বাড়ি ফেরা

বাবারা এমনই হয় (জুন ২০১৯)

রীতা রায় মিঠু
মোট ভোট ১৩ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৬.০৮
  • ১৩
  • ১১০
এক)
ব্যাগ ট্যাগ গোছগাছ করে রূপা মোটামুটি তৈরি হয়ে গেছে। পুরুষ নার্সেরা এসে রূপার বাবার পোশাক পালটে ফিটফাট করে দিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে ছোট দুই ভাই এসেছে, ওরা সাথে করে মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছে। ওরা গেছে কাউন্টারে, বকেয়া বিল সব পরিশোধ করে দিতে। দুপুর একটার দিকে রিলিজ অর্ডার হাতে পাওয়া যাবে। এরপর সবাই মিলে বাড়ি ফেরা।
ডাঃ মির্জা গতকাল সন্ধ্যায় রাউন্ডে এসেছিলেন। রূপা তখন ওর বাবাকে বেডের উপর বসিয়ে হাত পা ম্যাসাজ করে দিচ্ছিল। ডাঃ মির্জা কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন নির্বাক হয়ে দেখছিলেন দৃশ্যটি। বিরানব্বই বছর বয়স পেশেন্টের, প্রায় মৃত অবস্থায় হসপিটালে নিয়ে এসেছিল উনার স্বজনেরা। আইসিইউতে রেখে পাঁচদিনেও যখন অবস্থার উন্নতি হচ্ছিলোনা, উনি রিলিজ অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলেন। জুনিয়র ডাক্তারদের ডেকে বলে দিয়েছিলেন, এই পেশেন্ট পনের দিনের বেশি টিকবে বলে মনে হয়না, তাও যদি আইসিইউতে রাখা যায়। রোগির আত্মীয়দের বুঝিয়ে বলে দিও, রোগিকে যেন বাড়ি নিয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা বাবাকে যে কয়দিন চোখের দেখা দেখতে পায়, সেটুকুই লাভ। এখানে রাখলে আইসিইউর বিল বাড়বে। তাছাড়া আইসিইউতে বেডের সংখ্যা কম, ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে থাকা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, অযথা একটা বেড অকুপাই করে রাখার মানে হয়না।

সেই বৃদ্ধ এখন এয়ারকন্ডিশন্ড রুমের বেডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, মেয়ে তার বাবার হাত পা ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য বুঝি আর হয়না! মির্জা সাহেবের চোখ একটু জ্বালা করে উঠলো। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার উনি, এত নামী দামী হসপিটালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান, তাঁর চোখও সুন্দর দৃশ্য দেখে ভিজে ওঠে!
ডাঃ মির্জা রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথে রূপার মুখে চোখে হাসি ফুটে উঠেছিল। মির্জা স্যার প্রতি দিন আসেননা, গত ঊনিশ দিনে স্যার খুব বেশি হলে তিন কি চার দিন এসেছেন। মির্জা স্যার খুবই ব্যস্ত থাকেন আইসিইউ, সিসিইউতে থাকা পেশেন্টদের নিয়ে। পাঁচ তলার ফ্লোরের প্রধান ডাক্তার হচ্ছেন সামিউল স্যার। সামিউল স্যার প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আসেন।

বাবার হাত পা ম্যাসাজ থামিয়ে রূপা একটু সরে দাঁড়ালো। স্যার এখন পরীক্ষা করে দেখবেন বাবাকে। এই স্যারের কাছে রূপা চির কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে। বাবাকে রিলিজ অর্ডার দিয়ে দিয়েছিল হসপিটাল থেকে। অর্ডারে মির্জা স্যারের সিগনেচার ছিল।
সেই বিকেলের কথা ওর বুকের ভেতর আজও কাঁপন ধরায়। অচেতন বাবাকে নিয়ে রূপা কোথায় যাবে? বাড়িতে নিয়ে রাখবে কোথায় বাবাকে? চিকিৎসা কিভাবে হবে? চোখের উপর বাবাকে মরে যেতে দিবে! এমন কষ্টের মরণ হবে বাবার! রূপার বাবার মৃত্যু হবে এত কষ্টের ভেতর দিয়ে! এই বাবা, এই বাবা কত কষ্ট করে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ওদের বড় করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন, ছেলেমেয়েরা আজ সকলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাবার চেষ্টার কারণে। সেই বাবাকে এমন হেলাফেলা করে বাড়িতে রেখে মৃত্যুর হাতে তুলে দিতে হবে!
হসপিটালে থাকলে আর কিছু নাহোক, যে কদিনই বাঁচুক, তবুতো বাবার একটু যত্ন হবে! বিনা চিকিৎসায় তো বাবাকে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবেনা! অচেতন অবস্থাতে বাবা কি ভাবতে পারবে, তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানেরা চিকিৎসা শেষ না করেই তাকে হসপিটাল থেকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!

দুই)
সেদিন ছিল বুধবার। বাবা খুব অসুস্থ, বাবাকে দেশের সবচে দামী হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে চার দিন আগে। যদিও মা এই হসপিটালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান, তবুও বাবাকে সরাসরি এই হসপিটালেই নিয়ে আসা হয়েছে। আর কোন উপায়ও ছিলনা। সুস্থ বাবা মাত্র দুই দিনের মধ্যেই নাকি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। বিছানা থেকে নামতে পারেননা, এরপর বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসতে পারেননা, এরপর শোয়া অবস্থায় নিজে নিজে পাশ ফিরতে পারেননা। খাওয়া দাওয়া বন্ধ কারণ মুখ ভর্তি ঘা। পাড়ার ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।
রূপা থাকে অস্ট্রেলিয়া, ওর বড় ভাই থাকে ইতালি, আরেক ভাই জার্মানীতে। ছোট দুই ভাই আর ছোট বোন ত্রপা থাকে বাংলাদেশে। রূপার ভাই বোনেরা মায়ের অসুস্থতার সময় এই হসপিটালে অনেক আসা যাওয়া করেছে, তাই হসপিটাল সম্পর্কে মোটামুটি পরিষ্কার একটা ধারণা হয়েছে। অন্য হাসপাতাল তো ওরা কেউ ভাল করে চিনেওনা। বড় দাদা দিদি থাকে বিদেশে, তাই দিশেহারা হয়ে ওরা এই হসপিটালে নিয়ে আসে বাবাকে।
রূপা জানায় ও দুই দিনের মধ্যে দেশে এসে পৌঁছাচ্ছে। অন্য দুই দাদাও দেশে আসার জন্য প্রসেসিং শুরু করে দিয়েছে। মা নেই, বাবাই এখন ওদের একমাত্র আশ্রয়। বাবাকে তো মরতে দেয়া যাবেনা! মা চলে যাওয়ার পর এমনিতেই ওদের চারদিক ফাঁকা লাগে, বাবাও যদি চলে যায় তাহলে তো ওরা নিঃস্ব হয়ে যাবে!

মঙগলবার সন্ধ্যায় রূপা দেশে এসে পৌঁছায়। ত্রপা জানায়, ওদের বাবা এখন আগের চেয়ে ভাল আছে। আগামীকাল বাবাকে কেবিনে দেয়া হবে। বাবার মূল সমস্যা হয়েছিল দেহে ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্সড হয়ে গেছিল। সোডিয়াম লেভেল এতটা নীচে নেমে গেছিল যে বাবা প্রায় কোমায় চলে গেছিল।
-এখন কি বাবার চেতনা ফিরেছে? বাবা কি তোকে চিনতে পেরেছে? কথা বলেছে তোর সাথে?
- না রে দিদি, এত কিছু করার সময় কোথায়! আমাদের তো আইসিইউতে পাঁচ মিনিটের জন্য যেতে দেয়। একজন একজন করে যাই। দিদি, আইসিইউতে ঢুকলে আমার ভয় লাগে। সব বেডে শুধু রোগী আর রোগী, সব রোগীর নাকে মুখে নল লাগানো। বাবার নাকেও নল লাগানো, ঘায়ের জন্য মুখটা হাঁ করে থাকে, কথা বলবে কেমন করে! তবে কেবিনে যখন দিবে, তার মানে বাবার অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভাল। তুই তো কাল যাবি, তুই চলে এসেছিস এখন আমাদের আর কোন চিন্তা নেই।
পরদিন বুধবার, বাবাকে কেবিনে দেয়া হবে। গত দশ দিন বাবাকে নিয়ে ভাইবোনেরা অনেক কষ্ট করেছে। এবার রূপা যখন দেশে এসেই পড়েছে, এখন তাহলে কেবিনে বাবার সাথে রূপা থাকবে।
কয়দিন থাকতে হবে হসপিটালে কে জানে, মোটামুটি দিন সাতেকের জন্য জামা কাপড়, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস, আর বাবার জন্য চকোলেটের তিন চারটা বাক্স সুটকেসে সাজিয়ে রূপা হসপিটালে পৌঁছেছিল। আইসিইউর সামনে যে ওয়েটিং রুম আছে, রূপা প্রথমে সেখানে একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে বসলো।
আজ ওর মনটায় ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। মা’কে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি, বাবাকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে নেয়া যাবে। ভাগ্যিস রূপা অস্ট্রেলিয়া থেকেই ফোনে ভাইদের বলেছিল, যত দ্রুত সম্ভব বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে। ভাগ্যিস হসপিটালে সময়মত আনতে পেরেছিল, তাইতো বাবা সঠিক চিকিৎসা পেয়েছে! অন্যান্য চেয়ারে অন্য রোগীর স্বজনেরা বসে আছে, কী করুণ চাহনি ওদের চোখে। আহারে! ওদের পেশেন্টের অবস্থা হয়তো ভাল না।

রূপা বাবাকে আইসিইউতে দেখতে যাওয়ার একটা সুযোগ পেলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসতে হবে। রূপা যখন আইসিইউর ভেতরে প্রবেশ করলো, ওর বুকের ভেতর হঠাৎ কি যেন হাহাকার করে উঠলো। এমন হলো কেন, এমনতো হওয়ার কথা নয়!। বাবার বেড নাম্বার তিন। তিন নাম্বার বেডের কাছে গিয়ে দেখে মার্কিন কাপড়ের পর্দা দিয়ে তিন নাম্বার বেড ঢাকা। বাবা কি তবে মারা গেছে! বাবার বেড মার্কিন কাপড়ের ঘেরাটোপ দিয়ে ঢাকা কেন?
ডক্টর স্টেশনে গিয়ে রূপা মরীয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমার বাবা কোথায়? ্তিন নাম্বার বেড পর্দায় ঢাকা কেন? কি হয়েছে বাবার?
-পেশেন্টের ড্রেস পাল্টাচ্ছে।
বুক থেকে পাথর নেমে গেলো। রূপা বলল, আমি উনার মেয়ে। আজই এসেছি হসপিটালে। বাবাকে তো আজ কেবিনে দেয়া হবে, তাইনা?
-আমরা জানিনা। সময় হলে স্যার জানিয়ে দিবেন।
-আমি কি বাবাকে একটু দেখতে পারি?
-পর্দা সরিয়ে দিলেই আপনি পেশেন্টের সাথে দেখা করতে পারবেন। তবে লাভ নেই। পেশেন্টের তো জ্ঞান নেই।

-কি বলেন এসব! পেশেন্টের জ্ঞান না থাকলে পেশেন্টকে কেবিনে দিবে বলেছে কেন? আমার ভাই বোনদেরকে হসপিটাল থেকে বলে দেয়া হয়েছে, আজ বাবাকে কেবিনে দিবে। আমি তো সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি।
-দেখেন, মির্জা স্যার কি বলে।
রূপা তিন নাম্বার বেডের কাছে গেলো, এ কে? বেডে অমন মুখ হাঁ করে কে শুয়ে আছে! মুখটা এমন দেখা যাচ্ছে কেন? এটা বাবা? বাবাকে চেনা যাচ্ছেনা! মুখের উপর একটা কাপড়ের মাস্ক বেঁধে দিয়েছে কেন, বাবা কেমন করে শ্বাস ফেলবে?
রূপা নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই নার্স বলল, ইয়া খোদা, রুগীর মুখ থিকা যা দূর্গন্ধ বাইর হইতাছে, এইজন্যই মাস্ক পরায়ে দিছি।
রূপার দুই চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে লাগলো। আইসিইউর ভেতরে হাউ মাউ করে কাঁদা যায়না। ছেলের মৃতদেহ পাশে রেখেও মা কাঁদেনা জোরে জোরে। আইসিইউর ভেতরের পরিবেশটাই কেমন যেন ঠান্ডা শীতল। এখানে কাঁদা বারণ, হাসা বারণ, কথা বলা বারণ!
বাবার মুখ থেকে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে? এও সম্ভব! এই বাবা দুই বেলা দাঁত ব্রাশ করতেন নিমের ডাল ঘষে। খাবার খেয়ে কত রকম আওয়াজ করে মুখে জল নিয়ে কুলকুচি আর গার্গল করতেন। জামা কাপড় ধোয়া ইস্ত্রি করা, বিছানার চাদর থাকে টান টা্ন করে পাতা। সেই বাবার মুখ দিয়ে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে বলে বাবার হাঁ করা মুখটা মাসক দিয়ে বেঁধে দিয়েছে!
বাবা কি টের পাচ্ছে, বাবার মুখের গন্ধ আড়াল করতে মুখের উপর মাস্ক লাগানো! টের পেলে বাবা খুব লজ্জা পাবেন। কিছু হয়তো বলতে পারছেনা, আহারে, মৃত্যু পথযাত্রীকেও কত লজ্জা সঙ্কোচে জড়োসড়ো হয়ে থাকতে হয়!

আইসিইউ থেকে বের হয়ে রূপা ওয়েইটিং রুমে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছিল। মনটা খুব অশান্ত লাগছে, বাইরে থেকে কেউ জানেনা, আইসিইউর ভেতর তাদের প্রিয় জনকে কত অবহেলা করা হয়। আইসিইউ নাকি নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যা বিভাগ। সেখানে বাবার যেরকম পরিচর্যার নমুনা দেখে এলো রূপা, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে।
মা বলতেন একটা কথা, যে মানুষটা আর কিছুক্ষণ পর মারা যাবে, তাকেও সর্বোচ্চ আরাম বিলাস দিতে হয়। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে যে, আর তো ফিরবেনা, এটা কত কষ্টের, তাই যাওয়ার বেলায় তাকে দেহের আরাম দেয়ার চেষ্টা করা উচিত।
নিজের মনেই রূপা বলল, থাক, মন খারাপ করবোনা। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। কেবিনে ঢুকিয়ে দিলেই বাবা আমার হয়ে গেলো। কোন নার্সকে বিরক্ত করবোনা, আমার বাবার যত্ন আমিই করবো। আমার ছোটবেলায় বাবা কত যত্ন করে আমাকে স্নান করাতেন, চুলে শ্যাম্পু লাগিয়ে দিতেন। নিজে হাতে আমাকে সুন্দর জামা পরিয়ে মাথার চুল আঁচড়ে হাত ধরে বেরিয়ে পরতেন। নদীর ঘাটে বেড়াতে নিয়ে যেতেন, শিবু কাকুর ডাক্তারখানায়, তারপর লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারে নিয়ে শঙ্খ সন্দেশ কিনে খাওয়াতেন। আমার সেই বাবাটা আজ কেমন মুখ হাঁ করে অচেতন হয়ে পড়ে আছে।

দুই সপ্তাহ আগেও ফোনে বাবার সাথে কত গল্প হলো। এত রাতে ফোন করেছিস, কি ঘুম আসেনা?
-না বাবা, ঘুম আসছেনা।
- জোলার গল্প শুনবি?
-জোলার গল্প মনে আছে তোমার? ছোটবেলায় কত গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে বাবা তুমি। আজ আমি কত দূরে, তুমি কত দূরে। আমার চোখে ঘুম নাই, তোমারও নিশ্চয়ই সেসব গল্প মনে নাই।
-মন খারাপ করিসনা। জীবন ব্যাপারটাই এমন, সদা চলমান তো তাই দিক পরিবর্তন হয়। গল্প বলি, গল্পটা শুনে ঘুমিয়ে পড়। দুইটা গল্প বলি, তোর মন ভাল হয়ে যাবে।

জোলার গল্পঃ

এক জোলা (চরম বোকা) তার লোহার কাঁচিটা উঠানে ফেলে রেখেছিল। দুপুরের রোদে কাঁচি গরম হয়ে গেছে, জোলা কাঁচি হাতে নিয়ে দেখে কাঁচির শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কাঁচিরে কোলে তুলে সে কবিরাজের বাড়ীর দিকে রওণা হয়েছে। পথে তার বন্ধুর সাথে দেখা, বন্ধুটি আবার খুবই ‘ট্যাটনা’(চালাক)।
জোলাকে জিজ্ঞেস করলো, “ কিরে, এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কই যাস?”
জোলা বলে, “ আমার কাঁচিটার অনেক জ্বর, দ্যাখ শরীর পুড়ে যাচ্ছে, কবিরাজ মশায়ের কাছে নিয়ে যাই”।
বন্ধু বলে, “ কবিরাজের কাছে যাবি কেন, আমিই তোর কাঁচির জ্বর সারাবার ব্যবস্থা করি, কিন্তু আমাকে কি খাওয়াবি বল?” জোলা বলে, “ জ্বর সারিয়ে দে, তোরে পেট পুরে খাওয়াবো”।
বন্ধু কাঁচিটিকে নিয়ে পাশের পুষ্কুণীতে চুবালো, কাঁচি ঠান্ডা হয়ে গেল। জোলা তো দারুণ খুশী, বন্ধুকে নেমন্তন্ন করে দিল।

মাসখানেক পর জোলার মায়ের জ্বর এলো, ভয়ানক অবস্থা, জোলার মায়ের সই জোলাকে ডেকে বলে, “বাপুরে, কোবরেজ মশাইকে খবর দে, তোর মায়ের শরীরতো পুড়ে যাচ্ছে”।
জোলা বলে, “কোবরেজ মশায়কে দরকার নেই, দেখো আমিই মায়ের জ্বর সারিয়ে দিচ্ছি। মায়ের জ্বর সেরে গেলে আমাকে কি দেবে বলো?”
সই মাসী বলে, “আগে তো জ্বর সারিয়ে দে, জ্বর সেরে গেলে তোকে পেট পুরে মিঠাই মন্ডা খেতে দেবো’খন”।
জোলা তার মা’কে পাঁজাকোলা করে ঘরের পাশের পুষ্কুণীতে নিয়ে ডোবাল, ভাল করে ডুবিয়ে শরীর পুরোপুরি ঠান্ডা করে ঘরে এনে মায়ের সইয়ের কাছে দিয়ে বললো, “মাসী, এই নাও, মায়ের জ্বর সারিয়ে দিলাম। মা আর কোঁকাচ্ছেনা, এক্কেবারে চুপটি মেরে গেছে। এবার আমার মিঠাই মন্ডা দাও”।

জোলার মায়ের মৃতদেহ দেখে সই মাসী একেবারে পাথর হয়ে গেলো।

বোকা জোলার গল্প শুনলি, এবার শোন বুদ্ধিমান নাপিতের গল্প।
নাপিত ডাক্তারঃ

গ্রামের জমিদারের সবচেয়ে আদরের হাতীটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে, বেল গাছ থেকে পাকা বেল খাচ্ছিল হাতী, একটা বেল গলায় আটকে গেছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার উপক্রম। জমিদার বাবু তো মহা চিন্তিত হয়ে পড়লেন, শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের ডাক্তার-বদ্যিতে জমিদার বাটী ভরে গেছে, কিন্তু কেউ হাতীর গলা থেকে বেল বের করতে পারছেনা। জমিদারের লোক চারদিকে ঢ্যাঁড়া পিটিয়েছে, কেউ যদি জমিদারবাবুর প্রিয় হাতীর গলা থেকে বেল বের করে দিতে পারে, তাকে জমিদারবাবু পুরস্কার দিবেন।

ঐ গ্রামে বাস করতো এক নাপিত। নাপিতের কাজ হচ্ছে ক্ষুর-কাঁচি দিয়ে লোকের দাড়ি-গোঁফ, মাথা চেঁছে সাফ করে দেয়া, ধারালো ক্ষুর নিয়ে কাজ করতে হয় বলেই নাপিতের বুদ্ধিও খুব ক্ষুরধার হয়ে থাকে। সেই ক্ষুরধার বুদ্ধির নাপিত জমিদার বাড়ী গিয়ে বলল,
“বাবুমশাই, আমি পারবো হাতীর গলা থেকে বেল বের করে দিতে। আমার একটি মুগুর দরকার”।
জমিদারের লোক একখানা বিশাল সাইজের মুগুর এনে নাপিতকে দিল। জমিদার বাবু হাসেন, ডাক্তার বদ্যিরা হাসেন, উপস্থিত পাইক পেয়াদারা হাসে, সবাই বলে, “ হাতী ঘোড়া গেল তল, ভেড়া বলে, কত জল”!

নাপিত কিছুই বলেনা, হাতীর কাছে গিয়ে বসলো, হাতীর দেহ মাটিতে এলিয়ে পড়েছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, নাপিত প্রথমে হাতীর গলায় হাত বুলিয়ে দেখলো, বেলটা ঠিক কোথায় আটকেছে। বেলের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে বেশী সময় লাগলোনা, এবার শুরু হলো তার চিকিৎসা। হাতের মুগুর মাথায় তুলে দিল ‘বেল’ বরাবর এক বারি(আঘাত করলো), হাতীর শরীরে মুগুরের বারি তো কিছুইনা, হাতী টেরও পেলোনা, কিন্তু বেলটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। হাতী সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। নাপিতের এই চিকিৎসা পদ্ধতি অন্য সকলের সাথে গ্রামের জোলাও দেখেছিল। জোলার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। দ্রুত হেঁটে সে বাড়ী ফিরলো।

জোলার বউয়ের ‘গলগল’ ব্যারাম আছে (‘গলগন্ড’ রোগ, আয়োডিনের অভাবে হয়, গলা ফুলে থাকে), জোলা গরীব মানুষ, গাছের শেকড়-বাকড়ে এতদিন চিকিৎসা চালিয়েছে, কোন লাভ হয়নি। আজ জমিদার বাড়ীতে গিয়ে দেখে এসেছে, মুগুরের এক বারিতেই এত বড় হাতী ভাল হয়ে গেল, আর তার বৌ তো ছোটখাট, রোগা-পটকা মানুষ, তার গলা সারাতে মুগুর লাগবেনা, একটা হাতুড়ী হলেই যথেষ্ট। বাড়ী ফিরে দেখে বৌ ঘুমে অচেতন। জোলা বেড়ায় গুঁজে রাখা হাতুরীটা টান দিয়ে হাতে নিল, শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে হাতুরী দিয়ে বৌয়ের গলায় এক বারি দিতেই বউয়ের দম বেরিয়ে গেল!]


রূপা খিল খিল করে হাসছে, রূপার খেয়াল নেই ও হসপিটালের ওয়েইটিং রুমে বসে আছে। পাশের চেয়ারে বসা একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা রূপার কাঁধে হাত রেখে বললেন, রোগী কে হয় তোমার? কেমন আছেন তিনি?

রূপা একটু হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, পেশেন্ট আমার বাবা। অনেক বয়স হয়েছে, অসুখের ধকল সইতে পারছেন না। খুব খারাপ দেখে এলাম। পনের দিন আগেও বাবা সুস্থ ছিলেন, আমার সাথে ফোনে কত গল্প করলেন। আমাকে হাসির গল্প শোনালেন, ছোটবেলায় যেসব গল্প শোনাতেন। সেগুলো মনে পড়ছিল, তাই হেসে ফেলেছি। সরি, কিছু মনে করবেন না।

-কিচ্ছু মনে করিনি। আপনি অনেক ভাগ্যবতী, বাবা এখনও বেঁচে আছেন। ইনশাল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠবেন। বাবাকে নিয়ে আপনার কত মজার স্মৃতি এখনও বুকের মধ্যে বেঁচে আছে। আমি তো বাবাকে দেখিনি। আমার জন্মের আগেই বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।

-আপনি একজন শহীদ পিতার সন্তান, এটা কি কম বড় পরিচয়! শহীদ যাঁরা, তাঁদের তো মৃত্যু হয়না। শহীদরা অমর হয়ে থাকেন। সেই দিক থেকে ভেবে দেখুন, আপনিও ভাগ্যবতী, আপনার বাবা সারা জীবনের জন্য বেঁচে থাকবেন। উনার অসুখ হবেনা, উনাকে হসপিটালের আইসিইউতে থাকতে হবেনা, উনার মুখে ঘা হবেনা, ঘায়ের যন্ত্রণায় উনাকে হাঁ করে থাকতে হবেনা, মুখে দূর্গন্ধ হবেনা, উনার মুখে কাপড়ের মাস্ক বেঁধে দেয়া হবেনা-----বলে রূপা কাঁদতে শুরু করে দিল।

ভদ্রমহিলা রূপাকে আরেকটু কাছে টেনে নিলেন, ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, আইসিইউতে আমার স্বামী অসুস্থ অবস্থায় পাঁচ দিন ধরে আছে। আমি একটুও ভেঙে পড়িনি, আল্লাহর কাছে শুধু হাত পেতে রেখেছি, আল্লাহ করুণাময়, তিনি নিশ্চয়ই আমার সুস্থ স্বামীকে আমার হাতে তুলে দিবেন। আপনিও ভগবানের কাছে বাবার জন্য প্রার্থনা করুন।

৩)
ভেতর থেকে দরজা খুলে একজন নার্স বেরিয়ে এসে বলল, তিন নাম্বার বেডের পেশেন্টের কেউ আছেন এখানে? স্যার কথা বলবে।
তিন নাম্বার বেডের পেশেন্ট মানে রূপার বাবা। হ্যাঁ, আমি আছি, পেশেন্ট আমার বাবা।
-আসেন আমার সাথে, স্যার কথা বলবেন।
নার্সের পেছন পেছন রূপা ভেতরে একটা রুমে গেল। ডাঃ মির্জার কক্ষ। মির্জা স্যারের নাম শুনেছে রূপা, খুবই ভাল ডাক্তার। রূপা চিন্তায় পড়ে গেল, ভাল ডাক্তাররা অনেক গম্ভীর হয়। ডাঃ মির্জাও নিশ্চয়ই গম্ভীর।

মাঝারি উচ্চতার একজন ছিমছাম চেহারার ভদ্রলোক খুব ব্যস্ত ভঙ্গীতে চেম্বারে ঢুকলেন। নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, তিন নাম্বার বেডের পেশেন্টের কেউ এসেছে?
-জী স্যার, ইনি পেশেন্টের মেয়ে।
-সিস্টার, ডাঃ ফয়সালকে পাঠিয়ে দিন। বলে রূপার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বললেন, বাবাকে কেমন দেখলেন?
-স্যার, আমি তো দেশের বাইরে থাকি। গতকাল দেশে ফিরেছি, আজই প্রথম বাবাকে দেখলাম। আমার বোন বলেছে, আজ নাকি বাবাকে কেবিনে দেয়া হবে। আমি বাবার সাথে থাকব বলেই এসেছি। বাবাকে একটু সময় দেখলাম, বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে।
-জী, পেশেন্টের খুব কষ্ট হচ্ছে। বয়স হয়েছে তো, নব্বই বছর বয়স, এই বয়সে একটা হাঁচি দিতেও কষ্ট হয়। কিন্তু পেশেন্টকে কেবিনে দেয়া হবে কে বলল?
-আমার ভাই বোন গত কয়েকদিন এসেছিল, গতকাল বোনকে ডাক্তার বলেছেন, বাবা আগের চেয়ে কিছু ভএল, স্টেবল হয়েছেন তাই কেবিনে মুভ করা হবে।
- না না না! সরি সরি। কিছু একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। এইজন্যই পেশেন্টের স্বজনের সাথে কথা বলতে চেয়েছি। এই যে ডাঃ ফয়সাল এসে গেছেন। ডাঃ ফয়সালও আপনার বাবার চিকিৎসা সেবায় নিযুক্ত আছে। শুনুন বোন, আপনি এত বছর দেশের বাইরে আছেন, এত বছরে নিশ্চয়ই বাঙালির সেন্টিমেন্ট ভুলে আমেরিকানদের মত রিয়েলিটি মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

-স্যার, আমি অস্ট্রেলিয়া থাকি।
-ঐ একই কথা হলো। অস্ট্রেলিয়ানরাও ইমোশনের চেয়ে রিয়েলিটিটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যা বলছিলাম, আপনার বাবার যে বয়স, উনি আর সুস্থ হবেননা। আমাদের যতখানি সম্ভব চিকিৎসা দেয়ার, আমরা দিয়েছি। উনি ইমপ্রুভ করেননি, করার কথাও নয়। সোডিয়াম লেভেল বাড়ানোই যায়নি। এই অবস্থায় আইসিইউতে রেখে দিলে আরও ক্ষতি হবে।
বুড়ো মানুষ, এতদিনের অসুস্থতায় ইমিউন সিস্টেমটাও নষ্ট হয়ে গেছে। আইসিইউতে থাকলে উনার সারা শরীরই ইনফেকটেড হয়ে যেতে পারে। আইসিইউতে তো সব সিরিয়াস রোগীদের রাখা হয়, চারদিকে রোগ জীবানুর ছড়াছড়ি। আরেকটি কথা, বাবা যখন সুস্থ হবেইনা, অযথা আইসিইউর বিল গুনে কি লাভ বলেন? আমরা সকলেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ, আমি বলছি, আপনার বাবার চিকিৎসা আমরা দিয়ে যাব, কিন্তু কোন কাজ হবেনা, মাঝখান থেকে আপনাদের টাকাগুলো চলে যাবে হসপিটালের মালিকের ভান্ডারে। বুঝতে পারছেন কি বললাম?
-স্যার, আমার বাবা আর ভাল হবেইনা? ইলেক্ট্রোলাইট তো বাড়ানো যায়।
-বাড়েনি তো, উলটো নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শুনুন, একটা পরামর্শ দেই। বাবাকে নিয়ে যান, আপনাদের বাড়ির কাছাকাছি কোন ক্লিনিকের সাথে কথা বলুন, বাবার জন্য একটা রুম পাকাপাকি বন্দোবস্ত করুন। একজন আয়া ঠিক করে দিবেন, তার কাজ হবে, যখন আপনার বাবার শেষ সময়ে যেন সে আপনাদের ফোন করে জানায়। আপনারা যে যেমন অবস্থায় থাকেন, এক দৌড়ে বাবার শিয়রে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন।
-স্যার, এমন ক্লিনিক কোথায় পাব? এমন আয়া কোথায় পাব?
-আরে পাবেন। ক্লিনিক এখন পাড়ায় পাড়ায়।
-স্যার, এই বিশাল হসপিটালের বিশাল আয়োজন থেকে, আপনার মত ডাক্তারের কাছ থেকে সরিয়ে আমার বাবাকে পাড়ার ক্লিনিকে নিয়ে যেতে বলছেন!
-মনটাকে শক্ত করুন। বাবার জন্য কষ্ট তো হবেই, কিন্তু বাস্তবতাটা মেনে নিন। এখানে উনাকে আর কোন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছেনা। আমি বলে দিচ্ছি, ওরা কাগজপত্র রেডি করলে নিয়ে যাবেন।

রূপা তখনও হতবিহবল হয়ে আছে। সুটকেসটা এখনও ওয়েইটিং রুমে আছে। বাড়িতে ভাই বোনেরা আজ সবাই নিশ্চিন্ত, দিদি আছে বাবার সাথে। এদিকে ডাক্তার বলছে বাবাকে রিলিজ করে দিবে। হঠাৎ রূপা একটা কান্ড করে বসলো, হাঁটু গেড়ে মেঝেয় বসে ডাঃ মির্জার হাত দুটো ধরে কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগলো,
“ স্যার, আমাদের মা চলে গেছেন সাত বছর আগে। বাবা আমাদের কাছে সব। বাবার বয়স নব্বই, এত বছর খুব বেশি মানুষ বাঁচেনা। আমরাই হয়তো এত দীর্ঘ জীবন পাবোনা। স্যার জানেন, এত লম্বা একটা জীবন আমাদের বাবা নিজের বাড়ির ভেতরই কাটিয়ে দিয়েছেন। কেন জানেন? আমাদের দেখভাল করার জন্য। দীর্ঘ আয়ুর কী অপচয় তাইনা? কত কম সময়ে আমরা দেশ বিদেশ ঘুরছি, পাহাড় সমুদ্র দেখেছি, আরও দেখব। আর আমাদের বাবা বাড়ির সীমানা ছেড়ে কোথাও বের হন নাই। আমাদের কার কখন কি প্রয়োজন হয়, প্রয়োজনের সময় যেন বাবাকে খুঁজে পাই, তাই বাবা নির্দিষ্ট একটা ঠিকানায় থেকেছেন। আমাদের ছয় ভাই বোনকে নিজের হাতে বড় করেছেন। পনের দিন আগেও আমি ফোন করেছিলাম, এত রাতে ঘুমাইনি, বাবা ফোনে আমাকে দুটো গল্প বলল ঠিক ছোটবেলার মত। ছোটবেলায় আমার সহজে ঘুম আসতোনা, তখন বাবা আমায় গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। সেই বাবাকে নিয়ে পাড়ার ক্লিনিকে রেখে দিব, একজন আয়া থাকবে যার কাজ হবে, বাবার শেষ নিঃশ্বাস ফেলার সময় আমাদের খবর দেয়ার জন্য! স্যার, আমি তো মহাপাতকী হবো যদি আমার বাবার সাথে এই ধরণের আচরণ করি।
আপনার কাছে ভিক্ষা চাই, আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম, বাবাকে নিজে সেবাযত্ন করে ভাল করে তুলবো। আপনি আমার বাবাকে কেবিনে রেফার করে দিন, আপনার কাছে ঋণী হয়ে থাকবো স্যার। স্যার কয়েকটা দিনের জন্য হলেও দিন, এই ফাঁকে আমরা পাড়ার ক্লিনিক নয়, আরও ভা ল কোন ক্লিনিকে বাবার জন্য রুম খুঁজে নেই। এখানে যে কয়টা দিন থাকবে, বাবা আপনার চিকিৎসা পাবে, আমার সেবা পাবে। আরও ভা ল নাহোক, খারাপ তো হবেনা। ভএল ক্লিনিকে ব্যবস্থা হয়ে গেলে সাত দিনের মধ্যে বাবাকে নিয়ে চলে যাব। এটুকু দয়া করুন, নাহলে বাবার মৃত্যুর দায় মাথায় নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
মির্জা সাহেব ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেছিলেন। পরে বললেন, আপনি আমার হাতটা ছাড়ুন, চেয়ারে আরাম করে বসুন। বাবার ত্যাগের কথা বললেন, আমার বাবা মাও অনেক ত্যাগ করেছেন, তাই আজ আমি এইখানে বসে আছি। আপনি তো তবু বাবার শেষ সময়ে এসে উপস্থিত হতে পেরেছেন, আমার বাবার মৃত্যুর সময় আমি ইংল্যান্ডে, মেডিক্যাল পড়া নিয়ে ব্যস্ত। পরীক্ষা চলছে, পরীক্ষা দিতেই হবে। দেশে আমার বাবা মারা গেলেন, আমি বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পেলামনা।


মির্জা সাহেব রূপার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবু, কেমন আছেন?
-ডাক্তার ভগবান, ভগবান আমার সামনে দাঁড়িয়ে, ভাল তো আমাকে থাকতেই হবে। আমি ভাল আছি ডাক্তার সাহেব।
-আমি ভগবান নই, আপনার মেয়ে হচ্ছে আসল মা লক্ষ্মী। এই মা লক্ষ্মীই আপনাকে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছে। আমি কিছু করিনি, আমি শুধু কাগজে খস খস করে ওষুধের নাম লিখে দিয়েছি। বাবু, আপনি ভাল হয়ে গেছেন তো। বাড়ি ফিরতে চান?
-বাড়ি ফিরতে পারলে তো ভালোই হয়। আমার ছেলেমেয়েরা একেবারে অরক্ষিত অবস্থায় আছে। আমি না থাকলে এদের দেখবে কে বলেন? আমাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিন ডাক্তার সাহেব।

-অনুমতি পত্র লিখে দিচ্ছি। আগামীকাল যেতে চান? আপনি যেদিন যেতে চাইবেন সেদিনই যাবেন। নইলে আপনার মেয়ে আবার কান্নাকাটি শুরু করবে। আপনি মহা ভাগ্যবান এমন ছেলেমেয়ে পেয়েছেন। আমার ডাক্তারী জীবনে এইরকম ঘটনা এই প্রথম ঘটলো। পেশেন্টকে রিলিজ অর্ডার দিয়ে দেয়ার পর সেই অর্ডার ফিরিয়ে নেয়া, যে রোগী সবরকম চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে, তাকে শুধুমাত্র তার মেয়ের প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোরে জীবনে ফিরিয়ে আনা, এ এক বিরাট অভিজ্ঞতা হলো।

-রূপা, আপনার কথা আমার মনে থাকবে। আমি মনে প্রাণে চাইবো, প্রতিটি বাবার যেন আপনার মত একটি কন্যা থাকে। আমার দুই ছেলে, এতদিন আফসোস ছিলনা কন্যা সন্তানের জন্য। যেদিন আপনি আমার হাত দুটো ধরে বাবার কথা বলে কাঁদছিলেন, সেদিনই আমার মনে হলো, এমন একটি মেয়ে আমারও যদি থাকতো! কী এমন ক্ষতি হতো, দুই ছেলের এক মেয়ে থাকলে!
রূপা একটু এগিয়ে এসে দুই হাত জড়ো করে ডাঃ মির্জাকে প্রণাম জানিয়ে বলল, স্যার, আমার বাবার প্রতিটি কথা আমরা বেদবাক্য হিসেবে জেনে এসেছি। এই যে বাবা বললেন, ভগবান সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, এটাও আমার কাছে বেদবাক্যের মত। আমি ধর্মভীরু একজন মানুষ, আমি ঈশ্বর খুঁজি মানুষের মাঝে, গাছপালা প্রকৃতির মাঝে। ঈশ্বর আমায় দেখা দেন। এই যেমন এখন বাবা বললেন, আপনি ভগবান, অবশ্যই আপনি ভগবান। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, আপনিই ভগবান, আপনিই আমার বাবাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
একটা কন্যা সন্তানের জন্য আক্ষেপ হচ্ছে! স্যার, আমার মন বলছে, আপনার দুই ছেলের বউ আপনার কন্যা হয়ে উঠবে। স্যার, তাহলে আপনি অনুমতি দিলে আগামীকাল বাবাকে বাড়ি নিয়ে যাই!
-ঠিক আছে, আমি রিলিজ অর্ডার তৈরী করতে বলে দেব। বাবা সুস্থ দেহে আরও নব্বই বছর বাঁচুন। বাড়িতে সকলেই একটু খেয়াল রাখবেন। এই বয়সে ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্সড হয়, সিম্প্টম শুরু হলেই আপনারা ডাক্তার ডাকবেন। ভালো থাকবেন বাবাকে নিয়ে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী মনোরম ও মনোহর লেখা।
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০২০
Kazi Nishan ভালো লেগেছে গল্পটি। আসলে মানুষের মানসিক দিক প্রফুল্ল থাকলে যেকোন বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যায়। শিশু কালে বাবা মা একমাত্র আপন। কৈশোরে ভালোবাসার ভালো লাগার মানুষ যোগ হয়। তারপর স্ত্রী/স্বামী সন্তান। বৃদ্ধ বয়সেও একমাত্র সম্বল সন্তান। তারা পাশে বসে মাথাইয় হাত বুলালেও ৬০% রোগ ভালো হয়ে যায়, বাকি ৪০% ডাক্তার দেখে। দুঃখের বিষয় বর্তমানে বাবার লক্ষ্মী মেয়ে কিছু দেখা গেলেও সে তুলনায় লক্ষ্মী ছেলে অনেক কম। হয়তো ছেলেদের সাথে লক্ষ্মী শব্দটা যায় না বলে...
Kazi Nishan ভালো লেগেছে গল্পটি। আসলে মানুষের মানসিক দিক প্রফুল্ল থাকলে যেকোন বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যায়। শিশু কালে বাবা মা একমাত্র আপন। কৈশোরে ভালোবাসার ভালো লাগার মানুষ যোগ হয়। তারপর স্ত্রী/স্বামী সন্তান। বৃদ্ধ বয়সেও একমাত্র সম্বল সন্তান। তারা পাশে বসে মাথাইয় হাত বুলালেও ৬০% রোগ ভালো হয়ে যায়, বাকি ৪০% ডাক্তার দেখে। দুঃখের বিষয় বর্তমানে বাবার লক্ষ্মী মেয়ে কিছু দেখা গেলেও সে তুলনায় লক্ষ্মী ছেলে অনেক কম। হয়তো ছেলেদের সাথে লক্ষ্মী শব্দটা যায় না বলে...
নাজমুছ - ছায়াদাত ( সবুজ ) অনেক অনেক অভিনন্দন প্রিয় লেখক।
Fahmida Bari Bipu অভিনন্দন জানবেন। অনেকদিন পরে লেখা দিয়েছেন মনে হয়।
Salma Siddika আন্তরিক অভিনন্দন
Salma Siddika আন্তরিক অভিনন্দন
Salma Siddika আন্তরিক অভিনন্দন
Jamal Uddin Ahmed অভিনন্দন! মন ছুঁয়ে যাবার মত গল্প।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

বাবা

১৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

সমন্বিত স্কোর

৬.০৮

বিচারক স্কোরঃ ৩.৪৮ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৬ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪