসনা পারমিতা, তোর হাসু আপার দোষ কিছু কম নয়। এত কিসের পুতু পুতু যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে? সবার বিরুদ্ধেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যেখানে আছে, তারপরেও তাদের ফাঁসীর দড়িতে না লটকে সমস্যা বাঁচিয়ে রেখেছে।
-তুই এভাবে কথা বলিসনা। এত কিছু করার পেছনে অনেক কারণ আছে, হাসু আপার নিজের দলেই বহু রাজাকার ঢুকে গেছে, লোম বাছতে কম্বল উজাড় হওয়ার যোগাড় হয়েছে এখন। আর আমেরিকার নীতিও বুঝিনা, দ্রোন দিয়ে নিজেরা যখন যাকে ইচ্ছে মেরে ফেলছে, অথচ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বেলায় মানবাধিকার ফলাচ্ছে।

-তোর ভাই কি স্বপ্ন দেখেছে? আচ্ছা, তোর ভাই কোন দলের বুঝেছিস কিছু? কোন ফাঁদে পা দিচ্ছিস নাতো আবার! তুই যা সরল সোজা মানুষ, তোকে যে কেউ ভুলভাল বুঝাতে পারে।
-হা হা হা! আমি সরল মনের মানুষ এটা যারা বুঝতে পারে, তারা তখন আর ঠকানোর চেষ্টা করেনা। কারণ সরলকে ঠকিয়ে মজা পাওয়া যায়না। আমার ভাই কোন দলকে সাপোর্ট করে জানিনা, আমি জিজ্ঞেসও করিনি। তবে একদিন ও আমাকে বলেছিল, “ দিদি, আমি হাসিনা বা খালেদা নিয়ে মাথা ঘামাইনা, তুমি সব সময় হাসিনার পক্ষে বায়াসড লেখা লিখো, এটা আমি খুব একটা পছন্দ করিনা। কিন্তু তোমাকে আমি দিদি বলে জানি, কেন জানো? তুমি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। আমি তোমার স্ট্যাটাস, গল্প, নানা ধরণের লেখা পড়ে এটুকু বুঝতে পেরেছি, তুমি সত্যি সত্যি দেশের মঙ্গলের জন্য ভাবো, তুমি মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ।
-বুঝলাম তো, তোকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে তোর পেট থেকে কথা বের করতে চায়। টের তো পাওনা, আমি জানি, আমাদের চারদিকে এখন স্পাই ঘুরে। কে কোন স্বার্থে ঘুরছে, কে জানে!
-মানসী, মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। শুধু তুহীন কেন, ফেসবুকে আমাকে সবাই জানে, পুরা বাংলা পাগল এক মানুষ হিসেবে।

-তুই তো ফেসবুক অ্যাডিক্টেড, কাউকে চিনিসনা, বন্ধু বানিয়ে ফেলিস। দেখা যাবে , বন্ধুর বেশে শত্রু ঢুকে গেছে।
-শত্রু ঢুকবে কি রে! আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, বামদল, জামাতী সব ধরণের মানুষই আছে। আমি তো তাদের কাউকেই আমার শত্রু ভাবিনা, সবাইকে নিজের ভাই ভাবি।
-থাক তোর ভাই কাহিনী শুনতে চাইনা, মন খারাপ কেন, তা বল।
-মন খারাপের কারণ তুহীন আমাকে নিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে, আমি স্বপ্নটার মানে খুঁজছি, মানে ধরতেও পারছি, কিন্তু শেষ মেলাতে পারছিনা।
-তুই এমন ত্যানা প্যাঁচাচ্ছিস কেন? তুই কি আমার কাছে চিঠি লিখতে বসছিস নাকি যে এত কথা বলছিস?
-মানসী, তুই ‘ত্যানা প্যাঁচানো’ টার্মটা কোথায় শুনেছিস?
-যেখানেই শুনে থাকি, তুই আসল কথা বল। তুই স্বপ্নের কথা বল, দেখি আমি মানে ধরতে পারি কিনা।

-তুহীন আমাকে ফেসবুকে যা লিখেছে, হুবহু বলি, “ আজকের সকালের স্বপ্নটা আমার মনটাকে এখনো বিষন্ন করে রেখেছে... তোমাকে হারাতে দেখলাম কেন?... দেখি, তুমি আমি একটা বিলের পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি... ভেল দিয়ে কিছু মানুষ মাছ ধরছে... তুমি এগিয়ে গিয়ে দেখতে চাইলে, কি মাছ ধরেছে... দেখে মন খারাপ করলে, জেলের ঝোলায় অল্প কটা ছোট ছোট মাছ দেখে... বললে, আমেরিকায় এর চেয়েও বড় মাছ পাওয়া যায়... আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তোমাদের আমেরিকার কথা বাদ দাও / একবার দেখি কিসের যেনো হৈচৈ হট্রোগোল... দেখি বিলের পাশের রাস্তা দিয়ে একদল লোক লাঠি বল্লম মশাল হাতে শ্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে... তুমি ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়লে ... আমি তোমাকে অভয় দেয়া চেষ্টা করে বললাম, 'ও কিছু না দিদি, তুমি ভয় পেয়ো না... আজকাল মানুষ ছুতানাতায় হাতে লাঠি বল্লম নেয়' ...... তোমার মুখ থেকে চিন্তার রেখা সরেনি, বুঝতে পেরে, আমি তোমাকে আরো অভয় দিতে আমার হাত ধরতে বললাম... তুমি ধরলে... আমি তোমাকে বললাম, তোমার এখন আর কোনো চিন্তা নেই দিদি... তুমি আরো শক্ত করে আমার হাত ধরলে... এভাবে কিছুক্ষন হাঁটছিলাম, ... একসময় তুমি বিলের পানিতে শাপলা দেখে আমাকে বললে, 'আমাকে দুটা শাপলা এনে দে না, ভাইটি' ... আমিও তোমাকে পাড়ে দাঁড় করিয়ে বিলের পানিতে নেমে গেলাম ... ওমা শাপলা নিয়ে উঠে দেখি তুমি নাই সেখানে দাঁড়িয়ে... আমার সেই কি ছুটাছুটি ... একবার জেলেদের কাছে যাই... একবার লাঠি বল্লম হাতে রাস্তার মানুষদের কাছে যাই... কেউ কিছু বলতে পারে না... হায়রে স্বপ্নের ভিতর আমার সেই কি কষ্ট... কষ্টে কষ্টে ঘুম ভেঙ্গে গেলো... কিছু কিছু স্বপ্ন ভঙ্গ হলে স্বস্তি লাগে... আমিও একটা স্বস্তি ফীল করলাম ... ভগবান আমার প্রাণের দিদিকে নিরাপদে রাখুক...
এর উত্তরে আমি বলেছি,
তুহীন, স্বপ্নটা পুরাপুরিই অর্থবহ! স্বপ্নে যে হাত ধরেছো, তা ছেড়োনা। আমার আসলেই ভীষণ ভয় করে। কি জানি আছে কপালে। ভালো থেকো, একমাত্র মৃত্যু নাহলে আমি হারিয়ে যাবনা।
তুহীন তখন উত্তর দিয়েছে,
“একমাত্র মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছুই আমার হাত থেকে তোমাকে ছাড়াতে পারবে না, দিদি... তোমাকে আমি এর মধ্যে না দেখেই অনেক ভালোবেসে ফেলেছি দিদি... আমাকে মানুষ ভালো বলুক- কি মন্দ বলুক, আমার ধর্ম থাক-কি যাক... তোমাকে আমি যে স্থানে বসিয়েছি সেখান থেকে তোমাকে কেউ সরাতে পারবে না... শুধু হাত ধরে থাকা না, দরকার হলে তোমাকে আমি বুক পেতে নিরাপদে আগলে রাখবো, দিদি ...”
আমি বলেছি, “আমি সেটি জানি”
তুহীন বলে, কিভাবে জানো, দিদি? এতটা বিশ্বাস রাখলে কি করে?
আমি বলেছি, বিশ্বাসই আমার একমাত্র পুঁজি, বিশ্বাস করি বলেই পাই বেশী, হারাই কম
-তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা যেনো রাখতে পারি...
-তুহীন, তুমি এভাবে কথা বলো যেন যুদ্ধের ময়দানে নেমেছো
হাহাহাহাহাহহাহা!
-যুদ্ধ অবধারিত দিদি... পিশাচ রাজাকাররা মরণ কামড় দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে... ওদের এমনি এমনি নির্মূল করা যাবে না... আরেকটা যুদ্ধ যে আমাদের করতে হবে দিদি..
-সেটিই তুমি স্বপ্নে দেখেছো, তুহীন আসলে নিজের অজান্তেই আমি দেশপ্রেম নামক এই ভয়ানক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছি, তুমিও দেশপ্রেমিক সৈনিকের চাকুরী করছো। তাই আমাকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখেছো।তবে যুদ্ধ একটা ঠিকই হবে। দেশ এখন চরম অস্থিরতায় পৌঁছেছে। এভাবে চলেনা, যে কোন একটা ডিসিশানে আসতেই হবে, হয় আফগানিস্তান, নয় সোনার বাংলা।
-সোনার বাংলার জন্ম দিতে যে যুদ্ধ করতে হয়েছে, তার চেয়েও কঠিন যুদ্ধ আমাদের সামনে
- কি হবে? আর্মীতে কি জামাতীর সংখ্যা বেশী? দেশে এতবড় অরাজকতা শুরু হবে, আর্মী কিছুই করবেনা?
-আর্মিতে জামাতীর সংখ্যা বেশী না কম, সেটা কোনো ফেক্টর না... কট্টরপন্থী থাকেও যদি কিছু সেই সংখ্যাও খুবই নগন্য বলেই আমার ধারণা... বিষয়টা মোটেও সেখানে না...আর আর্মি কিছু করুক, সেটা কেনো চাও... সেটা মোটেও গণতান্ত্রিক কোনো পন্থা না... দেশের জনগণকেই গণতন্ত্র রক্ষায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে...
মানসী, এবার তুই বল, আমার মন খারাপ হওয়ার কারণ ঘটেছে কিনা! গণজাগরণ মঞ্চ ব্যর্থ, যুদ্ধপরাধী বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছেনা, বিরোধী দল নির্বাচনে আসতেই চাইছেনা, তারা জেদের বশেই যেন জামাতীদের সাথে সঙ্গ নিয়েছে, কীভাবে জ্বালাও-পোড়াও করছে, সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত ঘরের মানুষগুলো নিশ্চিন্ত হতে পারছেনা, এদিকে আওয়ামীলীগও সবকিছুতে কেমন একটা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। ----
-তুই ভয় পাচ্ছিস কেনো? তুই তো আর রাজনীতি করিসনা!
-ভয় করি আমাকে নিয়ে নয়, বাংলাদেশকে নিয়েই আমার ভয়। আমি আমেরিকায় থেকে যাব, আমার তো কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু দেশের মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে দ্যাখ! ভেবে দ্যাখ, পঁচিশ বছর আগেও কি পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ ছিল? তখন কি পথে বের হলে বোমা, গুলী খেয়ে মরে যাওয়ার আশংকা ছিল? তুই, আমি দুজনেই একা একা সারা ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছি, আর আজ তাপসীকে দেশে পাঠাতে তোকে দশবার ভাবতে হচ্ছে, কেন ভাবতে হচ্ছে? সেদিন অতুল আমাকে মেসেজ করেছে, “পিসী, হোস্টেলে বসে আছি, বাড়ী যেতে পারছিনা। গত সপ্তাহে আমার বন্ধু দীপ্ত’র বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। আমার খুব ভয় করছে। বাবাকে ডাক্তার দেখানো দরকার, কিন্তু হরতালে সব বন্ধ”।

-পারমিতা, সব জেনেও আমি তাপসীকে দেশে পাঠাতে চাইছি। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
-তাপসীকে পাঠানো ঠিক হচ্ছে কিনা, বুঝতে পারছিনারে! তুহীনের কথা শুনে বুঝতে পারছি, সামনে অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। হয়তো তুহীন আদতেই এই স্বপ্ন দেখেনি, কিন্তু আমাকে স্বপ্নের কথা বলে সতর্ক বার্তা দিতে চাইছে। ওদের তো আর্মির চাকুরীতে এমন সতর্ক বার্তা, কোড ব্যবহারেই কাজ চালাতে হয়। কোনকিছুই খোলসা করে বলেওনা। এই যে দ্যাখ, আমরা ভাবি, মিলিটারী নামিয়ে দিলেই পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে যাবে, কখনও ভাবি, মিলিটারী বোধ হয় শাসন ক্ষমতা নেয়ার জন্য বসে আছে। কিন্তু তুহীন তো বলেই দিল, সব কিছুতে আর্মিকে ডাকা কেন? মানে কি? আর্মি নামবেনা। বাংলাদেশের মানুষ এখন একমাত্র আর্মি ছাড়া আর কারো উপর ভরসাও করতে পারেনা।

-গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে নাকি? তাপসী তো বেড়াতে যাবেনা, কেয়ার’ এর একটি ইন্টার্নশীপ প্রোগ্রামে যাচ্ছে। আমেরিকান দূতাবাসে রিপোর্ট করে রাখলেই তো হয়। তুই কি বলিস! কবীরকে মানাতেই পারছিনা। অথচ কেয়ারের হেড কোয়ার্টারে আরও কয়েকজন এলিজিবল স্টুডেন্ট থাকার পরেও এই প্রোগ্রামটা তাপসীকে দেয়া হয়েছে। এর আগেরবার তাপসী নেপালে কাজ করে এসেছিল, ওর কাজের আউটকাম খুবই ভাল, তাই ওকে এই সুযোগ দেয়া হয়েছে।
-এক কাজ কর, তাপসীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জানুয়ারীতে দেশে যাব। কাউকেই জানাবোনা, গিয়ে উপস্থিত হবো। তাপসী আমার সাথে থাকলে তোর চিন্তা কম থাকবে।
-পারমিতা, এক কাজ কর, তোর ভাইকে বল, তোদেরকে যেন এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে নিয়ে যায়।
-হা হা হা! কেন, তুহীনকে বলতে হবে কেন? দেশটা তো আমারও, নিজের দেশে যাব মিলিটারী পাহারায়! দরকার হলে যাব না, কিন্তু এভাবে চোরের মত, ভীতুর মত যাব না। আরেকটা কথা শোন, তুহীন কিন্তু আমাকে নিজ থেকে খুঁজে নিয়েছে, দেশের প্রতি আমার যে টান, এই টানই ওকে আমার সাথে যোগাযোগ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এটা আমার ভাষ্য নয়, তুহীনের ভাষ্য। সেই আমি যদি তুহীনকে বলি, এয়া্রপোর্টে এসে আমাদেরকে এসকর্ট করে নিয়ে যেতে, ও তো অবাক হয়ে যাবে।
-আরে! আমি ভয় পাইনা, কবীরের জন্য বলেছি।
-তাপসী কি বলে?
-তাপসী তো হয়েছে আমার মতই লাফানী। পারলে সে আজকেই চলে যেতে চায়। তুই হচ্ছিস ওর আইডল। বহ্নিশিখার জন্য তুই যা কিছু করেছিস, তাপসী তা নিয়ে তো খুবই উচ্ছ্বসিত। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য তাপসীর আগ্রহই বেশী, আমার তো মায়ের মন, একটু ভয় তো থেকেই যায়। আজ যদি ও শোনে, পারমিতা মাসীও যাচ্ছে, তাহলে ওকে আর আটকায় কে?
-মানসী, দে পাঠিয়ে তাপসীকে। বুকে আগলে রেখে লাভ নেই। দেশটার বড়ই দুঃসময়, এই সময়ে আমরা সবাই যদি নিরাপদ দূরত্বে থাকি, দেশকে বাঁচাবে কারা? তাপসী মামনিটা কত ভাল হয়েছে, সত্যিই তো, আমেরিকায় লেখাপড়া শিখে নিজের জ্ঞাণ দেশের দুঃখী, অসহায় মানুষের কাজে লাগাবে, এর চেয়ে আনন্দের আর কি আছে। কারো সাহায্য নিতে হবেনা, দেশমাতা নিজেই তার ভবিষ্যত প্রজন্মকে আগলে রাখবে।
-আমি তোর ভাইয়ের স্বপ্নের মানে ধরে ফেলেছি।
-হা হা হা! কি বুঝলি?
-স্বপ্নের দুটি দিক, একদিক বলছে তোর দেশপ্রেমের কথা, গোলাপ, গ্ল্যাডিওলাসের রূপে নয়, তুই এখনও মুগ্ধ হতে পারিস বিলে ফুটে থাকা শাপলার দিকে তাকিয়ে, এখানে তোর দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে। চারদিকে তীর-ধনুক, বল্লমের আগ্রাসী আক্রমন মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির আস্ফালন, সেই আস্ফালন থেকে তোকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে তোরই ভাই, মানে কি? দেশের যে কোন বিপদে, বাংলা মায়ের ছেলেরা ঠিকই বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে, দেশকে রক্ষা করবে। প্রতীকী হিসেবে যদি দেখিস পুরো ব্যাপারটিকে, বল্লমধারীরা শত্রু, তুই বাংলা মায়ের শ্যামল-সবুজ মেয়ে, তোকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, অভয় দেয়ার জন্য তুহীন তোর হাত ধরেছে, তুই জেলের খলুইয়ে অল্প মাছ দেখে মন খারাপ করেছিস, দুঃখ করে বলেছিস আমেরিকায় এর চেয়ে অনেক বড় মাছ পাওয়া যায় মানেই দেশের দুঃখী মানুষের জন্য তোর অসীম মমতা, শাপলা চেয়েছিস মানেই জাতীয় ফুলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছিস, ভাই তার বোনের আবদার রাখতে বিলের পানিতে নেমে গেছে, বোনের জন্য শাপলা তুলে এনেছে। তার মানে, বোনের জন্য ভাই সব করতে পারে।

-আর শাপলা হাতে এসে যখন আমাকে আর কোথাও দেখতে পেলোনা, তার কি মানে?
-পজিটিভ ভাবলে পজিটিভ, নিগেটিভ ভাবলে নিগেটিভ। প্রথমে নিগেটিভই ভাবি, তুই বিপদে পড়েছিস, কেউ তোকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, তা সে দুর্বৃত্তই হোক আর মৃত্যুই হোক। আর পজিটিভ যদি ভাবি, তাহলে বলবো, ছোট ভাইয়ের সাথে তুই লুকোচুরী খেলেছিস, অনেকটা অপু আর দুর্গার মত! গ্রামের অবারিত মাঠ, শালুক ফোটা বিল, দুই ভাই বোন, এই তো লুকোচুরী খেলার অবারিত সুযোগ, শৈশবে ফিরে যাওয়া।
-তোর পজিটিভ ভাবনাটিই আমি নিতাম, কিন্তু পজিটিভ ভাবনাতেও তুই নিগেটিভ মিশিয়ে দিলি! পজিটিভ আর নিগেটিভের তফাৎটুকুও বুঝলিনা!
-কীভাবে নিগেটিভ মিশালাম?
-অপু আর দুর্গার কথা বলে, দুর্গা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেছিল! আমার তুহীন ভাইটি সত্যিই অপু, তাই দুর্গা দিদিকে হারিয়ে ফেলে এত দিশেহারা হয়ে গেছে। তবে পজিটিভ দিক হচ্ছে, আমার ভাইটির কোমরে পিস্তল গোঁজা থাকবে, শত্রু নিধন করবে, তবুও দিদিকে সহজে হারাতে দিবেনা।
-হা হা হা হা! পারমিতা, তুই খুব খেয়াল করিস কথাবার্তা, আমি নিজেও খেয়াল করিনি দুর্গার হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি! কেমন টপ করে ধরে ফেললি। যাক, আমি আজ কবীরের সাথে কথা বলবো। তোর সাথে গেলে নিশ্চয়ই তার আর কোন আপত্তি থাকবেনা।
-ঠিক আছে, আমাকে জানাস। আজ তাহলে রাখি, রান্না বসাতে হবে। ভালো থাকিস, চিঠি লিখবো।
-হ্যাঁ, তুইও ভালো থাকিস, তোর ভাইকে আমার ভালোবাসা জানাবি। দাদার দিকে খেয়াল রাখিস। আমিও চিঠি লিখবো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুন ম. আজিজ অনেক কিছু উঠে এলে দিদির দীর্ঘ গল্পে। ...ইতিবাচক এবং নেতিবাচক বর্ণনার বিস্তৃতি ভালো লেগেছে যুগপৎ.....একদম প্রবাসী লেখকের উপযুক্ত লেখাবটে।
সূর্য চিন্তার আর চেতনার অমিল অনেক সময়ই মানুষকে অস্থির করে তোলে। পারমিতার প্রথম আমেরিকা যাবার সময়টা ভাবলেও কথাটা মিলে যাবে। এক সময় চিন্তায় চেতনায় মিলের মানুষ এ অস্থিরতা ভুলিয়ে দেয়। যে কোন একটা পক্ষে অবস্থান করলে ন্যায় অন্যায় আপেক্ষিক হয়ে যায় যদি সে দলগুলোর নিজস্ব কোন স্বকীয়তা না থাকে। আমাদের দেশের বড় দলগুলো নেতানেত্রী ছাড়া বিশেষ কিছু পার্থক্য নেই। তবে এ টার্ম গণজাগরণ মঞ্চ একটা পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। হ্যা দিদি তুহিনের মতো লক্ষ লক্ষ তরুণ এখনো বেঁচে আছে ন্যায়কে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য। বাস্তবতার মিশেলে দারুন হয়েছে কিন্তু গল্প।
ছন্দদীপ বেরা ওরে বাস ! খুব সুন্দর ।
এশরার লতিফ চমৎকার দেশপ্রেমের গল্প, খুব ভালো লাগলো।
মোঃ মহিউদ্দীন সান্‌তু মন্তব্য করার মত যোগ্যতা এখনো হয়নি,শুধু এটুকু বলবো আপনার জন্য রইল অনেক অনেক দোয়া। ভালো থাকবেন :)
Kala Manik এমন দেশ প্রেমিক দিদির জন্য সব ভাইরাই কর্নেল ভাইয়ের মত সু রক্ষা দিবে বলে আশা করি । সময়োপযোগী সাহসী গল্প ।
তানি হক দিদি আপনার পক্ষয়েই এই সাহসি গল্প লিখা সম্ভব ... রাজনৈতিক ... কঠিন বাস্তবতা আর নিষ্পাপ ভালবাসায় মোড়ানো গল্পটি ... অসাধারণ ভাবে আমাদের কাছে উপস্থাপন করলেন ... আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।। পারমিতাকে আবার ও পেয়ে আনন্দিত হলাম । ভালো থাকবেন । সব সময়
সহিদুল হক গল্পের বাধুনি চমত্কার ! খুব ভাল লাগলো ! শুভ কামনা !
আতিক সিদ্দিকী ---যেতে দিচ্ছি কই, ভোট দিলামতো,লেখার সাথে মিশে যেতে হবে এবং আপনাকে দিয়ে হবে,ভালো থাকবেন আশা করি.
মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ বোন হাসালেন কাঁদালেন
বোন নিজেই তো হাসি-কান্নার দোলাচলে দুলছে, অনেক ধন্যবাদ ভাই।

১৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪