এই বাড়ির পেছনদিকে যাওয়ার দুটো দরজা আছে। একটি দরজা কিচেন থেকে, অন্যটি গ্যারেজ থেকে। দুটো দরজা থাকার কারণ আছে। গ্যারেজ থেকে যে দরজা, সে দরজা দিয়ে পেছনদিকে গেলে নাক বরাবর ছোট খুপরি ঘর আছে, যেটা স্টোরেজ রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর কিচেনের দরজা দিয়ে গেলে এক চিলতে ফাঁকা জমি পাওয়া যায় যেখানে গার্ডেন চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রাখলে বিকেলে বা সন্ধ্যায় বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দেয়া যায়।
তবে শরীফা খাতুন মেয়ের বাড়িতে যখন প্রথম এসেছিলেন, পেছনদিকের জমিটা ফাঁকা পড়েছিল। জমিতে না ছিল চেয়ার টেবিল, না ছিল গাছপালা। শরীফা খাতুনই ধীরে ধীরে পেছনের জমিতে গাছপালা লাগাতে শুরু করেন। আহামরি কোন গাছ নয়, দুই তিনটা টমেটো গাছের চারা, বেগুনের চারা, লাউ, কুমড়ার চারা দিয়ে শুরু করেছিলেন। এখন শরীফা খাতুনের বাগান আরেকটু বড় হয়েছে। মেয়ে জামাই বাগানের নাম দিয়েছে ‘মাম্মি’স গার্ডেন’। আমেরিকান সাহেব হলেও মেয়ে জামাইকে শরীফা খাতুনের ভীষণ পছন্দ। সাহেব জামাইও বাংলাদেশী শাশুড়িকে খুব ডাক খোঁজ করে, জামাইতো প্রতি বছর মাটি কুপিয়ে বেড বানিয়ে দেয়, বীজ এনে দেয়, চারা কিনে নিয়ে আসে। শরীফা খাতুনের মেয়ের এসব দিকে নজর নেই, কিন্তু খাওয়ার টেবিলে ঠিকই বেগুন ভর্তা, লাউয়ের খোসা ভাজি তার বেশি বেশি চাই। জামাইও খায়, তবে বেশি খেতে পারেনা। মেয়েতো গনগনে ঝাল খায়, কিন্তু জামাইতো ঝাল খেতেই পারেনা। মেয়ে অবশ্য বলে, “ ঝাল খেতে হবে। ঝাল খেতে শেখো”। শরীফা খাতুনের মায়া লাগে, আহারে, সাহেব মানুষ, সে কি পারে কাঁচামরিচ খাইতে? জামাইয়ের জন্য শরীফা খাতুন ঝাল ছাড়া রেঁধে দেন। এই বাগানের পেছনে জামাইতো সাহায্য করে, জামাইকে ফেলে তিনি খান কি করে?
শরীফা খাতুনের মেয়ের নাম জিনিয়া, জামাইয়ের নাম কেনেডি। বিয়ে হয়েছে ওদের বারো বছরের বেশি হয়ে গেলো। শরীফা খাতুন যে বছর আমেরিকা আসলেন, তার ঠিক দুই বছর আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। জিনিয়া নিজেই জামাই পছন্দ করেছে, জামাইর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। বউয়ের সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর জিনিয়ার সাথে বিয়ে হয়। জামাইর আগের পক্ষে চার ছেলেমেয়ে আছে, সবাই তাদের মায়ের সাথে থাকে। সপ্তাহে এক দিন বাবার কাছে থাকে।
চার জনের মধ্যে দুজন বড় হয়ে গেছে, ওরা আগের মত প্রতি সপ্তাহে আসেনা, ছোট দুই বাচ্চা প্রতি সপ্তাহের বুধবার আসে, বৃহস্পতিবার চলে যায়। জিনিয়ার ঘরে সন্তান হয় নাই। শরীফা খাতুনের অবশ্য তা নিয়ে কোন আফসোস নেই। মাঝে মাঝে তিনি ভাবেন, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্য করেন। জিনিয়ার ঘরে সন্তান হয় নাই, নিশ্চয়ই তা জিনিয়ার জন্য মঙ্গলজনক। কেনেডির বাচ্চারা যখন আসে, শরীফা খাতুন বাচ্চাগুলোকে অনেক আদর যত্ন করেন। তিনি মনে করেন, এই বাড়িতে যদি বাচ্চাদের আদর যত্ন হয়, তাহলে কেনেডির কাছে জিনিয়ার আদর বাড়ব। তিনি ওদের সাথে ইংলিশে কথা বলতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেননা। তবুও হাল ছাড়েননা, ইশারায় সব কথা বুঝিয়ে দেন। বাচ্চাগুলোর কোন বায়নাক্কা নেই, খাওয়ার সময় খায়, বেশির ভাগ সময় ভিডিও গেম নিয়ে বসে থাকে।
শরীফা খাতুন চেষ্টা করেন ওদের কাছে কাছে থাকতে, বাচ্চাগুলো দেখতে একেবারে পরীর বাচ্চাদের মত। উনি ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে দেন, চামচ দিয়ে তুলে খাইয়ে দেন। বাচ্চাগুলিও শরীফা খাতুনকে পছন্দ করে, ওরা শরীফা খাতুনকে ডাকে ‘ন্যানী’।
ছোট মেয়েটা মাঝে মাঝে ‘ন্যানী’র জন্য গিফট নিয়ে আসে। ন্যানীকে ইশারায় বলে চোখ বন্ধ করে হাত পাততে, এরপর ন্যানীর হাতে গিফট দিয়ে বলে “ ওপেন ইয়োর আইজ”। শরীফা খাতুন ইংলিশ বলতে না পারলেও এইসব ছোটখাটো ইংলিশ বুঝেন। ওপেন আর ক্লোজ বুঝবেননা কেন? ছোটবেলায় এমন খেলা কত খেলেছেন। শরীফা খাতুন চোখ খুলে দেখে হাতের তালুর মধ্যে চকলেটের প্যাকেট, নইলে কুকির প্যাকেট। শরীফা খাতুনের চোখে পানি চলে আসে। পরীর বাচ্চাগুলো তার মত এমন ফেলনা মানুষকে এত ভালোবাসে!
ইদানিং চকলেটের প্যাকেট, কুকির প্যাকেট শরীফা খাতুন একখানা বোয়ামে রেখে দেন। যেদিনই অরুণা আসে, অরুণাকে পরীর বাচ্চার দেয়া চকলেট, কুকি খেতে দেন। অরুণা বাংলাদেশেরই মেয়ে, জাতিতে হিন্দু হলেও শরীফা খাতুনকে খুব সুন্দর করে ‘খালা’ দাকে। এমনভাবে ‘খালা’ ডাকে, শরীফা খাতুনের চোখে পানি চলে আসে। মনে হয় যেন তাঁর নিজের মেয়েই তাঁকে ডাকছে।
অরুণাদের বাড়ি জিনিয়াদের বাড়ির কাছেই, হেঁটেই যাওয়া যায়। তবে অরুণাই আসে, শরীফা খাতুনকে যেতে হয়না। অরুণাই বলেছে, “ খালা, আপনার তো হাঁটতে কষ্ট হয়, আমিই আসব আপনাকে দেখতে। মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে আসব, আপনাকে গাড়িতে চড়িয়ে ধারে কাছে ঘুরিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। আমাদের বাড়িতে চা খাবেন, তারপর আপনাকে আবার গাড়িতে করেই বাড়ি পৌঁছে দেব”।
অরুণার কথা শুনলে শরীফা খাতুনের বুকে জমে থাকা কষ্টগুলো গলে যায়। মেয়েটা এত মায়া জানে! কোথাকার কোন বাড়ির মেয়ে, ধর্মেও মিলেনা, কিছুতেই মিলেনা। অথচ এই বুড়ির জন্য কত মায়া! নিজের ছেলেমেয়ে যদি শরীফা খাতুনকে এর অর্ধেক মায়া করতো!
দুই
গত তিনদিন একটানা বৃষ্টির পর আজই রোদ উঠেছে। বাড়িতে কেউ নেই, কেনেডি গেছে অফিসে, জিনিয়া গেছে শপিং করতে। শপিংয়ে গেলে জিনিয়া দিন পার করে বাড়ি ফিরে। ঘরে কোন কাজ কর্ম করতে হয় না, যখন খুশি বাড়ি ফেরো, বিনে পয়সার দাসীতো আছেই বাড়িতে। ঘরে ফেরার সাথে সাথে “ কি খাবি, কি খাবি” করে মাথা খারাপ করে দেয়। বড়লোক সোয়ামী, মেয়েকে তাই চাকরিও করতে হয়না। ঘরে সময় কাটেনা তাই কাছের একটা গ্যাস স্টেশানে মেয়ে নাকি ম্যানেজারের চাকরি পেয়েছে। শরীফা খাতুনের বিশ্বাস হতে চায়না, “এঃ হে রে, পুরানা পাগলে ভাত পায়না, নতুন পাগলের আমদানী। আমেরিকানরাই চাকরির লাইগা ফ্যা ফ্যা করে, আর তাইনে কত বড় লেডি আইছে, তারে ম্যানেজারের চাকরি দিয়া দিবে! আসলে ঐসব কিছুইনা, ঘরে থাকলে একটু হাত পা নড়াইতে হইব যে, পঁচাত্তর বচ্ছইরা বুড়ি মায় সব কাম করে, খাটে বইসা এই দৃশ্য দেখাওতো আরেক অশান্তি। ঐজন্যই তাইনে বাইরে গিয়া ফূর্তি কইরা বাড়িত ফিরে।”।
কিচেনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে শরীফা খাতুন বাগানে এসে দাঁড়ালেন। বেগুন গাছের গোড়ায় বেশ কিছু আগাছা জন্মেছে, আগাছাগুলো সাফ করে না দিলে বেগুন গাছগুলো বড় হতে পারবে না। শরীফা খাতুন আংটায় ঝুলানো গ্লাভস দুটো নামিয়ে হাতে পরলেন। গ্লাভস দুটো কেনেডি এই বছর মাদার ডে’তে গিফট দিছে। গ্লাভস পরা হাতে চিমটি দিয়ে দিয়ে তিনি একটা একটা করে আগাছা তুল্তে শুরু করেছেন।
আগাছা তুলছেন আর আপনমনে কথা বলছেন, “ মরার আগাছা, জনমের শত্তুর। মাত্র চাইর দিন আগেই এক বোচকা আগাছা তুলছি। আবার আগাছা ভইরা গেছে। চিমটাইয়া চিমটাইয়া কত ঘাস তুলা যায়?
তিন
টকটকে লাল রঙের কলিং বেল বাটনে অরুণা আরেকবার চাপ দিল। এই নিয়ে তৃতীয়বার বাজালো কলিংবেল। “কী ব্যাপার, বাড়িতে কেউ নেই নাকি! জিনিয়া অফিসে গেছে নিশ্চিত, কিন্তু খালাম্মা? খালাম্মা আসছে না কেন? শরীর টরির খারাপ করেনি তো আবার!”
জিনিয়াদের বাড়ির কলিং বেলের বাটনটার দিকে তাকালে অরুণার কাছে মনে হয়, জ্বলন্ত কোন চোখ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আগন্তুকের দিকে।
অরুণা যখনই আসে, তখনই কলিং বেলের বাটনটাকে খুব মন দিয়ে দেখে, লাল গনগনে চোখ মনে হয়। ছোটবেলায় পড়া এক ছড়ার কথা মনে পড়ে যায়, “ এক যে আছে একানোরে, সে থাকে তালগাছেতে চড়ে, কান দুটো তার নোটা নোটা, চোখ দুটো আগুনের ভাটা”। কবে কোথায় হারিয়ে যাওয়া শৈশবের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে অরুণার।
ডালাসে প্রচুর বাঙালির বসবাস হলেও অরুণাদের সাবার্বে বাঙালি নেই। ভারতীয় কিছু আছে, তাদের সকলেই সাউথ ইন্ডিয়ান। নিজেদের মানুষের সাথে সাউথ ইন্ডিয়ান বলে, অন্যদের সাথে ইংলিশ বলে। ওদের ইংলিশ উচ্চারণও সাউথ ইন্ডিয়ান উচ্চারণের মত। অরুণা ভাল ইংলিশ বলতে পারেনা বলে সাউথ ইন্ডিয়ানদের সাথে কথা বলতে পারেনা। সাউথ ইন্ডিয়ানরা হিন্দীও জানেনা, ওরা যদি হিন্দী জানতো তাহলেও অরুণার জন্য সুবিধা হতো। টিভিতে হিন্দী সিনেমা দেখতে দেখতে অরুণা হিন্দী কথা বলতেও পারে, বুঝতেও পারে। অরুণা আর ওর স্বামী একখানা কন্ডো হাউজে থাকে, একমাত্র ছেলে রাতুল আছে আটলান্টা জর্জিয়াতে। জর্জিয়া টেকে রাতুল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বাপও ইঞ্জিনিয়ার, ছেলেও একই লাইন পছন্দ করেছে। অরুণার খুব ইচ্ছে ছিল, রাতুল মেডিক্যাল স্কুলে যাক। কিন্তু মায়ের কথা রাতুল এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, ওর নাকি ডাক্তারি করার কথা মনে হলেই বিরক্ত লাগে।
জিনিয়ার আম্মার সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সাবার্বে অরুণার বন্ধু বলতে কেউই ছিল না। জিনিয়া বাংলাদেশি হলেও বিয়ে করেছে আমেরিকান সাহেবকে, ওর চালচলনও আমেরিকানদের মত হয়ে গেছে। হয়তো জিনিয়াকে অরুণা আগে দেখলেও বাংলাদেশী ভাবেনি। আসলে জিনিয়ার আম্মার সাথে সেদিন ডলার স্টোরে দেখা নাহলে অরুণা জানতেই পারতোনা ওদের বাড়ির পাঁচ বাড়ি পরেই এক বাংলাদেশি পরিবার আছে।
জিনিয়ার সাথে বন্ধুত্ব না হলেও অরুণা প্রায়ই জিনিয়াদের বাড়ি আসে, জিনিয়ার আম্মার সাথে গল্পগুজব করতে।
জিনিয়ার আম্মার সাথে ডলার স্টোরে পরিচয় হওয়ার ঘটনাটা আজও অরুণার মনে পড়ে। অরুণার খুব চায়ের নেশা আছে। দুধ, চিনি, চা পাতা জ্বাল দিয়ে কড়া লিকারের চা খেতে খুবই পছন্দ করে সে। লিকার চা, গ্রিন টি, আইসড টি--- ওসবে হবেনা। আগুন গরম দুধ চা না পেলে অরুণার কাছে মনে হবে, এই বুঝি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে!
সেদিনও চূলায় চায়ের জল চাপিয়ে অরুণা ফ্রিজ থেকে দুধের জার বের করতে গিয়ে দেখলো, দুধ জারের তলানীতে এসে ঠেকেছে। আগে খেয়াল করেনি, নাহলে গতকালই ওর স্বামীকে বললে ক্রোগার থেকে দুধ নিয়ে আসতো। তখন অরুণার স্বামীও বাড়িতে নেই, অত অল্প দুধে চা ভাল হবেনা। চূলা বন্ধ করে অরুণা বের হলো পাড়ার কাছের কনভিনিয়েন্ট স্টোরের দিকে। হেঁটে গেলে পনেরো মিনিট, গাড়িতে লাগে পাঁচ মিনিট। অন্য সময় হেঁটেই যাওয়া যেতো, কিন্তু তাহলে চা বানাতে দেরী হয়ে যাবে ভেবে অরুণা গাড়ি নিয়েই গেলো।
স্টোরের নাম ‘ডলার জেনারেল’। এই স্টোরে মোটামুটি সুলভ মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পাওয়া যায়।
দুধের জারের দাম দিচ্ছিল অরুণা, খেয়াল করলো স্টোর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দরজার পাশে রাখা লম্বা চেয়ারে এক বুড়ি বসে আছে। চেহারা পোশাক দেখে মনে হচ্ছে খুব সম্ভব মিডল ইস্টের কোন দেশের মানুষ। বুড়ি মাথা দুলাচ্ছে, অল্প অল্প হাত নেড়ে কিছু বলছে। আশেপাশে কেউ নেই, বুড়ি একা একা কথা বলছে। মাথায় গোলমাল আছে মনে হয়। অরুণা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ “ আমি কিচ্ছু জানিনা” কানে আসতেই ও ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পাশের চেয়ারে বসা বুড়ির দিকে তাকালো। বুড়ি ভিন ভিন করে কথা বলে চলেছে। “ আমি কি ওরে কিছু কইছি” কানে আসতেই অরুণা দাঁড়িয়ে পড়লো। এই বুড়ি বাংলায় কথা বলছে, বাংলায় কথা বলছে!!
অরুণা বুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ডাকলো, “ এক্সকিউজ মি, হেলো, এক্সকিউজ মি”।
ঘোলাটে চোখে বুড়ি মুখ তুলে অরুণার দিকে তাকালো। অরুণা বলল, “ আর ইউ ওয়েটিং ফর সামবডি?”
বুড়ি মাথা এপাশ ওপাশ দোলালো। অরুণা বলল, “ ডু ইউ নিড হেল্প? হোয়ার ডু ইউ লিভ ইন? ডু ইউ নিড আ রাইড?”
বুড়ি বলল, “ নো ইংলিশ”।
এবার অরুণা সরাসরি বাংলায় বলল, “ আপনি কি বাঙালি?”
বুড়ি স্পষ্ট চোখে অরুণার দিকে তাকিয়ে বলল, “ তুমি কেডা?”
ওটাই প্রথম পরিচয়, অরুণা গাড়িতে উঠিয়ে শরীফা খাতুনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। পরে জানতে পেরেছে, মাঝে মাঝে শরীফা খাতুনের মাথার বায়ু চড়ে যায়, তখন তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পরেন, হাঁটতে হাঁটতে নিরালা কোন স্থানে বসে আপনমনে কথা বলতে থাকেন। মাথা ঠান্ডা হলে আবার নিজ থেকেই বাড়ি ফিরে আসেন। অরুণা তথনই জানতে পারলো, ওদের বাড়ির কাছেই বাংলাদেশি একটি পরিবার আছে অনেক বছর ধরে। সেদিন থেকেই অরুণার দিনকাল বদলে যেতে থাকে। আগে বেশ মনমরা হয়ে থাকতো সে, এখন আর তেমন হয়না। জিনিয়ার সাথে তেমন কথা না হলেও জিনিয়ার মায়ের সাথে প্রায় আত্মীয়তা সম্পর্ক হয়ে গেছে ওর। এটুকুইতো চেয়েছিল অরুণা, বিদেশ বিভুঁইয়ে একজন অন্ততঃ কাউকে পাওয়া যার সাথে বাংলায় কথা বলা যায়।
চার
কলিং বেলের লাল চোখে আরেকবার চাপ দিতে যেতেই ভেতর বাড়িতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। কেউ আসছে দরজা খুলে দিতে। অন্য কেউ নয়, খালাম্মা নিজেই দরজা খুলে দিয়েছেন।
-খালা, অনেকক্ষণ ধরে বেল টিপছি, কেউ দরজা খুলছেনা দেখে ভয় পেয়েছিলাম।
-কিসের ভয় গো মা? ভাবছিলা বুড়ি বুঝি ‘হাটফেল’ কইরা মইরা গেছে?
-দূর খালা, এমন অলক্ষুণে কথা বইলেন না তো! এতকিছু ভাবার ফুরসত পাইনি। এমনিতেই ভয় পেয়েছি, আশেপাশে কাউকে না দেখতে পেলে আমার ভয় লাগে। ছোটবেলা থেকেই আমার এই সমস্যা। এই যে আপনাদের বাড়ি এসে বেল টিপছি, কেউ দরজা খুলছেনা, সাথে সাথে সেই ভয় এসে ভর করেছিল। কেন ভয়, কিসের ভয় জানিনা, বাড়িতে কেউ নেই ভেবেই ভয় লাগছিল।
-জামাই বাবাজি যখন অপিসে যায়, তহন একলা বাড়িতে ক্যামনে থাক গো মা? তহন ডর করে না?
-আগে ভয় লাগতো, কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু ভয়টা পুরোপুরি যায়নি। আপনার জামাই অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরী হলেই আমার ভয়টা শুরু হয়।
-ডাক্তর দেখাওনা ক্যান? ডরে ডরে জীবন কাটাইতে ভাল্লাগে?
-হা হা হা! খালা ভয়ে ভয়েই তো কাটিয়ে ফেললাম জীবন। এখন ডাক্তার বেটে খাওয়ালেও আমার ভয় যাবে না। যাক গে, কই ছিলেন খালা? কিচেনে?
-বাগানে ছিলাম, বেগুন গাছের গোড়ায় অনেক আগাছা জন্মাইছে। সেগুলি তুইল্লা ফেললাম।
-খালা, আপনার কি মজা। নিজের হাতে গাছ লাগান, নিজে যত্ন করেন, যখন সবজি হয়, কত্ত আনন্দ লাগে তাইনা?
-হ, যেই না বাগান! পাক ঘরের পিছনে এই এট্টুখানি খালি জমি ছিল, ঐটুক জায়গাতেই কয়েকটা গাছ লাগাইছি। এইডা কোন বাগান হইলো? আমার বড় পোলার বাগান দেখলে তাইজ্জব হইয়া যাইবা। একদিন তোমারে লইয়া যামু নে পোলার বাড়ি। বড় পোলার বাড়ি এই বাড়ির থিকা অনেক বড়, বাড়ির পিছনে বিশাল জমি। পোলা ঐ জমিতে কত যে গাছ লাগাইছে, নিজেই যত্ন করে। বৌ চাইয়াও দেখে না। দেখবো ক্যা, সোয়ামী গাছ লাগায়, গাছে পানি দেয়, গাছের ফসল তুইল্লা আইনা বউয়ের আঁচলে দেয়। বউয়ের ত কিছু করা লাগেনা।
-হা হা হা! খালা, আপনার কথা শুনলে আমার মন ভাল হয়ে যায়। বউ বাগানে কাজ করেনা বুঝলাম, সব্জিগুলো রান্না করে খাওয়ায় তো আপনার ছেলেকে?
-কেডা খবর লইতে যাইব? খাওয়াইলে খাওয়ায়, না খাওয়াইলে নাই। পোলা দয়া কইরা আমারে মাঝে মাঝে কয়ডা বেগুন, সিম পাঠায়।
-থাক খালা, আপনি নিজের হাতে যেটুকু করেন, সেই ভাগ্যই কজনের হয়? এই যে আমাকে দেখুন, যে বাড়িতে থাকি, রাস্তার উপরে বাড়ি, এক হাত জমিও নাই। শখ করে যে একটা গোলাপ গাছ পুঁতবো, সেই মাটিও নাই। অথচ আমি গেরস্ত ঘরের মেয়ে, আমার মায়ের খুব শখের কাজ ছিল সবজি বাগান, ফুল বাগান করা। আমাদের বাড়িতে যত ফুল ফুটতো, পাড়ার সবাই এসে আমাদের বাগান থেকে পূজার ফুল নিয়ে যেত। লাউ বেগুনতো আমাদের কিনে খেতে হয়নি কখনও। সেই বাড়ির মেয়ে আমি, একটা গোলাপ গাছ লাগানোর মত জমি নেই আমার।
-হ, এই কথা জিনিয়াও কয়। আমি যখনই বড় পোলার বাগানের কথা কই, জিনিয়া কয়, “ আম্মা, যা পেয়েছো তাতেই শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলো। পরের জিনিসের দিকে দৃষ্টি দিওনা”।
আমি কইছি, জিনিয়া, এইডা কেমুন কথা কইলা? জসিম আমার পেডের ছাওয়াল, জসিম আমার পর হয় ক্যামনে?
-খালা, জিনিয়া ওটা কথার কথা বলেছে। অত ভেবে বলেনি।
-মা গো, ভেবে বলবেনা কেন? আমি তাদের মা না? আমার মনে আনন্দ ব্যথা থাকতে পারেনা? আমার কিছু চাওয়া পাওয়া থাকতে পারেনা?
শরীফা খাতুনের কথায় বেশ ঝাঁঝ ফুটে উঠেছে। অরুণা চাইছেনা বুড়ো মানুষটাকে উত্তেজিত করে দিতে। খালা এমনিতে কখনও উত্তেজিত হয়না, আজ কোন কারণে হয়তো মন খারাপ। অরুণা বলল, “ খালা, সবার জীবনেই চাওয়া পাওয়া থাকে, আপনারও ছিল, এখনও আছে। সবার সব চাওয়া তো পূর্ণ হয়না।
- আমার জীবনের আর কতটুকুই বাকি আছে কও! আইজ আছি, কাইল নাও থাকতে পারি। কেমনে কেমনে লম্বা একটা জীবন পার কইরা ফেললাম। চাইছিলাম কত কিছুই, পাইলাম আর কি? বয়স পঁচাত্তর, মরণ তো দরজায় কড়া নাড়ে। আইজ দরজায় তুমি বেল টিপছো, কাইল আজরাইল কড়া নাড়বো। তোমার কাছে তো তাও মনের দুঃখ কওনের সুযোগ পাইলাম, তুমিও শুনতাছো, কিন্তু আজরাইল তো আমার দুঃখের কথা শুননের লাইগা দুই মিনিট দাঁড়াইবো না। আইবো, আর টানতে টানতে আমারে লইয়া যাইবো গা। কত কিছু পাওনা ছিল এই জীবনে, তার কিছু না পাইয়াই আমারে চইলা যাইতে হইব!
-খালা, কী যে বলেন! জানেন খালা, আপনাকে দেখলে আমার সব সময় মায়ের কথা মনে পড়ে। আপনি অনেক ভাগ্যবতী, জীবনের শেষ পর্যায়ে হলেও আমেরিকা দেখে ফেললেন। আপনার মেয়েটাও ভাগ্যবতী, তাই আপনাকে আমেরিকা দেখাইতে পারছে। আমার মায়ের খুব শখ ছিল দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু হয় নাই, আমেরিকা দূর কি বাত, ঘরের চৌকাঠই ডিঙ্গাইতে পারে নাই কোনদিন। আমার মা ছিল পোড়াকপালি, মায়ের কন্যা আমিও হইছি আরেক পোড়াকপালি। মায়ের একটা শখ, তাও পূরণ করতে পারিনি। কত মানুষের মা বাবা দেশ থেকে বেড়াতে আসে, আমার বাবা মাই শুধু এলোনা।
-হা হা হা হা
-খালা, হাসছেন কেন? মা’কে পোড়াকপালি বলেছি বলে?
-নাগো মা, তোমার মায়েরে পোড়াকপালি কইছো বইলা হাসি নাই, আমারে ভাগ্যবতী কইছো, তাই হাসতাছি। তেইল্লাচোরাও পক্ষী, আমিও ভাগ্যবতী!! হেঃ কত বড় কপাল আমার দেখছো, ওড়না পেঁচাইয়াও ঢাকতে পারিনা। এত্ত বড় কপাল!
-খালা, এমন করে বলছেন কেন? আপনার কি আমেরিকা ভাল লাগছে না?
শরীফা খাতুনের মুখ থেকে হাসি মুছে গেলো, হাতের কাছে রাখা প্লাস্টিকের কৌটোর ঢাকা খুলে পিচ করে পানের পিক ফেললেন। কৌটোর মুখে আবার ঢাকা দিয়ে হাতের তালুতে ঠোঁটে লেগে থাকা পানের রস মুছলেন।
শরীফা খাতুনকে চুপ হয়ে যেতে দেখে অরুণা অস্বস্তি বোধ করছে। সারাক্ষণ কথা বলে যে মানুষ, তিনি কেন এমন চুপসে গেলেন। অরুণা নিজের অজান্তেই উনাকে ব্যথা দেয়নি তো!
-খালা, আমি কি আপনাকে মনে ব্যথা দিয়েছি? খালা, আমার মা নেই, আশেপাশে আত্মীয়স্বজনও নেই। কতকাল হয়ে গেলো আমাকে কেউ নাম ধরে ডাকে না। আমিতো লেখাপড়াও তেমন শিখিনি যে এদেশে চাকরি পেতে পারি। পাড়া প্রতিবেশী যারা আছে তাদের সবাই বিদেশি, কারো সাথে যে মন খুলে কথা বলবো সেই উপায় নেই। ইয়েস নো ভেরি গুড ইংলিশ দিয়ে কি আর মন খুলে গল্প করা যায়! এই দেশে একা একা আছি, প্রায় ভুলেই গেছিলাম আমার নাম অরুণা, বাবা ডাকতো অরু মা, মা ডাকতো অরু। কতকাল হয়ে গেলো, কেউ আমাকে অরুণা বলে ডাকেনি। কতকাল পর আপনাকে পেয়েছি, তাই মনের উচ্ছ্বাসে হয়তো দুই একটা বেশি কথা বলে ফেলি।
-ক্যান, তোমার সোয়ামী তোমারে নাম ধইরা ডাকেনা? নাকি জিনিয়ার জামাইয়ের মত তোমার সোয়ামীও তোমারে ‘হানি, বেবি’ কইয়া ডাকে! ---হা হা হা হা হা হা
-খালা , হি হি হি হি! কী যে বলেন। জিনিয়ার তো সাহেব বর, সাহেবরা স্ত্রীকে হানি ,বেবি ডাকে। আমার স্বামী তো বাংলাদেশের ছেলে, সে আমাকে কখনও নাম ধরে ডাকেনি। রাতুল জন্মাবার আগে পর্যন্ত “ অ্যাই, ওগো, শুনছো” বলে ডাকতো। এরপর থেকে আজ অবধি ‘রাতুলের মা’ ডাকে।
-হায় আল্লা, কী কও! জামাই বাবাজী এত শিক্ষিত, এত বড় অফিসার, সাহেবগো লগে এক টেবিলে খানা খায়, আর ঘরে ফিরা তোমারে ডাকে ‘রাতুলের মা’? হি হি হি হি!
-অভ্যাস তো খালা। বড় অফিসার হলে কি হবে, তার জন্ম কর্মতো পাড়া গায়েঁ। সে ছোটবেলায় তার বাবা, কাকাকে যেমন দেখেছে, তেমনটাই শিখেছে। লেখাপড়া শিখেছে, ইঞ্জিনিয়ার হইছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বইয়ে তো লেখা থাকেনা বউকে হানি বেবি ডাকার কথা। হা হা হা হা হা!
-হা হা হা হা! ঠিকই কইছো গো মা।
-খালা, আপনার হাসি দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো আমার। তখন আপনাকে মুখ কালো করতে দেখে ভয় পেয়েছিলাম।
-তুমি একটা ডউরা মাইয়া। সব কিছুতেই খালি ডরাও। এত ডরাও ক্যা?
-যদি আপনার মনে ব্যথা দিয়ে থাকি, মুরুব্বি মানুষ, মা কইতো, গুরুজনের মনে ব্যথা দিতে নাই।
-তোমার বুকে মা’র লাগি খুব পোড়ায়?
-হ্যাঁ খালা, মায়ের জন্য বুক পোড়ায়। আপনাকে যেদিন প্রথম দেখলাম, একটু চমকে গেছিলাম। দূর থেকে আমার মায়ের মত লাগছিল। যখন জানলাম আপনি বাঙালি, আনন্দে সেই রাত্রে আমি অনেক কেঁদেছি খালা।
-আনন্দে কানছো? এত কান্দনি হইলে চলে? আমিও একটা মানুষ, তেইল্লাচোরাও একটা পক্ষী!
-দূর খালা, সব সময় নিজেরে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন কেন?
-মাগো, আমি নিজেরে তুচ্ছ জানার আগেই লোকজন আমারে তুচ্ছ জাইনা ফেলছে। নিজের লোকজন, আমার পেটের থিকা যাগোরে বাইর করছি, বুকের দুধ খাওয়াইয়া বড় করছি, সেই সকল লোকজনই আমারে সক্কলের আগে তুচ্ছ জ্ঞান করছে। পুতের বউরে দোষ দিয়া লাভ নাই, মাইয়ার জামাইরে দোষ দিয়াও লাভ নাই। আমার জীবন হইলো ‘কেউচ্ছার’ জীবন, খালি মাটির ভিতরে ‘সাইন্দা’ থাকতে পারলে বাঁচি।
-খালা, দূর থেকে আপনাকে দেখি, পরিপূর্ণ একজন মা মনে হয়। চার ছেলে মেয়ে আপনার, সকলেই আমেরিকা লন্ডনে ভালোভাবে আছে। ছেলেমেয়েদের কারোরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়না। আপনি ইচ্ছে হলেই আজ মেয়ের বাড়িতে থাকেন, কাল ছেলের বাড়িতে থাকেন। দেশে আপনার কোন পিছুটান ফেলে আসেননি। শেষ জীবনে সন্তান সন্ততিকে বুকের পাশে নিয়ে থাকতে পারা যে কত ভাগ্যের! আমার মা বাবার ভাগ্যে তো এমন সৌভাগ্য আসেনি।
মা মারা গেলো একা ঘরে! তখন আমি ছিলাম আমেরিকা, আমার দিদি ছিল রাজশাহী ওর শ্বশুরবাড়িতে, আর একমাত্র ভাই ছিল ব্যাংকক, বউ নিয়ে বেড়াতে গেছিল। বাবা বাজারে গেছিল, বাজার থেকে ফিরে দেখে মা রান্নাঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। রানতে রানতেই হার্ট এটাক, ওখানেই মৃত্যু।
-এইজন্যই তুমি ডরাইছিলা কলিং বেল টিপা? ভাবছো খালা বুঝি পাকের ঘরে মইরা রইছে?
-ছি ছি, বালাই ষাট। এমন ভাববো কেন খালা? আপনি বেঁচে থাকুন আরও অনেক বছর।
-নাগো মা, তোমারে একটা সত্য কথা কই, আমার কিন্তু বাঁচার শখ মিটে গেছে। আত্মহত্যা করা গুনাহ, তাই মরতে পারিনা।
-কেন গো খালা, এমন কেন বলেন? আপনার ছেলে মেয়েরা আপনাকে অনেক যত্ন করে, আপনি এক সময় ওদের যত্ন করে বড় করেছেন, ওরা এখন আপনার যত্ন নেয়।
-শোন, আমারে জিনিয়ার চাইতে অনেক বেশি ভালোবাসে জিনিয়ার আমেরিকান জামাই। হি হি হি হি! জিনিয়া আমারে দিনে একবার আম্মা কইয়া ডাকে কিনা জানিনা, কিন্তু কেনেডি আমারে ‘মাম্মি’ মাম্মি’ করতেই থাকে। অপিস থিকা ফোন কইরা সংবাদ নেয়, আমি খাইছি কিনা। জিনিয়া জানতেও চায়না আমি খাইছি কিনা। উলটা খাইতে বইসা আমার রান্দার ভুল ত্রুটি বাইর করে আর ‘ইয়াক, ইয়াক’ কইরা তরকারির বাটি সরায়ে দেয়।
শরীফা খাতুনের মুখে এমন কথা শুনবে অরুণা ধারণাও করেনি। অরুণা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে শরীফা খাতুনের মুখের দিকে। শরীফা খাতুন বলে চলেছেন,
-তবে, একটা কথা ঠিক, জিনিয়া আমারে ওর সংসারে আইনা রাখছে। নাইলে আমার যাওয়ার কোন জায়গা ছিল নাতো। আমার বড় পোলার এত বড় বাড়ি, বড় পোলাই আমারে স্পন্সর কইরা আনছিল। ছয় মাস না যাইতেই পোলার বউ দেখি সকালে ঘুম থিকা দেরি কইরা ওঠে, রান্দন ঘরে যায়না, পোলাপানগো লাইগা দোকান থিকা বার্গার কিনা আনে, পিজা কিনা আনে। নিজেও খায়, পোলাপানেও খায়, আমি বুড়ি না খাইয়া বইয়া থাকি। পোলা অপিস থিকা আসলে সবতে মিলা হোটেলে গিয়া খায়। পোলা জানতেও চায়না মায় কি খাইব, মায় কিছু খাইছে নি।
শরীফা খাতুনের গলা ধরে গেলো, চোখে জল এলো। ঘরে তিনি ঢোলা গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরে থাকেন। হাত দিয়ে গেঞ্জিটাকে তুলে দুই চোখ মুছলেন। অরুণা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে, খালার আজ কোন কারণে মন খারাপ।
“ শোন, আমি ভাল বংশের কন্যা ছিলাম, তবে দেখতে তোমার লাহান সুন্দর ছিলাম না তো, তাই সময়মত আমার বিয়া হয় নাই। পাত্রপক্ষ আইতো, পোলাও কোর্মা খাইয়া মুখ ধুইয়া যাইতো গা। শেষে অনেক বয়সে তোমার খালুর লগে বিয়ার প্রস্তাব আইলো। প্রস্তাব যহন আইলো, একখান কথা আমার কাছে গোপন রাখা হইল। পোলার আগের পক্ষে এক পোলা এক মাইয়া আছে, সেই পোলা মাইয়ারে যদি মায়ের স্নেহ দিয়া রাখি, তবেই এই বিয়া হইব। এই কথা আমারে জানানো হয় নাই। শুধু বলা হইছে, পাত্রের বয়স কিছু বেশি। আমি অমত করি নাই, আমার নিজেরই বয়স বেশি, তার মইদ্যে দেখতে শুনতেও ভালা না। বাপ মইরা গেছে, মাও যদি মইরা যায় আমার কি গতি হইব?
বিয়া হইয়া গেলো, বিয়ার রাইতে সোয়ামী আমারে কইল, আমার পোলা মাইয়ারে তুমি মায়ের স্নেহ দিয়া বড় কইরা তুইলো, তোমার কাছে এইটাই আমার চাওয়া।
সোয়ামীর মুখে বিয়ার রাইতে এমুন কথা শুইনা আমি তব্দা লাইগা গেছি। বিয়া অইতেই পোলা মাইয়া আইলো কইত্থনে?
ধীরে ধীরে সব মাইনা লইলাম। পোলা মাইয়া দুইজনেরেই আদর যত্ন করি। এরপরে আমার নিজের কোল জুইড়া আসে আরেক পোলা, আরেক মাইয়া। চাইর পোলা মাইয়া লইয়া সংসার আমার। পোলামাইয়া লেখাপড়া করে, আমি তাগোরে ভাত মাছ রাইন্দা খাওয়াই। বড় পোলা ব্যাংকে চাকরি পাইলো, বিয়া কইরা আলাদা বাসা কইরা চইলা গেলো। আরেক পোলা তহন কলেজে ঢুকছে। জিনিয়া তখন কলেজে পড়ে, আর মুনিয়া মেট্রিক দিব। ওগো বাপের শইল ভাইঙ্গা পড়ছে ততদিনে, জমিজমা যা আছিল সবই বেইচা পোলামাইয়ার লেখাপড়ার পিছনে খরচ করছে। আর আমারে শুধু কইছে, “ জসিমের মা, অনেক কষ্ট করছো আমার সংসারে আইসা, আর কিছু দিন। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শেষ করতে পারলেই তোমার দিন বদলাবে। ওরা চাকরি বাকরি করবে, তুমি খাটে বসে খাইবা”।
আমি কইতাম, “ আমি একলা খামু ক্যান, কষ্ট কি একলা আমি করছি? আপনি করেন নাই?
-জসিমের মা, আমি ততদিন থাকুমনা। আর কষ্ট আমি করছি আমার চার ছেলেমেয়ের জন্য, তুমি অতিরিক্ত কষ্ট করছো আরেকজনের ছেলেমেয়ের জন্য। কাজেই সওয়াব তোমার পাওনা।
অরুণা, মা গো, অনেক লজ্জার কথা, অনেক দুঃখের কথা। সংক্ষেপে কই, তাগোর বাপ কিন্তু সত্য সত্যই পোলামাইয়ার রোজগার খাওয়ার বরকত পায় নাই। মুনিয়া পাড়ার এক গুন্ডা পোলার লগে প্রেম কইরা ভাইজ্ঞা গেছিল। হেই পোলার হাত থিকা মুনিয়ারে ছুটাইতে কী পরিমাণ টাকা খরচ হইছে। মুনিয়া লেহাপরায় ভাল আছিল। বাড়িতে ফিরায়ে আইনা ওর পাছার লগে লাইজ্ঞা বইয়া রইছি, ও পড়ছে। মুনিয়া মেট্রিকে ভাল রেজাল্ট করছে, ইন্টারে ভাল করছে। এরপর টোফেল দিছে, আমেরিকা চইলা আসছে। স্কলারশিপ পায় নাই, বাপেরে টাকা পাঠাইতে হইতো। বাড়িটা বেইচ্চা দিছে, ভাড়া বাড়িত থাকছি আমরা হের পরে। জিনিয়া এম এ পাশ কইরা একটা এনজিওতে চাকরি নিছিল, সেইখানেই কেনেডির সাথে পরিচয়। পরিচয় থিকা বিয়া, আমগো পয়সা খরচ করতে হয় নাই, ওরা কোর্টে গিয়া বিয়া করে ফেলছে। ব্যস, জিনিয়া চলে আসছে কেনেডির সাথে আমেরিকায়। একদিন শুনি জসিমে ডিবি পাইছে। তহন ডিবির খুব চল। জসিমে তার বউ পোলাপান লইয়া আমেরিকা আইসা পড়বো, বাপের থিকা প্লেনের টিকিটের টাকা নিলো। বাকি রইলো ছোট পোলা, সে তখন বাড়িতেই ফিরতোনা। আমরা বুড়া বুড়ি থাকি ভাড়া বাসায়। মুনিয়া কি করে তাও জানিনা। হঠাৎ একদিন জিনিয়া ফোন কইরা জানাইলো, মুনিয়া নাকি আন্ডারগ্র্যাড পাশ করে নাই, তার আগেই কোন এক কাউলা পোলারে বিয়া কইরা আমেরিকান সিটিজেন হইয়া গেছে। বাপের পাঠানো টাকা কিন্তু নিছে নিয়মিত, বাপেরে জানায় নাই তার আকামের কথা।
তোমার খালু শেষের দিকে আমারে আর আশার কথা শুনাইতোনা। একদিন জসিম আমগোরে কাগজপত্র পাঠাইলো। ছোট পোলা আইলোওনা আমগো সাথে দেখা করতে। সে তখন স্টাডি ট্যুরে গেছে, আমরা বুড়াবুড়ি আমেরিকা চলে আসি। প্রথমে জসিমের বাড়িতেই উঠছি, দেশে ফালাইয়া আসা ছোট পোলার লাইগা কান্দি। মুনিয়া আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখে নাই। কই আছে, কার লগে আছে কিছুই জানিনা। জিনিয়া প্রতিদিন ফোন করতো। এক বছর পরেই তোমার খালু মারা গেলো, হার্ট ফেল করছে ঘুমের মইদ্যে। তখন আমার মাথাডা একটু আউলাইছে। সারাক্ষণ কথা কইতাম আপনমনে। তখন খুব খারাপ সময় গেছে। জসিম দূর্ব্যবহার করতো, জসিমের বউতো পারলে আমারে বাড়ির থিকা চইলা যাইতে বলে। জিনিয়ার কাছে যাইতে কয়, মুনিয়ার কাছে যাইতে কয়। নাইলে বাংলাদেশে ফিরা যাইতে কয়।
আল্লাহর কাছে কাইন্দা কইতাম, হে আল্লা, তুমি আমারে বাঁচাও। তুমি রহম করো আল্লা, এই অপমানের জীবন আর ভাল্লাগেনা। এমুন একটা জীবন কি আমার পাওনা আছিল? আমি কি জীবনে খুব বেশি কিছু চাইছিলাম? স্বামী সন্তান লইয়া গুছানো একটা সংসার চাইছিলাম। কিন্তু কি পাইলাম? দেখতে কালা ছিলাম বইলা বয়সকালে বিয়া হয় নাই। কালা কি আমি নিজে শখ কইরা হইছি? তুমি আমারে কালা বানাইয়া পাঠাইছো দুনিয়ায়। শেষ মেশ যাও বিয়া হইল তাও দোজবরে বিয়া হইছে। বেডার আগের পক্ষে দুই পোলা মাইয়া। বেডায় বিয়ার আগেই শর্ত দিল, সৎ পোলা মাইয়ারে নিজের সন্তান মনে করতে হইব। আমি সবই মানছি। মানুম না ক্যান, মা মরা পোলাপান, আমার কাছে মায়ের স্নেহ চাইতেই পারে। আমি যদি ওদের স্নেহ না করি কে ওদের দেখভাল করবো? বিয়ার পর আমি সত্য সত্যই ওদের ‘মা’ হইয়া গেলাম। একবারও মনে হয় নাই, ওরা আমার সৎ পোলা মাইয়া। হের পরে নিজের পেটেও আইলো দুই সন্তান। কাউরেই আমি কম নজরে দেখি নাই। আইজ আমার এই কি হাল হইছে? জমি জমা, ঘর বাড়ি কিছুই নাই আমার, আমি কই যামু? “
আমার কান্দায় নিশ্চয়ই খোদার আরশ কাঁপছে। খোদা এঞ্জেল পাঠাইছে আমার কাছে। এঞ্জেলটা কে জানো? কেনেডি, জিনিয়ার সাহেব সোয়ামী। হি হি হি হি! জিনিয়া একদিন আমারে ফোন করছিল, ফোনে আমি কানছিলাম। পাশে ছিল বোধ হয় কেনেডি, সব শুইনা কইছে, “ আমিই মাম্মিকে আমার কাছে নিয়ে আসব”। কেনেডি সত্যই আসছে, জসিমরে কইছে, ও আমারে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চায়।
জসিম এমুন পোলা, আমেরিকান সাহেবের কাছে মায়েরে দিয়া দিল। কেনেডি আমারে তার সাথে লইয়া গেলো। দুই বছর পর ওরা আগের জায়গা ছাইড়া এইখানে আইসা বাড়ি কিনলো। কারণ কেনেডি আমার খুশির কথা চিন্তা কইরা জসিমগো কাছাকাছি চলে আসছে যাতে আমি জসিম আর জিনিয়ার কাছাকাছি থাকতে পারি। তা ছাড়াও কেনেডিরও সুবিধা হইছে, ওর আগের বউতো এইখানেরই মাইয়া, তাই কেনেডি নিজের পোলাপানরে এখন প্রতি সপ্তায় দেখতে পারে।
-খালা, জিনিয়া আর জসিম ভাইয়া আপনার আগের পক্ষের সন্তান?
-হা হা হা! ঐটাই সত্য, কিন্তু আমি ভুইলা গেছি। আসলে আমার চাইর সন্তান, কিন্তু আমি ওদের কারোরই মা নই। আমি কেনেডির মাম্মি, কেনেডি আমার অ্যাঞ্জেল। বাংলায় এঞ্জেলরে কি কয়, ফেরেশতা?
-ফেরেশতা বলে, দেবদূত বলে। আল্লাহ যখন পাঠিয়েছেন, তাহলে ফেরেশতা।
-নাগো মা, কেনেডি আমেরিকান সাহেব, ওরে বরঞ্চ অ্যাঞ্জেল ডাকাই ভালো। তোমারে কই নাই, আমি কেনেডিরে ‘এঞ্জেল’ কইয়াই ডাকি।
শরীফা খাতুন আজ অনেক কেঁদেছেন, তবে ‘এঞ্জেলের কথা বলতে গিয়ে উনার মুখ থেকে ব্যথার ছাপ মুছে গেছে। এখন উনার মুখে কী সুন্দর সুখী সুখী আলো খেলা করছে।
অরুণা বলল, খালা আজ উঠি? আপনি এখন বরং একটু বিশ্রাম নিন। কিছু খেয়েছেন খালা?
-হ, খাইছি দুধ সিরিয়াল। ‘এঞ্জেল’ প্রতিদিন সকালে নিজের লাইগা দুধ সিরিয়াল রেডি করে, আমারেও বানাইয়া দেয়। আইজ তোমার কাছে মনের ভার কিছুটা লাঘব করলাম। আরও অনেক কথা আছে। তোমার খালুর কথাই ঠিক, আমার শেষ জীবনটায় সুখ আইছে। একটাই তফাৎ সুখ আমার পেটের সন্তান দিয়া আসে নাই, আমি এক মায়ের দুই সন্তান মানুষ করছি, আমারে সুখ দিতাছে আরেক মায়ের পোলা। লেনা দেনা শোধ বোধ হইয়া গেছে, কী কও অরু মা?