আজ আটাশ ডিসেম্বর ২০১৩ সাল। আর মাত্র দু’দিন পেরুলেই এই বছরের শেষ দিন। থার্টি ফাস্ট নাইট।
তনয় আর সনিয়া ভালোবাসার জুটি। দু’জন দু’জনকে খুব ভালোবাসে। দুই পরিবারেও বিষয়টা প্রায় সবাইই জানে। তারপরেও বিয়েটা হই হই করেও হয়ে উঠছে না। অবশেষে সনিয়ার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ও ওর আইডিয়াটা তনয়ের সাথে শেয়ার করলো-
- এই শোন, আমরা এইবার থার্টি ফার্স্ট নাইটেই বিয়েটা করে ফেলি!
- ঠিক আছে। কিন্তু, মাঝখানে তো মাত্র দুইটা দিন। আয়োজন করতে হবে না? আবার মাসের শেষ!
- আরে ধুর, দুজনে মিলে করলে সমস্যা হবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে। নিয়মিত আপডেট দিও।
কথা পাকাপাকি হয়ে যাওয়ার পরেই ওরা সিদ্ধান্ত নিলো একত্রিশে ডিসেম্বর সকালেই বাসা থেকে বেরুবে। বাসার মানুষের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না ঢুকিয়ে কাজটা করতে হবে। আর বাসা থেকে মনে হয় না সন্দেহ করবে। কেননা এই দিনটিতে অনেকেই উৎসবের আমেজে কাটাতে চায়। আর ওদের প্রেমের খবর তো সবাই জানেই। একজন আরেকজনের সাথে কিছুটা সময় কাটাবে এতো জানা কথাই।
একত্রিশ তারিখ বাড়ি থেকে বেরুতে তাই কাউকেই কোন সমস্যায় পরতে হলো না। মিরপুর দশ নাম্বার থেকে বাস নিয়ে তনয় চলে এলো টিএসসি চত্বরে। আর গুলশান থেকে এলো সনিয়া। দুজনে একসাথে দেখা হওয়ার পরে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালো কিছুটা সময়। নতুন কান্ড ঘটানোর উত্তেজনায় দুজনেই অস্থির। দুপুরে এক সাথে লাঞ্চ করে দুজনে কাজি অফিসে গেলো। সাক্ষী লাগবে। ওহ! এখন সাক্ষী কই পাবে? দু’জনেই চিন্তায় পরে গেলো। ওরা তো সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো। এখন বন্ধুদের যদি সাক্ষীর জন্যে ডাকে তাহলে কেমনে কি!
সনিয়াকে কাজী অফিসে বসিয়ে রেখে তনয় গেলো বাইরে যদি কাউকে রাজী করানো যায় বিয়ের সাক্ষীর জন্য। একটু পরেই ফিরে এলো। রাস্তা থেকে কয়েক জন লোক ডেকে নিয়ে এসেছে। আবার দুই জন তরূণিও এসেছে।
যা হোক, ওদের বিয়ে করা দরকার। বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো। দুইজনে হাসি হাসি মুখে বের হলো কাজী অফিস থেকে। তিন তলা বিল্ডিঙ থেকে নামতে নামতে দুই টোনাটুনি তর্কাতর্কিতে লেগে গেলো-
- “এই শোন, সামনের মাসের বেতন পেয়ে কিন্তু তুমি আমার টাকাটা দিয়ে দিবা” সনিয়া বলে উঠলো।
- “আরে তুমি তো আমার মিষ্টি বউ। এমন করো কেন? দিবো নে এক সময়।”
- “আরে বাহ! এর মধ্যেই স্বামীগিরি ফলাতে শুরু করলা?”
- “আহা! রাগ করো কেন?”
- “রাগ করবো না? যাও আমি তোমার সাথে আর কোত্থাও যাবো না!” বলে সিড়িতেই দাঁড়িয়ে গেলো সনিয়া।
- “আরে পাগলী এসো তো!”
- “নাহ! যাবো না! আমাকে আদর দাও। মিষ্টি করে সরি বলো। তারপর...”
- “আরে আমার পাগলী বউরে!” বলে কোলে তুলে নিয়ে বাইরে বেরুতে গেলো। আর ওমনি সনিয়া লজ্জায় দিলো এক চিৎকার- “আআহহ!! কি করো ছাড়ো না!” বলতে বলতেই দেখে, সামনে দুই বন্দুক ধারী। দেখে আর্মি বলেই মনে হচ্ছে।
সামনে নির্বাচন। ক্রমাগত হরতাল অবরোধ, ভাংচুড়, জ্বালাও পোড়াও এর কারণে দেশের শান্তি শৃংখলার জন্য দেশে আর্মি নামানো হয়েছে। চোখের সামনে আর্মি দেখে সনিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো দুজনে।
আর্মির মধ্যে যেই জন বয়স্ক সেই কথা বলে উঠলো প্রথমে-
- কি হচ্ছে এখানে?”
তনয় উত্তর দিলো- জ্বী স্যার। কিছু না!
আর্মি আবারো জিজ্ঞাসা করলো রাগী কন্ঠে- “কিছু না হলে এমনিতেই উনি চিৎকার দিলো?”
সনিয়া কি জবাব দেবে? ও লজ্জায় আরো জড়সড় হয়ে গেলো। গিয়ে তনয়ের পেছনে গিয়ে লুকালো।
এর মধ্যে আরেক মহিলা আর্মি সৈন্যের আবির্ভাব- “কি হয়েছে এখানে, স্যার?”
বয়স্ক আর্মি বলে উঠলো, “এই দুজনকে সন্দেহ হচ্ছে! লকাপে পুরে দেন তো!”
এইবার সনিয়া বলে উঠলো, “আরে কি মুশকিল! আমরা আজকে এইমাত্র বিয়ে করলাম। এখন বাসায় যাবো। অযথা আমাদেরকে লকাপে নিচ্ছেন কেন?”
“বিয়ে করেছো, তো একা একা কেনো?” মহিলা আর্মি বলে উঠলো।
এবার সনিয়া ও তনয় একসাথে জবাব দিলো-“আমাদের অভিভাবকরা আমাদের বিয়েটা দিচ্ছে না! কি আর করবো!”
এ কথায় তিন আর্মি অফিসারই ভীষণ মজা পেলো। সবাই এক সাথে হেসে উঠলো। তারপরে ওদের ছেড়ে দিলো- “আচ্ছা যান! রাস্তাঘাটে এরকম চিৎকার চেচামেচি না করে বাসায় চলে যান! দেশ এখন অশান্ত! বড় কোন ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো।”
আর্মি অফিসারদের লম্বা উপদেশ বাণী শুনে ওরা কাজী অফিস ছাড়িয়ে দ্রুত পা বাড়ালো। তারপরে কিছুদূর গিয়েই দুজনে ফোঁস করে উঠলো, “থার্টিন যে শালার আনলাকিই! প্রেম ভালোবাসার মধ্যে কোত্থেকে পুলিশ এসে হাজির!”
এদিকে সন্ধ্যা নামছে। চারুকলা ইনস্টিটিউটে নববর্ষকে উদযাপনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। টিএসসি’তেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচেও নানা রকম গানের কনসার্ট শুরু হয়েছে।
ওরা দু’জনে হেঁটে হেঁটে দুজনে হাত ধরাধরি করে শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরীর কাছে অনেকটা এগিয়ে এসে একটা ফুচকার দোকানে বসলো। অর্ডার দেয়া হয়ে গেছে। এখন অপেক্ষা!
সেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছে। মাগরিবের আজানও হয়ে গেলো। কারো বাসায় ফেরার নাম নেই। ফোনটা এলো সনিয়ার বাসা থেকে- “কিরে! আজ কি সারা রাত বাইরেই থাকবি?”
ভাবছে মা’কে বলবে কিনা! তনয় নিতে চাইলো ফোনটা। সনিয়া শুধু মা’কে বললো-“তনয় কথা বলবে তোমার সাথে!”
শাশুড়ি মায়ের সাথে ফোনে কথা বলবে। তনয় একটু কেঁপে উঠলো-“ আসসালামু আলাইকুম। আন্টি, আজকে আমি সনিয়াকে আমার বাসায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইছি।”
সনিয়ার মা হতভম্ব হয়ে বলে উঠলেন, “সেকি!”
“জ্বী মা! আজ আমরা দু’জন বিয়ে করেছি। আমাদেরকে দোয়া করবেন।” বলে তনয় চুপ করে রইলো। নতুন শাশুড়ি মা টাশকি খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলেন, “সনিয়াকে দাও!”
সনিয়া ফোন নিয়ে কানে ঠেকাতেই মা বলতে থাকলেন, “এরকম কিছু করবি বলে আমার সকালেই মৃদু সন্দেহ হচ্ছিলো তোকে নিয়ে। তোর শাশুড়ি কি জেনেছে? নাকি আগে থেকেই জানে?”
স্পিকারে দেয়া ছিলো ফোনটা। তনয় জবাব দিলো, “আপনি টেনশন করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালো থাকবেন।”
এরপরে চটপটি খেয়ে নিয়ে দু’জনে মিলে বাসে উঠে পরলো। মিরপুর দশ।
রাস্তায় অনেক জ্যাম। বাড়ি পৌঁছুতে বেশ রাতই হয়ে গেলো। বাড়ি পৌঁছে তনয়দের ফ্লাটবাড়িতে ইন্টারকমে শাশুড়ি মা’কে চাইলো সনিয়া-“খালাম্মা, আমি কি একটু আপনার বাসায় আসতে পারি?”
সম্মতি পেতেই দু’জনে উপরে উঠে গেলো। দরজা খুলে শাশুড়ি মা দাঁড়াতেই সদ্য বিবাহিতা দম্পতি সামনে দাঁড়ানো মুরুব্বীকে পায়ে ঠুকে সালাম করে নিলো।
ঘোমটা জড়ানো লাল রঙের শাড়িতে সনিয়াকে দেখে আর দুইজনে মিলে সালাম করাতে যা বুঝার বুঝে নিলেন ছেলের মা। নিজের ছেলের দিকে চেয়ে বলে উঠলেন, “ওরে বদমাশ! বিয়ে করে ফেলেছিস আমাকে একটু আগে থেকে জানাবি না? ছেলেটা আমার চিরকাল বোকাই রয়ে গেলো! বউমা, একে তুমি একটু মানুষ কোরো তো! এবার থেকে আমার বুড়ো ছেলের সব দায়িত্ব তোমার।”
সনিয়া যেখানে ভেবেছিলো রাগের চোটে না বাড়ি থেকেই বের করে দেন। সেখানে এরকম কথা শুনে ও আবেগে ভেসে গিয়ে শাশুড়ির বুকে জড়িয়ে গেলো।
শাশুড়ি তারপরে বাড়ির সবাইকে জানালেন। বর্ষবরণ উৎসবের সাথে সবাই এখন বাড়িতে নতুন বউ আসার উৎসবে মেতে উঠলো।
শাশুড়ি মা ছেলেকে বললেন, “তনয়, নিজের রুমটা তালাবন্ধ করে রেখে গেছিস কেন? আজকে তো রুমটা সারাদিনে ঝাড়ুও দেয়া হয়নি। কি যে করিস না!”
কিন্তু, তালা খুলে দরজাটা এক পাশে মেলে ধরতেই মা বউকে সাথে নিয়ে ভেতরে যেতেই চমকে উঠলেন, ঘরটা একেবারে বাসর ঘরের মতো করে পুরোটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে! পুরো থ হয়ে গেলেন তিনি- “একি! এইসব কখন হলো?”
তনয় শুধু হাসে। কিচ্ছু বলে না!
কিছুক্ষণ পরেই ঘড়িতে ঢং করে বারোটা এক বেজে উঠলো। ডিসেম্বরের একত্রিশ তারিখ এবং দুই হাজার তেরো সালটা পেরিয়ে নতুন বছর চলে এলো। আর তখনই নতুন জামাই বউয়ের দরজা জুড়ে এসে দাঁড়িয়ে বড় ভাই-ভাবী-ননদ-দেবর সবাই মিলে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার সনিয়া ভাবী’ বলে গান গেয়ে উঠলো। আর তখনি মনে পরে গেলো সনিয়ার। ওহ বিয়ের উত্তেজনায় নিজের জন্মদিনের তারিখটাই তো ভুলে বসে আছে। আর তার চেয়েও অবাক হয়ে গেলো যখন দেখলো আজকে কাজী অফিসে সাক্ষী হিসেবে যারা ছিলো তারাও বার্থডে পার্টির সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সনিয়া অবাক হয়ে গেলো- “একী? এরা কারা?” তনয় ওর তাকানো দেখেই বুঝিয়ে দিলো- “আরে, এরা আমাদের এই বাসাতেই ভাড়া থাকে। তোমাকে একটু চমকে দিলাম। হাহা হা!”
সনিয়া ভেবেছিলো বিয়ের আইডিয়াটা বুঝি শুধু ওরা দুজনই জানতো। কিন্তু, তনয় সব ব্যবস্থা করেই বাসা থেকে বেরিয়েছিলো। কিন্তু ভাব দেখিয়েছিলো দুই পরিবারের কেউই জানবে না। জানে না। এরকম একটা সারপ্রাইজের জন্য ও মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। তবু, ও এত বড় আনন্দ জীবনের আর কোন সময়েই পায়নি। খুশীতে ওর দুচোখ জলে ভরে গেলো। মাকে যে জানাতে হবে এই বাড়ির বউ হয়ে আসার এত আনন্দময় কাহিনীটা। পুরোটা। রাত পেরুনোর আগেই। নইলে বাসায় মা-বাবা কি শান্তিতে আজ একটু দু’চোখের পাতা এক করতে পারবে?
নতুন শাশুড়ি সনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “নিজের মাকে জানিয়েছো? এখনই জানিয়ে দাও। দেরী কোরো না!” সনিয়া আনন্দের আবেগে কান্না ভেজা কন্ঠে মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নেয়। ডায়াল করে মায়ের নাম্বারে। মায়ের ফোনে ওয়েলকাম টিউনে গান বাজতে থাকে, ‘আরে মনটা কানে কানে কয়, ভালোবাসা কেমন দেখতে চাই...’
১৭ অক্টোবর - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪