রহস্যময়ী আন্টি

রহস্যময়ী নারী (জুলাই ২০১৬)

রীতা রায় মিঠু
  • ৬৮
রহস্যময়ী আন্টি

“এটা কার নাম্বার, এরিয়া কোড ওহাইও স্টেটের, আমার কোন আত্মীয় স্বজন, বন্ধু ওহাইওতে থাকেনা। রাকা্র আত্মীয় স্বজন দূরে থাক এদেশে ওর কোন বন্ধুও নেই। তাহলে ফোন বিলে এটা কার নাম্বার উঠেছে। একবার নয়, কয়েক দিন পর পর বেশ কবার এই নাম্বার থেকে কল এসেছে। কে হতে পারে এটা, ফ্ল্যাটে রাকা আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকেনা। তাহলে কি---“ হাতে মার্চ মাসের ফোন বিল, রবিন কিছু ভেবে পেলোনা।

গলা তুলে রাকাকে ডাকতেই কিচেন থেকে রাকা দৌড়ে এলো। রাকার মুখে ভয়ের চিহ্ন, রবিন জানে রাকা ওকে খুব ভয় পায়। রবিন এতে খুশী, ও চায় রাকা ওকে ভয় পাক।সুন্দরী মেয়েদের ভয়ার্ত চেহারা দেখতে খুব ভাল লাগে, কেমন যেন ভীত হরিণীর কথা মনে পড়ে যায়। রাকা ভীত হরিণী ছাড়া আর কিছু নয়।

রবিনের প্রথম স্ত্রী নিনজার সাথে ডিভোর্স হওয়ার দুই বছর পর রাকার সাথে বিয়ে হয়। নিনজার চেয়ে রাকা অনেক বেশী সুন্দর, কিন্তু গরীবের মেয়ে বলেই হয়তো রূপ নিয়ে অহঙ্কার নেই। ও বুঝেওনা হয়তো, কী ভীষণ সুন্দরী ও। নিনজা ছিল মিলিয়নার বাপের কন্যা, চলনে বলনে স্টাইলে হলিউডের নায়িকাদের হার মানাবে। অহঙ্কার নিনজার মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত কিলবিল করে। অহংকার এত বেশী মটমটে যে রাতের বিছানাতেও সে তা প্রয়োগ করতো। মনে মনে নিনজাকে ঊদ্দেশ্য করে গালি দিলো রবিন, পুরনো দিনের দুঃসহ স্মৃতিগুলো মুছতে এত সময় লাগে!

রবিন আর নিনজা বুয়েটে সহপাঠি ছিল, প্রেমও বুয়েটে থাকতেই শুরু হয়। নিনজা ধনী বাপের কন্যা, রবিনও অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে। বিয়ের আগে ওদের মধ্যে তেমন কোন মতানৈক্য ছিলনা। বিয়ের আগে দুজনেই উচ্চশিক্ষা নিতে আমেরিকা আসে, একই ইন্সটিটিউটেই দুজনের এডমিশান হয়। আজকাল বিয়ের আগে বাঙালি ছেলেমেয়েও শারীরিক মেলামেশা করতে দ্বিধা করেনা। রবিন আর নিনজাও খুব আনন্দে ছিল। একসময় ওরা টের পায়, নিনজা কনসিভ করে ফেলেছে। রবিন চায়নি ভ্রুণটা এবর্ট করাতে, ও চেয়েছিল আপাততঃ কোর্ট ম্যারেজশিপ করিয়ে নিতে। কিন্তু রবিনকে কিছু না জানিয়েই নিনজা নিজ সিদ্ধান্তে এবরশান করিয়ে আসে। ওর সাথে পরামর্শ ছাড়াই নিনজা এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, রবিনের আঁতে ঘা লাগে, সেদিন দুজনে খুব তর্কাতর্কি হয়। পরে নিনজা ক্ষমা চায়, রবিন শান্ত হয়।

এরপর দুই পরিবারের মিলিত সিদ্ধান্তে ওরা দুজন দেশে গিয়ে বিয়ে করে আবার আমেরিকা ফিরে আসে। ডিগ্রী নেয়া হয়, দুজনেই চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করে, ইন্টারভিউ কলও আসে, কিন্তু রবিন চাকরি পায়, নিনজা পায়না। নিনজা যে চাকরি পাচ্ছেনা, এ নিয়ে ওর কোন আফসোসও ছিলনা। অফিস থেকে রবিন ফোন করতো, নিনজা কখনও ফোন ধরতো কখনও ধরতোনা। ধীরে ধীরে রবিন টের পায় নিনজা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে, চাকরির জন্য চেষ্টা নেই, চাকরির কথা বললেই বলে, “ আমি জীবনেও পরের গোলামী করিনি, এখনইবা করবো কেন? তুমি আমার স্বামী, তুমি আমায় খাওয়াবে। তুমি যদি না পারো বলো, পাপাকে জানাই। পাপা খরচ পাঠাবে”।

আরও পরের দিকে, অফিস থেকে ফোন করলে নিনজাকে পাওয়া যেতোনা। রবিন ভাবতো ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু সপ্তাহের প্রতিদিন কেউ দিনে একই টাইমে ঘুমায়?
নিনজা বলতো, “ তুমি এত ফোন করো কেন? আমি কি ঘরে বসে থাকি তোমার ফোনের জন্য?”
ধীরে ধীরে নিনজা বহির্মুখী হয়ে গেলো, রবিনের সাথেও তেমন কথা হতোনা। বিছানায় ওরা সুখী ছিলনা, রবিনের মনে হলো নিনজা অন্য কারো প্রতি আসক্ত। এবং এই নিয়ে দুজনে ঝগড়াও করতো কম নয়। একদিন নিনজা রবিনের কাছ থেকে দূরে চলে যায় এবং এক আফ্রিকান আমেরিকানের সাথে লীভ টুগেদার শুরু করে।

ডিভোর্স হয়ে গেছিলো, নিনজা বয়ফ্রেন্ড খুঁজে পেয়েছিল কিন্তু রবিনের মনে মেয়েদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায় নি, কিন্তু বাবা মা জোর করে রাকার সাথে বিয়েটা দিয়ে দেয়।

প্রথম প্রথম রাকাকে রবিনের সহ্য হতো না, সব কাজে খুঁত ধরতো। চূলা জ্বালাতে পারতোনা, ঘর ভ্যাকুম ক্লিন করতে জানতোনা, টিভি চালাতে জানতোনা, কিচ্ছু জানতোনা। ভ্যাবলার মত ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকতো। এই ভ্যাবলা মেয়েকে নিয়ে রবিন কী করবে বুঝতে পারতোনা। রবিন বাইরে থেকেই খেয়ে আসতো, বাড়ি ফেরার সময় মনে পড়তোনা রাকার কথা। অফিস থেকে ফিরে পোশাক পালটে কমপিউটার নিয়ে বসে যেত, রাকা খেলো কিনা, অথবা সারাদিন রাকার কিভাবে কেটেছে কিছুই জানতে চাইতোনা।

একদিন অফিস থেকে ফিরেছে, অন্যদিনের মত খেয়ে দেয়েই ফিরেছে। কমপিউটার নিয়ে বসেছে মাত্র, রাকা চায়ের কাপ হাতে হাজির। চায়ের সাথে নুডুলস। রবিন একটু চমকে ওঠে, হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নেয়, নুডুলস খাবেনা বলে। চায়ে চুমুক দিয়ে আরাম বোধ করে, আম্মাকে দেখেছে আব্বার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে। এই প্রথম নিজের ঘরে কেউ একজন ওর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল। রাকার দিকে চোখ তুলে তাকায়, মেয়ে নীচের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
রবিন বলল, এদিকে আসো। চেয়ারে বসো, দাঁড়িয়ে আছো কেন?
রাকা বলল, আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিন। এখানে আমার ভালো লাগেনা।
রবিন আবার চমকালো, কেন, দেশে যেতে চাও কেন? এখানে সমস্যা কি?
রাকা বলল, আমি এখানে থাকবোনা। আমার ভালো লাগেনা।
রবিন বলল, চা ভালো হয়েছে। আমি অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত আছি, তাই তোমার সাথে কথা বলতে পারিনা।
এই কথা বলে রবিনের নিজের কাছেই নিজেকে বোকা মনে হলো, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল।

পরবর্তি তিন মাসে রবিন রাকাকে জীবনের অংশ করে নেয়ার চেষ্টা করলো। এটুকু বুঝলো, রাকা খুব নরম স্বভাবের, অনেক ভীতু, তবে রবিনকে খুব ভালোবাসে। ভালোবাসা পেলে সকলেই খুশী হয়, রবিনও খুশী। ওকে নিয়ে সংসার করা যাবে, রবিন রাকার জন্য অনলাইন থেকে শাড়ি কিনে দেয়, উইকএন্ডে রাকাকে নিয়ে এদিক সেদিক বেড়াতে যায়, রাকাকে বুকে নিয়ে আদরও করে। তবে একটা শর্ত দেয়া আছে, রাকা বাপ মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেনা, কারণ নিনজাকে ওর মা কুপরামর্শ দিয়ে নষ্ট করেছিল। রাকা ফেসবুক করতে পারবেনা কারণ ফেসবুকে নানা জাতের রঙ তামাশা দেখে রাকার মত ভীতু মেয়ের ভয় কেটে যাবে, ওর ভয় কেটে যাক রবিন তা চায়না। আরেকটা শর্ত হচ্ছে, রাকা এখানকার কোন বাঙ্গালির সাথে মিশতে পারবেনা।



রবিন যা যা শর্ত দিয়েছে রাকা তার সব হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। ফেসবুক করবেনা কিন্তু কমপিউটারে গিয়ে দেশের সংবাদপত্র পড়লে ক্ষতি কি? রবিন এটুকু ছাড় দিয়েছে, আব্বু আম্মুকে ফোন অরতে পারেনা এটা নিয়ে রাকার কষ্ট আছে। আব্বুর চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে বলেই আম্মু তাড়াহুড়ো করে রাকাকে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়। আম্মুর খুব আশা ছিল, আমেরিকা থেকে রাকা ডলার পাঠাবে, ওদের সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসবে। রাকার আম্মুতো জানেনা রাকার স্বামী রাকাকে ভালোবাসলেও রাকার ফ্যামিলিকে সহ্য করতে পারেনা। রবিন স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, “ দেখো, আমি তোমার স্বামী, তুমি আমার বউ, এর মাঝে কারো বাপ মাকেই ঢুকতে দেবোনা। তোমার বাপ মাকেও না, আমার মাকেও না, আমার বাপ নেই অবশ্য।“

এত পয়সাওয়ালা স্বামী, চারপাশে এত ধন সম্পদ, রাকা এমন ভাগ্য কল্পনাও করেনি। ও মহাসুখে আছে এমনিতে, তবুও মাঝে মাঝে মনটায় খচ খচ করে ছোট ভাইবোন দুটোর জন্য। ও এখানে কত ভাল খাবার খায়, ওরা কি খাচ্ছে কে জানে! কমপিউটারে বসে অনলাইনে পত্রিকাগুলো পড়ে, একটি পত্রিকার আবার ব্লগ আছে। সেই ব্লগে কত লেখা, রাকা লেখাগুলো পড়ে সময় কাটায়। এখানে টিভি অনুষ্ঠান দেখে মজা নেই, ও ইংলিশ কথা বুঝেওনা। গল্পের বই নেই, কি করবে, তাই ব্লগের লেখা পড়ে। একদিন ব্লগে রান্নার রেসিপিসহ একটা লেখা পেয়ে গেলো, ‘আমার হেঁশেল’ নামে। রুই মাছের কালিয়া রান্নার রেসিপি, কৌতুহল বেড়ে গেলো। রেসিপি দিয়েছে শ্রাবণ মায়া নামের কেউ। বাহ! নামটাও কি সুন্দর, শ্রাবণ মায়া! আহারে, কতদিন আব্বু আম্মুকে দেখিনা, কতদিন ওদের গলার আওয়াজ শুনিনি। শ্রাবণ মায়া দেখেই কেন আব্বু আম্মুর কথা মনে পড়লো! রাকা ‘আমার হেঁশেল’ ক্লিক করলো, প্রচুর রেসিপি দেয়া আছে। দেখতে পেলো, এক লেখায় লেখিকা প্রসঙ্গক্রমে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়েছেন। আমেরিকার ওহাইওতে উনি থাকেন। ওহাইও কতদূর, নেব্রাস্কা থেকে ওহাইও যেতে কি প্লেন লাগে? ওহাইও দেখতে কেমন? শ্রাবণ মায়া দেখতে কেমন, উনার বয়স কত? উনি কি আম্মুর মত? আম্মুর সাথে কথা হয়না, এখানে কারো সাথে কথা হয়না। রাকা ইংলিশ পারেনা, বাংলাও ভুলে যাচ্ছে।

রাকা ইয়েলো পেজ হাতে নিলো, ডিরেক্টরি থেকে দেখে দেখে শ্রাবণ মায়ার বাড়ির ঠিকানা অনুযা্যী ফোন নাম্বার পেয়ে গেলো।

রাকার বুক কাঁপছে, ফোন করবে কি করবেনা। শ্রাবণ মায়া আন্টি কি রেগে যাবেন? আমেরিকাতে কি হুট করে কাউকে ফোন করা উচিত? রাকাতো কিছু নিয়ম জানেনা। তবুও সাহস করে ফোন নাম্বার টিপে ফেললো। একটা বাচ্চা মেয়ে ফোন তুলেছে,” হ্যালো, হু ইজ ইট?”
রাকার গলা শুকিয়ে গেছে, ঢোঁক গিলে বলতে পারলো, এ—এ—এটা কি শ্রাবণ মায়া আন্টির ফোন নাম্বার?
-হ্যাঁ, বলছি। আপনি কে?
রাকার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, শ্রাবণ মায়া আন্টি বলবে কি বলবেনা বুঝে পেলোনা। আন্টির কন্ঠ এমন বাচ্চার মত হবে কেন? আরেকবার শ্রাবণ মায়া আন্টিকে চাইতেই সেই কন্ঠ আবার বলল, আমিই শ্রাবণ মায়া। এটি আমার ব্লগের নাম, আপনি কে বলছেন?

তখন রাকা আনন্দে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে কী কী যে বললো, ও নিজেও বুঝতে পারছিলোনা। শ্রাবণ মায়া আসলে পঞ্চাশোর্ধ এক রমনী, ডিভোর্সড। একটি কমিউনিটি কলেজে গণিতের অধ্যাপক, অবসরে ব্লগে লিখেন।


এরপর পাক্কা এক বছর রবিনের অজান্তেই শ্রাবণ মায়ার সাথে রাকার কথা হয়েছে। শ্রাবণ মায়াকে রাকা ‘আন্টি’ সম্বোধন করে। এই আন্টির সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে রাকার মধ্যে অনেক চেঞ্জ এসেছে, সব পজিটিভ চেঞ্জ। এই চেঞ্জ রবিনের চোখ এড়ায়নি। রাকা আগের মত মন খারাপ করে থাকেনা, রাকা প্রতিদিন সুন্দর করে সেজে পরিপাটি হয়ে থাকে, রাকা হরেক রকমের রান্না শিখে গেছে। রাকা এখন আর আম্মু আব্বুর জন্য কাঁদেনা, রাকা রবিনের সাথে অনেক সুন্দর করে কথা বলে যা রবিনের ভাল লাগে। রবিনের কাছে সংসার মায়াময় মনে হয়। রাকার জন্য মায়া লাগে, ফোন কার্ড কিনে দেয়, আম্মুর সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলতে দেয়। পাঁচ মিনিট আম্মুর সাথে কথা বলতে পেরেই রাকা নিজেকে ধন্য মনে করে।


আরও পরে রাকা একদিন শ্রাবণ আন্টির কাছে বলে, ওর পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যার কথা। ছোট ভাইটাকে দোহা পাঠানোর সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, কিন্তু টাকার অভাবে প্লেনের টিকিট কাটতে পারছেনা। আন্টিকে অনুরোধ করে কিছু টাকা জোগার করে দেয়ার জন্য। মাত্র কুড়ি দিনের মধ্যে আন্টি পঁইয়তাল্লিশ হাজার টাকা জোগার করে, এবং রাকাকে শিখিয়ে দেয় কিভাবে রবিনের কাছ থেকে বাকী টাকাটা নেয়া যায়।

আন্টির শেখানো পদ্ধতিতেই রাকা রবিনকে বুঝিয়ে বলে, যাই হউক, বাকি টাকা রবিনই দেয়, তবে রবিন জানতেও পারেনা ধনী জামাতার শ্বশুর শাশুড়ির জন্য অচেনা কোন এক নারী পঁইয়তাল্লিশ হাজার টাকা ফেসবুকের বন্ধুদের কাছ থেকে ভিক্ষে করে জোগার করে দিয়েছে। রবিন ধরে নিয়েছে, শ্বশুর শাশুড়ির টাকা পয়সা কিছু আছে।

একদিন রাকা টের পায়, ও মা হতে যাচ্ছে। সবার আগে এই সুখবর শ্রাবণ মায়া আন্টিকে জানায়। আম্মুকে ফোন করার নিয়মে কড়াকড়ি অনেক শিথিল হয়েছে, এখন পাঁচ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেছে। আন্টি রাকাকে ফোনেই সব নিয়ম কানুন বলে দেয়, আন্টি কখনও রাকাকে বাজে উপদেশ দেয়না। কখনও বলেনা, এমন স্বামীর ভাত খেয়ো না, অথবা রবিনের সাথে ঝগড়া করতেও নিষেধ করে দেয়। রাকার মা দেশ থেকে রাকার অদেখা আন্টির জন্য অনেক দোয়া পাঠায়। রাকার খুব ইচ্ছে করে আন্টিকে দেখতে, আন্টিকে জড়িয়ে ধরতে। রবিন আন্টি সম্পর্কে জানেনা, তবে এটা জানে, শ্রাবণ মায়ার ‘আমার হেঁশেল’ ব্লগ পড়ে রাকা নিত্য নতুন রান্না করে। রবিন আর আগের মত রাগ দেখায়না।


সময়মত রাকার কোল জুড়ে ফুটফুটে সুন্দর এক কন্যা জন্ম নেয়। রাকা আন্টিকে ফোনে সুখবর জানায়, বলে, আন্টি, আমার মেয়ের নাম আপনি দিবেন”। আন্টি বলেছে, “ কখখনো নয়, কন্যার নাম রাখবে কন্যার পিতা। রবিনকে বলো, মেয়ের জন্য নাম ঠিক করতে, এভাবে পিতা আর কন্যায় মায়ার বাঁধন তৈরী হয়”। ইস! আন্টি কত্ত ভালো, আল্লাহ, এই আন্টিকে তুমি অনেক ভালো রেখো। রবিন কন্যার নাম দেয়, ভালোবাসা। রাকা একটু ইশঠিশ করে, ভালোবাসা কোন নাম হলো? আন্টিকে ফোনে বলতেই আন্টি মৃদু ধমক দিয়েছে, “ কেন, ভালোবাসা নাম হবেনা? ভালোবাসা খুবই সুন্দর নাম, জীবনে ভালোবাসা’র মূল্য কত, তুমি জানোনা? ডাক নাম ভালোবাসা থাকুক, পরে ভাল নাম বুঝে শুনে রেখো।”


রাকার আম্মু আবার রাকার কাছে টাকা চেয়েছে, ছেলের জন্য অনেক ঋণ করতে হয়েছিল। সেই ঋণ সুদে আসলে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এত টাকা রাকা কোথা থেকে দিবে? আবার আন্টিকে ফোন, “ আন্টি, আবার আমায় বাঁচান”।
এবার আন্টি আর ফেসবুক থেকে টাকা সংগ্রহের পথে গেলোনা। রাকাকে নানা কায়দা শিখিয়ে দিল কি করে রবিনের মন বশীভূত করতে হবে। রবিন যতটা দিবে, বাকীটা যেন রাকা নিজের কিছু খুচরো গয়না বিক্রি করে দিতে পারে। কারণ আমেরিকায় এইসব সোনাগয়নার কোন দাম নেই।


ভালোবাসাকে নিয়ে রবিন আর রাকা দুই সপ্তাহের জন্য দেশে গেলো, রবিনের আম্মু নাতনীর মুখ দেখবেন, সাথে রাকার আব্বু আম্মুও দেখতে পাবে। দেশে যেতে অনেক টাকার ধাক্কা, রাকা ভয় পাচ্ছিলো রবিনকে কি করে টাকার কথা বলবে। আন্টির শিখিয়ে দেয়া কথাগুলোকেই একটু কমিয়ে বাড়িয়ে রবিনের কাছে বলল। রবিন রাগ করেনি, রাজী হয়েছে পঁচিশ হাজার টাকা দিতে,। এতেই রাকা খুশী, বাকী চল্লিশ হাজার টাকার ধাক্কা গয়না বিক্রি করা টাকাতেই হয়ে গেছে। আম্মুর আর কোন ঋণ নেই।

আমেরিকা ফিরে এসেই রাকা আন্টিকে ফোন করে প্রথম যে কথা বলল, “ আন্টি, আমার আব্বু আম্মু এখন ঋণমুক্ত। আন্টি, আপনার কথা শুনেছি, কিছু গয়না বিক্রি করে দিয়েছি। সত্যিইতো, গয়না দিয়ে আমেরিকায় কি করব, তার চেয়ে আমার আব্বু আম্মু ঋণ মুক্ত হলেন, এটাই শান্তি”।

রাকার মনে হলো, শ্রাবণ মায়া আন্টি খুব খুশী হয়েছে। রাকা বলল, “ আন্টি একসময় আমার খুব মনে হতো, আপনার আসল নাম জিজ্ঞেস করি। এখন মনে হয়, আপনার নাম শ্রাবণ মায়াই থাকুক, শ্রাবণ মায়া নামেই মায়া আছে। আপনি হলেন একজন মায়াবতী মানুষ।“

আন্টি বলল, “ রাকা, তুমি অনেক স্মার্ট হয়ে গেছো। ফেইক আইডি দিয়ে একটা ফেসবুক একাউন্ট খোলো, তোমাদের সুখী ছবি আমাকে দেখাও।“

রাকা আন্টির কাছ থেকে শুনে শুনে ফেসবুক একাউন্ট খুলেছে, ওর বন্ধু লিস্টে আছে ওর ভাই আর এই আন্টি। এই ভালো, আন্টির ওয়ালে গেলেই মনে হয়, পুরা ফেসবুক আছে ওখানে।




কিচেন থেকেই রবিনের গলার আওয়াজ কেমন রাগী শোনা গেছে, রবিনকে রাকা প্রচন্ড ভালোবাসে। কিন্তু রবিন যখন ধমকে কথা বলে, রাকার ভয় লাগে। কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতেই রবিন হাতে ধরা ফোন বিলের কাগজ ওর দিকে বাড়িয়ে দিল, “ ওহাইও থেকে মাঝে মাঝেই কল আসে আমাদের ফোনে, এবং হুড়ি/পঁচিশ মিনিট কথা হয়। কে থাকে ওহাইওতে?
-রাকা ঢোঁক গিলে,

-কী হলো, কে থাকে ওহাইওতে?

-আ আ আন্টি

-এই দেশে তোমার আন্টি আছে? এতদিন জানলামনা কেন?

-ন না , মানে আমার কোন আন্টি থাকেনা আমেরিকায়

-তাহলে ওহাইও থেকে কে কল করে? মিথ্যে কথা বলবেনা, কে ফোন করে বলো। তোমার কি প্রাক্তন প্রেমিক ছিল?

-ইয়া আল্লাহ, কী বলছো, আমার প্রেমিক কেন থাকবে? আমি প্রেম করি নাই কোনদিন।

-তাহলে কে আছে ওহাইওতে?

-শ্রাবণ মায়া আন্টি।

-এই যে বললে তোমার কোন আন্টি থাকেনা?

-ইনি রান্না ব্লগের আন্টি

-রান্না ব্লগ মানে?

-আমি যে কমপিউটারে অনলাইনে পত্রিকা পড়ি, সেখানে রান্নার ব্লগ আছে। এই আন্টির ব্লগ।

-সত্যি বলছো? আন্টির নাম কি? তার পরিচয় কি? তার বয়স কত? তার কি ডিভোর্সি কন্যা আছে? অথবা ডিভোর্সি পুত্র?

এতগুলো প্রশ্ন শুনে রাকা ঘাবড়ে গেলো। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “ আমি আন্টির নাম জানিনা। কোনদিন জানতে চাইনি। আন্টি বলেছে, এটা উনার ছদ্মনাম। নামটা আমার ভাল লেগেছে, তাই উনাকে আমি শ্রাবণ মায়া আন্টি বলেই ডাকি। উনার পরিবার সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা, কয় ছেলেমেয়ে তাও জানিনা। আমি জিজ্ঞেস করিনি। তুমি বিশ্বাস করো, বিশ্বাস নাহলে আমি ফোন নাম্বার দিচ্ছি, তুমি কল দাও। আন্টি তোমাকে অনেক ভালোবাসে, আন্টিই আমায় সব সময় সুন্দর সুন্দর কথা বলে বুঝায়, আমার যখন অনেক মন খারাপ হয়, আমি আন্টিকে ফোন দেই। আন্টি কল ধরেনা, ভাবে আমার অনেক বিল উঠবে। আন্টি তখন কল ব্যাক করে। যত রান্না সবই আন্টি শিখিয়েছে। তুমি যখন আমাকে ভালোবাসতেনা, তখন আমি আন্টির কাছে অনেক কাঁদতাম। আন্টি বলেছে, একদিন তুমি আমায় বুকের মাঝে ঠাঁই দিবে----
রাকা এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। রাকার কান্নার আওয়াজে ওদের ‘ভালোবাসা’ ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো।
বউ আর মেয়ে একসাথে কাঁদছে, এমন হবে রবিন বুঝতে পারেনি। চূন খেয়ে ওর মুখ পুড়েছে, নিনজা ওর বিশ্বাসের ভিত ভেঙ্গে দিয়ে গেছে, অন্যসময় ফোন বিলের কাগজ ও পড়ে দেখেনা। আজ হাতে সময় ছিল তাই বিলে চোখ যায়।
রবিন এগিয়ে গিয়ে ভালোবাসাকে কোলে তুলে নিল, আরেক হাতে রাকাকে কাছে টানলো। রাকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ আমাকে অত ভয় পাও কেন? এমন এক আন্টি আছে তোমার, আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতে। বোকা মেয়ে কোথাকার! আর কেঁদোনা, আন্টি দেখতে কেমন?”

রাকা বুঝতে পারলোনা, আন্টি দেখতে কেমন প্রশ্নের উত্তর কি দিবে? যদি বলে, আন্টি খুব সুন্দরী, তাহলে রবিন জেনে যাবে ও ফেসবুক খুলেছে। যদিও আন্টি বলেছিল, রবিন যদি কোনদিন জেনে যায় তোমার ফেসবুকের কথা, বলো, আন্টি নিজে খুলে দিয়েছে। আন্টি চায়, আমি আন্টির ওয়ালে যাই, লেখাগুলো পড়ি। আন্টি আর রাতুল ছাড়া আমার আর কোন ফেসবুক ফ্রেন্ড নেই।---এখনই কি কথাগুলো বলে দিবে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহা রুবন সুন্দর গল্প!

১৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪