জলকাণা ও টুকু টুকু

পার্থিব (জুন ২০১৭)

হাবিব রহমান
  • ১২
  • ৩৮
(শিশুতোষ গল্প)
এক গভীর নীল সমুদ্রে বাস করত এক বাহারি রঙের মাছ। তার নাম টুকুটুকু। প্রতিদিন সে সাগরেরপানিতে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলা করতো। ফুস করে পানির উপরে লাফিয়ে উঠে আবার ঝুপ করে পানিতে ঝাপ দিয়ে পড়তো। তার সাথে খেলা করতো জলকণা। জলকণা আর তার বন্ধুরাও তার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠত আর এক সাথে পানিতে ঝাপ দিত।

সেদিন ছিল অনেক বাতাস। জলকণা আর তার বন্ধুরা টুকুটুকুর সাথে খেলা করছিল। এমনি করে জলকণা টুকুটুকুর সাথে লাফিয়ে উঠেছিল। টুকুটুকু পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেও জলকণাটা পারলো না। দুষ্টু বাতাস জলকণাটাকে বন্দি করে নিয়ে চলল। জলকণা টুকুটুকুর নাম ধরে ডাকলো, টুকুটুকু বাতাসের পিছু পিছু সাতরে চললো। কিন্তু ও আর কি করতে পারবে? ধাই করে আরেটা জোড়ালো বাতাস জলকণাকে অনেক উপরে উড়িয়ে নিয়ে গেল।

কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না জলকণা। একটা গাঙচিল উড়ে যাচ্ছিল। জলকণা ওকে বলল, বাতাস আমাকে কোথায় নিয়ে যায়? গাঙচিল উড়তে উড়তে বলল, তোমাকে মেঘের দেশে নিয়ে যাচ্ছে।
: আমাকে মেঘের দেশে কেন নিয়ে যাচ্ছে?
: তোমাকে মেঘ বানাবে।
: আমাকে কি ভাবে মেঘ বানাবে?
: তোমার মত আরো জলকণাদের এক সাথে করে মেঘ বানাবে। আমার তাড়া আছে আমি যাই, বলে গাঙচিল উড়ে চলে গেল।

বাতাস জলকণাকে নিয়ে একটা সাদা মেঘের সাথে মিশিয়ে দিল। সাদা মেঘটাতে আরো জলকণারা দল বেধে উড়তে থাকলো। বাতাস সব জলকণা গুলোকে ধেয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জলকণা নিচে তাকলো, ধুসর সৈকত পার হয়ে ওরা সবুজ পাহাড়ের উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগলো। জলকণাদের গায়ে রোদ লেগে চিকচিক করছিল। জলকণারা এবার নীল সাগর হরানোর কষ্ট ভুলে উড়ে বেড়াতে লাগলো। বাতাসের বেগে দল বেধে লুটোপুটিতে মেতে উঠল। সবুজ তেপান্তর পার হয়ে ওরা এগিয়ে চলল। এই যাত্রাপথে কত বন্ধু হল জলকণার। কত বন্ধু কত প্রান্তরে, জলাশয়ে ঝাঁপিয়ে নেমে গেল বৃষ্টি হয়ে।

ওদের সাদা মেঘের দলটার সাথে উড়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখলো একটা কালো মেঘ উল্টোদিক দিয়ে ধেয়ে আসছে। কালো মেঘ আর তার দলবল ধীরে ধীরে সূর্যকে আড়াল করে চারপাশ অন্ধকার করে দিল। ওদের সাথে তাল দিচ্ছে দমকা বাতাস। কাল মেঘ গুলো এগিয়ে এসে ওদের দলটার উপর ভয়ঙ্কর ভাবে আছড়ে পড়লো। হঠাৎ প্রচণ্ড আলোক ঝলকানি, সেই সাথে ভয়াবহ গুড়ম শব্দে ফেটে পড়ল বজ্রপাত। অন্ধকার চিরে আলো দিক্বিদিক ছুটে নিচে চলে যাচ্ছে। একের পর এক। মেঘের জলকণা গুলোও এদিক ওদিক ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল। আর নিচে বাতাস ধুলোর কুণ্ডলী পাকিয়ে দেছুট। দড়িতে বাধা গরু, ছাগল গুলো দড়ি ছিঁড়ে পালাতে চাইছে। না পেরে নিরুপায় হয়ে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করে দিল, হাম্বাও, ম্যা ম্যা...। পাখি গুলোও দল বেধে উড়ে সরে পরছে।

জলকণার কাল মেঘ আর বাতাসের এই কাজ কর্ম একদম ভাল লাগলো না। ও অন্য জলকণাদের হাত ধরে বৃষ্টির ফোটা হয়ে নিচে নামতে শুরু করলো। ওর সাথে আরো অসংখ্য বৃষ্টির ফোটা ঝুমঝুম শব্দে নিচে নামছিল। চারদিক ঝাপসা করে দিয়ে ওরা নিচে নেমে আসছে। জলকণা আর তার দলবল একটা টিনের চালে পড়ল। নূপুরের ঝনঝনানি সুর তুলে ওরা নামল মুশল ধারা হয়ে। টিনের চাল গড়িয়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখল একটা ছোট ছেলে উদাস হয়ে জানালার পাশে বসে আছে। ছেলেটার হয়তো খেলতে যাওয়া পণ্ড হয়েছে। টিনের চাল থেকে টুপ করে মাটিতে পড়লো জলকণা, মিশে গেল একটা পানির ধারার সাথে। উঠানের ধুলাবালির সাথে গড়াগড়ি দিয়ে পানির ধারাটি চলছে। এবার যাত্রা কোথায় কে জানে?

ওদিকে টুকুটুকুর মন খুব খারাপ।
বাতাস জলকণাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। সে বাতাসের পিছে পিছে সাতার কেটে জলকণাকে উদ্ধার করতে ছুটলো। জলকণা, জলকণা বলে ডাকলো। কিছুই করতে পারলো না। পানিতে মাথা উঁচু করে মন খারাপ করে ভাসতে থাকলো। একটা গাঙচিল ওর মাথার উপর উড়ছে। টুকুটুকুর গভীরে ডুব দিয়ে লুকিয়ে পড়া দরকার কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। হঠাৎ গাঙচিলটা ধাই করে ওর দিকে ছো মারলো। গাঙচিলটা যখন একেবারে কাছে এসে পড়ল তখন তাকে দেখতে পেল। কিছুই করার নেই এখন আর গাঙচিলের খাবার হওয়া ছাড়া। একটা ঢেউ এসে টুকুটুকুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে না দিলে হয়তো তাই হতো। অল্পের জন্য গাঙচিলটা টুকুটুকুকে ধরতে পারলো না। ভীষণ বাঁচা বেঁচে গেল। চিলটা আবার ঘুরে আসছে, এবার আর ভুল করলোনা টুকুটুকু। ডুব দিয়ে গভীরে চলে গেল। একটা পাথরে বসে মন খারাপ করে বসে থাকলো।

জলকণার বন্ধুরা তাকে সান্ত্বনা দিল। মাছ বন্ধুরা খেলা করতে ডাকল। খাবার খাওয়ার জন্য মা তাড়া দিল। কিছুই করলো না। কিছুই ভাল লাগছেনা টুকুটুকুর। কোথায় আছে জলকণা, কি করছে সে?

জলকণা তখন পানির ধারার সাথে গড়াতে গড়াতে একটা মাঠে এসে পড়লো। তখনো বৃষ্টি পড়ছে, তবে ধার কমে এসেছে। একদল বাচ্চা জম্বুরা নিয়ে বল খেলায় মেতেছে। একটাই গোল পোস্ট, একটাই দল। সবাই সবার প্রতিপক্ষ। যেখানে জাম্বুরা সেখানেই সব ছেলেরা। একজন শুধু গোলকিপার। ওকে জোর করে কিপার বানানো হয়েছে। খেলার চেয়ে লুটোপুটি কারেই ব্যস্ত সবাই। ইচ্ছে করে আছাড় খেয়ে কাদা মাখামাখি করতেই যেন বেশি আনন্দ। গোলকিপার বেশিক্ষণ পোস্টে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না। সেও সবার সাথে লুটোপুটিতে অংশ নিতে চলে আসলো।

জলকণা মাঠ পেড়িয়ে পানির ধারার সাথে নদীতে এসে পড়লো। পানির ধারাটি হয়ে গেল স্রোত। প্রচণ্ড স্রোতের সাথে মিশে জলকণা সামনে ধাবিত হলো। বর্ষার স্রোতস্বিনী নদী। স্রোত তার তলদেশের কাদা বালি উপড়ে নিয়ে জল ঘোলা করে ফেলল। জলকণা সেই কাদা বালির সাথে মিশে এগিয়ে চলল।

এক ঝাঁক ইলিশ মাছের সাথে দেখা হলো জলকণার। সাগরের চেনা মাছ গুলোকে দেখে আনন্দিত হয়ে উঠল। তাহলে কি ও সাগরে ফিরে যাচ্ছে? আবার তার দেখা হবে টকুটুকুর সাথে? অনেক দিন হয়ে গেল সে পথ চলছে। কত কিছু যে সে দেখলো, আবার কত কিছুই না অদেখা থেকে গেল! টুকুটুকুর কথা মনে পড়লেও এই যাত্রাপথ কি তার খারাপ লেগেছে? সাগরে ফিরে গেলে আবার তার মেঘ হতে ইচ্ছে করবে না?

হঠাৎ করেই জলকণা এক ঘূর্ণিপাকে আটকে গেল। প্রচণ্ড বেগে পানি ঘুরছে। জলকণা দেখতে পেল একটা নৌকাও সেই ঘূর্ণিতে আটকে পড়েছে। ভয়ার্ত মানুষ গুলোর চিৎকার চেঁচামেচিতে বাতাস কাঁপছে। নৌকার মাঝি প্রাণপণ চেষ্টা করছে হাল ধরে রাখতে, পারলোনা। পুরানো নৌকা কড়াত করে ভেঙ্গে গেল। সবগুলো মানুষ পানিতে পরে গেল। পানির ঘূর্ণি নিমিষে লোক গুলোকে নদীর গভীরে টেনে নিয়ে গেল। মানুষ গুলো কোথায় তলিয়ে গেল জলকণা বলতে পারবে না। কেউ কি বাঁচতে পেরেছে? পানির এহেন সন্ত্রাসী ভূমিকায় লজ্জিত হলো।

আরো কয়দিন স্রোতের সাথে চলতে চলতে মোহনায় এসে পড়লো জলকণা। সমুদ্রের নোনা স্বাদ পেল। আহ! জলকণার মনটা ভরে উঠলো। আবার আকাশের নীল রঙে নিজেকে রাঙানো, আবার বাহারি মাছের সাথে লুটোপুটি খেলা। সমুদ্রে এসে টুকুটুকুর খোঁজে নেমে পড়লো জলকণা।

খুঁজতে খুঁজতে একদিন জলকণা টুকুটুকুকে পেয়ে গেল। টুকুটুকুর সে কি উচ্ছ্বাস। জলকণাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। টুকুটুকু জলকণার কাছে তার যাত্রা পথের গল্প শুনে নেয়। টুকুটুকুকে সব বলে জলকণা। কিন্তু অন্য জলকণাদের সে গল্প বলা মানা। যে সব জলকণা নতুন যাত্রা করবে তারা যেন পুরো বিস্ময় নিয়ে সব উপভোগ করে সেই জন্য।

জলকণার অভিযানের গল্প শুনে টুকুটুকুর হয়তো হিংসা হয়। কিন্তু সব ভুলে তারা আবার পানির উপরে লম্ফঝম্ফ খেলায় মেতে ওঠে। জলকণা টুকুটুকুর সাথে লাফ দিয়ে উঠে আবার ঝাপ দিয়ে পড়ছে পানিতে।

তবে মাঝে মাঝে তার বাতাসের সাথে মেঘের দেশে যেতে ইচ্ছে করে। আবার দেখা, অদেখা পৃথিবীতে ঘুরে আসতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে আবার পার্থিব এ ধারার অংশ হতে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ কবির হোসেন amar mone hoy apnar golpo lekhar hat onek paka. apnar ei golpoti oshadharon. onek valo legechhe.
কাজী জাহাঙ্গীর টুকুটুকু’র মত মন খারাপ করবেন না সে, বেশ ভাল লিখেছেন, অনেক শুভেচ্ছা আর ভোট রইল।
মোঃ মোখলেছুর রহমান বাহারি রঙের মাছের মত পার্থিব জীবনটাও বাহরি রঙের।শিশুতোষ হলেও শেষের কথাগুলো অসাধারন। ভোট রইল।সেই সাথে আমার পাতায় আমন্ত্রন।
আহা রুবন কিছু সময়ের জন্য শিশু হয়ে ছিলাম। শুভ কামনা রইল।
নাদিম ইবনে নাছির খান আসাধারন,,,, ভাললাগলো চমৎকার সৃজনশীলতা,,,
রুহুল আমীন রাজু শিশুদের নিয়ে আসলে আমরা কেউ তেমন একটা লিখি না , আপনি লিখেছেন এবং অনেক ভাল লিখেছেন । শুভ কামনা । ( আমার পাতায় আসবেন )
দেওয়ান তাহমিনা শাওন বাহ.... চমৎকার লাগলো , উপস্থাপনটা অসাধারণ ছিল.... শুভ কামনা রইলো....!!! (আমার পাতায় সমালোচনা করার জন্য আমন্ত্রণ রইলো​।)
এশরার লতিফ চমৎকার কাব্য-কল্পময় গল্প। এই লেখার একটা গভীর বানী আছে, আমাদের আসা যাওয়া আর জীবনের পুনরাবৃত্তি নিয়ে।
ইমরানুল হক বেলাল খুব সহজেই মন জয় করে নিল আপনার লেখা শিশুতোষ গল্পটি। লেখার ধারাবাহিকতা অনেক গভীর মনে হলো। দোয়া করি আপনার সাহিত্যকর্ম সাফল্যের পথে এগিয়ে থাকুক । ভোট এবং মুগ্ধতা রেখে গেলাম ।

১৬ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৩২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪