এক
আজ শাহবাগ আন্দোলনের নবম দিন। আমি দাঁড়িয়ে আছি প্রজন্ম মঞ্চ থেকে হাত দশেক দূরে। মঞ্চে উপস্থিত তরুণ-তরুণীরা মুহূর্মুহূ শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে। আমার সামনে মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। গত কয়দিন ধরেই সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। লাকী আর মুক্তা নামের দুই তরুণীকে প্রতিদিনই দেখি, ক্লান্তিহীনভাবে শ্লোগান দিয়ে যায়। কখনও মঞ্চে দাঁড়িয়ে, কখনও বা জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে। ওদের পাশেই থাকে আরও অনেক তরুণ-তরুণী। এখন অবশ্য মঞ্চের উপর দুই একজন নামী-দামী মানুষের উপস্থিতিও দেখতে পাচ্ছি। এতদিন তাঁরা কোথায় ছিলেন কে জানে! চারদিক থেকে মুহূর্মূহু শ্লোগান উঠছে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, শ্লোগান উঠছে রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশের পক্ষে। শ্লোগান চলছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার শপথে। তাদের একটাই দাবী, রাজাকারের ফাঁসী চাই। মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’, “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা, যমুনা”র সাথে সুর মেলাচ্ছে চত্বরে আসা সকল জনতা। প্রতিদিনই নতুন নতুন শ্লোগান তৈরী হচ্ছে, নতুন ধরণের শ্লোগান শুনে খুব মজা পাচ্ছে চত্বরের লোকজন।
কী সুন্দর করে বর্ণমালা দিয়ে শ্লোগান তৈরী করছে ওরা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারী বলেই হয়তো বর্ণমালা দিয়ে শ্লোগান সাজাচ্ছে। যদিও বর্ণমালা দিয়ে সাজাচ্ছে শ্লোগান, তবে শ্লোগানগুলোতে বেশ ‘জঙ্গী’ জঙ্গী’ ভাব আছে! যেমন, কাদের মোল্লার ফাঁসী চেয়ে শ্লোগান দিচ্ছে, “ ক-তে কাদের মোল্লা, ফাঁসী চাই, ফাঁসী চাই”। প্রতিটি শ্লোগানের সাথে সাথে আমার শরীরেও বিদ্যুত খেলে যাচ্ছে, শিহরণ টের পাচ্ছি। বার বার মনে হচ্ছে, ওদের সাথে আমিও গলা মেলাই। কিন্তু কেমন যেন আড়ষ্ট লাগছে! শত হলেও বয়সটা তো আর বশে নেই, কিশোরী মেয়ের বাবা, মেয়ের মত করে তো আর লাফালাফি করার বয়স নেই। কিন্তু মন মানে না। এইজন্যই অফিস ছুটি হতেই চলে আসি এই তরুণদের কর্মযজ্ঞ দেখতে। গত নয় দিনের প্রতিটি দিন আমি বিকেল হলেই শাহবাগ চলে আসি। রাত এগারোটা পর্যন্ত থাকি। কিছুই করি না, শ্লোগানও দেই না, শুধু উপস্থিত থাকি। ভালো লাগে, শরীরে বিদ্যুত খেলে যায়।
আমি জন্মেছি এক দুঃখী সংখ্যালঘু পরিবারে, বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে, অন্ধের যষ্ঠী। ছেলেবেলায় বাবা মায়ের চোখের আড়াল হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। জীবনে অনেক হারিয়েছেন বলেই তাঁদের সমস্ত মনোযোগ আমার উপরে ঢেলে দিয়েছেন। তাঁরা বুঝতেও পারেন নি, এতে করে আমার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় নি, মেধাবী হলেই যে সব সার্থক হয় না, এই ব্যাপারটি হয়তো বা উনাদের বোধে আসেনি। বাবা মায়ের অধীনে থাকতে হতো বলেই বোধ হয় মনের গভীরে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। কিন্তু বিদ্রোহ করার মত পূর্ণ স্বাধীনতাটুকুও আমার ছিল না।
বুয়েটে ভর্তি হয়ে যোগ দিতে শুরু করি সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন মিছিলে। বাবা-মাকে লুকিয়ে মিছিলে যেতাম, শ্লোগান দিতাম, গলা চিরে শ্লোগান দিতাম। সাম্প্রদায়িক এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মনের ভেতর একটা রাগ পোষা ছিল। সব সময় মনে হতো, সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবো। খুব বেশীদিন পারিনি মিছিলে যেতে। একেকদিন ছাত্র আন্দোলনের তাজা খবর পেয়েই বাসা থেকে সমন জারি হতো, অতি দ্রুত বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য। আমিও মাথা নীচু করে বাসায় ফিরে মায়ের আঁচলের নীচে মুখ লুকাতাম। কী করবো, বাবা মায়ের ভয়কেও অগ্রাহ্য করতে পারতাম না।
এরপর আর দশটি সাধারণ গেরস্তবাড়ীর লক্ষ্মীছেলের মত আমিও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরেই চাকুরীতে ঢুকে গেলাম, রোজ সকাল-বিকেল অফিস করতে করতে একসময় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করে দিব্বি সংসার পেতে বসলাম। বিয়ের আগে ছিলাম বাবামায়ের ইচ্ছের অধীন, বিয়ের পর হলাম বউয়ের অধীন। ছেলেদেরও যে বিয়ের আগের জীবন আর বিয়ের পরের জীবন বলে কিছু থাকে, তা আর প্রকাশ করা হলো না। মাঝে মাঝেই আমার স্ত্রী সুর করে বলে “ইস! বিয়ের আগের জীবনটা কত স্বাধীন ছিল, বিয়েটা করেই যেন সংসার শেকলে বন্দী হয়ে গেছি”। ওকে বলি কী করে, “ তোমারতো তাও বিয়ের আগে স্বাধীন জীবন ছিল, আমারতো তাও ছিল না”।
আজ বুকের ভেতর খুব অস্থিরতা টের পাচ্ছি। একজনের মুখ খুব বেশী করে মনে পড়ছে, তিনি আমার সুন্দর ঠাকুমা, সম্পর্কে আমার বাবার খুড়ীমা। চার বছর আগে আমাদের ছেড়ে শান্তির দেশে চলে গেছেন। বয়স হয়েছিল উনার, প্রায় আশির কাছাকাছি। কিছুটা ছিটগ্রস্ত ছিল, ঠিক ‘পাগল’ বলা যাবে না, আবার সম্পূর্ণ সুস্থও বলা যাবে না। এলোমেলো মাথায় বারবার বলতেন, “ঠাকুর, এই পরাধীন জীবন আর ভাল লাগেনা, আমারে লইয়া যাও, তোমার চরণে ঠাঁই দেও”। ছোট ছিলাম বলে স্বাধীন বা পরাধীনের পার্থক্য বুঝতাম না। ঠাকুমাকে দেখেছি, আমাদের মত করেই ভাত খায়, ঘুমায়, স্নান করে, তাহলে আবার স্বাধীনতা চায় কেন? এটুকু বুঝতাম, ঠাকুমা আমাদের মত সব কাজ করলেও উনার মনে অনেক দুঃখ। মাথা গরম হলেই ভগবানের কাছে নিজের মৃত্যু কামনা করতেন আর কেঁদে কেঁদে নিজের মনেই বিড় বিড় করতেন,
“কী যে কইল সবাই, দ্যাশ স্বাধীন হইব, দ্যাশ স্বাধীন হইব। স্বাধীন ত হইছেই দ্যাশ, কই আমার পুনি ত ফিরা আইয়ে নাই, যত সব মিছা কথা। ঐ যে রহমইত্যার ঘরের দরজা থিকা এক ধাক্কা দিয়া মাইয়াটারে বাইর কইরা দিল, তারপরেই ত শ্যাখের দল আইয়া আমার মাইয়াটারে টাইন্যা লইয়া গেল, মাইয়াটা কী জোরে জোরে কানতেছিল, বাঁচাও বাঁচাও করতেছিল, ওরে পুনি রে! আমি ত তরে বাঁচাইতে পারলাম না, তোর মায়ের লগে দেখা হইলে কী জবাব দিমু, মারে! আমারে এমুন কইরা দোষের ভাগী কইরা গেলি তুই!”।
মাঝে মাঝে আমার বাবা হয়তো বা ধমকে উঠতেন,
“সুন্দর খুড়ী, এগুলি কী বলেন? আপনাকে কত বার কইছি, মাইয়া আপনের স্বর্গে আছে, শান্তিতে আছে, এইভাবে কাইন্দেন না। মাইয়াটার আত্মা কষ্ট পাইব। আরেকটা কথা, আপনি বার বার নামে গন্ডগোল করেন, আপনে ‘পুনি’ নাম কইরা বিলাপ করেন ক্যান? রায়টের সময় ‘ময়নারে ধইরা নিছিল, পুনিরে না। সেইটা তো ’৬৪ সালেই শেষ হইয়া গেছে। এখন আর পুরান দিনের কথা ভাইবা বিলাপ কইরেন না। দেশ স্বাধীন হইয়া গেছে, এখন আর হিন্দু, মুসলমান বইলা আলাদা কইরা কিছু নাই। আমরা সবাই বাঙ্গালী। আর কোন সময় ‘শ্যাখ’ তুইল্লা কথা কইয়েন না”।
আমি বড়দের কথা কিছুই বুঝতাম না, আবার কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস হতো না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই সবাই বকা দিত, বড়দের কথায় থাকতে হয় না বলে। তবে এটুকু বুঝতাম, কোথাও কিছু গোলমাল আছে, আমি ছোট বলে আমাকে বলা হচ্ছে না।
পুনি পিসী হচ্ছে সুন্দর ঠাকুমার মেয়ে। বয়সে আমার চেয়ে প্রায় বারো বছরের বড়। এই পুনি পিসীর সাথে ঠাকুমা তার মৃত মেয়ে ‘ময়না’কে গুলিয়ে ফেলতেন। সুন্দর ঠাকুমার এই বিলাপ শুনতে শুনতেই আমরা বড় হয়েছি। একবার পুনি পিসীকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“ঠাকুমা এমন করে কান্দে ক্যান? তুমি কাছে গিয়ে বলতে পারো না যে তুমি বেঁচে আছ? আর স্বাধীন দেশের কথা কী বলে গো? দেশ তো স্বাধীন হয়েইছে, এখন আর নতুন করে কী স্বাধীন হবে”?
পিসী বলেছে,“লাভ নাই কইয়া, মায়ের মাথায় গোলমাল হইয়া গেছে, ময়না দিদির সাথে আমার নাম গুলায়া ফেলে”।
“ময়না পিসীর কী হইছিল, কেমনে মারা গেল”?
“তোর জন্মের আগের ঘটনা এইটা, পাকিস্তান আমলে ঘটছিল,’৬৪ সালে একবার রায়েট হইছিল, নোয়াখালী আর মিরপুর থিকা মুসলমানরা আইসা নারায়নগঞ্জে অনেক হিন্দুরে কাইটা ফেলছিল। শুধু ময়না দিদিই না ত, আমগো বাড়ীর আটজনরে মাইরা ফেলছিল। থাউক, আর কমু না, তুই ছোট, তোরে এগুলি বলা ঠিক না”।
“আমি ছোট না, ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমি কাউরে বলবো না। আমার জানতে ইচ্ছা করে”।
“আমার ময়না দিদি তখন পোয়াতী আছিল, নিয়ম আছে, প্রথম বাচ্চা বাপের বাড়ীতে হইতে হয়, ঐজন্যই দিদিরে মায়ের কাছে নাইওর আনছিল। রায়েটের সময় আমাগোর গ্রামে অ্যাটাক হইছিল তো, তখনই ময়না দিদি মারা যায়।
“পুরা ঘটনা কও”।
“তুই বুঝবিনা ত, তরে এগুলি বলা ঠিকও না, তোর মায় জানলে আমারে অনেক বকবো”।
“মায়েরে কিছু বলবো না, কিরা কাটলাম, কিচ্ছু বলব না”।
“শোন, ময়না দিদি আমার আপন বইন না, সৎ বইন। দিদিরে ছোট থুইয়া আমার বড়মা মারা গেছিল, তখন আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে। তোর সুন্দর ঠাকুমা হইতেছে আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। বুঝতে পারতেছিস?”
“হ্যাঁ, তুমি তাড়াতাড়ি আসল গল্প বলো, মা আইসা পড়লে আর বলতে পারবা না”।
“পুলারে! তুই বড় নাছোরবান্দা। কী জানি কোন বিপদে ফেলবি আমারে! বড় বৌদিরে আমি অনেক ভয় পাই। আসলে অনেক কষ্টের গল্প তো, ছোট মানুষের শুনতে নাই। কাউরে কইস না। রায়েট মানে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা। ’৬৪ সালে রায়েট হইছিল। অনেক দিন পার হইয়া গেছে, তখন তো পাকিস্তান আমল আছিল, এখন স্বাধীন দ্যাশে এইসব পুরানো কথা কেউ মনে করতে চায় না।
- ঠাকুমা যে মাঝে মাঝে রহমইত্যার কথা বলে, রহমইত্যা কে?
-গ্রামে আমাদের প্রতিবেশী আছিল রহমত চাচা। আমাদের কাকা জ্যেঠাদের সাথে উনার খুব খাতির ছিল। রহমত চাচা ছাড়াও আরও কিছু মুসলমান পরিবার ছিল আমাদের সজ্জন প্রতিবেশী। রায়েটের সময় হিন্দুরা যে যেভাবে পারছে মুসলমান প্রতিবেশীদের বাড়ীতে লুকাইছে। আমরাও দল দল ভাগ কইরা একেক বাড়ীতে গিয়া আশ্রয় নিছিলাম। ময়না দিদিরে আমার অন্য দুই কাকীমার সাথে পাঠানো হইছিল রহমত চাচার বাড়ীতে। দিদি মাত্র শ্বশুরবাড়ী থিকে নাইওর আসছে, সাথে অনেক গয়না আনছিল, সেগুলি পোঁটলায় কইরা লইয়াই চাচার বাড়ীতে গেছিল। আমার মায়ও তাদের পিছন পিছন রওনা দিছিল, কিন্তু কেমনে জানি একটু পিছনে পইরা গেছিল, ভিতর বাড়িতে ঢুকার আগেই কাছে পিঠে ‘নারায়ে তকবীর’ শুনতে পাইছে। আর কোন দিশা না পাইয়া ঐ বাড়ীর খড়ের গাদার পিছনে লুকায় পড়ছিল।
ঐখান থিকেই দেখতে পাইছে সব, একদল মানুষ চাচার বাড়ীর উঠানে আইসাই হিন্দুগোরে ঘর থিকা বাইর কইরা দিতে কইছে। ওগো হাতে আছিল দাও, কুড়াল, চাক্কু। ঘরের ভিতরে কী হইছে, সেইটা তো আর মায় দেখে নাই, শুধু দেখছে, পূব দিকের ঘর থিকা ময়না দিদি, আর দুই কাকীমারে ধাক্কা দিয়া বাইরে বাইর কইরা ঘরের দরজা বন্ধ কইরা দিতে। দিদি আছিল ভরা পোয়াতী, ধাক্কা সামলাইতে না পাইরা উঠানে পইরা গেছিল। দলের মাইনষেরা দিদিরে টানতে টানতে লইয়া গেছে, আর আমার দুই কাকীর চুলের মুঠি ধইরা নিতে দেখছে মায়। সবাই হাউ মাউ কইরা কানতেছিল, ছাইড়া দ্যান ছাইড়া দেন, আমরা মুসলমান, আমগোরে ছাইড়া দ্যান, করতেছিল। মায় আর স্থির থাকতে পারে নাই, খড়ের পেছন থিকা এক দৌড়ে ছুইট্টা বাইর হইছিল, চীৎকার কইরা কইছিল,
“অরা সবাই মুছলমান, অগোরে নিয়েন না। ও রহমত ভাইগো, আপনে কই আছেন গো, আমার মাইয়ারে লইয়া যাইতাছে গা ধইরা”।
রহমত চাচা মনে হয় বাড়ীতে ছিল না, থাকলে এই আকাম হইতে দিত না। যাই হউক, তিনজনরে লইয়া একদল সামনে গেছে, আরেক দল মায়েরে ধরছে।
হায় হায়, সুন্দর ঠাকুমারেও ধরছিল? ঠাকুমা কেমনে বাঁচলো?
-জানিনা, মায় মনে হয় ঐ মুহূর্তেই পাগল হইয়া গেছিল। মা’রে ‘পাগল’ কইয়া অরা ছাইড়া দিছে।
-তাই নাকি? কী কও, আশ্চর্য্য তো!
-হ, মায়েরে জিগাইছে, অই মাতারী, তুই হিন্দু না মুছলমান? মা কইছে, আমি মুছলমান, আমার ভাইয়ের বাড়ীতে বেড়াইতে আইছি।
আরেকজন জিগাইছে, তুই মুছলমান হইলে কলেমা ক। মায় ত কলেমা জানতো না, জবাব দিছে, কলেমা কি? আল্লাহ আল্লাহ? আমি ত আল্লাহ কইলাম।
তখনই একজন হাতের কুড়াল উঠাইছিল ঘাড়ে কোপ দেওয়ার জন্য।। কিন্তু মার কপাল ভাল, আরেকজন বাধা দিছে, কইছে, আরে! এই মাতারী পাগল। মাতারী মুসলমানই হইব, দেখস না পায়ে চামড়ার জুতা পইরা রইছে। এই ত মায় বাঁইচা গেছে”।
-চামড়ার জুতা মানে? হিন্দুরা জুতা পরতো না?
-না, গরুর চামড়া দিয়া জুতা বানায় ত, তাই হিন্দু মহিলারা চামড়ার জুতা পরতো না। বাড়ীর থিকা পলানের সময় কাকার চামড়ার স্যানডেল পইরা মনে হয় রওনা দিছিল।
-আইচ্ছা, ঠাকুমায় ত শুধু দেখছে, সবাইরে টাইন্যা লইয়া যাইতে, মারতে ত দেখে নাই। এমুনও ত হইতে পারে, তারা বাইচ্চা আছে, হয়ত বা ঐ লোকগুলির বাড়ীতে ঝিয়ের কাজ করতেছে।
-নাহ! ঐটা হইলে ত আর কোন কথা ছিল না। মানুষগুলি প্রাণে বাঁইচা আছে, এইটাও একটা সান্ত্বনা থাকতো। তিনজনের গলাকাটা লাশ পাওয়া গেছিল। দুই কাকীরে শীতলক্ষ্যার পাড়ে নিয়া জবাই করছে। ছোট খুড়ীর কোলে তার এক বছরের মাইয়া ছিল, ওরে শীতলক্ষ্যায় ছুইড়া দিছে। ময়না দিদির গলা কাটা লাশ পাওয়া গেছিল ধান ক্ষেতের আইলের পাশে।
আর কিছু শুনবি? আর কিছু জানিনা। ঐ ঘটনা দেখার পর থিকা মায়ের মাথায় গোলমাল দেখা দেয়।”।
-তুমি কই পলাইছিলা? আর এত কথা জানলে কীভাবে?
- গ্রামের মানুষেই কইছে, তারা না কইলে জানতাম কই থেকে? আমারে লইয়া সোনা জ্যেঠিমা ফটিক চাচার বাড়ীতে আশ্রয় নিছিল।”।
-তাইলে ত ফটিক চাচারা অনেক ভাল মানুষ। তোমগোর জীবন যে বাঁচাইল তারা, ওনাগোরে কোন পুরস্কার দেয় নাই দাদুরা?
-তাতো ঠিকই। দুনিয়ায় ভাল খারাপ সবই আছে। রহমত চাচা নিজে ভাল মানুষ, উনার পরিবারের মানুষরা এই কাজ টা করছে, চাচা বাকী জীবন অপমানে মুখ লুকায়ে থাকছে। সোনা জ্যেঠার হাত ধইরা অনেক কানছে। সোনা জ্যেঠা নিজে ফটিক চাচারে তিন বিঘা ফসলী জমি দান কইরা দিছে। যাক, এই কথা আর কারোরে শুনাইছ না, তাইলে কিন্তু আমারে মাইরা ফেলবো তোর বাবায়”।
দুই
পুনি পিসীর কাছে এই গল্প শুনেছি স্বাধীনতার অনেক পরে, ’৭৬ সালে। যখন সুন্দর ঠাকুমাকে ডাক্তার দেখানোর মত অবস্থা দাঁড়ালো।
একাত্তরে এতটাই ছোট ছিলাম যে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কোন আবেগ বা অনুভূতিই তৈরী হয় নি মনে। দুই একটা ঘটনা হয়তো স্পষ্টভাবেই মনে পড়ে, আবার অনেক কিছুই আবছা আবছা মনে পড়ে। এখনও মনে পড়ে, আমার হাত ধরে মা দৌড়াচ্ছেন, বাবার মাথায় একটা কাপড়ের বোঁচকা। ক্ষিদেয় পেট জ্বলতো, স্পষ্ট মনে আছে, একটা বিরাট বড় মাঠে অনেক অনেক মানুষ, দল বেঁধে বসে আছে, চুলা জ্বালিয়ে অনেকেই রান্না করছিল, আমি মায়ের আঁচল ধরে টানছিলাম আর বলছিলাম,
“মা, আমার ক্ষিদা লাগছে। ও মা, পেটের মধ্যে কেমন জানি জ্বলে”!
মা মুখটাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছিলেন। আমি তো জানতামনা, ওদের কাছে টাকা পয়সা ছিল না। গভীর রাতে নৌকায় করে একটা ব্রীজের (পরে জেনেছি, সি এন বি ব্রীজ) নীচে দিয়ে পার হওয়ার সময় কে যেন চেঁচিয়ে বলেছিল,“ সাবধান! মিলিটারী গাড়ী আসতেছে”। এই কথা শুনেই আমাদের সবাইকে নিয়ে বাবা নৌকার পাটাতনের নীচে ঢুকে গেছিল। কী কষ্ট হচ্ছিল, আমি সবার নীচে পড়ে গেছিলাম। আরেকটু হলে দম বেরিয়ে যেতে পারতো। বাবা শরীর ঝুঁকে চেপে বসেছিল, জামার বুক পকেট থেকে এক গোছা টাকা বোধ হয় তখনই নৌকার পাটাতনে পড়ে গেছিল। বাবা জানতেই পারেনি, কখন কোথায় টাকাগুলো পড়ে গেছে। এক ফাঁকে বোধ হয় মায়ের সাথে বাবার কথা কাটাকাটিও হয়ে গেছে। টাকার শোকে মা ‘নিমুরাইদ্যা পুরুষ’ বলে বাবাকে গালি দিয়েছিল। ‘নিমুরাইদ্যা পুরুষ’ কাকে বলে, তখন বুঝিনি, এখন এই মধ্য বয়সে এসে বুঝি, কী কঠিন গালি এটা! অন্য সময়ে বাবা কী করতো জানিনা, কিন্তু সেদিন মায়ের কথায় কোন উত্তর দেয় নি।
মায়ের কান্না দেখে আমি সাথে সাথে চুপ করে গেছিলাম। তার একটু বাদেই আমাদের সুন্দর ঠাকুমাকে একেবারে উন্মাদ অবস্থায় আমার বাবার সামনে নিয়ে আসা হলো। দুই কাকা দুই দিক থেকে ধরে রেখেছিল ঠাকুমা’কে। বাবা হচ্ছে গোষ্ঠীতে সবার বড়, তার সকল ভাই-বোনের চোখে ‘বড়দা’ হিসেবে পরিচিত। সুন্দর ঠাকুমা’কে বাবার সামনে এনে এক কাকা বললো,
“বড়দা, মায়েরে লইয়া কী করুম? কোনভাবেই বর্ডার পার হইতে চায় নাই। জোর জবরদস্তি কইরা কোনমতে বর্ডার পার করছি, বার বার খালি গ্রামে ফিরা যাইতে চায়। মিলিটারীর গুল্লী খাইয়া মরবো না?
ঠাকুমা একটা কথাই বার বার আওড়াচ্ছিল,
“আমি আমার ঘর ফালাইয়া কোনখানে যামু না। পুনি ফিরা আইব, আমারে বাড়ীতে রাইখা আয়”!
টাকার শোকে বাবার মন খারাপ ছিল, তার উপর মা বাবারে খোঁটা দিছে, তবুও বাবা সুন্দর ঠাকুমার মাথায় হাত বুলায়ে বলেছিল,
“খুড়ীমা, আমরা গ্রামের বাড়ীতে সবাই মিলেই যামু। গ্রামের বাড়ীতে থাকা তো এখন নিরাপদ না, যুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে, যুদ্ধ শেষ হইয়া যাইব, দেশ স্বাধীন হইব, স্বাধীন দেশে আমরা সবাই মনের আনন্দে থাকুম। এখন এমন পাগলামী কইরেন না, সময় খুব খারাপ। এত ছোট ছেলে মেয়ের সাথে এমন পাগলামী করলে ওরা কী করবো কন তো! সুন্দর কাকাও বাঁইচা নাই, এই এতিম ছেলেগুলারে আর কষ্ট দিয়েন না। চলেন আমরা সবাই আগে একটা নিরাপদ জায়গায় গিয়া পৌঁছাই, এরপরে এই বিষয়ে কথা কমু”।
সুন্দর ঠাকুমা শান্ত হয়ে গেছিল, নতুন প্রলাপ শুরু হয়েছিল,
“ভাসুরপো কইছে, দ্যাশ স্বাধীন হইলেই আমরা সবাই একসাথে বাড়ীতে থাকুম, আর কোনদিন বিহারীরা আইবো না, পুনিরে ফিরা পামু। ওরে আর কেউর বাড়ীতে পাঠামু না”।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটু একটু করে বড় হতে হতে সব জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঁচ মাসেরও বেশী সময় আমরা কলিকাতাতে ছিলাম। আমাদের এক দূর সম্পর্কের কাকার বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই কাকার আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে দুই বেলা রুটি আর ঝোলা গুড় যোগাড় করতেও কাকার দম ফুরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। আমি আটার রুটি দুই চক্ষে দেখতে পারতাম না, তার উপর রুটির মধ্যে বালি কিচ কিচ করতো। ভয়ের চোটে ক্ষিদে পেলেও কিছু বলতাম না। রুটি ছিঁড়ে কাকের দিকে ছুঁড়ে দিতাম। একদিন শুধু মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“মা, আমরা কী সারা জীবন এইখানে থাকব?”
-না বাবা, দেশ স্বাধীন হলেই আমরা দেশে ফিরে যাব।
-কবে হবে দেশ স্বাধীন?
-দেশ স্বাধীন করার জন্যই তো যুদ্ধ করছে মুক্তিযোদ্ধারা।
-দেশ স্বাধীন হলে কি আমরা আবার ভাত খেতে পারব?
-হ্যাঁ রে বাবা! ভাত খেতে পারবে। এত খাই খাই করো কেন? আমার আর ভালো লাগে না। এইখানে তোর কাকার কত কষ্ট হচ্ছে এতগুলি মানুষের খাওয়ার যোগাড় করতে। এর মধ্যে তুই একটাও রুটি দাঁতে কাটতে চাস না। এমন করলে আমার ভাল লাগে?
-মা, রুটি মুখে দিলে দাঁতে সিরসির করে, সারা শরীরে সিরসির করে।।
-এখন আর কয়টা দিন মুখ বুজে থাক, দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেই আমরা নিজেদের বাড়ী ঘরে ফিরে যেতে পারবো। তখন যত ইচ্ছে ভাত খাইস।
এই কলোণীতে আমার বাবার পরিচিত অনেক মানুষ থাকতো। রায়টের পরেই সবাই গ্রাম ছেড়ে দল বেঁধে চলে এসেছিল। তখন থেকেই এরা পাশাপাশি ঘর তুলে থাকতে শুরু করে। আমার সাথে মা যখন দেশ স্বাধীন হওয়ার গল্প করছিল, সুন্দর ঠাকুমা পাশের লাগোয়া ঘরের বারান্দায় বসে মাথা আঁচড়াচ্ছিল আর উকুন মারছিল। একটা করে উকুন মারে আর বলে,
“অ চঞ্চলের মা, পোলারে মিথ্যা কথা শোনাও ক্যান? দেশ স্বাধীন হইব না, আমার পুনি রে অরা ধইরা লইয়া গেছে গা, আমি অভিশাপ দিতাছি, আমার বুকে যেই আগুন জ্বলতাছে, সেই আগুন না নিভা পর্যন্ত কোন স্বাধীনতা নাই”
-সুন্দর খুড়ী, কি বলেন এইসব! স্বাধীনতা আসবে না বলেন কেন? স্বাধীনতা আনার জন্যই তো যুদ্ধ হচ্ছে। আপনার ময়নাকে যারা ধরে নিয়ে গেছে, তাদের সাজা দেয়ার জন্যই যুদ্ধ হচ্ছে। অন্তর থেকে আশীর্বাদ করেন যেন দেশ স্বাধীন হয়, আমরা যার যার বাড়ীতে ফিরে যেতে পারি। পরের অন্ন ধ্বংস করছি, মনটা খারাপ থাকে সব সময়। পোলাটা রুটি খেতে পারে না, এক মুঠ ভাতও যোগাড় করতে পারি না, অথচ দেশে গোলা ভরা ধান পড়ে আছে।
-হ, থাউক গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ! যেই খারাপ অরা, মুক্তিযোদ্ধারা অগো কিচ্ছু করতে পারব না। ইস রে, আমার চউক্ষের সামনে পোয়াতি মাইটার প্যাটের উপরে খাড়াইয়া লাফাইছে অরা! কত যন্ত্রণা দিয়া মারছে রে!!!!!
এমনটাই চলতো সারাদিন। আমি মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন আমার বাবা দৌড়াতে দৌড়াতে কলোণীর ভেতর আসছিল আর বলছিল,
“দেশ স্বাধীন হইয়া গেছে, দেশ স্বাধীন হইয়া গেছে! কই আমার সুন্দর খুড়ীমা কই, খুড়ীমা, আপনেরে বলছিলাম না? দেশ ঠিকই স্বাধীন হইব, ইয়াহিয়া পলাইছে, পাকিস্তানী মিলিটারী গো অবস্থা কাহিল কইরা ফালাইছে। সবাই শোন, এখন থিকা আর পাকিস্তান কইবা না, ভুলেও কইবা না, এখন থিকা নতুন নাম, ‘বাংলাদেশ। সুন্দর খুড়ীমা, আর চিন্তা নাই, এইবার যাব স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে”।
১৬ই ডিসেম্বার দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম ২৬শে ডিসেম্বার সকালে। কলোণীর অনেকেই বলেছিল,
“দেশে গিয়ে কাজ কি? আবার দৌড়াতে হবে। তার চেয়ে এখানেই থাকো, শান্তিতে থাকতে পারবে”।
বাবাকে আটকে রাখার সাধ্য কারোই ছিল না। বাবা প্রায়ই বর্ডার এলাকায় চলে যেত, খুব ইচ্ছে ছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার। কিন্তু আমাদের পরিবারে নারী ও কম বয়েসী কিশোর-কিশোরীর সংখ্যাই বেশী ছিল, সমর্থ পুরুষ বলতে একমাত্র আমার বাবাই ছিল। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেন নাই। মনের মধ্যে চাপা কষ্ট ছিলই। মাঝে মাঝেই বলতেন,
“দূর, এই পরাধীন জীবন আর ভাল্লাগে না। কবে যে দেশ স্বাধীন হইব!
তিন
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আমরা নারায়ণগঞ্জ শহরেই থাকতাম, পুনি পিসীরা থাকতো গ্রামের বাড়ীতে। দেশ স্বাধীন হতেই পুনি পিসীরা গ্রামের বাড়ীতে চলে গেল, আমরা শহরের বাড়ীতে ফিরে এলাম। প্রথম প্রথম মনে বেশ ফূর্তি টের পেতাম, কিছুই বুঝতাম না, তবুও বড়দের সাথে তাল মিলিয়ে বলতাম,
“এখন আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক”।
তখন সুন্দর ঠাকুমাও মোটামুটি সুস্থই ছিলেন। ময়না পিসীর জন্য বিলাপ করতেন না। এভাবেই ’৭৫ এর ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত চলছিল, ১৫ই আগস্ট সকা্লেই সব কিছু বদলে যায়। আরেকবার দেশে গজব নেমে আসে। গ্রামের বাড়ী থেকে খবর আসতো, সুন্দর ঠাকুমা আবার প্রলাপ বকা শুরু করেছে। ভুলভাল বলতো না অবশ্য, মুজিবররে মাইরা ফেলছে যারা, তারাই নাকি তার মাইয়ারে লইয়া গেছে!
ধীরে ধীরে গ্রামের হাওয়া পাল্টাতে শুরু করে। রহমত চাচার ছেলেরা মাতব্বর হয়ে উঠে। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে রহমত চাচার ছেলেরা আমাদের বাড়ীর টিনের চাল, কাঠের পাটাতন সবই খুলে নিয়েছিল, এত তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, তারা ভাবে নাই। বাবার জ্ঞাতি পুরুষেরা গ্রামে ফিরে নতুন করে সব গড়ে নিয়েছিল। কিন্তু ’৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাথে সাথেই সব উলট পালট হয়ে যায়। রহমত চাচা আরও অসহায় হয়ে পড়েন, ছেলেদের শাসনে থাকতে হতো বলে অন্যায় দেখেও চুপ থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর বছর খানেক পরেই উনিও মারা যান। মৃত্যুর আগে একদিন আমার বাবাকে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন দেখা করতে চান বলে, বাবাকে কাছে পেয়ে দুই হাত চেপে ধরে কেঁদেছিলেন। রায়টের সময় তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর বাড়ীতে আশ্রিত তিন নারীকে গয়নাগাঁটি রেখে বের করে দেয়া হয়েছিল, অসহায়ভাবে তাদের মৃত্যু হয়, ব্যাপারটি উনাকে অনেক মানসিক কষ্ট দিচ্ছিল, এটা বলার জন্যই ডেকেছিলেন। শেষ মুহূর্তে বাবাকে চমকে দিয়ে একটি পোঁটলা বাবার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন,
“আমার ময়না মায়েরে তো ফিরায় দিতে পারলাম না, তার গয়নাগুলি এই বাড়ীর সিন্দুকে আছিল, তোমার হাতে তুইলা দিয়া নিশ্চিন্তে মরতে চাই”।
বাবা উনার চাচার মাথায় হাত বুলায়ে বলেছিলেন,
“চাচা, আমাদের বিশ্বাসটাই ভাইঙ্গা গেছে যেখানে, সেখানে এই গয়না দিয়া কী হইব। আপনি আমারে ডাকছেন, বুড়া মানুষ এইভাবে কানতেছেন, পুত্রের অপকর্মের দায় নিয়া জ্বলতেছেন, এইটা দেইখা আমার একটুও সুখ হইতেছে না। কয়টা গয়নার লোভে ওরা তিনটা নারীরে এইভাবে পশুগো হাতে তুইলা দিছিল, এই গয়না ওদেরকেই দিয়া দেন। আপনে কাইন্দেন না, গত বারো বছর ধইরা দোজখের আগুনে পুড়তেছেন আপনি। আপনের বিরুদ্ধে আমাদের কোন নালিশ নাই”।
’৭৭ সালের দিকের ঘটনা, রহমত চাচার ছেলেরা এক রাতে আমার দুই দাদুকে ডেকে শাসায়, প্রাণে বাঁচতে চাইলে যেন উনারা বাড়ীঘর তাদের কাছেই বিক্রী করে দিয়ে ইন্ডিয়া চলে যায়। দাদুরা পালটা প্রশ্ন করতে সাহস পায় নি, কেন বাড়ীঘর বিক্রী করতে হবে। উড়ো খবর শুনেছে, আপোসে না দিলে নাকি বাড়ী জবরদখল করে নিয়ে যাবে।
সুন্দর ঠাকুমা আর পুনি পিসীকে নিয়ে তরুণ কাকা শাঁখারীবাজারের এক অন্ধকার গলিতে বাসা ভাড়া নেয়, সেখানে থেকেই আমার কাকা একটি বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনার চাকুরী চালিয়ে যায়। বাকী জ্ঞাতি-গুষ্ঠী এক কাপড়ে আগরতলা হয়ে কলিকাতা চলে যায়। রহমত চাচার ছেলেরা দুই দাদুকে আদৌ টাকা পয়সা দিয়েছিল কিনা, কেউ জানে না। কলিকাতা গিয়ে দাদুরা বেশীদিন বাঁচেন নি, আর সুন্দর ঠাকুমা ঢাকা এসেই পুরোদমে পাগল হয়ে যান। কাকার পকেটের জোরও তেমন ছিল না। তাই বড় ডাক্তার দেখানোর বদলে পাড়ার ডাক্তারের কাছ থেকে হোমিওপ্যাথির পুরিয়া, নাহলে মাদুলী, তাবিজ কবচেই চিকিৎসা সীমাবদ্ধ ছিল। আমার বাবাও খুব একটা সাহায্য করতে পারতেন না, উনারও তো একই অবস্থা, দেশের বাড়ীর সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেছে, শহরের ভাড়া বাড়ীতে থেকে সওদাগরী আপিসে কেরাণীগিরি করে কত টাকাই বা আয় করেন! জ্ঞাতি গুষ্ঠী কলিকাতা চলে গেলেও শুধু দেশের টানে বাবা মাটি কামড়ে থেকে নীরবে দিন-যাপন করে গেছেন। একমাত্র সন্তান আমাকে নিয়েই সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখেছেন। খুব একা হয়ে গেছিলেন বলেই আমাকে অমন আগলে রাখতেন।
এইসব দেখে দেখে কখন যেনো আমি যুবক হয়ে উঠেছি, পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করেছি, বুয়েটে ভর্তি হয়েছি। আমাদের তো আর কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না, ঢাকাতে সুন্দর ঠাকুমাকে নিয়ে তরুণ কাকা থাকতেন। প্রায়ই যেতাম উনার বাসায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি করতাম, পয়সা বাঁচিয়ে সুন্দর ঠাকুমার জন্য টুকিটাকি জিনিস কিনে নিয়ে যেতাম। ঠাকুমা খুব খুশী হতেন। আমাকে ঠাকুমা খুব ভালোবাসতেন। শেষের দিকে আর পাগলামী করতেন না। হয়তো ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলেন। পুনি পিসীর বিয়েটাও খুব ভালো ঘরে হয়েছিল। পিসীর বর খুব বনেদী পরিবারের সন্তান। উনাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিল অনেক। এতেই সুন্দর ঠাকুমার মাথা থেকে বাড়ী হারাণোর শোক কেটে গিয়েছিল।
আমার পাশের খবর শুনে ঠাকুমা খুশী হয়েছিলেন। কিন্তু এমন এক মন্তব্য করেছেন যে আমার বুকে ধাক্কা দিয়েছে,
“বাহ! আমাগোর চঞ্চল বাবুর ভাইগ্যটা বড়ই ভাল, কেমুন ফাস্ট কেলাস পাইয়া গেছে। আমি ত মনে করছিলাম, তুমার নাম দেখলেই ফেল দিয়া দিব”।
বলেছি, কেন, ফেল দিবে কেন?
-দ্যাশটা তো আর মুজিবরের দখলে নাই, রাজাকারের দখলে গেছে গা। শ্যাখরেও মারলো, আমাগরেও মারলো। তোমার হিন্দু নাম দেইখা তোমারে ফেল দিল না, এইটা দেইখা অবাক হইছি।
-ঠাকুমা, তোমার দেখি মাথার পোকা আবার নড়তে শুরু করছে।
-ভাই রে,সাধে কি আর এই কথা কই! কত্ত বড় বাড়ী ঘর আছিল আমাগো, রাজাকারের পেটে গেছে গা। কত বড় বড় কথা শুনছিলাম, দেশ স্বাধীন হইব, স্বাধীন হইলেই আমরা মনের আনন্দে নিজের ভিটায় থাকতে পারুম। কী লাভ হইল রে ভাই, এক রায়েটে মাইয়াটারে দিলাম, আরেক রায়েটে দিলাম বাড়ী ঘর, জমাজমি। কেমনতর স্বাধীনতা পাইলাম আমরা? রহমইত্যার পুলাগো কোন বিচার হইল না”।
-ঠাকুমা, স্বাধীন দেশেই তো আছ। যা চলে গেছে, তা চলে গেছে। পুরানো দিনের কথা আর মনে করো না, আবার পাগল হয়ে যাবে। পাকিস্তান আমলের মত পরাধীন তো আর নাই তুমি। নিজেকে সব সময় স্বাধীন ভাববে।
-শোন চঞ্চল, তরে একটা কথা কই। মাইয়ালোকের জীবনে স্বাধীনতা বইলা কিছু থাকে না। এই যে ধর আমার কথা, আমারে তুই কী ডাকছ? সুন্দর ঠাকুমা ডাকছ। আমার পোলা মাইয়ায় ডাকে ‘মা’, তোর দাদু ডাকতো ময়নার মা, শশুর–শাশুড়ি ডাকতো সুন্দর বৌমা। আমার নাম ধইরা কেউ কোনদিন ডাকে নাই। নিজের নাম নিজেই ভুইলা গেছি।
জন্মের পরে মায় নাম দিছিল ‘শৈববালা’, বাপ-ভাইয়েরা ডাকতো ‘শবি’ কইয়া, আমার নামটাও কেউ ঠিক মত ডাকতো না। বিয়ার পরে তো নামই হারায়া গেল।
কালা আছিলাম বইলা দোজবরে বিয়া হইছে, আমি দোজবরের লগে বিয়া বইতে রাজী কিনা, এই প্রশ্নটাও কেউ করে নাই, নিজের মতামত দেওয়ার স্বাধীনতাও ছিল না। বুড়া স্বামীর সংসারে ঢুকছিই ‘মা’ হইয়া, ময়নারে নিজের মত কইরা আদর করার স্বাধীনতাও ছিল না, ময়নারে বকা দেওয়ার স্বাধীনতাও আছিল না, বকা দিলেই সবাই মনে করতো, সৎ মা তো, তাই মা-মরা মাইয়াটারে বকে। মাইয়াটারে আজরাইলের হাত থিকা বাঁচাইতেও পারলাম না। এরপরে তো কত কষ্ট গেল, মুক্তিযুদ্ধ হইল, দ্যাশ স্বাধীন হইল, নিজের ভিটায় উঠলাম, কিন্তু পাঁচ বছরের বেশী থাকতেও পারলাম না। এক কাপড়ে পলাইয়া আইলাম। নিজের ভিটামাটি থাকতেও ভাড়া বাড়ীতেই জীবন কাটায় দিলাম, মরতেও হইব পরের বাড়ীতেই। দ্যাখ এইবার চিন্তা কইরা, নিজের ঘরে মরুম, সেই স্বাধীনতাটাও আর থাকলো না”।
চার
ঠাকুমার সেদিনের কথা গুলো খুব মনে পড়ছে। কী কঠিন বাস্তব কথা! ‘পাগলের প্রলাপ’ বলার কোন কারণই নেই। প্রায় অশিক্ষিত এক নারী, অথচ স্বাধীনতা সম্পর্কে কী স্বচ্ছ ধারণা ছিল, ভেবেই অবাক হই।
আমার নিজের একটিমাত্র সন্তান, নাম রেখেছি ‘স্বাধীনচেতা’। আমিই রেখেছি নাম। এত বড় নাম কেউ বলতে চায় না। পরিবারে আইনজারী করেছি, মেয়েকে ওর পুরো নামেই ডাকতে হবে। মেয়েকেও বলেছি, সবাইকে বলবে যেন পুরো নামেই ডাকে। নামকে ভাঙ্গতে দেবে না।
স্বাধীনচেতার বয়স এখন ১৪ বছর। মেধাবী, প্রচুর পড়াশোনা করে, এই বয়সেই মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা অনেক বই তার পড়া হয়ে গেছে। আমার মতই পড়ুয়া হয়েছে মেয়ে, কিন্তু আমার মত শৃংখলে বাঁধা জীবন হয় নি ওর। স্বাধীনচেতা পুরোপুরি স্বাধীনভাবে বড় হচ্ছে। আমার বাবা মা আমাকে আঁচলে ঢেকে রাখতেন, আর আমি মেয়েকে নিজের মত করে চলার সুযোগ দিয়েছি। গত শুক্রবার আমার হাত ধরেই এসেছিল প্রজন্ম চত্বরে। সবার সাথে গলা তুলে শ্লোগান দিচ্ছিল। আমাকেও খুব খোঁচাচ্ছিল ওর সাথে গলা মেলাবার জন্য। আমি চোখ টিপে দিয়েছি। ও বুঝে গেছে, বাবা তার কর্মকান্ডে সায় দিচ্ছে।
প্রজন্ম চত্বরে তরুণ-তরুণীরা যেভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, দেখে মনে হয়, সুদিন বুঝি ফিরে আসি আসি করছে। রাজাকার, আলবদর, মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরু হয়েছে। একটা মাত্র রায়ের বিরুদ্ধে সারা দেশ ফেটে পড়েছে, আমার সুন্দর ঠাকুমা বেঁচে থাকলে তাঁকে আমি কাঁধে চড়িয়ে হলেও এই চত্বরে নিয়ে আসতাম। অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে উনি পৃথিবী ছেড়েছেন! এই কষ্ট উনার পাওনা ছিল না। কিছুই চান নি, নিজের ভিটায় মরতে চেয়েছিলেন। আজ যদি এই চত্বরে আসতেন, দেখতেন, “চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়”! আমার দেশটাকে এতকাল যারা খুবলে খুবলে খেয়েছে, আজ তারা তরুণদের জালে আটকা পড়েছে। আমরা যা পারিনি, আমাদের পরের প্রজন্ম তা করতে চলেছে। দেশের মাটিতে ওই নরপশুদের বিচার হবে। এই তারুণ্য, অনেক মেধাবী, অনেক সাহসী, অসাম্প্রদায়িক। এইজন্যই ওদের একটা মাত্র ডাকে আজ আকাশ কাঁপছে, মাটি কাঁপছে, দেশের সকল ধার্মিক, দেশপ্রেমিকের হৃদয় কাঁপছে! আমি ওদের দৃপ্ত কন্ঠে শ্লোগান শুনে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে সম্মান করছি। আজ বড় বেশী মনে পড়ছে আমার ‘পরাধীন’ সুন্দর ঠাকুমা’কে। ঠাকুমা বেঁচে থাকলে হয়তো রহমত চাচার ছেলেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারতেন, আর কিছু না হোক, অপরাধীর বিচার হবে, এই সত্যিটুকু জেনে যেতেন।
“বাবা, ও বাবা! তুমি এভাবে কাঁদছো কেন”?
“আরে, মামনি তুই কার সাথে এলি রে মা?”
“স্বাধীনচেতা একা একাই পথ চলতে পারে বাবা। আমি একা একাই এসেছি। মঞ্চের ঐ দিকটাতে দাঁড়িয়েছিলাম। ওখান থেকেই তোমাকে দেখতে পেয়েছি। এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন, আমার হাত ধরো, চলো আমার সাথে, সামনের দিকে যাই”।